আযদাহা পর্ব ৩৩
সাবিলা সাবি
গুহার অন্ধকারে ফায়ারপ্লেসের মৃদু জ্বলন্ত আলোর মাঝে ফিওনা আর জ্যাসপার চুপচাপ বসে ছিল। আগুনের শিখা ফিওনার মুখে উজ্জ্বল আলো ফেলছিল,আর তার চোখের ভেতরে কিছুটা ক্লান্তি আর ক্ষুধার চিহ্ন স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।ঠান্ডা বাতাস প্রবাহিত হচ্ছিল গুহায়,তবে আগুনের তাপে কিছুটা উষ্ণতা অনুভব হচ্ছিল।ফিওনার পেট তখন গুঞ্জন তুলছিল। বেশ কিছু সময় ধরে খালি পেটে বসে ছিল,আর তার তৃষ্ণা তো আরও বেশি অনুভূত হচ্ছিল।সে জানতো, এখনো কিছু খায়নি,পানিও পান করেনি।এমনকি, ড্রাগনের মতো শক্তিশালী জ্যাসপারও কখনো এমন অবস্থায় পড়বে না,কিন্তু সে তো একজন সাধারণ মানুষ।
ফিওনার অবস্থা লক্ষ্য করেই,জ্যাসপার অবশেষে কথা বললো।তার গভীর গাঢ় সবুজ চোখে কিছুটা নরমতা ছিল,”তোমার কি খিদে পেয়েছে,ফিওনা?”
ফিওনা কিছুক্ষণ চুপ ছিল,তার মাথায় খাবারের কথা ঘুরছিল।তারপর মৃদু স্বীকার করে বললো,”হ্যাঁ,খুব খিদে পেয়েছে,আর তৃষ্ণাও,তবে আপাতত পানি পান করতে পারলেই হতো।”
জ্যাসপার মাথা নেড়ে বললো,”ঝরনা থেকে পানি পান করতে পারো।খাবারের ব্যাবস্থা করতে হলে গুহার বাইরে বের হতে হবে।আর এটা বিপদজনক হবে।”
ফিওনা চোখে কিছুটা প্রশান্তি পেল,কারণ তার শরীরের অবস্থা একদম ভালো ছিল না।তৃষ্ণা মেটানোর জন্য সে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে,ঝরনার দিকে এগিয়ে গেল। তার গা থেকে পানি ঝরছিল,আর তার গায়ের সাদা টপস্ টা ভিজে গিয়েছিল,কিন্তু সে কোনোকরম চিন্তা করেনি।শুধু পানি পান করতে ব্যস্ত ছিল।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
জ্যাসপার ফিওনাকে নীরবভাবে লক্ষ্য করছিল। ঝরনার স্ফটিকের মতো পানি উঁচু থেকে নেমে এসে নরম সুরে গড়িয়ে পড়ছিল,আর ফিওনা নিজের হাতে সেই পানি পান করার চেষ্টা করছিল।তার হাতের আঙ্গুলগুলো পানি ছুঁয়ে খুব আলতোভাবে কাঁপছিল, আর তাতে কিছুটা পানির স্প্ল্যাশ ছড়িয়ে পড়ছিল তার শরীরের উপর।জামা ভিজে গিয়ে তার গা,ত্বক যেন একে অপরকে আরও উন্মুক্ত করছিল,প্রতিটি মুহূর্তে যেন আরো বেশি আকর্ষণ জাগিয়ে তুলছিল।
জ্যাসপারের হৃদযন্ত্র দ্রুত বেজে উঠছিল,চোখের দৃষ্টি আর অশ্রুতভাবে তার মধ্যে উথলে উঠছিল এক ধরনের প্রগাঢ় আকর্ষণ।ফিওনার সরলতা আর তার দৃঢ়তায় যেন কিছু একটা ছিল,যা তাকে এক অদ্ভুত টানে আবদ্ধ করছিল।
ফিওনা যখন পানি পান করতে ব্যস্ত ছিল,সে খুবই অবহেলিত মনে হচ্ছিল,কিন্তু জানত না যে এই ভয়ংকর ড্রাগন পুরুষ জ্যাসপার তার প্রতি কতটা আকৃষ্ট।
তার শরীরের প্রতি স্পর্শ,তার শ্বাসে ভেসে ওঠা হালকা গন্ধ,সবকিছুই যেন জ্যাসপারকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছিল।কিন্তু সে কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থেকে সেই দৃশ্যের প্রশংসা করছিল,যাতে কিছুটা গোপনীয়তা থাকে,কিন্তু এর মধ্যে ছিল এক গভীর অনুভূতি,যা দুইজনের মাঝের দূরত্ব কে আরও কমিয়ে দিচ্ছিল।
ফিওনা হঠাৎ চোখ তুলে দেখে,জ্যাসপার তাকে অবিরাম চোখে দেখে যাচ্ছে।তার চোখের মণি দুটি যেন আরও গাঢ় হয়ে উঠেছিল,যেন এক ধরনের আকর্ষণে পূর্ণ ছিল।মুহূর্তের জন্য তারা একে অপরকে কিছু না বলে দেখছিল,যেন দুইটি পৃথিবী একত্রিত হতে চলেছিল।
ফিওনা পানি পান করে ফিরছিল,তার প্রতিটি পদক্ষেপে গুহার ঠান্ডা বাতাস তার গা ভিজিয়ে দিচ্ছিল।হালকা অস্বস্তিতে সে পা বাড়াচ্ছিল,কারণ জানতো,এখনও তার সামনে অনেক কিছু অজানা রয়েছে।কিন্তু আচমকা,জ্যাসপার তার দুই বাহু ধরে তাকে গুহার পাথরের সাথে চেপে ধরলো।
ফিওনার হৃদয় এক লাফে বেড়ে গেল,তার দেহের প্রতিটি রন্ধ্রে একটা অস্বাভাবিক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লো।সে কিছু বলার আগেই,জ্যাসপার আরও কাছাকাছি ঝুঁকে পড়লো।তার শ্বাসের গরম বাতাস ফিওনার মুখের কাছে অনুভূত হচ্ছিল,যেন সে নিজেকে হারিয়ে ফেলবে।ফিওনার পিঠ পাথরের সাথে লাগানো ছিল,আর তার চোখ এক মুহূর্তের জন্য কিছু দেখছিল না,যেন তার চোখের সামনে অন্ধকার হয়ে এসেছিল।
ফিওনার ঠোঁটের আশেপাশে ছোট ছোট পানির বিন্দু জমে ছিল,যেন আকাশের মৃদু ফোঁটা তার মুখে নেমে এসেছে।সেগুলো ধীরে ধীরে তার ঠোঁটে নাচছিল,কিছু একেবারে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিল,যেন সেই মুহূর্তটি স্বপ্নের মতো।বাতাসে ঠান্ডা অনুভূতি ভর করেছে,আর ফিওনার শরীরের প্রতিটি অংশ শিহরিত হয়ে উঠছিল।
