আমায় রেখো প্রিয় শহরে পর্ব ৩১
নূরজাহান আক্তার আলো
ঘড়িতে তখন সাড়ে আট টা। নিলুফা ইয়াসমিনের রান্না প্রায় শেষ। তিনি
নীরবে কাঁদছে আর দ্রুত হাতে অন্যান্য কাজগুলো সারছেন। মেয়েটা না খেয়ে চলে গেল। ছেলেটাও বারণ শুনল না অসুস্থ একটা মেয়েকে বিয়ে করে নিলো। একজন নারীর জীবনে স্বামীর সন্তান ছাড়া আর কি আছে! এদের নিয়েই একজন নারী বেঁচে থাকে। বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে। স্বামীর
অনুপস্থিততেও ছেলে মেয়েকে নিজ হাতে আগলে রেখেছেন। কষ্ট করে হলেও তাদের যাবতীয় চাহিদা, ইচ্ছে ও স্বপ্ন পূরণের সর্বদা আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। অথচ সেই ছেলেই গতকাল উনাকে আদেশ অবজ্ঞা করেছে।
মুখের উপরে এটাও বলেছে, ‘বিয়ে করতে হলে ওই মেয়েটাকেই বিয়ে করবে। তাকে যেন বাঁধা দেওয়া না হয় আর বাঁধা দিলেও শুনবে না সে।’
এরপর আর কোনো কথা থাকে না। বলা মতো রুচিও থাকে না। জীবনে বন্ধুরা হচ্ছে অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই বলে বন্ধুর অসুস্থ বোনকে বিয়ে করে বন্ধুতালি করতে হবে?
রিদওয়ান ধীরপায়ে সিঁড়ি বেয়ে রান্নাঘরে দরজার কাছে এলো। নীরবে দাঁড়িয়ে মায়ের কান্নারত মুখে থেকে কিছুক্ষণ চুপ তাকিয়ে রইল।নিলুফা
ইয়াসমিন তার উপস্থিতি বুঝতে পেরেও ঘুরে তাকাল না। কথাও বললেন না। যে মায়ের মন বোঝে না তার মত ছেলের প্রয়োজন নেই। উনি উনার অশ্রু লুকানো প্রয়াস চালালেন কিন্তু পারলেন না। রাগে দুঃখে অশ্রুগুলো বেহায়া হয়ে ঝরে পড়ছে। রিদওয়ান মায়ের অভিমান বুঝে মায়ের কাছে এসে দাঁড়াল। তারপর সুন্দর করে ডাকল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-‘আম্মু।’
নিলুফা ইয়াসমিন নিরুত্তর। ঘুরেও তাকালেন না। শুধু আঁচলে চোখ মুছে সিদ্ধ ডিমের খোসা ছাড়াতে মনোযোগী হলেন। রিদওয়ান এবার পেছনে থেকে তার মাকে সন্মানের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে বলল,
-‘কাঁদছো কেন? আমি কি মারা গেছি?’
-‘রিদ যাও এখান থেকে। কাজ করতে দাও আমাকে।’
-‘কাজ তো করবে তার আগে আমার কয়েকটা কথা শোনো।’
-‘না। তুমি যা বলার কিংবা করার করেছো। আমি তো কিছু বলি নি তাই তোমারও উচিত হবে এখন আমাকে আমার মতো থাকতে দেওয়া। ‘
-‘আম্মু, তোমরা সবাই যদি এমন অভিমান করো তাহলে আমি কোথায় যাব? আমার কথাও ভাবো, প্লিজ। বাবা মুখ ভার করে আছে। তুমি রাত থেকে কাঁদছো। ওইদিকে ইসমত আন্টি কাঁদছে, রুপক কাঁদছে। তোমরা সবাই শুধু কাঁদছো। অভিমান করছো। একটাবার আমার কথাও ভাবো।
তোমাদের কান্না সহ্য করতে পারছি না আমি।’
-‘সহ্য করতে কে বলেছে, চলে যাও। বিয়ে করেছো, ভালো ইনকামও করো। বাঁধা কিসের?’
