আপনাতেই আমি সিজন ২ পর্ব ৫৪
ইশিকা ইসলাম ইশা
রাত তখন গভীর।রিদির বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে তীব্র।শান্ত সিগ্ধ কোমল মুখশ্রীতে একরাশ মায়া। ঘুমিয়ে থাকলে এই সুদর্শন পুরুষকে আরো বেশি সুন্দর লাগে।সাদা দাগ বিহীন ত্বকের দিকে রিদি বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে।আদুরে হাত বুলাল মাথায়।সিল্কি চুল গুলোই হাত বুলিয়ে ভাবতে লাগলো তখনকার কথা।রিদির প্রশ্নে তীরের রিয়্যাক্ট ছিল এমন যেন সে খুব সাধারণ বিষয়ে প্রশ্ন করেছে। তীর মুচকি হেসে বলল,
ভালবাসা!!তাও তীব্র!!কখনো না।ছোট থেকে একসাথে আছি!
রিদি আমতা আমতা করে বলল,
তাহলে হয়তো কাউকে পছন্দ??
তীর ফিক করে হেসে বলল,
যে ছেলে মেয়েদের দুচোখ সহ্য করতে পারে না তার আবার পছন্দ!ছোট বেলা থেকেই একসাথে বড় হয়েছি ভাবি ওর হাড়ে গোড়ে সব চেনা আছে আমার। কি আর বলব!বলেই পাশের ঝুড়ি থেকে একটা আপেল উঠিয়ে তাতে একটা কামড় বসিয়ে মুখটা মলিন করে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তখন সবেই আমরা ইন্টার এ উঠেছি। তীব্র তখন শান্ত আর গম্ভীর।পড়া ব্যাতিত দুনিয়াতে কারো সাথে কোন সম্পর্ক নেই তার।কলেজে গেলে ক্লাস শেষ করে সোজা গিয়ে বসবে লাইব্রেরীতে।এটাই তার ডেইলি রুটিং!!
একদিন আমরা সবাই বসে আছি গাছের নিচে।মিরের গানে তখন মগ্ন সবাই।হুট করে সবাই ছোটাছুটি দেখে আমরা এসে পৌঁছালাম লাইব্রেরীতে। ভেতরে ঢুকেই আমরা থ! রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে ঐ কলেজের অনার্স পড়ুয়া ক্ষমতাশালী এক বড় ভাই। বেচারা কে এমন মার দিছিল ভাবি আহা যদি দেখাতে পারতাম।পুরাই মাখন!!
রিদি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিরবির করে বলল,
দেখেনি কি!!হাহ! মার আবার মাখন!!
আমি,মির সহ সবাই অবাক। তীব্র কারন ছাড়া কাউকে মারে না।আমরা তীব্রর দিকে এগিয়ে আসতেই নজরে এলো একটা মেয়ের কান্নার শব্দ।মেয়েটা বুক শেলফ এর পেছনে।থরথর করে কাঁপছে।আমি অবাক হয়ে সেদিকে এগুতেই তীব্র আমার হাত চেপে ধরে কড়া গলায় বলল,
রাই মেয়েটার হেল্প কর!
রাইমা অবাক হলেও তীব্রর কথায় ছুটে গেল সেদিকে। তীব্র আমার হাত ছেড়ে নিজের হাতের রক্ত পরিস্কার করে বের হলো ওয়াসরুম থেকে।আমি তখনো কিছু বুঝিনি। এখানে কি হলো?শুধু ফ্যালফ্যাল করে দেখছি। তীব্র ওয়াসরুম থেকে বের হয়ে শান্ত কন্ঠে সবার উদ্দেশ্যে বলল,
কি ব্যাপার ভিডিও হয়নি এখনো??
সাথে সাথে সবাই ফোন বের করে দিদার নামক বড়ভাই এর ভিডিও শুরু করেছে। বেচারা বড় ভাই আহা লাগে উড়াধুড়া গানের মতোই উড়াধুড়া মার খেয়ে ঢলে আছে ।
তীব্র আবারো শান্ত কন্ঠে বলল,
আমি ক্যাপশন লিখে দিচ্ছি এই ক্যাপশন ব্যাতিত অন্য কোনো একস্টা ওয়ার্ড যদি অড হয় তবে সবার অবস্থা এমন হবে। তীব্রর হুমকিতে সবাই বেশ ভয় পায়। তীব্র খচখচ করে কাগজে কিছু একটা লিখে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,এটা পড়ে শোনা!আমি পড়লাম দুই লাইনে লিখিত একটা হুমকি!!
