আমরণ প্রেমতৃষ্ণা শেষ পর্ব
তানহা ইসলাম বৈশাখী
নিসর্গের বুকে সেদিন ঝুম বারিধারা। সেই সন্ধ্যে থেকে এক নাগাড়ে বিরতিহীনভাবে বৃষ্টি হচ্ছে এখনো থামার নাম নেই। বাইরের বৃষ্টির শব্দ, বুকের ভেতরের চাপা ভয় ও করিডোরের নিস্তব্ধতা–সব মিলিয়ে পরিবেশ কেমন অদ্ভুতুরে। ভয়কে যেন দশগুন বাড়িয়ে দিচ্ছে এমন এক পরিবেশ।
প্রার্থ হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। হসপিটালের করিডরে পায়চারি করতে লাগল। ভেতরে তার বউ বাচ্চা জন্ম দিতে ব্যাস্ত। এদিকে সে হার্ট এ্যাটাক করা থেকে নিজেকে বাঁচাতে ব্যাস্ত। বুকের গতি ঠিক কতটা দ্রুত চলছে সে নিজেও জানে না।
কিছুক্ষণ পর অপারেশন থিয়েটার থেকে একজন নার্স বের হলো। তার হাতে তোয়ালে প্যাচানো এক শিশু। সে এসে প্রার্থকে দেখেই বললেন,
“কংগ্রাচুলেশনস মিস্টার প্রার্থ চৌধুরী , আপনি মেয়ের বাবা হয়েছেন।”
প্রার্থর চোখ ফেটে জল আসতে চায়। ঠিক কতদিন অপেক্ষা করেছে এই কথাটা শোনার জন্য! যবে থেকে শুনেছে তার সন্তান আসবে পৃথিবীতে তবে থেকেই সে অপেক্ষায় আছে। সেই অপেক্ষার আজ সাতটা মাস পেরুলো।
নার্সটা তখন বাচ্চাটাকে এগিয়ে দিলো প্রার্থর দিকে। প্রার্থর বুকে কম্পন হয়। হার্টের গতি আরো বাড়ে। কাঁপা কাঁপা হাতদুটো সামনে এগিয়ে নিল সে। নার্স আলগোছে বাচ্চাটাকে প্রার্থর কোলে দেয়। প্রার্থর হাত তখনো কাঁপছে। তরতর করে ঘামছে শরীর।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কোলের ছোট্ট বাচ্চা মেয়েটা ফর্সা চোখমুখ কুঁচকে আছে কিন্তু কান্না করছে না। চোখ মেলে চাইতে পারছে না। প্রার্থ আলতো করে বুকের সাথে জরিয়ে রেখেছে যাতে মেয়েটা ব্যথা না পায়। মেয়ের ওমন কোমল নিষ্পাপ চেহারা দেখে প্রার্থর বুক এবার শান্ত হয়। নিষ্পলক চেয়ে রইল নিষ্পাপ মুখমন্ডলে। এরপর আস্তে করে ডেকে উঠে ‘আম্মু’ বলে।
আম্মু বলার সাথে সাথেই মেয়েটা ভ্যা করে কাঁদতে শুরু করে। সে কি কান্না তার। করিডোরে থাকা সকলে তখন প্রার্থকে ঘিরে ধরেছে বাচ্চা কোলে নিবে বলে। এ বলে আমাকে দে ও বলে আমাকে দে। প্রার্থ কাউকেই দিল না। মনভরে চোখ শীতল করে দেখে নিল আদরের চাঁদের টুকরোকে। এরপর পুষ্পর বাবা প্রত্যয় এসে নিয়েই গেল মেয়েকে। তিনি আযান দিবেন নাতিনের কানে।
প্রার্থর তখন মনে পড়ল তার স্ত্রীও আছে ভেতরে যার কোন খবর এখনো পায়নি সে। সেই নার্সটাকে ডেকে বলল,
“বাচ্চার মা কেমন আছে? ও ভালো আছে তো? আমি কি দেখা করতে পারব?”
“মা-মেয়ে দুজনেই একদম সুস্থ সবল আছে। তবে আপনি এখনই দেখা করতে পারবেন না। একটু সময় লাগবে।”
প্রার্থর মন আনচান করল পুষ্পকে দেখার জন্য। এরকম একটা মুহুর্ত ওকে ছাড়া এনজয় করা যায় নাকি? তবুও আনচানে মনকে সে সরিয়ে রাখল। পুষ্প সুস্থ আছে এটুকুই যথেষ্ট। দেখা পরে করে নিবে।
দুই ঘন্টা পর পুষ্পকে অন্য ওয়ার্ডে শিফট করা হয়। ডাক্তার পেশেন্টের সাথে দেখা করার সুযোগ দিলেও শর্ত দিয়ে দেন একসাথে দুইজনের বেশি মানুষ দেখা করতে পারবে না। পর্যায়ক্রমে দেখা করতে হবে সকলকে। তাই সকলে মিলে সিদ্ধান্ত নিলো প্রার্থ আগে একা গিয়ে দেখা করে আসবে। এমনিতেও কেউ না চাইলেও প্রার্থই প্রথমে দেখা করত।
সে আবার মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে ঢুকল কেবিনে। পুষ্প চোখ বুঁজে ছিল। কেবিনে কারো উপস্থিতি টের পেতেই চোখ খোলে। প্রার্থর কোলে ছোট বাচ্চাকে দেখে চোখে কোন বেয়ে গড়িয়ে পড়ে সুখজল। প্রার্থ এগিয়ে যায় ধীর কদমে। পুষ্পর কাছে এসে প্রথমেই একটা চুমু খায় তার মসৃণ কপালে। এরপর মেয়েকে উঁচু করে ধরে দেখিয়ে মুগ্ধ চোখমুখে তাকিয়ে আওড়াল,
“আমাদের!”
