আপনাতেই আমি পর্ব ৮০
ইশিকা ইসলাম ইশা
ঘুমন্ত মেয়েকে নিয়েই আদিল খাঁনের সাথে কথা শেষ করল তীব্র। বুদ্ধিমান আদিল খাঁনের তীব্রর কথার ধরন বুঝতে সময় লাগে নি।বৌ বাচ্চার ক্ষেত্রে যতটা নরম বাইরের মানুষের কাছে ততটাই শক্ত পারসোনালিটির একজন মানুষ।কথার ধাচ এ তাই বুঝেছে আদিল খাঁন।তবে তার স্বস্তি এই জায়গায় তার নাতনি ভালো আছে।সুখে আছে!উহু ভীষণ সুখে আছে!
মিসেস আরফিন বাংলাদেশে ফিরছে তবে!!
তীব্রর কথায় আদিল খাঁন হেসে বলল,
হ্যাঁ ফিরছে!!সবটা তোমার জন্য!আজ মা মেয়ে মিলন সবটাই তোমার জন্য!
তীব্র মেয়ের চুলগুলো আলতো হাতে গুছিয়ে নিতে নিতে একটু হেসে বলল,
আমি ভীষণ স্বার্থপর একজন মানুষ!কারো ভাবনা, ফিলিং এসবে আমার বিন্দুমাত্র ইন্টাররেস্ট নেই। আমার ভালো থাকার জন্য আমার বৌ লাগবে।তাই শুধু তার ভাবনা থেকে আমি চাইছি মা -মেয়ের মিলন হোক!
আদিল খান বিস্তর হেসে বলল,
কিছু মনে না করলে আজকের রাতটুকু আমি রিদিতাকে আমার সাথে নিতে চায় খাঁন বাড়ি!কাল তো দিয়া আসবে….
তীব্রর উওর সাথে সাথে,
বৌ আমার রাতেই চায়।
আদিল খাঁন কতখন আহাম্মক এর মতো চেয়ে রইল।এমন উওর হয়তো আশা করেনি।তবে একটু পরেই হো হো করে হেসে উঠল। আদিল খাঁন কে হাসতে দেখে দূরে বসা রিদি,নীর ভু কুঁচকে তাকাল। রিদু হতবাক হয়ে এগিয়ে এলো।বেশ অনেকক্ষণ নানুর সাথে কথা হয়েছে তার।তাই জরতা সরিয়ে সরল কন্ঠে বলল,
কি হয়েছে নানু??
জানিস নানুভাই!আমি আমার নাতনিকে চেয়েছিলাম আজ রাতটা তুই থাকবি আমার সাথে। কিন্তু উওর আসল এমন,
বৌ আমার রাতেই চায়।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রিদি হচকচিয়ে তাকাল তীব্রর দিকে। তীব্র ভাবলেস হীন সে ব্যস্ত মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে। কিন্তু রিদি লজ্জায় নুইয়ে গেল। আদিল খাঁন রিদির লজ্জা পাওয়া মুখ দেখে বিস্তর হেসে বলল।
তোকে খুশি দেখে আমার সমস্ত কষ্ট দূর হয়ে গেছে!এতো বছর মনের মধ্যে পুষে রাখা সত্য আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়েছে।তোর মা হয়তো আমাকে মাফ করবে না। কিন্তু তুই তোর এই বুড়ো নানুকে মাফ করে দিস নানুভাই।আমি তোর কাছে অপরাধী তোর মায়ের কাছেও অপরাধী।
যদি তোর নামে এতো কিছু না থাকত হয়তো ওই নরপিশাচ তোকে বাঁচিয়ে রাখত না।আমি অনেক চেষ্টা করেছি তোকে আমার কাছে নেওয়ার মায়ের বুকে ফিরিয়ে দেওয়ার কিন্তু আমি পারি নি।
আমি তোর মাকে নতুন জীবন তো দিয়েছি কিন্তু সেই জীবনে তোকে দিতে পারিনি।
রিদি আদিল খাঁনের দিকে তাকিয়ে বলল,
আমার ভাগ্য হয়তো ঐটুকু কষ্ট লেখা ছিল নানু।মা কি তা আমি বুঝিনি ঠিক। মায়ের আদর,ভালবাসা হীন বড় হয়েছি এটাও ঠিক। কিন্তু আমি একটা ভাই পেয়েছি নানু। রায়ান ভাইয়া আমাকে ছোট থেকে আগলে রেখেছে।আর বিয়ের পর আমার জীবনে সবচেয়ে বড় পাওয়া তীব্র।আমি তো রাজ্য হীন এক অচেনা,অজানা রাজার সাথে জরিয়ে গেছিলাম। কিন্তু আমি ছিলাম সেই রাজার ছোট্ট রাজ্যর রানী।না পাওয়া অনেক কিছুর মাঝে সে ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া,এক ফালি রোদ্দুর।সেই আমাকে অন্ধকার থেকে নিজের সাথে আলোতে টেনে আনল।মুক্ত করে দিল বন্দি খাঁচা থেকে।সুযোগ দিল ডানা ঝাপটানোর।উড়তে দিল মুক্ত পাখির মতো।
