আযদাহা পর্ব ৫৪

আযদাহা পর্ব ৫৪
সাবিলা সাবি

প্রশান্ত মহাসাগরের অন্ধকার গভীরে ফিওনা তলিয়ে গেছে।তার শরীর নি*স্তেজ,দুই হাত উপরের দিকে ভাসছে।অতিরিক্ত পানি গলায় ঢুকে গেছে,আর অক্সিজেনের অভাবে তার শরীরের সমস্ত শক্তি হারিয়ে গেছে।শূন্য চোখ আর নিথর হাতের মাধ্যমে ফিওনার অস্তিত্ব যেন সমুদ্রের গভীরতায় বিলীন হতে চলেছে।
ঠিক সেই মুহূর্তে আকাশে এক অদ্ভুত দৃশ্য।প্রবল ঝড় শুরু হয়েছে,যেন প্রকৃতি নিজেই কেঁদে উঠেছে।আকাশ বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত,আর সাগরের উত্তাল ঢেউ ফেনায়িত।হঠাৎ করেই এক বিশাল সবুজ ড্রাগন বিদ্যুৎবেগে আকাশ চিরে নিচে নামল।জ্যাসপার!তার চেহারায় তীব্র ক্ষোভ আর ব্যাকুলতা।
ড্রাগন রূপে জ্যাসপার সমুদ্রের গভীরে ঝাঁপিয়ে পড়ল।তার ভারী শরীরের কারণে মুহূর্তেই সমুদ্রজলে একপ্রকার ভূমিকম্পের সৃষ্টি হলো।গভীর জলে ড্রাগনের তীক্ষ্ণ চোখ খুঁজে নিলো ফিওনাকে।তার শরীর নিথর,তবে প্রাণের একটা মৃদু স্পন্দন এখনও বাকি।

জ্যাসপার তার বিশাল ড্রাগনপিঠ ফিওনার নিচে স্থির করল।নিথর মানবীর শরীরটা সে সাবধানে তুলে নিয়ে ওপরে উঠতে লাগল।তার ডানাগুলো বিশাল গতিতে নাড়তে শুরু করল,আর এক মুহূর্তেই সে সমুদ্রপৃষ্ঠ ভেদ করে আকাশে উড়াল দিলো।ঝড় যেন তার পথ ছেড়ে সরে গিয়ে তাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করছে।
ফিওনাকে নিয়ে জ্যাসপার বেশিদূর গেল না।সামনেই “লুনার দ্বীপ”—এক বিরান,রহস্যময় স্থানে সে নেমে এলো।এই দ্বীপটিকে ঘিরে ছিল চিরসবুজ বৃক্ষ আর নিঃশব্দ প্রকৃতি। তীব্র ঝড়ের মাঝেও এই দ্বীপ যেন এক সুরক্ষিত আশ্রয়।
জ্যাসপার সাবধানে ফিওনাকে মাটিতে শুইয়ে দিল।তার ড্রাগন চোখের কঠিনতায় এবার এক গভীর উদ্বেগ ফুটে উঠল।বাতাসে তার নিঃশ্বাসের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ল,যেন পুরো দ্বীপকেই উষ্ণ করে তুলল।ফিওনার মুখের দিকে তাকিয়ে,সে কপালে বিশাল ড্রাগনের নরম নখ দিয়ে একবার আলতো ছোঁয়া দিলো।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

