আযদাহা পর্ব ৫৩
সাবিলা সাবি
ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষার পরে অবশেষে ফিওনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারলেন মিস্টার চেন শিং।ভেনাসে পা রাখার পর থেকেই ফিওনার সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ ছিল না।যদিও স্পেসশিপে একটি লাইভ ক্যামেরা বসানো ছিল,তা শুধু শিপের ভেতরের পরিস্থিতি দেখানোর জন্য আর শিপের জানালা থেকে ভেনাসের চিত্র ধারন করার জন্য। ফিওনার সুটে কোনো ক্যামেরা লাগানো হয়নি।কারণ ভেনাসের প্রাণী বা অন্য কোনো বসবাসকারীর ছবি তোলা তাদের নীতির বিরুদ্ধে।
ফিওনার কন্ঠ শোনা মাত্র মিস্টার চেন শিংয়ের বুকের ভেতর থেকে যেন একটা ভার নেমে গেল।অনেক ঘন্টা পর প্রিয় নাতনির কন্ঠ শুনতে পেয়ে আনন্দে তার চোখ ঝলমল করে উঠল। “ফিওনা!আমার নাতনী!তুমি ঠিক আছ?সব ঠিক আছে তো?”
ফিওনার কন্ঠে তেমন কোনো আবেগ প্রকাশ করছিল না।তবে কয়েক মুহূর্ত পরে যখন তার গলার আওয়াজ ভেসে এলো, মিস্টার চেন শিং হতভম্ব হয়ে গেলেন।ফিওনার গলা ভারী, যেন সে অনেকক্ষণ ধরে কান্না আটকানোর চেষ্টা করেছে।
তারপর হঠাৎ করেই ফিওনার গলার স্বর ভেঙে গেল,আর কান্নার শব্দ ভেসে এলো।একটানা হেঁচকি তুলে সে কাঁদতে লাগল। “গ্র্যান্ডপা!”—তার কণ্ঠস্বর আকাশ কাঁপিয়ে দিলো, “আমি ভুল করেছি এখানে এসে।জ্যাসপার আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে।সে…সে আমাকে ভালোবাসে না!আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছে!”
মিস্টার চেন শিংয়ের মুখ থেকে সব রঙ যেন উবে গেল। ফিওনার কথা শুনে তিনি কয়েক মুহূর্ত নির্বাক হয়ে গেলেন। তার নাতনির এই ভেঙে পড়া দৃশ্য তার সহ্য হচ্ছিল না।তিনি নিজেকে সামলে নিয়ে দ্রুত বললেন,“ফিওনা,মন দিয়ে শোনো।এখন তোমাকে শক্ত হতে হবে।তুমি শিপে আছ,ভেঙে পড়লে শিপ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না।আর এটা খুব বিপজ্জনক হবে।শিপের নিয়ন্ত্রণ তুমি কি রোবোটিক প্যানেলের মাধ্যমে চালাচ্ছো?কেন?নিজে কেনো কন্ট্রোল করছো না?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ফিওনা কোনো উত্তর দিল না।সে যেন কেবল নিজের কান্নায় ডুবে ছিল।
মিস্টার চেন শিং আবার ধীর অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, “ফিওনা,তোমাকে আমার কথা শুনতে হবে।এই মুহূর্তে কান্না করে ভেঙে পড়লে,পুরো মিশন ব্যর্থ হবে।তুমি কি সেটা চাও? তুমি কি সত্যিই চাও,এই শিপ ভুল পথে চলে যাক?নিজেকে সামলাও।তুমি একা নও,আমি তোমার সঙ্গে আছি।আমরা সবাই আছি।কিন্তু আগে নিজেকে সামলাও।”
ফিওনা কাঁদতে কাঁদতে বলল,“কিন্তু আমি কীভাবে, গ্র্যান্ডপা? আমি পারছি না।আমি জানি না,কীভাবে এত কিছু সহ্য করব।”
মিস্টার চেন শিং তার গলা শক্ত করলেন।“তুমি পারবে, ফিওনা।তুমি চেন শিংয়ের নাতনি।তুমি ভেঙে পড়ার জন্য তৈরি হওনি।তুমি স্ট্রং।এই মুহূর্তে তোমার সেই শক্তি দরকার। এখন কান্না বন্ধ করো এবং শিপের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নাও।”
কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ বসে রইল ফিওনা।তারপর সে গভীর শ্বাস নিয়ে নিজের কান্না মুছে ফেলার চেষ্টা করল।
“ঠিক আছে,গ্র্যান্ডপা। আমি চেষ্টা করব।” তার কণ্ঠস্বর এখনও ভারী,কিন্তু সেখানে একটা নতুন সংকল্পের ছাপ স্পষ্ট।
“এগিয়ে চলো,ফিওনা,” মিস্টার চেন শিং বললেন।
“তুমি পারবে। আমি জানি।”
ফিওনা চোখ মুছে শিপের প্যানেলের দিকে তাকাল।তার হাতে এবার কাঁপুনির বদলে একটা দৃঢ়তা ছিল।তাকে এবার ফিরতে হবে,ফিরে গিয়ে নিজেকে প্রমাণ করতে হবে।এখন কান্নার সময় নয়।এখন তার সময় সংগ্রামের।
জ্যাসপারের ল্যাবের ভেতরে এক অদ্ভুত নীরবতা।স্ক্রিনের সামনে বসে থাকা জ্যাসপার তার চোখ দুটো এক মুহূর্তের জন্যও সরাচ্ছে না।স্ক্রিনে ফিওনার স্পেসশিপের লাইভ ফিড চলছে।
