আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ৩১
তানহা ইসলাম বৈশাখী
“-কে আপনি?
“-আমি তোর প্রার্থ, ফুল!
“-আমি আপনাকে চিনি না।
প্রার্থ আহত নজরে তাকালো পুষ্পর দিকে। বুকের ভেতর উথাল-পাতাল ঝড় বইছে। নিশুতির শীতল পরিবেশেও কপালে দেখা যাচ্ছে চটচটে ঘামের রেখা। ছাদের উপরে আলো কম। দূর আকাশের চাঁদের আলো এবং অদূরের রাস্তার নিয়নের আলোয় ছাদটা বেশ ভালোই পরিস্কার দেখাচ্ছে। সেই অল্প আলোর ছাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে পুষ্প। তার ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে এক অসহায় যুবক। যাকে তার প্রেয়সী চিনতেই পারছে না। তার ভালোবাসার মানুষটি ভুলে গেছে তাকে। ” কে আপনি?” শব্দটাই যেন কানে বাজছে এখনো। হৃদয় নিঙড়ানো ব্যাথায় টনটন করে উঠছে পাজর।
প্রার্থ বিষন্ন মনে ভগ্নহৃদয় নিয়ে একটু সামনে এগোলো। পুষ্পর ডান হাতটা নিজের দুহাতের আঁজলায় পুরে মেঘমন্দ্র কন্ঠে শুধালো।
“-আমি তোর প্রার্থ ভাই, ফুল। তোর স্বামী আমি। আমাকে কেন চিনতে পারছিস না? তুই না আমাকে ভালোবাসিস?
পুষ্প ঝারা দিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে নিলো। দুকদম পিছু হটে গেলো। দুহাত নিয়ে বুকের কাছে গুটিয়ে রাখে। ভয়গ্রস্থ কন্ঠে জোরে জোরে বললো।
“-আমি চিনিনা আপনাকে। আপনি আমার কেউ নন। দূরে থাকেন। দূরে…দূরে যান আমার থেকে। কাছে আসবেন না। ছুবেন না আমাকে।
প্রার্থর নিজেকে পাগল মনে হচ্ছে। ভয়ের সূক্ষ্ম তীরগুলো যেন বুকে লেগে সেখানে ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে। ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে সমস্ত শরীর। গায়ে কাটা দিচ্ছে পুষ্পর বলা একেকটি শব্দ। পুরুষ মানুষেরও বুঝি এত ভয় লাগে? পুরুষেরা তো খুব সহজে ভয় পায় না। তবে একটা নারীর এমন কথায় তার এত ভয় কেন হচ্ছে? অন্তঃপটে এত জ্বালা করছে কেন?
সে আবারও এগিয়ে গেলো। চোখ লাল হয়ে গেছে তার। ভয়ে ভয়ে আবার শুধালো।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“-ফুল আমার কথা শোন। তুই এমন…..
পুষ্প আবার ছলকে উঠে। পিছিয়ে গিয়ে জোরে জোরে বলে
“-দূরে যান। আমি দূরে যেতে বলেছি না আপনাকে? কাছে আসবেন না। ছুবে না। ছুবেন না আমাকে। নয়তো এই ছাদে থেকেই ঝাপ দিবো। দূরে যান।
প্রার্থ সেখানেই থেমে যায়। হার্ট যে কবার বিট করা মিস দিলো তা গোনা গেলো না। চোখদুটো ভয়ে কোটর ছেড়ে যাবে যেন। ভেতর থেকে কেমন অনুভুতিরা এসে দলাপাকাচ্ছে। সেগুলো এসে ধরা দিলো চোখে। অবিশ্বাসী চোখে অশ্রু কনা টলটল করছে। বক্ষস্থল শূন্য হয়ে যাচ্ছে।
দুকদম পিছিয়ে যায় সে নিজে। ভয়ে ভয়ে বলে।
“-ঠিকাছে। যাবো না। যাবো না কাছে। ছুবোও না। প্লিজ পিছাস না। ছাদে রেলিং নেই সত্যিই পরে যাবি। আমি দূরে সরে যাচ্ছি। তুই চলে আয় ওখান থেকে।
“-দূরে যান আপনি। আমি কোথাও যাবো না। দূরে সরুন। নয়তো সত্যিই ঝাপ দিবো।
প্রার্থ শুস্কো ঢোক গিলে। চোখের কোটর থেকে টপ করে একফোটা তরল নিচে পরলো। পিছিয়ে গেলো আরো কয়েক কদম। অকুতিভরা স্বরে মিনতি করে বললো।
“-প্লিজ ফুল মারিস না আমাকে। কেন এমন করছিস? আমার কষ্ট হচ্ছে। আমাদের বাচ্চা তোর পেটে। ওর কথা একটু ভাব। এমন করিস না জান প্লিজ। আমার বুকে ব্যাথা করছে। এখানে আয় একটু।
পুষ্প অবাক লোচনে নিজের পেটের দিকে তাকালো। অবাক স্বরে বিড়বিড় করে বললো।
“-বাচ্চা!
