আযদাহা পর্ব ৫
সাবিলা সাবি
ফিওনা ডেস্কের সামনে চেয়ারে বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করছিল।বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা খুব কাছে,আর তার জন্য প্রস্তুতি নিতে কোনো ফাঁক রাখছে না।খোলা জানালা দিয়ে মৃদু বাতাস আসছে,আকাশে সন্ধ্যার আলো নিভু নিভু করে জ্বলে উঠেছে।ভেনাস তারার উজ্জ্বলতা সেই পরিচিত শান্তি নিয়ে হাজির হয়েছে।
হঠাৎ,তার চোখে ধরা পড়ল আকাশে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য।আজ কিছু অস্বাভাবিক ঘটছে।একসাথে পাঁচটি আলোক রশ্মি ভেনাস থেকে তীরের মতো ছুটে আসছে পৃথিবীর দিকে—সোনালী,আকাশী,রুপালী,ধুসর,আর কালো রঙের।
আলোক রশ্মিগুলো এত দ্রুতগতিতে এগিয়ে আসছিল যে তার চোখ অবাক বিস্ময়ে স্থির হয়ে গেল।
মুহূর্তের মধ্যে আলোক রশ্মিগুলো কোথায় যেন গায়েব হয়ে গেল।সে তখনো আকাশের পানে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে ছিল।ওর চোখে লাল,সোনালী,কালো,আকাশী আর ধূসর রঙের আলোক রশ্মির সেই অদ্ভুত দৃশ্য এখনও স্পষ্ট।এর আগে এমন কিছু ও কখনো দেখেনি। যদিও চীনের পৌরাণিক কাহিনিতে ও এমন অস্বাভাবিক দৃশ্যের কথা পড়েছিল,আজ ওর সামনে সত্যি সত্যি তা ঘটলো।
হঠাৎ করেই লিয়া বাইরে থেকে ফিরে এসে রুমে প্রবেশ করলো।লিয়ার চোখ পড়ে ফিওনাকে জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকতে।তার অদ্ভুত মনোভাব দেখে লিয়া সোজা ফিওনার কাছে এসে ডাক দেয়,
“ফিওনা, তুমি ঠিক আছো তো? এমন অন্যমনস্ক হয়ে জানালা দিয়ে কি দেখছিলে?”
ফিওনা তেমন কিছু বলার আগেই লিয়া তার পাশে দাঁড়িয়ে,কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ফিওনা এই মুহূর্তে কি বলবে তা ভেবে পায়না,আর বললেও লিয়া বিশ্বাস করবেনা, কেননা ফিওনা চাইলে এখন তা প্রমানিত করতে পারবেনা তাই কথা ঘুরিয়ে নেয়। আর স্বাভাবিক স্বরে বলে,
“তেমন কিছুনা লিয়া,আমার গ্ৰান্ডপার কথা খুব মনে পড়ছিলো তাই বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিলাম।
লিয়া ফিওনার দিকে মিষ্টি করে হেসে বলল,
“শোন,আজকে রাতে আমার একটা বেস্ট ফ্রেন্ডের জন্মদিন উদযাপন হবে।আমাকে ইনভাইট করেছে, আমি ভাবছিলাম তোমাকে আমার সাথে নিয়ে যাবো। মজা হবে,আর মনে হয়,তোমার মনটাও ভালো হয়ে যাবে।”
ফিওনা একটু চিন্তিত মুখে বলল, “না, আমি যাবো না। তুমি যাও,তোমার বন্ধু তোমাকে ইনভাইট করেছে। আমি যদি যাই,তাতে কেমন দেখাবে?”