এই সময় থারিনিয়াস ল্যাবে প্রবেশ করল।হাতে একটি ট্রে, যাতে খাবার সাজানো।জ্যাসপারের আদেশে এখন থেকে থারিনিয়াস প্রতিদিন খাবার ল্যাবেই দিয়ে যাবে।ট্রেটি টেবিলে রেখে থারিনিয়াস বলল,”প্রিন্স,অনেক রাত হয়েছে।আপনার এখন ঘুমানোর প্রয়োজন।আপনার শরীরের বিশ্রাম দরকার।”
জ্যাসপার খাবার খেতে শুরু করল,কিন্তু তার চোখ তখনো স্ক্রিনেই আটকে।কোনও বিরক্তি বা তাড়াহুড়ো ছাড়াই সে শান্ত গলায় বলল,”আমি একটা কেমিক্যাল নিয়েছি।
এটা আমাকে টানা ৪০ দিন না ঘুমিয়ে থাকতে দেবে।”
থারিনিয়াসের মুখে বিস্ময়ের ছাপ ফুটে উঠল।সে বলল, “প্রিন্স,এভাবে নিজেকে ক্ষ*তিগ্রস্ত করছেন কেন?এতো দিন না ঘুমালে আপনার শরীর দুর্বল হয়ে যাবে।এমনকি সাময়িক অসুস্থতাও দেখা দিতে পারে।”
জ্যাসপার থেমে তাকাল থারিনিয়াসের দিকে।তার সবুজ চোখে যেন আগুনের ঝিলিক। ষএক কথায় উত্তর দিল,
“আই ডোন্ট কেয়ার।”
থারিনিয়াসের ঠোঁট নড়ল,কিন্তু সে আর কিছু বলল না।সে জানত,প্রিন্সের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু বলার সাহস তার নেই। তার প্রিয় প্রিন্স হয়তো নিজের শরীরের যত্ন নিচ্ছে না,কিন্তু থারিনিয়াস বুঝতে পারল,এই ল্যাবের একমাত্র মনোযোগ এখন স্ক্রিনের ওই ছবিতে আটকে।
জ্যাসপার আবার স্ক্রিনের দিকে মন দিল।তার চোখে ক্লান্তি স্পষ্ট,কিন্তু সেগুলো উপেক্ষা করার ক্ষমতাও তার অসীম। তার মনে শুধু একটাই চিন্তা—ফিওনা যেন নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরে যাম।যতক্ষণ না সে নিজ চোখে সেটা দেখে,ততক্ষণ সে নিজের জন্য কিছু ভাবার সময়ও পাবে না।
ল্যাবের নীরবতা ভেঙে থারিনিয়াস আবার কথা বলল,তার কণ্ঠে মিশে ছিল কৌতূহল আর দুঃখ।”প্রিন্স,আপনি যদি তাকে এতটাই ভালোবাসেন,তাহলে তাকে যেতে দিলেন কেনো?এভাবে কষ্ট দিয়ে?”
জ্যাসপার ধীরে ধীরে স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে তাকাল থারিনিয়াসের দিকে।তার সবুজ চোখের গভীরতায় যেন শত প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে।ঠাণ্ডা গলায় সে বলল,
“থারিনিয়াস,তুমি তো সবটাই জানো।তাহলে এ প্রশ্ন করছো কেন?”
থারিনিয়াস কিছু বলার আগেই কক্ষের দরজা খুলে গেল। ভেতরে ঢুকল আলবিরা আর এথিরিয়ন।দুজনের মুখেই চিন্তার ছাপ।
এথিরিয়ন প্রথমে মুখ খুলল,”জ্যাসু ভাইয়া।এভাবে চলতে থাকলে অসুস্থ হয়ে পড়বে।তোমার শরীর এতোটা চাপ নিতে পারবে না।”
আলবিরা এগিয়ে এসে খাবারের ট্রেটির দিকে তাকিয়ে দেখল যে জ্যাসপার খুব সামান্যই খেয়েছে।তার কণ্ঠে উদ্বেগ স্পষ্ট হয়ে উঠল,”আপনার এ জেদ শুধু আপনাকেই নয় প্রিন্স আমাদের সবাইকেও চিন্তায় ফেলছে।আমরা কীভাবে আপনাকে এভাবে দেখব?”
জ্যাসপার গভীর নিঃশ্বাস ফেলল।তার দৃষ্টি এক মুহূর্তের জন্যও নরম হলো না।তার গলায় কঠোরতা স্পষ্ট, যেন সবকিছু থেকে নিজেকে দূরে রাখতে চাইছে।”তোমরা সবাই যাও এখান থেকে,” ষসে বলল।”আমাকে একা থাকতে দাও।”
এথিরিয়ন কিছু বলতে যাচ্ছিল,কিন্তু আলবিরা তার হাত ধরে তাকে থামিয়ে দিল।দুজনেই জানত,জ্যাসপার যখন একবার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়,তখন তাকে বিরক্ত করার অর্থ হয় আরও রাগানো।
এথিরিয়ন পুনরায় গম্ভীর কণ্ঠে বললো,”জ্যাসু ভাইয়া,তুমি যা করছো,এতে কী লাভ হচ্ছে?মেয়েটাকে কষ্ট দিয়ে বিদায় করে দিলে,আর তুমি নিজের মধ্যে এত কষ্ট জমিয়ে রাখছো।আমি তোমাকে আগে থেকেই সতর্ক করেছিলাম।আজ যদি ফিওনা আমাকে ভালোবাসতো,আমি কখনোই এমন কিছু করতাম না।”
জ্যাসপার এক ঝটকায় চোখ তুলে তাকালো এথিরিয়নের দিকে।তার সবুজ চোখে ক্ষোভের ঝিলিক।এথিরিয়নের মুখ হঠাৎ চুপসে গেল।
এর মধ্যেই আলবিরা নীরবতা ভেঙে নরম কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে বললো,”প্রিন্স,আপনি আমাদের সত্যিটা বলছেন না কেনো? এমন কী ঘটেছিলো যে আপনাকে ফিওনার সঙ্গে এমন ব্যবহার করতে বাধ্য করলো?”
