আযদাহা পর্ব ৪২

আযদাহা পর্ব ৪২
সাবিলা সাবি

ডক্টর আগ্নিসের সোনালি রঙের ড্রাগন অবয়ব মাউন্টেন গ্লাস হাউজের শীতল বাতাসে জ্বলজ্বল করতে থাকে। তার দীর্ঘ ডানা হালকা আওয়াজে কাচের ঘরের দেয়াল ছুঁয়ে যায়। শক্তিশালী অথচ শীতল চোখে তিনি চারপাশ পরখ করে দ্রুত মানবীটিকে দেখার জন্য জ্যাসপারের নির্দেশ অনুসরণ করেন।
জ্যাসপার হাত দিয়ে ইঙ্গিত করে বললো, “ওর চিকিৎসা করতে হবে, আগ্নিস। সময় খুব কম।”
ডক্টর আগ্নিস তখন ফিওনার দিকে তাকিয়ে খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে গেলেন। তার গাঢ় সোনালি চোখে অবিশ্বাসের ঝিলিক

“একজন সাধারণ মানবী…!” তিনি নিজের মনে বিড়বিড় করলেন।
কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই তার বিজ্ঞানমনা মন এই চিন্তা ঝেড়ে ফেলে ফিওনার শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করলো। তার চোখে জ্বলজ্বল করতে থাকা উজ্জ্বল অরব এক ঝলক আলো ছড়িয়ে দিলো।
ডক্টর আগ্নিস দ্রুত তার বিশেষ প্রযুক্তিসম্পন্ন যন্ত্রপাতি খুলে নিলেন। তার সোনালি ড্রাগন চোখগুলো ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল, যেন কোনো অজানা শক্তির উৎস তিনি সক্রিয় করতে চলেছেন।
“অ্যাস্ট্রোবায়োটিক স্ক্যানার” নামের একটি আধুনিক ডিভাইস তিনি প্রথমে ফিওনার হৃদপিণ্ডের দিকে স্থাপন করলেন। এটি একটি ড্রাগনদের তৈরি অতি-উন্নত হোলোগ্রাফিক মেশিন, যা কোষের গভীর স্তর থেকে ডিএনএ পর্যন্ত সমস্ত কিছুর নিখুঁত চিত্র তুলে আনতে পারে। যন্ত্রটি ফিওনার দেহের উপরে ভাসতে থাকা আলোকরশ্মি তৈরি করল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই একদম পরিষ্কার হোলোগ্রাম তৈরি হল—ফিওনার রক্তনালী, টিস্যু এবং কোষের ভেতরে “ড্রাগন স্পার্মের” সক্রিয় কণাগুলো আলোকিত হয়ে ফুটে উঠল।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ডক্টর আগ্নিস চোখ ছোট করে স্ক্যানের ফলাফল বিশ্লেষণ করলেন। তিনি বিড়বিড় করে বললেন,
“এটা অবিশ্বাস্য… মানব কোষের সাথে ড্রাগন ডিএনএর সংমিশ্রণ! কোষ বিভাজন এত দ্রুত কীভাবে হচ্ছে?”
পরবর্তী পদক্ষেপে তিনি “ডিএনএ অ্যানালাইজার” যন্ত্রটি বের করলেন। যন্ত্রটি দেখতে ছিল ছোট একটি থ্রি-ডি স্ফটিকের মতো, যার গায়ে অসংখ্য ন্যানো-লেজার প্রবাহিত হচ্ছে। এটি ফিওনার শরীর থেকে এক ফোঁটা রক্ত সংগ্রহ করল এবং তাত্ক্ষণিকভাবে বিশ্লেষণ শুরু করল। যন্ত্রের ফলাফল তাকে হতবাক করে দিলো।
স্ক্রিনে ফুটে উঠলো:
“ড্রাগন স্পার্মের বায়ো-কেমিক্যালস দ্বারা কোষের পুনর্গঠন শুরু হয়েছে। মানব কোষের প্রাকৃতিক জেনেটিক কোড পরিবর্তিত হচ্ছে।”
ডক্টর আগ্নিস দ্রুত লেজার-স্ক্যানারটি ফিওনার ঘাড় এবং বুকের অংশে চালিয়ে দেখলেন। সেখানে এক অদ্ভুত তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং “বায়োকেমিক্যাল রিঅ্যাক্টিভিটি” শনাক্ত হল। তিনি গম্ভীর হয়ে পড়লেন এবং মনে মনে হিসাব করলেন।

