আবার বসন্ত পর্ব ৩

আবার বসন্ত পর্ব ৩
ঝিলিক মল্লিক

গত দু’দিন যাবত তিতান আর তাজরীনের নিয়মিত দেখা-সাক্ষাৎ হচ্ছে বিল্ডিংয়ের বাইরে হাতকয়েক দূরত্বে নির্মিত সেই বসার মনোরম জায়গায়। তাজরীন মূলত প্রতিদিন নিজেকে কিছুটা আলাদাভাবে সময় দিতে বুক ভরে খোলা হাওয়া নেওয়ার জন্য-ই এখানটাতে এসে বসে। দ্বিতীয় দিন যখন এখানে এসে বসেছিল, তার ঠিক আধ ঘন্টাখানেক পরে তিতান আসলো তার দিদার সাথে বাইরে হাঁটতে। তখনই তাজরীনের সাথে ওর দেখা। তাজরীনের কাছ থেকে যেইমাত্র জানলো, তাজরীন প্রতিদিন এখানে এসে বসবে; তখনই তিতান জানিয়ে দিলো, সে-ও প্রতিদিন তার দিদার সাথে এখানে আসবে তাজরীনের সাথে গল্প করতে। এভাবে পরপর দু’দিন তিতানের বাবা ক্যান্টনমেন্টে চলে যাওয়ার পরে তিতান সকালে একবার আসে, আবার বিকালে ওর বাবা ফেরার আগেই আরো একবার এসে ঘুরপাক দিয়ে যায়। তাজরীন যদিও তিতানের সাথে সাক্ষাৎ করার নিয়তে এখানে এসে বসে না। তবে ছোট বাচ্চাটাকে দেখলে ও সব ভুলে যায়৷ তিতানের কথাগুলো যেন জাদুর মতো। আবদারগুলো শুনলে ফেলতে ইচ্ছা করে না৷ তাজরীন আশ্চর্য হয়ে ভাবে, এ কি আসলেই রুবায়েতের ছেলে?

রুবায়েত যতোটা কঠোর, তার ছেলে ততোটা নমনীয়। আর বড় হলেও এমনই থাকবে সম্ভবত। রুবায়েত যতোটা গম্ভীর, তার ছেলে তার শতগুণ বেশি চঞ্চল, উৎফুল্ল। সদা হাসিখুশি থাকে৷ দু’জন সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী স্বভাবের মানুষ বাবা-ছেলে হতে পারে! এমন সমীকরণ আগে দেখেনি বলে কিছুটা অবাক হয় তাজরীন। এবং তার সাথে এ-ও ভাবে, তিতানের থেকে দূরে থাকতে হবে তাকে। রুবায়েত নিশ্চয়ই তার ছেলের সাথে তাজরীনের মেলামেশা করাটা ভালো চোখে দেখবে না। না দেখাটাই স্বাভাবিক। রুবায়েত তার ছেলের ব্যাপারে অত্যাধিক পজেসিভ। আর রুবায়েত তাজরীনের চঞ্চল স্বভাবটা নিতে পারে না– · একথাও তাজরীন খুব ভালোভাবে জানে। চট্টগ্রামের সেই ট্যুরে বেশ ভালোই টের পেয়েছিল ব্যাপারটা। আরো কতগুলো অজানা কারণে তাজরীন তিতানকে এড়িয়ে চলতে চায়। কিন্তু তিতান নিজ দায়িত্বে প্রতিদিন তার দিদার তত্ত্বাবধানে যখন এই আড্ডাস্থলে এসে বসে; তখন তাজরীন ওকে এড়িয়ে যেতে পারে না।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তিতানের দিদা আয়েশা খানম প্রতিদিন সকালে ওকে এখানে দিয়ে যান। বাসার টুকটাক কাজ সেরে এসে আবার ওকে নিয়ে যান। বিকালে তিনি নিজেও থাকেন।
আজ বৃহস্পতিবার। আজ-ও তিতান এসেছে সকাল সাড়ে দশটার দিকে। তাজরীনের আজ খুব তাড়া। তহুরা কল করেছিল ভোরবেলায়। তাজরীনকে যেতে হবে দুপুর একটার মধ্যেই। তারপর তিনটা থেকে অনুষ্ঠানের সূচনা। আজ এখানে না আসলেও পারতো তাজরীন। তবু কোনো এক অজানা টানে গত তিনদিনের মতো আজ-ও এসে বসেছে ছাতা ঘেরা বেঞ্চিতে। তাজরীন বসে অদূরে তাকিয়ে ছিল আনমনে৷ তখনই পেছন থেকে বাচ্চা কন্ঠে কেউ বলে উঠলো, “ভাউউউ!”
তাজরীন প্রথমে খানিকটা চমকে উঠলো। পরিচিত কন্ঠস্বর টের পেয়ে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে পেছনে ঘুরে দেখলো, তিতান কোমরে হাত গুঁজে মুখ উঁচু করে তাকিয়ে আছে তাজরীনের মুখপানে। তাজরীন হাত বাড়াতেই তিতান এক লাফে তাজরীনের কোলের মধ্যে উঠে বসে গলা জড়িয়ে ধরলো৷ তারপর বিড়াল ছানার মতো বসে রইলো। তাজরীন ভ্রু নাচিয়ে তিতানের অনুসন্ধানী মুখের দিকে চেয়ে মুচকি হেসে জিজ্ঞাসা করলো,

