আযদাহা পর্ব ৪০

আযদাহা পর্ব ৪০
সাবিলা সাবি

দুদিন পেরিয়ে গেছে।অ্যালিসা আর সিলভা এখনো মাউন্টেন গ্লাস হাউজে অবস্থান করছে।তাদের উপস্থিতিতে জ্যাসপার কোনো মিশনেই যাচ্ছে না।থারিনিয়াস একাধিকবার জিজ্ঞেস করেছে তার পরিকল্পনার ব্যাপারে,কিন্তু প্রতিবারই জ্যাসপার এক কথায় জানিয়ে দিয়েছে— “ফিওনাকে আমি এখানে অ্যালিসা আর সিলভার সঙ্গে একা রেখে যেতে পারব না।”
থারিনিয়াস একটু বিরক্ত হলেও কিছু বলার সাহস করেনি। সে জানে,জ্যাসপারের জেদ ভাঙানো সহজ নয়।অন্যদিকে, ফিওনা এসব কথা শুনে বেশ অস্বস্তি বোধ করছে।সে বুঝতে পারছে না, এটা কি জ্যাসপারের সুরক্ষার অযুহাত নাকি তার প্রতি কোনো অতিরিক্ত অনুভূতি।
অ্যালিসা অবশ্য খুবই স্বাভাবিক আচরণ করছে।যেন কিছুই ঘটেনি।মাঝে মাঝে সে জ্যাসপারের সঙ্গে হাসি-তামাশা করে, আর সিলভা যেন ইচ্ছা করে ফিওনার প্রতি ঈর্ষা প্রকাশ করছে।
এই পরিস্থিতির মাঝে ফিওনার মনে অদ্ভুত এক অস্বস্তি কাজ করছে।তার কাছে মনে হচ্ছে,জ্যাসপারের এই অতিরিক্ত যত্নশীলতা যেন কোনো অজানা ঝড়ের পূর্বাভাস দিচ্ছে।

পুষ্প রাজ পাহাড়ে অবস্থিত গোপন ল্যাবরেটরির ভেতর গুনগুন শব্দে যন্ত্রপাতি চলছিল।বিশাল এক ট্রান্সমিশন ট্যাংক মাঝখানে স্থাপন করা হয়েছে, ষযার চারপাশে লাল ও নীল রঙের লাইট দপদপ করছে।জ্যাসপার,থারিনিয়াস, আর মিস্টার চেন শিং মাথা নিচু করে বিভিন্ন পরিমাপ ও হিসাব-নিকাশ নিয়ে ব্যস্ত।
টেবিলের ওপর রাখা বিশাল স্ক্রিনে ভেনাসের ছবি ফুটে উঠেছে।স্ক্রিনের ডানদিকে বিভিন্ন রাসায়নিক গ্যাসের অনুপাত দেখা যাচ্ছে—অক্সিজেন ৩৭%,হাইড্রোজেন ৪১%, এবং কার্বন ২২%।ভেনাসের বায়ুমণ্ডলে এই উপাদানগুলো প্রেরণ করার মাধ্যমে নতুন পরিবেশ তৈরির পরিকল্পনা চলছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

জ্যাসপার একটি হোলোগ্রাফিক প্রজেকশন তুলে বলল, “ভেনাসের বায়ুমণ্ডলে এই উপাদানগুলো মিশিয়ে দিতে হবে এমন উচ্চমাত্রায় যাতে এটি দীর্ঘস্থায়ীভাবে বায়ুমণ্ডলের ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে।তবে এর জন্য প্রাথমিক পদ্ধতিতে সব গ্যাস সংকুচিত করে উচ্চচাপের ধারায় প্রেরণ করতে হবে।”
থারিনিয়াস তার ডানহাতে পরা প্রযুক্তিগত গ্লাভস দিয়ে কিছু নির্দেশ দিলো।হঠাৎই মাঝের ট্রান্সমিশন ট্যাংকের ভেতরের রঙ পরিবর্তন হতে শুরু করলো।জ্যাসপার বলল,”প্রথম ধাপে,হাইড্রোজেন সংকুচিত করে একধরনের সুপারফ্লুইডে পরিণত করা হবে।”ট্যাংকের ভেতরে থাকা তরল হাইড্রোজেন ক্রমেই স্থির হয়ে ধোঁয়ার মতো ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলো।
মিস্টার চেন শিং তখন একটি কন্ট্রোল প্যানেলে দাঁড়িয়ে বলল,”এই সিস্টেমের মাধ্যমে সংকুচিত গ্যাসগুলো থারিনিয়াসের বাহনের ইলেকট্রোম্যাগনেটিক স্টোরেজ সেলে পাঠাব।ভেনাসে পৌঁছে এটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় মুক্তি পাবে।”

এরপর জ্যাসপার তার হাতে থাকা পোর্টেবল ডিভাইস দিয়ে আরেকটি নির্দেশ দিলো।সঙ্গে সঙ্গে ট্রান্সমিশন ট্যাংকের আরেক পাশে রাখা অক্সিজেন ট্যাঙ্ক থেকে বিশুদ্ধ অক্সিজেন সংগ্রহ শুরু হলো।এর চারপাশে নীল আলোর ঝলকানি দেখে থারিনিয়াস মৃদু হাসল,” মানুষেরা সত্যিই বিজ্ঞানকে জাদুতে পরিণত করেছ।”
সবশেষে কার্বন সংগ্রহের পালা।এটি আরও জটিল কারণ কার্বনকে কঠিন থেকে গ্যাসীয় অবস্থায় পরিবর্তন করে সংকুচিত করা হচ্ছে।মিস্টার চেন শিং সতর্ক গলায় বলল, “এই প্রক্রিয়ায় খুব বেশি চাপ দিলে মিশ্রণটি অস্থিতিশীল হয়ে পড়তে পারে।”