লিয়া দ্বিধাগ্রস্তভাবে বলল, “আরেহ, ও তো আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।তাছাড়া,এত রাতে আমি একা একা যাবো, আবার একা একা বাসায় ফিরবো।প্লিজ,ফিওনা! না করো না, আসো,আমার সাথে চলো।”
ফিওনা কিছুক্ষণ ভাবল, তারপর মৃদু হাসি দিয়ে বলল, “আচ্ছা, ঠক আছে। আমি তোমার সাথে যাবো।”
দুজন মিলে দ্রুত প্রস্তুতি নিতে শুরু করল।।।
ফিওনা আজকে ব্ল্যাক মিনি ড্রেস পরেছে।তার ঠোঁটে ব্রাউন লিপস্টিকের একটি গাঢ় শেড,চোখে ক্যাট আই মেকআপ,আর কানের দুল হিসেবে সিম্পল ব্ল্যাক ইয়ারিংস।তার হাতে একটি সিম্পল ব্রেসলেট আর গ্ল্যামারাস কার্লস হেয়ারস্টাইল সম্পন্ন
ফিওনার পায়ে স্টিলেটো হিল,আর হাতে একটি লিটল ক্লাচ ব্যাগ।
লিয়া ফিওনার সাজপোশাক দেখে মুগ্ধ হয়ে বলল,
“ওহ,ফিওনা,তোমাকে আজকে সত্যিই অসাধারণ লাগছে! তোমার এই ব্ল্যাক মিনি ড্রেস আর গাঢ় ব্রাউন লিপস্টিক একসাথে খুবই গ্ল্যামারাস লাগছে। একদম পারফেক্ট!”লুক।
ফিওনাও লিয়ার সাজপোশাক দেখে প্রশংসা করতে শুরু করলো।
“তোমাকেও আজকে একেবারে দারুণ লাগছে!” ফিওনা মুগ্ধ কণ্ঠে বললো, “তোমার এলিগেন্ট বডিকন ড্রেস আপটায় তোমাকে বেশ মানিয়েছে ”
লিয়া হাসিমুখে উত্তর দিল, “ধন্যবাদ, ফিওনা!এবার চলো বের হওয়া যাক বাইরে গাড়ি অপেক্ষা করছে।”
ফিওনা আর লিয়া একসাথে গাড়িতে উঠে পড়লো। গাড়ি ধীরে ধীরে চলতে শুরু করলো,রাতের শহরের আলো আর সঙ্গীতের সুরের মাঝে মিশে গেলো।
ফিওনা জানালার পাশে বসে বাইরে তাকাচ্ছিলো, শহরের উজ্জ্বল আলোকরশ্মি আর নৈশজীবনের ঝলক তাকে আকর্ষণ করছিলো।লিয়া পাশেই বসে,মৃদু হাসিতে তার মুখ উজ্জ্বল ছিলো।দুজনেই আজকের রাতের জন্য প্রস্তুত ছিলো,অনুভব করছিলো নতুন এক উত্তেজনা।গাড়ির ভিতরে আলো আর মিউজিকের মৃদু ঝলক ফিওনা আর লিয়ার উত্তেজনাকে আরো বাড়িয়ে তুলছিলো।
ল্যাবের ভিতরে মিস্টার চেন শিং আর ওয়াং লি বসে গভীর চিন্তায় মগ্ন।তাঁদের আলোচনার বিষয় ছিল গতকাল রাতের ঘটনার পরিণতি।
“ওই ড্রাগনকে উদ্ধার করার জন্য তার সঙ্গী এসে পড়েছে,” মিস্টার চেন শিং বললেন,তাঁর মুখাবয়ব চিন্তিত। “আমার ল্যাব ভাঙচুর করেছে, সিক্রেট রুমের দরজা খুলতে না পেরে।তবে তুমি জানো,সে সহজে হার মানবে না।নিশ্চিতভাবে আবার চেষ্টা করবে।একবার লোকেশন পেয়ে গেছে,আর এখন আমরা কীভাবে প্রতিরোধ করবো?”
