আযদাহা পর্ব ৪৭
সাবিলা সাবি
“পুষ্পরাজ” পাহাড়ের মধ্যে অত্যাধুনিক ল্যাবের কনফারেন্স রুমে এক চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে।চারপাশের স্ক্রিনে বিভিন্ন ডেটা ভাসমান,মাঝে মাঝে রঙ পরিবর্তন করে সংকেত দিচ্ছে।টেবিলের চারপাশে জ্যাসপার,থারিনিয়াস,আলবিরা, এবং মিস্টার চেন শিং গভীর আলোচনায় মগ্ন।
টেবিলের কেন্দ্রে একটি হোলোগ্রাফিক প্রজেকশন।এতে দেখা যাচ্ছে দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন বনাঞ্চলের একটি ত্রিমাত্রিক মানচিত্র।জ্যাসপার তার লম্বা আঙুল দিয়ে একটি নির্দিষ্ট স্থানের দিকে ইঙ্গিত করে বললো,“এই এলাকাটি হলো আমাদের পরবর্তী লক্ষ্য।এখানে‘ইথেরিয়াম অরব’রয়েছে,যা আমাদের ভেনাসের প্রজেক্ট সম্পন্ন করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।তবে সমস্যা হলো,এটি ‘শেডো স্নার্ক’নামে একটি অত্যন্ত বিপজ্জনক মনস্টার দ্বারা সুরক্ষিত।”
থারিনিয়াস তার চেয়ার ঠেলে পেছনে হেলান দিয়ে বললো, “শেডো স্নার্ক সহজ প্রতিপক্ষ নয়।আমি ভেনাসেও এমন একটি প্রাণীর মুখোমুখি হয়েছি।এটি কেবল ফিজিক্যাল অ্যা*টাক করে না,এটি সাইকোলজিকাল ম্যানিপুলেশনেও সক্ষম।সুতরাং আমাদের স্ট্র্যাটেজি হতে হবে অনেকটাই সুনিপুণ।”
মিস্টার চেন শিং,যিনি সবসময় তথ্য বিশ্লেষণে ব্যস্ত থাকেন, তার হালকা ধাতব কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।”তোমাদের প্রাথমিক লক্ষ্য হলো অরবের অবস্থান শনাক্ত করে তা নিরাপদে উদ্ধার করা।তবে এই মিশনের জন্য আমাদের তিন স্তরের সুরক্ষা প্রয়োজন। প্রথমত, শেডো স্নার্কের বিষাক্ত ধোঁয়ার প্রতিরোধী স্যুট,দ্বিতীয়ত,আলোক-ভিত্তিক অস্ত্র যা এর অন্ধকার শক্তিকে ভেঙে দিতে পারবে,এবং তৃতীয়ত,একটি দ্রুত পালানোর ব্যবস্থা।”
আলবিরা তার ল্যাব-প্যাডে কিছু লিখে বলল,“আমার ফায়ার এনহ্যান্সড আলোক অস্ত্র তৈরি করা সম্ভব।তবে এর জন্য ‘রেয়ার ক্রিস্টাল’প্রয়োজন,যা ল্যাবের ভেনাসিয়ান স্টক থেকে আনতে হবে।এটা করতে আমার কিছু সময় লাগবে।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
স্ক্রিনে একটি নতুন ডেটা ফিড প্রদর্শিত হলো।তাতে দেখা যাচ্ছে,শেডো স্নার্ক যেকোনো কম্পাঙ্কের শব্দ শোষণ করতে পারে,তবে একটি নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যে এটি দুর্বল হয়ে যায়।
জ্যাসপার সামনের দিকে ঝুঁকে বললো,“আমাদের আলোক অস্ত্রের পাশাপাশি সাউন্ড ফ্রিকোয়েন্সি নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে হবে।থারিনিয়াস,তুমি সাউন্ড এম্প্লিফায়ার প্রস্তুত করবে। এটি স্নার্কের ধোঁয়া ভেদ করে তার কেন্দ্রীয় স্নায়ুকে আঘাত করবে।”
থারিনিয়াস মাথা নেড়ে বললো,“ঠিক আছে।আমি সুরক্ষা স্যুট এবং সাউন্ড ডিভাইস তৈরি করছি।তবে আমাদের দ্রুত কাজ করতে হবে।সময় বেশি নেই।”
চেন শিং একটি হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে অরবের বিশ্লেষণ তুলে ধরে বললেন,“ইথেরিয়াম অরবের ভেতর এমন একটি শক্তি আছে যা গ্র্যাভিটি-ফিল্ড ম্যানিপুলেট করতে পারে।এটি যদি তোমরা সফলভাবে উদ্ধার করতে পারো,তাহলে এটি শুধু তোমাদের গবেষণার জন্য নয়,পৃথিবীর পরিবেশকে স্থিতিশীল করতেও কাজে লাগবে।”
জ্যাসপার দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে বলল,“তাহলে পরিকল্পনা এমন—আমরা আগামীকাল রাতেই আমাজনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করব।থারিনিয়াস,আলবিরা,তোমাদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে হবে। মিস্টার চেন শিং,আপনি অরবের শক্তির সঙ্গে আমাদের ডিভাইসগুলোর সামঞ্জস্য নিশ্চিত করবেন।”
আলোচনা শেষে সবাই ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল।রুমের ভেতরে এক চাপা নীরবতা।সবাই জানে,এই মিশন শুধু তাদের দক্ষতার পরীক্ষাই নয়,বরং এটি পৃথিবী এবং ভেনাসের ভবিষ্যতের জন্য একটি অমোঘ চ্যালেঞ্জ।
কনফারেন্স রুমে সবাই ধীরে ধীরে বেরিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল।আলোচনার টানাপোড়েন সত্ত্বেও পরিবেশে একটি চাপা শান্তি নেমে এসেছিল।মিস্টার চেন শিং হঠাৎ থেমে জ্যাসপারের দিকে তাকিয়ে বললেন,“জ্যাসপার, ্তোমার সাথে আমার কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।তুমি আমার কক্ষে এসো।”জ্যাসপার ভ্রু কুঁচকে বলল, “এখনই?”
