আমি তোমার দ্বিধায় বাঁচি পর্ব ১৪
ইয়াসমিন খন্দকার
আয়ুশ বাড়িতে ফিরতেই দেখতে পায় বাড়িতে যেন কুরুক্ষেত্র বেঁধেছে। গুলশেনারা বেগম একটু আগেই হজ থেকে ফিরেছেন। আর ইতিমধ্যেই তিনি ঈশিতার দেশ ত্যাগ করে বিদেশে গিয়ে পড়াশোনার ব্যাপারে জেনে গেছেন। গোঁড়া, রক্ষণশীল ঘরানার গুলশেনারা বেগম এটা কিছুতেই মানতে পারছেন না৷ বাড়িতে এসে এসব শুনে তিনি জাহানারা বেগমের উপর চেচাচ্ছেন। রেগে রেগে বলছেন,”কেমন মেয়েকে নিজের ছেলের বউ করে এনেছ তুমি? বাড়ির বউ ডেংডেং করে বিদেশে পড়তে চলে গেল। আমার মাথা কাজ করছে না। এতগুলো দিন মেয়েটা স্বামীর থেকে দূরে থাকবে ওর চরিত্র ধরে রাখতে পারবে তো? আর সবথেকে বড় কথা স্বামীর হক তো আদায় হবে না। এই অনাচার আমি কিছুতেই মেনে নিব না।”
আয়ুশ তার দাদির সমস্ত কথাই শুনেছে। সে এগিয়ে এসে বলে,”আমার এতে কোন অসুবিধা নেই দাদি। আমার ঈশিতার উপর পূর্ণ সমর্থন আছে। ও আগে নিজের ক্যারিয়ার গড়ুক তারপর আমাদের সংসার নিয়ে ভাবা যাবে।”
গুলশেনারা বেগম বলেন,”ঐ মেয়ে কি তোকে যাদুবিদ্যা দিয়ে বশ করল নাকি আয়ুশ? তুই এ কেমন অবিবেচকের মতো কথা বলছিস? না, অনেক হয়েছে। আমার সংসারে আমি এসব কোন ধরনের কোন অনাচার মানব না। ঐ মেয়ে গেছে তো ন্যাটা চুকে গেছে। এমনিতেও ঐ মেয়েকে বাড়ির বউ হিসেবে আমার একেবারেই পছন্দ ছিল না। এবার আমি একটা ভালো মেয়ে দেখে আয়ুশের বিয়ে দিব।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আয়ুশ স্পষ্ট জানিয়ে দেয়,”আমি মনেপ্রাণে ঈশিতাকে আমার স্ত্রী মানি। ওকে ছাড়া আর অন্য কাউকে আমার স্ত্রী বলে মানবো না।”
আলতাফ তালুকদার সবেমাত্র বাড়িতে এলেন। ছেলের কথায় তিনি রেগে গিয়ে আয়ুশের গালে চ*ড় বসিয়ে দিয়ে বললেন,”বেয়াদব! এতদিন ধরে তোমার অনেক বেয়াদবি সহ্য করেছি কিন্তু আর নয়৷ এবার তোমাকে আমাদের কথা শুনতেই হবে৷ ঐ ঈশিতাকে আমরা আর এই বাড়ির বউ বলে মানি না।””
জাহানারা বেগম অসহায় হয়ে সব দেখছেন। তার যে এখন কিছুই করার নেই। এই ভয়টাই তো তিনি পাচ্ছিলেন৷ তার সব রাগ এখন ঈশিতার উপর। ঐ মেয়েটার জন্যই সবকিছু এমন এলোমেলো হয়ে গেল। একটা সাজানো সংসার ফেলে উনি গেলেন ক্যারিয়ার ঠিক করতে। এখন তো এই সংসার টিকে থাকার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই।