জ্যাসপার দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিলো,যেন অনেক বড় ভার নামানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর সে বললো,
“তাহলে শোনো। সেদিন,যখন ভেনাসের উপাদান মেশানোর কাজ শেষ হলো,আমি ড্রাকোনিসের কাছে গিয়েছিলাম অনুমতি নিতে পৃথিবীতে যাওয়ার জন্য।”
তার গলা ভারী হয়ে উঠলো।আলবিরা আর এথিরিয়ন একদৃষ্টিতে জ্যাসপারের দিকে তাকিয়ে রইলো।জ্যাসপার আবার বলতে শুরু করলো,”ড্রাকোনিস জানতো আমি পৃথিবীতে ফিওনার জন্যই যেতে চাই। সে অনুমতি দিলো,তবে একটি শর্তে।শর্ত ছিল আমাকে আগে ভেনাসের দেবতার সাথে কথা বলতে হবে,সবটা শোনার পর আমি যা সিদ্ধান্ত নিবো তাই ড্রাকোনিস মেনে নিবেন।
জ্যাসপার চলে গেলো সেদিনের স্মৃতিতে যেদিন প্রথম সে ভেনাসের দেবতার সাথে সাক্ষাত করলো।জ্যাসপার ভেনাসের দেবতাকে যথেষ্ট সম্মান আর বিশ্বাস করেন কেননা পুরো ভেনাসের দায়িত্ব জ্যাসপারের হলেও এই ভেনাসের আগাম বার্তা ভবিষ্যতে নির্ধারন তিনি করে থাকেন ভেনাস দেবতা আভ্রাহার।
ড্রাকোনিস জ্যাসপারকে দেবতার কাছে নিয়ে এলো।দেবতার সিংহাসন ঘিরে ছিলো এক সোনালি জ্যোতি,যা চারপাশের শূন্যতা পূর্ণ করেছিল।জ্যাসপার দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে ছিলো, কিন্তু ভেতরে এক অজানা শঙ্কা যেন কুঁকড়ে ধরছিল তাকে। দেবতা তার চিরাচরিত গাম্ভীর্য নিয়ে বললেন,
“প্রিন্স জ্যাসপার,পৃথিবীতে যাওয়ার জন্য তুমি অনুমতি চেয়েছো।কিন্তু তুমি কি জানো,তোমার ভালোবাসা কেবল তোমার নয়,পুরো ভেনাসের ঔজন্য হুমকি হতে পারে?”
জ্যাসপার ঠোঁট চেপে ধরে বললো,”আমি জানি,কিন্তু আমি ফিওনাকে ছেড়ে থাকতে পারবো না। তার জন্য সবকিছু করতে রাজি আছি।”
দেবতা তখন তার হাত তুলে এক চিত্র ফুটিয়ে তুললেন। ঝাপসা আলো আর ধোঁয়ার মধ্যে ফুটে উঠলো একটি দৃশ্য। সেখানে এলিজিয়ার প্রতিচ্ছবি।দেবতা বললেন,
“জ্যাসপার,তুমি জানো না,তোমার আত্মার প্রকৃত উৎস।তুমি জাইরন আর কায়রার কাহিনী নিশ্চয় শুনেছিলে? তবে শোনো সেই জাইরন আর তার এলিজিয়ার পুনর্জন্ম হয়েছে।সেটা আর কেউ না তুমি, স্বয়ং তুমি জাইরন। এটা শুনে জ্যাসপার হতভম্ব হয়ে গেলো। দেবতা পুনরায় বলা শুরু করলো “অতীতে জাইরন যে এলিজিয়াকে ভালোবাসতো, সেই আত্মাও পুনর্জন্ম নিয়েছে।তবে এখন সে আর এলিজিয়া নয়।এলিজিয়া এই জন্মে ভেনাসের প্রিন্সেস অ্যালিসা। ফিওনা মানবী কন্যা সে এই চক্রের বাইরে,তোমার আর অ্যালিসার পুনর্জন্ম হয়েছে পুনর্মিলনের জন্য, ইতিহাস পুনরাবৃত্তি হয়েছে অতীতের কালজয়ী অধ্যায় মুছে ফেলার জন্য।”
জ্যাসপার অবাক হয়ে তাকালো।”কিন্তু এটা আগে কেনো জানলাম না আমি আর পুনর্জন্ম কেনো হলো কি উদ্দেশ্যে?”