-‘আম্মু প্লিজ! এভাবে কেন কথা বলেছো? আমি সেটা বলেছি?’
-‘ বলতে হবে কেন? ঘাসে মুখ দিয়ে তো আর চলি না। এইটুকু বোঝার মতো জ্ঞান আমার আছে।’
-‘কুহু খুব ভালো মেয়ে। ওকে একটু ভালোবেসে দেখো দেখবে তোমার মনের মতো হয়ে উঠেছে।’
-‘ভালোবাসা দিয়ে কি হবে? সে অসুস্থ। আজকের কথা দুদিন পরে ভুলে যাবে। সারাজীবন একটা অসুস্থ মেয়ের ভার বহন করতে হবে তোমাকে।’
-‘আমি তো ভয় পাচ্ছি না। তাহলে তোমরা কেন ভয় পাচ্ছো?’
-‘কেন পাবো না? বলো, কেন পাবো না? আমার ছেলেটাকে সুখে দেখতে চাওয়া কি আমার অপরাধ? মা হয়ে তার ভালো মন্দ চিন্তা করতে পারব না? এইটুকু অধিকারও কি আমার নেই?’
-‘আছে, অবশ্য আছে। আর তোমার ছেলে তোমারই আছে। তাছাড়া ওর চিকিৎসা চলছে। আল্লাহ চাইলে কতকিছুই তো ঘটে, তাই না? আমি তো নেগেটিভ কিছু ভাবছি না। কেন ভাববো? আমার আল্লাহ উপর আমার অগাধ বিশ্বাস আছে। নিজের উপর আস্থা আছে। চেষ্টার কোনো ত্রুুটি’ই রাখব না আমি। এরপরেও যদি কুহু আর সুস্থ না হয় তাহলে মেনে নেবো সৃষ্টিকর্তার এমনই ইচ্ছে। আমার তকদিরে এমন কিছু ছিল। ‘
-‘নিজের খামখেয়ালিপণার দায়ভার তকদিরের উপর দিলে দিয়ে হয় না।’
-‘ সৃষ্টিকর্তার আদেশ ছাড়া গাছে পাতাও নড়ে না। সেখানে বিয়েটা হচ্ছে তকদিরের লেখা। এই নিয়ে আমার মনে আফসোসের ছিঁটেফোঁটা নেই।
আমি স্বজ্ঞানে ওকে মেনে নিয়েছে। ওয়াদা করেছি বাকিটা পথ ওর হাত ধরেই পাড় করব।’
-‘(…)’
-‘আম্মু কুহুর জায়গায় রিমিকে বসাও। একবার ভাবো তোমার মেয়েটা যদি কুহুর জায়গায় থাকতো তুমি কি পারতে ফেলে দিতে? নাকি পারতে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলতে? কোনোটাই পারতে না। তেমনি রুপক কিংবা ইসমত আরা আন্টিও পারছে না। এমনকি তারা কিন্তু আমাকে বারবার বারণ করেছে। বিয়ের আগ মুহূর্তেও সুযোগ দিয়েছে ভেবে দেখতে বরং আমিই শুনি নি। আমার মনের কথাকেই প্রাধান্য দিয়েছি। এখানে তারা নির্দোষ।’
-‘তারা নির্দোষ হলে কে দোষী, তুমি?’
-‘ঠিক। আমিই দোষী কারণ আমি তাকে ভালোবেসেছি। সত্যিকার অর্থে ভালোবাসি বলেই ছেড়ে রাখতে/ ছেড়ে দিতে পারি নি।’
-‘(……..)’