মিস্টার চেন শিং মাথা নেড়ে বললেন,“হ্যাঁ,এখনই।এটা অত্যন্ত জরুরি।”
এই কথা বলেই মিস্টার চেন শিং দ্রুত কনফারেন্স রুমের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন,তার সুনিপুণ চলাফেরা থেকে বোঝা যাচ্ছিল যে বিষয়টি নিঃসন্দেহে গুরুতর।জ্যাসপার কয়েক মুহূর্ত স্থির দাঁড়িয়ে রইল,ভেবে দেখল কী হতে পারে। তার মন কিছুটা অস্বস্তিতে ভরে গেল।
কনফারেন্স রুমের আলো ম্লান হয়ে আসছিল।থারিনিয়াস টেবিলের চারপাশ থেকে সবার নোটপ্যাড আর ডিভাইস গুছিয়ে তুলছিল।হঠাৎ,সে জ্যাসপারের দিকে ফিরে বলল, “মাফ করবেন প্রিন্স,একটি কথা ছিল।”
জ্যাসপার,নিজের নোটপ্যাড গুছাতে গুছাতে চোখ তুলে তাকিয়ে বলল,“বলো,থারিনিয়াস, কী বলবে?”
থারিনিয়াস একধরনের দ্বিধা নিয়ে তার সামনে এগিয়ে এসে বলল,“প্রিন্স,বলছিলাম যে আপনি ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার ল্যাবের কম্পিউটার আর ডিভাইস ধ্বং*স করে ফেলেছেন। কিং ড্রাকোনিস ভেনাস থেকে যে ডিভাইসগুলো এনে স্টোকে রেখেছিলেন,সেগুলো প্রায় শেষ।স্টোর রুমে এখন আর মাত্র একটা ডিভাইস সেট রয়েছে।এবার আপনি এগুলো ভেঙে ফেললে আবার ভেনাস থেকে আনতে যথেষ্ট কষ্ট হবে,সময়ও লাগবে।তাই প্লিজ,দয়া করে ওই অবলা ডিভাইসগুলোর ওপর আর রাগ ঝাড়বেন না।”
জ্যাসপার থারিনিয়াসের কথা শুনে সামান্য হেসে ফেলল। তার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে বিদ্রূপের ছাপ ফুটে উঠল। “ঠিক আছে,থারিনিয়াস,”সে বলল।“এরপর থেকে ডিভাইসের ওপর নয়,তোমার ওপর রাগ ঝাড়ব।”
থারিনিয়াস বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল,কিন্তু কিছু বলার সাহস করল না।জ্যাসপার নোটপ্যাডটি হাতে নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল।রুমের বাইরে যাওয়ার সময় তার পায়ের ধপধপ শব্দ থারিনিয়াসের মনে অজানা শঙ্কার জন্ম দিল।
কনফারেন্স রুমের দরজা খুলে জ্যাসপার বেরিয়ে গেল। করিডোরের শীতল বাতাস তার মুখে আছড়ে পড়ল। তার চোখে দৃঢ় সংকল্পের ছাপ ছিল।সে জানত,মিস্টার চেন শিং এর সাথে কথোপকথন সহজ হবে না,তবুও তাকে সেখানে যেতে হবে।
থারিনিয়াস পেছনে দাঁড়িয়ে চুপচাপ তার যাওয়া দেখল।সে নিজেকে মনে মনে বলল,“প্রিন্স আর তার রাগ… কোনো একদিন এটাই হয়তো আমাদের সবার জন্য ঝামেলা ডেকে আনবে।”এরপর সে ধীর পায়ে রুমের বাকি সরঞ্জাম গুছানোর কাজে মন দিল,যেন সেগুলো আর কোনোভাবেই জ্যাসপারের ক্রোধের শিকার না হয়।
ল্যাবরেটরির প্রশস্ত করিডোর ধরে এগিয়ে চলল জ্যাসপার। তার পায়ের শব্দ কাচের মেঝেতে প্রতিধ্বনি তুলছিল,আর চারপাশে ভাসমান মনিটরে বিভিন্ন গ্রাফ ও ডেটা চলমান ছিল।
চেন শিং এর কক্ষটি ছিল ল্যাবের এক কোণে।দরজায় পৌঁছে জ্যাসপার হালকা চাপ দিল,আর দরজা ধীরে ধীরে খুলে গেল।
জ্যাসপার মিস্টার চেন শিং এর কক্ষে প্রবেশ করতেই চেন শিং তাকে দেখেই গম্ভীর মুখে বললেন,“তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম,জ্যাসপার।বসো,আমাদের কিছু জরুরি কথা আছে।”
জ্যাসপার সামনে রাখা চেয়ারে বসল।তার চোখে এক ধরনের বিরক্তি ছিল,তবে মুখে তা প্রকাশ করল না।
“বলুন,মিস্টার চেন শিং।কী বিষয়ে কথা বলতে চান?”
