আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ২৪

আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ২৪
তানহা ইসলাম বৈশাখী

হসপিটাল থেকে পুষ্পরা বাড়িতে ফিরেছে বিকেলের দিকে। এখন বাজে সন্ধ্যা ছয়টা। আকাশটা আজ বিকেল থেকে গুমোট বেধে আছে। শরৎের আকাশে বুঝি এবার বর্ষনের ডাক দিবে। সারাদিন শুভ্র মেঘেরা আকাশে উড়ো উড়ি করেছে অথচ বিকেলের পর থেকেই সেখানে কালো মেঘের ঘনঘটা।
চৌধুরী বাড়ির ড্রয়িংরুমে চিন্তিত হয়ে বসে আছেন সকলে। প্রার্থ পুষ্পদের বাড়িতে পৌছে দিয়েই গেছে থানায় রাজিবের ম্যাটার ক্লোজ করতে। পুষ্পর জ্ঞান ফেরার পর তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তখনই তারা জানতে পারে সব। রাজিবের পুরো দলকেই জেলে দেওয়া হয়েছে। তার আনুষাঙ্গিক কাজ নিপ্টাতে প্রার্থকেও থানায় যেতে হয়েছে। ওদের একটা পার্মানেন্ট ব্যাবস্থা করেই ফিরবে।
কিন্তু চিন্তা আরেক জায়গায়। সে গিয়েছে বিকেল চারটার দিকে এখনো ফেরেনি। এদিকে আকাশের অবস্থাও খুব একটা ভালো না। যখন তখন ঝপঝপিয়ে বৃষ্টির পরবে । তার উপর আবার নিয়ে গেছে বাইক। বৃষ্টি হলেই ভিজে যাবে।

বাড়িতে তাদের গাড়িই ছিলো দুটো। একটা আশরাফের আরেকটা প্রার্থর। তারটা তো কাল পুড়েই গেলো আগুনে। নিজেদের গাড়ি রাখার গেরেজে অনেকদিন যাবত তার শখের বাইকটা পরে ছিলো সেটাই বের করেছে এখন। পূর্নিমা বেগম ছেলেকে বাইক চালাতে দেয় না। একবার বাইক এক্সিডেন্ট করেছিলো। সেই থেকে ভদ্রমহিলার ভয় বাইকে। তিনি কিছুতেই বাইক চালাতে দিবে না। প্রার্থও না পেরে রাজি হয়ে গেছে। কিন্তু বাইকটা শখের ছিলো বলে আর বিক্রি করেনি। গ্যারেজেই রেখে দিয়েছিলো। এখন প্রয়োজনের সময় কাজে লাগাতে পারছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

অনেকক্ষন যাবত লিভিংরুমে সোফায় বসে আছে পুষ্প। এবার একটু পিঠ এলিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। প্রার্থ জোর করে এবাড়িতে নিয়ে এলো তাকে। প্রত্যয় সাহেবও মেয়েকে যেতে দিবে বলে পন নিয়েছিলো। কিন্তু প্রার্থর জেদের কাছে হেরে গেছে। সে সবাইকে উপেক্ষা করে পুষ্পকে কোলে করেই নিয়ে বেরিয়ে পরেছে। কেউ আর আটকাতে পারেনি তখন। পুষ্পও হতবিহ্বল চোখে তাকিয়ে ছিলো। তার হাজার চেষ্টায়ও কাজ হয়নি প্রার্থ তাকে নিয়েই এসেছে। অগত্যা সাথে প্রিয়াকেও আসতে হয়েছে। সে তো আরো আসতে চাইছিলো না এবাড়ি। দুবোনের যেন মুখ উঠে গেছে বাড়ি থেকে। তবুও তাদের আসতে হলো। প্রিয়াকে সবাই জোর করে এখানেই পাঠালো পুষ্পর জন্য। অসুস্থ বোন যেটুকু কাজে লাগে সেটুকুই আসান। মেয়েটার আবার কলেজও খুলে গেছে অনেক আগে৷ নিজেদের বাড়ি থেকেই কলেজ যেতো এতদিন এবার যে কয়দিন এবাড়ি থাকবে সেই ক’দিন এখান থেকেই সব হবে।
পুষ্পর পরনে সাদা একটা কামিজ। শাড়ী পরেনি আজ। সে শাশুড়ী মায়ের উদ্দেশ্যে বললো
“-বড় আম্মু আমি বরং ঘরে যাই। ভালো লাগছে না আর। তুমি চিন্তা করোনা। তোমার ছেলে বৃষ্টি হওয়ার আগেই আসবে। তুমিও ঘরে গিয়ে রেস্ট নাও। প্রিয়া দিয়ে আসবে তোমাকে। একটু পর অহনা আন্টি আসলে আবার এসো। এখন ঘরে যাও।
তিনি বললেন,