“লাড্ডু সোনা কিছু খুঁজছে নাকি?”
তিতান তাজরীনের আশেপাশে উঁকি দিয়ে জবাব দেয়,
“আচকি আনোনি চক্কেত?”
তাজরীন তিতানের কপালে একটা চুমু খেয়ে পেছনে হাত গলিয়ে হাতের মুঠোয় কতগুলো লাল-নীল প্যাকেট বের করে নিয়ে আসে। তা দেখে তিতান উচ্ছ্বসিত হলো। দ্রুত হাত বাড়িয়ে কাঙ্ক্ষিত জিনিসগুলো তাজরীনের হাত থেকে নিতে যাবে, তার আগেই তাজরীন নড়েচড়ে বসে। এগিয়ে রাখা হাতটা চটজলদি সরিয়ে নেয় দূরে। তারপর কপট গম্ভীর স্বরে তিতানকে বললো,
“উহু।”
“কুহু?”
তিতান পাল্টা বলে বসে৷ তাজরীন জবাব দেয়,

“এগুলো নিতে হলে তো কিছু দিতে হবে। প্রতিদিন যা দাও। ভুলে গেছো?”
তিতান ভোলেনি। তাজরীনের কোলের মধ্যে থেকে মাথাটা উঁচু করার চেষ্টা করলো। তাজরীন ওর কষ্ট কমিয়ে দিতে নিজের মুখটা নামিয়ে আনলো। সঙ্গে সঙ্গে তিতান টুপ করে তাজরীনের ডান এবং বাম গালে চুমু খায় কতকগুলো। এরপর হাত পেতে আবদার করে,
“ইবাল দেও না তাজ বাবুউ।”
তাজরীন প্যাকেটগুলো একটা একটা করে ছিঁড়ে তিতানের হাতে দিলো। তিতান গপাগপ মুখের মধ্যে একের পর এক চকলেট ঠেসে পুরতে লাগলো। এমন তাড়াহুড়ো করছে, যেন এখনই ওর বাবা এসে ওকে জায়গায় ধরবেন। তিতান তার বাবার কাছে এই নিষিদ্ধ কর্ম সমেত ধরা পরবে এবং তার বাবা তাকে ফ্ল্যাট নামক কারাগারে বন্দী করে রাখবেন। তিতানের যে একটুও ভালো লাগে না সারাদিন ওই বদ্ধ ঘরে থাকতে। তিতান খেতে খেতে এসব-ই ভাবছিল। তাজরীন যেন ওর মনের কথা পড়ে নিলো। তাই সুর করে ছন্দে ছন্দে মিলিয়ে আবৃতি করলো কাজী নজরুল ইসলামের ‘সংকল্প’ কবিতার কিছু চরণ – ·
থাকব না কো বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগৎটাকে,

কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে।
দেশ হতে দেশ দেশান্তরে
ছুটছে তারা কেমন করে,
কিসের নেশায় কেমন করে মরছে যে বীর লাখে লাখে,
কিসের আশায় করছে তারা বরণ মরণ-যন্ত্রণাকে।
হাউই চড়ো চায় যেতে কে?
চন্দ্রলোকের অচিন পুরেঃ . . .
তিতান হাঁ করে তাকিয়ে শুনলো তাজরীনের কথা। কিছু বুঝলো কিনা, তা ওর মুখভঙ্গি দেখে ঠিক বোঝা গেল না। তাজরীন কিছু বলার আগেই তিতান কৌতূহল ধরে রাখতে না পেরে বলে উঠলো,
“ইতা তুমি কিতা বুললে তাজ বাবু?”
তাজরীন ওর হাতদুটো নিয়ে নাড়াচাড়া করে খেলা করতে করতে জবাব দিলো,

“এটা একটা কবিতা লাড্ডু। আমাদের দেশ আছে একটা৷ সোনার দেশ। এই-যে যেই দেশে আমরা থাকি না? এটাকে বলা হয় বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। কবি মানে বুঝিস? যিনি কবিতা লিখেন, তাকে কবি বলা হয়। আর কবিতা? কবিতা হলো– ছন্দ, বাক্য, শব্দতত্ত্ব এবং মনের ভাব-অনুভূতি মিলিয়ে যেই শৈল্পিক সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা হয়। আমি মাত্র যা বললাম না? সেটাও একটা কবিতা। কারো মনের ভাব৷ এই-যে কবিতার চরণগুলো— এখানেই তোর-আমার মনের ভাব লুকিয়ে আছে। কবি মূলত আমাদের মনের ভাবনা, মনস্তাত্ত্বিক কল্পনাকে নিজেদের কলমের আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলেন। তুই-আমি আমরা কিন্তু ঘরবন্দী থাকতে চাই না। আমাদের ইচ্ছা– · আমরা যখন খুশি খোলা হাওয়ায় ঘুরবো, বুকভরে শ্বাস নেবো। যখন ইচ্ছা লাফাবো, হাসবো-কাঁদবো, পছন্দের সব খাবার গপগপিয়ে খাবো। মোটকথা নিজেদের যা মন চাইবে করবো৷ জগতটাকে দেখবো। কেউ আমাদের আটকাতে পারবে না। কি এটা আমাদের ইচ্ছা না?”

তিতান ঘনঘন সামনে কয়েকবার মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ-সূচক জবাব দিলো। ওর মুখের প্রতিক্রিয়া দেখে বোঝা গেল, প্রথমের শক্ত কথাগুলো মোটামুটি বুঝলেও শেষের কথাগুলো বেশ ভালোই বুঝলো। তাজরীন যেন মন পড়তে পারে। তিতানের মনের সকল কথা অনায়সে বলে দিলো! তিতান ভীষণ খুশি। তাজরীনের গলা জড়িয়ে ধরে আরো কতগুলো চুমু উপহার দিলো ওর গালে।
তৎক্ষণাৎ তাজরীনের ফোনটা বেঞ্চিতে ওর হাতের কাছে বেজে উঠলো। তাজরীন ফোন তুলে স্ক্রিনে তহুরার নাম্বার দেখে সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে তহুরা বলে উঠলো,
“তাজরীন, তুমি আসছো কখন?”
তাজরীন যারপরনাই ব্যতিব্যস্ত হয়ে সময় দেখলো। এখন বাজে এগারোটা! গোসল সেরে তৈরি হতে হতে একটা বেজে যাবে। তাজরীন বেঞ্চি ছেড়ে উঠতে উঠতে তাড়াহুড়ো করে বললো,