ওয়াং লি ধীরে ধীরে মাথা ঝাঁকালেন,তাঁর চিন্তামগ্ন মুখে একটা সংকল্পের ছায়া। “আপনার মতে,যদি সে সত্যিই চেষ্টা করে,তাহলে আমাদের অবশ্যই আরও শক্তিশালী ব্যবস্থা নিতে হবে।হয়তো আমাদের দরজার নিরাপত্তা বাড়াতে হবে বা অন্য কোনো ব্যবস্থা নিতে হবে।কিন্তু আমাদের আগে নিশ্চিত করতে হবে যে সে কীভাবে আবার দরজায় পৌঁছবে”।
মিস্টার চেন শিং গভীর নীরবতা কাটিয়ে বলেন,
“তাহলে আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে।যেকোনো মূল্যে দরজার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।আর আমাদের তদন্ত অব্যাহত রাখতে হবে,যাতে সে কোনোভাবে আমাদের প্ল্যান ধরতে না পারে।”
দুইজনেই এই সংকল্প নিয়ে তাদের আলোচনা শেষ করলেন, তাদের চোখে প্রতিশ্রুতি আর দৃঢ়তা ফুটে উঠছিল।
গুহার অন্ধকার কোণায় পাঁচজন আগুন্তক একে একে প্রবেশ করে,তাঁদের মুখে গভীর শ্রদ্ধা ও শ্রদ্ধাবোধের প্রতিফলন স্পষ্ট।তাঁরা সবাই প্রিন্স জ্যাসপারকে অভিবাদন জানিয়ে সম্মান প্রদর্শন করে।
“প্রিন্স অরিজিন আমরা উপস্থিত,” একজন আগুন্তক বললেন, মাথা নোয়ালো। “আমাদের নির্দেশ দিন,আমরা কীভাবে আপনার নির্দেশ পালন করব?”
জ্যাসপার,যাঁর মুখে ছিল গম্ভীর ও দৃঢ় ভঙ্গি,তাদের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালো।
“বর্তমানে তোমাদের কাজ হলো আমার দেওয়া লোকেশনে কড়া নজরদারি রাখা।এই সময়ের মধ্যে,চেষ্টা করো ক্যামিকেল প্রতিরোধের জন্য কৌশল বের করতে।কিন্তু মনে রাখবে আমার মিশন আরও গুরুত্বপূর্ণ।আমি এখন আমার মূল লক্ষ্য পালনে যাচ্ছি।”
আগুন্তকরা মাথা নুয়ে সম্মতি জানিয়ে চলে গেলো, জ্যাসপার তাঁদের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রস্তুতি নিতে শুরু করলো, জ্যাসপার তাঁদের প্রতি আস্থাশীল ছিলো,কিন্তু নিজস্ব মিশনে প্রবেশ করার জন্য তাঁর মনোযোগ সম্পূর্ণভাবে নিবদ্ধ ছিল।
জ্যাসপার তাঁর গুহার অভ্যন্তরে এক কোণে দাঁড়িয়ে, এক ক্ষণও অপেক্ষা না করে দ্রুততার সাথে তাঁর স্মার্ট ঘড়ির স্ক্রীনে ফিওনার সর্বশেষ লোকেশন ট্র্যাক করলো
।স্ক্রীনে ফিওনার অবস্থান স্পষ্ট হয়ে উঠলো।জ্যাসপার নিঃশব্দে গুহার মধ্যে থেকে বেরিয়ে গেলো।ওর প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল দ্রুত আর নির্ভুল।ও জানতো,আর এক মুহূর্তও সময় নষ্ট করা সম্ভব নয়;ফিওনার দিকে ওর যাত্রা শুরু হয়ে গিয়েছে।
গাড়ি এসে থামল তার গন্তব্য,ফিওনা আর লিয়া গাড়ি থেকে নামতেই ফিওনার চোখে পড়ল উজ্জ্বল সাইনবোর্ড,যার ওপর স্পষ্টভাবে লেখা ছিল
“এমওয়ানটি বেইজিং”। সে অবাক দৃষ্টিতে সাইনবোর্ডের দিকে তাকিয়ে ছিল।
“এখানে বার্থডে পার্টি হবে?” ফিওনা লিয়ার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল।