“-ঠিকাছে যাবো। তোর ভালো না লাগলে তুই আগে ঘরে যা। প্রিয়া মা বোনকে একটু ঘরে দিয়ে আয়।
“-আমি যেতে পারবো।
“-তবুও ওকে নিয়ে যা।
বড় আম্মুর উপর আর কিছু বললো না। প্রিয়াও বসা থেকে উঠে গেলো বোনকে ধরতে। যদিও তার হাতে পায়ে কোন চোট নেই ফোস্কা ছাড়া।মাথায়ই বেশি লেগেছে। তবুও প্রিয়া গেলো। প্রার্থ ভাই যাওয়ার আগে বারবার বলে গেছে-” তোর বোনের খেয়াল রাখিস”।
প্রিয়া পুষ্পকে উপরে প্রার্থর রুমে নিয়ে যেতে চায় কিন্তু পুষ্প আগেই বারন করে দেয়। প্রার্থর রুম ডিঙিয়ে সে যায় প্রিয়ার রুমে। ওই রুমে সে শুবে না প্রিয়ার রুমেই থাকবে। প্রিয়া জোর করলেও শুনলো না। নাছোরবান্দা না পেরে হার মেনে নিলো প্রিয়া। পুষ্পকে নিজের রুমেই শুয়িয়ে দিয়ে এলো।
এবার নিচে গিয়ে বড়আম্মুকে নিজের রুমে দিয়ে আসতে হবে। এরপর প্রান্তর সাথে আরামে বসে সিনচ্যান দেখবে। সিনচ্যান তার আর প্রান্তর প্রিয় কার্টুন।

করিডোর পেরিয়ে কেবলই সিঁড়িতে পা ফেলেছে। ওমনি হেঁচকা টান অনুভব করলো হাতে। কেউ কুনুই ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। অন্ত প্রিয়াকে টেনে বামপাশে করিডরের মাঝখানে নিয়ে থামলো।
প্রিয়া নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে রাগী কন্ঠে বললো।
“-হাত ধরেছো কেন? ছাড়ো হাত৷
অন্ত ছাড়লো না। ভোলাভালা ছেলেটার শরীরে জেদ চেপে বসলো। হাতের কুনুই আরো শক্ত করে চেপে ধরলো। চোয়াল শক্ত করে বললো।
“-এভয়েড কেন করছিস? কি চাই তোর? আমাকে কেন এত অপছন্দ?
প্রিয়া শান্ত হয়ে কঠোর স্বরে বললো।
“-হাত ছাড়তে বলেছি। তোমাকে কখনো ওই চোখে দেখেছি আমি?
অন্ত আরো চেপে ধরলো।

“-দেখিস নি কেন? আমার আচরন আমার কেয়ার আমার ভালোবাসা চোখে পড়লোনা? আমি তো চাই আমাকে ওই চোখে দেখ। তাহলে তোর দেখতে এত সমস্যা কেন?
“-,কারন আমার তোমার মতো ছেলেকে পছন্দ না।
“-তো কার মতো ছেলে পছন্দ তোর? হৃদয়ের মতো? হুম? ওর মতো কুল, হ্যান্ডসাম, তোর থেকে বয়সে দ্বিগুন, প্লেবয় ছেলে পছন্দ? ঠিকাছে আমিও প্লে বয় হবো। দিনে দশটা মেয়ে বদলাবো। তারপর পছন্দ করবি আমাকে?
প্রিয়া হাতে প্রচুর ব্যাথা অনুভব করছে। অন্তর আচানক ক্ষিপ্রতায় সে হতবাক। হাতটাও এত জোরে ধরেছে। চোখে জল চলে এসেছে ব্যাথায়। চোখের কোটরে জমা জল নিয়ে অন্তর চোখে তাকালো। বললো।
“-ছাড়ো প্লিজ। ব্যাথা পাচ্ছি।
অন্ত প্রিয়ার চোখে তাকাতে তার কোটর জমা জল এসে বুকে লাগলো। তার জন্য বুঝি তার অন্তঃপ্রিয়া ব্যাথা পেলো। সাথে সাথে রাগ-ঢাগ গিলে নিলো। ছেড়ে দিলো প্রিয়ার হাত।
হাত ছাড়া পেয়ে প্রিয়া আবার জলে উঠলো। রাগত্ব স্বরে বললো।