চেন শিং হাত গুটিয়ে নিজের চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন, “তুমি হয়তো জানো আমি কেন তোমাকে আলাদা ডেকেছি। বিষয়টি আমার নাতনী ফিওনাকে নিয়ে।”
জ্যাসপার একটু এগিয়ে বসে বলল,“দেখুন,মিস্টার চেন শিং, আমি আগেই বলেছি,যখন আমার কাজ শেষ হবে,আমি ফিওনাকে এবং আপনাকে চীনে পৌঁছে দিয়ে ভেনাসে ফিরে যাব।তাহলে এই বিষয়ে আর কথা বলার কী দরকার?”
চেন শিং তখন এক গভীর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালেন। “আমি এই বিষয়ে কথা বলতে চাই না,জ্যাসপার।আমি অন্য বিষয়ে কথা বলতে চাই।তোমার মনে নেই ,তুমি আমাকে কী বলেছিলে?তুমি বলেছিলে,তুমি প্রমাণ করবে যে ফিওনা তোমার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে কোনো আবেগের প্রভাবে ভাসছে না।বরং সে তোমাকে সত্যি সত্যি ভালোবাসে।আমি এখন সেই প্রমাণ দেখতে চাই।”
জ্যাসপারের মুখ হঠাৎ কঠোর হয়ে উঠল।তার চোখে এক ধরনের আগ্রহ আর রাগ মিশ্রিত হয়েছিল।“আপনার বিশ্বাস নেই,তাই তো?”সে ঠান্ডা স্বরে বলল।“আপনি কি ভেবেছেন, ফিওনা কেবল আমার সৌন্দর্যের ফাঁদে পড়ে আবেগের বশে আমার সাথে থাকছে?”
চেন শিং ঠান্ডা গলায় বললেন,“আমি জানি না,জ্যাসপার। আমি একজন বৈজ্ঞানিক।আমার কাজ হলো প্রমাণ খোঁজা। তুমি যদি বলো ফিওনা তোমাকে সত্যি ভালোবাসে,তাহলে তা প্রমাণ করো।যদি তুমি তা করতে পারো,আমি আর কখনোই তোমার আর ফিওনার সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন তুলব না।”
জ্যাসপার গভীরভাবে এক মুহূর্তের জন্য ভাবল। তারপর সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ঠিক আছে। আমি প্রমাণ করব। তবে মনে রাখবেন, মিস্টার চেন শিং, সেই প্রমাণের পর ফিওনার লাইফের সবকিছুই আমার দায়িত্বে থাকবে।”
মিস্টার চেন শিং হালকা হেসে বললেন,“আমি অপেক্ষা করব, জ্যাসপার।দেখি তুমি কী প্রমাণ করো।”
জ্যাসপার কোনো কথা না বলে ঘুরে দাঁড়াল তার মনের ভেতর এখন নতুন এক পরিকল্পনার বীজ অঙ্কুরিত হচ্ছিল।
জ্যাসপার মিস্টার চেন শিং-এর কক্ষের দরজার সামনে দাঁড়িয়েই গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “আমি আজ রাতেই প্রমাণ করব। আপনাকে আর বেশি অপেক্ষা করতে হবে না।”
চেন শিং এক ভুরু উঁচিয়ে বললেন, “আজ রাতেই? এত দ্রুত কীভাবে?”
জ্যাসপার তার স্বাভাবিক আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে উত্তর দিল, “আপনার উত্তর পেতে খুব বেশি সময় লাগবে না। আমি এখনই যাচ্ছি। কিছুক্ষণ পরেই থারিনিয়াসকে পাঠাব। সে আপনাকে নিয়ে বের হয়ে আসবে। আমি তার আগেই সব প্রস্তুতি সেরে ফেলব।”
চেন শিং কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগে জ্যাসপার দ্রুত ঘুরে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। তার পায়ের শব্দ কক্ষের বাইরে মিলিয়ে যাওয়ার পর চেন শিং নিঃশ্বাস ফেলে নিজের চেয়ারে হেলান দিলেন। তার চোখে মিশ্র অনুভূতির ছায়া।
“দেখি, ড্রাগন প্রিন্স জ্যাসপার।তোমার সাহস আর আত্মবিশ্বাস কতটা ঠিক,” চেন শিং নিজে নিজেই বিড়বিড় করলেন।
এদিকে,জ্যাসপার ল্যাবের করিডোর ধরে দ্রুত এগিয়ে গেল। তার মুখে এক অনমনীয় দৃঢ়তা স্পষ্ট।নিজের পরিকল্পনা নিয়ে সে এক মুহূর্তের জন্যও দ্বিধায় ছিল না।
“ফিওনা,আজ রাতেই আমি সবাইকে প্রমাণ করব, তুমি আমাকে কেবল মুগ্ধ হয়ে নয়,সত্যিকার অর্থে ভালোবাসো,” সে মনে মনে বলল।
ল্যাবের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে জ্যাসপার থারিনিয়াসকে নির্দেশ দিল,“থারিনিয়াস,আমি একটা সিগন্যাল পাঠানোর সাথে সাথেই তুমি মিস্টার চেন শিংকে নিয়ে ল্যাবের বাইরে যাবে, আর সিগন্যালেই লোকেশন থাকবে।
থারিনিয়াস একটু অবাক হয়ে বলল, “আপনার পরিকল্পনা কী, প্রিন্স?”