ট্রান্সমিশন শেষ হলে থারিনিয়াস তার বাহনের কাছে দাঁড়িয়ে গেল।একটি গোলাকার প্ল্যাটফর্ম ভেসে উঠল,যার কেন্দ্র থেকে আলোকরশ্মি বেরিয়ে আসছে।প্ল্যাটফর্মের ওপর রাখা হল সংকুচিত গ্যাসের পাত্র।জ্যাসপার বলল, “সব প্রস্তুত। কালকের মধ্যেই এগুলো ভেনাসে পৌঁছানো হবে।তুমি শুধু গন্তব্যে পৌঁছানোর পর ডিকম্প্রেশন চালু করবে।”
থারিনিয়াস পাত্রগুলো নিজের হাতে তুলে নিয়ে একটি বিশেষ চেম্বারে রাখল,যা ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফোর্স দিয়ে নিরাপদ করা হয়েছে।গম্ভীর কণ্ঠে সে বলল,”আমার উপর ভরসা রাখুন প্রিন্স।ভেনাস এই উপহার সসম্মানে গ্রহণ করবে।”
চূড়ান্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন করে তারা আবার ল্যাবের পর্দা নামিয়ে দিলো যেন এই বিপ্লবী কাজের গোপনীয়তা অক্ষুণ্ণ থাকে।

ল্যাবের ভেতর থমথমে পরিবেশ।জ্যাসপার পর্দার সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ নীরবে তাকিয়ে থাকল।স্ক্রিনে ভেনাসের লাইভ ফিড ভেসে উঠছে—চরম উষ্ণ পরিবেশ,বিষাক্ত মেঘের আস্তরণ।এই মিশনের সফলতা তার জাতির জন্য অপরিহার্য। তবুও,এই মুহূর্তে তার মন বারবার অন্য কোথাও চলে যাচ্ছে। ফিওনা।
জ্যাসপার ধীরে ধীরে মুখ তুলে বলল, “থারিনিয়াস,এই মিশন তোমার হাতে দিচ্ছি।”
থারিনিয়াস অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল, “সাথে আপনি গেলে ভালো হতো না?এতো গুরুত্বপূর্ণ উপাদান আমার হাতে দিলে যদি কোনো ভুল হয়ে যায়?”
জ্যাসপার সামনের দিকে কয়েক ধাপ এগিয়ে তার সামনে দাঁড়াল।সবুজ চোখদুটো দৃঢ়তায় জ্বলছিল।”তুমি আমাকে চেনো না থারিনিয়াস?আমি কাউকে এত সহজে বিশ্বাস করি না।তবে তুমি আমার অনুগত সঙ্গী।এই কাজে আমার চেয়ে বেশি তোমার অভিজ্ঞতা আছে।”

থারিনিয়াস এক মুহূর্ত ভেবে নিল। তারপর বলল,”আপনার আসল কারণটা বলুন প্রিন্স।আপনি কেন যাচ্ছেন না?”
জ্যাসপার এক চিলতে হাসি দিয়ে বলল,”এটা ব্যক্তিগত। আমি ফিওনাকে একা রেখে যেতে পারি না।ও এই পরিবেশে নতুন,এবং এখানে অ্যালিসা আর সিলভা রয়েছে।আমি ওকে সুরক্ষিত রাখতে চাই।”
থারিনিয়াস কিছুক্ষণ নীরবে তাকিয়ে থেকে বলল,”আপনি সত্যিই বদলে যাচ্ছেন,প্রিন্স অরজিন।একজন মানুষের জন্য এতটা চিন্তা—”
জ্যাসপার হাত তুলে থামিয়ে দিল।”এটা নিয়ে এখন আলোচনা করার সময় নেই।তুমি প্রস্তুতি নাও।সবকিছু সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে হবে।”
ল্যাবের একপাশে রাখা সংকুচিত গ্যাসের কন্টেইনারগুলো থারিনিয়াসের দিকে নির্দেশ করে জ্যাসপার বলল,”তোমার বাহন সম্পূর্ণ নিরাপদ,এবং ভেনাসে পৌঁছানোর সময় সব ধাপে যোগাযোগ করবে।আমি তোমার অবস্থান সবসময় পর্যবেক্ষণ করব।”

থারিনিয়াস তার ডান হাত বুকে রেখে সম্মানের ভঙ্গিতে বলল, “আপনার আদেশ যথার্থ ,প্রিন্স।”
জ্যাসপার এবার চেয়ারে বসে গভীরভাবে শ্বাস নিল। ফিওনার মুখটি মনে পড়ল। ষসে জানে,এই মিশন তার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ,কিন্তু ফিওনার সুরক্ষা তার কাছে এখন সবার আগে।”আমার দায়িত্ব শুধুই আমার জাতির প্রতি নয়। আরেকটি দায়িত্ব এখন আমার কাছে নতুনভাবে এসেছে।” সে মৃদু স্বরে বলল।
থারিনিয়াস প্রস্তুতি নিয়ে দ্রুত ল্যাব থেকে বেরিয়ে গেল। জ্যাসপার স্ক্রিনে চোখ রেখে গভীর মনোযোগে পরবর্তী পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে লাগল,যেন সবকিছু নিখুঁতভাবে সম্পন্ন হয়।

রাতের বেলায় জ্যাসপার দরজা দিয়ে ঢুকেই সোজা লিভিং রুমে গেল।তার সাদা শার্টটা ভেজা তুষারে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, তাই সে এখন কালো শার্টের ওপর লম্বা হুডি পরে আছে। লিভিং রুমের আলো মৃদু,আগুনের কুণ্ডলী চিমনিতে জ্বলছে। কিন্তু অ্যালিসার মুখের অভিব্যক্তি দেখে মনে হলো যেন আলোও এখানে গম্ভীর হয়ে গেছে।
জ্যাসপার থমথমে গলায় বলল,”অ্যালিসা,এত রাতে এখানে বসে আছো কেনো?”
অ্যালিসা উঠে দাঁড়াল,তার নীলচে পোশাক বাতাসে হালকা দুলছে।একটু চঞ্চল কণ্ঠে বলল, “আপনার জন্য বসে আছি, প্রিন্স।”