“-তোমার বয়স কত বলো তো?
“-বিশ
“-আর আমার বয়স?
“-সতেরো
“-মাত্র তিন বছরের বড় তুমি আমার। আমার এত কম এজের ছেলে পছন্দ নয়। হ্যাঁ আমার পছন্দ হৃদয় ভাইয়ের মতো ছেলে। তবে তাকে এখন আর পছন্দ নয়। সে অন্য কারো। আমি আর কাউকে মন দেবো না। ওইটুকুনি মন আমার ওটা ভবিষ্যৎ জামাইয়ের জন্য রেখে দেবো।
অন্ত অকপটে বলে দিলো
“-ওইটাও আমিই হবো। জামাই হওয়ার পর দেওয়ার চেয়ে ভালো এখনই দিয়ে দে। তাতে আমার কষ্টটা যদি একটু কমে।
প্রিয়া বিরক্ত হলো প্রচুর। চোখমুখ কুঞ্চিত করে বললো।
“-আশ্চর্য তো! এ্যাই তোমার বয়স কতো? মাত্র বিশ বছরের একটা ছেলে হয়ে তুমি আমার পেছনে এভাবে পড়ে আছো। তোমার বিয়ের বয়স হয়েছে?
“-আমি কি বলেছি এখনই বিয়ে করবো?যেভাবে আমার মনটা নিয়ে রেখেছিস সেভাবে তোর মনটাও আমার কাছে থাকলেই চলবে আপাতত।
“-কখনোই না। তুমি এসব আবেগের বসে বলছো বুঝেছো। তোমার বয়স তো অল্প এজন্য এগুলো বুঝো না। তুমি তো পুষ্প আপুরও পাঁচ মাসের ছোট। তোমাকে কি করে…না না কখনোই না।
“-বয়স কম আমার না তোর। ভালোবাসা আবেগ বোঝার ক্ষমতা আছে আমার। গুনে গুনে তিন বছরের বড় আমি তোর। আর কত চাস? মানুষ সেম এজের মানুষকে বিয়ে করে। আর সেখানে আমি তোর তিন বছরের বড়। তো সমস্যা কোথায়?
“-সমস্যা আছে। আমার তোমাকে পছন্দ না। তোমার আমার মাঝে এমন সম্পর্ক গড়ে উঠা সম্ভব নয়। ভুলে যাও আমাকে।
অন্তর প্রেমিক সত্তা নড়ে উঠলো। নরম হয়ে আসলো সে। যে মেয়েকে একদিন না দেখলে দশদিন ঘুম হয় না। তাকে সে কোনদিন পাবে না, সে অন্যকারো বউ হয়ে যাবে একদিন। ভাবলেই অন্ত’র অন্তরাত্মা শুকিয়ে যায়।সে দু কদম এগিয়ে যায় প্রিয়ার দিকে। প্রিয়া একহাত ধরে নিজের মুঠোয় পুরে। নিভু নিভু কন্ঠে বলে।
“-ভালোবাসি প্রিয়া। কেন বুঝিস না? তুই ছাড়া অন্ত’র ভেতরটা শূন্য প্রিয়া। দুবছর ধরে তোকে বুকে আগলে রেখেছি। সেখানে এভাবে দগ্ধ করে যাস না প্লিজ।
প্রিয়ার চোখ অন্তর চোখে। সে চোখে যেন কত কষ্ট লুকিয়ে। সব কষ্ট প্রিয়াকে না পাওয়া নিয়ে। চোখে তার আকুতি প্রিয়াকে নিজের করার। প্রিয়া সে চোখে বেশিক্ষণ সময় তাকিয়ে থাকতে পারলো না। শীতল হয়ে আসলো শরীর। কানে বাজলো অন্তর ” ভালোবাসি প্রিয়া ” কথাটা। গায়ে কাটা দিলো আবার। প্রিয়া চোখ সরিয়ে শান্তভাবে বললো।
“-হাত ছাড়ো।

অন্ত তাও ছাড়লো না। নিজের মতো করে আবারও বললো।
“-সবাই তোকে প্রিয়ু বলে ডাকে। আমি প্রিয়া কেন ডাকি জানিস? কারন তুই আমার প্রিয়া। আমার অন্তঃপ্রিয়া! অন্তরের বিশেষ জায়গায় তোকে রেখেছি। যেখানে কখনো কেউ জায়গা করতে পারবে না। কি করলে তুই আমাকে বুঝবি? কি করলে আমার ভালোবাসা বুঝবি? দেখ আজ তোর জন্য কতটা নির্লজ্জ হয়েছি। তোকে ভালোবাসি বলতে একবারও দ্বিধাবোধ করছি না। তোর প্রত্যাখানেও ফিরে যাচ্ছি না ছুটে তোর কাছেই আসছি। আর কত নির্লজ্জ হতে বলছিস? কি করতে হবে তোকে পাওয়ার জন্য বল আমি তাই করবো।
অন্তর চোখে আকুতি কন্ঠে ব্যাকুলতা। প্রিয়ার বুক মুচড়ে উঠলো হঠাৎ। এখানে আর দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়। অন্তর থেকে হাতটা ছুটিয়েই দৌড়ে চলে গেলো।
অন্ত অসহায় চোখে দেখে গেলো তার প্রস্থান। মনে মনে ভাবলো -” একটু বেশিই তাড়াহুড়ো করলো না তো? আরো কয়েকবছর পরে বললে কি ভালো হতো? যদি প্রিয়া কখনো তাকে ভালো না বাসে তখন সে কি করবে? পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া শূন্য হৃদয় নিয়ে বেচে থাকতে পারবে তো?