-‘আম্মু? একটাবার সুযোগ দাও। ওকে একটু কাছে টেনে নাও। তুমি রাগ করে থাকলে তার মন দূর্বল হয়ে যাবে। আমার থেকে দূরে সরার অপ্রাণ চেষ্টা করবে। এতে ওর চিকিৎসাও ফুলফিল হবে না। প্লিজ আম্মু, একটু ইজি হও। অন্তত আমার কথা ভেবে ওর সঙ্গে সহজ হও।’
-‘আমার সমস্যা হচ্ছে, আমি যাকে তাকে অপছন্দের লিস্টে রাখি না। আর যাকে অপছন্দ করি তাকে পছন্দের ধারে কাছেও আসতে দেই না।’
-‘কুহুর সমস্যা তার অসুস্থতা তাই তো? এছাড়া তাকে অপছন্দের আর কোনো কারণ দেখাতে পারবে? যদি পারো তাহলে আমি তোমার কথা মেনে নেবো।’
-‘ যাও এখান থেকে।’
-‘ যাচ্ছি। আর হ্যাঁ,জেনে বুঝে দায়িত্ব যখন নিয়েছি এড়িয়ে যেতে পারব না। পারার প্রশ্নই আসে না। এ নিয়ে কোনো কথাও বলব না তোমাকে। আমারই ব্যর্থতা তোমাকে সঠিকটা বোঝাতে পারলাম ন।। শুধু লাস্ট একটাই অনুরোধ ওর সঙ্গে মিসবিহেভ করিও না, প্লিজ।’
একথা বলে রিদওয়ান প্রস্থান করল। বাসা থেকে বেরিয়ে নেইবার হুডের রাস্তা পেরিয়ে আরো সামনে এগিয়ে গেল। রাস্তা টা ফাঁকা। মাঝে মাঝেই দু’একটা গাড়ি দেখা যাচ্ছে। রিদওয়ান হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল। বুকের ভেতর অসহ্য যন্ত্রণার অনুভূতি হচ্ছে। এই যন্ত্রণায় শেষ কোথায় সেও জানে না।
শুধু জানে, থামলে চলছে না। এটা তার নিজের লড়াই। ভালো থাকার লড়াই। ভালোবাসাকে জয়ী করার লড়াই। এসব ভেবেই সে বুকের বাঁ পাশে হাত রেখে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিলো। তখন এক যুবক হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-‘আর ইউ ওকে ব্রাদার?’
-‘ইয়াহ্, আ’ম ফাইন।’
-‘সিওর?’
-‘ইয়াহ্।’
-‘ওকে।’
একথা শুনে ছেলেটা হাসিমুখে বিদায় নিলো। রিদওয়ানও বাসার দিকে পা বাড়াল। একটুপরেই ডেইজি আসবে। শুরু হবে তার আরেকটা যুদ্ধ। এই যুদ্ধটা হবে তার সহধর্মিণীকে সুস্থ করার যুদ্ধ। এখানে ঢাল তলোয়ার নেই,আছে শুধু মানিয়ে নেওয়া আর মেনে নেওয়ার ব্যাপারটা। সে জানে না এই যুদ্ধে জয়ী হবে না কী না। তবে আপ্রাণ চেষ্টা চালাবে।
কুহু ফ্রেশ হয়ে পরিপাটি সাজে নিচে নেমেছে। সে খেয়াল করেছে, তার শাশুড়ী মা ভীষণ স্মার্ট। রিমির থেকেও শুনেছে উনি এলোমেলো থাকা কিংবা কিছু অগোছালো কিছু পছন্দ করেন না।
অথচ সে আগে বাসায় থাকত কাজের মেয়ের বেশে। হুট করে কেউ এসে তাকে কাজের মেয়ে ভাবার রেকর্ডও আছে।এতেই যেন শান্তি। কিন্তু এখন সেসব চলবে না। স্মার্ট শাশুড়ীর মন জয় করতে তাকেও স্মার্ট হতে হবে। সে আশেপাশে কাউকে না দেখে ভয়ে ভয়ে রিদওয়ানের আম্মুর কাছে গেল। মুখটা বেশ থমথমে। তারমানে পরিস্থিতি গরম। এ গরম পরিস্থিতিতে বিড়াল সেজে থাকায় উত্তম। ইসমত আরার রেগে গেলে সে তাই করত। শুধু সে না তার বাবা, ভাইও তাই করত। নয়তো তার মা একে একে সবার গুষ্টি উদ্ধারের কাজে লেগে পড়ত। সে পেছন থেকেই উঁকি মেরে দেখল রান্না করা শেষ, এখন বেড়ে টেবিলে দিতে হবে। উনি সেসব’ই করছিলেন। কুহু বার বার ঢোক গিলছে। কিছু বলতে চায় কিন্তু সাহসে কুলাচ্ছে না।তারপর নিশ্চুপ থেকে ভয়কে জয়কে করে একপর্যায়ে সে মিনমিন করে বলল,
-‘আম্মু! আমাকে দিন আমি খাবারগুলো টেবিলে রেখে আসছি।’
-‘রান্না করতে যখন পেরেছি রাখতেও পারব।’
-‘তাহলে আমি ঝটপট কফি/চা বানিয়ে ফেলি?’