পুষ্প টলমলে চোখে উপর নিচ মাথা নাড়ায়। শোয়া থেকে উঠে বসতে চায়। প্রার্থ বাঁধা দেয়,
“উঠিস না। শুয়ে থাক। ব্যথা লাগবে কোথাও।”
“কিছু হবে না আমি ঠিক আছি।”
“তবুও উঠতে হবে না। আমি বেড উঁচু করে দিচ্ছি।”
এডজাস্টেবল বেডটা সামান্য উঁচু করে দিলো প্রার্থ। এরপর বাচ্চাটাকে ওর কোলে দিল। পুষ্প চোখে জল ফেলছে আর মেয়েকে দেখছে। গভীরভাবে তাকিয়ে থেকে পুষ্পর মনে হলো মেয়েটা একদম বাবার মতো হয়েছে। ওই চোখ, নাক, ঠোঁট সবই তো বাবার মতো। মায়ের মতো শুধু গায়ের রংটা পেয়েছে তাছাড়া কিছুই মায়ের মতো হয়নি। যদিও এত ছোট বাচ্চা কার মতো হয়েছে তা যাচাই করা মুশকিল। তবে পুষ্পর এমনটা মনে হলো। সে আদুরে গলায় বলল,
“আম্মু, আমার আম্মু। তুমি কেন শুধু বাবার মতো হয়েছো? আমি..”
কথাটুকু শেষ হওয়ার আগেই মেয়েটা আবার কাঁদতে শুরু করল আকাশ পাতাল কাঁপিয়ে। প্রার্থ উঠে কোলে নেয় ওকে। এদিক ওদিক হেঁটে থামাতে চায় মেয়েকে। পুষ্পকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“এই ফুল, ওর কি আম্মু ডাক পছন্দ হয়নি? তখন আমিও আম্মু ডেকেছি আর কেঁদে ফেলেছে। এখনও তাই। ওকে তাহলে কি ডাকব?”
পুষ্পর এত্ত হাসি পেল কথাটায়! কিন্তু সেভাবে হাসল না। চাপা হেসে বলল,
“আপনিই জিজ্ঞেস করুন না আপনার মেয়েকে।”
প্রার্থ মেয়ের দিকে তাকাল। চোখ, নাক, মুখ কুচকে কিভাবে কাঁদছে দেখো। প্রার্থ কন্ঠে পৃথিবীর সবটুকু আদর ও মায়া ঢেলে ডাকল,
“আম্মাজান, আম্মু বললেই আপনি কাঁদেন কেন? আম্মু ডাক কি আপনার পছন্দ হয়নি? তাহলে কি বলব? ‘আম্মাজান’ বলব না ‘মা’ বলব?
মেয়ের কান্না থামছেই না। প্রার্থ বিচলিত হয়। এদিক ওদিক হাঁটে এটা ওটা বলে মেয়েকে শান্ত করতে। সে কত কথা তার। এত কথা কখনো পুষ্পর সাথে বলেছে কিনা সন্দেহ। পুষ্প নিষ্পলক দেখে গেল বাবা মেয়েকে। স্বামী প্রার্থ তার কাছে পুরোনো হলেও বাবা প্রার্থ একেবারেই নতুন। একটু আদুরে, অনেকটা সুন্দর আর একেবারে আদর্শ বাবা।
পুষ্পকে বাড়িতে আনা হল দুদিন পরই। এরপর সাতদিনের দিন আকিকা করে বাচ্চার নাম রাখা হয় “প্রার্থনা প্রজ্ঞা চৌধুরী”। সেদিন আরেকদফা প্রজ্ঞাকে দেখতে আসে প্রার্থর বন্ধুরা। সাথে তাদের ছানাপোনা তো আছেই। সাতদিনের প্রজ্ঞা, তার চোখমুখ তখনো কুঁচকানো ফোলা ফোলা। দেখতে সবার কাছে মিষ্টি লাগলেও হৃদের কাছে এই মেয়ে খুবই বাজে। তখন প্রজ্ঞা বিছানায় শুয়ে শুয়ে হাত পা নাড়ছিলো। তার চারপাশে বাবা-চাচারা বসে আছে। হৃদ দূরে দাঁড়িয়ে আছে। হৃদয় ওকে কাছে ডেকে বলে,
” কি বাপ? তুমি কি বোনরে কোলে নিবা না? শশী আপু, স্নিগ্ধা ওরা দুজনেই কিন্তু প্রজ্ঞাকে কোলে নিয়েছে। তুমি নিবা না?”