প্রার্থ বাড়ি ফিরলো সন্ধ্যা সাতটারও পরে৷বৃষ্টি এখনো পরা শুরু করেনি।সে এসেই প্রথমে মায়ের রুমে গিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলে নিলো। এরপর তাড়া দিয়ে চলে গেলো উপরে। অনেকক্ষণ হয় পুষ্পকে দেখে না। ভেতরটা কেমন ফাকা ফাকা লাগছে।
ক্লান্ত পায়ে সিঁড়ি ডিঙিয়ে নিজের রুমে গেলো। শূন্য কক্ষ দেখে হৃদয় মুচড়ে উঠলো। পুষ্প চলে যায়নি তো? আবার মনে পরলো- “গেলে তো মা বলতোই তাকে। নিশ্চয়ই প্রিয়ুর রুমে আছে।”
সে দাতে দাত চেপে এগোলে। তার পাশের রুম প্রিয়ার। দরজায় দুটো টোকা দিলো কারো কোন শব্দ পাওয়া গেলো না। হালকা ভিরিয়ে রাখা দরজাটা ঠেলে খুলে দিলো। ভেতরে তাকাতেই দেখে পুষ্প বিছানায় আলুথালু হয়ে শুয়ে আছে। গায়ে একটা কাথাও নেই। জুবুথুবু হয়ে আছে। হাটু নিয়ে বুকের সাথে মিশিয়ে রেখেছে।
প্রার্থ তাকে দেখেই প্রান ভরে নিশ্বাস নিলো। ধীর কদমে অগ্রসর হলো সামনে। বিছানার সামনে এসে ঝুকে পরলো পুষ্পর মুখের উপর। এলোমেলো হয়ে পড়া চুলগুলো হাত বাড়িয়ে গুজে দিলো লতানে কানের পিঠে।
ওয়াসরুম থেকে শব্দ এলো পানির। হয়তো প্রিয়া ভেতরে। প্রার্থ এখানে সময় নষ্ট করলো না। ঘুমন্ত অবস্থায় পুষ্পকে কোলে তুলে নিলো।
হঠাৎ বিছানা ছেড়ে হাওয়ায় ভাসছে মনে করে ধরফরিয়ে উঠলো পুষ্প। সতর্ক চোখে এদিক ওদিক চাইতে বুঝলো সে কোথায়।

“-এত নড়ছিস কেন? চুপচাপ বোস।
প্রার্থর হঠাৎ ধমকে চমকে উঠলো সে। বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইলো প্রার্থর দিকে। প্রশ্ন করলো অবাক ভঙ্গিতে।
“-কি করছেন আপনি? নামান আমাকে।
প্রার্থ গা ছাড়া ভাবে হাটতে হাটতে বললো।
“-জামাই রেখে বোনের ঘরে শুয়ে আছিস লজ্জা করে না?
“-আশ্চর্য আপনি বোনের ঘরে থাকতে লজ্জা কিসের? আপনি এভাবে কোলে করে নিয়ে যাচ্ছেন আপনার লজ্জা করছে না?
“-না।
পুষ্প যে প্রার্থর ব্যাবহারে কতটা অবাক হচ্ছে বলে বোঝানো দ্বায়। তার খটকা লাগছে প্রার্থর এমন ব্যাবহারে। কয়েকদিন যাবত যা ব্যাবহার করছে তা মেনে নেওয়ার মতো না। সেদিন পর্যন্ত এত অপমান এত অত্যাচার করলো তার উপর। অথচ আজ কয়েকদিন যাবত তার পুরো চরিত্রটাই বদলে গেছে। মনে হয় না এই প্রার্থ আর সেই প্রার্থ একই মানুষ।
কথা বলতে বলতেই নিজেদের রুমে এসে পৌঁছালো তারা। প্রার্থ পুষ্পকে খাটের উপর বসিয়ে দিলো সাবধানে। বললো গম্ভীর স্বরে।