জ্যাসপার তার দিকে তাকিয়ে এক ঠান্ডা হাসি দিল। “তোমার জন্য সেই গল্প নয়,থারিনিয়াস।শুধু আমার নির্দেশ পালন করো।এবং দয়া করে আর কোনো প্রশ্ন কোরো না।”
থারিনিয়াস মাথা নাড়ল। “আচ্ছা,প্রিন্স।আপনার নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করব।তবে আশা করছি,আপনি আর কোনো ডিভাইস ভাঙবেন না।”
জ্যাসপার তার দিকে এক দৃষ্টি ছুড়ে দিয়ে দ্রুত নিজের গন্তব্যের দিকে রওনা দিল।তার চোখে এক গভীর সংকল্পের ছাপ।আজ রাতটি তার এবং ফিওনার জন্য নতুন কিছু বয়ে আনতে চলেছে।
রাত গভীর হলেও ল্যাবের গোপন কক্ষটি এক অদ্ভুত নীরবতায় আচ্ছন্ন।জ্যাসপার নিজের চেম্বারে ঢুকে দরজা বন্ধ করল।এই ঘরটি তার একান্ত নিজস্ব—যেখানে অন্য কারও প্রবেশ নিষেধ।দেওয়ালে ঝুলে থাকা মনিটরের নীল আলোকছটা তার মুখে পড়ে,তার চোখের গভীরতায় এক দুঃখমাখা কিন্তু অদম্য সংকল্প ফুটে উঠল।
সে মনিটরের সামনে দাঁড়িয়ে কিছু ডেটা স্ক্যান করল,তারপর ধীরে ধীরে একটি কেমিক্যালের বোতল তুলে নিল। বোতলটির ভিতরে ছিল একটি স্বচ্ছ,উজ্জ্বল তরল—একটি বিশেষ কেমিক্যাল যার নাম‘ফিনোমাইন (Phenomine)’ এটি একটি শক্তিশালী ড্রাগ,যা মানব রুপের অবস্থায় কৃত্রিম উপায়ে ড্রাগন শক্তি স্থানান্তরিত করে।এর ফলে কিছুক্ষণ জন্য মানবদেহের ফিজিওলজিতে পরিবর্তন ঘটে,যা ফলস্বরূপ কুৎসিত ও ভয়ঙ্কর চেহারা তৈরি করে।
জ্যাসপার বোতলটি খুলে সেই কেমিক্যালটি ধীরে ধীরে নিজের মধ্যে প্রবাহিত করতে লাগল।প্রথমে এটি তার শরীরে কোনো অনুভূতি তৈরি করল না,কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যে ধীরে ধীরে তার দেহে উত্তেজনা অনুভূত হতে শুরু করল। কেমিক্যালটির প্রভাব শুরু হল—এটি তার রক্তপ্রবাহে ছড়িয়ে পড়ে এবং শরীরের অভ্যন্তরে অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটাতে লাগল।
“এটাই সঠিক পথ,” জ্যাসপার মনে মনে বলল।
কিছুক্ষণের মধ্যে,তার মুখে এবং শরীরে অদ্ভুত পরিবর্তন শুরু হল। তার চামড়া কুঞ্চিত হতে লাগল,চোখে এক উজ্জ্বল আলো ফুটে উঠল।ঠোঁট ফুলে গেল,আর কানের আকৃতি পরিবর্তন হতে শুরু করল।সে মিররে নিজের প্রতিফলন দেখে হতভম্ব হয়ে গেল। এক ধরণের বিকৃতি ঘটতে লাগল,এবং তার মুখের কাঠামো পরিবর্তিত হতে শুরু করল,যেন একটি ভয়ঙ্কর ড্রাগনে রূপান্তরিত হচ্ছে।
“কী ভয়ংকর লাগছে নিজকে।” সে আতঙ্কিত হয়ে ভাবতে লাগল।
তার শরীরে শক্তি অনুভূত হচ্ছিল,কিন্তু সেই শক্তির সাথে যুক্ত ছিল ভয়াবহতা।তার চেহারা এখন অতি বিকৃত এবং কুৎসিত। “এই কেমিক্যাল আমাকে আর্টিফিশিয়াল ভাবে আমার প্রকৃত শক্তি দিতে চাচ্ছে।”
এরপর সে দ্রুত করিডোর পেরিয়ে ল্যাব থেকে বেরিয়ে মাউন্টেন গ্লাস হাউজের দিকে রওনা দিল।তবে কেমিক্যালের প্রভাবে সে কিছুটা অসুস্থ ও অস্বস্তিতে ভুগছিল।তার মুখের বি*কৃতি এক ভয়ংকর রূপ নিচ্ছিল,এবং এটাই তার জন্য সবচেয়ে কার্যকর ছিলো পরিকল্পনা।
মাউন্টেন গ্লাস হাউজে প্রবেশ করার পর সে প্রথমেই আলবিরাকে খুঁজে পেল।আলবিরা লিভিং রুমে কিছু কাজ করছিল,কিন্তু জ্যাসপারছর উপস্থিতি দেখে বুঝতে পারল যে কিছু গুরুতর বিষয় ঘটছে।
“ প্রিন্স!আপনি কী করেছেন?” আলবিরা তার বি*কৃত চেহারা দেখে হতবাক হয়ে গেল।
“আলবিরা,আমার দিকে তাকিও না।জরুরি কথা আছে। ফিওনার কাছে গিয়ে বলো আমি তাকে মাউন্টেন গ্লাস হাউজের বাইরে পাহাড়ে ডেকেছি,”জ্যাসপার বলল,তার কণ্ঠে দ্বিধা ছিল।