ডক্টর আগ্নিস ধীরে ধীরে তার বিশাল পরীক্ষাগুলো শেষ করলেন।ফিওনার নিস্তেজ শরীর থেকে এক ফোঁটা রক্ত, হৃৎস্পন্দনের কম্পন এবং কোষের গভীরে চলা অদ্ভুত জৈবপ্রক্রিয়া তার চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠছিলো।তিনি থমকে দাঁড়ালেন।এক মুহূর্তের জন্য তার সোনালি চোখ বিস্ময়ে জ্বলে উঠল।
অবশেষে তিনি মাথা তুলে জ্যাসপারের দিকে তাকালেন। কণ্ঠে একধরনের চরম বিস্ময় আর শঙ্কা—জ্যাসপার…”
জ্যাসপার চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলো ফিওনার শিয়রের পাশে। ডক্টর আগ্নিস এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না।

অবশেষে ডক্টর আগ্নিস গভীর শ্বাস নিয়ে মুখ তুলে জ্যাসপারের দিকে তাকালেন। তার কণ্ঠে ভারী গাম্ভীর্য।
“প্রিন্স অরিজিন,এটা বোঝা যাচ্ছে যে তোমার লাভ ফাংশনালিটি অ্যাক্টিভ হয়েছে।”
জ্যাসপার কিছুটা বিরক্ত স্বরে বলল, “এটা আমি জানি, আগ্নিস।ফিওনাকে নিয়ে কী হয়েছে সেটা বলো।”
“এই মানবীর শরীরে ড্রাগনের স্পার্ম শনাক্ত হয়েছে।” ডক্টর চিৎকার করে বললেন।”এটা কি তোমার কাজ?তুমি ওর সাথে ফিজিক্যাল সম্পর্কে জড়িয়েছো?”
জ্যাসপার একটু নড়েচড়ে দাঁড়ালো,কিন্তু তার চেহারা শান্ত। যেন এই প্রশ্নের জন্য সে প্রস্তুত ছিলো।ধীরে ধীরে মাথা নত করে বললো,”হ্যাঁ।”
ডক্টর আগ্নিস হতবাক হয়ে গেলেন।কয়েক মুহূর্ত তিনি চুপ করে তাকিয়ে রইলেন।তারপর কঠিন গলায় বললেন,
“কিন্তু কেনো?কে এই মেয়ে?কে হয় সে তোমার?”

জ্যাসপার এবার ফিওনার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন। তার চোখে এক অদ্ভুত কোমলতা আর দৃঢ়তা ফুটে উঠলো। খুব শান্ত অথচ গভীর কণ্ঠে বললো “ও আমার ভালোবাসা।”
ডক্টর আগ্নিস বিস্ময়ে এক পা পিছিয়ে গেলেন।তার মতো অভিজ্ঞ ড্রাগন বিজ্ঞানীও এমন কথা কোনোদিন শোনেননি। তিনি হতভম্ব কণ্ঠে বললেন,
“একজন ড্রাগন প্রিন্স…যে শুধু এল্ড্র রাজ্যের নয়,গোটা ভেনাসের উত্তরাধিকারী…সে কিনা মানবীর প্রেমে পড়েছে? এটা তুমি কী করলে,জ্যাসপার?”
কয়েক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা। তারপর ডক্টর আগ্নিস এক দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।তার চোখে উদ্বেগ ঝলসে উঠলো।
“তুমি কি জানো এই ব্যাপার যদি তোমার পিতার কাছে পৌঁছায়,কী হবে?ড্রাগন রাজ্যে এ প্রেমের মূল্য খুবই ভয়ানক। তোমার এই সম্পর্ক গোটা ভেনাসকে সংকটে ফেলতে পারে!”

