আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ১১
suraiya rafa
বাংলাদেশ মিশনের প্রায় দু’মাস আগে…..
রাশিয়াতে এখন আর গরমকাল নেই,তবে শীতটাও সেভাবে গেঁড়ে বসেনি ভূখণ্ডে।
গভীর রাত হলে মৃদুমন্দ ঠান্ডা শীতল হাওয়ায় খানিকটা কেঁপে ওঠে শরীরের সর্বাঙ্গ তবে তুষারপাত হতে এখনো ঢেড় দেরি।
তুষারপাত হলো এরীশের সবচেয়ে প্রিয় প্রাকৃতিক দূর্যোগ ।প্রচন্ড ঠান্ডায় সবুজ রঙের তরতাজা বিস্তৃত জঙ্গলটা যখন ধবধবে ফ্যাকাশে সাদা লা’শের ন্যায় মৃ’ত ভূখণ্ডে পরিনত হয়, তখন তৃপ্তিতে চোখ জুড়িয়ে আসে ওর।ভেতরের পৈশাচিক সত্তাটা দিগুণ আগ্রহ নিয়ে ফন্দি আঁটতে শুরু করে নতুন কোনো মিশনের, মেতে ওঠে নতুন কোনো মস্তিষ্কের খেলায়।
তবে এই মূহুর্তে প্রকৃতির সামান্য হিমেল হাওয়াতেও টগবগিয়ে ফুটে উঠছে এরীশের দাবানলের মতো মস্তিষ্ক, তুষারপাতের অপেক্ষা করতে গেলে শত্রু নিধনে বড্ড দেরী হয়ে যাবে, চোখের সামনে শত্রুর ফেলে যাওয়া টোপ কে এতো সহজে ছেড়ে দিলে পাইথন প্যারাডাইসের লিডার হওয়ার যোগ্যতা আর রইলো কই? তাছাড়া এরীশ নিজেও তো প্রতিশোধ নিতে চায়, ডেনিয়েল হ্যারিসনের ডানা কেটে দেওয়ার এটাই সূবর্ণ সুযোগ।কারণ, ওর একমাত্র সুন্দরী গার্লফ্রেন্ড এখন এই মূহুর্তে এরীশ হাতেই বন্দী।
পেন্ট হাউজের ব্যাক ইয়ার্ডে আজ ফায়ারফ্লেক্স জ্বালানো হয়েছে, দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা অগ্নিশিখার র’ক্তাক্ত লালিমায় অদ্ভুত গা ছমছমে লাগছে চারিপাশ। ফায়ারফ্লেক্স থেকে কয়েক হাত দূরে চেয়ারের সঙ্গে হাতমুখ বেধে বসিয়ে রাখা হয়েছে ডেনিয়েলের গার্লফ্রেন্ড ববি কে।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
ববির চোখেমুখে ভয়ের ঘনকালো মেঘ।এই পেন্ট হাউজে এসে এরীশকে নিজের লাস্যময়ী রূপে পাগল করতে যেয়ে ও নিজেই যে কতবড় বিপদের মুখে ফেঁসে গিয়েছে তা এতোক্ষণে ভালো মতোই অনুমান করতে পেরেছে ববি। এই মূহুর্তে আদৌও এরীশের থাবা থেকে জীবন নিয়ে বেঁচে ফিরতে পারবে কিনা সেই আতঙ্কেই র’ক্ত ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে মেয়েটার। নিজ মুখে যে কোনোকিছু স্বীকার করবে সেই উপায়টুকুও বাঁচিয়ে রাখেনি গার্ড’স রা, এমন ভাবে মুখ বেধেছে যে টুঁ’শব্দটাও বের হচ্ছেনা ভেতর থেকে । শুধু চোখের কার্নিশ বেয়ে ঝরে যাচ্ছে অনবরত নোনাজল।
একটু পরে ব্যাক ইয়ার্ডে হাজির হয় এরীশ, এসেই ববির মুখোমুখি একটা চেয়ারে পায়ে পা তুলে আরাম করে বসে পরে ও।
তুষার ওর পাশেই রিভলবার হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, এরীশ বসে খানিকক্ষণ ববি মেয়েটাকে পর্যবেক্ষন করে, অতঃপর ঠোঁট কামড়ে হিসহিসিয়ে বলে,
—- টোটাল মিস্টেক, ডেনিয়েল তোমাকে পুরোপুরি একটা বিচ বানাতে পারেনি বেবিগার্ল। কারণ তুমি আজ জামাকাপড় খুলে যাকে সিডিউস করায় ব্যস্ত ছিলে ওটা আসলে আমি ছিলাম ই না, তুষার ছিল।
আঙুলের ইশারায় তুষারকে দেখিয়ে দেয় এরীশ, সঙ্গে সঙ্গে টাইয়ের নটে হাত দিয়ে খক খক করে কেশে ওঠে তুষার।
— এনিওয়ে তুমি আমাকে এর আগে দেখোনি এটা তোমারও মিস্টেক নয়, অফকোর্স এটা তোমার গডফাদার ডেনিয়েলের মিস্টেক।
অত্যন্ত ঠান্ডা স্বরে ববিকে কথাগুলো শুনিয়ে, তুষারের দিকে না তাকিয়েই নিজের সিল্কি কালো চুল গুলোতে ব্যাকব্রাশ করতে করতে এরীশ ওকে আদেশ দিয়ে বললো,
—- ডেনিয়েল কে ভিডিও কনফারেন্সে নিয়ে এসো।
তুষার তৎক্ষনাৎ তাই করলো, ডেনিয়েলকে ভিডিও কল দিয়ে ম্যাকবুকটা ববির সামনে ছোট্ট একটা সেন্টার টেবিলের উপর রেখে দিলো সে। স্ক্রিনে ববির এহেন হাল দেখা মাত্রই ওপাশ থেকে উদ্বিগ্ন কন্ঠস্বর ভেসে এলো ডেনিয়েলের,
— বেবিগার্ল, হোয়াট হ্যাপেন টু ইউ? আর ইউ ওকে?