“-আমি চেঞ্জ করে আসছি। এখান থেকে কোথাও যাবি না।
পুষ্পকে হতবিহ্বল রেখেই সে রওনা করলো ওয়াসরুমের দিকে। পুষ্প মনে মনে আকাশ পাতাল ভাবছে। হুট করে একটা মানুষের এতটা পরিবর্তন কি করে সম্ভব! এর পেছনে কি কোন কারন আছে? বড় কোন কারন? কি করতে চাইছে প্রার্থ?
কিছুক্ষণের মধ্যে শাওয়ার নিয়ে বের হলো প্রার্থ। গায়ে একটা টিশার্ট জরানো। আর একটা ট্রাউজার পরা। বড় চুলগুলো কপালে পরে আছে। সেখান থেকে টপটপ করে পানি পরছে। সাদা রংয়ের তোয়ালেটা দিয়ে চুলগুলো মুছতে মুছতে এগিয়ে এলো। পুষ্পকে যেভাবে রেখে গেছে সে সেভাবেই বসে আছে। দিন দরিয়া ভুলো কোন এক ধ্যানে মগ্ন সে।
প্রার্থ গিয়ে পুষ্পর সামনে দাঁড়ালো। পরনে সালোয়ার-কামিজ দেখে বললো।

“-শাড়ী পরিসনি কেন?
পুষ্প মুখ তুলে তাকালো। ভ্রুকুটি করে বললো
“-আপনি আমার শাড়ী পরা নিয়ে কেন পড়ে থাকেন?
সে অকপটে বলে দিলো
“-শাড়ীতে তোকে বেশি সুন্দর লাগে।
পুষ্প সন্দিহান চোখে তাকালো। বিয়ের পর এই প্রথম বোধহয় সে পুষ্পর প্রশংসা করলো। পুষ্পর তাতে কিছু এলো গেলো না। সে চোখ সরিয়ে বললো।
“-এখন থেকে আর শাড়ী পরবো না।
প্রার্থ গম্ভীরমুখে বললো।
“-পরবি। পরতে হবে। কাবার্ডে শাড়ী রাখা যেটা পছন্দ পরে নে।
পুষ্পর কপাল কুচকে গেলো। প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো।
“-কাবার্ডে শাড়ী আছে? আমি তো সব নিয়ে গিয়েছিলাম। এবাড়িতে তো আনা হয়নি সব।
প্রার্থ তোয়ালে রাখতে রাখতে বললো।

“-আমি এনেছি।
“-কখন?
“-আসার সময়।
“-বাড়িতে গিয়েছিলেন?
“-না।
“-তাহলে?
“-আসার সময় মল থেকে নিয়ে এসেছি। এত প্রশ্ন করছিস কেন? চুপচাপ পরে নে একটা। আমি নিচ থেকে খাবার নিয়ে আসছি
পুষ্পর মাথা ঘুরছে। প্রার্থকে সে চিনতে পারছে না। এটা প্রার্থ ভাই নয়। হতেই পারে না। প্রার্থ ভাই শাড়ী কিনবে তাও পুষ্পর জন্য। সব কেমন এলোমেলো লাগছে না? যে সামনের মানুষটার মনের খবর জানে না তার কাছে এসব এলোমেলোই লাগবে। পুষ্পরও তাই। সব মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।
প্রার্থ দরজার সামনে যেতেই পুষ্প ডেকে উঠলো।
“-খাবার আনতে হবে না। আমি নিচে গিয়ে খেয়ে আসবো।
প্রার্থ ঘুরে তাকালো। গম্ভীর স্বরে আদেশ দিয়ে গেলো।

“-নিচ থেকে এসে যেন শাড়ী পরা দেখি।
ব্যাস! এরপরই চলে গেলো। পুষ্পর কথার প্রতুত্তর না করে সে বলে গেলো শাড়ী পরার কথা। পুষ্প কিছু একটা ভেবে উঠে গেলো কাবার্ডের সামনে। কাবার্ড খুলে দেখে নতুন নতুন শাড়ী দিয়ে ভরা পুরোটা। প্রার্থ এসেই রুবির কাছে দিয়েছিলো শাড়ীগুলো। সে-ই এসে গুছিয়ে রেখে গেছে সব।
পুষ্প অবাক হয়। সবগুলোর রং পুষ্পর খুব পছন্দের সাথে প্রার্থর পছন্দের রংয়েরও আছে। সে দেখেই কাবার্ড লাগিয়ে দিলো। হাত দিয়ে ধরলোও না সেগুলো। আবার গিয়ে বিছানায় বসে পরলো।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই প্রার্থ খাবার নিয়ে উপস্থিত হলো রুমে। পুষ্পর গায়ে শাড়ী না দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এগিয়ে গিয়ে প্লেটটা টেবিলে রাখলো। চোখে মুখে গম্ভীর্যতা বজায় রেখে বললো।
“-পরিসনি কেন?
“-ইচ্ছে হয় নি। আপনি খাবার কেন এনেছেন? বললাম না নিচে গিয়ে খাবো।
“-আমি খাইয়ে দিবো।