পেট থেকে চোখ তুলে ঝট করে তাকায় প্রার্থর দিকে। চোখ মুখে তার বিষ্ময়। হঠাৎই পুষ্পর নাক বেয়ে গড়িয়ে পরলো লাল রঙা রক্ত। মাথা চক্কর কেটে উঠে। এক হাতে মাথা চেপে ধরে অন্যহাতের কব্জায় নাকের রক্ত মুছলো। হাতটা চোখের সামনে ধরতেই দেখে হাতে রক্ত। বিস্ময়ে চোখ ছানাবড়া। পুষ্পর নাকে রক্ত দেখে ঘাবড়ে গেলো প্রার্থ। ভেতরে এমন লাগছে যেন এক্ষুনি হার্ট এ্যাটাক হবে। নাকে রক্ত কেন বেরোচ্ছে? এখন কি সামনে এগিয়ে পুষ্পকে ধরবে? যদি সত্যিই পরে যায়। ছাদে যে রেলিং নেই। ভয়ে, দ্বিধাদন্তে আগাতে পারলো না। ভাবলো বিভিন্নকথা বলে ভুলিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে নয়তো হায়পার হয়ে যেতে পারে। কিন্তু প্রার্থ কিছু বলার আগেই দেখলো পুষ্প পরে যাচ্ছে। শরীর টলছে। প্রার্থ চিৎকার দিয়ে দৌড়ে আসতে আসতেই পুষ্প ছাদের শেষ অংশটা থেকে হেলে পরে গেলো নিচে। প্রার্থ দৌড়ে এসেও ধরতে পারলো না তাকে। ফুল বলে চিৎকার করে উঠে সে। চোখ ঘোলা হয়ে আসে পানির তোপে। নিচে তাকিয়ে দেখে মাটিতে লেপ্টে আছে পুষ্পর সুতনু দেহটা। মাথার নিচ দিয়ে তরল রক্তের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। এমন দৃশ্য দেখে আবারও চিৎকার দিয়ে উঠে প্রার্থ।
চিৎকার দিয়েই ধরফরিয়ে উঠে বসে সে। বড় বড় শ্বাস নেয়। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষেও ঘেমে নেয়ে একাকার হচ্ছে সে। বা-হাতের তালু দিয়ে কপালের চটচটে ঘাম মুছলো। খুব গরম লাগছে, মাথা আউলে যাচ্ছে। অতঃপর মস্তিষ্কে বেজে উঠলো পুষ্পর নাম। পুষ্প কই? বিভ্রান্তের মতো এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে তার পাশেই সে গুটিগুটি হয়ে শুয়ে আছে। ঘুমন্ত নিষ্পাপ আদলটা দেখে মরুর খড়খড়ে বুকে পানি এলো বোধহয়। তবুও বাইরে থেকে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছে না। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। বেড সাইড টেবিলটা থেকে এক গ্লাস পানি উঠিয়ে ঢগঢগ করে সাবার করলো পুরোটা।
এজন্যই ইদানীং এত ভয়ে থাকে প্রার্থ। কেন যেন বারবার স্বপ্ন দেখছে পুষ্পকে নিয়ে। তাও এরকম খারাপ স্বপ্ন। যেটা প্রার্থর মনে ভয় সৃষ্টি করছে। বক্ষপটে কম্পন তৈরী করছে।
প্রার্থ ফের তাকালো পুষ্পর মোহাবিষ্ট আদলে। যেখানে ভালোবাসার এক নিঃশব্দ আর্তি লুকিয়ে আছে। এই সুন্দর মসৃন মুখের মেয়েটি যেন তার হৃদয়ের খুব গভীরে ঢুকে গেছে। এত সহজে এত শীঘ্রই কি করে অন্তঃপটের এত ভেতরে ঢুকে গেলো মেয়েটি?