তৎক্ষনাৎ দক্ষ হাতে ম্যাকবুকটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো এরীশ,স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ক্রুর হেসে শুধালো,
— নিজের বিচ কে স্পাই বানিয়ে পাঠিয়ে আমাকে জব্দ করতে চেয়েছিলে তাই তো মি.ডেনিয়েল? কিন্তু কি বলোতো তোমার বিচ টা তোমার মতোই বোকা।
—- ডোন্ট কল হার বিচ,শী ইজ নট আ স্লাট,শী ইজ মাই গার্ল, এন্ড আই লাভ হার।
ডেনিয়েলের কর্কশ আওয়াজ ভেসে এলো মনিটরের ওপাশ থেকে।
ওর কথায় ঠোঁটের হাসি প্রসারিত হলো এরীশের, যেন মাত্রই কোনো মশকরা করেছে ডেনিয়েল,
— ওকে কিছু করোনা,আমরা একটা ডিলের মাধ্যমে সমঝোতায় আসতে পারি, দরকার পরলে Bratva এর সাহায্যে….
উদভ্রান্তের মতো কথা বলে যাচ্ছিল ডেনিয়েল,তখন হুট করেই ওর মুখের উপর কথা ছুড়লো এরীশ,
—- তুমি বোধায় ভুলে যাচ্ছো Bratva আমার কথায় চলে,ইভেন Bratva এর কোনো মাফিয়া বস ই আমার কথার বাইরে গিয়ে তোমাকে সাহায্য করতে আসবে না, কারণ তুমি রুলস ব্রেক করেছো, আমার টেরিটোরিতে নিজের স্পাই পাঠিয়েছো।
এবার সত্যিই ক্ষীণ হয়ে এলো ডেনিয়েলের গলার স্বর, সে খানিকটা কাহিল কন্ঠে এরীশকে অনুনয় করে বললো,
—- প্লিজ এরীশস্কা ওকে কিছু করোনা, যা প্রতিশোধ নিতে হয় আমার সাথে মোকাবিলা করো। আমি ববিকে সত্যিই ভালোবাসি।
— ভালোবাসি? একটা মাফিয়া বস হয়ে কাউকে কি করে ভালোবাসতে পারো তুমি ডেনিয়েল? তাও আবার সেটা নিজের শত্রুর সামনে এভাবে জাহির করছো? সিরিয়াসলি!
হাসলো এরীশ, পরবর্তীতে মুখভঙ্গিমা গম্ভীর করে কঠিন গলায় বলে উঠলো,
— একজন মাফিয়া কোনোদিন কাউকে ভালোবাসতে পারেনা,কিন্তু তুমি বেসেছো। তাই তুমি অনেক দূর্বল ডেনিয়েল, নিজের এই দূর্বল আত্মাটাকে নিয়ে আমার সাথে আর কখনো গেইম খেলতে এসোনা, নইলে এভাবেই মা’রা পরবে,
কথা শেষ করে তুষারের হাত থেকে রিভলবারটা ছিনিয়ে নিয়ে পেছনের একটা গার্ডকে পয়েন্ট করে আচমকা গু’লি ছুড়লো এরীশ।
এরপর সামনে ঘুরে রিভলবারে থাকা সবকটা গু’লি কয়েক ন্যানো সেকেন্ডের মধ্যে পাস করে দিলো সামনে বসা ববির মস্তিষ্কে।
ওর এই আকস্মিক কর্মকান্ডে হতভম্ব সকলে, ভিডিও কলের ওপাশ থেকে ডেনিয়েলের রাগি গর্জন ভেসে আসছে,সে অনবরত চিৎকার করে এরীশকে কঠিন হু’মকি দিয়ে যাচ্ছে। মূহুর্তেই এরীশ রিভলবার থেকে গু’লি ছুড়ে চোখের সামনে গোটা ম্যাকবুক টাই ভেঙে ফেললো। তুষার চট করেই কোমড় থেকে আরেকটা গান বের করে সর্তক অবস্থান নিতে নিতে এরীশকে শুধালো,
— কি হলো হঠাৎ?
এরীশ ঘাড় ফুটিয়ে এদিক ওদিক সর্তক দৃষ্টিপাত করে বললো,
— ডেনিয়েল যখন ভিডিও কনফারেন্সে কথা বলার সময় বারবার হাত নাড়িয়ে কাউকে মোর্স কোড বোঝাচ্ছিল,তখনই সন্দেহ হয়েছিল যে ওদের ব্যাকআপ প্ল্যান আমার পেছনেই রয়েছে। এরপর সন্দেহের পারদটা আরেকটু ঝালিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে ববির পায়ের দিকে লক্ষ্য করলাম, এবং তখনই সিওর হলাম, শী ইজ অলসো আ মাফিয়া গার্ল,কারণ ওর পায়ে ইংরেজি অক্ষরে Bratva ট্যাটু করা ছিল, যেটা আমাদের সবার শরীরেই রয়েছে ।
বর্তমান…….
— আরেহ কি ভাবছো সেই তখন থেকে, তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছি আমি রীশস্কা?
এ্যালেক্স এর কথায় ধ্যান ভঙ্গ হয় এরীশের, সে বিরক্ত ভঙ্গিতে পায়ের উপর পা তুলে কাউচ চেয়ারে গা এলিয়ে বসে।সেন্টার টেবিল থেকে হাতে ওয়াইনের গ্লাস তুলে তাতে সিপ নিয়ে নিরেট স্বরে বলে ,
— কি বলেছিলে শুনতে পাইনি।
— আশ্চর্য মন থাকে কোথায় তোমার?
—ডোন্ড টক টু মাচ, কি বলতে চাইছো সোজাসাপ্টা বলো। আর কাজের কথার বাইরে অন্য কোনো কথা থাকলে বিদেয় হও, তুষার রাস্তা দেখিয়ে দেবে।
এ্যালেক্স খানিকটা মেকি রাগ দেখিয়ে বললো,
— তুমি আমাকে এই স্নো ফলের মধ্যে বিদেয় হতে বলছো? আমাকে? এই টমেটো প্রিন্স কে?
—- আমি দয়ালু নই, তাছারা এটা আমার পেন্ট হাউজ এ্যালেক্স, কথার নড়চড় হলে তোমাকে এই স্নো ফলের মধ্যে মে’রে পুতে রেখে দিতেও আমি দু’বার ভাববো না।
এরীশের বরফ শীতল ধারালো কথার পারদে শুষ্ক ঢোক গেলে এ্যালেক্স, পরক্ষণেই জিভ দিয়ে অধর ভিজিয়ে পুনরায় শুধায়,
—- বলছিলাম যে মি.ডেনিয়েল আর তোমার মাঝে লাস্ট টাইম ঝামেলাটা কি নিয়ে?