বলতে বলতে ভাতের প্লেট নিয়ে পুষ্পর সামনে বসলো । পুষ্প তখনও প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে। ও ঠিক শুনলো তো? প্রার্থ খাইয়ে দিবে?
পুষ্পকে অবাক করে দিয়ে প্রার্থ তার মুখের সামনে চামচ ধরলো। যেহেতু হাতে তার ব্যান্ডেজ তাই চামচ দিয়েই খাওয়াতে হবে। পুষ্পকে ইশারা করে বললো।
“-হা কর।
পুষ্প হা করলো না। উল্টো প্রশ্ন করলো।
“-আপনি কেন করছেন এগুলো?
“-ভালো লাগছে তাই?
“-আপনার এসব করতে ভালো লাগছে?
“-হু। হা কর।
পুষ্পর মন মানছে না। এমন ব্যাবহার কেন করছে? এই প্রশ্নই মাথায় কিলবিল করছে। সে আবারও বললো।
“- আপনার কিছু হয়েছে? কি চাইছেন আপনি?
প্রার্থর মেজাজ চটলো। দাঁতে দাঁত চেপে বললো।
“-আপাতত খাইয়ে দিতে চাইছি। আমার অসুস্থতায় আমার সেবা করেছিলি খাইয়ে দিয়েছিলি না? তাই আমিও তাই করছি। তোর ঋণ শোধ করে দিতে চাইছি। হা কর! নাহলে বা-হাত দিয়ে একটা চড় মারবো গালে।
লাস্টের ধমকে আতকে উঠলো পুষ্প। বেশ উচ্চ শব্দেই ধমকে উঠেছে সে। পুষ্প হা করলো সাথে সাথে।
আর কোন কথা বললো না। প্রার্থ চুপচাপ খাইয়ে দিলো পুষ্প চুপচাপ খেয়ে গেলো।
খাওয়া শেষ করে আবার ওষুধও খাইয়েছে নিজে হাতে। হাতের ফোসকা পরা জায়গায় আঙ্গুলের ডগা দিয়ে ওষুধও লাগিয়ে দিয়েছে। পুষ্পকে শুয়িয়ে দিয়ে গেছে নিচে মায়ের কাছে।

রাত তখন বাজে দশটা কি এগারোটা। প্রার্থ নিচে থেকে মাত্র এলো। পুষ্প শুয়ে আছে বিছানায়। চোখ বন্ধ। প্রার্থ রুমের লাইট নিভিয়ে দরজা লাগিয়ে বিছানায় এলো। পুষ্পর পাশের জায়গাটা দখল করে নিলো। বাইরের জানালা দিয়ে হিরহিরিয়ে বাতাস আসছে। একটু আগেই বৃষ্টি হয়েছে। এখন পরিবেশটা ঠান্ডা ঠান্ডা। জানালা গলিয়ে আসা বাতাসটাও অনেক ঠান্ডা। এসি অন ছিলো রুমের। সে রিমোট চেপে বন্ধ করে দিলো এসিটা। জানালা দিয়ে আসা বাতাসের তোপে পুষ্পর মসৃন চুলগুলো মুখের উপর নাচানাচি করছে। ডিম লাইটের আলোতে সে মুখটা পুষ্পদীপের মতো মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে। যেটা গিয়ে বিধছে প্রার্থ বুক জুড়ে। এত নজরকাঁড়া মুখটার থেকে নজর সরাতে ইচ্ছে করছে না।
প্রার্থ উঠে পুষ্পর উপর ঝুঁকে পরলো। ফু দিয়ে মুখের উপরের চুল সরিয়ে দিলো। তাকে ডাকলো হাস্কি স্বরে।
“-ফুল!