কথায় আছে কারো পৌষ মাস তো কারো সর্বনাশ। এই কথাটা যেন আবার সত্য প্রমাণিত হলো। এতকিছুর মাঝেও ঐশীর কাছে সম্ভাবনার দ্বার খুলে গেছে। মুখোশ খুলে বাইরে আসছে তার আসল রূপ। ঐশী মনে মনে বলে,”এবার এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আমি আয়ুশ ভাইয়াকে নিজের করে নেব। আয়ুশ ভাইয়া তো ঈশিতাকে কখনো স্পর্শ পর্যন্ত করেনি, ওদের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর কিছুই হয়নি। আয়ুশ ভাইয়া এবার শুধু আমার হবে শুধুই আমার।”
এসব কথা ভেবেই হাসল ঐশী। এখন তার একটাই কাজ। যেকোন মূল্যে আয়ুশকে নিজের দিকে প্ররোচিত করা। তাহলেই ষোলকলা পূর্ণ হবে। সফল হবে তার পরিকল্পনা।
ঈশিতা লন্ডনে এসে সবকিছুর সাথে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। যদিওবা এসব করতে তার অনেক সময় লাগছে৷ তবে তামিমের মামা এবং মামি ভীষণ ভালো মানসিকতার। তাদের সাথে মানিয়ে নিতে ঈশিতার মোটেও সমস্যা হচ্ছে না বরং ভালোই লাগছে অনেক। তবে লন্ডন শহরে মানিয়ে নেয়া তার জন্য কষ্টকর। গ্রামে বড় হয়ে ওঠা এক সাধারণ মেয়ের কাছে এত অত্যাধুনিক শহরে থাকার অভিজ্ঞতা একেবারেই ভিন্ন। ঈশিতা তো ভেবে পাচ্ছে না এই শহরে নিজেকে কিভাবে মানিয়ে নেবে। আদৌ পারবে তো?
এরমাঝে তার ফোনে এলো জাহানারা বেগমের কল। ফোনটা রিসিভ করতেই জাহানারা বেগম ঈশিতাকে ভৎসনা করে বলল,”লোভী, স্বার্থপর মেয়ে। তোমার জন্য আমার সংসার টা ভেসে যেতে বসেছে। তুমি তো আমার সংসারে অলক্ষী হয়ে এসেছিলে আর আমি তোমায় মাথায় তুলেছিলাম। তোমার কখনো ভালো হবে না দেখে নিও। আমার ছেলেটাকে কষ্ট দিয়ে তুমি সুখী হতে পারবে না।”
বলেই তিনি ফোন রেখে দেন৷ ঈশিতা কিছু বুঝে উঠতে পারে না। কিছু বলারও সুযোগ পায় না। জাহানারা বেগমের থেকে এমন কিছু আশা করেনি সে। মহিলাটা তাকে কতই না ভালোবাসত। ঈশিতা এরপর আয়ুশকে ফোন করল। আয়ুশ ফোনটা রিসিভ করতেই ঈশিতা জিজ্ঞেস করল,”কেমন আছেন আপনি? ওদিকের পরিস্থিতি ঠিকঠাক তো?”
“আমি ভালোই আছি। আর এখানকার পরিস্থিতিও ভালো৷ তুমি বলো ওখানকার কি অবস্থা? লন্ডনে কোন অসুবিধা হচ্ছে না তো?”
“না, এদিকেও সব ঠিক আছে।”
“বেশ, তবে আর কি। তুমি নিজের ক্যারিয়ারে ফোকাস করো৷ এটাই তো চেয়েছিলে তুমি। যা চেয়েছ তাই পেয়েছ। এখন তুমি নিশ্চয়ই অনেক খুশি।”
“এভাবে বলছেন কেন?”
“তো কিভাবে বলব?”
ঈশিতার ভীষণ খারাপ লাগলো। আবেগের বশে বলল,
“আমার কাজগুলো কি ভীষণ স্বার্থপর ছিল?)”