জ্যাসপার এক মুহূর্তের জন্য থেমে তাকে নিরীক্ষণের দৃষ্টিতে দেখল।তারপর গম্ভীরভাবে বলল,”আমার জন্য খামোখা অপেক্ষা করছো কেনো?তুমি জানো না,আমার সময়ের কোনো ঠিকঠিকানা নেই।”
অ্যালিসা এক পা এগিয়ে এসে মৃদু স্বরে বলল,”জানি।কিন্তু তবুও মনে হলো আপনার সাথে কিছু কথা বলা দরকার।”
জ্যাসপার ভ্রু কুঁচকে তাকাল,”তোমার কথাগুলো কি এত জরুরি যে রাত জাগতে হবে?”
অ্যালিসা এক মুহূর্ত চুপ রইল।তারপর একটু সাহস নিয়ে বলল, “প্রিন্স আপনি নিজেকে সবসময় দূরে রাখেন।কিন্তু আপনার প্রিয়জনরা কখনো আপনার থেকে দূরে থাকে না। আমরা সবসময় আপনার আশেপাশে থাকি।”
জ্যাসপার হালকা বিরক্তি নিয়ে একপাশে বসে পড়ল। হাত দিয়ে চুল সরিয়ে বলল, “তুমি জানো,অ্যালিসা,আমি আমার কাজ নিয়ে ব্যস্ত।ব্যক্তিগত সম্পর্কের জন্য আমার কাছে সময় নেই।আর এটাই আমি শুরু থেকেই বলেছি।”
অ্যালিসা এবার একটু অভিমান নিয়ে বলল, “আপনার ব্যক্তিগত সম্পর্কের জন্য সময় নেই,কিন্তু ফিওনার জন্য সব কিছুতে সময় হয়ে যায়,তাই না?”

জ্যাসপার মুহূর্তে চুপ হয়ে গেল।তার চোখের গভীরে একটা অদ্ভুত আলো জ্বলে উঠল,যেন প্রশ্নটা তার ভেতর কোনো না বলা সত্যকে ছুঁয়ে দিয়েছে।কিন্তু সে শান্ত গলায় বলল, “তুমি যা বলছো,অ্যালিসা,তার কোনো ভিত্তি নেই।আমি যা করি, তা আমার সিদ্ধান্তে করি।”
অ্যালিসা এবার আর কোনো উত্তর দিল না।সে জানত, জ্যাসপারের সামনে বেশি যুক্তি দিয়ে লাভ নেই।সে একপাশে ফিরে আসনটিতে বসে বলল,”ঠিক আছে,আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করেছিলাম।এখন আমি যাচ্ছি।”
জ্যাসপার তার যাওয়া দেখল,কিন্তু কিছু বলল না।তার চোখে গভীর এক চিন্তার ছাপ ফুটে উঠল,যা শুধু অন্ধকার রাতেই প্রকাশ পায়।

জ্যাসপার ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেল।তার ভারী বুটের শব্দ শীতল মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ছিল।তুষারের স্নিগ্ধতা যেন এখনও তার চুলের শেষ প্রান্তে আটকে ছিল।উপরে পৌঁছে,সে এক মুহূর্ত থেমে ফিওনার কক্ষের দরজার সামনে দাঁড়াল।চোখের পলকে তার আঙুল সাইড প্যানেলে গিয়ে স্পর্শ করল।একটি লাভ-সিগন্যাল সক্রিয় হয়ে উঠল—একটি লালচে আলো যা ধীরে ধীরে জ্বলতে নিভতে লাগল।
এই সিগন্যালটা এই দুদিন আগেই সেট করে নিয়েছে জ্যাসপার আগেই ফিওনাকে সব বুঝিয়ে দিয়েছিল।এর মানে একটাই—জ্যাসপার তাকে এখন তার কক্ষে চায়।এটি কোনো আদেশ নয়,কিন্তু তা এক ধরণের অনুরোধ।যদিও জ্যাসপারের মতো একজনের পক্ষ থেকে অনুরোধ শব্দটি একটু অবাস্তব মনে হয়।

ফিওনা তখন নিজের বিছানায় বসে একটি বই পড়ছিল। আলো কমিয়ে দেওয়া ছিল,বাইরের হিমশীতল বাতাস দেয়ালের কাঁচে ধাক্কা দিচ্ছিল।হঠাৎ সিগন্যালের আলো তার চোখে পড়ল।
সে জানত,এটি অবহেলা করার মতো কিছু নয়।জ্যাসপারের উপস্থিতি এবং সিদ্ধান্ত সবসময় অদৃশ্য শক্তির মতো কার্যকর।ফিওনা বইটি পাশে রেখে উঠে দাঁড়াল।তার মনে প্রশ্ন জাগল,এত রাতে হঠাৎ কেনো ডেকেছে?
ফিওনা দ্রুত তার শালটি গায়ে জড়িয়ে দরজা খুলে বাইরে বের হলো।লম্বা করিডোরটি ফাঁকা,তবে করিডোরের শেষ প্রান্তে জ্যাসপারের কক্ষের দরজার নিচ থেকে হালকা আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে।ফিওনা ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগল,তার মনে অজানা উত্তেজনা।

কক্ষে প্রবেশ করার আগে ফিওনা এক মুহূর্ত থেমে গভীর শ্বাস নিল। তারপর দরজার সামনে দাড়াতেই স্লাইডিং হয়ে খুলে যায় আর ফিওনা ভেতরে ঢুকল।
জ্যাসপার কাঁচের দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল।বাইরে বরফে ঢাকা পাহাড়ের দৃশ্য চাঁদের আলোয় ঝলমল করছিল। জ্যাসপারের চোখে গভীর চিন্তার ছাপ ছিল।সে ধীরে ধীরে ঘুরে ফিওনার দিকে তাকাল।
“তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম হামিংবার্ড,” বলল জ্যাসপার শান্ত গলায়,তার গ্রীন আইরিস যেন আরও রহস্যময় দেখাচ্ছে।”তোমার সাথে কিছু কথা আছে।”
ফিওনা জানত,যখনই জ্যাসপার তাকে এভাবে ডাকে,তখন তার কথাগুলোর মধ্যে সবসময় কোনো গভীর অনুভূতি লুকিয়ে থাকে।
ফিওনা ধীরে ধীরে আরও কাছে এগিয়ে গেল।তার কণ্ঠে ছিল মৃদু উত্তেজনার আভাস।
“এতো রাতে কেনো ডেকেছেন?যদি কেউ দেখে ফেলে?” ফিওনা তার সন্দেহ আর অস্বস্তি লুকিয়ে রাখতে পারছিল না।