জ্যাসপার এক পা এগিয়ে,তার অগ্নিঝরা চোখে যেন আগুনের তাপ ছিল,ঠোঁটের কাছের পানির বিন্দুগুলো নিজের ঠোঁট দিয়ে স্নিগ্ধভাবে শুষে নিলো।তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফিওনার দিকে থেমে ছিল,যেন তিনি তার সমস্ত অনুভূতি বোঝার চেষ্টা করছে।ফিওনার ঠোঁটের নিচে চিবুকে এক কাতর পানি ঝরছিল,তার শরীরের প্রতিটি অঙ্গ শিথিল হয়ে গেছিল।
জ্যাসপার নিঃশব্দে,এক অদৃশ্য সংকেতের মতো, থুতনির পানি নিজের ঠোঁট দিয়ে শুষে নিলো।যেন কিছু বলতে চাইছিলো না,কিন্তু তার প্রতিটি আদলে একটা গভীর অর্থ ছিল।সেই নীরবতা,সেই অদ্ভুত টান ফিওনাকে আরও বিভ্রান্ত করেছিল,এক অজানা কারণে সে আর কিছু বলতে পারছিল না।
ফিওনার মনে বারবার প্রশ্ন উঠছিল,সে কখনোই কোনো পুরুষের স্পর্শে সাড়া দেয়নি।আজ পর্যন্ত একবারও তার শরীর অন্য কোনো পুরুষের হাতে আঁকা হয়নি। কিন্তু জ্যাসপার—তার চোখে যে গভীরতা, যে রহস্য—সেগুলো যেন তাকে এক অদৃশ্য শক্তির মতো বাঁধে। ফিওনার এক অজানা টান অনুভব করছিল,যেন সে প্রতিরোধ করতে পারছে না।
জ্যাসপার তার সবুজ চোখে এক ধরণের প্রভাব নিয়ে আসছিল।চোখের জাদু,যেন সে একজন পুরুষ নয়, একজন গভীর ম্যানিপুলেটর।
জ্যাসপার একদৃষ্টিতে ফিওনার চোখে চোখ রেখেছিল, যেন সে তার সমস্ত অনুভূতিকে এক মুহূর্তে পড়ে ফেলতে চাচ্ছিল।ফিওনার ভেতরের এক অদৃশ্য বাধা, তার আত্মবিশ্বাস,সব কিছু যেন এক চুম্বকের মতো তার দৃষ্টি থেকে মেনে চলছিল।তারপর হঠাৎ এক নিঃশব্দ শ্বাসের মধ্যেই,জ্যাসপার তার হাত ফিওনার ঘাড়ে রেখেছিল।তার স্পর্শ একটানে তাকে আরো কাছে টেনে আনলো,যেন দুই শরীরের মধ্যে কোনও দূরত্ব ছিলই না।
ফিওনার শ্বাসের গতি দ্রুত হয়ে গেল,আর জ্যাসপার তার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো।প্রথমে একটু হালকা, শীতল চুম্বন,তারপর গভীর,ও বোধগম্য এক চুম্বনে তাদের মধ্যে সমস্ত পৃথিবী যেন থেমে গিয়েছিল। জ্যাসপার তার কাঁধে শক্ত করে হাত রেখে,আরো গভীরভাবে চুম্বন করতে লাগলো,যেন সে ফিওনাকে এক অদৃশ্য জালে জড়িয়ে ফেলছে।
ফিওনার মন যেন একেবারে বিব্রত,তাকে কোনো কিছুতেই নিজেকে ধরে রাখতে পারছিল না।অনুভূতি, স্পর্শ,আকর্ষণ—সব কিছু মিলিয়ে সে যেন হারিয়ে যাচ্ছিল।
জ্যাসপার ফিওনার ঠোঁটের কাছে আরো কাছে এগিয়ে এল।তার দৃষ্টি একেবারে গভীর,যেন সে ফিওনার আত্মাকে ছুঁতে চায়।এক মুহূর্তে,তার ঠোঁট ফিওনার ঠোঁটে রুদ্ধ হয়ে গেল,আর তারপর হালকা করে ঠোঁট কামড়াতে লাগলো।কামড়টি ছিল এমন,যেন জ্যাসপার তার আকর্ষণকে আরও গভীর করে নিতে চায়।
ফিওনার দেহে এক শিরশিরে অনুভূতি বয়ে গেল,তার সারা শরীর যেন উত্তপ্ত হয়ে উঠলো।প্রথমে তার মধ্যে কিছুটা বাধা ছিল,তবে জ্যাসপার তার স্পর্শে,তার কামড়ের গভীরতায় এমনভাবে জড়িয়ে ধরেছিল,যেন প্রতিরোধ করার কোনো সুযোগই ছিল না।ফিওনার মনের মধ্যে একধরনের সত্ত্বার লড়াই চলছিল,কিন্তু তার হৃদয়, তার শরীর, সব কিছু যেন জ্যাসপারের কাছে সমর্পণ করতে শুরু করছিল।
জ্যাসপার ধীরে ধীরে ফিওনার টপসের বাটান খুলতে শুরু করলো,তার আঙুলগুলি যেন এক ধরনের মোহময়তায় কাজ করছিল।তার চোখে ছিল এক অদৃশ্য আগ্রহ,আর তার স্পর্শে ফিওনার শরীর সাড়া দিচ্ছিল,যদিও তার মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি ছিল।
হঠাৎ,ফিওনা নিজেকে শক্ত করে ধরে ফেললো।তার হাত দ্রুত এগিয়ে এসে জ্যাসপারের হাতকে বাধা দিলো।”স্টপ ইট,”ফিওনা তার কণ্ঠে কাঁপুনি নিয়ে বললো,কিন্তু তার মধ্যে এক ধরনের দ্বিধা ছিল,যেন তার কথা আর তার শরীরের প্রতিক্রিয়া একে অপরের সাথে মেলাতে পারছিল না।
জ্যাসপার কিছুটা থেমে গেল,তার চোখের গভীরতা আর ফিওনার শরীরের মধ্যে অদৃশ্য বোঝাপড়ার এক ভিন্ন প্রকৃতি তৈরি হচ্ছিল।সে কিছুটা পিছু হটলো,কিন্তু তার দৃষ্টি ছিল একরকম তীব্র,যেন সে ফিওনার প্রতিরোধের পরও তার মন এবং শরীরকে ধীরে ধীরে জয় করতে চাইছিল।
ফিওনার হৃদয়ে একধরনের সংকল্প জন্ম নিলো,সে নিজের অজান্তেই নিজের সীমানা অক্ষুণ্ণ রাখতে চাইল, কিন্তু তার দেহের ভিতর যে আগুন জ্বলছিল,তা অস্বীকার করার মতো ছিল না।
ফিওনা তার চোখে রাগ আর অপমানের ছাপ নিয়ে জ্যাসপারকে সরাসরি দেখতে লাগলো।তার গলায় একপ্রকার তিক্ততা ছিল,যেন কোনো কিছু আর তাকে ভেতর থেকে ধ্বংস করতে পারবে না।”আপনি যা ভাবছেন,আমি তেমন মেয়ে না,” ফিওনা তার ঠোঁট কামড়ে,তীব্র কণ্ঠে বললো,”আপনি আমার সাথে এসব কীভাবে করছেন?কোন অধিকারে?আমাকে কি আপনার রক্ষিতা মনে হয়?”