দেবতা ধীরে ধীরে বললেন,
“এটা প্রকৃতির খেলা।তবে তুমি যদি ফিওনা ওই মানবীর কাছে যাও তার জীবনের সমাপ্তি ঘটবে।প্রকৃতি তাকে তোমার মতো শক্তির কাছে নিরাপদ রাখবে না কারন তুমি তার কাছে যাওয়া মানে প্রকৃতির ভবিষ্যতের বিরুদ্ধে যাওয়া,তখন ফিওনা প্রকৃতির শত্রু হবে আর তোমাদের ভালোবাসার শত্রু হবে সে এই জন্মের।”
এরপর দেবতা আরেকটি দৃশ্য দেখালেন—ফিওনা জ্যাসপারের হাত ধরে আছে,এবং তার শরীর ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ছে।মাটি ফাটছে,বাতাস উন্মত্ত,আর ফিওনার নিথর দেহ জ্যাসপারের বুকে লুটিয়ে পড়েছে।এই দৃশ্য দেখে জ্যাসপার থমকে গেল।
ড্রাকোনিস ধীরে ধীরে বললো,
“মাই সান!তুমি বুঝতে পারছো তো?ফিওনাকে বাঁচানোর একমাত্র উপায় হলো তাকে দূরে রাখা,তোমার কারনে একজন নিরীহ সাধারন মানবীর মৃত্যু হবে সেটা কি তুমি চাও?”
জ্যাসপার গভীর শ্বাস নিয়ে নিজের সিদ্ধান্ত জানালো,
“আমি আর ফিওনার কাছে যাব না।আমি তাকে ভালোবাসি, তাকে রক্ষা করতে আমি সবকিছু করতে প্রস্তুত।”
ড্রাকোনিস আর দেবতা শান্ত হলো।কিন্তু হঠাৎ জ্যাসপার এক কঠোর দৃষ্টিতে দেবতার দিকে তাকিয়ে বললো,
“তবে শুনুন,আমি অতীতের জাইরন নই।আমার ভালোবাসা শুধুই ফিওনার জন্য।অ্যালিসা যদি এলিজিয়ার পুনর্জন্ম হয়েও থাকে,তা আমার কিছু যায় আসে না।কারন আমি এই জন্মের জ্যাসপার আর এই জনমে জ্যাসপার শুধুমাত্র ফিওনাকেই ভালোবাসে আর সারাজীবন ভালোবেসে যাবে। ফিওনাকে পাবার জন্য আমি ইতিহাস বদলাতেও প্রস্তুত আবার ওকে বাঁচাতে আমি ওর থেকে দূরে থাকতেও প্রস্তুত।”
দেবতা কিছুক্ষণ নীরব রইলেন।তারপর তার ঠোঁটে এক অদ্ভুত রহস্যময় হাসি ফুটে উঠলো।তিনি বললেন,
“তাহলে সময়ই বলে দেবে,জ্যাসপার।ইতিহাস কি তোমাকে সাহায্য করবে,নাকি তোমার এই প্রতিজ্ঞাই তোমার ধ্বং*স ডেকে আনবে।”
ড্রাকোনিস চিন্তিত দৃষ্টিতে জ্যাসপারের দিকে তাকালো।সে জানে জ্যাসপার সহজে হার মানবে না।কিন্তু তার এই জেদ তাকে কোথায় নিয়ে যাবে,তা কেবল ভবিষ্যতই জানে।
আলবিরা, থারিনিয়াস এবং এথিরিয়ন—তিনজনই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।জ্যাসপারের কথাগুলো যেন তাদের বুকের ভেতরে ভারী পাথরের মতো আঘাত করছিল।ল্যাবের নির্জন পরিবেশে এক গভীর নীরবতা নেমে এলো।জ্যাসপার ধীরে ধীরে স্ক্রিন থেকে মুখ সরিয়ে তাদের দিকে তাকালো।তার সবুজ চোখগুলোতে এক অপূর্ব বেদনার ছাপ ছিল।
জ্যাসপার গভীর এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“আজ যদি কেউ ফিওনাকে বলতো যে আমার কাছে আসলে তার মৃত্যু হবে,আর সেই দৃশ্যটা তাকে দেখাতো,সে কী করতো?আমি জানি,ফিওনা ঠিক এটাই করতো যা আমি করেছি।সে আমাকে ভালোবাসে,তাই সে আমাকে রক্ষা করতে নিজের ভালোবাসাকে ত্যাগ করতো।”
জ্যাসপার চোখ বন্ধ করে এক মুহূর্ত বসে থাকলো।যেন নিজের মনের গভীরে আরও কিছু বলতে চাইছে।তারপর নিচু স্বরে বললো,”আমি শুধু চাই,ফিওনা আমার কাছ থেকে দূরে থাকলেও ভালো থাকুক।আমাকে ঘৃণা করলেই যদি সে ভালো থাকে,তাহলে সে ঘৃণাই সই।তার কাছ থেকে দূরে থাকতে, তাকে নিরাপদ রাখতে আমি যা করেছি,সেটাই সঠিক ছিল।”
থারিনিয়াস গলার স্বর নরম করে বললো,
“প্রিন্স,আপনি এমনটা করলেন,অথচ নিজেকে পুরোপুরি ধ্বং*স করছেন।এভাবে কি আপনি সত্যিই ফিওনার ভালো চেয়েছেন?”