“প্রিন্স,আপনি… আপনার চেহারা!” আলবিরা বিস্ময়ে প্রায় চিৎকার করে উঠলো।
“প্রশ্ন কোরো না,আলবিরা।শুধু আমার বার্তাটি ফিওনার কাছে পৌঁছে দাও।বাকিটা আমি সামলে নেব,” জ্যাসপার অঙ্গভঙ্গিতে কিছুটা শক্তি প্রদর্শন করল,কিন্তু তার শরীরের বি*কৃতি তাকে দুর্বল ও অবসন্ন করে ফেলছিল।
আলবিরা মাথা নাড়ল,“ঠিক আছে,প্রিন্স। আমি এখনই যাচ্ছি।”
জ্যাসপার কিছু না বলে সোজা লিভিং রুমের কাঁচের দেয়ালের দিকে এগিয়ে গেল।জানালার কাচে রাতের আকাশ প্রতিফলিত হচ্ছিল,আর দূরের পাহাড়ের চূড়াগুলি এক রহস্যময় ছায়ায় ঢাকা পড়ে ছিল।তার মন তখন আরও একবার সেই সংকল্পে আটকে গেল।“এবার সব পরিষ্কার হয়ে যাবে,”সে মনে মনে বলল।
আলবিরা দ্রুত ফিওনার কাছে চলে গেল,তবে সে জানত না, এই রাতটি তাদের দুজনের জন্য কী অপেক্ষা করে রেখেছে।
ফিনোমাইন (Phenomine)এর প্রভাব ৩০ মিনিটের মধ্যে তার চেহারা বিকৃত করে দেবে এবং প্রায় বিশ মিনিটের জন্য তাকে ভয়ংকর রূপে আবদ্ধ রাখবে।
মাউন্টেন গ্লাস হাউজের বাইরে পাথুরে পথ বেয়ে ফিওনা ধীরে ধীরে পাহাড়ের চূড়ার দিকে এগোচ্ছিল।অন্ধকার আকাশে তারার আলো ম্লান,আর বাতাসে ছিল এক অজানা উত্তেজনার গন্ধ।জ্যাসপার পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে চেয়ে ছিল।তার হাত এখনও বডি স্যুটের পকেটে ঢোকানো,যেন কিছু একটা লুকানোর চেষ্টা করছে।
ফিওনা মৃদু স্বরে ডাকলো,”প্রিন্স?”
জ্যাসপার ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ালো।তার মুখটা যেন এক অদ্ভুত আভায় আবৃত।চোখের নিচে গভীর রেখা,গালের চামড়া ঝলসে যাওয়ার মতো,আর ঠোঁটের কোণে এক নির্মম হাসি।শরীরের বাকি অংশেও পরিবর্তন স্পষ্ট—মুখ,বুক আর বাহু থেকে বড় বড় আশ বেরিয়ে এসেছে,যা ড্রাগনের মতো দেখাচ্ছে।
ফিওনা থমকে দাঁড়ালো।তার গলা শুকিয়ে এলো। “তোমার… তোমার চেহারাটা এমন কেন?এটা কী হয়েছে তোমার?”
জ্যাসপার তার চোখ মেলে সরাসরি ফিওনার দিকে তাকালো। তার চোখের গভীরতায় লুকিয়ে থাকা বেদনা চাপা পড়ে আছে।সে মৃদু কণ্ঠে বলল,”এটা এক ধরনের দুর্ঘটনা,ফিওনা। ল্যাবে এক বিশেষ কেমিক্যালের সঙ্গে কাজ করছিলাম। হঠাৎ করে এটি আমার শরীরের সঙ্গে বিক্রিয়া করেছে।”
ফিওনার চোখ বড় হয়ে গেল। “কিন্তু… এটা কি ঠিক হবেনা? তুমি কি আবার আগের মতো হতে পারবে না?”
জ্যাসপার এক দম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,”বিজ্ঞানীদের মতে, এটা স্থায়ী।আর কখনো আগের মতো হওয়া সম্ভব নয়।এমন রূপ নিয়ে আমাকে সারাজীবন বাঁচতে হবে।”
ফিওনা ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে এলো।কিন্তু প্রতিটি পদক্ষেপে তার পা ভারী হয়ে আসছিল।তার মন ঘূর্ণিঝড়ে পড়ে গেল।জ্যাসপারের এই রূপ দেখে সে যেন ঠিক বুঝতে পারছিল না কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে।
“তুমি কি… তুমি কি আমাকে ভয় পাচ্ছো,ফিওনা?” জ্যাসপার প্রশ্ন করল।তার কণ্ঠে ছিল এক ধরনের চাপা ব্যঙ্গ।
ফিওনা তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,”আমি… না, ভয় পাচ্ছিনা।কিন্তু এটা… কীভাবে…”
জ্যাসপার তার দিকে আরও এগিয়ে এলো।এবার তার কণ্ঠ দৃঢ়,”তাহলে?আমাকে বলো, ফিওনা।এই রূপে আমাকে দেখে তুমি কী অনুভব করছ?