এই কথাগুলো যেন জ্যাসপারের মাথায় বজ্রপাতের মতো আঘাত করলো।তার চোখে এক মুহূর্তের জন্য অসহনীয় রাগ ফুটে উঠলো।সে মুহূর্তে ফিওনাকে ঝাঁকুনি দিয়ে,তার হাত শক্ত করে ধরে টেনে হিচড়ে গুহার ঝর্নার দিকে নিয়ে যেতে লাগলো।তার প্রতিটি পদক্ষেপ যেন ধ্বংসের সুরে বেজে উঠছিল,আর ফিওনার প্রতিরোধ শুধুই তার জন্য আরও এক অগ্নিপরীক্ষা হয়ে দাঁড়াচ্ছিল।
ঝর্নার সামনে পৌঁছে,জ্যাসপার এক ঝটকায় ফিওনার এক হাত ধরে তাকে ঝর্নার দিকে ঠেলে দিলো।পানি প্রচণ্ড গর্জনে ফিওনার শরীর আর মুখে পড়ছিল,যেন পৃথিবীর সমস্ত অভিশাপ একসঙ্গে এসে তার ওপর আছড়ে পড়ছে।ফিওনার শ্বাস আটকে যাচ্ছিল,তার চোখে পানি আর ঝর্নার জল মিশে গিয়েছিল,আর সে এক মুহূর্তের জন্য দম নিতে পারছিল না।
জ্যাসপার তার কাছে দাঁড়িয়ে,তার কনিষ্ঠতম স্পর্শের চাহিদা নিয়ে ফিওনার প্রতি নিবদ্ধ ছিল,কিন্তু তার চোখে ছিল এক তীব্র তিক্ততা।সে যেন মনে করছিল, এই প্রতিশোধে তার পুরো আত্মা শান্তি পাবে।
ফিওনার শরীর পানির নিচে জলে ভেসে যাচ্ছিল,কিন্তু তার আত্মবিশ্বাস আর কঠোরতা যেন তাকে আরও শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকার সাহস দিচ্ছিল।
যতই ঝর্নার পানি ফিওনার মুখে পড়ছে,ততই তার অন্তরের আগুন আরও তীব্র হচ্ছিল,যেন এক বিপ্লবী সংকল্প তৈরি হচ্ছিল—কোনো কিছুই তাকে ভেঙে ফেলতে পারবে না।
কিছুক্ষণ বাদেই এক ঝটকায় ফিওনাকে তার দেহের মধ্যে টেনে নিয়ে,জ্যাসপার তাকে নিজের কাছে জড়িয়ে ধরলো।ফিওনার সারা শরীর যেন জল থেকে বেরিয়ে এসে ঠান্ডায় কাঁপছিল,তার কাঁধ থেকে পায়ের আঙুল পর্যন্ত অস্থির শীতের অনুভূতি হচ্ছিল।এক মুহূর্তের জন্য,তার শরীর এমনভাবে জড়িয়ে পড়েছিল যে সে আর কোনো প্রতিবাদ করতে পারছিল না।
ফিওনার ঠোঁট ঠান্ডায় জমে গিয়েছিল,নাকে মুখে প্রচন্ড পানি প্রবেশ করেছে।তার চোখে এক ধরনের ভীতি ছিল,কিন্তু জ্যাসপার তার শক্ত হাতে তাকে আরও কাছে টেনে নিয়ে,ঠাণ্ডার সাথে পাল্লা দিয়ে তার গাঢ় উপস্থিতি অনুভব করতে শুরু করেছিল।
জ্যাসপার ফিওনার দিকে তাকিয়ে,তার কণ্ঠে একটা গভীর,অবিচল শাস্তির অনুভূতি নিয়ে বললো:”এটা তোমার শাস্তি,” জ্যাসপারের গলা ছিল সুষম কিন্তু কঠোর,”আমার অনুভূতিকে অপমান করার জন্য।আর মনে রেখো তোমর দ্বিতীয় শাস্তিও পাবে,গ্লাস হাউজে ফিরে সেটা হবে আমার কাছ থেকে পালানোর জন্য শাস্তি।”
ফিওনার শরীর যেন আর সহ্য করতে পারছিল না। ঝর্নার ঠান্ডা পানির তীব্র আঘাতে এক মুহূর্তে তার চোখ অন্ধকার হয়ে এলো,আর সে জ্যাসপারের বুকে ঢলে পড়লো।তার শরীর কাঁপছিল,তবুও কোনো শব্দ বের হচ্ছিল না।পুরোপুরি অচেতন হয়ে সে একদম নীরব হয়ে গিয়েছিল।
জ্যাসপার দ্রুত তাকে কোলে তুলে নিলো,তার শক্ত বাহু দিয়ে ফিওনাকে স্নেহের সাথে ধরে।পাথরের পাশেই বসিয়ে,সে তার মাথাটি হেলান দিয়ে রাখল।ফিওনার মুখের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে,তার চোখের কোণে এক ধরনের অস্বাভাবিক কষ্ট আর এক অদ্ভুত আবেগ ফুটে উঠল।
অবশেষে,জ্যাসপার নিঃশব্দে ফিওনার মুখের দিকে তাকিয়ে,তার গলার মধ্যে শীতল আর গভীর এক ব্যথা মিশিয়ে বললো,”কেনো,হামিংবার্ড,কেনো আমাকে এতোটা রাগিয়ে দাও তুমি?তোমাকে কষ্ট দিলে,তার থেকেও বেশি কষ্ট আমি পাই,জানো না?”