“মেয়েদের অসম্মতিতে তাঁদের গায়ে টাচ করার শাস্তি।
ভুলে যাবেন না আপনাদের ঘরেও মা বোন আছে।”
প্রথম লাইনটা ছিল মাফিয়া লাইন দ্বিতীয় লাইনটা ছিল নেতা লাইন।রিদি ফ্যালফ্যাল করে তাকালো তীরের দিকে।তীর রিদির তাকানো দেখে ফিক করে হেসে উঠলো।হাসি থামিয়ে বললো,
আসলে ভাবি হুমকি+সহানুভূতি ঐ আরকি!!ভাবি কেস টা কি বুঝেছেন !
রিদি মাথা নাড়ল যার অর্থ বুঝতে পেরেছে।
তীর এরপর বলতে শুরু করল,
তো মেয়েটার নাম ছিল মোনালিসা। দেখতে বেশ সুন্দরী ছিল।তাই দিদারের মতো নরপশু সুযোগ চেয়েছে।মেয়েটি ছিল মধ্যবিত্ত পরিবারের বড় মেয়ে।ভালো আর ভদ্র। সেদিন ঠিক সময়ে তীব্র গিয়ে না পৌঁছালে খারাপ কিছু হতে পারত মেয়েটার সাথে।সেই থেকে মোনালিসা তীব্র কে পছন্দ করত, ভালোবাসত।
যেদিন ছিল আমাদের এইচএসসি বিদায় অনুষ্ঠান।গোটা২ টা বছর সবাই একসাথে থাকার পর এবার বিদায় পালা। এখানে থেকে সবার চয়েস অনুযায়ী কাজ করতে, ক্যারিয়ার গড়তে এগুবে।সেদিনই সকল লজ্জা ভুলে সবার সামনে তীব্র কে প্রপোজ করে মোনা কিন্তু জানেন সেদিন তীব্রর উওর ছিল এমন।সেদিন তীব্র বলেছিল,
“আম অলরেডি হাফ ম্যারেড। বৌ আমার সবেই দুনিয়াতে ডাউনলোড হয়েছে।বৌ এখনো ছোট।তাই তোমার প্রোপোজাল গ্রহন করতে পারব না।তবে বৌ বড় হয়ে যদি দ্বিতীয় বিয়ের পারমিশন দেয় তো অবশ্যই আমি তোমার কথা মাথায় রাখব”
আমরা হতবাক হয়ে গেলাম কারন তীব্র মিথ্যা বলার মানুষ নয় আর না মজা করার।এই বয়সে বলে কি না সে ম্যারেড তাও হাফ। যেখানে বিয়ের বয়সও হয়নি আমাদের।মোনা সেদিন অবাক হয়ে বলছিল,
মজা করছ তীব্র!!আমি জানি তুমি আমাকে ভালোবাসো না।হয়তো বাসবেও না।তোমার লাইফে অনেক অপশন আছে।আমি সব জেনেশুনে তোমাকে আমার মনের কথা জানিয়েছি।ভালবাসবে না জেনেও ভালোবেসেছি।না করার জন্য এমন বাহানার প্রয়োজন নেই।
তীব্র গম্ভীর মুখে শান্ত গলায় বলল,
“প্রথমত আমি মজা করছি না। দ্বিতীয়ত আমার লাইফে অপশন থাকলেও সে আমার একমাত্র চয়েস।আর তৃতীয়ত না করার জন্য তীব্র চৌধুরীর কোন বাহানার প্রয়োজন হয় না”
আই হোপ তুমি বুঝতে পেরেছো!এনি ওয়ে গুড লাক ফর ইউর ফিউচার।