“এই প্রশ্ন তুমি আমাকে না করে নিজেকে করো উত্তর পেয়ে যাবে।”
ঈশিতা স্তব্ধ।
“আপনারা আমায় ভুল বুঝছেন।”
“কেউ তোমায় ভুল বুঝছে না। তুমি নিজের মতো থাকো। মনে করো, তুমি বিদেশে যাওয়ার পর থেকে আমাদের রাস্তা আলাদা হয়ে গেছে।”
“এমন করে বলবেন না।”
“আমি না বললেই বাস্তবতা বদলাবে না ঈশিতা। তুমি তো কখনো আমার সাথে সংসার করতে চাও নি। আর আল্লাহ হয়তো তোমার সেই চাওয়াটাই পূর্ণ করতে চলেছেন।”
“আপনি একদম এমন ভাবে বলবেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“হয়তো।”
“আমি ফিরবো, আমার জন্য একটু অপেক্ষা করবেন।”
“কত বছর অপেক্ষা করব? আজীবন?”
“এমন বলবেন না।”
এপর্যায়ে ধৈর্য হারালো আয়ুশ। রেগে বললো,”তো কিভাবে বলবো? আর কোন ভাষায় কথা শুনতে চাও তুমি? তুমি কি মনে করো সবকিছু এতটাই সহজ? তুমি যেভাবে চাইবে সেভাবেই সব হবে? দুনিয়াটা তোমার মর্জি মতো চলবে না ঈশিতা। তোমার জন্য আজ আমার বাবা প্রথমবার আমার গায়ে হাত তুলেছে, আমাদের সংসারে অশান্তি হচ্ছে শুধু তোমার জন্য। আমি এত সবকিছু মেনে নিতে পারছি না। আমার এবার মুক্তি চাই এসব থেকে।”
“মুক্তি?”
“হ্যাঁ, মুক্তি। তুমি নিজের জীবন নিজের মতো গুছিয়ে নাও। আমি এভাবে দ্বিধা নিয়ে বাঁচতে পারবো না আজীবন। আমার শান্তি চাই।”
ঈশিতা স্তব্ধ, বিমূর্ষ। তবে সে হার মানবে না। আয়ুশকে বলল,”আমি জানি, আপনি মুখে যাই বলুন আপনি আমার জন্য অপেক্ষা করবেন। আমি সেই আশাতেই রইলাম। আজ থেকে ঠিক ৫ বছর পর আমি দেশে ফিরবো। আপনাকে আমার জন্য অপেক্ষা করতেই হবে মিস্টার আয়ুশ, করতেই হবে।”
বলেই ঈশিতা ফোন রেখে দেয়। আয়ুশ মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে বিছানায়। তার কিছু ভালো লাগছে না। সবকিছু এলোমেলো লাগছে। জড়িয়ে যাচ্ছে সবকিছু।
ঐশী ঈশিতাকে ফোন দিলো। ঈশিতা ফোন রিসিভ করতেই ঐশী বলল,”তুমি এত স্বার্থপরতা কেন করছ ঈশিতা? কেন আয়ুশ ভাইয়াকে এত দ্বিধায় রাখছ? তোমার সমস্যাটা কি? আয়ুশ ভাইয়াকে সুখী হতে দিতে চাও না তুমি?”
“তোমায় এসব বলতে বাধ্য নই।”
“তুমি একটা লোভী, স্বার্থপর মেয়ে। যে নিজের ছাড়া কারো কথা ভাবো নি। আয়ুশ ভাইয়ার কথা তো নাই৷ তোমার সাথে এই পৃথিবীর কোন পুরুষই সুখী হবে না। তুমি এক অভিশপ্ত নারী। বিদেশে গেছ, তোমার চরিত্র আর কয়দিন ঠিক থাকবে? তখন কি তোমার মতো দুশ্চরিত্রাকে আয়ুশ ভাইয়া নিজের বউ হিসেবে মানবে? নাকি আমরা তোমায় তালুকদার বাড়ির বউ মানব?”
আমি তোমার দ্বিধায় বাঁচি পর্ব ১৩
“আমার চরিত্র হেফাজত করার দায়িত্ব আমার। এই নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না। এটাই প্রথমবার জন্য আমি কিছু বললাম না। কিন্তু এরপর আমার সম্মন্ধে এমন কিছু বললে আমিও কিন্তু ছেড়ে কথা বলবো না।”