— সেটা তোমার না জানলেও চলবে। জাস্ট এনজয় ইওর ড্রিংক।
এ্যালেক্সের জিভ খসে কথা বেরোনোর আগেই ওকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে কর্কশ আওয়াজে কথা ছোড়ে এরীশ।
আজ প্রায় একসপ্তাহের বেশি হয়ে গেলো ঈশানী এই কালো পেন্ট হাউজে পুরোপুরি বন্দি। না, কেউ ওকে হাত পা বেধে তালা মে’রে কক্ষবন্দী করে রাখেনি। তবে গার্ড’সরা নজরবন্দি করে রেখেছে সবসময়।
পেন্ট হাউজের নিচের তলায় যেখানে স্টাফ কোয়ার্টার তারই অন্য পাশে কিচেন কাউন্টার,কিচেন পেড়িয়ে দুটো বারো বাই বারো ফুটের ছোট্ট ছোট্ট রুম, যার একটাতে থাকে ফ্লোরা নামক রুশ মেয়েটি, আর অন্যটাতে ঠায় হয়েছে ঈশুর।
প্রথম ক’দিন ওই ছোট্ট রুমটা থেকে কিছুতেই ভয়ে বের হয়নি ঈশানী, পাছে না ওকে ধরে নিয়ে বিক্রি করে দেয় লোকগুলো।
ভালোবেসে ঠকে যাওয়ার ভীষণ যন্ত্রনা,নিজের করা ভুলের জন্য নিয়তি স্বরূপ সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে একা একটা বন্দি জীবনের গোলকধাঁধায় আটকে পরার বিষন্নতা,পালানোর আকাঙ্ক্ষা, বেঁচে ফেরার আকুতি, সবকিছু মিলিয়ে যেন এক প্রলয়ংকারী ঝড় বয়ে গিয়েছে ঈশুর তনু হৃদয়ের উপর দিয়ে।
কিন্তু এতোকিছুর মাঝেও ঈশানী আবিষ্কার করে ফ্লোরা মেয়েটাকে, মেয়েটা বন্ধু সুলভ, দিনরাত ঈশানীর খোজ নেয় সে।এককথা দু’কথা দিয়ে ঈশুর সঙ্গে ভাব জমানোর পায়তাড়া করে বেড়ায় সারাক্ষণ , কথায় কথায় চঞ্চলা হরিণ শাবকের ন্যায় মিষ্টি করে হাসে,শেষ বিকেলের ম’রা রোদের মতোই স্নিগ্ধ লাগে সেই হাসি।
প্রথম প্রথম ভয়ে কুঁকড়ে থাকলেও ধীরে ধীরে ঈশানীও স্বাভাবিক হতে শুরু করে ফ্লোরার সঙ্গে। যদিও ঈশু সবসময়ের মতোই কথা কম বলে তবে ফ্লোরা ওকে কথা বলতে বাধ্য করে,মনে করিয়ে দেয় দেশে ফেলে আসা সবচেয়ে ভালো বন্ধু নিঝুমের কথা।
ঈশানী তো এটাই ভেবে পায় না যে, ফ্লোরার মতো একটা সাদাসিধে,কূলকূলে বহমান নদীর জলের মতো ঠান্ডা প্রাণোচ্ছ্বল একটা মেয়ে এই মাফিয়াদের কালো দুনিয়ায় করছে টা কি? কিভাবেই বা টিকে থাকছে সে? ঈশানী জানতে চায় ফ্লোরার অতীত,জিজ্ঞেস করলে হয়তো উত্তর দিতে এক মিনিট ও দ্বিধাবোধ করবে না ফ্লোরা। কিন্তু ওই যে, অন্তর্মুখী স্বভাবের দরুন সবকথা সহজেই জিজ্ঞেস করে উঠতে পারে না ও।
এই ক’দিনে ঈশানী আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস লক্ষ্য করেছে এরীশ তুষার কেউই সচারাচর পেন্ট হাউজে থাকেনা, এ ব্যাপারে ফ্লোরাকে জিজ্ঞেস করলে ফ্লোরা জানায়,
—- এরীশ বেশিরভাগ সময়ই রাশিয়ার বাইরে থাকে, কখন আসে কখন চলে যায় সে হদিস কেউ দিতে পারেনা। এছাড়া বিভিন্ন সময় মিশনের উদ্দেশ্যে দেশ ত্যাগ করলে মাসের পর মাস ও কেটে যায় তবুও ফিরে আসেনা এরীশ।
মাঝেমধ্যে এমনও হয়, বহুদিন না ফেরার দরুন আমরা ধরেই নিই এরীশ আর বেঁচে নেই। কারণ মাফিয়াদের জীবন ম’রণের কোনো সিকিউরিটি নেই, মিশনে গেলে আদৌও ফিরে আসবে কিনা তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই, আর এভাবেই চলতে থাকে বছরের পর বছর।
ঠিক তেমনই গত কিছুদিন ধরেই পেন্ট হাউজে নেই এরীশ, ঈশানী অন্তত দেখেনি।
অবশ্য এরীশ গন্তব্যে না থাকলে স্বস্তি লাগে ঈশানীর, ওই সময় গুলোতে একটু শান্তিতে দম নিতে চায় ও। নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার ক্ষুদ্র প্রয়াস বলা চলে, কারণ এরীশ এলেই প্রচন্ড ভয়ে তটস্থ থাকে ঈশানী, কখন যেন আবার ওকে ওইসব নোংরা যায়গা পাঠানোর কথা বলে ফেলে, সেই আতঙ্কে।
বিকেল থেকে চুলায় ভেড়ার মাংস কষাচ্ছে ফ্লোরা,অন্যপাশে কাউন্টারের উপর ময়দার গোলা বানিয়ে সেটাকে অপটু হাতে মেখে খামির বানানোর চেষ্টা চালাচ্ছে ঈশু। ফ্লোরা কখনোই রান্নার কাজে হাত লাগাতে দেয় না ঈশুকে, কিন্তু সম্পর্কটা আগের তুলনায় স্বাভাবিক হওয়ার দরুন ঈশানী নিজেই সময় কাটাতে এসব করে, ফ্লোরাও আগ বাড়িয়ে আর না করেনা ওকে।
একপর্যায়ে ময়দা মাখাতে মাখাতে ফ্লোরাকে উদ্দেশ্য করে ঈশানী শুধালো,
— আচ্ছা ফ্লোরা,এই বিকেল বেলা এতো বড় বান,এতো এতো মাংস, কার জন্য এতো আয়োজন করছো বলোতো? কোন গেস্ট আসবে নাকি? গত কয়েকদিনে আমি যতদূর দেখেছি কেউই বাড়িতে খাবার খায় না। তাহলে?