জ্যাসপার হালকা হাসল,তার সবুজ চোখ দুটো যেন গভীর অন্ধকারে জ্বলে উঠল।সে এক পা সামনে এগিয়ে এসে বলল, “আই ডোন্ট কেয়ার অ্যাবাউট এনিওয়ান।”
তার গম্ভীর,দৃঢ় স্বরটি ফিওনার বুকের ভেতর যেন অদ্ভুত শিহরণ জাগাল।চারপাশের নিস্তব্ধতা যেন এই কথাগুলোকেই আরও তীক্ষ্ণ করে তুলল।
ফিওনা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।তার কণ্ঠ কাঁপল একটু। “তাহলে কেনো ডেকেছেন?তাড়াতাড়ি বলুন।”
জ্যাসপার এক মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।তারপর দেয়ালের পাশে গিয়ে বাইরের তুষারময় দৃশ্যের দিকে তাকাল।তার দীর্ঘ নীরবতার পর সে বলল,”আমি যখন তোমাকে ডাকি,তখন কারণ জানতে চাওয়ার প্রয়োজন নেই। কারণটা সবসময় তোমার জন্যই হয়।”
ফিওনা একেবারে স্থবির হয়ে গেল।জ্যাসপারের কথাগুলো সরাসরি,কিন্তু তার চোখের গভীরতা আর অচেনা আবেগ ফিওনাকে আরও বিভ্রান্ত করল।

“কিন্তু,” ফিওনা সাহস করে বলল, “আপনার যা ইচ্ছে তাই করতে পারেন বলে এরকম করবেন?এটা ঠিক না।আমি একটা মানুষ।আপনি কি সেটা বুঝতে পারেন?”
জ্যাসপার ধীরে ধীরে ঘুরে তার দিকে তাকাল।সে এক পা ফিওনার দিকে এগিয়ে এসে বলল, “ঠিক,তুমি মানুষ।কিন্তু তুমি সেই মানুষ,যাকে আমি ছাড়া অন্য কারও কাছে যেতে দেব না।আর এটাই বাস্তবতা,যেটা তোমাকে মানতে হবে।”
তার স্বর গভীর,কিন্তু তার চোখে যেন একটি অদ্ভুত কোমলতা ফুটে উঠল। এই কোমলতা ফিওনাকে বিভ্রান্ত করল,যেন সে বুঝতে পারল না—এটা হুমকি,না ভালোবাসার দাবি।
জ্যাসপার ফিওনার দিকে তাকিয়ে ছিল গভীর দৃষ্টিতে,তার এতটা কাছে যে ফিওনা কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।তার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল,কিন্তু সে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করল।
“একটু নিচু হবেন?”ফিওনার অনুরোধে জ্যাসপার সামান্য ঝুঁকল।তবে তার চোখে মৃদু একটি ছায়া খেলে গেল—একটি ভুল বোঝাবুঝির ছায়া।

সে ভেবেছিল,হয়তো ফিওনা তাকে চুম্বনের জন্য বলছে।তাই সে আরও একটু কাছে এল,এতটাই যে ফিওনার গালে তার নিঃশ্বাস স্পষ্ট অনুভূত হলো।
ফিওনার চোখ তখন বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল।সে মুহূর্তে কিছু বলার ভাষা খুঁজে পেল না।
তবে পরের মুহূর্তেই ফিওনা নিজের হাত বাড়িয়ে জ্যাসপারের চুলে লেগে থাকা তুষারগুলো আস্তে করে মুছে দিল।”এগুলো চুলে লেগে ছিল,”ফিওনা বলল মৃদু হেসে।
জ্যাসপার বুঝতে পারল যে সে ভুল বুঝেছিল।তার ঠোঁটের কোণে এক মুহূর্তের জন্য মৃদু হাসি ফুটে উঠল।
“তাহলে তুমি আসলে আমার চুল ঠিক করতেই চাইছিলে?” জ্যাসপার বলল,গলায় মিশ্রিত মজা আর কৌতূহল।
ফিওনা একটু অপ্রস্তুত হাসল। “হ্যাঁ,তা ছাড়া আর কী? আপনি কেন অন্য কিছু ভাবলেন?”
জ্যাসপার কোনো উত্তর দিল না।তবে তার চোখে একটি মৃদু, দুষ্টুমি মেশানো চাহনি ছিল।সে সামান্য দূরে গিয়ে বলল, “তুমি যদি অন্য কিছু করতে চাইতে,আমি না করতাম না।”

ফিওনা লজ্জায় গাল দুটো লাল করে ফেলল।”আপনার মতো একজন ড্রাগনের কাছে এসব কথা খুব সহজ হবে,কিন্তু আমার জন্য নয়,” সে গম্ভীরভাবে বলল,যদিও তার গলার স্বরে একটি কাঁপুনি ছিল।
জ্যাসপার হেসে বলল,”তোমার সরলতাই তো তোমাকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে, হামিংবার্ড।”
এই কথাগুলো শোনার পর ফিওনা দ্রুত পাশ ফিরল।তার হৃদয়জুড়ে মিশে থাকা লজ্জা আর অজানা উত্তেজনা তাকে আবারও বিভ্রান্ত করে তুলল।
জ্যাসপার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গম্ভীরভাবে ফিওনার দিকে তাকিয়ে বলল,”আজকে তোমাকে একটা জিনিস উপহার দেব।”

উপহারের কথা শুনে ফিওনার চোখে আনন্দের ঝিলিক ফুটে উঠল।তার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি।”উপহার? আপনি আমাকে উপহার দেবেন?তাহলে তো সেটা অবশ্যই বিশেষ কিছু হবে,তাই না?”
জ্যাসপার একটু রহস্যময় হাসল।”তুমি নিজেই তা বুঝবে।”
ফিওনার মুখে তখন কৌতূহল আর উত্তেজনার মিশ্রণ।”কী সেটা?এখনই বলুন!”
জ্যাসপার ধীরে ধীরে সিঁড়ির দিকে হাঁটা শুরু করল। “তাড়াহুড়ো করো না, হামিংবার্ড।উপহার সবসময় সঠিক সময়ে দেওয়া হয়।”