ফিওনা হতবাক হয়ে গেল। সে সত্যিই কিছু বলতে পারছিল না।জ্যাসপারের বিকৃত মুখ আর ড্রাগনের মতো শরীর দেখে তার মনের গভীরে যেন ভয়ের ছায়া নেমে এলো
পাহাড়ের শীর্ষে ঠাণ্ডা বাতাস বইছিল।জ্যাসপার ফিওনার দিকে তাকিয়ে বলল,”হামিংবার্ড,তোমাকে আমি আজকেই তোমার বাড়িতে তোমার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেবো।”
এই কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে ফিওনা থমকে গেল।তার চোখে জল টলমল করে উঠল।কোনো কিছু না ভেবেই সে এক দৌড়ে এসে জ্যাসপারকে শক্ত করে জাপটে ধরল।তার হাত জ্যাসপারের চারপাশে শক্ত করে পেঁচানো,যেন তাকে আর ছাড়তেই চাইছে না।
জ্যাসপার নিরাবেগ মুখে দাঁড়িয়ে রইল।অনেক আগেই সে থারিনিয়াসকে সিগন্যাল পাঠিয়েছিল,যার নির্দেশ ছিল সিগন্যাল পেলেই মিস্টার চেন শিংকে নিয়ে এখানে এসে পৌঁছানো।মাত্র কয়েক হাত দূরে,মিস্টার চেন শিং এসে দাঁড়িয়েছেন এবং নীরবে সবকিছু দেখছেন।
ফিওনা জ্যাসপারের বুক থেকে মুখ তুলে তার চোখে চোখ রাখল।তার কণ্ঠ ভাঙা কিন্তু দৃঢ়। “প্রিন্স,আমাকে তোমার থেকে দূরে পাঠিয়ে দিওনা।আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না।তোমার যাই হয়ে যাক,যতো ভয়ংকর রূপই হোক না কেন,যতই কু*ৎসিত হোক,আমি তবুও তোমার সাথেই থাকব।প্লিজ, আমাকে দূরে সরিয়ে দিওনা।”
জ্যাসপার এক মুহূর্তের জন্য চুপ রইল।তার চোখ ম্লান হয়ে গেল,যেন কোনো গভীর দ্বন্দ্বের মধ্যে আটকে আছে।ধীরে ধীরে সে ফিওনার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,”কিন্তু হামিংবার্ড…এই রূপ নিয়ে আমি কীভাবে তোমার পাশে থাকতে পারি?এটা কেবল শুরু।প্রতিদিন আমার রূপ আরও বিকট হবে।তুমি সহ্য করতে পারবে না।প্লিজ,আমার কথা শোনো।”
ফিওনা কথা না বলে জ্যাসপারের দিকে এগিয়ে এলো।তার চোখে কোনো দ্বিধা ছিল না।সে জানত,এই মুহূর্তে তাকে নিজের ভালোবাসার প্রমাণ দিতে হবে।
জ্যাসপার কিছু বলার আগেই,ফিওনা তার ঠোঁটজোড়া জ্যাসপারের কুৎসিত বিকট ঠোঁটে চেপে ধরল।চুম্বনটা গভীর, দৃঢ়,আর সমস্ত ভালোবাসা দিয়ে পূর্ণ।যেন এই মুহূর্তে সে প্রমাণ করতে চাচ্ছে,তার ভালোবাসা কোনো চেহারা,রূপ বা অবস্থার উপর নির্ভর করে না।
কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মিস্টার চেন শিং সাথে সাথেই ঘুরে দাঁড়ালেন।তার চোখে দৃশ্যটা ছিল যতটা অবিশ্বাস্য, ততটাই আবেগপূর্ণ।তার বুকের ভেতর এক ধরনের ঝড় বয়ে গেল।তিনি জানলেন,ফিওনার ভালোবাসা সত্যিই নিঃস্বার্থ এবং শর্তহীন।
জ্যাসপার ধীরে ধীরে ফিওনার থেকে নিজেকে সরিয়ে নিল। তার চোখে এক ধরনের বিস্ময়। “হামিংবার্ড…”
ফিওনা মৃদু হেসে নিজের ঠোঁটজোড়া আলগা করে বলল,”তোমার যা-ই হোক,আমি তোমার সাথেই থাকব।এটা কখনোই বদলাবে না, এটা বলেই পুনরায় চুম্বন করলো জ্যাসপার ঠোঁটজোড়ায়”
দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মিস্টার চেন শিং নিজের মনে বললেন, “এটাই বোধহয় সত্যিকারের ভালোবাসা।এমন ভালোবাসাই মানুষকে অপরাজেয় করে তোলে।”
এই মুহূর্তে,পাহাড়ের ঠাণ্ডা বাতাস আর তারার আলো যেন দুজনকে আশীর্বাদ করল। ভালোবাসার পরীক্ষায় ফিওনা উত্তীর্ণ হয়েছে,আর জ্যাসপার বুঝল,তার জীবনে ভালোবাসার অর্থ কতটা গভীর।
ফিওনা ধীরে ধীরে চুম্বন শেষ করে জ্যাসপারের দিকে তাকাল।সে অবাক হয়ে দেখল,জ্যাসপারের বিকৃত চেহারা আর নেই।তার আগের সেই সুদর্শন, ষসুপুরুষ রূপ ফিরে এসেছে তার চামড়ার সমস্ত পোড়া দাগ উধাও,শরীরের ড্রাগনের চিহ্নগুলোও মিলিয়ে গেছে।
“প্রিন্স,তোমার মুখ,শরীর—সব ঠিক হয়ে গেছে!” ফিওনা বিস্ময়ে ফিসফিস করে বলল।”এটা কিভাবে সম্ভব হলো?”
জ্যাসপার হাসল,সেই পরিচিত বাঁকা হাসি।তার চোখে এক ধরনের দুষ্টুমির ঝলক ফুটে উঠল। “হামিংবার্ড,”সে বলল, তার কণ্ঠ গভীর এবং কোমল,”আমিতো ভুলেই গেছিলাম, তোমার মধ্যে আমার জন্য তৈরি বায়ো-কেমিক্যাল মেডিসিন আছে।তোমার ভালোবাসার স্পর্শ আর সেই চুমুই আমাকে সুস্থ করে দিলো।”
ফিওনা অবাক হয়ে জ্যাসপারের কথা শুনল।তার মুখে লজ্জার একটি মৃদু ছাপ ফুটে উঠল। “তাহলে… আমার চুমু-ই আবার তোমাকে ঠিক করল?”
