আত্মার আগলে পর্ব ৫
সানজিদা আক্তার মুন্নী
মেহনূরকে বাড়ি নিয়ে আসার পর অনেক চেষ্টা করেও তার জ্ঞান ফিরানো সম্ভব হয়নি এহসানের পক্ষে। তাই এহসান তাদের পারিবারিক মহিলা ডাক্তারকে ফোন করে নিয়ে আসে। ডাক্তার এসে মেহনূকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এহসানকে জানান,
— “মেহনূরের অতিরিক্ত ভয় এবং হেজিটেশনের কারণে বারবার জ্ঞান হারাচ্ছে। তবে চিন্তার কিছু নেই, কিছু মেডিসিন নিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।”
ডাক্তার চলে যাওয়ার পর এহসান মেহনূরের পাশে বসেই রইলো এহসান । তার চাহনি যেন আটকে গেছে মেহনূরের মুখের ওপর। এক মুহূর্তের জন্যও চোখ সরাতে পারছে না। মেহনূরের মুখের প্রশান্তি, তার চুলের এলোমেলো বুনন, এমনকি অচেতন অবস্থায়ও তার সৌন্দর্য এহসানের হৃদয়ে শঙ্খের সুর তুলছে। কিন্তু সেই সুরে এক ধরনের টানাপোড়েনও রয়েছে।
এহসান গভীরভাবে তাকিয়ে ভাবে, “আচ্ছা, যদি ওর কপালে একবার চুমু খাই, পাপ হবে কি?”
নিজের প্রশ্নের উত্তর যেন নিজেই খুঁজে পায়। মনে ভেসে ওঠে মেহনূরের কড়া কথাগুলো—”আপনার স্পর্শ আমার জন্য যে এক ভয়ংকর কলঙ্ক
আবার মনে পড়ে, মেহনূর তো তার হালাল নারী। তাহলে কি সত্যিই পাপ হবে? নিজেকে শান্ত করতে চেষ্টা করে। কিন্তু তার অন্তরে আরেকটি প্রশ্ন যেন বিদ্রোহ করে বসে—”আমি তো নিজেই পাপ, তাহলে শখের নারীকে ছুঁয়ে সেই পাপের ভার বাড়ালে ক্ষতি কী?”
এদিকে ছোট তালুকদার বাড়ির প্রত্যেকটি সদস্যের মন আজ দুদিন ধরে বিষাদে ভরে গেছে। ছোট তালুকদার মঞ্জিল মনে হচ্ছে প্রানহীন কেনো বা হবে না, বলুন তো, এই মহলের প্রাণ মেহনূর যে এই মহলে আর নেই! দাদু, দাদা, চাচা, চাচীরা, চাচাতো ভাইবোনরা, আর রইল বড় ভাই মেহরাজের কথা, সে তো কাঁদতে বাসিয়ে দিচ্ছে দুনিয়া “! আর বারবার ফোন দিচ্ছে আর একটাই কথা জানতে চাচ্ছে—তার কলিজার টুকরোকে বাড়ি ফিরানো হয়েছে কি না! আর ছোট ভাই মেহরুব, যে কিনা গুরুতর অসুস্থ, এহসানের লোকজন খুব বাজে ভাবে মেরেছে ওকে, কিন্তু এসবে পাত্তা দিচ্ছে না। সে যে কত বার যেতে চেয়েছিলো বড় তালুকদার বাড়ি, তার হিসেব নেই। কিন্তু বাড়ির মহিলারা তাকে বারবারই অনেক কষ্টে বুঝিয়েছেন! নিজ ঘরে বসে নিজের বোনের জন্য চিৎকার দিয়ে কাঁদছে, কারণ সে জানে, এহসান তার বোনকে তিলে তিলে শেষ করে দিবে। এই এহসান তালুকদার মানুষ নয়, এক ভয়ংকর শিকারী, যার নজর যেটায় পড়ে, সেটা ছিনিয়ে নেয়! যদি সে জানতো এহসানের লক্ষ্য তার বোন ছিলো, তাহলে সে মেহনূরকে এই গ্রামেই রাখতো না!
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আজ সবাই অতি আগ্রহ ও উচ্ছ্বাস নিয়ে সদর দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন, মনে করছেন হয়তো মেহনূরকে ফিরিয়ে এনেছেন, এহসানকে জায়গা ফিরিয়ে দিয়ে! কিন্তু তাদের আশা ভুল ধারণা, ভুল! যেভাবে গিয়েছিলেন, সেভাবেই আসলেন বাড়ির সব পুরুষরা!
এটা দেখে এনিফা বেগম, মানে মেহনূরের দাদু, তাড়াতাড়ি তার ছেলেদের সামনে গিয়ে দাঁড়ান আর প্রশ্ন করেন,
— আব্বা, আমার মেহনূর কই ওরে তো আনো নি?কই আমার সোনার টুকরো
মেহনূরের বাবা ডুকরে কেঁদে ওঠেন মায়ের এমন প্রশ্নে! নিজের বড় ছেলেকে এভাবে কাঁদতে দেখে এনিফা বেগমের হুশ উড়ে যায়! উনি কিছুই বুঝে উঠতে পারেন না, তাই চিৎকার করে নিজের ছেলে কে বলেন,
—কি হয়েছে আব্বা এমন ভাবে কাঁদছিস কেনো? আর আমার নাতনি কোথায়?