“এইতো আসছি আমি! আর ঘন্টা দুয়েক সময় লাগবে। তুমি ওয়েট করো। বেশি দেরি করছি না।”
তাজরীন ফোন কেটে তিতানকে নিয়ে হাঁটা দিলো ওকে ওর বাসায় পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে। তিতান তাজরীনের হাত টেনে ধরে দাঁড়িয়ে পরলো হঠাৎ। তাজরীন পাশে তাকাতেই তিতান ফিচেল কন্ঠে বলে উঠলো,
“তুমি কি কুথাউ ঘুত্তে যাচ্চো তাজ বাবু?”
“হ্যাঁ সোনা। আমাকে একটু বের হতে হবে। পরিচিত একজনের বিয়ে। আজ থেকে অনুষ্ঠান শুরু। সেখানেই যেতে হবে আমাকে।”
“তুমি ফিববে ককন?”
“আজ না-ও ফিরতে পারি। খুব সম্ভবত বিয়ের সব অনুষ্ঠান শেষ করে ফিরতে হবে আমাকে। সেই অনুযায়ী প্রস্তুত হয়েই যাবো। তারপর দেখা যাক, কি হয়।”
“তুমি তালমানি ইকানে তাকবে না? আমি তু তুমাল ছাথে গপ্পো কততে পাব্বো না।”
“আমি ফিরে এসে আবার তোমার সাথে গপ্পো করবো লাড্ডু সোনা। এখন তো আমাকে যেতে হচ্ছে। চলো বাবা, দ্রুত চলো। দেরি হচ্ছে আমার।”
“না, আমি তাবো নাহ।”
“যাবে না মানে?”
“আমি বাতায় তাবো না। তুমাল ছাথে তাবো।”

কি আশ্চর্য! এ-কি কথা! তাজরীনের মাথায় যেন বাজ পরলো। তিতান তো বেঁকে বসেছে। একদম জেদ ধরে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছোট মাঠটার মাঝখানের ঘাস অদৃশ্য শক্তিবলে আঁকড়ে ধরে। তাজরীন হতভম্ব হলো। এখন তিতানকে সামলাবে কী করে? কী বলে বুঝ দেবে? বাচ্চাটা তো জেদ ধরে খাম্বার ন্যায় শক্ত হয়ে বুকে হাত গুঁজে মুখ ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নড়েচড়েও না। ফোলানো মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে রেখেছে। যেন অভিমান করেছে। তাজরীন আমতা আমতা করে ভয়ে ভয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
“লাড্ডু সোনাকে বরং আমি পরে একদিন নিয়ে যাই?”
কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে লাড্ডু মুখটা তড়িৎ বেগে ঘুরিয়ে নাকি সুরে বললো,
“তুমি আমালে না নিই গিলে আমি কিনতু কান্দি দিবু।”
কেঁদে দেবে! তাজরীন দিশাহারা হলো। কি-যে করবে ভেবে পেলো না। তিতান এক নাগাড়ে হুমকি দিয়েই চলেছে— তাজরীন যদি ওকে না নিয়ে যায়, তাহলে ও এই মাঠের মাঝখানে গড়াগড়ি খেয়ে কান্নাকাটি করবে। তাজরীনের মতিগতি বেগতিক বুঝে লাড্ডু এবার প্যান্টের মাথা দুই হাতে শক্ত করে চেপে ধরে প্রধান হুমকিটা দিতে বললো,

আবার বসন্ত পর্ব ২

“তাজ বাবু, তুমি আমালে না নিই গিলে আমি কিনতু প্যান্ট খুলি ফিলবু। খুলি ফেললাম কিনতু। প্যান্ট খুলি ফিলবু তু?”
কি সর্বনাশ! ভরা মাঠে নাকি লাড্ডুটা প্যান্ট খুলে ফেলবে! আশেপাশে কি লোকসংখ্যা নেহাৎ কম? তাজরীন এবার শঙ্কায় পরলো। পরিস্থিতি বেগতিক। বাপকা বেটা। একদম বাপের মতো ব্ল্যাকমেইল করতে জানে।
তাজরীন দ্রুত দুই কদম এগিয়ে তিতানকে চেপে ধরে কোলে তুলে নিয়ে আশ্বস্ত করতে বললো,
“তোমাকে আমি নিয়ে যাব তো লাড্ডু সোনা। অবশ্যই নিয়ে যাবো। তবু এই ভরা সভায় প্যান্ট খুলে নিজের এবং সাথে আমারও মান-ইজ্জত শেষ করিস না বাপ৷ পিলিজ লাগে তোরে। একটু থাম। কান্নাকাটি বন্ধ কর। প্যান্টটা টেনে তোল!”

আবার বসন্ত পর্ব ৪