ফিওনা একটু অসন্তুষ্ট মুখ করে বলল,”আপনার এই রহস্যময় আচরণই আমাকে পাগল করে দেয়।”
জ্যাসপার তখন তার হুডির পকেট থেকে একটি লকেট বের করলো।লকেটটি এত সুন্দর যে দেখেই মনে হচ্ছে এটি পৃথিবীর কোনো কিছু নয়।লকেটের মাঝখানে লাভের আকারের একটি পাথর রয়েছে,যা সবুজ রঙের আলোতে জলজল করছে।ফিওনা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে,যেন এই জাদুকরী বস্তুটি তার হৃদয়ের গভীরে নাড়া দিচ্ছে।
জ্যাসপার ফিওনার দুই বাহু ধরে পেছনের দিকে ঘুরিয়ে নিলো,আর আলতো করে ফিওনার পিঠের কাছে থাকা চুল সড়িয়ে দিলো।ফিওনা একটু কেঁপে উঠলো,যেন তার শরীরে একটি চেনা অনুভূতি বয়ে নিয়ে আসছে।
“এটা তোমার জন্য,”জ্যাসপার বলল,তার গলায় গভীর একটি সুর ছিল।”এই লকেটটি শুধু একটি সাজসরঞ্জাম নয়; এটা আমাদের সম্পর্কের প্রতীক।”

ফিওনা অনুভব করল,তার হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়ে যাচ্ছে। জ্যাসপার যত্ন করে লকেটটি তার গলায় পরিয়ে দিলো,যেন এটি শুধুমাত্র একটি গহনা নয়,বরং তার অন্তরের একটি অংশ।
“এখন তুমি সবসময় আমার সাথে থাকবে,”জ্যাসপার বলল, তার চোখে এক ধরনের প্রতিজ্ঞা ছিল।”এটা তোমাকে মনে করিয়ে দেবে,তুমি একা নও,আমি সবসময় তোমার সাথেই আছি।”
ফিওনা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো,তার চোখে জল জমে গেল। “আপনি কি সত্যিই আমাকে এইভাবে ভাবেন?”
“অবশ্যই,”জ্যাসপার উত্তর দিলো।”তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ।”
ফিওনার মন জড়িয়ে গেল এক অদ্ভুত শান্তির অনুভূতিতে। লকেটটি তার গলায় ঝুলে থাকা অবস্থায়,সে বুঝতে পারল যে এই মুহূর্তটি তাদের সম্পর্কের একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা।
“ধন্যবাদ, প্রিন্স,” সে বলল,”এটা সত্যিই অসাধারণ।”

জ্যাসপার তখন পেছন থেকে ফিওনাকে জড়িয়ে ধরলো।তার নিঃশ্বাস ফিওনার কানে এসে পরল,আর সে অনুভব করলো যেন তার হৃদস্পন্দন বাড়ছে।”এটা সাধারণ কোনো পাথর নয় হামিংবার্ড,” জ্যাসপার বললো,তার কণ্ঠে একটি গম্ভীরতা ছিল।”এটা ভেনাসের লাভ স্টোন।”
ফিওনা বিস্মিত হয়ে গেলো।”লাভ স্টোন?এর মানে কী?”
জ্যাসপার ধীরে ধীরে ব্যাখ্যা করতে শুরু করলো।”এটা তখনই পরানো হয় যখন আমাদের ভেনাসে সফটওয়্যার ম্যাচের পর বিবাহ করা হয়।বাসরের আগে,জীবনসঙ্গীনীকে উপহার দিতে হয়।”
ফিওনার মুখাবয়বে হতভম্বতার ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠলো। “আপনি আমাকে এমন একটি বিশেষ উপহার দিলেন?”
“হ্যাঁ,”জ্যাসপার সোজা হয়ে বললো। “এটার আরেকটি বিশেষত্ব হচ্ছে,এর মধ্যে মানব জাতীর এক থেকে দুই বছর পর্যন্ত স্মৃতি সংগ্রহ করে রাখা যায়।তুমি যখন চাও,তখন এই স্মৃতিগুলো দেখতে পারবে।”
ফিওনা এরকম একটি বিষয় জানার পর আরো অবাক হয়ে গেলো।”মানে আমি আমাদের সাথে কাটানো সময়ের স্মৃতি ধরে রাখতে পারব?”

“ঠিক তাই,”জ্যাসপার বললো,”এটা আমাদের সম্পর্কের জন্য একটি চিরস্থায়ী বন্ধন তৈরি করবে।”
ফিওনার হৃদয়ে এক অপরিসীম অনুভূতি বয়ে গেল। “এটা সত্যিই অসাধারণ, প্রিন্স।আমি জানি,আমাদের এই সম্পর্কের মূল্য অনেক বেশি।”
“তুমি এটা নিয়ে চিন্তা কোরো না হামিংবার্ড।আমি তোমাকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি,এই স্মৃতিগুলো সবসময় তোমার জন্য থাকবে।”
ফিওনা তখন কিছুটা মজা করেই বললো, “আরেকটা কাজ করতে পারি আমি। যখন পড়বো, তখন ওই পড়া গুলো এতে কালেক্ট করে রাখবো। তারপর পরীক্ষার খাতায় লিখে নকল করবো!”
এই কথা শুনে জ্যাসপার কাশির মতো হেসে উঠলো, যেন তার হাসি থামতেই চাইছে না। ফিওনা একটু অবাক হয়ে তাকে দেখলো। সাধারণত মৃদু হাসি ছাড়া জ্যাসপার কখনোই এভাবে হাসেনি। এই প্রথমবার তাকে এতটা হাসতে দেখে ফিওনার মনে একটি উষ্ণ অনুভূতি ঢুকে গেল।