তখন তৌফিক সাহেব বলেন,
— আম্মা, ঐ কুত্তার বাচ্চা এহসান ওরে নিয়ে গেছে, আমাদের আম্মাজানকে নিয়ে গেছে!
এটা শুনে সবাই স্তব্ধ হয়ে যান। বাড়ির মহিলারা আঁচলে মুখ চেপে কাঁদতে শুরু করেন। মেহনূরের দাদু সোফায় মাথা নিচু করে বসে থাকা উনার স্বামী মুস্তফা সাহেবের কাছে যান আর গিয়ে কান্না করে বলেন,
— আপনার জমি পেয়েছেন তো, হলো তো, এখন আমার নাতনিকে খেয়ে”! মেরে ফেলবে ঐ অমানুষ এহসান ওকে”! আপনারা জানতেন না কী খারাপ ঐ কুকুরটা? তাহলে কেন রাজি হইলেন ঐ নিকৃষ্ট চুক্তিতে?
মুস্তফা সাহেব মাথা নিচু করে নেন, কীই বা বলবেন! তার জন্যই তার ফুলের মতো নাতনির জীবন এক বিষাদ কলঙ্কে ছেয়ে গেলো!
কিছুক্ষণ পর মেহনূরের জ্ঞান ফিরে। ধীরে ধীরে চোখ মেলে দেখে, এহসান তার পাশে বসে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
মেহনূর ধীরে উঠতে চেষ্টা করে, কিন্তু ব্যর্থ হয়। এহসান সাহায্য করার জন্য হাত বাড়ালে, মেহনূর তৎক্ষণাৎ চিৎকার করে বলে ওঠে,
— “বলেছি না, স্পর্শ করবেন না! দূরে থাকুন আমার থেকে! আমার আপনার প্রতি ঘেন্না হয়, ঘেন্না!”
এহসান মেহনূরের কথা শুনেও ধৈর্য ধরে তাকে বিছানায় হেলান দিয়ে বসায়। মেহনূর ভেতরে তোলপাড় অনুভব করছে। তার অন্তর যেন জ্বলছে। নিজেকে সামলানোর জন্য বড় বড় শ্বাস নিতে শুরু করে।
ঠিক তখন এহসান আজব এক প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় ওর দিকে,
— “ঐ ছেলে, কি যেন নাম? ও হ্যাঁ, রায়ান! সে কে?”
মেহনূর নির্ভর দৃষ্টিতে এহসানের দিকে তাকিয়ে ধীরে বলে,
— “আমার স্বামী।”
এই উত্তর শুনে এহসানের ধৈর্য আর ধরে না। কোনো কথা না ভেবে টাশ করে একটা চড় বসিয়ে দেয় মেহনূরের বাম গালে।
অসুস্থ অবস্থায় এত জোরে চড় মেহনূর সহ্য করতে পারে না। চোখের সামনে দুনিয়া উল্টে যেতে শুরু করে। মনে হয়, আজরাইল তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। মগজ যেন গলে কানের বাইরে বেরিয়ে আসবে।
এহসান তখন বজ্রকণ্ঠে চিৎকার করে বলে,
— “তোর স্বামী আমি! তোর সবকিছু আমি! আর কোনোদিন তোর মুখে কোনো হারাম পুরুষের নাম শুনলে জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলব! বেয়াদব নারী!”
মেহনূর নিস্তেজ হয়ে পড়ে। মাথা বালিশে এলিয়ে দেয়। এত ভয়ংকর চড় হজম করা তো সহজ ব্যাপার নয়!
এহসান মেহনূরকে আর কিছু বলে না কারণ সে ভালো করেই অনুভব করতে পারছে এই থাপ্পড় হজম করা মেহনূরের পক্ষে অতি সহজ নয়। তাই উঠতে উঠতে বলে,
— থাপ্পড়টা ভালো করে হজম করে নিয়ে যোহরের নামাজটা পড়ে নিস!
এহসান এমন আদেশ করে কক্ষ ত্যাগ করে! মেহনূর এখনও আগের মতোই শুয়ে আছে।
এহসান নিচে আসে। বর্তমানে কেউ বাড়িতে নেই পুরুষ মানুষ। তার আব্বা একটা বিচারসভায় গেছেন আর তার দুই ভাই, একজন ফ্যাক্টরির কাজ দেখতে গেছেন, অন্যজন অফিসে, টাউনে।
এহসান নিচে আসতেই হাসিব এসে বলে,
— ভাইজান, বাগানে আলতাফ হোসেন আইসা বসে আছেন আপনার লাইগা।
এহসান বলে,
— ও হ্যাঁ, এরে তো বলেছিলাম আসতে। আচ্ছা, তাহলে তুই চা-নাস্তা তৈরি করার জন্য বল, আমি যাচ্ছি।
— আচ্ছা।
এহসান যায় বাগানে। বাগানে কয়েকটা সাদা সেটের চেয়ারের টেবিল রাখা আছে মিটিং ও কথাবার্তা বলার জন্য। কারণ তালুকদার মঞ্জিলের নিয়মই বাইরে থেকে লোক আসবে, বাইরে বসে কথা বলে চলে যাবে। বাগানটা অনেক বড়। অনেক ফুলের গাছ, ফলের গাছ রয়েছে। আর তা থাকবে না কেন? এই বাগানের যত্ন নেওয়ার জন্য পাঁচ থেকে সাতজন লোক রাখা হয়েছে। এহসান যেতেই আলতাফ হোসেন বসা থেকে উঠে যান আর ওকে উদ্দেশ্য করে সালাম দেন,
— আসসালামু আলাইকুম সাহেব, কেমন আছেন?