লিয়া হাসি মুখে উত্তর দিলো, “হ্যাঁ, আসো, আমি তোমাকে ভেতরে নিয়ে যাই।”
ফিওনা লিয়ার হাত ধরে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। ভিতরে প্রবেশ করতেই তার চোখে পড়ল এক দৃশ্য—এটি একটি আধুনিক নাইট ক্লাব,যেখানে চারপাশ জুড়ে উজ্জ্বল আলো, বর্ণিল নাচের ডিস্কো বল,আর সুরম্য সঙ্গীতের ঝঙ্কার।ফিওনার জন্য,এই পরিবেশ ছিল নতুন আর অদ্ভুত।ঘরের অভ্যন্তরের চমকপ্রদ সাজসজ্জা আর সঙ্গীতের উন্মাদনা তাকে অভ্যস্ত দুনিয়া থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক জগতে নিয়ে গেলো। ধুমপান থেকে শুরু করে নানা ধরণের আলো, গানের তালে তালে সবাই মগ্ন। সে এক মুহূর্তের জন্য হোঁচট খেল,এমন অভিজ্ঞতা তার আগে কখনো হয়নি।
একটি টেবিলের চারপাশে বেশ কিছু ছেলে মেয়ে জমায়েত হয়ে বসেছিল।লিয়া তাদের দিকে এগিয়ে গিয়ে সবার সাথে পরিচিত হতে শুরু করলো। একটি মেয়ে,যার হাতে ককটেল ছিলো,উঠে এসে লিয়াকে জড়িয়ে ধরলো।
“ওহ,লিয়া! তুই এসেছিস!” মেয়েটি আনন্দের সাথে বলল।তোকে কি সুন্দর লাগছে, তোর জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।”
লিয়া উজ্জ্বল মুখে মেয়েটিকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলল, “মিং ঝু,শুভ জন্মদিন! তুইতো তো আমাদের পার্টির প্রধান অতিথি!”
মিং ঝু মিষ্টি হাসি দিয়ে লিয়াকে ধন্যবাদ জানালো। ফিওনার দিকে তাকিয়ে বলল, “ও কে রে?”
“ওর নাম ফিওনা, আমার নতুন রুমমেট,” লিয়া উত্তর দিলো।
“ফিওনা, এ হলো মিং ঝু,আজকের বার্থ ডে গার্ল।আর এখানে সবাই আমাদের বন্ধু।”
ফিওনা মিং ঝুকে সম্মান জানিয়ে বলল, “শুভ জন্মদিন, মিং ঝু! খুব ভালো লাগছে তোমার সাথে পরিচিত হয়ে।”
মিং ঝু হাসি দিয়ে ফিওনার হাতে হাত রেখে বলল, “তোমার সাথে পরিচিত হয়ে ভালো লাগছে।আসো, আমাদের সাথে বসো।”
ফিওনা লিয়ার সাথে টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলো। তাপমাত্রা কিছুটা কম হলেও, ক্লাবের আনন্দমুখর পরিবেশে সে দ্রুত মানিয়ে নিয়েছিল।
এমন পরিবেশে সে প্রথমবার এসেছে,তাই কিছুটা আশ্চর্য ছিল।কিন্তু লিয়ার সাথে সাথে,পার্টির আনন্দের সঙ্গে মিশে যেতে শুরু করলো।
অবশেষে কেক কাটা সম্পুর্ন করলো,কেক কাটা শেষ হতেই পরিবেশ আরো প্রাণবন্ত হয়ে উঠল।সবার মুখে কেকের স্বাদ আর আনন্দের হাসি মিশে গিয়েছিল। তারপরে,একে একে ওয়েটাররা এলকোহল দিয়ে ভরা গ্লাস নিয়ে টেবিলের দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করলো। ফিওনা প্রথমবারের মতো এমন দৃশ্য দেখছিল,সবাই মদপানে মগ্ন হয়ে উঠলো।
“ফিওনা, তুমি কিছু খাবে?” লিয়া উৎসাহিতভাবে বলল।
“না, ধন্যবাদ,” ফিওনা নম্রভাবে উত্তর দিলো। “আমি ককটেল পছন্দ করি না,যদি সম্ভব হয় তবে মকটেল খেতে পারি ?”