ফ্লোরা সস প্যানের ঢাকনা তুলে খানিকটা লবন চেখে দেখতে দেখতে ঠোঁট উল্টে বললো,
— কার জন্য আবার বোজোর জন্য।
— এ্যা? এতো কষ্ট করে রান্না করে তুমি ওই ভ’য়ঙ্কর জন্তুটাকে খাওয়াবে? তুমি জানো সেদিন রাতে ও আমাকে কত জোরেই না ধাওয়া করেছিল, ভাবলে এখনো কলিজা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসে আমার।
কথা বলতে গিয়েও খানিকটা ভয়াতুর ঢোক গিললো ঈশানী।
বিশাল সাইজের বান টা ওভেনে ঢুকিয়ে, ওকে আস্বস্ত করে ফ্লোরা বলে,
—- কি করবো বলো? বোজো এরীশের খুব আদরের।তাছাড়া আমার তো কাজ নেই এখানে, বছরের দু’একবার পেন্ট হাউজে ডিনার অথবা লাঞ্চ করে এরীশ, সেদিনই একটু রান্না বান্না করতে হয়। এছাড়া আমিতো শুয়ে বসেই দিন কাটিয়ে দিই।
ফ্লোরার কথার পাছে ঈশানী শুধায়,
—- তুমি এখানে কেন পরে আছো ফ্লোরা? তোমার কি ভয় করেনা ওদের? কেন চলে যাচ্ছ না এই কালো দুনিয়া ছেড়ে, তুমি কি বুঝতে পারো না এখানে থাকা মানে তোমার ভবিষ্যত মরীচিকার মতোই অন্ধকার? নাকি তোমাকেও ওরা জোর করে..
ঈশানীর কথায় মৃদু হাসলো ফ্লোরা,অতঃপর ওকে আস্বস্ত করে বললো,
—- তুমি যা ভাবছো তেমন কিছুই নয় ঈশু, আমার বাবা মা দু’জনই এরীশের আন্ডারে কাজ করতো, ওরাও কিছু বছর আগে একটা মিশনে মা’রা যায়। তারপর থেকেই আমি এখানে আছি।বলতে পারো….
কথা শেষ করতে পারেনা ফ্লোরা, তার আগেই বাইরের তুষার ঝড়ের দিকে চোখ যায় ওর। তুষারের বেগ বেড়েছে তা দেখে মেয়েটা সচকিত হয়ে চট করে কথা ঘুরিয়ে বলে ওঠে,
—- খাবার আমি সার্ভ করে দিয়েছি, তুমি একটু কষ্ট করে গার্ড’সদের হাতে পাত্রটা দিয়ে এসোনা ঈশু। দুপুরের দিকে সামান্য রোদ দেখতে পেয়ে ছাঁদ বারান্দায় অনেক গুলো জামাকাপড় দিয়ে এসেছিলাম, এখন তুষার পরছে, নিশ্চয়ই সবগুলো জামা কাপড় এতোক্ষণে বরফ জমে হাড্ডিতে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছে।
কথা শেষ করে ছাঁদ বারান্দার দিকে দ্রুত ছুট লাগায় ফ্লোরা, ওদিকে খাবারের পাত্র হাতে নিয়ে বোকা বনে যায় ঈশানী, ও তো জানেই না এই বোজো ফোজোর ঘর কোন দিকে।
গার্ড’সরাই বা কোথায় দাঁড়িয়ে আছে? অগত্যা কোন দিকে যাবে না বুঝতে পেরে চেঁচিয়ে ফ্লোরাকে ডাকে ঈশানী,
—- আরে যাবো টা কোন দিকে, সেটা তো বলে দিয়ে যাও?
ওপাশ থেকে সারা দেয় না ফ্লোরা, হয়তো শুনতেই পায়নি। মাফিয়া পেন্ট হাউজ বলে কথা, সাউণ্ডপ্রুফ আর সিকিউর তো হবেই।
এদিকে এরীশ পেন্ট হাউজে না থাকায় খুব বেশি ভাবলো না ঈশানী,খাবারের পাত্র সমেত হাটা দিলো লাউঞ্জের দিকে, কিন্তু এদিকটায় কোনো ঘর নেই, তাই এবার ভয়ে ভয়ে পা বাড়ালো দোতলায়, সেই যে প্রথম দিন এরীশ টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গিয়েছিল তারপর আর কোনোদিন এ মুখো হয়নি ঈশানী।
এতোদিন বাদে আজ আবারও একই পথে পা বাড়াতে কিঞ্চিৎ ভয় করছে ওর, কিন্তু স্বস্তি একটাই আশেপাশে কোথাও এরীশ নেই। তাই কিছুটা আত্নবিশ্বাস নিয়েই এবার করিডোর ধরে হাটা শুরু করে ঈশানী। বিশাল করিডোরের এমাথা ওমাথা খুঁজতে খুজঁতে একপর্যায়ে দেখলো করিডোরের শেষ মাথায় কিছু গার্ড’স দাঁড়িয়ে আছে। মনে হয় তারাই পাহারা দিচ্ছে, তাদের দেখে ঈশুর মনে পরে যায় ফ্লোরা বলেছিল,
—-বোজোর ঘরের সামনে সর্বক্ষন গার্ড পাহারায় থাকে।
তারমানে এরাই হবে হয়তো, সেই ভেবে সামনে এগোয় ঈশানী, সামনে এগোতেই দেখতে পায় একটা বিশালাকৃতির নান্দনিক কারুকাজ করা কালো ফটকের সামনে পাহারায় দাড়িয়ে আছে লোকগুলো , ঈশু তাদের নিকট এগিয়ে গিয়ে ঠোঁটের সাহায্যে শুষ্ক অধর ভিজিয়ে আড়ষ্ট কন্ঠে বলে,
—- খা..খাবার নিয়ে এসেছিলাম।
ঈশুর কথা শোনা মাত্রই দু’পাশে সরে দাড়িয়ে দরজা সামান্য খুলে হাতের ইশারায় ভেতরে এগিয়ে যেতে বলে লোকগুলো। তাদের এই অদ্ভুত রহস্যময়ী কর্মকান্ডগুলো বড্ড ভাবায় ঈশানীকে, ও অমনোযোগী হয়ে এলোমেলো পায়ে ভেতরে যেতে যেতে বিড়বিড় করে বলে ওঠে ,
—- আশ্চর্য লোকগুলো এমন কেন কথা বলতে পারেনা নাকি?