জ্যাসপার এবার মুখ তুলে কঠিন কণ্ঠে বললো,
“তাই বলে কি ভালোবাসাকে অস্বীকার করবো?
আমি জানি কী ভুল করেছি,কিন্তু ও আমার।আমি তাকে রক্ষা করবো,আমার জীবন দিয়ে হলেও।”
ডক্টর আগ্নিস হতাশ চোখে জ্যাসপারের দিকে তাকালেন। তিনি মনে মনে জানতেন,এই ভালোবাসার পরিণতি খুব জটিল হতে চলেছে।ধীরে ধীরে বললেন,
“তুমি ভালোবাসা বলতে যা বুঝছো,তার মূল্য হয়তো তোমার পিতার রাজ্যের চেয়েও বেশি।কিন্তু মনে রেখো,জ্যাসপার—তোমার ভুলের শাস্তি তোমার নয়,হয়তো এই মেয়েটিকেই পেতে হবে।”
ঘরের ভেতর নীরবতা নেমে এলো।ফিওনার নিঃশ্বাসের মৃদু শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা যাচ্ছিল না।ডক্টর আগ্নিস ফিওনার দিকে তাকিয়ে বললেন,

“এখন যা হোক না কেনো,তাকে বাঁচানোর জন্য যা করা প্রয়োজন,সেটা করতে হবে।আমি চেষ্টা করবো।কিন্তু তোমার উচিত ওর থেকে দূরে থাকা।তোমার শক্তি ওর মানব শরীরের জন্য ধ্বংসাত্মক হতে পারে।”
জ্যাসপার কিছু বললো না।শুধু ফিওনার হাতটা আলতো করে ধরলো,যেন নিজের ভালোবাসার প্রতিশ্রুতি আবারও তার নিঃশব্দে জানিয়ে দিলো।
তিনি যন্ত্রের ফলাফলের দিকে ইঙ্গিত করে ব্যাখ্যা করতে শুরু করলেন।
“তোমার স্পার্ম—ড্রাগনের স্পার্ম—মানব শরীরে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।প্রথমত,ড্রাগনদের কোষে যে প্লাজমেটিক এনার্জি থাকে সেটা মানব কোষের সঙ্গে মিলিত হওয়ার পর একটা বিরাট জৈবিক সংঘর্ষ তৈরি করেছে।এই সংঘর্ষের ফলে ফিওনার কোষ বিভাজন দ্রুত হয়ে যাচ্ছে, এমনকি কিছু কোষ মিউটেটও করছে।”
জ্যাসপার একপাশে দাঁড়িয়ে ফিওনার দিকে উদ্বিগ্ন দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে।জ্যাসপার ভ্রু কুঁচকে বলল, “তাহলে তার শরীরে কি ধরণের পরিবর্তন হচ্ছে?”

ডক্টর আগ্নিস গভীর গলায় বললেন,”মেয়েটির শরীরে হঠাৎ তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণ হচ্ছে ড্রাগনিক এনজাইমস।তোমার স্পার্মে থাকা বিশেষ প্রোটিনসমূহ তার দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে অস্বাভাবিকভাবে উত্তেজিত করেছে।তার ইমিউন সিস্টেম তোমার ডিএনএকে বহিরাগত শত্রু হিসেবে চিনে ফেলেছে এবং প্রতিরোধ গড়ে তুলছে।এটা খুবই বিপজ্জনক,কারণ তার শরীর নিজেই তার কোষ ধ্বংস করতে পারে।ডক্টর আবার বললেন,”এটা একধরনের “জেনেটিক শক”—