লিয়া আগেই ফিওনার বিষয়ে সবাইকে অবহিত করে রেখেছিল তাই ওয়েটাররা ফিওনার জন্য বিশেষভাবে মকটেল প্রস্তুত করতে শুরু করলো।অন্যরা যখন মদের গ্লাস তুলে আনন্দে মশগুল ছিল,ফিওনা লিয়ার পাশে বসে নিজের মকটেল হাতে নিয়ে উপভোগ করতে শুরু করলো।
ফিওনার চোখ মদপানের পরিণতি লক্ষ্য করে গাঢ় উদ্বেগে ভরে উঠল।
লিয়ার সঙ্গীরা আনন্দে মাতাল হয়ে উঠলেও,ফিওনার চোখে পড়েছিল এক ধরনের অস্বস্তি আর পরিমাণের সীমা ছাড়া পানীয়ের প্রতি আসক্তি।
“লিয়া, তোমার কি মনে হয় সব ঠিক আছে?” ফিওনা শান্ত স্বরে জানতে চাইল।
লিয়া হাসি মুখে উত্তরে বলল, হ্যাঁ, সবাই মজা করছে। তুমি চিন্তা করো না।”
ফিওনা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।ক্লাবের উজ্জ্বল আলো আর আনন্দমুখর পরিবেশের মধ্যে,ও লিয়ার কাছে আশ্রয় পেলো।ওর চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তবুও ক্লাবের পরিবেশকে বিশ্লেষণ করতে থাকল।
এমন পরিস্থিতিতে,সে নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলেও,লিয়ার বন্ধুদের আনন্দের অংশ হয়ে উঠতে সে চেষ্টা করছিলো।
ফিওনা হাতে পিঙ্ক রঙের একটি মকটেল ধরে ধীরে ধীরে চুমুক দিচ্ছিল,এতে ছিল পীচ আর পাইন অ্যাপলের সুমধুর মিশ্রণ।প্রতিটি ঢোকের সাথে সাথে মিষ্টি স্বাদ তার মনকে একটু হলেও প্রশান্তি দিচ্ছিল।
ক্লাবের আলোছায়ায় চারপাশের পরিবেশ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে সে;তর্কাতর্কি, হাস্যরস,মিউজিক, আর সুরেলা হইহুল্লোড় ওকে আবিষ্ট করে রেখেছে।
হঠাৎ,বার কাউন্টারের দিকে ওর চোখ পড়তেই,
ফিওনা দেখলো এক রহস্যময় ব্যক্তিকে দাঁড়িয়ে থাকতে।ব্যক্তিটির হাতে ছিল একটি গাঢ় লাল পানীয়, তার উপর দিয়ে কালো রঙের হুডি পরা,মাথায় হুডি দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছে।চোখে সানগ্লাস আর মুখে মাস্ক দিয়ে মুখ আচ্ছাদিত ছিল। তার অদ্ভুত পোশাক আর গোপনীয়তা দেখে ফিওনার মনে সেদিনের স্মৃতি ঝলসে উঠলো,যখন সে বেলকনি থেকে নিচে একটি অজ্ঞাত ব্যক্তিকে দেখেছিল।
তার অস্বস্তি বেড়ে গেল। কীভাবে ওই লোক এখানে এসেছে?ৎকেন তার মুখের সমস্ত পরিচয় আড়াল করা? অদ্ভুতভাবে,ৎক্লাবে এসে সানগ্লাস পরা একটি ব্যক্তিকে দেখে ওর কৌতূহল আরও বেড়ে গেল।
সে অনুভব করলো যে সেই রহস্যময় ব্যক্তি ওকে লক্ষ্য করছে।তাঁর চোখের তীক্ষ্ণ নজর আর মুখাবয়বের অস্বাভাবিক গোপনীয়তা ফিওনার ভেতর গভীর এক অস্বস্তি তৈরি করলো।হৃদস্পন্দন দ্রুত হতে শুরু করলো,আর শরীরের প্রতিটি আণুবীক্ষণিক কোষে এক অদ্ভুত শীতলতা অনুভব হতে লাগলো।
ভয়ের কারণে সে দ্রুত লিয়াকে খুঁজতে লাগলো।
কিন্তু লিয়া আর তার বন্ধুরা ইতিমধ্যে মাতাল হয়ে পড়েছে। তাদের মধ্যে কেউই নিজেকে সংবেদনশীলভাবে অভ্যস্ত না রেখে মনের কোনো অবস্থায় নেই।
ফিওনা একদিকে তাদের অবস্থা দেখে উদ্বিগ্ন হতে লাগলো,অন্যদিকে,ও চেয়েছিল যেন তারা দ্রুত ঘরে ফিরে যায়।
ফিওনা দ্রুত লিয়ার কাছে গিয়ে বললো, “লিয়া,চলো আমরা এখনই বাসায় চলে যাই।আমি তাড়াতাড়ি চলে যেতে চাই।”
লিয়া মাতাল অবস্থায় হাসতে হাসতে বললো,“আরে, একটু সময় তো দাও।পার্টি তো শুরু হয়েছে সবেমাত্র!”