এহসান তার চেয়ারের সামনে বসতে বসতে বলে,
— ওয়ালাইকুম আসসালাম। আলহামদুলিল্লাহ, ভালো। বসুন, বসুন (বসার জন্য হাত দিয়ে ইশারা করে)।
আলতাফ হোসেন মুচকি হেসে বসেন। আর ইতস্তত কণ্ঠে বলেন,
— আসলে আপনি যে প্রচারের কথা বলেছেন নির্বাচনে…
এহসান ভ্রু নাচিয়ে বলে,
— আমি শুদ্ধ বাংলায় স্পষ্ট ভাষা খুব পছন্দ করি। আশা করি আপনি তা সম্পর্কে অবগত।
এমন কথা শুনে আলতাফ হোসেন আরও ঘাবড়ে যান। কিন্তু নিজেকে যথাযথ শান্ত রেখে বলেন,
— একটু যদি ভেবে দেখতেন কারণ এখন তো আর দেশে আগের মতো নেই, স্বৈরাচারি সরকারও নেই।
এহসান মৃদু হেসে বলে,
— তো, কী হয়েছে? ঐ মহিলা গেছে সাথে কি দেশের রাজনীতিও নিয়ে গেছে? নেয়নি, নি তো। তাহলে আমি আর কোনো কথা শুনতে চাই না। নমিনেশন পেয়ে গেছি, তার মানে আমিই এ শহরে মেয়র। বুঝলেন তো?
আলতাফ হোসেন কাচুমাচু করতে করতে বলেন,
— সেটা বুঝেছি। কিন্তু সমস্যা এখানে নয়। সমস্যা তো রাতুল। সে তো আমাকে বারবার হুমকি দিচ্ছে প্রচার না করতে।
এহসান যথেষ্ট শান্ত সুরে বলে,
— কাল অথবা পরশুর মধ্যে ওকে আমি তুলার ব্যবস্থা করছি। আপনি আপনার কাজে মনোযোগ দিন।
আলতাফ হোসেন ভড়কে গিয়ে বলেন,
— কোথায় এনে তুলবেন?
এহসান রুক্ষভাবে জবাব দেয়,
— দুনিয়া থেকে।
আলতাফ হোসেন কাচুমাচু করে বলেন,
— কিন্তু উনার আশেপাশে তো অনেক লোকজন থাকে, সবসময়ই নিরাপত্তার মধ্যে!
এহসান তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে,
— কখনো দেখেছেন আপনি এই এহসান তালুকদারের শিকার মিস হতে?
— না।
— ইনশাআল্লাহ, তাহলে এটাও হবে না।
এ বলে হাসিবকে ডাক দেয়।
— হাসিব, এদিকে আয় তো।
হাসিব দৌড়ে এহসানের সামনে আসে আর বলে,
— জ্বি ভাইজান, বলেন।
এহসান চেয়ার থেকে উঠে যেতে যেতে বলে,
— কাল দক্ষিণের মাঠের ফসলের যে টাকা নিয়ে এসেছিস, তার থেকে উনাকে এক অথবা দুই দিয়ে দিস, চা-নাস্তা খাওয়ার জন্য।
তারপর আলতাফ হোসেনের দিকে তাকিয়ে বলে,
— চা-নাস্তা করে নিবেন সাহেব। আর কোনো ভুল যাতে না হয়। আসি, আসসালামু আলাইকুম।
এ বলে এহসান বাগান থেকে চলে যায়। আর হাসিব আলতাফ হোসেনকে ২ লক্ষ টাকা দিয়ে বিদায়ে দেয়।
এদিকে মেহনূর অনেকক্ষণ পর ধীরে ধীরে উঠে ওযু করে নামাজ পড়ে নেয়। এখনও সেই জায়নামাজেই বসে আছে আর নিজের অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়া ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবছে।
এহসান ঘরে এসে দেখে মেহনূর জায়নামাজে বসে আছে। এটা দেখে কিছুটা শান্তি পেলো মনে। মেহনূরের মুখ দেখার জন্য মেহনূরের সামনে যায়। কিন্তু তাও দেখতে পারছে না, মাথা নিচু করে বসে আছে। এই বেয়াদব নারী! এহসান জানে ওর উপস্থিতি টের পেয়েই এমনটা করছে, তাই খুব রাগ হচ্ছে এর জন্য। এহসান জানে এটা অহেতুক রাগ। কিন্তু তাও কেন রাগ হচ্ছে?