হৃদ তখন নাক মুখ কুচকে বলে,
“না আমি কুলে নিব না ওকে। কি বাজে ও। চুখ, মুখ এমন ছুটু ছুটু। টিথও নাই। একদম বাজে। আমি নিব না কুলে।”
প্রার্থ মেয়ের নামের বদনাম শুনে ফুলে উঠে। হৃদের দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বলে,
“আমার মেয়ের কাছে তোমাকে আসতেও দিবনা। বড় হয়ে ওর পিছনে ঘুরলে তোমার পিছনে আগুন লাগিয়ে দিবো একদম।”
হৃদ তখন নাক সিটিয়ে বলে,
“উহহ! তোমাল মেয়ে সুন্দল না। নিগ্ধা সুন্দল। সুশী আপুও সুন্দল। ওকে আমি নিব না।”
হৃদের অপছন্দের সেই মেয়ের আজ এক বছর পূর্ণ হলো। প্রার্থ তার জন্য ছোটখাটো একটা বার্থডে পার্টির আয়োজন করেছে। প্রজ্ঞাকে বার্বিডল সাজিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে ঘরে। একটু পরেই ওকে নিচে নিয়ে যাওয়া হবে। পুষ্প, প্রিয়া, স্নেহা, মোহ, সুস্মিতা চারজনে এবার নিজেদের সাজুগুজু শেষ করছে। সারাদিন কাজ করে এখন সময় পেল তারা সাজার।
প্রজ্ঞা সবে বসা শিখেছে। তাকে বিছানায় বসানো হয়েছে এলাচির ছানাপোনা চিনি, মিনির সাথে। চিনি মিনি এবার বেশ বড় হয়েছে। তাদের নিয়ে খেলতে ভালোবাসে সে। তার সামনে আবার বসে আছে হৃদ। প্রজ্ঞা চিনিকে ছোঁয় আর খিলখিল করে হেঁসে উঠে। তার সামনের দুটো দাঁত উঠেছে । হাসলে দাঁতগুলোর জন্য বেশি কিউট লাগে। আর ফোলা ফোলা গালদুটো তো আছেই। হৃদের দেখলেই টুপটাপ চুমু খেতে ইচ্ছে করে।
যাকে ছোটবেলার দেখলে নাক সিটকাতো এখন তার সামনে সারাদিন বসে থাকতে পারবে। কারণ এখন প্রজ্ঞাকে দেখতে তার ভীষন সুন্দর লাগে। ওদের দুজনের মাঝে তখন হাতে পুতুল নিয়ে কুটিকুটি করে হেটে এলো স্নিগ্ধা। মেয়েটার এবার চার বছর চলছে। আর হৃদের পাঁচবছর। সে এসে হৃদকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“লিদ বাইয়া, চলো কেলবো।”
হৃদ ওর দিকে না ফিরেই বলল,
“আমি খেলব না, তুই সুশী আপুল সাথে খেল।”
“না আমি তুমাল সাতে কেলব। আসো না লিদ বাইয়া।”
স্নিগ্ধা হৃদের হাত ধরে টানাটানি করছে খেলার জন্য। কিন্তু হৃদ উঠল না। সে প্রজ্ঞার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে স্নিগ্ধার দিকে তাকাল। কপাল কুঁচকে বলল,
“আমি খেলব না নিগ্ধা। আমি পুগ্গাকে আদল কলব।”
স্নিগ্ধা ঠোঁট ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ফোলা ফোলা গালদুটো আরো ফুলে উঠে। প্রজ্ঞা তখনো বিছানায় বসে চিনি মিনির সাথে খেলছে। হৃদ তখন টুপ করে গিয়ে টুকুস করে একটা চুমু খায় প্রজ্ঞার ফুলকো লুচির মতো গালে। মেয়েটা কিছু না বুঝে গোলগোল চোখে তাকিয়ে থাকে হৃদের দিকে। হৃদ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“খেল পুগ্গা, খেল।
প্রজ্ঞা আবার চিনি, মিনির সাথে লেগে পড়ে। এদিকে স্নিগ্ধা যে গাল ফুলিয়েছে সেটা যেন দেখলোই না হৃদ। স্নিগ্ধা এবার রাগ করে হৃদের হাতে কামড় বসায়। এরপর ওর গায়ের সাদা গেঞ্জিটা টেনে ধরে। নিজের সমস্ত শক্তি খাটিয়ে টানতে টানতে বলে,
” চলোওও, তুমি আমাল সাতে কেলবে। চলো লিদ বাইয়ায়া।”
হৃদও নাছোড়বান্দা যাবে না। সে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলে,
“আমি যাব নাআআ। ছাল নিগ্ধা। আম্মু, আমি যাব না।”
দুজনের একপ্রকার ধস্তাধস্তি চলে। ওদিকে প্রজ্ঞা ওদের দেখে হাত তালি দেয় আর খিলখিল করে হাসে।
ওদের ঝগড়া দেখে এবার পুষ্পরা কাছে এলো। স্নেহা স্নিগ্ধাকে সরিয়ে নিয়ে বলে,
“কি হয়েছে মাম্মা? ভাইয়াকে এভাবে টানছো কেন?”
স্নিগ্ধা আবার ঠোঁট ফোলায়। এরপর কেঁদে ফেলে। কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“বাইয়া আমার সাতে কেলে না কেনু?”
মোহ হৃদকে বলে,
“তুমি বোনের সাথে খেলোনা কেন হৃদ? ওকে কাঁদাচ্ছ কেন?”