জ্যাসপার হেসে বলল, “ঠিক তাই। তুমি জানো না, হামিংবার্ড, তুমি শুধু আমার ভালোবাসা না,আমার জীবনও।তোমার একটুখানি স্পর্শেই আমি নতুন করে বাঁচি।”
এই কথা বলেই জ্যাসপার ফিওনাকে শক্ত করে নিজের বাহুতে জড়িয়ে ধরল।তার মুখ ফিওনার ঘাড়ে গুঁজে দিয়ে গভীরভাবে শ্বাস নিল।তার গলার গভীর ধ্বনি যেন ফিওনার শরীরে শিহরণ জাগিয়ে তুলল।
ফিওনা স্থির দাঁড়িয়ে রইল,তার হৃদয় তুমুলভাবে ধুকপুক করছিল।জ্যাসপারের উষ্ণতা,তার আলিঙ্গনের শক্তি, সবকিছু যেন তাকে আরও বেশি করে জ্যাসপারের প্রতি আকৃষ্ট করছিল।
পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা এই দুইজন যেন পুরো পৃথিবী থেকে আলাদা একটি জগতে চলে গেল। ঠাণ্ডা বাতাসে তাদের ভালোবাসা মিলেমিশে গেল। দূরে তারার আলো তাদের এই মুহূর্তটাকে আরও রোমাঞ্চকর করে তুলল।
জ্যাসপার ধীরে ধীরে ফিসফিস করে বলল, ষ”তোমার ভালোবাসা আমাকে শুধু সুস্থ করে দেয়নি,হামিংবার্ড, আমাকে অজেয় করেছে।”
ফিওনার ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে উঠল। তার চোখে ভালোবাসার এক গভীর ছায়া।”তোমার সাথে থাকাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সুখ,প্রিন্স।”
জ্যাসপার মনে মনে বলল, “তুমি তোমার ভালোবাসার পরীক্ষায় বিজয়ী হয়েছ।আর আমি তোমার জন্য আমার প্রাণটাও দিয়ে দিবো নির্দ্বিধায়।”
এই ভাবনায় তার হৃদয়ে একটি অদ্ভুত অনুভূতি জেগে উঠল। ফিওনার প্রতি তার ভালোবাসা এত গভীর যে, তার জন্য নিজের জীবনও উৎসর্গ করতে প্রস্তুত। সে জানত, ফিওনা শুধুই তার প্রেমিকা নয়; সে তার জীবনের একমাত্র আলো, যাকে ছাড়া তার অস্তিত্ব অসম্পূর্ণ।
জ্যাসপার কিছুক্ষণ ফিওনাকে আঁকড়ে ধরে থাকল, মনে মনে ভেবে চলল, “আমি যতদিন বেঁচে থাকব, তোমাকে কখনো দূরে যেতে দেবো না। তুমি আমার জন্য যে ভালোবাসা দেখিয়েছ, সেই ভালোবাসা আর তোমাকে আমি চিরকাল রক্ষা করবো।”
পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে জ্যাসপার আকাশের দিকে তাকাল।রাতের আকাশে নক্ষত্রগুলো যেন হীরের মতো জ্বলজ্বল করছিল।শীতল বাতাস তার গায়ে লাগছিল,কিন্তু সে মনে মনে তার প্রিয় হামিংবার্ডের কথা ভাবছিল।আজ রাতে সে ফিওনাকে নিয়ে সময় কাটানোর পরিকল্পনা করেছে।
ফিওনা যখন জ্যাসপারের আঙুলের মাঝে নিজের আঙুল দিয়ে আঁকড়ে ধরলো, তখন জ্যাসপার তাকে এক উজ্জ্বল হাসি দিয়ে স্বাগত জানাল।চাঁদের আলোতে তার মুখের উজ্জ্বলতা যেন আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল।”হামিংবার্ড,আজ রাতে আমাদের জন্য একটি বিশেষ সময়,”জ্যাসপার বললো, তার গলায় উষ্ণতা ও আন্তরিকতা ছিল।
ফিওনা হেসে বললো,”তুমি আজ রাতে কী পরিকল্পনা করেছ, প্রিন্স?”“আমরা এখানে সময় কাটাবো,তারা হাজারো তারা আমাদের সাক্ষী হবে,”জ্যাসপার বললো। “আর আমি তোমাকে জানাতে চাই যে,তুমি আমার জন্য কতটা বিশেষ। এই রাতটা আমাদের।”
ফিওনার চোখে উজ্জ্বলতা ফুটে উঠলো,সে বুঝতে পারছিল জ্যাসপার আজ রাতে তার হৃদয়ের আরো অজানাই কথা বলার জন্য প্রস্তুত।পাহাড়ের শীর্ষে,তারা দুজন একত্রে বসে থাকা,রাতের পরিবেশ যেন এক রোমাঞ্চকর স্বপ্নের মতো লাগছিল।
জ্যাসপার পাহাড়ের চূড়ায় বসে ছিল,তার দুপায়ের মাঝখানে ফিওনা।ফিওনাকে পেছন থেকে জ্যাসপার জড়িয়ে ধরে বসে ছিল,আর ফিওনা তার মাথাটা হেলান দিয়ে রেখেছিল জ্যাসপারের বুকে।রাতের নিস্তব্ধতায় চারপাশে শুধু তাদের কণ্ঠস্বরের মৃদু প্রতিধ্বনি।তারা অনেক গল্প করেছে, হাসিঠাট্টা করেছে,আর সময়ের গতির কোনো অনুভূতি পায়নি।
হঠাৎ,ফিওনা এক আকর্ষণীয় প্রশ্ন করে বসলো,“আচ্ছা, প্রিন্স,তুমি কি এই প্রথম পৃথিবীতে এসেছোনাকি আগেও এসেছিলে?”