পুষ্প তখনো পুরোপুরিভাবে ঘুমায়নি। কাচা ঘুমটা ভেঙে গেলো ফুল ডাক শুনে। চমকে তাকালো সামনে। প্রার্থ ততক্ষণে সরে গেছে তার উপর থেকে।
সতর্ক চোখে এদিক ওদিক তাকালো সে। পাশে প্রার্থকে দেখে আরেকদফা চমকে উঠলো।
ধরফর করে উঠে বসলো বিছানায়। গলার ক্লেশ পরিষ্কার করে বললো।
“-আপনি? আপনি এখানে কেন?
প্রার্থ স্বভাবতই বললো।
“-তো কোথায় থাকার কথা আমার?
“-আপনার তো সোফায় থাকার কথা।
“-আমার বিছানা আমার বউ রেখে আমি সোফায় কেন ঘুমাবো?সোফা কি আমার বউ নাকি?
“-এতদিন তো তাই ছিলো। আজ কেন হবে না?
প্রার্থ ভ্রু উঁচিয়ে বললো।
“-সোফা কারো বউ হয়?
পুষ্প হেঁয়ালি গলায় বললো।

“-আপনার তো হয়। সোফায় যান নাহয় আমিই প্রিয়ার রুমে চলে যাই।
প্রার্থ খপ করে পুষ্পর কবজি চেপে ধরলো। চোখ রাঙিয়ে বললো।
“-চুপচাপ শুয়ে পড়। কথা আছে।
পুষ্প ভ্রু কুচকে বললো।
“-কি কথা?
প্রার্থ চুপ রইলো কিছুক্ষণ। পুষ্পর হাত ছেড়ে দিয়ে মাথার নিচে দুহাত রাখলো। চিত হয়ে শুয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে বললো।
“-আমাদের বিয়ে হলো কতদিন?
হঠাৎ এমন প্রশ্নে পুষ্পর কেমন সন্দেহ সন্দেহ লাগছে। সে সন্দিহান চোখে তাকিয়ে জবাব দিলো।
“-দের মাস হবে।
প্রার্থ তপ্ত শ্বাস ছেড়ে আবারও বললো।
“-আচ্ছা এখন বল, একটা জিনিস যেটা দের বছরে হয় না অথচ দের মাসেই হয়ে যায়। শুধু হয় না তীব্র থেকে তীব্রতর হয় তা।
এরকম পেচানো কথার অর্থ মেয়েটা বুঝলো না। কপাল গুটিয়ে বললো।
“-এমন কি জিনিস হলো যেটা দের বছরে হলোনা দের মাসে হয়ে গেলো? কি বলতে চাইছেন।
“-যেটা বলছি সেটার উত্তর দে।
“-আজব! জিনিসটা কি সেটা না জানলে বলবো কি করে? পরিবেশের উপর নির্ভর করে জিনিসটা কত দিনে হবে। কিন্তু জিনিসটা কি?
প্রার্থ পুষ্পর চোখে তাকিয়ে গভীর কন্ঠে বললো।

“-ভালোবাসা!
পুষ্প আঁতকে উঠে৷ বড় বড় চোখে তাকিয়ে অবিশ্বাসের তোপ ছোড়ে। শুষ্ক ঢোক গিলে বলে।
“-আপপনি ভালোবাসেন কাউকে?
প্রার্থ স্বাভাবিক ভাবেই বললো
“-হুম।
পুষ্পর চোখে মুখে অবিশ্বাস। অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে বলতে লাগলো।
“-কাকে? সে বুঝি অনেক সুন্দরী? তার মাঝে যা আছে আমার মাঝে তা নেই? এজন্যই আমাকে মানতে এত কষ্ট আপনার? আগে বলে দিতেন। আগেই চলে যেতাম। আমি তো আপনার ভালোবাসা ছিনিয়ে নিতে আসিনি। আমাকে আগে কেন বললেন না আপনি? আগে বললে তো আর এতদিন পরে থাকতাম না এখানে। তাকে নিয়ে সুখে সংসার করতে পারতেন। কিন্তু এখন তো চলে যাচ্ছিলাম আমি। এখন কেন আবার নিয়ে এলেন? ও বুঝেছি। ডিভোর্সের জন্য এত নাটক, এত ভালো ব্যাবহার? আপনি আমাকে এখনো চিনলেন না? আপনি শুধু ডিভোর্স লেটারটা পাঠিয়েই দিতেন আমি নির্দিধায় সাইন করে দিতাম। এত নাটক করার তো কোন প্রয়োজন ছিলো না। আমি তো…….
আর কিছু বলতে দিলোনা পুষ্পকে। প্রার্থ উঠে ঝাপিয়ে পরে পুষ্পর উপর । তাকে বিছানায় ফেলে নিজের তার উপর উঠে পরে। তীর তীর করে কাঁপতে থাকা অধরোষ্ঠ নিজের আয়ত্তে করে নেয়। নরম গরম উষ্ঠের মাঝে খুব সহজেই ডুবে যায় প্রার্থর নিকোটিনে পোড়া ঠোঁট দুটো।
পুষ্পর চোখে কান্নার বদলে ভর করলো বিষ্ময়। গোল গোল চোখে তাকালো সামনে। সেখানে দেখা গেলো প্রার্থর বুজে রাখা আবেশ মাখা দুটো চোখ।
পুষ্পর শ্বাস আটকে আসে। বেড়ে যায় ধুকপুকে বুকের উঠানাম। শরীরের শিরা-উপশিরায় বয়ে যায় এক অদ্ভুদ শিহরণ।
কিছুক্ষণ পর প্রার্থ নিজে থেকে ছেড়ে দেয় তাকে। মুখোমুখি হয় দুটি মুখ। দুজনের শ্বাসপ্রশ্বাসের গরম বাতাস বারি খায় তাদের মুখে।
পুষ্পর টলটলে চোখে প্রশ্ন। প্রার্থ সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে আবেগ মেয় কন্ঠে বললো।