ফিওনা জ্যাসপারের হাসি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলো, যেন সেই হাসির মধ্যে হারিয়ে গেছে।জ্যাসপারের হাসি ধীরে ধীরে থেমে গেল।ফিওনা এভাবে তাকিয়ে আছে দেখে জ্যাসপার কিছুটা কাছে চলে আসে।ফিওনা টের পায়নি,তার কোমড় ধরে তাকে আরো কাছে নিয়ে আসলো।
জ্যাসপার ফিসফিস করে বললো,”এবার আমার উপহার দাও।”
ফিওনা কিছুটা অবাক হয়ে বললো,”এখন কিভাবে?”
জ্যাসপার হাসিমুখে বললো,”আমার উপহার হচ্ছে তোমার মিষ্টি কোমল ঠোঁটজোড়া।”
জ্যাসপার ফিওনাকে চুমু দেয়ার আগেই ফিওনা তাকে থামিয়ে দেয়,”এখন না!মনে হচ্ছে অ্যালিসা আসছে!”
জ্যাসপারের চোখে বিরক্তির ঝিলিক।কিন্তু ফিওনা তখনি এক ছুটে পালিয়ে যায়।করিডোর ধরে চলে যাওয়ার সময় ফিওনা সিঁড়ি বেয়ে উপরে আসা অ্যালিসাকে দেখতে পায়। হাতে কফি নিয়ে অ্যালিসা আসছে,আর ফিওনার বুঝতে বাকি থাকে না যে,সে নিশ্চয়ই জ্যাসপারের জন্য কফি নিয়ে আসছে।

ফিওনার মনে রাগ জন্মায়,কিন্তু সে নিজেকে সামলে নিয়ে দ্রুত নিজের কক্ষে ঢুকে পড়ে। “কেন এই সময়ে এই মেয়ে ওনার কক্ষে যাচ্ছে?” মনে মনে কাঁদতে কাঁদতে ফিওনা তার কক্ষের বিছানায় ধপাস করে বসে পড়ে।
এদিকে,জ্যাসপার মুহূর্তটিকে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করে।সে বুঝতে পারে ফিওনা তাকে মিথ্যা বলে পালিয়েছে।একচোট হাসি তার মুখে ফুটে ওঠে। “ঠিক আছে,হামিংবার্ড,”মনে মনে ভাবে,”এবার এমন কিছু করবো যে তুমি নিজেই আমাকে চুমু দেবে।”
জ্যাসপার তার পরিকল্পনা নিয়ে ভেবেচিন্তে নিচে চলে যায়। তার মাথায় কিছু চতুর উপায় ঘুরপাক খাচ্ছে, যা তাকে নিশ্চিত করে দেবে যে ফিওনা আর তার প্রতি অসংবেদনশীল থাকতে পারবে না।রাতের অন্ধকারে,সবকিছু তার পরিকল্পনার দিকে এগিয়ে চলছে।

তখনি অ্যালিসা জ্যাসপারের কক্ষে প্রবেশ করে।হাতে কফি দেখে জ্যাসপার মনে মনে বিরক্ত হয়,তবে মুখে কিছুটা নরমতা রেখে বললো,”এতো রাতে আমার কক্ষে?আর এই সময় কফি?”
অ্যালিসা হেসে উত্তর দেয়,”কেনো,প্রিন্স?আপনি তো যেকোনো সময়েই কফি পান করেন।আমি শুনেছি আলবিরার কাছে,আর ওখান থেকেই রেসিপি জেনেছি এই সুমাত্রা ডার্ক রোস্ট কফির।”
জ্যাসপার কফির কাপটি হাতে নিয়ে এর সুবাসে একবার নাকের কাছে নিয়ে আসে।”সুমাত্রা ডার্ক রোস্ট.. সত্যিই?” তিনি কফির দিকে তাকিয়ে থাকেন,মনে মনে ভাবতে থাকেন, “এখন আমার চিন্তা এখানে নেই।”
অ্যালিসা তখন বললো, “আচ্ছা,আমি এই সময়ে কক্ষে আসাতে আপনি কি বিরক্ত?কিন্তু আমি তো আপনার বাগদত্তা।আপনার কক্ষে আসার জন্য আমার কোনো সময় বা অনুমতি কিছুই লাগবে না।”
তখনই জ্যাসপার কিছু কড়া কথা বলতে যাবে,কিন্তু মুহূর্তেই তার ভাবমূর্তি পাল্টে যায়।সে হাসি নিয়ে বললো “হ্যাঁ, অ্যালিসা,আমি একটুও বিরক্ত হইনি।আমার তো ভালোই লাগছে,তুমি এসেছো আমার কক্ষে। সত্যি,কফিটা দারুণ হয়েছে;এর আগে কেউই এই হাউজে এত ভালো কফি বানাতে পারেনি।”

অ্যালিসার চোখ চকচক করে উঠে।সে বুঝতে পারে, এ কোন জ্যাসপারকে দেখছে!এতো সুন্দর করে প্রশংসা কিভাবে করতে পারে,ভাবতেই পারছে না।তার মধ্যে এক অদ্ভুত অনুভূতি জন্ম নেয়।
এদিকে,ফিওনা তখনই জ্যাসপারের কক্ষে বাইরের সাইডের দিকে দাঁড়িয়ে আড়ি পেতে আছে।কক্ষে বসে তার মন আনচান করছিলো,বিশেষ করে অ্যালিসা যখন জ্যাসপারের কক্ষে এসেছে।এতো রাতে কেন সে এখানে?তার মনে বিভিন্ন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল।ফিওনা দুরু দুরু বুকে দাঁড়িয়ে থেকে ভাবতে লাগলো,”এখন কি হবে?”
ফিওনার মধ্যে কিছুটা সন্দেহ ছিল,কিন্তু সে বুঝতে পারছিলো না,তার হরমোনের ঘ্রাণ জ্যাসপারের নাকে অনেক দূর থেকেই চলে যায়।জ্যাসপারকে চিন্তায় ডুবিয়ে রেখেছে অ্যালিসার উপস্থিতি অথচ ফিওনা পুরো ঘটনাটা আবিষ্কার করতে পারছে না।

কিছুক্ষণ পর,অ্যালিসা আরও কাছে চলে আসে,”আপনি সত্যিই আমার সম্পর্কে কিছু ভাবছেন, প্রিন্স?”
জ্যাসপার, সামান্য বিরক্ত হলেও মুখে হাসি রেখে বলেন, “আমি জানি,অ্যালিসা।তবে আমাকে সময় দাও।”
অ্যালিসা একটু অপ্রস্তুত হয়ে যায়, “আমি জানি,কিন্তু আপনি জানেন তো,আমরা দুজনের সম্পর্ক আরো গভীর করতে আমাদের একসাথে সময় কাটানো উচিত।”
এদিকে, ফিওনার হৃদয়ে আগুন লেগে যায়।সে কিছুটা ক্ষুব্ধ হয়ে মনে মনে বলে,”অ্যালিসা এমন গায়ে পড়া কেনো আর এই ফায়ার মনস্টারটার হঠাৎ ওর সাথে এতো ভালো ব্যবহার করছে কেনো?”
জ্যাসপার তখন ফিওনাকে আরেকটু জ্বালাতে বলতে শুরু করলো,”অ্যালিসা,দাঁড়িয়ে আছো কেন?বসো বিছানায়। আজ তো তোমার খুশির দিন!”