জ্যাসপার ড্রাগন রূপ থেকে ফিরে মানব রূপ নিলো।তার চেহারা ভেজা,চোখে একধরনের আ*তঙ্ক।ফিওনার নিথ*র দেহ তার দু’হাতে তুলে নিলো,বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরল।এক হাত দিয়ে ফিওনার মুখ স্পর্শ করল,আরেক হাত দিয়ে চুল সরিয়ে বারবার ডাকতে লাগল,“ফিওনা…ফিওনা…চোখ খোলো,প্লিজ!”
কিন্তু কোনো সাড়া নেই।ফিওনার নিস্তব্ধ মুখ দেখে জ্যাসপারের বুকের ভেতরটা টুকরো টুকরো হয়ে গেল।তার শক্তি,তার অহংকার—সবকিছু যেন মুহূর্তেই হারিয়ে গেল।
জ্যাসপার ফিওনাকে মাটিতে শুইয়ে দিলো।দ্রুত তার পেট চেপে ধরে চেষ্টা করলো সাগরের গিলে ফেলা পানি বের করতে।কিন্তু কোনো ফল হলো না।
আকাশে ঝড়ের গর্জন আর বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজ তাকে যেন আরো বিচলিত করলো।এক মুহূর্ত দেরি না করে জ্যাসপার ফিওনার ঠোঁটের ওপর নিজের ঠোঁট রেখে শ্বাস দিতে লাগল।সে নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে অক্সিজেন দিচ্ছে, বারবার ফিওনাকে জীবন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে।

“ফিওনা!প্লিজ!রেসপন্স করো!”তার কণ্ঠে তীব্র আকুতি। একবার…দুইবার…তিনবার…তবুও ফিওনা রেসপন্স করছে না।জ্যাসপারের সবকিছু যেন থেমে যাওয়ার উপক্রম।তার চোখের কোণে অশ্রু জমে উঠলো।
ঠিক তখনই,ফিওনার শরীরটা একটু নড়ে উঠল।তার ঠোঁট থেকে হালকা কাশির শব্দ ভেসে এলো।পানি তার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো,আর সে ধীরে ধীরে চোখ খুলল।“হামিংবার্ড!”জ্যাসপারের কণ্ঠ আনন্দ আর স্বস্তিতে ভরে উঠল।
ফিওনার চোখ খুলতেই প্রথমে সবকিছু ঝাপসা লাগলো। দৃষ্টির সামনে সবকিছুই আবছা,কিন্তু একজোড়া উজ্জ্বল সবুজ চোখ যেন তার পুরো পৃথিবীটা দখল করে নিল।ফিওনার মুখে একপ্রকার বিস্ময় খেলে গেল।সে ভালো করে দেখার চেষ্টা করলো।তার বুক ধীরে ধীরে ওঠা-নামা করছে, তবে চোখে অবিশ্বাসের ছাপ স্পষ্ট।
এক মুহূর্তের মধ্যেই জ্যাসপারের মুখাবয়ব স্পষ্ট হয়ে উঠল তার সামনে।সেই অদ্ভুত সুন্দর মুখ,তীক্ষ্ণ চোয়াল,আর গভীর সবুজ চোখ,রক্তিম বেগুনী ঠোঁট,ঘাড়ের ড্রাগন ট্যাটু—সবকিছু যেন একবারে জ্বলজ্বল করছে।ফিওনার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে গেল।

সে ধীরে ধীরে উঠে বসল,চোখের দৃষ্টিকে আরও পরিষ্কার করার চেষ্টা করল।কিন্তু তার মনে হলো,এই দৃশ্যটা বাস্তব হতে পারে না।তার ঠোঁট ফিসফিস করে উঠল,“আমি কি… মা*রা গেছি?”
জ্যাসপার চুপ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে।তার মুখে কোনো আবেগের ঝলক নেই,কিন্তু তার চোখ বলে দিচ্ছে সে কতটা আত*ঙ্কিত ছিল।
ফিওনা নিজের চারপাশে তাকালো।ঝড় থেমে গেছে,তাদের ঘিরে দ্বীপের নির্জনতা আর প্রশান্তি।কিন্তু ফিওনার মনে হলো,সে কোনো দুঃস্বপ্নে আটকে আছে।তার ঠোঁট কাঁপতে কাঁপতে বলে উঠল,“তুমি…প্রিন্স,
এটা কি…মৃ*ত্যুর পরের কোনো এক পৃথিবী?নাকি আমি কল্পনা করছি?”
জ্যাসপার গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে বলল,“তুমি বেঁচে আছো,ফিওনা।আমি তোমাকে ম*রতে দিইনি।”
তার কণ্ঠে দৃঢ়তা,কিন্তু ফিওনা অবিশ্বাসে মাথা নাড়ল।তার হাত জ্যাসপারের মুখের দিকে বাড়িয়ে দিল,স্পর্শ করল সেই তীক্ষ্ণ মুখ।স্পর্শের সঙ্গে সঙ্গে তার হাত কেঁপে উঠল।