এদিকে মাউন্টেন গ্লাস হাউজে এক অদ্ভুত চাপা অস্থিরতা বিরাজ করছিল।ঝর্ণার নিচের নীলাভ আলোয় চারপাশটি যতটা মনোরম,ভেতরের পরিবেশ ততটাই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত।সবার চোখে একটাই প্রশ্ন—জ্যাসপার আর ফিওনা এখনো ফিরছে না কেনো?
এথিরিয়ন করিডোরের পাশের কাচের দেয়ালের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল,যেন বহুদূরে কিছু খুঁজে বেড়াচ্ছে।তার নীল চোখে এক অদ্ভুত শীতলতা ছিল,কিন্তু মনের গভীরে স্পষ্ট ছিল উদ্বেগ। “জ্যাসু ভাইয়া এত দেরি করছে কেন?সে কোনো সংকেতও পাঠাচ্ছে না।এটা তার স্বভাববিরুদ্ধ,” বললো সে,ঠাণ্ডা গলায়,কিন্তু কথাগুলোর ওজন যেন পুরো ঘরের পরিবেশকে আরো ভারী করে তুললো।
আলভিরা এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। তার রুপালী চুল চাঁদের আলোয় ঝলমল করছিল,কিন্তু তার মুখে গভীর চিন্তার ছাপ। “ওরা কোনো বিপদে পড়েনি তো? তবে ফিওনা একজন মানুষ।পৃথিবীতে তার সঙ্গে কিছু হয়ে গেলে প্রিন্স হয়তো নিজের নিয়ন্ত্রণ হারাবে,” বললো সে,নীরবে।
থারিনিয়াসের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছিল।সে বড় বড় পায়ের শব্দ তুলে করিডোরে হাঁটছিল।তার ফর্সা শরীর রাগের তাপে এক অদ্ভুত আভা ছড়াচ্ছিল।“আমরা আর কতক্ষণ বসে থাকবো?কাল পর্যন্ত অপেক্ষা করবো না!আমি এখনই খুঁজতে বের হবো,”তার গর্জনে যেন পুরো গ্লাস হাউজ কেঁপে উঠলো।
অ্যাকুয়ারা শান্ত ছিল,কিন্তু তার নীলচে সবুজ চোখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট।সে ধীরে ধীরে বললো,“ধৈর্য ধরো,থারিনিয়াস। পৃথিবী আমাদের জন্য অপরিচিত।আমরা যদি ভুল করি,তবে প্রিন্স আর ফিওনা দুজনের বিপদ বাড়িয়ে ফেলবো বরং অপেক্ষা করা উচিত,অন্তত কাল সকাল পর্যন্ত।”
আলবিরার উদ্বেগ অন্য মাত্রায় পৌঁছেছিল।
স্মার্ট ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সে বললো,“ প্রিন্স তো জানে আমরা ওনার জন্য কতটা উদ্বিগ্ন থাকবো।সে কেন সিগন্যাল পাঠাচ্ছে না?এটা নিশ্চয়ই কোনো বিপদের ইঙ্গিত।”
এথিরিয়ন কক্ষের এক কোণে গিয়ে স্থির দাঁড়ালো। “যদি জ্যাসু ভাইয়া নিজে বিপদে থাকে,তবে আমরা একে একে তাকে খুঁজতে যাবো।তবে এখন অস্থির হওয়া কাজের কথা নয়,” বললো সে,তার চিরস্থির গলায়।
গ্লাস হাউজের পরিবেশ থমকে ছিল,কিন্তু সবার মনে প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছিল।যদি কাল সকালের মধ্যে তারা না ফেরে, তবে মাউন্টেন গ্লাস থেকে চারটি বিশাল ড্রাগনের অভিযান শুরু হবে।
সকালবেলা গুহার ভেতর হালকা সোনালি আলো ঢুকতে শুরু করেছে।ঝর্ণার ধার থেকে প্রতিফলিত সূর্যের আলো গুহার দেয়ালে অদ্ভুত এক মোহময় আভা ছড়াচ্ছে।ঠান্ডা বাতাসের স্পর্শে ফিওনা আস্তে আস্তে চোখ খুললো।ধীরে ধীরে তার বোধ ফিরে এলো,আর নিজেকে আবিষ্কার করলো জ্যাসপারের লম্বা,দৃঢ় পায়ের ওপর শুয়ে।তার হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়ে উঠলো, যখন বুঝতে পারলো তার গায়ে তার আগের জামা নেই।
তার শরীরে জড়ানো ছিলো এক ধরনের মখমলের মতো নরম চাদর,যার রঙ গভীর সবুজ।এটা গুহার এক কোণে পাওয়া হয়েছিল,যা হয়তো কোনো প্রাচীন ড্রাগনের বসার আসনের অংশ ছিল।চাদরের প্রান্তে সোনালি সুতার কাজ,যা একে আরো রাজকীয় করে তুলেছে।
জ্যাসপার গুহার দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল।তার শ্বাস-প্রশ্বাস ছিল ধীর,কিন্তু তার মুখাবয়ব এমন ছিল যেন রাতটি তার জন্য সহজ ছিল না।ফিওনা বুঝতে পারলো,ভেজা কাপড়ে তার ঠান্ডা লাগার কারণে জ্যাসপার তার পোশাক বদলে এই চাদরটি তার গায়ে জড়িয়েছে।
ফিওনা সোজা হয়ে বসার চেষ্টা করলো,কিন্তু তার হাতের স্পর্শে চাদরটা পড়ে যেতে চাইলে সে তাড়াতাড়ি সেটি আবার জড়িয়ে নিলো।তার মুখ লাল হয়ে গেল, এক অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতিতে।
জ্যাসপার চোখ খোলার আগেই ফিওনা তার দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে বললো, “আপনি… আমার জামা কেন খুলেছিলেন?”