প্রার্থ শুধু চেয়েই রইলো। ডিম লাইটের আলোতে তার নিষ্পাপ মুখখানা প্রার্থর কাছে মোহমায়ার এক স্বপ্নিল পৃথিবী লাগছে। সেই মুখখানার দিকে তাকিয়ে শুধু দেখেই গেলো। যতক্ষণ পর্যন্ত না তার সংকীর্ণ বুক শীতল হয়।
একটু পর আস্তে ধীরে শুয়ে পরলো প্রার্থ। আলগোছে পুষ্পকে টেনে নিয়ে নিজের হাতের উপর রাখলো। কাত হয়ে শুয়ে খুব সন্তর্পণে নিজের বুকের সাথে আগলে রাখলো পুষ্পের মাথাটা। আলতো হাতে জরিয়ে ধরলো তাকে। ঘুমন্ত ফোলা গাল দুটোতে সুপ্ত অধর ছুয়িয়ে দিলো সে। অতঃপর কপালেও গভীর চুম্বন একে দিলো। ঠোঁট উঠিয়ে হাত রাখলো পুষ্পর গালে। মেঘমন্দ্র কন্ঠে আওড়ালো।
“-আমাকে ছেড়ে কোত্থাও যাওয়া যাবে না। আমি বলিনি আমাকে ভালোবাসতে শেখা। এখন যখন ভালোবাসতে শিখিয়েছিস তখন একদম ছেড়ে যাওয়া যাবে না। তুই আমার হৃদয়ের অন্তঃকরণের কারন। আমার সুখ ফুল। সুখ ফুল ছাড়া প্রার্থর বেঁচে থাকা অসম্ভব। আমার মরন না দেখতে চাইলে আমার বুকেই থাকতে হবে তোকে। তুই ছেড়ে গেলে নির্ঘাত মৃত্যু হবে আমার, ফুল। আমরণ প্রেমতৃষ্ণায় রেখে ভুগাতে পারবি না আমাকে। তার আগেই নিজের মরন কবুল করে নিবো। তোকে ছাড়া বাচার চেয়ে মরন উত্তম।
বলতে বলতে আবারও ছোট্ট চুমু খেলো পুষ্পর পাতলা অধরভাজে। আবারও বুকের সাথে মিশিয়ে রাখলো তাকে। ভেতরে ভয়ের পরিমান বেশি। এই মেয়ে তার বক্ষ ভাঁজে না থাকলে তার নিশ্চিত মরন হবে। সামান্য একটা স্বপ্নই ভেতর থেকে বার বার নাড়া দিচ্ছে তাকে। অস্থীর করে তুলছে অন্তঃপুর। সেখানে বাস্তবে যদি বাজে কিছু ঘটে যায় তবে কি বেচে থাকতে পারবে প্রার্থ? বুকের অসহনীয় ব্যাথার মরে যাবে না? অথবা মস্তিস্কের প্রবল চাপে পাগল হয়ে যাবে না?