ওদিকে এরীশ, এ্যালেক্স আর তুষার কিছু একটা নিয়ে কথা বলায় ব্যস্ত ভীষণ। ঠিক এমন সময় দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে একটা মেয়ে,যার আগমনে সচকিত হয়ে পেছনে ঘুরে তাকায় ওরা তিনজনই।
রিনঝিন করে ঝঙ্কার তোলা নুপুরের আওয়াজে এরীশের চোখ যায় ঈশানীর পায়ের দিকে, মোমের মতো মসৃণ ফর্সা দুটো পা। প্রচন্ড ঠান্ডার মাঝেও খালি পায়ে তকতকে মেঝের উপর দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা,খালি পায়ে দাঁড়িয়ে থাকার দরুন ফর্সা পা দু’টো র’ক্তিম হয়ে আছে যেন দূধে আলতা বর্ণ তার।পা থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে এরীশের কুটিল দৃষ্টি বিচরণ শুরু করে ঈশানীর সর্বাঙ্গে,পরনে ফ্লোরার থেকে ধার করা ফিনফিনে পাতলা একটা ফ্রক,হাতে খাবারের পাত্র,কাঁধ ছাড়িয়ে পিঠে নেমে আসা রেশমের মতো সিল্কি চুলগুলোর দু’একখানা চুল অবাধ্য সহচরের ন্যায় এলোমেলো হয়ে বিচরণ করছে মুখের ওপর।
হাত আটকে থাকার দরুন ঈশানী চাইলেও সেগুলো ঠিকঠাক করতে পারছে না সহজে, পানপাতার মতো ঢলঢলে সুন্দর মুখশ্রীর এখানে সেখানে লেগে আছে ময়দার গুঁড়ো। হাত দু’টোর ও একই অবস্থা, ময়দায় মাখামাখি সেগুলো। দেখে মনে হচ্ছে ময়দার ড্রাম থেকে মাত্রই উঠে এসেছে মেয়েটা, অথচ এতো এলোমেলোর মাঝেও ঈশানীর সমুদ্রের জলের মতো গভীর নীলাম্বর ওই টানাটানা চোখ দুটো পুরো দুনিয়ার আকর্ষন কেঁড়ে নিতে সক্ষম, যে আকর্ষন থেকে আজ বাদ যায় নি স্বয়ং টমেটো প্রিন্স এ্যালেক্স ও।
আচমকা দরজা ঠেলে এতোগুলো মাফিয়াকে একসঙ্গে দেখতে পেয়ে ভয় আর চকিতে কয়েক মূহুর্তের জন্য হৃদপিণ্ডের কার্জক্রম বন্ধ হয়ে যায় ঈশানীর। কিছুক্ষণের জন্য যেন নড়াচড়া করতেই ভুলে যায় মেয়েটা।পরক্ষনেই এরীশের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি লক্ষ্য করে কোনোকিছু না বলেই আবারও পিছন ঘুরে চোখমুখ খিঁচে দৌড়ে অফিস রুম থেকে বেরিয়ে যায় মেয়েটা।
কয়েক মিনিট, মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানে বৃষ্টি শেষে শীতল হাওয়ার মতোই বুক চিড়ে ভেতরে প্রবেশ করে, আবারও ঝড়ের বেগে অকস্মাৎ হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো মেয়েটা।
এরীশ ভ্রু কুঁচকে থমথমে মুখে চেয়েচেয়ে দেখলো শুধু, ওদিকে ঈশুকে দেখা মাত্রই এ্যালেক্স উত্তেজিত হয়ে তুষারকে শুধালো,
—- ওয়াও কোথায় পেয়েছো একে? পুরোই ভীত হরিণী, আর চোখ গুলো দেখলে? উপসস!
এরীশের ঘোর কাটে এ্যালেক্সের কথায়, ওর চোখেমুখে উচ্ছ্বাসের জোয়ার, তা দেখে এরীশ বলে,
— আমার পেন্ট হাউজের যে কোনো জিনিস থেকে নিজের নজরটা সামলে রাখার অভ্যেস করো এ্যালেক্স, এখানকার সবকিছুই ভীষন দামী।
উচ্ছ্বাসের জোয়ার কমেনা এ্যালেক্সের কন্ঠে, ও কি ভেবে যেন হুট করেই মেঘ না চাইতে জলের মতো একটা দারুণ প্রস্তাব দিয়ে বসে তুষারের কাছে, এরীশকে শুনিয়ে শুনিয়ে এ্যালেক্স বলে,
— রীশস্কা এই মূহুর্তে যেটার জন্য মুখিয়ে আছে, ইভেন যার জন্য ও মিশন পর্যন্ত রেডি করতে চাইছে, সেটা হাতে পাওয়া কিন্তু খুব সহজ।
— মানে?
এ্যালেক্সের কথায় ভ্রু কুঁচকালো এরীশ,
এ্যালেক্স পুনরায় শয়তানি হেসে বললো,
— র’ক্ত হীরক। তুমি যেমন এই অমূল্য পাথরটি নিজের বানতে চাইছো,তেমনই এর বিনিময়ে ডেনিয়েল ও কিছু চায়।
তুষার বললো,
— আমি জানি,আপনি আকারে ইঙ্গিতে মেয়েটার কথা বলছেন। কিন্তু একটা মেয়ের বিনিময়ে ডেনিয়েল কেন আমাদের ব্লাড ডায়মন্ড দিতে যাবে?