জ্যাসপার এক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে থারিনিয়াসের দিকে তাকালো। তার মুখে দৃঢ়তা স্পষ্ট।”তোমরা বোঝোনা।ভালোবাসা মানে কেবল নিজের প্রিয়জনকে কাছে রাখা নয়।ভালোবাসা মানে তার সুখ নিশ্চিত করা,তার সুরক্ষা নিশ্চিত করা।আমার মৃ*ত্যুও যদি তাকে রক্ষা করতে পারে,আমি তাই করবো। তাকে কাছে পাওয়ার স্বপ্নই যদি তাকে কষ্ট দেয়,আমি সেই স্বপ্নকে ত্যাগ করবো।”
আলবিরা ফুঁপিয়ে বললো,”কিন্তু প্রিন্স,আপনি জানেন না,ফিওনা এখন কতটা ভেঙে পড়েছে।তার কষ্টের জন্য নিজেকে দায়ী করবেন না।”
জ্যাসপার কণ্ঠে এক অদ্ভুত কঠোরতা নিয়ে বললো,
“আমি জানি ফিওনা কষ্ট পাচ্ছে।কিন্তু তার কষ্টের থেকে তার জীবন বেশি গুরুত্বপূর্ণ।একদিন সে এই কষ্টকে অতিক্রম করবে।সে নিজের সুখ খুঁজে নেবে।কিন্তু আমি কখনোই তার মৃ*ত্যুর কারণ হতে পারি না।”
এথিরিয়ন তখন হতাশ গলায় বললো,
“জ্যাসু ভাইয়া,আমরা সবাই জানি তুমি ফিওনাকে কতটা ভালোবাসো।কিন্তু তুমি কি জানো,এই ত্যাগ তোমার নিজের জীবনকে ধ্বংস করছে। একদিন তুমি নিজেই টিকতে পারবে না।”
ল্যাবের বাতাস ভারী হয়ে উঠলো জ্যাসপারের কথায়। তার মুখে এক অদ্ভুত বেদনা আর দৃঢ়তার ছাপ। আলোর ম্রিয়মান ছটা তার চোখের গভীর অনুভূতিগুলোকে যেন আরও স্পষ্ট করে তুললো।
জ্যাসপার ধীরে ধীরে বললো,
“দেবতা যদি আমাকে বলতো আমি ফিওনার কাছে গেলে আমার মৃ*ত্যু হবে, তবুও আমি ফিওনার কাছে যেতাম।তাকে আপন করে নিতাম।নিজের মৃ*ত্যুকে হাসিমুখে বরণ করে নিতাম।কিন্তু আমার ভালোবাসা,আমার হামিংবার্ড… যদি তার মৃ*ত্যু আমার কারণে হতো,সেটা এই জন্মেও মেনে নিতে পারতাম না।”
তার কথাগুলো যেন চারপাশের নীরবতাকে ভেদ করে এক গভীর অর্থ নিয়ে ছড়িয়ে পড়লো।থারিনিয়াস কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর গভীর শ্বাস ফেলে বললো,
“প্রিন্স,ফিওনা যাওয়ার আগে আপনার জন্য একটা বার্তা রেখে গেছে।”
জ্যাসপার একটু ভ্রু কুঁচকালো।তার চোখে কৌতূহল আর সংশয়।”কী বার্তা?”
থারিনিয়াস কণ্ঠ দৃঢ় করে বললো,
“ফিওনা বলেছে,আপনি যতোই অস্বীকার করুন,যতোই তাকে প্রত্যাখ্যান করুন,তবুও সে আপনাকে সারাজীবন ভালোবাসবে।এলিসন ফিওনা আপনাকে এই মহাবিশ্বের চেয়েও বেশি ভালোবাসে।”
থারিনিয়াসের কথা শেষ হতে না হতেই ঘরের ভেতর যেন এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে এলো।জ্যাসপার স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। তার চোখে এক গভীর ব্যথা।থারিনিয়াসের কথাগুলো তার হৃদয়ের গহীনে গিয়ে আঘাত করেছিল।
জ্যাসপার মাথা নিচু করে একটু থেমে রইলো।তারপর কণ্ঠ ভারী করে বললো,”এতোটা তার ভালোবাসা…যে আমি তার মনে আমার জন্য ঘৃণা জন্ম দিতে পারিনি।আমি চেয়েছিলাম সে আমাকে ঘৃণা করুক,আমাকে ভুলে যাক।তবুও সে…।”
সে মুখ তুলে তাকালো,তার চোখে পরাজয়ের ছাপ স্পষ্ট।
“আমি হেরে গেছি।তার ভালোবাসার কাছে আমি সম্পূর্ণ পরাজিত।”
আলবিরা আর থারিনিয়াস নির্বাক হয়ে জ্যাসপারের দিকে তাকিয়ে রইলো। এই মুহূর্তে তারা বুঝতে পারলো, ভালোবাসার কাছে পরাজিত হওয়ার বেদনা কতটা গভীর হতে পারে। জ্যাসপার,যে সারা জীবন শক্তি আর ক্ষমতার প্রতীক ছিল আজ এক মানবী নারীর ভালোবাসার কাছে ভেঙে পড়েছে।
আলবিরা একটু মুচকি হেসে বললো,
“সত্যি,ফিওনার ভালোবাসার কোনো তুলনা হয় না।সে একজন সাধারণ মানবী হয়েও ভেনাসে চলে এসেছে। কতোটা সাহসী সে!কতোটা দৃঢ় তার ভালোবাসা!”