এহসান শান্ত সুরে ওকে ডাক দেয়,
— মেহনূর।
এমন আকস্মিকভাবে ডাক দেওয়ার কারণে মেহনূরও মুখ তুলে ওর পানে তাকায়।
ব্যাস, এই শেষ। এহসানের অন্তর মেহনূরের এই অবুঝ চাহনি এহসানের বক্ষস্থল অব্দি গিয়ে গেঁথে যায়। নামাজ পড়ার জন্য পরনের ওড়না গোল করে মাথায় পেঁচিয়েছে, যার কারণে মেহনূরের মায়াবী মুখখানা অতি সুন্দর লাগছে। এহসান নিজ মনে ভাবে, “এই নারীর কত রূপ দেখবো আল্লাহ! তুমিই ভালো জানো। এখন তো পুরো কবুতরের বাচ্চা লাগছে। ইসস, মনে হচ্ছে দুই গাল বরাবর কয়েকবারে হাজারটা চুম্বন করতে!”
মেহনূর মনে মনে ভাবছে, “এই কুত্তাকে দেখে কেন জানি আমার অন্তর অবধি বিষাদ হয়ে যায়!”
ফের চোখ নামিয়ে নেয় মেহনূর।
তখনই এহসান ওর অতি নিকট এসে হাঁটু গেড়ে বসে।
মেহনূর এটা দেখে স্তব্ধ হয়ে যায়। কারণ এহসান ওর নিকট আসা মানে, ওর আজরাইল ওর কাছে আসা। এতটা ভয়ংকরভাবে ভয় পায় এহসানকে মেহনূর।
এহসান ওর দুই গাল আলতো করে ধরে নিজের মুখের দিকে করে।
ভয়ে মেহনূরের ঠোঁট অবধি কাঁপছে।
এহসান হেসে বলে,
— জানিস, তোকে এই রূপে একদম কবুতরের বাচ্চার মতো লাগছে।
মেহনূর ভয়ে ভয়ে বলে,
— আ… আমায় ছাড়ুন, আমার কষ্ট হচ্ছে।
এহসান তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে,
— এতটা যত্ন নিয়ে স্পর্শ করি, তাও তোর….
এহসান হাত সরিয়ে নেয়। মেহনূর মৃদু স্বরে বলে,
— কলঙ্কের ছোঁয়া যতই যত্নের হোক, তা হয় বিষাক্ত।
এহসান দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে যায়। কিছু না বলে কাপড় রাখার ঘরে যায়। তাকে অফিসে যেতে হবে।
এটা দেখে মেহনূর অবাক হয়ে যায়, কারণ এই একটি কক্ষের ভেতর কতগুলো কক্ষ সম্ভব! প্রথমত, এই কক্ষটাই দুটি বড় বড় কক্ষে বিভক্ত। প্রথমে দরজা খুলে একটি কক্ষ, যেখানকার মাঝখানে রয়েছে রাজকীয় একখানা বড় সোফা, একটি রাজকীয় বইয়ের শেলফ, যেখানে হাজারো বই রয়েছে, আর দুটি রাজকীয় ধরনের ক্যাবিনেট। প্রথম কামরায়”!
তারপর একটি বড় দরজা, যেখানে মখমলের পর্দা ঝুলানো। সেই দরজা অতিক্রম করলেই আরও একটি বড় কক্ষ। সেখানে রাজা-বাদশাহদের মতো মখমলের কাপড়ের চাদর দিয়ে সাজানো রাজকীয় একটি বিশাল বিছানা। এখানেও রয়েছে রাজকীয় একখানা বড় সোফা।
এই কক্ষে একটি বড় বেলকনিও রয়েছে, তবে মেহনূর এখনও সেখানে যায়নি। এছাড়াও রয়েছে একটি বড় কালো টেবিল, যেখানে রাখা আছে অনেক কিছু—ল্যাপটপ, কম্পিউটার ইত্যাদি। আরও রয়েছে কক্ষের দেয়ালে অনেক ছোট ছোট তাকের মতো শেলফ, যেখানে বিভিন্ন সংবর্ধনার প্রতীক, অ্যান্টিক জিনিসপত্র সুন্দর করে সাজানো।
একটি মধ্যম আকারের রাজকীয় ওয়ার্ডরোব রাখা আছে, যার উপরে রাখা কোরআন শরীফের তিনটি খণ্ড ও একটি তসবি। ড্রয়ারে সম্ভবত জায়নামাজ রাখা, কারণ এখান থেকেই মেহনূর জায়নামাজ নিয়েছে। বিছানার দুই পাশে রয়েছে সুন্দর দুটি ছোট টেবিল।
এই কক্ষের ঝাড়বাতিগুলো অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন। আর বাকি রইল ওয়াশরুম “! এক ওয়াশরুম তিন ভাগে বিভক্ত “! এক দিকে গোসল এর জন্য থাই লাগানো বেশ বড়সড় কক্ষের মতো আর অন্য দিকে থাই দিয়ে আবৃত টয়লেট “! আর মাঝখানে বড় একখানা বেসিন ওযুর জন্য “! ওয়াশরুমের পাশে একটি দরজা দেখে প্রথমে মনে হয়েছিল সেটিও ওয়াশরুম, কিন্তু এখন বুঝতে পারছে সেটি কাপড় রাখার কক্ষ।
এই বাড়ির ভেতর এতটা সুন্দর, অথচ বাইরে থেকে পোড়ামাটির রঙ করে রাখা হয়েছে। দেখে মনে হয় কত বছরের পুরনো রাজবাড়ি। এটাও চিরসত্য—এটি রাজবাড়ি। তাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে কেউ একজন এই এলাকার রাজা ছিলেন। তার সবচেয়ে বড় মহলটি এরা পেয়েছে, আর ছোট মহলটি পেয়েছে মেহনূররা।
এহসান তৈরি হয়ে বেরিয়ে আসে। মেহনূর ঘরের সৌন্দর্যের মধ্যে ডুবে আছে তখনি হঠাৎ এহসানের কণ্ঠে ধ্যান ভাঙে মেহনূরের”!