এরপর থেকে মোনার দেখা আমরা আর পায়নি।জীবনে ব্যস্ততা বাড়ল সবাই সবার জীবন নিয়ে এগিয়ে গেল।যার যার চয়েস অনুযায়ী সে সেখানে ভর্তি হলো। এদিকে তিব্র দা গ্রেরেস্ট শাহী খান পীর আলিমুল্লার নাতি মেডিকেল কাঁপিয়ে পর্দাপন করল ভার্সিটি।না না স্টুডেন্ট হিসাবে না। রাজনীতি করতে।ধীরে ধীরে পাওয়ার বাড়ল সাথে বাড়ল আরো পাওয়ার আশা।সময়ের সাথে তীব্রর ক্ষমতা বৃদ্ধি পেল।এই ভাবেই চলতে থাকল দিন মাস বছর।কতো কতো মেয়ে যে ঐ “নীলমনিহারি চোখওয়ালা ধলার নাতিরে” প্রপোজ করছে ভাবি আল্লাহ মালুম।
রিদি দীর্ঘশ্বাস ফেলল।প্রেম ঘটিত ব্যাপারে যে তীব্রর খাতা শূণ্যের কোঠায় তা সে জানত তবুও মনে শঙ্কা ছিল।তবে জেনে ভালো লাগলো সে ব্যাতিত তার প্রিয় পুরুষের জীবনে কেউ ছিল না।তবে ছোট বৌ আবার কে??যাই হোক এই খুশিতে বর কে টপাটপ দুটো চুমু দিয়ে আসলে মন্দ হয় না।কি কপাল রে তোর রিদু আসলেও মেলায় ভালো জামাই পাইছি।
রিদির ভাবনার মাঝেই তীরের ফোন বেজে ওঠে।তীর ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো বিরক্তকর কন্ঠস্বর,
তোকে আমার কলেজ হিস্ট্রি বলতে বলেছি ইডিয়ট।এখুনি বের হ আমার বাড়ি থেকে।বৌ যদি আমার এক অংশ রাগ করে তোর ফালতু কথায় দেখিস তোকে আমি উল্টা ঝুলিয়ে রাখব!
টুং টুং টুং……….
তীর পাংশুটে মুখ করে ফোন কান থেকে নামিয়ে বিরবির করে বলল,
সাধে বলি মিরজাফর আসলামুল্লাহ পীর বাবা সন্দেশ চোরের একমাত্র নাতি।বরদোয়া করলাম তোর বৌ তোকে উঠতে বসতে কিলানি দিবে।হু….
রিদি তীর কে বিরবির করতে দেখে বলল,
কি হলো ভাইয়া?কিছু বললেন?
তীর মুখে হাসি হাসি টেনে বলল,
ভাবি আমি একটু আসছি!
রিদি স্বাভাবিক ভাবেই বলল,
আচ্ছা!!
রিদি ভেবেছে সে হয়তো ওয়াসরুমে যাবে।তাই ওতটা আমলে নেয় নি।তবে সুযোগ পেয়ে বরটাকে একটু আদর করে আসলে মন্দ হয় না।যেই ভাবা সেই কাজ। আঁচ মৃদু করে রিদি উপরে উঠে এল। তীব্র ল্যাপটপে মনোযোগ দিয়ে কিছু করছে।রিদি একছুটে গিয়ে তীব্র কে জড়িয়ে ধরতেই ব্যালেন্স হারিয়ে রিদি পড়তে নিলে তীব্র ঢট করে ধরে ফেলে রেগে বলল,
এসব কি!!এসব তুফানি বেগে আসা কবে থেকে শুরু করলেন? এখুনি যদি লেগে যেত ইডিয়ট!!
আরে লাগতোই না!আমি জানি আপনি লাগতে দিতেন না!
এতো ভরসা!!
তো!!একটা মাত্র বর আমার!ভরসা করব না।
ওহহ আচ্ছা!!
হু!!!