আমার সকল বিপদ আমার ধারনাতেও আনতে না দিয়ে সামলে নিল।আমাকে পরিপূর্ণ করল।আমার
জীবনে ছোট্ট পরি এনে দিল।
এতোটা ভালবাসা পাওয়ার যোগ্যতা আমার কখনো ছিল না নানুভাই।আজও হয়তো নেই।ওনাকে পাওয়া চরম সৌভাগ্য আমার।এই যে এতো কিছু একসঙ্গে জেনে মেনে নিচ্ছি মানিয়ে নিচ্ছি তার পেছনে কারনটা তীব্র।আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী একজন মানুষ নানু।তুমি শুধু দোয়া করো আমার জন্য। এতো অর্থসম্পদ আমার চায় না নানু।আমি সবকিছুর উর্ধ্বে শুধু তাকেই চায়।
আদিল খান অবাক হয়ে চেয়ে রইলো রিদির দিকে।
কি সুন্দর মনের কথা গুছিয়ে বলতে পারে রিদি। ডক্টর রিদিতা!একদম মায়ের মতো শান্ত তার কথা। আদিল রিদির মাথায় হাত রাখল।তার মনে হলো রিদির মাঝে সুখে আছে ভীষণ সুখে!রিদি আদিলের দিকে চেয়ে বিস্তর হাসল।আদিল বেশ কিছুক্ষণ দেখল সেই আমায়িক মিষ্টি হাসিটা।
তীব্র সবটা শুনে ওর ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠল তৃপ্তির হাসি।তবে সেটা কারো নজরে আসল না।সে রিদির জীবন সুন্দর করেছে!!! উহু করেনি!!বরং রিদিকে সে নিয়ে এসেছে নিজের স্বার্থে।নিজেকে ভালো রাখতে তার শ্যামকন্যা চাই।তাকে বুকে নিলে যে শান্তি পায় সেটা তার চাই।ওর স্পর্শে যে জ্বলন্ত হৃদয় শান্ত হয় সেটা তার চাই!!তাইতো সে স্বার্থপর। নিজেকে ভালো রাখতে তার এতো আয়োজন।নয়তো তীব্র চৌধুরীর এতো সময় কোথায়??
সে তো বেশি কথা শুনতে পারে। অতিরিক্ত দুইটা কথা বললেই তো তার মাথায় দপদপিয়ে আগুন জ্বলত।অথচ দেখো এখন সে শতাধিক কথা বলে।এখন তো মাত্রা আরো বেড়েছে। অকারণে মেয়ের সাথে হাজরটা কথার ঝুড়ি নিয়ে বসে।
খাঁন বাড়িতে পরপর দুটো গাড়ি প্রবেশ করতেই সেখান থেকে বেরিয়ে আসে শ্যামবতী একজন মহিলা।পড়নে বাঙালি পোশাক। চোখ মুখে চিন্তার ছাপ।গাড়ি থেকে নেমে এদিক ওদিক না দেখে সোজা বাসায় ঢুকে দিয়া।বসার রুমে বাবাকে দেখেই ছুটে এসে বলে,
কি হয়েছে আব্বু?আরভি বলল তুমি অসুস্থ হয়ে পড়েছ।তোমাকে কতোদিন মানা করেছি।দেশে না আসতে।কি হয় এসে!কি আছে এখানে?কেন আমার বারন শুনো না।
এই আভু ডক্টর কি বলেছে?তোর নানুর কি হয়ছে?
আরভি কিছু না বলে চুপচাপ বসে আছে।সে বলবেই বা কি!কাল থেকে সব শুনে সে নিজেই এখনো ঘোরে আছে।নানু এতো বড় সিক্রেট লুকিয়েছে।এটা তার ধারনার বাইরে।তার মানে মা যে তার নিজের তারার কথা বলত মাঝে মাঝে তার মানে মা রিদির কথা বলত। মা এতো বড় সত্য কিভাবে নিবে?
কি রে চুপ হয়ে আছিস কেন?বল!কি হয়েছে?
আদিল খাঁন মেয়ের উদ্দেশ্য করে করে,
আমার কিছু হয়নি দিয়া।আমি ঠিক আছি।তোকে বাংলাদেশে আনতে শুধু একটু মিথ্যা বলেছি।আমি তোকে আজ একটা সত্য বলতে চাই।যা তোর আজানা।আমি জানি না এরপর তুই আমাকে মাফ করবি কি না কিন্তু এখনি সময় কথাটা বলার।
এসব কি বলছ বাবা?