— দেখে নে। এখন থেকে এই মহলের রাজার রানী তুই।
মেহনূর অবাক হয়ে এহসানের দিকে তাকায়। চোখে বিস্ময়।
সারাজীবনে যতবার এহসানকে দেখেছে, সবসময়ই পাঞ্জাবি-পায়জামায় দেখা। ধবধবে সাদা কিংবা কখনো হালকা রঙের পোশাকে। কিন্তু আজ! এহসান যেন অন্য এক রূপ ধারণ করেছে। কালো স্যুট-কোট, চকচকে কালো জুতো, বাঁ হাতের কব্জিতে ঘড়ি, আর চুলগুলো যেন আলাদা যত্ন নিয়ে গুছিয়ে রাখা।
মেহনূর কিছুক্ষণ স্তব্ধ। এমন করে আগে কখনো দেখেনি এহসানকে। স্বাভাবিক অবস্থায়ই তাকে সুদর্শন মনে হয়। কিন্তু আজকের এই নতুন রূপ যেন মেহনূরের মনের কল্পনার সব প্রতিচ্ছবি ছাড়িয়ে গেছে। তবুও, মেহনূরের মনে প্রশ্ন জাগে—যাকে সে এত অপছন্দ করে, তার কি সৌন্দর্য চোখে পড়ে? হয়তো নয়।
তাই মেহনূর তাচ্ছিল্যের সুরে বলে,
— কোনো পাপীর রানি আমি হতে চাই না।
এহসান মৃদু হেসে বলে,
— রাজা পাপ, রানী নিষ্পাপ। এর চেয়ে সুন্দর আর কিছু হতে পারে?
কিছু বলে না মেহনূর শুধু ঘৃণাভরে তাকিয়ে থাকে এহসানের পানে । এহসান তার ব্যাগ হাতে নিয়ে সালাম দিয়ে বেরিয়ে যায়।
এহসান বেরিয়ে এসে আপন মনে বলে – বুকটা কেঁপে ওঠে যখন তোমার চোখের ঘৃণা আমাকে বিদ্ধ করে।
এহসান চলে যাওয়ার খানিকক্ষণ পর এশা কক্ষে প্রবেশ করল। তার হাতে খাবারের একটি থালা। মেহনূর এখনও এক জায়গায় স্থির হয়ে বসে আছে। এশাকে দেখে এক পলক তাকায়, তারপর দ্রুত মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
এশা ধীর পায়ে এগিয়ে এসে মেহনূরের সামনে খাবারের থালাটি রাখে। মুখে এক ধরনের বিষণ্ণতা ঝুলে ছিল। নরম গলায় বলে,
–“খুব রাগ হচ্ছে, তাই না আমার ওপর?”
মেহনূর ধীর চোখে তার দিকে তাকায়, ছলছল কণ্ঠে বলে,
—“কি করব বল? তোর ভাইয়ের জন্য আমার জীবনটাই শেষ হয়ে গেল। এখন আমার কি করা উচিত? তুই বল।”
এশা এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
–“দেখ, মেহনূর। আমিও জানি, এই ব্যাপারটা খুব নোংরা। আমার নিজেরও ঘৃণা হয়। কিন্তু কি করব? আমার কিছুই করার নেই। কেউ আমার কথা শুনবে না। আর ভাইজান… সে তোকে কখনোই ছাড়বে না। আমার ভাইজান খুব বেশি বাজে একটা লোক
মেহনূরের চোখে কান্নার ঢেউ ভেসে ওঠে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে,
“–তোর ভাই একটা জানোয়ার। একটা পশু। সে আমার ভাইটাকে কুকুরের মতো মেরেছে “! কি দোষ ছিলো ওর”?
এ কথা বলে সে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। এশা দ্রুত তার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রুগুলো মুছে দিয়ে বলে,
–“আমি কি করব বল? কিছুই করার নেই আমার। যা হোক, এখন খেয়ে নে জান। ওষুধ তো খেতে হবে।”তুই খুব অসুস্থ
এশা এক লোকমা ভাত মেহনূরের মুখের সামনে ধরে। মেহনূর গলা চেপে এক লোকমা গিলে ফেলে”!