জ্যাসপারের মুখ ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছে।সে ধীর গলায় বললেন,”আর কী হয়েছে?”
ডক্টর আগ্নিস এবার আরেকটি স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বললেন,”সবচেয়ে গুরুতর বিষয় হলো তার মস্তিষ্কে নিউরাল সিগন্যালের পরিবর্তন।সাধারণ মানুষের স্নায়ু সংকেতের যে সীমাবদ্ধতা থাকে, তা ভেঙে যাচ্ছে।তার স্নায়ুতন্ত্রে ড্রাগন-ইনফ্লুয়েন্সড এনার্জি ফ্লো তৈরি হয়েছে। এটি তার অনুভূতি এবং চিন্তার জগতে এক নতুন স্তর তৈরি করতে পারে,কিন্তু এক্ষেত্রে তার দেহ এতে মানিয়ে নিতে পারছে না।তীব্র ক্লান্তি,জ্বর এবং অজ্ঞান হয়ে যাওয়া সবই এর ফল।”
জ্যাসপার এগিয়ে গিয়ে ডক্টরের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “তাহলে তার জীবন ঝুঁকির মধ্যে আছে?”
ডক্টর আগ্নিস গম্ভীর মুখে বললেন,”এখনই নয়।তবে তার শরীর ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে।যদি এই সংঘর্ষ চলতে থাকে,একসময় তার শরীর অক্ষম হয়ে পড়বে। তোমার স্পার্মের প্রভাব এতটাই শক্তিশালী যে মানব দেহের জন্য তা সহ্য করা কঠিন।”

কিছুক্ষণ নীরবতা নেমে আসে।ফিওনা তখনো ঘুমিয়ে আছে,তার নিস্তেজ মুখের দিকে তাকিয়ে জ্যাসপারের চোখে অপরাধবোধের ছায়া খেলে যায়।
ডক্টর আগ্নিস এবার “বায়ো-স্ট্রিম ডিভাইস” চালু করলেন,যা ফিওনার শারীরিক শক্তির স্তর মাপতে পারে।স্ক্রিনে দেখা গেল,তার প্রাণশক্তি ক্রমশ কমে যাচ্ছে এবং একটি বিশেষ অংশে—ফুসফুস ও হৃদপিণ্ডের সংযোগস্থলে অদ্ভুত শক্তির প্রবাহ তৈরি হয়েছে।
তিনি আশঙ্কাজনক গলায় বললেন,”তোমার লাভ ফাংশনাল অ্যাক্টিভেশনের কারণে তার শরীরে ‘ড্রাকোনিয়ান লাভ এনজাইম’ সক্রিয় হয়েছে।এই এনজাইম তাকে বাঁচিয়ে রাখছে,কিন্তু খুব দ্রুত তার কোষ ক্ষয় হয়ে যাবে।”
ডক্টর আগ্নিস হালকা গলায় বললেন, “এখন বুঝতে পারছো?ভালোবাসা কতটা বিপজ্জনক?মানবী কখনোই ড্রাগনের শক্তিকে পুরোপুরি ধারণ করতে পারবে না।এই মেয়েটিকে রক্ষা করতে হলে তোমাকে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে।আমি তোমার সাথে আছি,কিন্তু মনে রেখো,এই সম্পর্ক শুধু তার জন্য নয়,তোমার জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ।”
জ্যাসপার ধীরে ধীরে বলল,”আমি যা করবো,তার সবই তাকে রক্ষার জন্য।”

ডক্টর আগ্নিস তখন বললেন,”আমাকে সময় দাও। আমি তার শরীরের সঙ্গে তোমার ডিএনএকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার একটা উপায় খুঁজে বের করবো। কিন্তু ততদিন তাকে সাবধানে রাখতে হবে। একটুও ঝুঁকি নয়।”
জ্যাসপার তখন ডক্টরের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল,”কীভাবে তাকে বাঁচানো যায়?”
ডক্টর আগ্নিস চিন্তা করে বললেন,”তার শরীরে একটি প্রতিষেধক ইনজেকশন দিতে হবে।আমি ড্রাগনদের জিনেটিক ক্ষমতা কিছুটা স্তিমিত করতে পারি,যাতে তার কোষ বিভাজনের হার স্বাভাবিক হয়।তবে এই সমাধান সাময়িক।তাকে পুরোপুরি সুস্থ করতে চাইলে তোমার শক্তি নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে,জ্যাসপার।”
তিনি দ্রুত “ড্রাকোনিয়ান নিউরো-সিঙ্ক ইনজেকশন” বের করে ফিওনার বাহুর শিরায় ইনজেকশন দিলেন।এরপর তিনি কিছু ট্যাবলেট রেখে বললেন,”এই ওষুধ তাকে কয়েকদিন স্থিতিশীল রাখবে,কিন্তু মনে রেখো—তোমার তার কাছ থেকে আপাতত দূরে থাকা প্রয়োজন।তার প্রাণই এখন গুরুত্বপূর্ণ।”