হৃদও ঠোঁট ফুলিয়ে বলে,
“আমি পুগ্গার সাথে খেলব মাম্মা।”
“না, তুমি আমাল সাতে কেলবে।”
দুজন নিজের সিদ্ধান্তে অটল। স্নিগ্ধা হৃদকে ছাড়া খেলবে না হৃদ স্নিগ্ধার সাথে খেলবে না। এ নিয়ে একচোট লড়াই হলো, কান্নাকাটি হলো। শেষমেশ কেউ তাদের একসাথে করতে পারল না। স্নিগ্ধা কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলো নিচে।
এরপর রাতে কেক কাটা হলো। প্রজ্ঞা কেক কেটে খেয়ে-দেয়ে বাবার কোলে ঘুমিয়ে যায়। হৃদ এবার কার সাথে খেলবে? প্রজ্ঞা তো ঘুমিয়ে গেলো। তাই সে চলে যায় শশী, স্নিগ্ধার কাছে। দুজনে মিলে একসাথে খেলছিল। হৃদ গিয়ে স্নিগ্ধাকে বলে,
“আয় নিগ্ধা আমরা খেলি।
স্নিগ্ধা মুখ ঘুরিয়ে নেয়। তখন খেলার জন্য কান্না করল তখন আসেনি এবার এসেছে খেলতে। স্নিগ্ধা নতুন স্টাইলে ভেঙচি কাটতে শিখেছে। জ্বিভ বের করে মুখ চুক বাকিয়ে ভেঙচি কেটে বলে,
“কেলব না আমি তুমাল সাতে। যাও একান থিকে।”
হৃদ মুখ ফিরিয়ে শশীকে জিগায়,
“সুশী আপু, চলো আমরা খেলি।”
শশীও মানা করে দেয়,
“তুই যা, তোর সাথে খেলব না। আমি আর নিগ্ধা খেলব।”
এতক্ষণ ও কাউকে পাত্তা দেয়নি। এখন ওকে কেউ পাত্তা দিচ্ছে। তবুও সে চলে গেল না। ওদের সাথেই জোর করে খেলতে বসল। এত সহজপ হার মানার পাত্র হৃদ নয়।
রাত তখন দশটা বাজে। তখনও হৈ-হুল্লোড় চলছে লিভিংরুমে। বাচ্চারা সবাই ঘুমিয়ে গেছে। বড়রা লিভিংরুমে আনন্দ করছে। এমনিতেও এখন সবাই সবার লাইফ নিয়ে মহা ব্যাস্ত। যে যে যার যার পারিবারিক ব্যবসায় নিজ কাঁধে নিয়েছে পাশাপাশি তাদের ব্যন্ডের কনসার্ট তো আছেই। তবে তা অপশলান। মাঝে মাঝে বেছে বেছে সো করে তারা। দেখা সাক্ষাৎ হয় খুব কম। ওই যখন অনুষ্ঠানের আয়োজন হয় তখনই একটু বেশি সময় পাড় করা হয় একত্রে৷
গল্প আড্ডার মাঝে থেকে একসময় দৌড়ে বেসিনের দিকে গেল প্রিয়া। অন্তও সাথে সাথে উঠে দৌড় লাগায় ওর পিছে। মেয়েটা বমি করছে বেসিনে। অন্ত বিচলিত হয়। পিঠে হাত বুলিয়ে অস্থির গলায় বলে,
“প্রিয়া, কি হয়েছে? বমি করছিস কেন? কি খেয়েছিস? ভাই,, ভাই ডাক্তার ডাকো। এম্বুলেন্স ডাকো। ভাই দেখো প্রিয়ার কি হয়েছে। এই প্রিয়া।”
বমি করা শেষে প্রিয়া নেতিয়ে পরে অন্তর উপর। অন্তর বুক কাঁপছে। ত্রাসে গলা শুকিয়ে কাঠ। তখন পুষ্প এসে ধরল প্রিয়াকে। অন্তকে বলল,
“অন্ত, ভেতরে নিয়ে চল ওকে।”
অন্ত সময় ব্যয় না করেই কোলে তুলে নেয় ওকে। নিয়ে গিয়ে শুয়িয়ে দেয় সোফায়। সবার উৎসুক নজর ওদের উপর। প্রিয়ার কি হয়েছে কিছুই বুঝতে পারে না। ওদিকে বেচারা অন্ত তো পাগল প্রায়। কি থেকে কি করবে কোথায় যাবে ভেবে পায় না। পুষ্প ওকে শান্ত করল। অহনা বেগম পানি এনে খাওয়ালেন বউমাকে। তিনি প্রথমে একটু নারাজ থাকলেও এখন প্রিয়াকে ভীষণ ভালোবাসে। তিনি প্রিয়াকে জিজ্ঞেস করলেন হাবিজাবি কিছু খেয়েছে কিনা। প্রিয়া মাথা নাড়িয়ে না করে দেয়। প্রার্থ উপরে ছিল, নিচে এসে ওকে এই অবস্থায় দেখেই ডাক্তার ডাকে।
ডাক্তার আসে প্রায় আধা ঘন্টা পর। তখন ওকে নেওয়া হয় ওদের নিজেদের রুমে । ডাক্তার মহিলাটি এসে প্রথমে প্রিয়ার নাড়ি দেখলেন। ঠান্ডা ঘামে ভিজে আছে প্রিয়ার গাল। হালকা করে পেটে চেপে দেখলেন নিচের দিকে কিছুটা স্ফিতি। তিনি হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন,
“শেষ পিরিয়ড কবে হয়েছিলো?”