জ্যাসপার আলবিরার কথা শুনে একটু থেমে গেলো।তারপর গভীর এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,”এটাই তো,আলবিরা। ফিওনা কখনোই সাধারণ নয়।সে সব দিক থেকেই অসাধারণ।তার সাহস,তার নিষ্ঠা,তার ভালোবাসা—এসবের কারণেই ভেনাসের ড্রাগন প্রিন্স তার প্রেমে পড়েছে।”
তার কণ্ঠে এক অদ্ভুত গর্বের সুর ছিল,তবুও কোথাও একটা বেদনার ছাপ লুকিয়ে ছিল।
জ্যাসপার একটু থেমে আবার বললো,
“পাগলিটা!আমি কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি,সে এভাবে ভেনাসে চলে আসবে।আমার জন্য এত বড় ঝুঁকি নেবে।আমি চেয়েছিলাম তাকে দূরে রাখতে,নিরাপদ রাখতে। কিন্তু সে… সে নিজেই আমার কাছে চলে এলো।”
আলবিরা মৃদু হেসে বললো,
“ভালোবাসার শক্তি তো এটাই,প্রিন্স।আপনি যতোই তাকে দূরে রাখতে চান না কেন,সে আপনাকে ছেড়ে থাকতে পারবে না।”
জ্যাসপার মাথা নিচু করে বললো,
“জানি।কিন্তু তাকে রক্ষা করার জন্যই আমি তাকে দূরে পাঠিয়েছি।আমার কাছে থাকলে সে নিরাপদ থাকবে না। আমি চাই,সে সুখে থাকুক।”
আলবিরা তখন আর কিছু বললো না,কিন্তু তার চোখে দেখা গেলো জ্যাসপারের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।একজন ড্রাগন প্রিন্স, যে তার ভালোবাসার জন্য নিজের অনুভূতিগুলোকে দমন করছে,তার ত্যাগ সত্যিই অতুলনীয়।
এথিরিয়ন একধাপ এগিয়ে এসে জ্যাসপারের দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে বললো,”সত্যি,জ্যাসু ভাইয়া,তোমরা দুজন দুজনের জন্যই তৈরি।ফিওনা তোমাকে বেছে নিয়ে কোনো ভুল করেনি।তুমি তাকে ডিজার্ভ করো।”
জ্যাসপার কিছুক্ষণ এথিরিয়নের কথা শুনে চুপ করে রইলো। যেন নিজের ভেতরে কথাগুলো মেলানোর চেষ্টা করছে।
এথিরিয়ন আবার বললো,
“তোমার প্রতি তার যে ভালোবাসা,তার সাহস আর তার আত্মবিশ্বাস—সবকিছুই প্রমাণ করে,সে জানে তুমি তার জন্য ঠিক।আর আমার মনে হয়,আমিও জানি।ফিওনা আমার কাছ থেকে তোমার কাছেই বেশি সুরক্ষিত।আমি যদি কখনো তার জায়গায় থাকতাম,আমিও তোমাকেই বেছে নিতাম।”
জ্যাসপার এক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করলো,যেন নিজের আবেগ সামলাতে চেষ্টা করছে। তারপর ধীর কণ্ঠে বললো,
“এথিরিয়ন,সুরক্ষা শুধু শারীরিক নয়।আমি জানি আমার সঙ্গে থাকলে সে কখনো সুখী হবে না।সে সব সময় বিপদের মুখোমুখি হবে।তার থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি তার মঙ্গলেই।”
এথিরিয়ন হালকা হেসে বললো,
“তোমার এই ত্যাগই প্রমাণ করে,তুমি তাকে কতটা ভালোবাসো।কিন্তু আমি একটাই বলবো,হয়তো একদিন সে নিজেই আবার তোমার কাছে ফিরে আসবে,আর তখন তুমি তাকে আটকানোর আর কোনো কারণ খুঁজে পাবে না।”
জ্যাসপার কিছু বললো না।শুধু স্ক্রিনে ফিওনার শেষ দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে থাকলো,যেন ওখান থেকেই কোনো সান্ত্বনা খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছে।
সবাই কক্ষ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর জ্যাসপার গভীর একটি নিঃশ্বাস ছাড়লো।তার হৃদয় ভাঙা,মনে দ্বন্দ্ব চলছিল। এক মুহূর্তের জন্য তিনি নিজেকে হারিয়ে ফেললেন।
অবশেষে,নিজের চিন্তায় ডুবে গিয়ে বললো,
“একটা সময় আমি গর্ব করতাম যে আমি ড্রাগন হয়ে জন্ম নিয়েছি।আমি ভেনাসের ড্রাগন প্রিন্স—সবচেয়ে শক্তিশালী, সবচেয়ে বুদ্ধিমান।কিন্তু আজ মনে হচ্ছে,আমার ড্রাগন হয়ে জন্ম নেয়া ছিল সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যাপার।”
তিনি কিছুক্ষণ থেমে থেকে বললেন,
“আজ যদি আমি সাধারণ মানব হয়ে পৃথিবীতে জন্মাতাম, তাহলে এক নিমিষেই তোমাকে আমার করে পেয়ে যেতাম। কোনো বাধা থাকতো না।”
তার চোখের কোণে জল জমে গেল।সে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলেও,ফিওনার কথা মনে পড়লেই তার হৃদয়ে একটা তীব্র বেদনা অনুভব হচ্ছিল।
“হামিংবার্ড,”তিনি আবার বললেন,”তুমি আমার কাছে কতটা মূল্যবান,তা আমি কখনোই প্রকাশ করতে পারবোনা আর। তবে আজ আমি জানি,তোমার জন্য আমি কতদূর যেতে পারি।তোমাকে হারানোর চিন্তাও আমাকে ভেঙে দেয়।”
জ্যাসপারের মুখে এক অস্পষ্ট হাসি এল,কিন্তু তা অশ্রু লুকিয়ে রাখতে পারলো না।মনে মনে সে আকাঙ্ক্ষা করলো যে,একদিন সে ফিওনাকে আবার ফিরে পেতে চায়,যেন তার হৃদয়ের সেই বিশেষ জায়গাটা পূর্ণ হয়।
চল্লিশ দিনের দীর্ঘ যাত্রা শেষে,ফিওনার স্পেসশিপ পৃথিবীতে ল্যান্ড করার জন্য প্রস্তুত ছিল।তবে,যখন সে সাগরের ওপরে অবতরণের প্রক্রিয়া শুরু করল,তখন হঠাৎ করে শিপের প্যানেলে অদ্ভুত একটি বার্তা ভেসে উঠলো—”শিপ নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে!”