“তুমি…সত্যি?” ফিওনার গলা কাঁপল।
ফিওনা হঠাৎ করেই শক্ত করে জড়িয়ে ধরল জ্যাসপারকে। তার ভেজা শরীর কাঁপছিল,আর চোখ থেকে অশ্রু টপটপ করে পড়ছিল।জ্যাসপার নিজের শক্ত হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছিল,একদম স্থির বসে।তার মুখে কোনো আবেগের ছাপ নেই,কিন্তু চোখে কিছু চাপা কষ্ট যেন ফুটে উঠছিল।
ফিওনা তার বুকের ওপর মাথা রেখে কাঁপা কণ্ঠে বলল,
“তুমি বলেছিলে,তুমি আমাকে ভালোবাসো না…তাহলে আমাকে কেন বাঁচালে,প্রিন্স?কেন?”
জ্যাসপার শান্তভাবে উত্তর দিল,“কারণ আমি মানুষকে বাঁচাই।তুমি আমার জন্য ভেনাসে গিয়েছিলে।তোমার সাহসিকতা…আমি সেটা অস্বীকার করতে পারিনি।তুমি আমার প্রতি যা-ই অনুভব করো না কেন,তোমাকে মরতে দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।”

ফিওনা তার চোখ তুলে সরাসরি জ্যাসপারের সবুজ চোখের দিকে তাকাল।তার দৃষ্টি গভীর,ভেজা আর তীক্ষ্ণ।সে চিৎকার করে বলল,“তুমি জানলে কীভাবে আমি বিপদে পড়েছি? তুমি জানলে কীভাবে আমি মরতে বসেছি?যদি তুমি আমাকে ভালো না বাসতে,তাহলে এটা কখনোই জানতে না।এটা ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই না জ্যাসপার। এটা অস্বীকার করো না!”
জ্যাসপার মুহূর্তের জন্য চুপ করে রইল। তার চোখের গভীরতা যেন আরও গাঢ় হয়ে গেল ফিওনা এই প্রথম তার নাম ধরে ডাকলো।সে ফিওনার দিকে তাকিয়ে বলল,“তুমি যা ভাবছো,সেটা ভুল।ভালোবাসা আমাকে দুর্বল করবে।আর আমি দুর্বল হতে পারি না।তোমাকে বাঁচানো আমার দায়িত্ব ছিল…কিন্তু ভালোবাসা নয়।”
ফিওনার চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এলো।সে ধীরে ধীরে তার হাত দুটো সরিয়ে বলল,“তাহলে আমি কী তোমার কাছে শুধুই দায়িত্ব?আমি কিছুই না..শুধু একজন বোঝা?”
জ্যাসপার মুখ ফিরিয়ে নিল।তার ঠোঁট শক্ত হয়ে গেছে,কিন্তু ভেতরে ভেতরে যেন কিছু একটা ভেঙে পড়ছে।সে কোনো উত্তর দিল না।ফিওনা তার সামনে বসে কাঁদতে লাগল,আর বৃষ্টি তাদের চারপাশে পড়তে থাকল,সেই অদৃশ্য দূরত্বটা আরও গভীর করে তুলল।