জ্যাসপার চোখ খুলে তাকে গভীরভাবে দেখলো,যেন তার প্রশ্নটা একেবারে অবান্তর।“তোমার ভেজা কাপড়ে ঠান্ডা আরও বেড়ে গিয়েছিল।তুমি হয়তো টের পাওনি, কিন্তু তোমার শরীর কাঁপছিল,”বললো সে শান্ত গলায়। “ভেজা জামাটা পাল্টে,এই চাদরটা তোমার গায়ে না দিলে তুমি আরও অসুস্থ হতে।”
ফিওনার মুখ আরও লাল হলো।সে কিছু বলার চেষ্টা করলো,কিন্তু জ্যাসপারের কণ্ঠ তাকে থামিয়ে দিলো। “তুমি কী ভেবেছো হুম?
ফিওনার কথায় তার কণ্ঠ কিছুটা কাঁপছিল,লজ্জা আর বিরক্তি মেশানো এক অনুভূতিতে।সে জ্যাসপারের দিকে তাকিয়ে বললো,“তার মানে,আপনি..আমার সব দেখে ফেলেছেন?এটা কীভাবে করলেন আপনি?”
জ্যাসপার তার অবস্থান থেকে সামান্য সোজা হয়ে বসল।তার চোখে এক ধরণের ধৈর্য আর কিছুটা বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠলো।“আই উইশ,যদি দেখার অধিকার পেতাম,”সে ঠান্ডা গলায় বললো,যেন কথাগুলো তার হৃদয়ের গভীর থেকে বেরিয়ে এলো। “কিন্তু তোমার শান্তির জন্য বলছি,সত্যি কিছু দেখিনি। চোখ বন্ধ করে তোমার ভেজা পোশাক সরিয়ে দিয়েছি। তোমাকে ঠান্ডা থেকে বাঁচানোর জন্য করেছি—আর কিছু না।”
ফিওনার মুখ লাল হয়ে উঠলো। তার ভেতরে উত্তপ্ত মিশ্র অনুভূতি দোল খাচ্ছিল।সে এক মুহূর্তের জন্য চুপ করে রইলো,তারপর বললো, “বিশ্বাস করতে হবে আপনাকে…এমনটাই তো বলছেন,তাই না?”
জ্যাসপার সামান্য হেসে বললো,“বিশ্বাস করতে চাইলে করো,না চাইলে নাই।তবে মনে রেখো,আমি শুধু তোমার প্রাণ বাঁচানোর জন্য এটা করেছি।
তার কণ্ঠের দৃঢ়তা আর চোখের গভীর দৃষ্টিতে এমন কিছু ছিল,যা ফিওনাকে আর কোনো প্রশ্ন করতে দিলো না।সে নীরবে তার সামনে বসে থাকা এই রহস্যময়, অথচ যত্নশীল ড্রাগনের দিকে তাকিয়ে রইলো।
ফিওনার চোখে আবারও হতাশার ঝিলিক দেখা দিল। সে চাদরের কোণ মুঠো করে ধরলো,জ্যাসপারের দিকে তাকিয়ে বললো,“কিন্তু…আমার পোশাক কোথায়? আমি এখন কী পরব?”
জ্যাসপার এক মুহূর্তের জন্য নিঃশ্বাস নিলো,যেন প্রশ্নটা তাকে বিরক্ত করছে।তারপর ফায়ারপ্লেসের দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে বললো,“তোমার পোশাক শুকোতে দিয়েছি সেখানে।দেখো।”
ফিওনার দৃষ্টি ফায়ারপ্লেসের দিকে গেল।সেখানে তার পোশাক ঝুলিয়ে রাখা ছিল,গুহার উষ্ণতা আর আগুনের তাপ পোশাকটা দ্রুত শুকানোর জন্য যথেষ্ট। সে চাদর পেঁচিয়ে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালো।গুছিয়ে জামাটা হাতে নিলো,কিন্তু তখনই বুঝতে পারলো,জামা পরে নেওয়ার জন্য একটা সমস্যা থেকে যাচ্ছে।
সে জ্যাসপারের দিকে তাকিয়ে একটু কাঁপা গলায় বললো, “আপনি…আপনি কি একটু ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন?আমি পোশাকটা পরবো।”
জ্যাসপার গভীরভাবে ফিওনার দিকে তাকালো,তার চোখে অদ্ভুত এক মিশ্র অভিব্যক্তি—অধিকারবোধ আর বিরক্তি।কিন্তু কিছু না বলে সে ধীরে ধীরে অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়ালো।তার পিঠের শক্ত গঠন,চওড়া কাঁধ আর উঁচু দৈর্ঘ্য গুহার আলোতে আরও তীক্ষ্ণ দেখাচ্ছিল।
ফিওনা দ্রুত চাদরটা সরিয়ে পোশাক পরে নিলো।কিন্তু তার প্রতিটি নড়াচড়ায় মনে হচ্ছিল,জ্যাসপার তার সবকিছু বুঝতে পারছে,যদিও সে মুখে কিছু বলছে না। জামাটা পরে নেয়ার পর সে ধীরে ধীরে বললো “আমি রেডি।আপনি এবার ঘুরতে পারেন।”
জ্যাসপার ঘুরে দাঁড়ালো,তার চোখে এক ঝলক হাসির আভাস।তারপর মনে মনে বললো“তোমার মতো মিষ্টি ঝামেলা আমি আর দেখিনি,হামিংবার্ড,” সে বললো। “তোমার প্রতিটি মুহূর্তই যেন আমাকে পরীক্ষা নিতে ব্যস্ত।”
ফিওনা জামাটা ঠিক করতে করতে এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেল।তার ভেতরে এক অস্বস্তিকর সন্দেহ উঁকি দিতে লাগলো।জ্যাসপারের কথা আর আচরণ যতটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছিল ততটাই মনে হচ্ছিল,হয়তো সে পুরোপুরি সত্যি বলছে না।
“ড্রাগন আর যাই হোক সে তো একজন পুরুষ…এত কাছাকাছি ছিল…আর কিছুই দেখেনি?এটা কি সম্ভব?” তার মনে প্রশ্নটা বারবার ঘুরপাক খাচ্ছিল।
জ্যাসপার তখন গুহার প্রবেশপথের দিকে হাঁটছিল, যেন কিছুই হয়নি।তার দীর্ঘ,সুশৃঙ্খল চলাফেরা আর নির্লিপ্ত অভিব্যক্তি ফিওনাকে আরও অস্থির করে তুললো।”সে হয়তো বলছে চোখ বন্ধ ছিল,কিন্তু সত্যিই বন্ধ ছিল তো?”