মিস্টার চেন শিং এবং তার বন্ধুর হুয়াং ঝির মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল।তাদের কাছে বোঝা গেলকিছু গুরুতর ভুল হয়েছে।রেড এলার্ট সিগনাল জ্বলতে লাগল,আর জ্যাসপারের হিডেন ক্যামেরা জ্যাসপারের কাছে সংকেত পাঠাতে শুরু করলো।
এদিকে,ফিওনা বুঝতে পারল যে শিপটি ব্লাস্ট হতে যাচ্ছে। মনোবল ধরে রাখতে না পেরে সে সুটের জিপার খুলতে লাগলো।সুটের ভারী আবরণ থেকে মুক্ত হতে চাইল “এটাই আমার শেষ সুযোগ,”সে মনে মনে ভাবলো।দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে সে একটি মুহূর্তের জন্য পেছনে তাকালো।
শিপের ভিতর থেকে সংকেতের আওয়াজ,অ্যাম্বার এলার্টের শব্দ,এবং কম্পনের অনুভূতি তার মনে ভয় তৈরি করেছিল। কিন্তু সে জানতো,বাইরে সাগর অপেক্ষা করছে।জানালার দিকে তাকিয়ে,প্রশান্ত মহাসাগরের বিশাল জলরাশি তাকে ডাকছে।
“এবার আর ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়,”ফিওনা দৃঢ় সংকল্পে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইলো।নিয়ন্ত্রণহীনভাবে চলতে থাকা শিপটি তার দিকে এগিয়ে আসছিল।
শিপের নিয়ন্ত্রণ প্যানেল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া তার সুটটি যেন একটি বর্মের মতো তাকে গিলে নিচ্ছিল।একবার শিপের শক্তিশালী প্রপেলারের গর্জন তার হৃদয়কে ভেঙে দিতে লাগলো।
“আমি মুক্তি চাই,”সে নিজের কণ্ঠস্বরে বললো,যেন শিপের ভেতরের যান্ত্রিক কন্ঠস্বরের বিরুদ্ধাচারণ করছে।
অবশেষে ফিওনা সুট খুলে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো। নিচে বিশাল প্রশান্ত মহাসাগরের নীল জলরাশি অশান্তভাবে তরঙ্গাতে লাগলো।এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেল,তারপর সে চোখ বন্ধ করে নিল।
মনে-মনে ভেসে উঠলো একাধিক স্মৃতি—মায়ের মিষ্টি হাসি, বাবার স্নেহময় আলিঙ্গন,তাদের দুর্ঘটনাজনীত মৃত্যু এবং তার গ্র্যান্ডপা আর মিস ঝাং-এর আদর।এই মুহূর্তগুলো যেন তাকে জীবনের গভীরতায় ডুবিয়ে দিল।
তার ঠোঁট ফিসফিস করে,’আমার পৃথিবী বোধহয় এখানেই শেষ।’
শেষবারের মতো জ্যাসপারের মুখ তার মনে ভেসে উঠলো। কিছুটা তাচ্ছিল্যের হাসি ঠোঁটে খেলতে লাগলো।”তুমি ঠিকই বলেছিলে,প্রিন্স,” সে বললো,”ভালোবাসা মানুষকে ধ্বং*স করে দেয়,মৃ্*ত্যুর দিকে ঠেলে দেয়।কিন্তু তোমাকে দেখার আকাঙ্ক্ষা,আমার মৃত্যু*র পরেও শেষ হবে না।”
এরপর, ক গভীর শ্বাস নিয়ে,ফিওনা ঝাঁপ দিল গভীর সমুদ্রে। পেছনে স্পেসশিপটি আগুনের কুণ্ড*লিতে পরিণত হলো। শিপটির বি*স্ফোরণের শব্দ এবং তীব্র শিখা তার শরীরের কাছে পৌঁছাল,কিন্তু সে এসবের কিছুই অনুভব করলো না।
জলের গভীরতার দিকে নিমজ্জিত হয়ে,ফিওনার মনে এক নতুন স্বাধীনতা অনুভূতি জন্ম নিল।সে জানতো,সাগরের নীল জলে তার সমাপ্তি হলেও,হৃদয়ে জ্যাসপারের প্রেম চিরকাল বেঁচে থাকবে।
এদিকে, যখন স্পেসশিপটির বি*স্ফোরণ ঘটলো,মিস্টার চেন শিং একটি ভয়ংকর চিৎকার করে উঠলেন,“ফিওনা!”তার কণ্ঠস্বর ছিল আতঙ্কিত এবং হৃদয় বিদারক।
বিস্ফো*রণের তীব্র শব্দের সঙ্গে সঙ্গে তার শরীরের মধ্যে একটা শূন্যতা অনুভব হলো,যেন সব কিছু হারিয়ে গেছে। হঠাৎ করে,তার হৃদপিণ্ড দ্রুত স্পন্দিত হতে শুরু করলো।চেন শিং এর বন্ধু হুয়াং ঝি অবাক হয়ে গেল,কারণ সে দেখেছিল মিস্টার চেনের মুখে আতঙ্ক এবং অসহায়ত্ব।