এহসান যখন তার কোম্পানিতে নিজের কক্ষে প্রবেশ করল, চোখে পড়ল টেবিলজুড়ে ফাইলের স্তূপ। গোটা অফিস যেন নীরব, কিন্তু কাজের চাপ তার মাথার ওপর পাহাড় হয়ে ভর করেছে। সব চিন্তা সরিয়ে সে নিজের চেয়ারে বসল। হাত বাড়িয়ে একটি ফাইল তুলে নিয়ে সই করতে শুরু করল।
কিন্তু কাজের মাঝেই তার মন যেন কোথাও অন্য কোথাও ছুটে গেল। রাতুলের মুখ বারবার মনে পড়তে লাগল। সেই প্রতিদ্বন্দ্বী, সেই শত্রু, যে এখন তার জীবনের বর্তমানে সবচেয়ে বড় বাধা। কিছুক্ষণ নিঃশব্দে বসে থাকে এহসান। তারপর গভীর চিন্তায় নিমগ্ন হয়ে টেবিলের উপর রাখা ফোনটি হাতে তুলে নেয়।এক মুহূর্ত দেরি না করে ফোন লাগায় একজন রাশিয়ান “কনটাক্ট কিলারের কাছে। উদ্দেশ্য একটাই—রাতুলকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য একজন কিংবদন্তি স্নাইপার হায়ার করা। কারণ রাতুল এখন সর্বদাই নিরাপত্তার চাদরে মোড়া, তাকে সামনে থেকে আঘাত করা অসম্ভব।
“ওকে দূর থেকে উড়াতে হবে,” এহসান নিজের মনে ফিসফিস করে।
রাশিয়ান কিলারের সঙ্গে আলাপের পর, সে ঠিক করে একজন দক্ষ স্প্যানিশ স্নাইপারকে হায়ার করবে। এমন একজন, যার এক শটেই সবকিছুর সমাপ্তি ঘটে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, এহসান তার কাজ সম্পন্ন করে। বুকের ভেতরটা হালকা লাগলেও চোখে এক অদ্ভুত অন্ধকার নেমে আসে।
“রাতুল… এবার তোর কাহিনী শেষ!” নিজ মনে এহসান কঠিন স্বরে বলে ওঠে।
মাগরিবের নামাজ পড়ে মেহনূর জায়নামাজে বসে ছিল। শান্ত পরিবেশে চোখ বন্ধ বসে আছে, কিন্তু হঠাৎ কক্ষে প্রবেশ করে এশা, আমেনা বেগম, এনিসা বেগম, এবং আয়শা বেগম। তাদের দেখে মেহনূর চোখ খুলে অতঃপর তাড়াতাড়ি জায়নামাজ ছেড়ে দ্রুত দাঁড়িয়ে যায়, চোখে বিস্ময়ের ছাপ স্পষ্ট ভরকে যাওয়ার কারণে,তাদের হাতে সাজানো তিনটি থাল ছিল,মনে হচ্ছে এ একটি অদৃশ্য পরিকল্পনার সূচনা। তারা একে একে থালাগুলো বিছানায় রাখেন “! মেহনূর কিছু বলতে যাবে তখনি এশা ওকে হাত টেনে বিছানায় বসিয়ে দেয়
মেহনূর শ্বাস আটকে, হতবাক হয়ে বলে, “কি করছো তোমরা, এসব কি?”
তখনই আয়শা বেগম ঠাণ্ডা কণ্ঠে বলেন,
—“মেহনূর, আজ তোমার আর এহসানের বিয়ের দুদিন হয়ে গেছে, অথচ তোমাদের সোহাগ রাতের কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি, তাই আজ সেই ব্যবস্থা করা হবে।”
মেহনূর তার কথা শুনে ভয়ানক ভাবে আঁতকে উঠে, এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে, বাজখাঁই কণ্ঠে বলে,
—“কি সব বলছো তোমরা! উনি আমার চাচা হন, চাচা আমার, উনার সাথে এমন কিছু কখনোই সম্ভব নয়!”পাগল হয়ে গেছো তোমরা আরে আমি কি মানুষ? তোমরা আমাকে একটু তো নিস্তার দাও “!
এনিসা বেগম ধীরে ধীরে মেহনূরের হাত ধরে টেনে বিছানায় বসিয়ে দেন, তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
—“দেখ, এটা এই বংশের নিয়ম। এহসান এখন তোর স্বামী, তাকে তার প্রাপ্য মর্যাদা ও অধিকার দিতে হবে।”
মেহনূর এমন উওর পেয়ে দাঁত চেপে বলে,
–“আমি তো তাকে স্বামী হিসেবে মানি না, তাহলে এসব বাজে রাতের কি দরকার?”