—- বিকজ হি ইজ আ ওয়েম্যান হান্টার, মেয়েদের প্রতি ওর আলাদা আসক্তি রয়েছে। গার্ল ফ্রেন্ড ববিকে হারানোর পরে বলতে পারো সাইকোপ্যাথে পরিনত হয়েছে।আই থিংক এরকম একটা সুন্দরী ভার্জিন মেয়ের জন্য ব্লাড ডায়মন্ড দিয়ে দিতে দু’বার ভাববে না ডেনিয়েল।
কিছু একটা ভেবে লম্বা শ্বাস নিলো এরীশ, ভেতরে কিছুটা বাতাস টেনে নিয়ে বললো,
—- সবই বুঝলাম, কিন্তু তুমি এতোটা সিওর কিভাবে হলে ?
—- ডেনিয়েল আমার মিত্র, তুমি চাইলে আমি নিজ দ্বায়িত্বে এই ডিল টা হ্যান্ডেল করতে পারি রীশস্কা।
এরীশ আর কিছুই বলেনা,এ্যালেক্সের জ্বলন্ত কুটিল চোখ আর বাঁকা হাসির দিকে তাকিয়ে ওয়াইনের গ্লাসে সিপ নেয় নির্লিপ্তে।
সন্ধ্যা হয়েছে অনেকক্ষন, বাইরে অবিরত তুষারপাত হচ্ছে, পেজা তুলোর মতোন ঠান্ডা বরফ কুঁচি জমে একেবারে সাদা হয়ে আছে দৃশ্যপট। ফ্রন্ড ইয়ার্ড ছাড়িয়ে চোখের সামনে পুরো জঙ্গলটাই যেন আস্ত এক বরফ খন্ডে রূপ নিয়েছে, দেখলেই কেমন চোখ জুড়িয়ে আসে।
ঝুলন্ত বারান্দার রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বাইরের তুষারপাতের দৃশ্য একমনে উপভোগ করছে ঈশানী।
ঠিক এমন সময় দু’মগ ধোঁয়া ওঠা কফি নিয়ে ওর পাশ ঘেঁষে দাড়ায় ফ্লোরা। ঈশানীর শরীরে গরম কাপড় নেই, কোনো মতে একটা চাদর দিয়ে নিজের শরীর আবৃত করে রেখেছে শুধু, অবশ্য ভেতরের দিকে ঠান্ডাটা অনুভব করা যায়না তেমন , নয়তো সেরকম হলে ঠান্ডায় জমে এতোদিনে ভূত হয়ে যেত ঈশু।
তবে বারান্দার এখানে ভালোই শীত লাগছে, ফ্লোরা এসে ঈশানীর একহাতে কফির মগ ধরিয়ে দিয়ে অন্য হাতটা নিজের সোয়েটারের পকেটে পুরে দিয়ে মিষ্টি হেসে বলে,
— কফিটা পান করো আরাম পাবে।
বিপরীতে ফ্লোরাকে আন্তরিকতা মাখা এক চিলতে হাসি ফেরত দেয় ঈশানী, অতঃপর কফি খেতে খেতে নিচে তাকাতেই ও দেখলো, এই তীব্র ঠান্ডায় স্নো ফলের মাঝেই তাড়াহুড়ো পায়ে পার্কিং লটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে কেউ একজন। পরনে তার মোটা উলের তৈরি ওভার কোট, সেই সাথে কালো গ্লাভস। ঈশানী লোকটাকে দেখে ফ্লোরাকে শুধালো,
— কে উনি?
ফ্লোরা নিচের দিকে উঁকি দিয়ে লোকটাকে ভালোমতো পরখ করে জবাব দিলো,
—- টমেটো প্রিন্স।
— টমেটো প্রিন্স?
উল্টো প্রশ্ন ছুড়ে ভ্রু কুঁচকালো ঈশানী।
ফ্লোরা হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে বললো,
— কান্ট্রি সাইডে ওনার দাদার আমলের একটা টমেটো সসের ফ্যাক্টরী রয়েছে, ওইজন্য ওনাকে সবাই টমেটো প্রিন্স নামেই চেনে।
ঈশানী একটু ভেবে ঠোঁট উল্টে শুধালো,
—তারমানে তো উনি একজন ভালো লোক, তাহলে উনি এই মাফিয়া হাউজে কি করছেন?
ঈশানীর সরলতায় খানিকক্ষণ হাসলো ফ্লোরা, অতঃপর ধাতস্থ কন্ঠে বললো,
— এখানে যে ই আসে সেই কোনো না কোনো মোস্ট ওয়ান্টেড টেরোরিস্ট ঈশু।উনি হলেন টমেটো প্রিন্স এ্যালেক্সান্দ্রেয়। রাশিয়ার নাম্বার ওয়ান ড্রা’গ ডিলার। মজার বিষয় হলো ওনার টমেটো ফ্যাক্টরীতে টমেটো সস নয় বরং ড্রা’গ উৎপন্ন হয়। ড্রাগ পা’চারের সূত্র ধরেই মূলত এরীশের মতো বাঘা বাঘা মাফিয়া বসের সাথে ওঠা বসা রয়েছে ওনার। উনি দেখতে বেশ হাসিখুশি চঞ্চল হলেও ভেতরে ভেতরে ওনার মধ্যে হায়নার বসবাস।
ফ্লোরার কথাগুলো শুনে বিস্ময়ে হতবিহ্বল ঈশানী, কত সহজেই না এদের মতো জানোয়ারের বর্ণনা দিয়ে দেয় ফ্লোরা, শুনে মনে হয় এগুলো যেন কোনো বৈধ পেশা। অবশ্য ফ্লোরাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। রাশিয়া দেশটাই এমন, পৃথিবীর অধিকাংশ মাফিয়া গ্যাং এরই মূল ঘাঁটি এই দেশে অবস্থিত।
পেরিয়ে গিয়েছে আরও তিনদিন, আজ আর সকাল সকাল তুষার পড়ছে না, বরং ঘন কুয়াশার আড়াল থেকে উঁকি দিয়েছে একফালি সোনালী সূর্য কীরণ। মৃদু আঁচের ঝুরঝুরে রোদে বেশ চনমনে লাগছে চারিদিক, পেন্ট হাউজের চারিপাশে জমে থাকা বরফের আস্তর গলতে শুরু করেছে ধীরে ধীরে।
ফ্রন্ট ইয়ার্ডে কৃত্রিম উপায়ে বড় করা সৌন্দর্য বর্ধক ঘাসগুলোতে শিশিরের ছড়াছড়ি,সবমিলিয়ে সুন্দর এক প্রাণোচ্ছ্বল সকাল।
তবে ঈশানীর জন্য আজ সকালটা হতে চলেছে সবচেয়ে অভিশপ্ত আর বিষাদময়, কারণ এরীশ সিদ্ধান্ত নিয়েছে ও ব্লাড ডায়মন্ডের বিনিময়ে ঈশানীকে ডেনিয়েলের ক্লাবে পাঠিয়ে দেবে।
ব্লাড ডায়মন্ড এরীশের বহুবছরের স্বপ্ন, অবসেশন বলা চলে। ওই পাথরের বিশেষত্ব আর মূল্য দুটোই আকাশ চুম্বি, তার চেয়েও বড় কথা মাফিয়া জগতে রাজ করতে হলে পৃথিবী বিখ্যাত এই ব্লাড ডায়মন্ড তো এরীশের কুক্ষিগত করতেই হবে। তাছাড়া ডেনিয়েল হ্যারিসন আপোষে রাজি হয়েছে, এই রকম শান্তিচুক্তি কেইবা হাত ছাড়া করে?