জ্যাসপার কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,“না,এটা নিয়ে আমার দ্বিতীয়বার।প্রথমবার যখন এসেছিলাম,অনেক বছর আগে, ১০ বছর আগে একবার এসেছিলাম।”
ফিওনা কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো,“তখন তুমি কী দেখতে পেয়েছিলে?কেমন ছিল সেই অভিজ্ঞতা?”
জ্যাসপার একটু হাসলো।“সেই সময় পৃথিবীকে দেখার দৃষ্টিকোণ ছিল ভিন্ন।আমি এই প্রকৃতির সৌন্দর্য,মানুষের হাসি আর তাদের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে নতুনভাবে উপলব্ধি করেছিলাম।তবে তখন আমি কিছুটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম,কারণ আমার মধ্যে ছিল এক অদ্ভুত অনুভূতি—কিছু একটা রয়েছে যা আমাকে এখানে আসতে বাধ্য করেছিল।”
ফিওনা তার কথায় গভীরভাবে মনোযোগ দিল। “তাহলে,তোমার প্রথম পৃথিবীতে আসার অনুভুতি কেমন ছিল?”জ্যাসপার তার স্মৃতিতে খুঁজতে গিয়ে বললো, “প্রথমবার যখন এসেছিলাম,তখন এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল।প্রায় দশ বছর আগে আমাকে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছিল।কারণ,আমার পৃথিবীতে অনেক কাজ ছিল।আমি ভবিষ্যতে প্রিন্স হবো,তাই মাউন্টেন গ্লাস হাউজ দেখতে আমাকে পাঠানো হয়েছিল।”
ফিওনা মনোযোগ দিয়ে শুনছিল,তার কৌতূহলী চোখগুলো জ্যাসপারের দিকে মেলে ধরেছিল।
“আমি রওনা দিয়েছিলাম ভেনাস থেকে,”জ্যাসপার এগিয়ে বলে,“সোজা চীনের বেইজিংয়ে ল্যান্ড করেছি।সেদিন মেবি ওই এলাকায় ড্রাগন উৎসব ছিলো।চারপাশে উজ্জ্বল আলোকিত পতাকা,উৎসবের গান,আর মানুষের উল্লাস। আমার মনে হয়েছিল, আমি যেন এক ভিন্ন জগতে প্রবেশ করেছি।”
ফিওনা একটু হাসলো “এটাতো তো খুব রোমাঞ্চকর!আমার প্রিয় উৎসবের মধ্য এটা একটি।তবে তুমি তখন কী অনুভব করছিলে এই উৎসব নিয়ে?”
জ্যাসপার জবাব দেয়ার পুর্বেই ফিওনা হঠাৎ কি ভেবে চমকে উঠলো আর বিষ্ময়ে বললো “এক মিনিট তুমি কি বললে?১০ দশ বছর আগে ড্রাগন উৎসবে এসেছিলে?তারমানে,আমি যে দুবার ওই সবুজ আলোকরশ্মি দেখছিলাম,সেটা তুমি ছিলে?”
জ্যাসপার মুহূর্তের জন্য থমকে গেলো,তার চোখগুলো বিস্ময়ে চমকিত।“কি বলছো তুমি সবুজ আলোকরশ্মি দেখেছো?কিন্তু কিভাবে?ড্রাগনরা যখন পৃথিবীর কোনো মানুষের উপস্থিতিতে ল্যান্ড করে,তখন আমরা আমাদের আসল রূপ লুকিয়ে রাখি।আলোকরশ্মি দেখা কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়!”
ফিওনা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,“কিন্তু আমি দেখেছি।তুমি এবারের ড্রাগন উৎসবে যখন পৃথিবীতে এসেছো,তখনও আমি ওই সবুজ আলোকরশ্মি দেখেছি। সেই মুহূর্তগুলো আমাকে এক অদ্ভুত অনুভূতি দিয়েছে।”
“এটা অসম্ভব,”জ্যাসপার বললো, তার কৌতূহল আরও বাড়তে লাগলো।“তবে যদি তুমি সত্যিই ওই আলোকরশ্মি দেখে থাকো,তাহলে এর মানে কি? হয়তো তোমার মধ্যে কিছু বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে,যা অন্যদের থেকে তোমাকে আলাদা করে।
আযদাহা পর্ব ৪৬
“বিশেষ ক্ষমতা?”ফিওনা একটু চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো।“আমি তো একজন সাধারণ মানুষ।”
“তুমি সাধারণ নও,হামিংবার্ড,”জ্যাসপার বললো। “তুমি বিশেষ।তোমার মধ্যে এমন কিছু রয়েছে যা হয়তো তুমি জানো না।ড্রাগনদের সঙ্গে তোমার এই সংযোগের কারণেই তুমি সেই আলোকরশ্মি দেখতে পেরেছো।”
ফিওনার মনে কিছুটা গুঞ্জন হলো।“তাহলে কি তুমি বলতে চাচ্ছো যে,আমাদের মধ্যে কোনো যোগসূত্র রয়েছে?হয়তো আমার ভিতরেও বিশেষ কিছু লুকিয়ে আছে?”
জ্যাসপার তার চোখে গভীরতা আনলো।“হতে পারে। তুমি যেহেতু সেই আলোকরশ্মি দেখেছিলে,তাহলে তোমার সঙ্গে আমার সংযোগ আরও গভীর।