আয়শা বেগম শীতল সুরে বলেন,
–“তুমি মানো বা না মানো, এটা চিরসত্য—তুমি এখন এহসানের অধীনস্থ, আর তার খুশি হওয়া তোমার দায়িত্ব।”
আমেনা বেগম সান্ত্বনার সুরে বলেন, ”
—মেহনূর, তুমি বুঝতে পারছো না? তুমি যদি এমন না করো, হয়তো এহসান বড় কিছু করতে পারে।”
মেহনূর সারা শরীরে একটা শূন্যতা অনুভব করে। তার মুখ থেকে একটিও শব্দ বের হয় না, এক অসহায়তা ভর করে। এই মুহূর্তে মন চাচ্ছে এক দৌড়ে বাড়ি চলে যেতে গিয়ে নিজের আব্বার বুকে লুকিয়ে যেতে, কিন্তু সে জানে, এমন কিছুই সম্ভব নয়। তার চারপাশে যেন শুধু অন্ধকার, অমানবিকতা। তাদের আচরণে কোনো মানবিক অনুভূতি আছে কি? তারা কি মেহনূরের মন বোঝে? না বুঝে না তারা যদি বুঝতো তবে কি এমন করতো না করতো না?
এদিকে মেহনূরকে স্তব্ধ হয়ে যেতে দেখে, এশা হতাশ হয়ে ধীরে ধীরে একটা তালা থেকে মেহেদী বের করে এবং মেহনূরের হাত নিজের হাতে নিয়ে কামিজের হাত গুটিয়ে লাগিয়ে দেয়। এশার ভিতর টাও তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে কিন্তু কিছু করার নেই তার সে নিরুপায়’!
মেহনূর এশার দিকে তাকায়, চোখে এক ধরনের নিঃশব্দ কষ্ট। কিন্তু আফসোস নিজের কিছুই করার নেই, তার হাতে কিছু নেই—শুধু নিজের অস্তিত্বের প্রতি এক অদৃশ্য ঘৃণা জন্মাচ্ছে এখন “! কারণ এহসান বলেছিল মেহনূর তার এক পবিএ অস্তিত্ব”!
আমেনা বেগম মেহনূরের অন্য হাতে মেহেদী লাগিয়ে দেন। মেহনূর শূন্য চোখে তাদের কাজ দেখে, এই বাস্তবতার সঙ্গে সে এক অদ্ভুত সম্পর্ক তৈরি করতে পারছে না সে “!
এনিসা বেগম আর আয়েশা বেগম কক্ষ থেকে চলে যান। কারণ বাড়ির পুরুষ দের চা নাস্তা তৈরি করে দিতে হবে “! তখন এহসানও অফিস থেকে চলে এসেছে। সে যখন সিড়ি বেয়ে কক্ষে যেতে যাবে, তখন এনিসা বেগম বলেন,
“—আব্বা, এখন কক্ষে যেও না, অন্য কক্ষে যাও।”
এহসান সব কিছু বুঝে যায়, মায়ের কথা মতো অন্য কক্ষে গিয়ে গোসল করে পাঞ্জাবি পায়জামা পরে ।বাগানে বসে জমিজমার হিসাব করতে থাকে বাপ-ভাইদের সাথে”!
এশার আযান শোনা যায়। মেহনূরকে এশা ও আমেনা ধীর কন্ঠে বলেন
“–যাও, নামাজ পড়ে নাও হাত ধুয়ে “!
মেহনূর কাঠের পুতুলের মতো, নির্বিকারভাবে তাদের নির্দেশ অনুসরণ করে ওযু করে এসে নামাজে দাঁড়িয়ে যায়।
এশা তখন কিছু গোলাপ নিয়ে এসে পুরো কক্ষ সাজিয়ে নেয়। কয়েকটি মোমবাতি জ্বালিয়ে দেয়। ঘরটি এখন ফুলের ঘ্রাণে ভরপুর, মৌ মৌ করছে। অন্যদিকে, মেহনূর নামাজ শেষে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে এশা ও আমেনার দিকে। তার মনে প্রশ্ন আসে, “তারা তো মেয়েই, তাহলে কীভাবে অন্য একটি মেয়ের ভিতরে অনুভূতি অনুভব করতে পারছে না?” আর তাদের কী করার? এই তালুকদার মঞ্জিলে তো, পুরুষদের উপরে ওঠা সম্ভব নয়,তাই তারাও ওর মতোই নিরুপায়!
মেহনূর নিজের হাতের দিকে তাকায়। দুই হাতের মেহেদী দেখে তার মনটা বিষাদ হয়ে উঠে । গাঢ় রঙের মেহেদীতে রাঙানো হাতগুলো দেখে মেহনূর ভাবতে থাকে, “আজ যদি এমনটা না হতো… তাহলে খুশির সাথে আমিও মেহেদী পড়তাম কাল তো আমার আকদ ছিল রায়ানের সঙ্গে। কত স্বপ্ন ছিল, অথচ কিছুই হলো না। উল্টো আজ এমন একজনের জন্য মেহেদী পড়তে হচ্ছে, যে আমার জীবনের সবচেয়ে ঘৃণিত পুরুষ!”যে শুধু কলঙ্কের ছোয়া “!
মেহনূরের চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। তার নিজের অস্তিত্বের প্রতি এক ধরনের ঘৃণা সৃষ্টি হচ্ছে “!