জ্যাসপার ধীরে ধীরে ফিওনার পাশে বসে পড়ল।তার বড় হাত ফিওনার নরম চুলের ওপর স্পর্শ করতেই ফিওনা যেন শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে রইল।তার চোখের গভীর বিষণ্ণতা এক ঝলক ঝরে পড়ল। তিনি ফিসফিস করে বললো,”আম সরি,হামিংবার্ড।আমাকে মাফ করে দাও। আমি হয়তো বুঝতে পারিনি আমার অস্তিত্ব তোমার জন্য কতটা বিপদজনক।কিন্তু আমি আর কখনো তোমাকে স্পর্শ করবো না।দূর থেকেই তোমাকে ভালোবাসবো,তোমার পাশে থেকেও তোমার থেকে দূরে থাকবো।”
তার কণ্ঠে একটা অদ্ভুত ব্যথা আর প্রতিজ্ঞা মিশে ছিল, যেন নিজেকেই তিরস্কার করছে।
ডক্টর আগ্নিস সামনের দিকে এগিয়ে এসে দৃঢ় কণ্ঠে বললেন,”জ্যাসপার,এখন বুঝতে পারছো তুমি কী করেছো?এই মেয়েটি একজন সাধারণ মানবী!ড্রাগনদের শক্তি কখনোই সাধারণ দেহে সহ্য হবে না,।”
জ্যাসপার কোনো উত্তর দিল না।তার হাতের আঙুলগুলো ফিওনার কপালের ওপর স্থির হয়ে রইল।
ডক্টর আগ্নিস দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। “ভালোবাসা অনেক শক্তিশালী,প্রিন্স জ্যাসপার,কিন্তু কখনো কখনো ভালোবাসার জন্য ত্যাগ করতে হয়।সাবধানে পদক্ষেপ নিও।তোমার সিদ্ধান্ত যেন তোমার জাতির কিংবা এই মেয়েটির জীবনে বিপদ না বয়ে আনে।”

জ্যাসপার চুপচাপ ডক্টরের কথা শুনলো।তার দৃষ্টি আবার ফিরলো ফিওনার দিকে।অচেতন ফিওনার নিস্তেজ মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন—”তোমার জন্য আমি সব কিছু করবো,হামিংবার্ড।এমনকি যদি নিজের অস্তিত্বের বিপদ ডেকে আনতে হয়,তাও তোমাকে রক্ষা করবো।”
ডক্টর আগ্নিস তখন উঠে দাঁড়ালেন এবং চুপচাপ ফিওনার দিকে একবার তাকিয়ে কক্ষ ত্যাগ করার প্রস্তুতি নিলেন,কিন্তু তার চোখে ছিল উদ্বেগ আর কৌতূহলের মিশ্রণ।”একটা সাধারণ মানবী কীভাবে ড্রাগনের হৃদয় এতটা গভীরে পৌঁছাতে পারে?এ যেন ইতিহাসের নতুন দিক উন্মোচন।”
ডক্টর আগ্নিস দরজার সামনে পৌঁছেই থেমে গেলেন। তার চিন্তামগ্ন চোখে কিছু একটা স্পষ্ট হলো।তিনি ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ালেন এবং আবার জ্যাসপারের দিকে ফিরে এসে বললেন,
“জ্যাসপার,আরেকটা কথা।এই মেয়ের দেহে যে বায়ো কেমিক্যাল পাওয়া গেছে,সেটা কীভাবে সম্ভব?এই ক্যামিক্যাল শুধুমাত্র ড্রাগনদের মধ্যেই তৈরি হয়।স্পার্মের মাধ্যমে এটা কোনো মানবীর শরীরে যাওয়ার কথা নয়।এটা তো জৈবিকভাবে অসম্ভব।”
জ্যাসপার গভীর নিঃশ্বাস ফেলল।তার চেহারায় কোনো চমক নেই,যেন সে এই প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলো।ধীরে এবং স্থির স্বরে তিনি বললো,