ফিওনার মুখে উদ্বেগ স্পষ্ট হয়ে উঠলো।ও জানালো,
“আমার সত্যিই আর ভাল লাগছে না।আমার যাওয়ার বাসায় দরকার।”
লিয়ার সঙ্গীরা নেচে আর গেয়েই যাচ্ছিল।ফিওনা ততক্ষণে ওর মোবাইল বের করে দ্রুতভাবে ক্যাবের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছিল।ওর মনোযোগ এখন সেই রহস্যময় লোকের দিকে,যে প্রতি মুহূর্তে ওর কাছে ঘনিষ্ঠ হয়ে আসছিলো কোনো অদৃশ্য থাবা তাদের ভেতর প্রবেশের জন্য প্রস্তুত।
ফিওনা ক্লাবে ভেতরে নিজকে একদম অস্বস্তিতে অনুভব করতে লাগলো।ওর চোখের কোনে সেই রহস্যময় ব্যাক্তি এখনো দাঁড়িয়ে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আছে।
হঠাৎ,একজন ছেলে এসে ওর হাত ধরে, “চল, আমাদের সাথে নাচো!” বলে প্রস্তাব দিলো।
ফিওনা নিজের অস্বস্তি প্রকাশ করে বললো, “না, ধন্যবাদ। আমি নাচতে চাই না।” ছেলেটি আপত্তি না মেনে বারবার জোর করতে থাকলো,“আরে, এসো না, একটু মজা হবে!” তার বারবার অনুরোধে ফিওনার বিরক্তি বাড়তে থাকে।
“আমি বলেছি না, আমি নাচব না!” সতর্ক ও উত্তেজিত পরিস্থিতির মধ্যে হঠাৎ ঘটে গেলো একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা।
তৎক্ষণাৎ এক অজ্ঞাত ব্যক্তি ছেলেটির মাথায় একটি কাঁচের বোতল দিয়ে আ’ঘা’ত করলো। কাঁচের বোতল ভে’ঙে মাথায় আ’ঘা’ত লাগতেই, ছেলেটার মাথা ফে’টে র**ক্ত বের হতে শুরু করলো, ছেলেটি মাথায় হাত দিয়ে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়লো। ঘটনাটি এতোটাই তীব্র ছিলো যে সবার মনোযোগ সেদিকে চলে গেলো।
ফিওনা চমকে উঠে। ক্লাবের পরিবেশে একটা অস্থিরতা সৃষ্টি হয়—আলো ও
আর সঙ্গীত বন্ধ হয়ে যায়।
মাতালদের মধ্যে কেউই প্রতিক্রিয়া জানায় না; তারা নিজেদের মতো করে নাচে আর মেতে থাকে। তবে ফিওনার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে রহস্যময় ব্যক্তি,যে ওই ঘটনাটি ঘটিয়েছে,তার দিকে তীব্রভাবে তাকিয়ে থাকে।ফিওনার বুকের মধ্যে এক ধরনের শীতলতা অনুভব হয়।
ম্যানেজার দ্রুত ছুটে আসে,তার মুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট।রহস্যময় ব্যক্তির চোখে হালকা সানগ্লাস ছিল,যা সে নরম করে নিচে নামিয়ে ফেললো।ম্যানেজার তার মুখের অভিব্যক্তি দেখে আরও বেশি ভীত হয়ে পড়লো।
রহস্যময় ব্যক্তি এক নিঃশ্বাসে ফিওনার হাত ধরে,ওর শরীরের অদৃশ্য শক্তি যেন তাকে নীরবভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে।
ফিওনার চোখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট,কিন্তু ওর হাত ধরে নেওয়ার পর,ও কোনোরকম প্রতিরোধ ছাড়াই, অসহায়ের মতো ম্যানেজারের সামনে দিয়ে চলে আসে।