“চেন,তুমি ঠিক আছো?” হুয়াং ঝি দ্রুত এগিয়ে এসে তাকে ধরে রাখলো।
“আমার কিছু হয়নি,তবে…ফিওনা!” মিস্টার চেন শিং তার হৃদয়গ্রাহী অনুভূতি প্রকাশ করতে পারছিলেন না।তাঁর চেহারায় ভীতির ছাপ যেন সমস্ত পৃথিবী তার চারপাশে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
“তোমাকে এখনি প্রাথমিক চিকিৎসা করতে হবে!” হুয়াং ঝি তার একজন সদস্যকে তৎক্ষণাত নির্দেশ দিলো।তারা তাকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে গেলো,সেখানে একজন ডাক্তার আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন।
ডাক্তার দ্রুত কাজ শুরু করলেন,মিস্টার চেন শিং-এর বুকে চাপ দিয়ে হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণগুলো পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। “আমার কথা শুনুন,শ্বাস নিন।শান্ত থাকুন!” ডাক্তার তার দিকে চোখ মেলে বললেন।
মিস্টার চেন শিং-এর মাথায় শুধু ফিওনার মুখ ভেসে উঠছিল। তিনি ভাবছিলেন,“কী হয়ে গেলো আমার ফিওনার?”এই চিন্তায় তার হৃদয়টি আরো দ্রুত স্পন্দিত হতে লাগলো।
প্রথমিক চিকিৎসা চলাকালীন, হুয়াং ঝির মাঝে চাপ এবং আতঙ্কের ছায়া ছিল।সে জানতো,ফিওনার জন্য তার বন্ধুর জীবন বিপন্ন ।“ফিওনা ফিরে আসবে,আমি বিশ্বাস করি,”চেন শিং এর বন্ধু বললেন,তবে তার কণ্ঠে বিশ্বাসের চেয়ে সংশয় ছিল বেশি।
কিন্তু মিস্টার চেন শিং-এর মনে,ফিওনার অশ্রু ঝরা চেহারা আর মৃ*ত্যুর মুখ কল্পনা করতেই যেন সব কিছু শেষ হয়ে যাওয়ার মতো অনুভব হচ্ছিল।
ফিওনা গভীর প্রশান্ত মহাসাগরের জলে তলিয়ে যেতে যেতে এক দুঃস্বপ্নের মতো অনুভব করছিল।পানির চাপ তার শরীরকে গ্রাস করে ফেলছিল,এবং অক্সিজেনের অভাবে তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল।প্রতিটি শ্বাস ক্রমশই দুর্বল হচ্ছিল, যেন শরীরের সমস্ত শক্তি শেষ হয়ে আসছে।
পানির অন্ধকারে ফিওনা অনুভব করলো,তার চারপাশে অসংখ্য মাছ সাঁতার কাটছে,কিন্তু সেগুলো তার দৃষ্টির বাইরে চলে যাচ্ছে। সে জানত যে তার মৃত্যুর পথ প্রশস্ত হয়ে উঠছে, কিন্তু তার মনে কোনো ভয় ছিল না।স্মৃতিগুলো ধীরে ধীরে তার মনে ভেসে উঠতে লাগলো—মায়ের হাসি,বাবার আদর, গ্র্যান্ডপা এবং মিস ঝাং-এর প্রশ্রয় আর জ্যাসপারের গভীর ভালোবাসা, অবশেষে জ্যাসপারের প্রত্যাখ্যান সেই মুহূর্তগুলো যেন জলের গভীরতায় গাঢ় হতে শুরু করল।
আযদাহা পর্ব ৫২
অক্সিজেনের অভাব তাকে শ্বাস নিতে দিচ্ছিল না,এবং সে অনুভব করছিল,শরীরের শক্তি যেন একেবারে শেষ হয়ে যাচ্ছে। চোখ দুটো ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে আসছিল,আর জলের তলায় হারিয়ে যাওয়ার সময়ে সে মনে মনে ভাবছিল,
“এটাই কি আমার শেষ?”
জলের চাপ আর অক্সিজেনের অভাব তাকে খুব দ্রুত নিচে টানছিল।কষ্টের মধ্যে সে অনুভব করলো,তার শ্বাস ফুরিয়ে আসছে, এবং তার মুখ দিয়ে জল প্রবাহিত হচ্ছে।সে অজ্ঞান হয়ে যেতে লাগলো আর চোখ দুটো এখন সম্পূর্ণ বন্ধ।গভীর থেকে আরো গভীরে তলিয়ে যেতে থাকলো,যেন সাগরের অন্ধকারে তার আত্মা হারিয়ে যাচ্ছে।
মনে হচ্ছিল,এই মুহূর্তে তার হৃদয়ে কোনো দাগ নেই,শুধু এক নীরবতা। সবকিছু ধীরে ধীরে মুছে যেতে লাগলো,এবং ফিওনা জানতো,সে আর ফিরে আসবে না আর কোনদিন দেখতে পাবেনা তার গ্ৰান্ডপাকে।আর কোনদিন ছুঁতে পারবে না তার ভালোবাসার প্রিন্সকে।