বড় ভাইদের সামনে এমন প্রশ্নটা করায় লজ্জায় পড়ে যায় মেয়েটা। তখনই রুম থেকে বেড়িয়ে যায় ছেলেরা। ওরা বুঝে এবার স্পেস দরকার। ছেলেরা যেতেই প্রিয়া জবাব দেয় ধীরে ধীরে,
“দে..দেড় মাস হবে।”
ভদ্রমহিলা হাসেন। তিনি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে যাওয়ার আগে ব্যাগ থেকে প্রেগন্যান্সি কীট বের করে দেন। অতঃপর কাঠি পরীক্ষা করার পর সিওর হয় প্রিয়া প্রেগন্যান্ট। বিয়ের প্রায় এক বছর সাতমাস চলছে। এটা সঠিক সময় বাবা মা হওয়ার। বাড়িতে আরেকটা বাচ্চা আসার সুবাদে আরেকদফা খুশির ঢেও খেলে গেল বাড়িতে। এদিকে প্রিয়া শুধু লজ্জা পাচ্ছে। সবাই কি ভাববে ভেবে ভেবেই লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে। অথচ লজ্জা লাগছে না লজ্জাওয়ালা সেই ছেলেটার। বাবা হওয়ার খুশিতে পুরো বাড়ি ঘুরে ঘুরে মাথায় করে নিয়েছে। নিজের বাবাকে জানাচ্ছে সে নিজেও বাবা হবে। সে-কি খুশি তার। এতদিন চাচ্চু ছিল এবার বাবা হবে ভাবতেই শরীরে কাটা দিচ্ছে। খুশিতে পারছে না একশো একটা চুমু খাবে প্রিয়াকে। মানুষজন কমুক, প্রিয়াকে ঠেসে ধরে চুমু খাবে তাকে বাবা করার দায়ে।
রাত তখন একটার ঘরে। একে একে সকল গেস্ট বিদায় নিচ্ছে। বাচ্চারা সকলে ঘুমিয়ে গেছে। অর্নব, হৃদয়রা যার যার গাড়ি নিয়েছে। ওরা এখনই বাড়িতে ফিরবে। গেটের সামনে প্রার্থর থেকে বিদায় নিয়ে একেকজন চলে গেল একেক পথে।
হৃদয়ের গাড়িতে শুধু হৃদয় মোহ এবং হৃদ। হৃদ ঘুমাচ্ছে তাই মোহ ওকে কোলে করে রেখেছে। ড্রাইভিং সিটে বসে হৃদয় গাড়ি ড্রাইভ করছে। নীরবতার মাঝে হঠাৎ হৃদয় বলে উঠল,
“শোনো জান, আমার না আবার বাবা হতে ইচ্ছে করছে।”
মোহ সরু চোখে তাকিয়ে বলে,
“তোমার হঠাৎ এমন ইচ্ছে হলো কেন?”
“অন্তকে দেখলে না? ব্যাটা বাপ হচ্ছে। ওকে দেখে আমারও ইচ্ছে করল। চলো না হৃদের জন্য একটা ভাই বা বোন নিয়ে আসি। চলো আজই প্রসেসিং এর কাজে লেগে পরব।”
“একদম বাজে কথা বলবে না হৃদয়। হৃদ আরো বড় হোক। এরপর প্ল্যানিং করব।”
হৃদয় গাড়ি থামায় মাঝ রাস্তায়। বাচ্চাদের মতো ছটফট করে উঠে,
“না জান প্লিজ চলো আজকেই প্ল্যানিং করি। আমার আরেকটা ছানা চাই। বেইবি প্লিজ।”
মোহর রাগ হলো। এখন কি এগুলো বলার সময়? সে তেতে উঠে,
“এ্যই তুমি গাড়ি চালাবে? মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে কিসব বকছ তুমি?”
“আগে বলো, একটা ছানা দিবে এরপর গাড়ি চালাব।”
“হৃদয়, আমি কিন্তু তোমাকে এখানে ফেলেই চলে যাব।তারপর নিও তুমি তোমার ছানা। ফালতু একটা। কাজের কাজ কিচ্ছু না যত্তসব ফালতু মার্কা কথা। তোমাকে এখন মাঝ রাস্তায় বাচ্চা পয়দা করে দিতে হবে? আশ্চর্য!
মোহ ভীষনরকম তেতেছে। হৃদয় এবার একটু মিইয়ে আসে। গলা ঝেড়ে বলে,
” রাগ করো কেন জান? আচ্ছা আর বলব না। একটা চুমু দাও। এনার্জি নিয়ে গাড়ি চালাই।”
বলতে বলতেই সে এগিয়ে আসে মোহর দিকে। একদম কাছাকাছি দুটো ঠোঁট । আর একটু আগালেই চুমু বসে যাবে তখনই হৃদের কথার শব্দ এলো,
“কি কচ্ছো বাবা?”
কথা শুনেই ঝট করে সরে আসে হৃদয়। বুকে হাত দিয়ে দম ফেলে ঘনঘন। বিড়বিড় করে আওড়ায়,
“কি ছেলেরে বাবা! একটু রোমান্সও করতে দিল না। এখনই তোমার কেন উঠতে হল বাপ? আরেকটু পরে উঠা গেল না? দিলো ইমোশনের মান সম্মান শেষ করে। থাক আমার আর বাচ্চা লাগবে না। একটাতেই যা অবস্থা করে রেখেছে। জুনিয়রটা এলে আমাকে আর বউয়ের কাছে যেতে হবে না।”
ওর বিড়বিড় করে বলা কথাও মেহ বুঝে। অবস্থা দেখে মিটিমিটি হাসে সে। হৃদকে বলে,
“কিছু না বাবা, আমার চোখে ময়লা পড়েছিল তাই বাবা পরিষ্কার করে দিচ্ছিল তুমি ঘুমাও।”
হৃদ আবার শুয়ে পরে। হৃদয় বড় নিশ্বাস ছেড়ে গাড়ি স্টার্ট দেয়। এ জীবনে সে আর শান্তিমত রোমান্স করতে পারবে পারবে না।
অর্নবরাও বাড়িতে পৌঁছাল খুব দ্রুত। স্নিগ্ধা তখন ঘুমে বিভোর। অর্নব ওকে নিয়ে শুয়িয়ে দিল বেডের মাঝখানে। মেয়ের কপালে ছোট্ট চুমু দিয়ে উঠে দাঁড়াল। স্নেহার ওর কাছে এসে শার্টের বোতামগুলো খুলে দিতে লাগল। ও স্নেহার কোমড় জরিয়ে ধরে। স্নেহার হাত থামে। লজ্জাভরা চোখমুখে তাকায় অর্নবের চোখে। অর্নব একহাতে ওর নরম তুলতুলে গাল টেনে দিয়ে বলল,
“এইযে এত যত্ন নাও আমাদের, তুমি ক্লান্ত হও না?”