ফিওনা স্বপ্নের মতো সেই লোকের পেছনে পেছনে চলে যায়,ক্লাবের চটজলদি পরিবেশের মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসে।ম্যানেজারার অন্যান্যরা আশপাশের পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করে,কিন্তু ফিওনার অদৃশ্য গতির দিকে কোনো নজর দিতে পারে না।
বাহিরে এসে, রহস্যময় ব্যক্তির গতি অব্যাহত থাকে।ফিওনার মনের ভেতর প্রশ্ন আর উদ্বেগের ছায়া বাড়তে থাকে,কিন্তু ও এক মুহূর্তের জন্যও দাঁড়িয়ে যায় না,ওর হাতের শক্তি মনে যেন কোনো বাধা দেয় না।
ফিওনার চোখের সামনে গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে,একটি গাঢ় রঙের গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল।রহস্যময় ব্যক্তি গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে ফিওনাকে বসতে সাহায্য করে। ফিওনা,অস্বস্তির মাঝে,গাড়ির আসনে বসে পড়ে। রহস্যময় ব্যক্তি ড্রাইভিং সিটে বসে আর গাড়িটি চলতে শুরু করে।
গাড়ির ভেতরের শীতল পরিবেশে,ফিওনার মন অবসন্ন হয়ে পড়ছিল,আর কিছুক্ষণ পরেই ওর সম্বিত ফিরে আসে।
ভয় ও অবাক অবস্থায় তাঁর দৃঢ় কণ্ঠে প্রশ্ন করে,
“কে আপনি?এরকম রহস্যময় পোশাক কেনো? ওই লোকটাকে এমন নি’র্ম’ম ভাবে মার’লেন কেন? আর আমাকেই বা কেনো ওই লোকটার হাত থেকে রক্ষা করলেন?”
রহস্যময় ব্যক্তি গাড়ি থামিয়ে দেয় আর তার মুখে ঠাণ্ডা, গম্ভীর একটি দৃষ্টি নিয়ে ফিওনার দিকে তাকায়।
গম্ভীর কিন্তু শান্ত কণ্ঠে তিনি বলেন, “জ্যাসপার অরিজিন। আমার নাম”।
ফিওনার মনে দ্বিধার সৃষ্টি হয়, ওর কণ্ঠে স্পষ্ট উত্তেজনা আর সন্দেহ। “কি চান? কোথা থেকে এসেছেন”?
জ্যাসপার তাঁর ঠাণ্ডা,শান্ত কণ্ঠে উত্তর দেয়, “আপাতত আমি কিছুই চাই না শুধু তোমার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাই।”
ফিওনার চোখে অস্বস্তি ঝিলমিল করে ওঠে। “আপনি কেনো রাতের বেলায় এমন অদ্ভুতভাবে সানগ্লাস আর মুখে মাস্ক পরেছেন? আমার সামনে আপনার আসল চেহারা দেখান।”
জ্যাসপার ধীরে ধীরে তার সানগ্লাসের দিকে হাত বাড়ায় আর হাসতে হাসতে বলে, “যদি আমি সানগ্লাস খুলে ফেলি আর মাস্ক সরিয়ে ফেলি,তুমি কি আমাকে দেখে ঠিক থাকতে পারবে ? মনে রেখো,যদি তুমি সত্যিই দেখার সাহস রাখো তবে আমি দেখাতে পারবো”
ফিওনা তার কথায় একটু স্নিগ্ধ হাসি দেখতে পায়,
যেটা কেমন যেন রহস্যময় আর অপ্রত্যাশিত।
ফিওনা মৃদু কৌতুহল আর উদ্বেগের মিশ্রণ কন্ঠে প্রশ্ন করলো,, “আপনি কি এতটাই ভয়ানক দেখতে যে আমি দেখে ঠিক থাকতে পারব না? আপনার আসল চেহারা দেখলে আমি কি ভয় পেয়ে যাবো?”