ফিওনা আর কোনো কথা না বলে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল।তার শরীর বৃষ্টিতে ভিজে চুপচুপে,আর চোখের জল বৃষ্টির ফোঁটার সাথে মিশে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিল।তার মনে যেন এক অদ্ভুত ভারাক্রান্তি,কিন্তু একইসাথে জীবিত থাকার মৃদু আনন্দ।জ্যাসপার তাকে মরতে দেয়নি—এই ছোট্ট সত্যটাই যেন তার মনে একটুখানি প্রশান্তি এনে দিল।
বৃষ্টির মাঝে সে ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগল।তার পা ভারী,কিন্তু তার মন চাইছিল এই মুহূর্তে একটু মুক্তি।দূরে গিয়ে,যেখানে বৃষ্টির ধারাটা আরও গভীর,সে দাঁড়াল।মাথা উঁচু করে আকাশের দিকে তাকাল।ঠান্ডা বৃষ্টি তার গাল বেয়ে নামছিল, যেন তার সমস্ত ক্লান্তি ধুয়ে দিচ্ছিল।
পেছনে জ্যাসপার তাকে চুপচাপ দেখছিল।তার সবুজ চোখ গভীর আর চিন্তিত।ফিওনার প্রতিটি পদক্ষেপ যেন তার হৃদয়ের কোথাও একটা অদ্ভুত অনুভূতি জাগিয়ে তুলছিল, কিন্তু সে নিজের সেই অনুভূতিকে চেপে ধরে দাঁড়িয়ে রইল। তার মনে হচ্ছিল,ফিওনা যত দূরেই যাক,সে তাকে ছেড়ে যেতে পারবে না।
বৃষ্টি পড়তেই থাকল।ফিওনা বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে থাকল,যেন প্রকৃতি তাকে সান্ত্বনা দিতে চাইছে।কিন্তু তার হৃদয়ের গভীরে, জ্যাসপারের জন্য একটা কষ্ট,একটা প্রশ্ন বারবার ফিরে আসছিল—“তুমি আমাকে কেন বাঁচালে?”

বৃষ্টি থেমে যাওয়ার কোনো লক্ষণ নেই।ফিওনা নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে,দু’হাত মেলে আকাশের দিকে মুখ তুলে।তার চোখ বন্ধ,আর ঠান্ডা বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা তার ভেতরের সমস্ত ক্লান্তি আর অস্থিরতাকে ধুয়ে মুছে দিচ্ছে।বাতাসে তার ভেজা চুল এলোমেলো হয়ে গেছে,কিন্তু সে সেসবের তোয়াক্কা করছে না।এই মুহূর্তে,তার মন যেন প্রকৃতির সাথে একাত্ম হয়ে গেছে।
কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে জ্যাসপার নিঃশব্দে ফিওনার প্রতিটি পদক্ষেপ লক্ষ্য করছিল।তার চেহারায় এক অদ্ভুত শীতলতা, যেন কোনো অনুভূতি প্রকাশ করতে চায় না।কিন্তু তার চোখ, সেই সবুজ চোখের গভীরে লুকানো এক তীব্র উদ্বেগ ধরা পড়ছিল।
জ্যাসপার ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো।তার চলাফেরায় ছিল নিঃশব্দ দৃঢ়তা।কাছে এসে কোনো কথা না বলে,নিজের ব্লেজার খুলে ফিওনার মাথার ওপর ছাতার মতো ধরে রাখল।
ফিওনা ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকাল।তার সামনে জ্যাসপার,দূরে তাকিয়ে,মুখ শক্ত করে ধরে আছে।সে কোনো দুর্বলতা প্রকাশ করতে চায় না।ফিওনা এক মুহূর্ত তাকে দেখল, তারপর তার ঠোঁটে এক অনির্বচনীয় হাসি খেলে গেল।

হঠাৎ,ফিওনা এগিয়ে গিয়ে জ্যাসপারকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।তার ভেজা শরীর ঠান্ডা,কিন্তু জড়িয়ে ধরার স্পর্শে ছিল উষ্ণতার এক গভীরতা।
“তুমি যতই চেষ্টা করো নিজেকে দূরে রাখতে,আমি জানি,তুমি আমাকে যত্ন করো,”ফিওনা কান্নাভেজা কণ্ঠে বলল।
জ্যাসপার নিজের হাত দুটো শক্ত মুষ্টিতে বন্দী করে রাখল,যেন নিজেকে দুর্বল হতে দিতে চায় না।কিন্তু তার শীতল চেহারা ধীরে ধীরে বদলে গেল।ফিওনার কথাগুলো যেন তার হৃদয়ের এক গোপন দরজা খুলে দিচ্ছিল।ফিওনা তার গালে হালকা ছুঁয়ে ফিসফিস করে বলল, “তোমার মুখোশের পেছনে যা লুকিয়ে আছে,আমি তা দেখতে পাই।”
জ্যাসপার চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।তার চোখের শীতলতা গলে গিয়ে এক অজানা মমতা ফুটে উঠল।কিন্তু সে কিছু বলল না।