“-তোকে ভালোবাসি!
পুষ্পর শিরদাঁড়ায় অনুভব করলো হিমশীতল স্রোত। কলিজা শুকিয়ে তার এইটুকু হয়ে গেছে। প্রার্থর কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। কন্ঠ মুদে এসেছে।
অবিশ্বাস্য গলায় শ্লেষ নিয়ে বললো।
“-কি..কি বললেন?
প্রার্থ চমৎকার হাসলো। পুষ্পর নাকের ডগায় ছোট্ট চুমু একে বললো।
“-ভালোবাসি ফুল! নিজের অজান্তে ভালোবেসে ফেলেছি তোকে। না চাইতেও পিছলে গেছি তোর মায়াভরা চোখে। তোর প্রেমতৃষ্ণার কাছে হেরে গেছে আমার মন। জিতে গেছে তোর প্রেমতৃষ্ণা। তোর প্রেমে দিশেহারা হয়েছে আমার হৃদয়। ভালোবাসা শব্দকে নতুন করে উপলব্ধি করেছি। নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে ফেলেছি তোকে। ভালোবাসি আমার ফুলকে।
পুষ্পর চোখে জল। সে ভাঙা ভাঙা কন্ঠে বললো।
“-আবার বলুন কাকে?
“-আমার ফুলকে।
“-আর একবার বলেন।
“-ভালোবাসি ফুল! ভালোবাসি!
“-আবার।
“-আর না।
“-কেন?
“-ভালোবাসা বেশি প্রকাশ করলে হারিয়ে যায়।
পুষ্প ঠোঁট ভেঙে আবার বললো।

“-আরেকবার বলেন না।
বলতে বলতেই কেঁদে দিয়েছে। ঠোঁট উল্টে ঠিক বাচ্চাদের মতো কেঁদে উঠলো। দু’হাতে খামচে ধরেছে প্রার্থর টিশার্টের গলা।
পুষ্পর কান্নাতেও প্রার্থ হাসলো। পুষ্পর চোখের কোন বেয়ে গড়িয়ে পরা অশ্রুকণা হাত দিয়ে মুছে দিলো। বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে গালে স্লাইড করতে করতে বললো।
“-কাঁদছিস কেন? ভালোবাসার কথা বললে কাঁদে কে?
পুষ্পর কান্না থামলো না আরো বাড়লো। সে মাথা উঠিয়ে প্রার্থর গলা জরিয়ে ধরে। শক্ত করে চেপে ধরলো টিশার্ট।
প্রার্থ পুষ্পর পিঠে হাত বুলিয়ে দিলো।
তাকে নিজের সাথে মিশিয়েই সোজা হয়ে শুয়ে পরলো। পুষ্পকে আগলে রাখলো নিজের বুকে। পুষ্পর রীতিমতো হেঁচকি উঠে গেছে। প্রার্থ তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। চুলের মাঝে চুমু একে দিলো কতগুলো।
প্রার্থ জানে আজ পুষ্প কেঁদে ভাসাবে। তাই আটকালো না। আজ কাদুক। সুখের অশ্রু আটকে না রেখে গড়াতে দেওয়ায়ই ভালো।

আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ২৩

পুষ্প প্রার্থকে অনেক শক্ত করে ধরে আছে বলে সে বললো।
“-ফুল আস্তে ধর। হাতে ফোস্কা পরা। ব্যাথা পাবি তো।
পুষ্পর এসব শোনায় সময় নেই। সে ব্যাথাযুক্ত হাতেই জাপ্টে ধরছে তাকে। প্রার্থর বুকে মুখ ডুবিয়ে রেখেছে। নাকের পানি চোখের পানি দিয়ে ভিজিয়ে একাকার করে দিচ্ছে সব।

আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ২৫