জ্যাসপারের কথায় অ্যালিসা সাথে সাথে বসে পড়লো,তার মুখে হাসি ফুটে উঠলো।কিন্তু তার হাসি স্থায়ী হয়নি,কারণ জ্যাসপার বললো, “একটু বসো,পাঁচ মিনিট।”এটি বলেই সে কক্ষ থেকে বের হয়ে গেলো।
ফিওনা সুযোগ পেলো,সে আবারও উঁকি মারতে যাবে।কিন্তু আচমকাই জ্যাসপার ফিরে আসে আর ফিওনাকে দেখতে পেয়ে তার হাত খপ করে ধরে ফেলে।হাত দুটো একসাথে করে মাথার ওপরে দেয়ালে চেপে ধরলো।
ফিওনা বিস্মিত হয়ে যায়। “এটা কি করছেন?” সে জিজ্ঞেস করে,তার হৃদয় দ্রুত ধকধক করতে থাকে।
জ্যাসপার তখন ফিওনাকে প্রশ্ন করলো,”তুমি এখানে কি করছো?কথা শুনছিলে?”
ফিওনা খানিকটা লজ্জিত হয়ে বললো,”হ্যাঁ,শুনছিলাম। আপনি অ্যালিসার সঙ্গে এতো মাখোমাখো করে কথা বলছিলেন কেন?”

জ্যাসপার আরো একটু নিচু হয়ে এসে বললো,”তোমার কি জেলাসি হচ্ছে?তাহলে তো তখন এমনভাবে পালিয়ে যেতে না।”
ফিওনা একটু গম্ভীর হয়ে বললো,”আপনি বুঝে গেছিলেন আমি এখানে দাঁড়িয়ে আছি?”
জ্যাসপার মুচকি হেসে বললো,”হ্যাঁ,আমি জানতাম।তুমি আমার সামনে আসলেই তোমার শরীরের হরমোনের মিষ্টি ঘ্রাণ আমার কাছে পৌঁছে যায়।”
ফিওনা অবাক হয়ে গেলো।সে বুঝতে পারলো যে জ্যাসপার তার প্রতি কতটা সচেতন।জ্যাসপারের এই কথা শুনে তার মনে অদ্ভুত একটা অনুভূতি জাগ্রত হলো।সে চুপ করে থাকলেও,তার হৃদয় দ্রুত ধড়ফড় করছিল।
জ্যাসপার ফিওনাকে আর কোনো কথা বলতে দিলো না। ফিওনার হাত দুটো এখনো উঁচু করে দেওয়ালের দিকে চেপে ধরেই আছে।এরপর হঠাৎ করেই জ্যাসপার ফিওনার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো।
ফিওনা প্রথমে একটু অবাক হয়ে গেল,তার মনে হলো,সে বুঝি এটা আশা করেনি।কিন্তু এরপর,যখন সে নিজেকে ছাড়াতে গেল, তখনই জ্যাসপার আরও শক্তভাবে ধরে ফেললো।তার চুম্বন ছিল পাগলের মতো,যেন পৃথিবীর সব কিছুর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কেবল এই মুহূর্তটুকুতে আটকে আছে।

ফিওনার হৃদয় ধুকপুক করতে লাগলো।সে ভাবতে লাগলো, এই অনুভূতি কি সত্যি?
জ্যাসপার তখন তার ঠোঁটের কোমল স্পর্শে ফিওনাকে আরও কাছে টেনে নিলো। ফিওনার মনে হচ্ছিল,পুরো পৃথিবী থমকে গেছে।সবকিছু মুহূর্তের মধ্যে বদলে গেল—শুধু তাদের দুইজনের মধ্যে একটি অদৃশ্য সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে,যা প্রতিটি চুম্বনের মাধ্যমে বেড়ে উঠছিল।
জ্যাসপার তখন বললো, “এখন কি তুমি বুঝতে পারছো, আমি তোমার জন্য কতটা পাগল?”
ফিওনা শ্বাস নিতে চেষ্টা করলো,কিন্তু তার চোখের সামনে শুধুই জ্যাসপারের মুখ ছিল।সে বুঝতে পারলো,তার অন্তরে কি অনুভূতি জন্ম নিচ্ছে।
জ্যাসপার ফিওনাকে কোনো প্রতিবন্ধকতা না বুঝে কোলে তুলে নিলো।ফিওনার দুই পা তখন জ্যাসপারের কোমরে জড়িয়ে ধরলো,যেন সে নিরাপদ সুরক্ষিত।জ্যাসপার তার ঠোঁট ফিওনার ঠোঁটে রেখে চুম্বন করতে করতে করিডোর পার করতে লাগলো।
ফিওনার মনে এক অদ্ভুত উত্তেজনা ছিল।সে জানতো অ্যালিসা কক্ষেই আছে,কিন্তু এই মুহূর্তে সে শুধুমাত্র জ্যাসপারের উপস্থিতিতে মগ্ন ছিল।দুইজনের মধ্যে যে আবেগের ঝড় বয়ে চলছিল,তা যেন পৃথিবীর সব কিছু থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছিল।