জ্যাসপার ওর মাথা একটু ঝুঁকিয়ে,এক হাতে স্টিয়ারিং এর ওপর রাখে আর অন্য হাতে সানগ্লাস সরানোর জন্য প্রস্তুত হয়।
ফিওনার চোখে সে মুহূর্তে এক অদ্ভুত মিশ্রণ,উত্তেজনা আর অত্যাশ্চর্য রুপ নিল।
জ্যাসপার তার সানগ্লাস খুলে ফিওনার দিকে তাকালো। মাস্কের আড়াল থেকে দুইটি চোখে দেখা গেল।
চোখ দুটি প্রাকৃতিক অলিভ গ্রিন রঙের,যেখানে সোনালী সবুজের মধ্যে হালকা ধূসর টোন দেখা যায়। এই চোখের রঙ যেন ক্যালিডোনিয়ান গাছের পাতা আর সূর্যের আলোতে পরশে নরম সোনালী হালকা আভা মিশিয়ে তৈরি করা অলিভ গ্রিন মিশ্রণ।
এই চোখের রঙ পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর দৃশ্যের প্রতিচ্ছবি—সাগরের গভীরতায় সূর্যের আলোর প্রতিফলন,যা একদিকে শান্ত আর অন্যদিকে রহস্যময়। এই চোখ দুটি গাছের পাতার টোন আর মেঘমুক্ত আকাশের মৃদু ধূসরতা মিশ্রিত,যা তাদের প্রতি দৃষ্টির মাধ্যমে এক অদ্ভুত প্রশান্তি আর গহনতার অনুভূতি প্রদান করে।
ফিওনা এক অজানা পৃথিবীতে হারিয়ে যায়,যেখানে এই চোখের আভা তাকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো ঘিরে ধরে।
ফিওনাকে এতটা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখতে পেয়ে,জ্যাসপার দ্রুত গতিতে গাড়ি স্টার্ট দিলো।গাড়ি ফিওনার ভার্সিটির সামনে এসে থামল।
ফিওনার দৃষ্টি ফিরে এসে বোধের মধ্যে ফিরে এল।
ও অবাক হয়ে দেখলো,ওদের এই সময়ে এসে পিকিং ইউনিভার্সিটির সামনে পৌঁছানোর জন্য কিভাবে সম্ভব হল—উঠে দাঁড়াতে গিয়ে ওর মুখ থেকে বের হলো,
“আপনি কিভাবে জানলেন আমি এখানে থাকি?”
জ্যাসপার রহস্যময় কণ্ঠে উত্তর দিলেন, “ইটস আ সিক্রেট।রাত হয়ে গেছে,ভার্সিটির ভেতরে যাও।”
আযদাহা পর্ব ৪
ফিওনা গাড়ির দরজা খুলে নেমে পড়ল।হালকা হাওয়ার সাথে চোখে মিটমিটে আলোয় চিৎকারের অনুভূতির পর,আরো একবার জ্যাসপারের দিকে তাকিয়ে দেখলো,এরপর একটি রহস্যময় অভিব্যক্তির সাথে ফিওনা উল্টো হেঁটে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণের দিকে প্রবেশ করলো মনের মধ্যে হাজারও প্রশ্ন আর চিন্তা নিয়ে।
ফিওনার চলে যাওয়ার পর,জ্যাসপার গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখেই গাড়ি স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে ছিল। ওর চোখের দৃষ্টি ফিওনার চলার পথে একনিষ্ঠভাবে নিবদ্ধ ছিল,যদিও ওর অনুভূতির গভীরতা আর উদ্দেশ্য স্পষ্ট ছিল না।
ফিওনার চোখের আড়াল হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, জ্যাসপার অল্প কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে গাড়ির ইঞ্জিন ধরে গাড়ি চলানোর জন্য প্রস্তুতি নিল।গাড়ি ধীরে ধীরে সড়কে ছুটতে শুরু করল,গন্তব্যের দিকে গোপন পরিকল্পনা নিয়ে দ্রুত ছুটে চলছিল।