ফিওনা নিজেই নিজের এই চিন্তাগুলোকে থামানোর চেষ্টা করলো।কিন্তু মনের এক কোণে সন্দেহ জমে রইলো।তার সব কিছু যেন ভেঙে পড়ছিল।একজন ড্রাগন হয়েও জ্যাসপারের মধ্যে ছিল অদ্ভুত এক আকর্ষণ,যা তাকে বারবার দুর্বল করে দিচ্ছিল।
তুমি কী ভাবছো?” হঠাৎ জ্যাসপারের গভীর কণ্ঠ ভেতরের দোলাচল ভেঙে দিলো।সে ঘুরে দাঁড়িয়ে ফিওনার দিকে তাকালো,তার চোখে ছিল এক অদ্ভুত প্রশ্নবোধক দৃষ্টি।
“কিছু না,”ফিওনা দ্রুত উত্তর দিলো,কিন্তু তার কণ্ঠে স্বাভাবিকতা ছিল না।
জ্যাসপার ফিওনার প্রতিক্রিয়া খেয়াল করলো।তার ঠোঁটের কোণে সামান্য হাসি ফুটলো। “তোমার সন্দেহ হচ্ছে,তাই না?” সে ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে ফিওনার চোখে চোখ রেখে বললো।“কী নিয়ে সন্দেহ করছো, হামিংবার্ড?যে আমি সত্যি চোখ বন্ধ রেখেছিলাম, নাকি তোমার সম্মান রক্ষা করার জন্য মিথ্যা বলছি?”
ফিওনা তার কণ্ঠে কোনো উত্তর খুঁজে পেল না।তার সন্দেহের উত্তাপে যেন আরও বেশি লজ্জা পেয়ে গেল। কিন্তু সে বুঝতে পারলো,জ্যাসপার তার মনের ভেতরের সবকিছু ঠিকই পড়তে পারছে।
ফিওনা দ্রুত নিজের জামাটা ঠিক করে নিলো। জ্যাসপার ইতিমধ্যেই গুহার ভেতরে ছড়িয়ে থাকা সামান্য জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছিল। “এখন এসব ভাবাভাবি বাদ দাও,”সে বললো,তার কণ্ঠে কঠোরতার আভাস।“আমাদের এখন এই স্থান থেকে বের হতে হবে। সময় নষ্ট করার মতো অবস্থা নেই।”
ফিওনা একবার জ্যাসপারের দিকে তাকালো,তারপর নিজের ভেতরের চিন্তাগুলোকে সরিয়ে রেখে প্রস্তুত হতে শুরু করলো।কিন্তু ঠিক তখনই,গুহার মাটিতে এক অদ্ভুত কম্পন অনুভূত হলো।
প্রথমে কম্পনটা মৃদু ছিল।ফিওনা থমকে দাঁড়ালো। “এটা…এটা কী?”
জ্যাসপার কিছু বলতে যাচ্ছিল,কিন্তু তার আগেই গুহার দেয়াল থেকে ছোট ছোট পাথরের টুকরো খসে পড়তে শুরু করলো।কম্পন দ্রুত বাড়ছিল।বাইরে থেকে গর্জনের মতো শব্দ আসছিল,যেন প্রকৃতির রোষ তীব্র হয়ে উঠছে।
“ভূমিকম্প!” জ্যাসপার তৎক্ষণাৎ ফিওনার দিকে ছুটে গেল।
গুহার ভেতরে পাথরগুলো কাঁপতে কাঁপতে বড় বড় ফাটল ধরতে শুরু করলো।ছাদ থেকে একাধিক বড় পাথরের খণ্ড ধসে পড়ছিল।গুহার দেয়ালের গায়ে জড়ানো শ্যাওলাগুলো ধূলায় মিশে যাচ্ছিল।ফিওনা আতঙ্কে এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল,তার পায়ের নিচে মাটি যেন থরথর করে কাঁপছিল।
গুহার অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছিল।ভেতরের বাতাস ধূলায় ভরে গিয়েছিল।আলো আসছিল গুহার ফাঁক থেকে,কিন্তু সেই ফাঁকগুলোও ধ্বংসস্তূপে ঢেকে যেতে শুরু করেছিল।
“এভাবে হলেতো গুহাটা ধ্বসে পড়বে!” ফিওনা ভীত কণ্ঠে বললো।তার দম বন্ধ হয়ে আসছিল ধূলার চাপে।
চুপ করো!”জ্যাসপার রাগে বললো,কিন্তু তার কণ্ঠে ছিল উদ্বেগের স্পষ্ট ছাপ।“আমি কিছু একটা করব। ্শুধু আমার হাতটা শক্ত করে ধরো।”
বাইরে ভূমিকম্পের গর্জন যেন আরও তীব্র হলো। পাহাড়ের উপর থেকে পাথরের স্রোত নেমে আসছিল। জ্যাসপার দ্রুত গুহার মাটিতে ফাটল দেখে বুঝতে পারলো যে মাটিও অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে।
“আমরা আর এখান থেকে বের হতে পারব না!” ফিওনা চিৎকার করে বললো।
পারব,”জ্যাসপার দৃঢ় কণ্ঠে বললো।
“আমি আছি,তাই তোমার ভয় পাওয়ার কিছু নেই।”
জ্যাসপার ফিওনাকে শক্ত করে ধরে ঝটপট চারপাশ পরখ করতে লাগলো।গুহার প্রবেশপথের কাছে ধসে পড়া পাথরের স্তূপের ভেতর দিয়ে একটা সরু পথ তৈরি হয়েছিল।কিন্তু সেখানে পৌঁছানো ঝুঁকিপূর্ণ ছিল।
“তোমার আমার ওপর ভরসা রাখতে হবে,হামিংবার্ড,” সে ফিসফিস করে বললো।“আমাকে শুধু শক্ত করে ধরে রাখো।”
জ্যাসপার ফিওনাকে নিজের শরীরে সুরক্ষিত করে ধীরে ধীরে সেই সরু পথের দিকে এগোতে লাগলো। তাদের চারপাশে পাথর ধসে পড়ছিল,ধূলায় বাতাস ভারী হয়ে গিয়েছিল।ফিওনার মনে হচ্ছিল,এক মুহূর্তের জন্যও জ্যাসপারের হাত ছেড়ে দিলে সে এই ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে যাবে।