ঠিক বলছি! সেদিন তোর এক্সিডেন্ট এর পর আমি তোকে রাতারাতি আমেরিকা নিয়ে আসি।তোর বেঁচে থাকার কথাটা সবাইকে মৃত বলে ঘোষণা করি।সেই এক্সিডেন্ট এ তুই মারা গেছিস এটা সবাই জানে।
দিয়া শান্ত স্বরে বলে,
এসব এখন কেন বলছ!এসব তো আমি জানি।আর এটাও জানি আমাকে মারার জন্যই সেদিন ইচ্ছে করে এক্সিডেন্ট করানো হয়েছে।সেটা রুপেশ করেছে। আমি জানি….
আদিল খান দিয়া থামিয়ে দিয়ে বলে,
না সেদিন এক্সিডেন্ট রুপেশ না আমেনা করিয়েছিল।
দিয়া শুনলেও চমকালো না।আমেনা তাকে পছন্দ করত না।তাই বলে মেরে ফেলতে চাইবে এটা আশা করেনি।
সে যাই হোক।ওসব আমি ভুলে গেছি।তুমি কেন অতীত তুলছ।সেই বিষাক্ত অতীত আমি মনে করতে চাইছি না।আর না আমি এখানে থাকতে চাইছি।আজ ই ফিরে যাব আমরা।
নিজের অস্তিত্ব ফেলে যাবি!!
দিয়া তাৎক্ষণিক বলে,
আমার এখানে কোন কিছু নেই বাবা।আছে শুধু তীক্ত অতীত।আর হারানোর যন্ত্রণা।এই দেশে আমি শুধু হারিয়েছি বাবা। ভালবাসা, স্বামী,সংসার,আমার স ন্তা ন! যার জন্য সব ছাড়তে আমি প্রস্তুত ছিলাম তবে এখন আর কিছু হারাতে চায় না।আমরা আজকে ফিরে যাব ব্যাস।
যদি হারানো কিছু ফিরে পাস!
চিরতরে যা হারিয়ে ফেলেছি তা কিভাবে ফিরে পাব।এমন কিছু নেই যা ফিরে পেতে চাইবো।
যদি তোর সন্তান হয়!!
এবার চমকে উঠল দিয়া।বাবা তাকে আমেরিকা নেওয়ার মাস খানেক পর যখন তার ঙ্গান ফিরল।সে শুধু বারবার একটা জিনিস চেয়েছে তার সন্তান।বার বার বলেছে ওরা আমার বাচ্চা কে মেরে ফেলবে আমাকে যেতে দাও। কিন্তু সেদিন বাবা তাকে বলে আমেনা পড়ে গেছিল যার কারনে বাচ্চা গর্ভে মারা গেছে তার এক্সিডেন্ট এর দুদিন পরেই।বাচ্চাটাকে আমেনা কখনো চাইত না তাই এমন ঘটনা ঘটাতে পারে বলে অবিশ্বাস করে নি দিয়া।
এরপর তো আরো বেশি অসুস্থ হয়ে যায় দিয়া। সুস্থ হতে তার পুরো ২টা বছর লাগে।তাও সেটা সম্ভব হয়েছে ৪বছরের আরভির জন্য। আরফিন আর রুমির ছেলে আরভি।আরভি জন্মানোর দুদিন পরেই মারা যায় রুমি। আরফিন থাকত আদিল খাঁনের সাথের এপাটমেন্টে।সেই সূত্রে পরিচয়। ঘরবন্দি করে রাখা দিয়া সেদিন আরভির কান্নায় রুম থেকে বের হয়ে দেখেছিল সুন্দর একটা বাচ্চা কাঁদছে।আর তার হাত চুইয়ে রক্ত পড়ছে।দিয়া সেদিন ছুটে বুকে জরিয়ে নিয়েছিল ৪ বছরের ছোট্ট আরভি কে।হাতে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছিল। খাবার খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিল।এরপর থেকে আরভি দিয়ার কাছেই থাকতে শুরু করল।একটা সন্তানহীন মা আরভির মধ্যে নিজের সন্তান পেল।আর আরভি পেল মমতাময়ী একজন মা। এরপর ধীরে ধীরে দিয়া গুমোট পৃথিবী থেকে বেরিয়ে এলো।তবে সন্তান হারানোর শোক তার আজীবন বয়ে বেড়াতে হচ্ছে।তাহলে বাবা কোন সন্তানের কথা বলছে।
আপনাতেই আমি পর্ব ৭৯
আদিল খান দিয়ার মনোভাব বুঝতে পেরে বলল,
যে সন্তান হারানোর শোক এত বছর বয়ে বেরাচ্ছিস সেই! তোর সন্তান!তোর মেয়ে!রিদিতা বেঁচে আছে।
দিয়া বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে আদিল খাঁনের দিকে।তার বিষ্ময় কাটাতে বেশ সময় লাগল।সে কি ভুল শুনল!নাকি! কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব!তবে কি বাবা মিথ্যা বলেছে!! কিন্তু কেন?
দিয়া নির্বাক হয়ে আছে।হয়তো সত্যি টা হজম হচ্ছে না। মাথার ভেতর হঠাৎ ই ঘুরে উঠল।ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে এলো সব।শুধু কানে এসে বাজল
আম্মু………কথাটা।