“আমি জানি,ডক্টর আগ্নিস।আমি জানি ফিওনার শরীরে বায়ো কেমিক্যাল আছে।”
ডক্টর আগ্নিস বিস্মিত হয়ে বললেন,”তাহলে তুমি কীভাবে জানলে?এটা কখন থেকে?”
জ্যাসপার কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল, যেন অতীতের সেই মুহূর্তে ফিরে গেছেন। তারপর সে বললো,
“একদিন আমার শরীর হঠাৎ করে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। আমি অনুভব করছিলাম যে আমার সমস্ত শক্তি শেষ হয়ে যাচ্ছে।কিন্তু তারপর,তার ঠোঁটের স্পর্শে আমি কিছু একটা পেলাম।আমি বুঝতে পারলাম ওর শরীর থেকে আমার মধ্যে একধরনের বায়ো কেমিক্যাল প্রবেশ করেছে।সেটাই আমাকে সুস্থ করে তুলেছিল।এবং ওই মুহূর্তেই আমার ‘লাভ ফাংশনালিটি’—যেটা আমার মধ্যে কখনোই ছিল না—তা এক্টিভ হয়ে যায়।”

ডক্টর আগ্নিস স্তম্ভিত হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। তার চোখে বিস্ময়ের ছাপ স্পষ্ট। তিনি ধীরে ধীরে বললেন,
“এটা তো অসম্ভব…আর অদ্ভুতও বটে।এমন ঘটনা তো ইতিহাসে কখনো ঘটেনি।এমনকি একজন ড্রাগন কন্যার মধ্যেও এই বিশেষ কেমিক্যালের অস্তিত্ব থাকা অসম্ভব।এটা কীভাবে সম্ভব?”
জ্যাসপার মাথা নিচু করে শান্ত গলায় বলল,
“আমি জানি না।কিন্তু ফিওনা সাধারণ কোনো মানবী নয়।সে আমার জন্য বিশেষ… এবং হয়তো তার অস্তিত্বের মধ্যেই কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে,যেটা আমি এখনও বুঝতে পারিনি।”
ডক্টর আগ্নিস গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন।তিনি মনে মনে হিসাব মেলানোর চেষ্টা করলেন।
“যদি এই মানবীর শরীরে ড্রাগনদের বায়ো কেমিক্যালের প্রতিরূপ থাকতে পারে,তাহলে তার জন্মসূত্রে কিছু না কিছু ড্রাগন সম্পর্কিত শক্তি অবশ্যই লুকিয়ে আছে।এটা অসম্ভব নয় যে তার পূর্বপুরুষদের মধ্যে কেউ ড্রাগন ছিল।”
তিনি আবার জ্যাসপারের দিকে তাকিয়ে বললেন,

“তোমাকে সাবধান থাকতে হবে,প্রিন্স জ্যাসপার।এই মেয়েটি শুধু তোমার জন্য নয়,আমাদের জাতির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ অথবা বিপদজনক হতে পারে।তার মধ্যে যে রহস্য লুকিয়ে আছে,সেটা হয়তো আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।”
জ্যাসপার কপাল কুঁচকে ফিওনার দিকে তাকালো।তার মনে যেন নতুন চিন্তার ঢেউ উঠল।সে নিজেকে বললো,
“তুমি কে,হামিংবার্ড?কেন তোমার মাঝে এমন শক্তি লুকিয়ে আছে যা আমার মতো ড্রাগনকেও বদলে দিতে পারে?”
ডক্টর আগ্নিস আবার মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন,”আমি এটা নিয়ে আরো পরীক্ষা করবো।কিন্তু সাবধানে থেকো, জ্যাসপার।এই রহস্যের সমাধান যতই আকর্ষণীয় হোক না কেন,তার মূল্য চুকাতে হতে পারে।”
এরপর সে কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।তার গতি দ্রুত,কিন্তু তার মনে অসংখ্য প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।আর জ্যাসপার,সে আবার ফিওনার পাশে বসে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।