ভূমিকম্পের গতি একটু একটু করে কমতে শুরু করলো।কিন্তু গুহার অবস্থা ছিল ভয়াবহ।জ্যাসপার শেষ পর্যন্ত ফিওনাকে নিয়ে প্রবেশপথের দিকে এগিয়ে গেল।আলো ঝলমল করে তাদের মুখে পড়ছিল,আর দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল পাহাড়ের গাছগুলোও মাটিতে ঢলে পড়েছে।
“আমরা বেঁচে গেছি,” ফিওনা কাঁপা গলায় বললো।
“এখনও পুরোপুরি না,”জ্যাসপার বললো,তার কণ্ঠে দৃঢ়তা।“আমাদের এখানে আরও নিরাপদ বের হওয়ার জায়গা খুঁজে বের করতে হবে।এই পাহাড়ের অংশটা এখনও পুরোপুরি স্থির হয়নি।”
গুহার অবস্থা ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছিল। ভূমিকম্পের কম্পন কিছুটা কমলেও পাথরগুলো এখনও মাঝে মাঝে খসে পড়ছিল।জ্যাসপার ফিওনার মাথাটা নিজের বুকের মধ্যে শক্ত করে ধরে বললো,”আর অপেক্ষা করার সময় নেই।আমাকে এখন কিছু করতে হবে।”
ফিওনা তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো, জ্যাসপারের চোখে এক ধরণের অদ্ভুত জ্বলজ্বল।তার দেহের চারপাশে এক ঝলক আলোর আভা ফুটে উঠলো। “আপনি …আপনি কি করতে চলেছেন?” ফিওনা আতঙ্কিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলো।
“তোমার জীবন বাঁচাতে যা যা প্রয়োজন,” জ্যাসপার শান্ত কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে বললো।
এক মুহূর্তে জ্যাসপারের শরীর রূপান্তরিত হতে শুরু করলো।তার হাত থেকে লম্বা,তীক্ষ্ণ নখ বেরিয়ে এলো, পিঠে বিশাল ডানাগুলো প্রসারিত হলো,এবং তার পুরো শরীরটা ড্রাগনের অবয়ব ধারণ করলো।তার সবুজ চোখ দুটো আগুনের মতো জ্বলছিল,আর সেই চোখে দৃঢ় প্রতিজ্ঞার আভা।
ফিওনা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো।ঔএকদিকে তার মনের ভেতর ভয়,আর অন্যদিকে বিস্ময়। “আপনি আবার ও… ড্রাগন রুপ নিয়েছেন?”সে ফিসফিস করে বললো।
“এখন কোনো প্রশ্ন নয়,হামিংবার্ড,” জ্যাসপার বললো।তার গর্জন পুরো গুহায় প্রতিধ্বনিত হলো।বিশাল ড্রাগনের রূপ নিয়ে সে তার শক্তিশালী লেজ দিয়ে গুহার পথের ধ্বংসস্তূপগুলো এক এক করে সরিয়ে ফেলতে শুরু করলো।তার নখের তীক্ষ্ণ আঘাতে বড় বড় পাথরগুলো চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে পড়ছিল।
এক মিনিটের মধ্যেই একটি সংকীর্ণ পথ তৈরি হলো, যেখানে আলো প্রবেশ করছিল। “পথ তৈরি হয়েছে,”সে গম্ভীর কণ্ঠে বললো। “এবার তোমাকে এখানে থেকে সরাতে হবে।”
জ্যাসপার তার বিশাল ডানাগুলো মেলে ধরলো।তার সোনালী আঁশগুলো আলোতে ঝলমল করে উঠলো। ফিওনা কিছু বলার আগেই সে তার ড্রাগন রূপে নিচু হয়ে ফিওনাকে নিজের পিঠে তুলে নিলো।
“ধরো আমাকে শক্ত করে,” সে বললো।ফিওনা ভয়ে তার শক্ত ডানার কাছাকাছি ধরে নিলো।
এক বিশাল গর্জন দিয়ে জ্যাসপার ডানা মেলে উড়ে উঠলো।গুহার ভেতর থেকে বেরিয়ে এক ঝটকায় সে আকাশে উড়াল দিলো।তার বিশাল ডানা পাহাড়ের বাতাসকে চূর্ণ করে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। নীচে ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে যাওয়া পাহাড় আর ভেঙে পড়া গাছপালা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল।
ফিওনা একবার নিচের দিকে তাকিয়ে কেঁপে উঠলো। এত উঁচু থেকে সবকিছু খুব ক্ষুদ্র দেখাচ্ছিল।সে তার হাত দিয়ে জ্যাসপারের পিঠ আরও শক্ত করে ধরে রইলো।
“তুমি ভয় পাচ্ছো না তো?” জ্যাসপার বললো,তার কণ্ঠে একটি মৃদু তাচ্ছিল্যের ছোঁয়া।
“আমার কিছু বলার মতো ভাষা নেই,” ফিওনা কাঁপা কণ্ঠে বললো।
“কিছু বলতে হবেনা,শুধু উপভোগ করো,” জ্যাসপার বললো।
ফিওনা জ্যাসপারের পিঠে বসে শক্ত করে ধরে রেখেছে, তার মন এখনও গুহার ধ্বংসস্তূপ আর ভূমিকম্পের স্মৃতিতে অস্থির। কিন্তু এক মুহূর্ত পরই,সে অনুভব করলো ড্রাগনের বিশাল ডানার শক্তিশালী ঝাপটায় তারা আকাশে ভেসে উঠছে।বাতাস তার চুলে খেলা করছে ঠান্ডা অথচ মুক্তির স্পর্শ।