-‘না।’
-‘বাবা কি উঠেছেন? নাস্তা করতে আমি ডেকে আনি?’
উনি এ কথার জবাব দিলেন না। কুহুও আর কোনো কথা খুঁজে পেল না।
সে গিয়ে শশুরকে ডেকে রুপক রিমিকেও ডাকতে গেল। রিমি কলেজে চলে গেছে। রুপক এলো। তিনজন পুরুষই চেয়ার টেনে বসেছে। তখন রিদওয়ান চেঁচিয়ে বলল অফিসে যাবে তাড়াতাড়ি খাবার দিতে। এ কথা শুনে উনি টেবিলে খাবার সাজিয়ে চুলাতে কফির পানি বসালেন। তখন কুহু তোতলাতে তোতলাতে বলল,
-‘আম্মু, আ আম আমি সরি।’
-‘কেন?’
-‘উঠতে লেট করে ফেলেছি। এমন আর হবে না।’
-‘যাক বোধশক্তিটুকু সচল আছে।’
গুরুগম্ভীর কন্ঠে একথা শুনে কুহু কি করবে বুঝতে পারল না। দিশেহারা বোধ করল। অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এখন কি বলবে বোধগম্য হলো না। একথার প্রেক্ষিতে কি বা বলা যায়?সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। উনি যে কথা বলতে আগ্রহী নন সে তাও বুঝল। একটা মানুষ যদি কথা বলতেই না চায় তাহলে রাগ ভাঙাবে কিভাবে? নিজের মা হলে এতক্ষণে সেই চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করে ফেলত। নাওয়া-খাওয়া বন্ধ করে দিতো।
ধরাম করে স্বজোরে রুমের দরজা আঁটকে চুপ করে বসে থাকত। তখন একটুপরে তার মা’ই এসে উল্টে তার রাগ ভাঙাতো। নিজ হাতে খাইয়েও দিতো। মায়ের কথা মনে পড়াতে সে কেঁদে ফেলল। কান্নার চাপাতে গিয়ে ফোঁপাতে লাগল। এভাতে ফোঁপানোর শব্দ শুনে নিলুফা ইয়াসমিন ঘুরে তাকালেন। চোখে মুখে বিষ্ময়ভাব কাটিয়ে ভ্রুঁ কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন।
আমায় রেখো প্রিয় শহরে পর্ব ৩০
এদিকে চেয়ারে বসা তিনজন পুরুষের দৃষ্টিও এদিকে নিবদ্ধ। রিদওয়ান কুহুকে কাঁদতে দেখে উঠতে গেলে রুপক তার হাত ধরে ফেলল। এরপর ঝকঝকে কাঁচের পানিভর্তি গ্লাসের দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘ওদেরটা এবার ওদেরকেই বুঝে নিতে দে। ওদের মধ্যে তোর আমার না যাওয়াটাই ভালো।