বেশিকিছু ভাবতে পারলো না সে। ভাবতে গেলেও দম আটকে আসছে। নিশ্বাস ঘন হচ্ছে।
এই অসহ্য যন্ত্রনা থেকে মুক্তি পাওয়ার একটাই উপায়। নিজের বুকের মাঝে তার ফুলকে আষ্টেপৃষ্টে জরিয়ে রাখা। ধুকপুকে হৃপিন্ডটাকে একটু শান্ত করা।
আজ সারারাত আর ঘুম নামক পাখিটা ধরা দিবেনা চোখে। সে পালিয়ে গেছে সেই কখন। আজকের জন্য আর আসবে না। এভাবেই প্রেয়সীকে বুকে জরিয়ে নানান ভাবনায় বুদ থাকবে।
কাল আবার অর্নবের গায়ে হলুদ সেখানেও তো যেতে হবে। এদিকে পুষ্পকে নিয়ে আবার নতুন ভয়ও তৈরী হয়েছে মনে। বিশেষ করে ছাদ নিয়ে। গায়ে হলুদ তো ছাদে হবে। ছাদে রেলিং আছে তো? স্বপ্নে যে দেখলো রেলিং বিহীন ছাদ। ভয়ে আবার কুঁকড়ে উঠে ছেলেটা। কি অসহ্য জ্বালা! স্বপ্ন নিয়ে এত সিরিয়াস হওয়ার কি আছে। নিজেকে নিজেই বকলো। আবার ভাবলো, এ স্বপ্ন যে আজকে প্রথম এলো তা তো নয়। পুষ্পর মা হওয়ার খবর জেনেছে আজ সাত আটদিন হতে চললো। ওই তখন থেকেই রাতে আজেবাজে স্বপ্ন দেখে এবং সারাদিন ভয়ে ভয়ে থাকে। কেন রোজ রোজ এত ভয়ানক স্বপ্নের সম্মুখীন হতে হবে? ভালোবেসে কি শান্তিতে বাচা যাবে না? ভালোবাসায় এত ভয় কেন থাকে। প্রতিটি পল স্মৃতিমধুর হয় না কেন? সুখের মাঝে দুঃখরা এসে লুটিয়ে পরে কেন সবসময়?
সকাল গড়িয়ে বিকেল হয়েছে। অর্নবদের বাসার পুরো ছাদ ডেকোরেট করা হয়েছে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানের জন্য। যদিও অর্নব ঘটা করে বিয়ে করতে চাইছিলো না। দু পরিবারের সামনে কাগজে সাইন করে কবুল বলে বিয়েটা সারতে চেয়েছিলো। যে বিয়েতে মনের আনন্দ নেই সে বিয়ে আয়োজন ছাড়া করাই ভালো। কিন্তু অর্নবের বাবা তা হতে দিলো না। এত টাকা পয়সার মালিক তারা। একমাত্র ছেলের বিয়ে এমনি এমনি দেওয়া যায় নাকি? সমাজ কি বলবে? অর্নবের সাথে একপ্রকার যুদ্ধ করে ছোটখাটো একটা আয়োজন করতে পেরেছে তাতে কিছু আত্মীয়স্বজন ও পরিচিত লোকদের দাওয়াত করা হয়েছে।
মেয়ের বাড়ি থেকে অবশ্য স্নেহার বাবা অনুষ্ঠান করতে চায়নি তার অবস্থা ভালো নয় বলে কিন্তু অর্নবের বাবার রিকোয়েস্টে ফাংশনগুলো অর্নবদের বাড়িতেই করছে।
এখন বিকেল। একটু পরেই বর বউকে একসাথে বসিয়ে হলুদ মাখানো হবে।
পুষ্প সবসময় শাড়ী পড়লেও প্রিয়া কখনো পড়েছে কিনা সন্দেহ। বোনের দেখাদেখি হাতেগোনা কয়েকবার পড়েছিলো হয়তো। আজ আবার পড়েছে গায়ে হলুদ উপলক্ষে। হলুদ রংয়ের একটি শাড়ী। মুখে আজ হালকা সাজ। খুব ভারী মেকআপ করেনি তাতেই তাকে আরো বেশি সুন্দরী লাগছে। বড় বড় ঘন চুলগুলো পিঠে এলিয়ে দিয়েছে। হাটার তালে তালে সেগুলো হেলছে দুলছে।
হুট করে কেউ একজন এলোমেলো চুলগুলোতে টান দিলো। ব্যাথায় ‘আহ’ শব্দ তুলে চোখ মুখ খিচে নিলো মেয়েটা। পেছনে ঘুরতেই দেখে তার সমবয়সী একটা মেয়ে তার দিকে তাকিয়েই হাসছে। এক নজর দেখেই চিনে ফেললো তাকে। বিষ্ময় সমেত চেয়ে থেকে বললো।
“-শিফা! তুই এখানে?