গভীর রাত ফিওনার কক্ষের বাইরে থারিনিয়াস ফিসফিস করে অ্যাকুয়ারাকে বলল,”এই মুহূর্তে প্রিন্স জ্যাসপারের নির্দেশ মতো কেউ কক্ষের কাছে ঘেঁষতে পারবে না।কিন্তু তুমি কি লক্ষ্য করেছ,আলিসা অনেকক্ষণ ধরেই আমাদের দিকে নজর রাখছে?”
অ্যাকুয়ারা মাথা নাড়ল।তার চোখে সন্দেহের ছাপ ফুটে উঠল।”হ্যাঁ।আলিসা সন্দেহ করছে।সে নিশ্চয়ই কিছু আঁচ করতে পেরেছে।কিন্তু তাকে বেশি কাছে ঘেঁষতে দেওয়া যাবে না।”
থারিনিয়াস কপাল কুঁচকে বলল,”আমাদের প্রিন্সের যে কি হয়ে গেলো,এতোটা উন্মাদ আগে কখনো দেখিনি।”

ভেতরে,জ্যাসপার রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল,”তোমাকে সুস্থ করবো,হামিংবার্ড।যত কিছুই হোক না কেন।আর কেউ তোমাকে কষ্ট দেবে না।”
সে ফিওনার মাথায় হাত রেখে চুপচাপ বসে থাকল,বাইরে চাঁদের আলো পাহাড়ের আড়ালে মিলিয়ে যেতে শুরু করল।
জ্যাসপার নিঃশব্দে ফিওনার পাশে বসে রইল।তার গভীর চোখে দুঃখ আর অনুশোচনা একসাথে জ্বলজ্বল করছিল। ফিওনার মুখের দিকে তাকিয়ে সে হঠাৎই হাত বাড়িয়ে আলতো করে তার চুল সরিয়ে দিল।মেয়েটার নিঃশ্বাস ধীরে উঠানামা করছে,যেন কোনো অচেনা স্বপ্নের মধ্যে ঘুমিয়ে আছে।

জ্যাসপার নিজেকে আর সামলাতে পারল না।সে ফিওনার কপালের কাছে ঝুঁকে গিয়ে খুব সাবধানে,খুব যত্নের সাথে একটি চুমু এঁকে দিল—নিঃশব্দে,যেন কোনো বাতাসের স্পর্শও না পড়ে তার ঘুমে।
“তোমার আমার ভালোবাসা সারাজীবন শুধু মনে মনেই হবে,”জ্যাসপার ধীরে ধীরে ফিসফিস করল।তার কণ্ঠ ভারী,যেন আবেগের গভীর সমুদ্র থেকে উঠে আসছে।

আযদাহা পর্ব ৪১

“আর কখনোই শারীরিকভাবে তোমাকে কাছে পাবো না,হামিংবার্ড।তোমার ওই মিষ্টি,কোমল দেহ আমি আর কখনো ছুঁতে পারবো না,আর চাইওনা ছুঁতে যেটার কারনেই তোমাকে মরতে হবে সেটা আমি কখনোই করবো না।”
তার চোখে এক ফোঁটা জল চিকচিক করে উঠল,কিন্তু সে নিজেকে সামলে নিল।চুপচাপ ফিওনার হাতের কাছে বসে রইল,যেন তার উপস্থিতির উষ্ণতা দিয়ে মেয়েটাকে সুস্থ করার চেষ্টা করছে।
পাহাড়ের বাইরে বাতাস বয়ে চলল,আর মাউন্টেন গ্লাস হাউজের কাঁচের জানালা দিয়ে জ্বলজ্বলে রাতের আকাশের তারা তাকিয়ে রইল,দু’জনের এই নিরব ভালোবাসার সাক্ষী হয়ে।

আযদাহা পর্ব ৪৩