চারপাশে বৃষ্টির মৃদু শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল।সময় যেন থমকে গিয়েছিল,আর ফিওনা আর জ্যাসপারের মাঝে এক নীরব অনুভূতির ভাষা বিনিময় হচ্ছিল।যে ভাষায় কোনো শব্দ প্রয়োজন হয় না,শুধু অনুভূতিগুলোই যথেষ্ট।
ফিওনা ধীরে ধীরে মাথা তুলে জ্যাসপারের চোখে চোখ রাখল।তার ভেজা চুল গালের পাশ ঘেঁষে নেমে এসেছে,আর চোখে এক অদ্ভুত প্রশ্নের ঝলক।”এই নিয়ে দ্বিতীয়বার তুমি আমার প্রাণ বাঁচালে,” ফিওনার গলা শীতল হলেও ভেতরে লুকিয়ে থাকা কষ্ট স্পষ্ট। “দ্বিতীয়বার নিজের অক্সিজেন দিয়ে আমাকে রক্ষা করলে।কিন্তু সেদিন তুমি বলেছিলে এটা আমাদের ডেসটিনি।তাহলে আজ কেন তুমি সেই ডেসটিনিকে অস্বীকার করছ?”
জ্যাসপার নীরবে তাকিয়ে রইল।তার চেহারায় একধরনের শক্তিশালী অনমনীয়তা ফুটে উঠল,যেন সে নিজের ভেতরের কোনো লড়াইতে মগ্ন।কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে সে গভীর গলায় বলল,”আমাদের ডেসটিনি আমাদের দূরে থাকতেই বলেছে, ফিওনা।”

ফিওনা স্থির হয়ে গেল।তার চোখে বেদনাভরা বিস্ময় ফুটে উঠল।কিন্তু জ্যাসপার তার কথাগুলো শেষ করল।”তুমি আমার কাছ থেকে দূরে থাকলেই ভালো হবে।এখানে থেকে তুমি শুধু নিজের বিপদ বাড়াচ্ছ।তোমার পৃথিবী আছে, তোমার নিজের জীবন আছে।সেটাই গুছিয়ে নাও।আমার মতো কারও পাশে থেকে নিজের জীবন নষ্ট কোরো না।”
ফিওনার ঠোঁট থরথর করে উঠল,কিন্তু সে নিজেকে শান্ত রাখল। “তুমি যদি সত্যিই বিশ্বাস করতে,আমরা একে অপরের জন্য নই,তাহলে আজ আমাকে বাঁচাতে আসতে না। তুমি যদি আমাকে ভালো না বাসো,তাহলে কেন বারবার আমাকে রক্ষা করছ,জ্যাসপার?”
জ্যাসপার তার দৃষ্টি সরিয়ে নিল।এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, তার মুখে কঠিনতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা কোনো অনুভূতি বেরিয়ে আসতে চাইছে।কিন্তু সে দৃঢ়ভাবে বলল,”তোমার জন্য যা করেছি,তা আমার দায়িত্ব ছিল।এর বেশি কিছু নয়।”