তার চোখ ধীরে ধীরে নিচের দিকে গেল।পাহাড়ের চারপাশে সুবিশাল মহাসাগর,যেটি চারদিক থেকে এই পর্বতটিকে ঘিরে রেখেছে।কুয়াশা আর সমুদ্রের ঢেউ একসাথে মিশে এক মায়াবী দৃশ্য তৈরি করেছে।“এই পাহাড় সত্যিই পৃথিবীর বাইরে কোনো জায়গার মতো,” ফিওনা মনে মনে বললো।
তার দৃষ্টি উপরের আকাশে চলে গেল।সূর্যের প্রথম আলোতে আকাশ গোলাপি আর সোনালী রঙে রঙিন হয়ে উঠেছে।মেঘগুলো যেন তুলোর মতো আলতো ভেসে বেড়াচ্ছে। আকাশ থেকে পৃথিবীকে দেখতে পাওয়ার এই অভিজ্ঞতা তাকে এক নতুন রোমাঞ্চে ভরিয়ে তুললো।
“কেমন অবিশ্বাস্য আর দুঃস্বপ্ন মনে হচ্ছে ,” ফিওনা ফিসফিস করে বললো।
“তোমার জন্য তো বটেই,” জ্যাসপার সামনে থেকে বললো,তার ড্রাগন কণ্ঠে বললো।
ফিওনা নিচের দিকে তাকিয়ে আবার বললো,“স্বপ্নই তো ছিলো।এত বছর ধরে ভাবতাম,যদি পাখির মতো উড়তে পারতাম,যদি আকাশ থেকে এই পৃথিবী দেখতে পেতাম…আজ সেটা সত্যি হলো।কিন্তু কল্পনায় কখনও এমন সুন্দর মনে হয়নি।”
জ্যাসপার ডানার ঝাপটায় বাতাসকে ভেদ করে আরও ওপরে উঠতে লাগলো।তার সবুজ সোনালী আঁশগুলো সূর্যের আলোয় ঝিকমিক করে উঠছিল,যেনো আকাশের অংশ হয়ে গেছে।ফিওনার চোখ পড়লো পাহাড়ের চূড়ার দিকে।সে বুঝতে পারলো,এই জায়গা শুধু ড্রাগনদের জন্যই তৈরি।কোনো উরন্ত প্রাণী ছাড়া এই পাহাড় থেকে বের হওয়া অসম্ভব।
“এটাইতো ড্রাগনদের রহস্য আর আভিজাত্যে,” জ্যাসপার বললো,যেন ফিওনার ভাবনা বুঝতে পেরেছে। “এখানে কেউ ইচ্ছেমতো আসতে বা যেতে পারে না।এই পাহাড়কে যারা চেনে,তাদের জন্যই এটা নিরাপদ।”
ফিওনা হেসে বললো “আপনি কি বোঝাতে চাইছেন, আমি এখান থেকে পালানোর চেষ্টা করলে সেটা অসম্ভব?”
জ্যাসপার তার ডানার গতিবিধি সামান্য কমিয়ে বললো, “আমি যা বলেছি,তা বোঝার জন্য তোমাকে পালানোর চেষ্টা করতে হবে না।তবে চেষ্টা করলে,আজকের মতোই অবস্থা হবে।”
ফিওনা তার চঞ্চল মনকে শান্ত করলো।এই মুহূর্তে সে এক অদ্ভুত রোমাঞ্চ আর শান্তির মধ্যে আছে।পৃথিবীর সৌন্দর্য আর আকাশ থেকে পৃথিবী দেখার অনুভূতি তাকে মুগ্ধ করে রেখেছে।
“ঠিক বলেছেন” ফিওনা বললো। “এটা সত্যিই স্বপ্ন পূরণের মতো।”
জ্যাসপার কিছু বললো না,শুধু তার ডানা মেলে মহাসাগরের মাঝখানে উড়তে থাকলো,যেন সে নিজেও এই মুহূর্তকে উপভোগ করছে।
ফিওনার চোখ সজাগ হয়ে উঠলো,আর সে কিছুটা বিস্মিত হয়ে নিচে তাকালো।আকাশে ভেসে থাকা অবস্থায়,দূরে,পাহাড়ের একেবারে শেষে মাউন্টেন গ্লাস হাউজের ঝলমলে দৃশ্য স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছিল।তার স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ গ্লাসের দেয়ালগুলি সূর্যের আলোতে ঝিকমিক করছিল,যেন কোনো জাদুর রাজ্য থেকে বেরিয়ে এসেছে।
“ওইতো,মাউন্টেন গ্লাস হাউজ!” ফিওনা চিৎকার করে বললো,তার কণ্ঠে অবাক হওয়ার পাশাপাশি এক ধরনের স্বস্তি ছিল।”এখানে এসে তো আমি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না,কিন্তু ওই গ্লাস হাউজ এখনও সেখানে দাঁড়িয়ে আছে।”
অতঃপর, এক মুহূর্তে জ্যাসপার ফিওনাকে নিজের শক্তিশালী ড্রাগন পিঠে আঁকড়ে ধরে,গ্লাস হাউজের মাটিতে ধপাস করে পড়ল।শক্তির এক তীব্র ঝাঁকুনিতে তার বিশাল ড্রাগন রূপ বিলীন হয়ে গেল,আর ধীরে ধীরে,সে ফিরে এল তার মানব রূপে।তার বিশাল দেহ সংকুচিত হয়ে মানুষের উচ্চতায় রূপান্তরিত হলো,কিন্তু সেই রহস্যময় আভা,সেই অদ্ভুত শক্তি,তার মধ্যে অবিকল রয়ে গেল।
আযদাহা পর্ব ৩২
ফিওনা,চমকে গিয়ে হতবাক চোখে তাকাল।তার গা শীতল হয়ে এল,তার সারা শরীর যেন এক গভীর অস্বস্তি ও উদ্বেগে ভরে উঠলো।জ্যাসপার তার সামনে দাঁড়িয়ে,পাঁজরের গভীর শ্বাস ফেলে এক পা এগিয়ে এল।তার চোখে এক ধরনের টান ছিল,যা ফিওনার সমস্ত অনুভূতিকে যেন অচেনা করে ফেলছিল।
গ্লাস হাউজের ভেতর এক নিঃশব্দতা,যেন সবকিছু থেমে গিয়েছে।ফিওনার সারা শরীর কাঁপছিল,তবে এক অদ্ভুত টান তাকে সেখান থেকে সরতে দিচ্ছিল না। জ্যাসপার,তার মানব রূপে ফিরেও,যেন সেই অগ্নিস্বরূপ,তাকে তীব্র এক শক্তির জালে বেঁধে ফেলছিল।