বলেই টপাটপ দুটো চুমু খেল তীব্রর গালে। তীব্র বাঁকা হাসল।পাগলি বৌ!!সে জানেই না সব কথাই শুনেছে ঘরে বসে সিসিটিভি ক্যামেরায়।বৌ মানুষ সন্দেহ করবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।অথচ সে জানেই না তীব্র কি জিনিস। তীব্র চৌধুরী মাস্টারমাইন্ড, আন্ডারওয়ার্ল্ড মাফিয়া এমনি এমনি নাকি!রিদির ধারনার চাইতেই অধিক জানে সে রিদিকে।
তীব্র নিজের ভাবনা থেকে বেরিয়ে তাকালো বাচ্চা বাচ্চা চেহেরায় মিষ্টি মেয়েটার দিকে।এই বৌ এতো মিষ্টি যে এভাবে থাকলে নিজেকে সামলে রাখা মুশকিল হয়ে পড়ে। তীব্র নিজেকে কন্ট্রোল করতে না পেরে রিদিকে আচমকাই সোফায় শুইয়ে ওর ওপর ভর ছেড়ে দিল।রিদি চমকালো,ভরকালো তাড়াতাড়ি করে উঠতে চাইলেও উঠতে পারল না।কিছু বলার আগেই তীব্রর উষ্ঠ এসে মিলিত হলো তার উষ্ঠে।রিদি নড়াচড়া করতেই তীব্র শক্ত করে চেপে ধরলো রিদিকে। ছোট্ট দেহখানা নিয়ে লড়াই করতে করতে রিদি হার মানল। শান্ত হয়ে গেল।জানে লড়েও লাভ নেই।
রিদির ভবানায় ছেদ পড়ে তীব্রর গোঙানির শব্দে।কিছু বিরবির করছে।প্রায় এমন করে।তবে একটু পর শান্ত হয়ে যায়।রাত তখন ৩ টা বাজে।রিদির খেয়াল নেই অনেক রাত হয়েছে। ভাবনায় এতো বিভোর ছিল যে বুঝতেই পারেনি এতোটা সময় চলে গেছে।
সময় চলছে তার গতিতে।দেখতে দেখতে পার হয়েছে আরো ৩ টা মাস। তীব্র ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরতেই কিছুটা ভু কুঁচকে আশেপাশে সব কটা গাডের দিকে তাকালো। সবার চোখমুখ দেখে সন্দেহ হলেও ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
কি হয়েছে?কোন সমস্যা??
একটা সাদা লোক মানে বডিগার্ড এগিয়ে এসে বলল,
ম্যাম!!!
তীব্র ভু কুঁচকে বলল,
ম্যাম হোয়াট??
লোকটা থরথর করে কাঁপছে।বাকিরা সবাই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।লোকটা প্রান হাতে নিয়ে বলল,
বস ম্যাম পালিয়েছে!!
তীব্র ভূ কুঁচকে বলল,
পাগল নাকি!!এতো গাড থাকা সত্ত্বেও ও কিভাবে পালাতে পারে!!
গার্ড তীব্রর শান্ত কথায় অবাক হলেও কাপা কাঁপা হাতে দুটো খাম এগিয়ে দিল। তীব্র ভু কুঁচকে খামদুটো নিল।
প্রথম খামে লিখা “সাদা উল্লুক” দ্বিতীয় খামে লিখা “প্রিয় রাক্ষস মশাই”।
ডোমান সাদা উল্লুক এর অর্থ না জানলেও রিদির সাদা উল্লুক ডাকে নামটা পরিচিত।তাই বুঝতে অসুবিধা হয় নি খামটা তার র জন্য!!
প্রথমে সাদা উল্লুক খামটা থেকে চিঠি বের করে পড়ল তীব্র,
সাদা উল্লুক ভাইয়া।আশা করছি ঙ্গান ফেরার পর চিঠিটা পাবেন।প্রথমেই সরি।আমি আপনাদের চায়ে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছি তার জন্য।এটা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। চিন্তা নেই তীর ভাইয়া আমার সাথে আছে!!আপনার বসের চিঠিটা আপনার বসের হাতে পৌঁছে দিয়েন।
চিঠি পড়ে তীব্রর রিএকশন বুঝা গেল না।সে এবার তার নামের চিঠিটা পড়তে শুরু করল,
চালাকির জন্য একটি ধন্যবাদ তো পেতেই পারি।কেমন দিলাম রাক্ষস মশাই! মাফিয়ার বৌ বলে কথা।একটু আকটু ডেঞ্জারাস না হলে চলে।
আপনাতেই আমি সিজন ২ পর্ব ৫৩
সরি!!ভালোবাসি!!
তীব্র চিঠি পড়ে হো হো করে হেসে উঠতেই সবাই আহাম্মক এর মতো করে তাকালো তীব্রর দিকে।এটা কি ঝর আসার আগের আবহাওয়া নাকি অন্যকিছু!!