ফিওনার চোখে তীক্ষ্ণ বেদনার ছায়া ফুটে উঠল।তার গলা ধরে এলো,কিন্তু সে কিছু বলল না। বৃষ্টি ততক্ষণে আরও ভারী হয়ে গেছে। প্রতিটি ফোঁটা যেন তাদের চারপাশের পরিবেশের সাথে মিশে গিয়ে আরও বেশি থমথমে করে তুলেছে। তাদের কথার কোনো শেষ নেই, যেন প্রকৃতির বুকে বৃষ্টির শব্দ ছাড়া কিছুই শোনা যাচ্ছে না।
ফিওনার কণ্ঠে ভেজা কাঁপন ছিল,তবু তার চোখে ছিল দৃঢ়তার আগুন।সে থামল না। “তুমি ভাবছো,তোমার থেকে দূরে গেলে আমি ভালো থাকব?আজকে যে অ্যাক্সি*ডেন্ট ঘটেছে,যে স্পেসশিপ নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে,সেটা কেনো জানো? তোমার কথা ভাবতে ভাবতে আমি সব উল্টোপাল্টা করে ফেলেছিলাম।আজ যদি আমি মারা যেতাম,তার জন্য তুমি দায়ী থাকতে।”
জ্যাসপার স্তব্ধ হয়ে শুনছিল।তার মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই,কিন্তু ফিওনার প্রতিটি শব্দ যেন তাকে ছুরির মতো বিঁধছিল।

ফিওনা একপা এগিয়ে এসে তার দিকে আঙুল তুলে বলল,”তুমি কি সত্যিই ভাবো,তোমাকে ছেড়ে এই পৃথিবীতে এসে আমি খুব ভালো থাকতাম?না,জ্যাসপার,আমি তিলে তিলে ম*রে যেতাম।তোমার সমস্যাটা জানো কি?তুমি নিজের মনের কথা ঠিকই বোঝো,কিন্তু আমার অনুভূতিগুলো বুঝতে পারো না।”
জ্যাসপারের সবুজ চোখ দুটো ক্ষণিকের জন্য ফিকে হয়ে এলো। সে মুখ ফেরাতে চেষ্টা করল ,কিন্তু ফিওনার শব্দগুলো যেন তাকে থামতে বাধ্য করল।
ফিওনা তার সামনে এসে দাঁড়াল।তার কণ্ঠস্বর এবার নরম,তবু গভীর আঘাতে ভারী।”জ্যাসপার,ভালোবাসা কেবল তোমার একার বিষয় নয়।এটা আমাদের দুজনের।তুমি কীভাবে ঠিক করছো আমি কী চাই বা কীভাবে বাঁচতে চাই?তুমি ভাবছো দূরে গিয়ে আমার জন্য ভালো করছো?না,তুমি আমাকে কষ্ট দিচ্ছো।প্রতিবার যখন আমাকে দূরে ঠেলে দাও,আমার হৃদয় ভেঙে যায়।”
জ্যাসপার চোখ বন্ধ করল।তার শক্ত চোয়াল এক মুহূর্তের জন্য কেঁপে উঠল। তারপর সে গভীর শ্বাস নিয়ে বলল, “ফিওনা,আমি তোমার জন্য যা করছি,তা তোমার ভালো থাকার জন্যই।আমি একটা ভিনগ্রহের ড্রাগন।আমার জীবন তোমার জীবনের চেয়ে আলাদা।তুমি আমার সাথে থাকলে তোমার জীবন হুমকির মুখে পড়বে।আমি…আমি এটা মেনে নিতে পারি না।”

ফিওনার চোখে পানি জমে উঠল।কিন্তু সে হাল ছাড়ল না। “তুমি কি জানো,জ্যাসপার?আমার জীবনের সবচেয়ে বড় হুমকি তোমার অনুপস্থিতি।তোমাকে ছাড়া আমার জীবন অর্থহীন।আর তুমি যদি সত্যিই আমার ভালো চাইতে,তাহলে আমায় দূরে ঠেলে দিতে না।”
জ্যাসপার কিছু বলল না।তার চোখে যেন অজানা অনুভূতির আলোছায়া খেলা করছিল। ফিওনার কথাগুলো তাকে এক অদৃশ্য বেড়াজালে বন্দি করে ফেলেছে।বৃষ্টি তখনও ঝরছিল, আর তাদের চারপাশে তৈরি হয়েছিল এক অদ্ভুত নীরবতা। দুজনের মধ্যের দূরত্ব ক্রমশ মিলিয়ে যাচ্ছিল।

বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পরেও বাতাসে ভেজা মাটির গন্ধ আর সাগরের লবণাক্ততার মিশ্রণ টিকে ছিল। ফিওনা ধীরে ধীরে দাঁড়িয়ে জ্যাসপারের দিকে ঘুরে বলল,”আচ্ছা,এখন এসব বাদ দাও।আগে বলো,আমরা কোথায়?এটা কোন জায়গা?”
জ্যাসপার শান্ত গলায় উত্তর দিল,”এটা লুনার দ্বীপ।”
ফিওনার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল।”লুনার দ্বীপ?এটা আবার কোথায়?”
জ্যাসপার দূরে সাগরের দিকে তাকিয়ে বলল,”এটা পৃথিবীর একেবারে শেষপ্রান্তে।প্রশান্ত মহাসাগরের গহীনে লুকিয়ে থাকা এক রহস্যময় জায়গা।মানুষের পৃথিবীর মানচিত্রে এর কোনো অস্তিত্ব নেই।খুব অল্প লোকই জানে এই দ্বীপের কথা, আর যারা জানে তারা এখানে আসার সাহস করে না।”
ফিওনা একটু ঘন হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,”কেন?এখানে কী এমন আছে?”

জ্যাসপার ঠান্ডা গলায় বলল,”লুনার দ্বীপ নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত। বলা হয়,এখানে অজানা শক্তি রয়েছে,যা প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।এই দ্বীপের আকাশ সবসময় রহস্যে ঢাকা,আর এর সাগরতল অনেক গভীর এবং বিপজ্জনক। কিন্তু এর প্রকৃতি এতটা নির্জন আর সুন্দর যে এখানে এলে মনে হয়,সময় থেমে গেছে।”
ফিওনা ধীরে ধীরে চারপাশে তাকাল।বিশাল সবুজ পাহাড়, গভীর জঙ্গল,আর একপাশে অবিরাম ঢেউয়ের শব্দ তার মনকে অদ্ভুত এক কৌতূহলে ভরিয়ে তুলল।”তাহলে আমরা এখানে কীভাবে এলাম?”ফিওনা জিজ্ঞেস করল।
জ্যাসপার এক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল,”এটাই একমাত্র জায়গা যেখানে আমরা দুজন নিরাপদ থাকতে পারছি আপাতত।”
ফিওনা আবার বলল, “তুমি জানলে কীভাবে এই জায়গার কথা? তুমি কি আগে এখানে এসেছিলে?”
জ্যাসপার মৃদু হাসল।”লুনার দ্বীপ শুধু একজন ড্রাগনের পক্ষে খুঁজে পাওয়া সম্ভব।এটা আমাদের পূর্বপুরুষদের ইতিহাসের অংশ।”

ফিওনা নীরব হয়ে গেল,কিন্তু তার চোখে বিস্ময় আর কৌতূহল আরও গভীর হয়ে উঠল।”লুনার দ্বীপ…”ফিসফিস করে বলল সে। “এটা যেন কোনো এক কল্পকাহিনির অংশ।”
ফিওনা চারপাশে তাকিয়ে দ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে দেখতে হঠাৎ বলল, “আচ্ছা, আমরা এখনো এখানেই দাঁড়িয়ে আছি কেন? আমাকে চীনে পৌঁছে দাও। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসও মিস হয়ে যাচ্ছে। দাদা নিশ্চয়ই ভীষণ চিন্তা করছে।”
জ্যাসপার কোনো কথা বলল না। তার সবুজ চোখের গভীরে যেন অদৃশ্য এক দ্বন্দ্ব খেলা করছে। ফিওনা তার নিরুত্তর চেহারা দেখে এক ধাপ এগিয়ে বলল, “জ্যাসপার, আমি তোমার সঙ্গে মজা করছি না। চলো, এখনই চীনে ফিরে যাই।”