স্নেহা কন্ঠ নামিয়ে বলে,
“ক্লান্ত কেন হবো? নিজের মানুষদের যত্ন নেওয়ায় ক্লান্তির কি আছে? তাছাড়া আমার চেয়ে বেশি যত্নশীল তো আপনি।”
“তাই? কিন্তু আমি কি তোমাদের যত্ন নেই?”
“নেন না?”
অর্নব দুপাশে মাথা নেড়ে বলে,
“আমার তো মনে হয় না।”
“আমার তো মনে হয়।”
“কি মনে হয়?”
“মনে হয়, আপনি আমার দেখা সর্বোত্তম ধৈর্যশীল ও যত্নবান পুরুষ।”
“সে তো তুমি আমাকে ভালোবাসো তাই তোমার মনেহয়।
” তাছাড়াও আপনি….
“আমি?”
” উফফ! আপনি হঠাৎ জ্বালাচ্ছেন কেন বলুন তো?
“আমার স্নেনময়ীকে জ্বালাতে আমার ভীষণ ভালো লাগে, তাই।
” হয়েছে জ্বালানো? এবার সরুন রাত হয়েছে। যান ফ্রেশ হয়ে আসুন, ঘুমাব।”
“বললেই হলো ঘুমাব? আপনাকে ঘুমাতে দিলে তো ঘুমাবেন। আমি জ্বালাচ্ছি তো? এখন আরো জ্বালাব।”
স্নেহা হতাশ হয়ে আওড়ায়,
“অর্নব।”
অর্নবও একই স্বরে বলে,
“স্নেহা।”
স্নেহা লজ্জা পায়। অর্নব ওর লজ্জারাঙা মুখ দেখে ঠোঁট কামড়ে হাসে। হুট করে স্নেহা বলে উঠে,
“স্নিগ্ধা উঠে গেছে ছাড়ুন।”
অর্নবের হাত ঢিলে হতেই মেয়েটা পালায়। স্নিগ্ধার পাশে শুয়ে বলে,
“যান, ফ্রেশ হয়ে এসে ঘুমান।”
অর্নব দুষ্টু স্বরে বলে,
“এখন যাচ্ছি। এসে কিন্তু সত্যিই জ্বালাব। তৈরী থেকো।”
স্নেহা লজ্জায় পরে কাঁথা দিয়ে মুখ ঢেকে শুয়ে থাকে। অর্নব সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হেসে চলে যায় ওয়াসরুমে। তাদের তো এভাবেই চলছে। বিয়ের এত বছরেও তাদের প্রেমটা টক-ঝাল-মিষ্টি স্বাদের প্রেম মনে হয়।
চৌধুরী বাড়ি এখন নিশ্চুপ। অতিথিরা কেউ নেই। প্রিয়ার পাশে এতক্ষণ পূর্নিমা, অহনা পুষ্প ছিল। এখন ওরাও চলে গেছে। অন্ত দরজা আটকে এসেই প্রিয়াকে জরিয়ে ধরল। কথা মতো ঠেসে ধরে চুমু খেল। আবারও শক্ত করে জরিয়ে ধরল। প্রিয়া ছটফট করে উঠে,
“আরে কি করছ? ব্যথা পাচ্ছি তো।”
অন্ত হাতের বাঁধন নরম করে,
“স্যরি জান, তুই এমন খুশির খবর দিলি এখন আমি আমার নিজেকে ধরে রাখতে পারছি না।”
প্রিয়া লাজুক হেসে বলল,
“তুমি খুশি?”
“খুশি মানে! আমার ছাব্বিশ বছরের জীবনে এই নিয়ে দুবার আমি এমন খুশি হলাম।”
প্রিয়ার ভ্রু কুঁচকে যায়। দুবার মানে বুঝতে পারে না। সন্দিহান গলায় শুধায়,
“দুবার মানে? এর আগে কি নিয়ে এত খুশি ছিলে তুমি শুনি?”
অন্ত সময় নিয়ে বলে,
“প্রথমবার যখন তোকে পেয়েছিলাম তখন এমন খুশি হয়েছিলাম। তখন এভাবে প্রকাশ করিনি খুশিটা তবে দ্বিতীয়বার বাবা হওয়ার সুবাদে এই খুশিটুকু প্রকাশ করলাম।”
প্রিয়া বিজ্ঞের ন্যয় মাথা নাড়ায়। এরপর ভ্রু উঁচু করে বলে,
“তোমার মনে হচ্ছে না তুমি অল্প বয়সে বাবা হচ্ছো?”
অন্ত উদ্বেগ নিয়ে বলে,
“ছাব্বিস বছরের ছেলেকে তোর অল্পবয়সী মনে হয়? যেই বয়সে প্রেম করেছি সেই বয়সে বিয়ে করলে আমার পাঁচ বছরের একটা বাচ্চা থাকত।”
প্রিয়া হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেয়ে বলে,
“তুমি এত চালু?”
“তোর চেয়ে কম।”
প্রিয়া অবাক হয়ে বলে,
“আমি চালু?”
অন্ত ঘনঘন মাথা নাড়ে দুপাশে। কথা ঘুরায় দ্রুত,
“না না, কে বলল তুই চালু। চালু তো আমি। এজন্যই ছাব্বিশ বছর বয়সে বাবা হতে হচ্ছে। আচ্ছা শোন, আমাদের বাচ্চার নাম রাখবো কি? ”
অন্ত কথার মাঝেই কায়দা করে ওকে নিয়ে শুয়ে পরেছে। অন্তর হাতে প্রিয়ার মাথা। ও প্রিয়ার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। প্রিয়া একহাত ছরিয়ে রেখেছে অন্তর উপর। সে একটু ভেবে বলে,
“আমাদের ছেলে হবে না মেয়ে তা না জেনে কি করে নাম রাখি?”