শিফা নামক মেয়েটা বললো।
“-চিনেছিস তাহলে। ভাবলাম চিনবিই না।
প্রিয়া হেসে দিলো। বললো।
“-চিনবো না কেন? কালও তো কলেজে একসাথে ছিলাম। কিন্তু তুই এখানে কি করে?
“-আরে অর্নব ভাই তো আমাদের আত্মীয় হয়। এজন্য তার বিয়েতে এসেছি। এসে ভালোই হলো। তোকে পেলাম। আমি আরো ভাবছিলাম একা একা কি করবো?
“-ভালই হয়েছে। আমার বুবুরাও এসেছে পরিচয় করিয়ে দিবো তোকে। এখন একটু চল আমার সাথে নিচে। শাড়ীর কুচিটা খুলে যাচ্ছে। ওয়াশরুমে যাবো।
মেয়েটা উৎফুল্ল ভাব নিয়ে বললো।
“-হ্যাঁ হ্যাঁ চল আমিও নিচেই যাচ্ছিলাম একটা বিশেষ কাজে। এখন তোকে পেয়েছি কাজটা পানির মতো সহজ হবে।
প্রিয়া ভ্রু কুঞ্চিত করে বললো।
“-কি এমন কাজ?
মেয়েটা এবার মাথা নিচু করলো লজ্জায়। ইনিয়ে বিনিয়ে বললো।
“-আচ্ছা তোকে তো বলবোই। আগে বল আমাকে খারাপ ভাববি না এবং আমার সাথে থাকবি?
প্রিয়া সন্দিহান গলায় বললো।
“-আগে বল, কি হয়েছে?
মেয়েটা লজ্জামাখা কন্ঠে বললো।
“-আমার না তোর ওই ভাইটাকে অনেক পছন্দ হয়েছে।
প্রিয়া যেন আকাশ থেকে পরলো। জোরে করে বলে ফেললো।
“-কিহহ! তুই কি পাগল? তুই জানিস না প্রার্থ ভাইয়ের বিয়ে হয়েছে আমার বুবুর সাথে।
শিফার লজ্জা লজ্জা মুখ উবে গেলো। চোখমুখ কুঁচকে বললো।
“-আরে ধুর! আমি তোর ওই ভাইয়ের কথা বলছি নাকি? আমি তো জানি সে বিবাহিত। ওইযে আরেকটা আছে না অন্ত ভাই। ইনোসেন্ট দেখতে। ওকে না আমার ভীষন ভালো লাগে। আগে থেকেই পছন্দ কখনো বলিনি। আজ তার নাম্বারটা নিয়েই ছাড়বো। প্লিজ আমাকে সাহায্য কর না বোন। একটু কথা বলিয়ে দে আমাকে। তোর ভাবি বানিয়ে নে।
প্রিয়া বিস্ময়ে হা হয়ে আছে। মেয়েটা কি বললো এখন? অন্ত ভাইকে পছন্দ করে ও? অনেক আগে থেকে? আবার আজকে নাম্বারও নিবে? কথাগুলো ভেবেই ভেতর থেকে কেমন রাগ লাগলো। কন্ঠে ঝাঁজ নিয়ে বললো।
“-ওই অন্ধের বাচ্চাকে তোর ভালো লাগে? কি দেখে ভালো লাগলো?