তার জের ধরেই ইতিমধ্যে এ্যালেক্সের তত্ত্বাবধানে ডেনিয়েলের কিছু বিশ্বস্ত গার্ড’স রা এসেছে ঈশানীকে তুলে নিয়ে যেতে।
ঈশানী তখন সবে সবে পাউরুটিতে একটা কামড় বসিয়েছে মাত্র, ঠিক তখনই গার্ড’সা হনহনিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে ওকে জোরজবরদস্তি করতে শুরু করে। প্রথমে বুঝে উঠতে না পারলেও পরক্ষণে ঈশু ঠিকই বুঝতে পারে যে এরীশ ওকে কোথাও পাঠিয়ে দিচ্ছে।
যখনই ব্যাপারটা ঈশানীর বোধগম্য হলো সঙ্গে সঙ্গে যেন পুরো আকাশ ভেঙে পরলো ওর মাথার উপর। ও তৎক্ষনাৎ বাইরে না যাওয়ার জন্য কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে গিয়ে লুকিয়ে পরে কিচেন কাউন্টারের পেছনে। গার্ড’সরা সেখানে থেকে দু’বাহু শক্ত করে চেপে ধরে টেনে হিচঁড়ে বের করে আনে ঈশানীকে। অতিরিক্ত টানা হেঁচড়ার ফলস্বরূপ ওর পরনের ফিনফিনে সফেদ গাউনটা ছিঁড়ে যায় পায়ের কাছ থেকে।
শরীরটা ব্যথা দিয়ে ভরে গিয়েছে অথচ ঈশানীর তাতে বিন্দু মাত্র নজর নেই,ও বারবার নিজেকে ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা করে যাচ্ছে। এক পর্যায়ে যখন জোরজবরদস্তির আর কোনো শক্তি অবশিষ্ট থাকেনা ওর মাঝে, তখনই চিৎকার করে কেঁদে ওঠে ঈশানী, বারবার মিনতি করতে থাকে ওই নিষ্ঠুর গার্ড’স গুলোর কাছে,
— আমাকে ছেড়ে দাও, আমি কোথাও যেতে চাই না, ম’রে গেলেও আমি ওই জায়গাতে যাবো না, কিছুতেই না।
এতোক্ষণ যাবত ফ্রন্ট ইয়ার্ডে দাঁড়িয়ে তুষারের সঙ্গে কিছু একটা নিয়ে আলাপ করছিল এরীশ, হুট করেই পেন্ট হাউজের ভেতর থেকে আসা ঈশানীর আকস্মিক চিৎকারে মস্তিষ্ক সজাগ হয়ে উঠলো ওর। বারবার একই গলার চিৎকার, কান্না, মিনতি ভেসে আসছে ভেতর থেকে। এরীশ নিজের বাঁজপাখির মতো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ভেতরে নিক্ষিপ্ত করে তুষারকে জিজ্ঞেস করলো,
— কি হয়েছে?