“ছেলে মেয়ে দুজনের নামই ভেবে রাখি। যখন বাচ্চা আসবে তখনই তো বোঝা যাবে।”
প্রিয়া আবার ভাবল। অনেক্ষণ ভেবে ভেবে বলল,
“আচ্ছা, ছেলে হলে ওর নাম রাখব “অন্তিক প্রণয় চৌধুরী”। কেমন?”
“এটা তো অনেক সুন্দর হয়। আমাদের দুজনের নামের অক্ষরও আছে।”
“হুম হুম। এবার তুমি একটা মেয়ের নাম বলো।”
অন্ত ফটাফট বলে দিলো,
“অন্বেষা প্রিয়ন্তী চৌধুরী”।
প্রিয়া অবাক হয়ে বলে,
” মাশা-আল্লাহ! এত সুন্দর নাম! এইটুকু সময়ে তুমি এত সুন্দর নাম ভাবলে কি করে বলো তো? ”
অন্ত হেসে বলে,
“এটা আমি অনেক আগেই ভেবে রেখেছিলাম।”
“তারমানে তুমি মেয়ে চাও?”
অন্ত প্রিয়ার কপালে চুমু খেয়ে বলে,
“আমার কোন এক্সট্রা চয়েজ নেই। আল্লাহ আমাকে যা দিবে আমি তাতেই খুশি।”
প্রিয়া মুগ্ধ হয়। বুকের ভেতর প্রশান্তির শীতল স্রোত বয়ে যায়। অন্তকে আরো টাইট করে করে জরিয়ে ধরে। এরপর সারারাত তাদের আরো নানাবিধ কথা চলে। প্রথম দিনের এক্সাইটমেন্টটা একটু বেশি দুজনের। সেই এক্সাইটমেন্ট থেকে মনের আশ মিটিয়ে গল্প করল তারা স্বামী স্ত্রী।
অতিথিদের বিদায় করে নিচের সমস্ত কাজ গুছিয়ে উপরে আসতে আসতে প্রার্থদের একটু সময় লাগল। দুজন ঘরে এসে অবাক। ঘুমন্ত প্রজ্ঞা আর ঘুমিয়ে নেই। উঠে পরেছে। এক জায়গায় বসে বসে হাত পা নাড়ছে। পুষ্প দ্রুত এগিয়ে যায় ওর কাছে। কোলে নিয়ে বলে,
“প্রজ্ঞা, মা তুমি উঠে গেছো? কাঁদোনি তো মা!”
প্রজ্ঞা কাঁদেনি। পুষ্প তাও দেখল ভালো করে। প্রার্থ দরজা আটকে এগিয়ে এসে বলে,
“আমার মেয়েকে কি তোর ভীতু মনেহয়? ও ইউভান প্রার্থ চৌধুরীর মেয়ে। ও কিছুতে ভয় পায় না, কাঁদেও না।”
মাত্রই গর্ব করে বলল কথাটুকু। তখনই অকারণে কান্না শুরু করে দেয় প্রজ্ঞা। পুষ্প মিটি মিটি হাসে। টিটকারি করে বলে,
“মা, তুমি তো ইউভান প্রার্থ চৌধুরীর মেয়ে- তুমি কেন কাঁদছো বলো তো? উনার মেয়ে তো কাঁদে না।”
কথার ঈঙ্গিতটুকু ঠিকই বুঝল সে। প্রজ্ঞাকে নিজের কোলে নিতে নিতে বলে,
“দে। আমার মেয়ে তোর কাছে থাকলে কাঁদে। আমার কাছে থাকলে কাঁদে না।”
“আচ্ছা তো এবার কান্না থামান মেয়ের আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।”
পুষ্প চলে যায়। প্রার্থ প্রজ্ঞাকে নিয়ে এদিক ওদিক হাটাহাটি করে বলে,
“আম্মাজান, আপনি কাঁদেন কেন? আপনার বাবাই কি আপনাকে বকেছে? আম্মাজান এবার বাবাইকে বকে দাও তো।”
প্রজ্ঞার কান্না থামে। গোলগোল চোখে তাকিয়ে থাকে বাবার দিকে। বাবার হাসি হাসি মুখ দেখে খিলখিল করে হেসে উঠে। সে হাসিতে প্রার্থর প্রাণ জুরিয়ে যায়। পৃথিবীতে তিনটি জিনিস প্রার্থর প্রাণ শীতল করে। এক তাদের মায়ের হাসি, দ্বিতীয় তার ফুলের হাসি, আর তৃতীয় তার মেয়ে তার আম্মাজানের হাসি। পৃথিবীতে সুখী হতে আর কিছু লাগে না বোধহয়।
প্রার্থ ওকে নিয়ে বসে বিছানায়। প্রজ্ঞাকে মাঝখানে বসিয়ে প্রার্থ শুয়ে পরে ওর সামনে। নিজের মথাটা প্রজ্ঞার সামনে রেখে বলে,
“আম্মাজান, আপনার বাবাইয়ের মাথাটা ভীষণ ব্যথা করছে। একটু মাথাটা টিপে দেন তো আম্মাজান।”
প্রজ্ঞা কি বুঝল কে জানে। সে বাবার দেখিয়ে দেওয়া কপালে তার ছোট ছোট হাত রেখে খেলে। এরপর হা করে এসে বাবার কপালে হামলে পরে। প্রজ্ঞার লালা দিয়ে প্রার্থর কপাল মাখিয়ে যায় তবুও সে উঠে না। মেয়ের আদরটুকু উপভোগ করে।
পুষ্প এসে বাবা মেয়ের এমন আদর দেখে নিজেও ঝাঁপিয়ে পরে। প্রার্থর আদরে ভাগ বসাতে সেও শুয়ে পরে। প্রার্থকে ঠেলে সরিয়ে বলে,
“আম্মা, মাম্মামের মাথাটাও ব্যথা করছে। একটু আদর করে দাও না।”
প্রজ্ঞা কনফিউজড কাকে আদর করবে। একবার বাবার দিকে তাকায় একবার মায়ের দিকে তাকায়। অবশেষে মায়ের মাথায় হাত রাখে। মুখ নামিয়ে মাকেও ভিজিয়ে দেয় লালা দিয়ে।
প্রার্থ সরু চোখে তাকিয় বলে,
“তুই আমার আদরে ভাগ বসাতে আসছিস কেন?”