“-এভাবে কেন বলছিস? সুন্দরই তো ছেলেটা। একদম প্রার্থ ভাইয়ের মতোই দেখতে। শ্যামলা হলেও চেহারাটা চোখে লাগার মতো। আর আজকে এতদিন পর তাকে দেখে তো আমি অবাক। অনেকদিন আগে যখন দেখেছিলাম তখন মনে হয়েছিলো বাচ্চা ছেলে আজকে দেখে তো আমি হা হয়ে গেছি। কেমন বড় বড় লাগে তাইনা? মনেই হচ্ছিলো না ভার্সিটির প্রথম বর্ষের ছাত্র সবে। চেহারায় কেমন গম্ভীর ভাব এসেছে দেখেছিস? আমি তো এক দেখাই ফিদা হয়ে গেছি ভাই। ক্রাশ খেয়ে ফেলেছি। কিছু একটা কর দোস্ত।
প্রিয়া হা করেই রইলো। সত্যি বলতে অন্তর এমন পরিবর্তন লক্ষ করেছে সেও। বয়সের তুলনায় যেন বেশিই বড় লাগে গম্ভীর্যতার কারনে। তবে এতটা পাগল হওয়ার মতোও কিছু হয়নি। তাকে দেখে ক্রাশ খাওয়ার কি আছে? আশ্চর্য! এসব আদিখ্যেতা দেখে এবার গা জ্বলা শুরু হলো প্রিয়ার।
প্রিয়াকে চুপ দেখে শিফা আবার বললো।
“-কিরে কিছু বল।
“-কি বলবো? এখন কিছু বলতে পারবো না। আমার শাড়ী খুলে যাচ্ছে। ওয়াসরুমে যাবো।
“-হ্যাঁ চল আমিও যাবো নিচে। তোর দুলাভাই নিচেই আছে। তুই কিন্তু নাম্বারটা চেয়ে দিবি। বাকিটা আমিই করে নিবো।
প্রিয়া নাক মুখ কুচকে ফেললো। দুলাভাই মানে কি? ও আবার প্রিয়ার দুলাভাই হলো কখন? রাগে এবার অন্তকেই পেটাতে ইচ্ছে করছে। এত গম্ভীর হতে বলেছে কে যা দেখে মেয়েরা ক্রাশ খায়। যত্তসব!
সে নাক মুখ কুচকেই বললো
“-কিসের দুলাভাই?
“-বাহ রে! দুদিন পর যে ওটাকে বয়ফ্রেন্ড বানাবো তখন তো আমার পক্ষ থেকে তোর দুলাভাইই হবে তাইনা?
প্রিয়া আর কথা আগালো না। ঠোট গোল করে শ্বাস ছেড়ে বললো।
“-নিচে গেলাম।
বলেই হাটা ধরে। শিফা মেয়েটাও যায় তার পিছু পিছু৷
নিচে নেমে সামনে একটু হাঁটতেই মুখোমুখি হলো অন্তর সাথে। সে বোধহয় উপরেই যাচ্ছিলো। শিফা প্রিয়াকে পেছন থেকে বলতে থাকে।
“-থামতে বল প্রিয়া থামতে বল। এখানে দাড়াঁতে বল একটু। কথা বলবো আমি।
প্রিয়ার রাগ হলো প্রচুর। ধমকে উঠলো অন্তকে।
“-এই দাড়াঁও।
অন্ত থেমে যায়। মাত্রই পাশ কাটিয়ে যেতে নিয়েছিলো সে। প্রিয়ার আচানক ধমকেই থেমে গেলো পা জোরা। প্রিয়ার দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকাতেই সে বললো।
“-ও তোমাকে কি জানি বলবে শুনে যাও।
বলেই মুখটা ঘুরিয়ে নিলো অন্য দিকে। এবার রাগের মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সে কি জানেনা এটা বিয়ে বাড়ি। অল্পবয়সী মেয়ে দিয়ে ভরা থাকবে বাড়ি। তাহলে এত সেজেগুজে আসতে বলেছে কে মহারাজাকে? হলুদ পাঞ্জাবীতে এত সুন্দর লাগতে বলেছে কে? এরকম গম্ভীর ব্যাক্তিত্বরে হতে বলেছে কে? কে বলেছে? কেউ না। তবো মেয়েদের ঘায়েল করা লুকে আসতে হবে কেন? এই না প্রিয়ার প্রতি তার কত ভালোবাসা তাহলে অন্য মেয়েদের কেন আকৃষ্ট করতে হবে?