জ্যাসপার ফিওনাকে ফিওনার কক্ষের বিছানায় আলতো করে ফেলে দিলো।ফিওনার মুখে উদ্বেগ ফুটে উঠলো, “আরে, কি করছেন?অ্যালিসা দেখে ফেলবে!”
জ্যাসপার হেসে বললো,”হুশ,তোমার কক্ষে শুধু আমি আর অ্যাকুয়ারা প্রবেশ করতে পারবো।আমি সেটাই দরজার প্যানেলে সেট করে রেখেছি।”
ফিওনা কিছুটা চিন্তিত হয়ে বললো,”কিন্তু অ্যালিসা আপনাকে খুঁজবে।”
জ্যাসপার তখন আরও নিশ্চিতভাবে বললো,”খুঁজুক।” এই বলে সে ফিওনার ওপর শুয়ে পড়লো,তার হাত দুটো চেপে ধরলো বিছানায়।
ফিওনার হৃদয় দ্রুত স্পন্দন প্রক্রিয়া শুরু করলো,সে অনুভব করলো যে পরিস্থিতিটি কতটা জটিল।জ্যাসপারের আচরন তাকে যেন মুহূর্তের মধ্যে অন্য জগতে নিয়ে যাচ্ছিল।

ফিওনার মনে জ্যাসপারের সান্নিধ্য পাওয়ার তাগিদ যেন ক্রমেই বাড়ছিল,তবে অ্যালিসার চিন্তাও তার মাথায় ঘুরছিল। সে জানতো যে যদি অ্যালিসা তাদের কথা শুনে ফেলে, তাহলে পরিস্থিতি যে কতটা গোলমাল হতে পারে।
জ্যাসপার আবারও ফিওনার ঠোঁটে চুম্বন করতে লাগলো, তার ঠোঁটের মৃদু স্পর্শে ফিওনার শরীরে একটা শিহরণ বয়ে গেল।তার সঙ্গে সঙ্গে জ্যাসপার তার ঠোঁটের কোণে দন্ত দিয়ে কামড়াতে লাগলো,যা ফিওনার জন্য আরও উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠলো।
“এই মুহূর্তে এটা ঠিক না,” ফিওনা বিষ্ময়ে বললো,তার কণ্ঠে কিছুটা উদ্বেগ ছিল। “অ্যালিসা তো এখানে চলে আসতে পারে!”

জ্যাসপার তাতে কোনো কর্ণপাত না করে আরো গভীরভাবে তার দিকে তাকালো,”তুমি শুধু আমার দিকে ফোকাস করো হামিংবার্ড এখন অ্যালিসা নিয়ে ভাবার সময় না।” তার কণ্ঠে এক অদ্ভুত সুর ছিল, যেন সে সত্যিই ফিওনাকে তার পৃথিবীতে নিয়ে যেতে চায়।
ফিওনা তখন বুঝতে পারছিলো যে জ্যাসপার তার জীবনের এক বিশেষ অংশ হয়ে উঠছে।কিন্তু অ্যালিসার উপস্থিতি এবং পরিস্থিতির অস্বাভাবিকতা তাকে চিন্তিত করে তুলছিল।
জ্যাসপার এবার ফিওনার দিকে গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো, তার চোখে এক অদ্ভুত আকর্ষণ ছিল।”আমি আজকে তোমাকে পুরোপুরি চাওয়ার জন্য প্রস্তুত,হামিংবার্ড,” সে নেশালো কন্ঠে বললো।”তোমার অস্তিত্বের একদম গভীরে আমি বিচরণ করতে চাই।”

ফিওনার চোখ বড় বড় হয়ে যায়,জ্যাসপারের কথার গভীরতা বুঝতে পেরে সে কয়েকবার ঢোক গিলে ফেললো।”এটা আমার জন্য প্রথমবার,”তার মনে ভয় ঢুকে যায়।
জ্যাসপার তার পরিবর্তিত মুখাবয়ব দেখেছিল,তাই সে বললো,”ভয় পেও না,হামিংবার্ড।কিছু হবে না।প্রথমবার হয়তো কষ্ট হবে,তবে একটু পর সব ঠিক হয়ে যাবে।”
ফিওনার মনে অনুভুতি ভয়ের দ্বন্দ্ব জাগতে থাকে;সে ভয়ের সঙ্গে সঙ্গে এক অদ্ভুত আকর্ষণও অনুভব করে।”আমি কি সত্যিই প্রস্তুত?” ষসে ভাবতে থাকে।
জ্যাসপার তার হাত দিয়ে ফিওনার মুখের দিকে আস্তে আস্তে হাত রাখে,তার স্পর্শে এক নিরাপদ অনুভূতি অনুভব করে ফিওনা।”তুমি যদি আমাকে বিশ্বাস করো,তবেই আমি সবকিছু করবো,”সে বললো।
ফিওনা তার চোখের দিকে তাকায়,মনে হয় যেন তার মনে জমে থাকা ভয়গুলো ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। “ঠিক আছে,” সে শেষে বললো, “কিন্তু ধীরে ধীরে।”
জ্যাসপার তার সিদ্ধান্তকে সম্মান জানিয়ে অঙ্গীকার করে। “আমাদের মাঝে যা হবে,তা হবে একদম সাবধানে,” সে বললো,”তোমার প্রতিটি অনুভূতি আমি বুঝবো।”

আযদাহা পর্ব ৩৯

তাদের মাঝে সেই মুহূর্তটি একটি অদ্ভুত নীরবতা নিয়ে আসে, যেন সময় থমকে গেছে। ফিওনার হৃদয় ধুকপুক করতে থাকে, কিন্তু সে জানতো, জ্যাসপারের ভালোবাসা ও যত্ন তাকে এই যাত্রায় পথ দেখাবে।
“তুমি শুধু আমাকে বলো,” সে বললো,”আমি তোমার ইচ্ছার প্রতি শ্রদ্ধা জানাবো।”
ফিওনা নিজের ভয়ের কাঁটাগুলো কাটিয়ে উঠতে শুরু করে, আর তার হৃদয়ে এক নতুন আগ্রহ জাগে।দুইজনের মধ্যে একটি অদ্ভুত,আকর্ষণীয় সেতুবন্ধন তৈরি হয়,যা তাদের সম্পর্ককে নতুন এক উচ্চতায় নিয়ে যাবে।

আযদাহা পর্ব ৪১