পুষ্প তেতে উঠে,
“কেন, মেয়ে কি আপনার একার?”
প্রার্থ নরম গরম স্বরে বলে,
“তা না, কিন্তু তোকে তো আমি আদর করব। তুই আমার কাছে আয়।”
পুষ্প রাগ শেষ। দাঁত কেলিয়ে হেসে উঠে গিয়ে বাচ্চাদের মতো আঁছড়ে পরে ওর বুকে। মেয়েয়টা আসার পর থেকে প্রার্থটা ভাগ হয়ে গেছে। বেশিরভাগ সময় প্রজ্ঞাই বাবার কোলে চড়ে ঘুরে বেরায়। পুষ্প শুধু চেয়ে চেয়ে দেখে। এবার মেয়েকেও একটু দেখাল তার বাবা শুধু তার না পুষ্পরও।
এদিকে প্রজ্ঞা আবারও গোলগোল চোখে তাকিয়ে দেখে দুজনকে। হাসি নেই মুখে। কাঁদবে কাঁদবে ভাব। তাকে আদর করছে না কেন? নরম কোয়ার মতো তুলতুলে লাল ঠোঁটটা উল্টে দিল প্রজ্ঞা। ওর অবস্থা দেখে হেসে ফেলে দুজনে। পুষ্প বলে,
“দেখেছেন, জেলাসি লেভেলটা দেখেছেন মেয়ের? আমাকেও আপনার কাছে দেখতে পারে না। আমিও এখন থেকে জেলাস হব। ওকে কোলে নিবেন না আপনি।”
প্রার্থ হেসে বলে,
“তুই কি বাচ্চা? সর কেঁদে ফেলবে কিন্তু।”
পুষ্পকে ছেড়ে প্রজ্ঞাকে কোলে নিল প্রার্থ। মেয়েকে বুকে নিয়ে মাঝখানে শুয়ে পড়ে সে। পুষ্প গিয়ে বাতি নিভিয়ে আসে। বিছানায় পুষ্পর বালিসের উপর প্রার্থ হাত মেলে রেখেছে। এটা হচ্ছে তার আসল বালিস। এই শক্তপোক্ত হাত ছাড়া আজকাল তার ঘুম হয় না। আর মেয়ের ঘুম হয় বাবার শক্ত বুক ছাড়া। ওদিকে প্রার্থর ঘুম হয় না বুকে মেয়ে এবং হাতে স্ত্রীকে ছাড়া।
দুজনকে দুই জায়গায় নিয়ে আরামসে শুয়ে পরল প্রার্থ। একহাতে মেয়ের পিঠ চাপড়ে ঘুম পাড়ায় অন্য হাতে পুষ্পর চুল নাড়াচাড়া করে। প্রজ্ঞা বাবার বুক পেয়েই শান্ত হয়ে যায়। ঘুমিয়ে যায় অল্প সময়েই।
ততক্ষণ নীরবে কাটে সময়। হঠাৎ নীরবতা চিড়ে পুষ্পকে ডেকে উঠে প্রার্থ,
“ফুল!”
“হুম।”
প্রার্থ একটু সময় নিয়ে এরপর বলল,
আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ৪৮
“মাঝে মাঝে ভাবি, তুই না থাকলে আমার কি হতো? #আমরণ_প্রেমতৃষ্ণায় ভুগে মরে যেতাম না আমি? এত সুখ, এত আনন্দ কোথায় পেতাম আমি?”
পুষ্প মাথা উঁচু করে তাকায় প্রার্থর শান্ত চেহারার দিকে। একহাত উঠিয়ে তার গালে রেখে নরম স্বরে বলে,
“আপনি ওগুলো নিয়ে এখন কেন ভাবছেন, বলুন তো? আল্লাহ উত্তম পরিকল্পনাকারী। তিনি আমাদের ভাগ্যে যা লিখেছে আমরা তাই পাচ্ছি। তাহলে অতিরিক্ত কিছু ভেবে আমাদের লাভ আছে, বলুন? আর শুনুন, প্রেমতৃষ্ণায় কেউ মা/রা যায় না। এই যেমন আপনি যতদিন বেঁচে আছেন ততদিন আপনার তৃষ্ণা আমার #আমরণ_প্রেমতৃষ্ণা। ওসব কথা তাই একটু কম কম বলবেন। বুঝেছেন?”
প্রার্থ প্রসন্ন হাসে। ঠোঁট এগিয়ে পুষ্পর কপাল ছোঁয়। নিজের সাথে আরো শক্ত করে জরিয়ে ধরে বলে,
” তুই যতদিন বেঁচে আছিস ততদিন তোর তৃষ্ণা আমার #আমরণ_প্রেমতৃষ্ণা।