এসব ভেবে ভেবে নাকের পাটা ফুলে ফেঁপে উঠেছে। জেদ হচ্ছে প্রচুর। তবুও চুপ রইলো। একটা কথাও বললো না। এখান থেকে গেলোও না। কি বলে দুজন শুনতে হবে না? কুচি দুহাতে ধরে রেখে দাঁড়িয়ে রইলো।
এদিকে অন্ত জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো দুজনের দিকে। এই মেয়েটাকে তে অন্ত চিনেও না। এ কি বলবে? শিফা লজ্জায় কিছু বলতে পারছে না। এদিক ওদিক মুচড়া মুচড়ি করছে। অন্ত বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করলো প্রিয়াকে।
“-কি হয়েছে প্রিয়া? মাঝপথে আটকে রেখেছিস কেন? যা বলার জলদি বল। উপরে যাবো।
এমনিই মন মেজার চটে আছে তার উপর অন্ত ওকেই মেজাজ দেখাচ্ছে। চেতে উঠলো মেয়েটা। তর্জনী তুলে শাসালো।
“-আমার সাথে এভাবে কথা বলবেনা একদম। তোমাকে এত সুন্দর হয়ে আসতে বলেছে কে? মেয়েরা দেখলে তো পাগল হবেই। এখন যাও দুবছরের ভালোবাসা রেখে নতুন মেয়েদের সাথে পিরিত করো গিয়ে।
রাগের মাতালে তাল খুয়িয়ে কি থেকে কি বললো নিজেও বুঝলো না প্রথমে। যখন বুঝলো তখনই জিভ কামড়ে ধরলো। পাশে তাকিয়ে দেখলো শিফা অবাক হয়ে প্রিয়ার দিকে তাকিয়ে। একটু অপমানবোধ করলো বোধহয় মেয়েটা। প্রিয়া আসলে ওভাবে বলতে যায়নি কিন্তু রাগের বসে কি থেকে কি বলে ফেললো। অল্প কথায় ছ্যাৎ ছ্যাৎ করা মেয়েদের এই এক জ্বালা। রাগের বসে তারা কোথায় কি বলে ফেলে নিজেও জানে না।
সে ঘুরে অন্তর দিকে তাকালো। চশমার কাচ গলে এক জোড়া মোহিত নজর তার দিকেই তাক করা। সে নজর গিয়ে বিধলো সোজা তার হৃদয় বরাবর। বুকটা ধ্বক করে উঠলো তৎক্ষনাৎ। প্রিয়া কি বললো অন্ত কি বুঝলো কিছুই বুঝতে পারছে না সে।
অন্ত দুকদম এগিয়ে এলো প্রিয়ার দিকে। চোখে চোখ রেখে ঘায়েল করা কন্ঠে বললো।
“-আমার ভালোবাসা এতটাও ঠুনকো নয় যে সেটা ভুলে অন্যকাউকে ভালেবাসবো। অন্ত’র অন্তঃপটে যাকে বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন জায়গায় বসিয়েছি সেখানে সেই অন্তঃপ্রিয়া ছাড়া আর কাউকে বসাতে পারবো না। তার জন্য অপেক্ষা করতে করতে যদি আমার এক যুগও পেরিয়ে যায় তবুও আমি অপেক্ষা করবো। কিন্তু অন্তঃপ্রিয়া ছাড়া অন্য কাউকে অন্ত’র মনে জায়গা দিবো না। এবং মনে রাখবি আজ হোক বা কাল, এক বছর হোক বা এক যুগ কোন একদিন তুই অন্তর নামেই দাখিল হবি। আমার অন্তঃপ্রিয়া বলার অধিকার হবি। আমার থেকেও বেশি আমাকে ভালোবাসবি। এটা আমার চ্যালেঞ্জ।
যতটা অবাক হয়েছে প্রিয়া তার থেকেও দিগুন অবাক হয়েছে শিফা। অন্তর প্রতিটি কথায় প্রিয়ার জন্য গভীর প্রেম নিবেদন করছে যেন। এটা কি করে সম্ভব? সে একবার অন্তর দিকে তাকাচ্ছে তো একবার প্রিয়ার দিকে। প্রিয়াও অন্তর দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। সে বুঝতে পারলো না অন্তর হঠাৎ হলোটা কি? এতদিন তো খুব লুকিয়ে চলছিলো। আজ না থামালে তো আজও এড়িয়ে যেতো। প্রিয়া তো ভেবেছিলো অন্ত হার মেনে নিয়েছে। তাকে ভুলার চেষ্টা করছে৷ কিন্তু এ তো উল্টো হয়ে গেলো। সে যে ভুলছে না উল্টো আরো পাকা পোক্ত ভাবে তার মনে জায়গা তৈরী করছে প্রিয়াকে সেখানে বন্দী করার জন্য।
প্রিয়া হা করে থেকে আওড়ালো।
“-তুমি ঠিক আছো তো? হঠাৎ করে কি হলো?