মেহনূরের নামাজ শেষ দেখে এশা একটা প্লেটে খাবার নিয়ে আসে। তারপর মেহনূরের সামনে বসে দুপুরের মতো তার সামনে দুই লোকমা খাবার ধরো। মেহনূর ছলছল চোখে একবার এশার দিকে তাকায়,তারপর নিশ্বব্দে গুনেগুনে মাত্র চার লোকমা ভাত খায়। তারপর আর মুখে নেয় না। এশা তাকে জোর করে কিছু খেতে বলে না, কারণ সে জানে, মেহনূরের ভিতরে কি চলছে।
খাবার খাইয়ে মেহনূরকে সাজিয়ে দেওয়ার জন্য সবাই প্রস্তুত হন”! ঘরের পরিবেশটা যেন এক অদ্ভুত শান্তিতে ভরে উঠেছিল। এশা ও আমেনা মিলেই তন্ন তন্ন করে প্রস্তুতি নিচ্ছিল। অতঃপর সেই থালা থেকে একটা খয়েরী কালারের নেটের শাড়ি বের করে তাকে পরানো হয়। শাড়িটি গায়ের ওপর কোমলভাবে বসে,যায়, যেন তার শরীরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে আরো ফুটিয়ে তোলে। তারপর মেহনূরের ঘন চুলগুলো ছেড়ে দেওয়া হয়, সেগুলোকে সুন্দর করে আচরানো হয়, যেন আকাশের নীলাভ দুলাল বাতাসের মতো গড়িয়ে গড়িয়ে আসে। মেহনূরকে যত্ন করে সাজানো হচ্ছিল, উদ্দেশ্য তাকে পরিপূর্ণ রূপে তুলে ধরা”!, হালকা লিপস্টিক তার গোলাপি অধরে লাগানো হয় “সুন্দর করে কাজল দিয়ে দেওয়া হয় তার মায়াবী চোখে,
সাজানো শেষে মেহনূরকে আয়নার সামনে দাঁড় করানো হয়। আজ প্রথমবার জীবনে সাজল মেহনূর । অনেক অবাক হয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকে। সারা জীবনে কখনো সে সাজেনি। সাজগোছ তার পছন্দ না। সে ভাবত, সাজতে হবে নিজের স্বামীর জন্য, তার হালাল পুরুষের জন্য। কিন্তু আজ তাকে এক পাপের জন্য সাজতে হচ্ছে। তার ভেতর থেকে এক ভয়ানক অশান্তি অনুভব হয়। নিজের নারীত্বের প্রতি এক অজানা ঘৃণা সৃষ্টি হচ্ছে আজ। তার দৃষ্টি আয়নায় তার নিজের শরীরের ওপর স্থির । “এটা কি আমি?” মেহনূর নিজেকে চিনতেই পারে না। আজ যে নারীত্ব, তাকে গর্বিত করা উচিত ছিল, আজ তা পরিণত হয়েছে এক অন্ধকার অধ্যায়ে।
শাড়িটি এমনভাবে পড়ানো হয়েছিল, পেটের কিছু অংশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। মেহনূর ভয়ে ভয়ে নিজের শরীরের দিকে তাকায়, বুকের ভেতর এক তীব্র সংকোচ সৃষ্টি হয়। ভয়, ভয় আর ভয়—এ যেন এক অভিশাপের মতো তাকে গ্রাস করছে। তার দম বন্ধ হয়ে আসছে এটা ভেবে ভেবে যে, কিছু সময় পর এহসান তাকে স্পর্শ “!তাকে ভোগ করবে। নিজের সর্বাঙ্গে ঐ অপবিত্র হাতের স্পর্শ পাবে “! নিজের অস্তিত্ব ঐ পাপিষ্ঠ পুরুষের সাথে বিলীন হয়ে যাবে “! চোখে পানি জমে আসে, কিন্তু এই মুহুর্তে যে কাঁদাও নিষেধ “!
তখনি, মেহনূরের কানে আমেনা বেগমের কথাটি আসতে থাকে—”মেহনূর, খেয়াল রেখো, এহসান যাতে তোমার উপর সন্তুষ্ট থাকে। তোমার স্বামীকে খুশি করার দায়িত্ব তোমার।”
আত্মার আগলে পর্ব ৪
এই কথা যেন মেহনূরের ভেতর আরও একটি নতুন যন্ত্রণা সৃষ্টি করে। কেন তাকে এমন করতে বলা হচ্ছে? তার আত্মসম্মান, তার স্বাভাবিক সত্ত্বা—সর্বসেটাই কেনো এহসানের সন্তুষ্টির জন্য চলে যাচ্ছে?৷
একে একে সবাই কক্ষ ত্যাগ করেন। মেহনূর এক দীর্ঘ শ্বাস নেয়। বুকের ভেতরে ভীষণ উত্তেজনা, বিষন্নতা আর ভয় একসঙ্গে ঘূর্ণায়মান হয়ে ওঠে। ধীর পায়ে বেলকনির দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে “!আজ যে সবশেষ হয়ে যাবে ঐ পাপের হাতে