— ডেনিয়েলের লোকেরা ওকে নিয়ে আসতে ভেতরে গিয়েছে।
জবাব দেয় তুষার।
এরীশ আর বিপরীতে কিছু বলেনা, তুষার শুধু লক্ষ্য করে মূহুর্তেই এরীশের স্বাভাবিক মুখভঙ্গিমা কঠিন রূপ ধারণ করেছে। ও হাতদুটো মুঠি বদ্ধ করে ঈশানীর চিৎকার না শোনার চেষ্টা করছে।
একটু পরেই গার্ড’সরা টেনেহিঁচড়ে পেন্ট হাউজ থেকে বের করে নিয়ে এলো ঈশানীকে, প্রচন্ড ধস্তাধস্তির ফলে ওর সফেদ গাউনটা ময়লায় ভরে গিয়েছে, জায়গায় জায়গায় ছিড়ে পায়ের কোমল অংশ বেরিয়ে এসেছে চোখের সামনে । তবুও নিজেকে ছাড়াতে মরিয়া ঈশানী, ওকে যখন লন থেকে টেনেহিঁচড়ে ফ্রন্ট ইয়ার্ডে নিয়ে আসা হলো তখনই এরীশকে দেখতে পায় ঈশানী।
ওকে দেখা মাত্রই চিৎকার করে কেঁদে ওঠে মেয়েটা, সেদিনের মতোই কাঁদতে কাঁদতে কাকুতি মিনতি করে বলে,
— আমি যেতে চাইনা অরন্য,আমি ওখানে কিছুতেই যাবো না, ওই জায়গাটা অপবিত্র,আপনি আমাকে ওখানে পাঠাতে পারেন না।
ভীষণ পাপ হবে, অন্যায় হবে, দয়া করে ওদের আটকান, আপনিতো সব পারেন,তাহলে বাঁচাচ্ছেন না আমায়? কেন যেতে দিচ্ছেন আমাকে? আপনি ভালো করেই জানেন ওখানে গেলে ম’রে যাবো আমি,সত্যিই ম’রে যাবো ।
কথা বলতে বলতে একপর্যায়ে ভেজা ঘাসের আস্তর আর ছেঁড়া গাউনে পা বেঁধে এরীশের পায়ের সামনে হুঁমড়ি খেয়ে পরে ঈশানী, যখন ও মাথা তুলে দেখতে পায় এটা এরীশ সঙ্গে সঙ্গে ওর পা দু’টো আঁকড়ে ধরে ঈশু, ভীষণ অসহায় কন্ঠে অনুনয় করে বলে,
—- দয়া করুন, এটা হতে দেবেন না, আমি সারাজীবন আপনার এই কালো দুনিয়ায় আঁটকে থাকতে রাজি আছি। তবুও বাঁচান আমায়। আপনি যা বলবেন তাই শুনবো, কখনো কোনো কৈফিয়ত চাইবো না, তবুও ওদের আটকান একবার বাঁধা দিন, আমি যেতে চাইনা ওখানে, হতে চাইনা ওই নোংরা মানুষদের একজন।
ঈশানী বলেই যাচ্ছিল যতক্ষণ না গার্ডরা পুনরায় ওকে টেনেহিঁচড়ে গাড়ির কাছে নিয়ে যেতে শুরু করে। এরীশ এখনও নিস্প্রভ চোখে কান্নারত ঈশানীর মুখের দিকে চেয়ে আছে। যে পেছনে ঘুরে ওর দিকে নিজের হাতটা বাড়িয়ে রেখেছে, এরীশ জানেনা এই মেয়েটা কেন সবসময় বি’পদের মুখে ওর দিকেই হাত বাড়িয়ে দেয়? মেয়েটা কি বোঝেনা এরীশ যে একটা হার্টলেস।
কিন্তু এই মূহুর্তে যে ওই অশ্রু ভেজা নীল চোখ গুলো আরও একবার আ’গুন ধরিয়ে দিয়েছে এরীশের বুকের পেশীতে। হুট করেই ওর পাপী মনটা পাপের ভয়ে তটস্থ হয়ে উঠেছে। কেন যেন ভেতর থেকে উগড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে নিজের রাগী সত্তাটা, বারবার ভেতর থেকে ধাক্কা অনুভব করছে ও, ভেতরের সত্তাটা মানতে চাইছে না বাস্তবতা, ডেসটিনি ফেসটিনির উর্ধ্বে গিয়ে ওর মন বলছে,
—- ঈশানী সত্যিই পবিত্র, ভীষণ পবিত্র।বসন্তের সদ্যফোঁটা চেরি ব্লোসমের মতোই শুভ্রতা তার সর্বাঙ্গে,ব্লাড ডায়মন্ডের চেয়েও বহুগুন মূল্যবান তার এই পবিত্রসত্তা,তার এই সরলতা।এই মেয়েটাকে পাপ ছুঁতে পারেনা, অসম্ভব, এরীশ সেটা কিছুতেই হতে দিতে পারে না, কিছুতেই না।
মনের ভাবনাকে কোনো অবস্থাতেই দূরে ঠেলে দিতে পারছে না এরীশ। এই মূহুর্তে ওই মহাসমুদ্রের মতো টলটলে অস্রু ভেজা স্নিগ্ধ নীল চোখ জোড়ার তুলনায় শুধু ব্লাড ডায়মন্ড কেন পুরো দুনিয়াটাই তুচ্ছ ঠেকছে এরীশের নিকট।
ওদিকে গাড়িতে ওঠার আগ মূহুর্তেও এরীশের দিকে হাত বাড়িয়ে কাঁদছে ঈশানী। ওর আকুতি ভরা চোখ জোরা প্রতিমূহুর্তে নিঃশ্বাস আটকে দিচ্ছে এরীশের। ঈশানী কিছুতেই গাড়িতে উঠছে না দেখে এক পর্যায়ে রেগেমেগে হাতের রিভলবার দিয়ে ওর মাথায় আঘাত করে বসে একটা গার্ড, সঙ্গে সঙ্গে কপাল কেটে র’ক্ত বেরিয়ে আসে ঈশুর।
ঈশানীর কপাল চুয়িয়ে র’ক্ত গড়িয়ে পড়ছে তা দেখা মাত্রই কয়েক ন্যানো সেকেন্ডের মধ্যে ওই গার্ডের মাথায় রিভলবার তাক করলো এরীশ। মূহুর্তেই পুরো ক্লাইমেক্স বদলে দিয়ে আগুনঝরা তেজি কন্ঠে গর্জে উঠে বললো,
—- এইইইই! ডোন্ট ডেয়ার টু হার্ট হার।
এরীশের কর্মকান্ডে মূহুর্তেই অবাকের সপ্তম আসমানে পৌঁছে গেলো আশপাশে থাকা প্রত্যেকে। পেছন থেকে তুষার ডেকে উঠলো ওর নাম ধরে,
—- এরীশ, কি করছেন?
এই মূহুর্তে কারও কথায় ভ্রক্ষেপ নেই এরীশের, ও ফ্লোরাকে ডেকে পাঠিয়ে আদেশ করে বললো,
—- ওকে ভেতরে নিয়ে যাও ফ্লোরা।
এতোক্ষণ যাবত এককোণে দাড়িয়ে কান্নাকাটি করা ফ্লোরাও এবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে ছুটে এসে একটা চাদরে মুড়িয়ে দ্রুত ভেতরে নিয়ে যায় ঈশুকে।
এর কিছুক্ষন বাদে বড়বড় পা ফেলে এরীশ ও পা বাড়ায় ভেতরের দিকে। পেছন থেকে উদ্বিগ্ন কন্ঠে তুষার ডেকে শুধায়,
আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ১০
—- এটা কি করলেন এরীশ? এর ফল কি হবে ভেবেছেন একবারও?
এরীশ থামলো না,তুষারের কোনো কথার জবাব দেওয়ার প্রয়োজন বোধ না করেই হনহনিয়ে চলে গেলো পেন্ট হাউজের ভেতরে।