“-হঠাৎ করে তো কিছু হয়নি। যা হওয়ার আগেই হয়েছে। প্রেমের জলে অন্ত আগে থেকেই হাবুডুবু খাচ্ছে এখন সেখানে তোকে ডুবিয়ে মারার পালা।
প্রিয়া বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে বললো।
“-তুমি কে? অন্ধ ভাই এভাবে কথা বলে না। সে জোর করে কারো ভালোবাসা আদায় করার মতো মানুষ নয়।
অন্ত আরেকটু এগিয়ে এসে তাদের মাঝের দুরুত্ব ঘুচালো। হাটু মুরে বসে পরলো প্রিয়ার সামনে। শাড়ীর কুঁচি থেকে প্রিয়ার হাতটা সরিয়ে নিজে নিচ থেকে কুচিগুলো একত্র করতে লাগলো। সেথায় সমস্ত মনোযোগ রেখেই বললো।
“-ভেবেছিলাম ভুলে যাবো। মুক্ত হবো এই প্রেম নামক বিষাক্ত যন্ত্রনা থেকে। কিন্তু পারলাম না। এখান থেকে মুক্ত হতে হলে যে মরতে হবে প্রিয়া। ”
নত মুখটা উপরে তুললো। চশমা ভেদ করে চোখ আটকালো প্রিয়ার চোখে। তারপর নরম কন্ঠে বললো।
“-আমি তো মরতে চাইনা। আমার অন্তঃপ্রিয়াকে অন্য কারো জন্য রেখে দিয়ে আমি মরতে চাই না। আমি বাচঁতে চাই। সারাজীবন তোর হাতে হাত রেখে বাচঁতে চাই। তোর পুষ্প রঞ্জিত মুখটার দিকে চেয়ে থেকে গোটাজীবন পাড়ি দিতে চাই। এই প্রিয়াকে আমার অন্তঃপ্রিয়া করে রাখতে চাই।
শাড়ীর কুঁচি গুলো একত্র করে প্রিয়ার হাতে দিলো। বললো।
“-ওয়াসরুমে গিয়ে ভালো করে গুজে নিস।
ব্যাস! প্রিয়াকে কিংকর্তব্যবিমুঢ় করে রেখে হাটা ধরলো সামনে। আর কোন কথা বাড়ালো না। প্রিয়া জড়বুদ্ধির ন্যায় চেয়ে রইলো সেখানে। এটা কি সত্যিই অন্ত ছিলো? কিন্তু কি করে সম্ভব। একটা মানুষের এতটা পরিবর্তন কি করে সম্ভব? আগের অন্ত হলে তো এভাবে কথা বলার সাহস পেতো না। আকুতি করতো। বারবার প্লিজ বলতো। কত কথাই না বলতো। কিন্তু এ অন্তর কন্ঠে আকুতি কই? এ কন্ঠে তো অধিকার, সাহস। প্রিয়াকে কেড়ে নেওয়ার হুমকি ছিলো যেন এতে। যেন তার জিনিস সে নিয়েই ছাড়বে যে কোন মূল্যে।
আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ৩০
অন্তর প্রতিটি কথায় প্রিয়ার লোমকূপের সমস্ত লোম দাড়িয়ে গেছে। এখনো সেগুলো দাড়িয়েই আছে। কথাগুলো হজম করতে কষ্ট হচ্ছে। তবে মনের কোন এক জায়গায় খুব সূক্ষ্ণ সুখ অনুভুত হচ্ছে। বা একটু খুশি খুশি লাগছে বলা যায়। অন্তর মনে তবে প্রিয়া ছাড়া কেউ নেই? কেউ আসবেও না কখনো? ভাবা যায় গোটা একটা পুরুষের হৃদয় জুরে তার একার বসবাস! এমন সৌভাগ্যবতী কজন মেয়ে হয়? এবার বোকা প্রিয়াটা বুঝলেই হলো।