কিন্তু জ্যাসপার তখনো চুপ। তার মুখে কোনো আবেগের প্রকাশ নেই। কয়েক মুহূর্ত পর সে নীরবে মুখ ফিরিয়ে সাগরের দিকে তাকাল। তার ভ্রু কুঁচকে আছে, যেন সে কিছু গোপন করছে।
ফিওনা বিরক্ত হয়ে বলল,“তুমি শুনছো না?আমার সঙ্গে কথা বলছো না কেন?”
জ্যাসপার গভীর শ্বাস নিয়ে বলল,“আমি এখন তোমাকে চীনে পৌঁছে দিতে পারব না। আমার শক্তি… আমার ড্রাগন রূপ এই মুহূর্তে ব্যবহার করা সম্ভব নয়।”
ফিওনা বিস্ময়ে বলল, “কী বলছো তুমি?কেন সম্ভব নয়? তুমি তো ড্রাগন!তুমি তো এতটা শক্তিশালী!কী হলো তোমার?”

জ্যাসপার ধীরে ধীরে বলল,“যখন আমি সিগন্যাল পেয়েছিলাম যে তোমার স্পেসশিপ নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে, আমি সময় নষ্ট করতে পারিনি। পৃথিবীর এতটা গভীরে তোমাকে বাঁচাতে আসার জন্য আমাকে ইম্পালস জাম্পিং এনালজি ব্যবহার করতে হয়েছিল। এটি আমাদের ড্রাগনদের এক বিশেষ শক্তি, যা আমাদের কয়েক সেকেন্ডে আলোকবেগে ভ্রমণ করতে সাহায্য করে। কিন্তু এর খরচ অনেক বেশি। এর ফলে আমার ড্রাগন শক্তি কয়েকদিনের জন্য স্থগিত হয়ে গেছে।”
ফিওনা অবাক হয়ে বলল,“ইম্পালস জাম্পিং এনালজি? সেটা কী?”
জ্যাসপার ধৈর্য ধরে বোঝাল,“এটা এমন এক প্রযুক্তি যা ভেনাসের ড্রাগনদের জন্য তৈরি হয়েছে। এর মাধ্যমে আমাদের দেহের প্রতিটি কোষ এক ধরনের সুপারচার্জড স্টেটে চলে যায় এবং স্থান-কালকে ভেদ করে আলোর চেয়ে দ্রুতগতিতে গন্তব্যে পৌঁছায়। কিন্তু এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ভয়ংকর। এর ফলে আমার কোষগুলো এখন নিষ্ক্রিয় হয়ে আছে। এই অবস্থায় ড্রাগন রূপ ধরে বেশি শক্তি ব্যবহার করলে আমার দেহ আর কখনো আগের মতো স্বাভাবিক হবে না।”

ফিওনার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। “তাহলে? তুমি কি আর ড্রাগনে রূপ নিতে পারবে না?”
জ্যাসপার সামান্য হাসল। “পারব, তবে আমাকে কয়েকদিন সময় দিতে হবে। এই কয়েকদিন যদি আমি আবার শক্তি ব্যবহার করি, তাহলে আমার শরীর স্থায়ীভাবে শক্তিহীন হয়ে পড়বে। এমনকি আমার ভেনাসে ফিরে যাওয়ার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলব।”
ফিওনা নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে বলল, “তাহলে আমরা এই লুনার দ্বীপে আটকে আছি?”
জ্যাসপার নীরবে মাথা ঝাঁকাল। তারপর বলল, “তুমি এখানে নিরাপদে থাকবে। আমি আমার শক্তি পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করব। তার পরেই তোমাকে চীনে পৌঁছে দেব।”
ফিওনা হতাশ হয়ে আকাশের দিকে তাকাল। তার ঠোঁটে একটুখানি বিদ্রূপের হাসি ফুটে উঠল। “তাহলে আমিই প্রথম মানুষ, যাকে কোনো ড্রাগন শক্তিহীন অবস্থায় আটকে রেখেছে।”
জ্যাসপার কোনো উত্তর দিল না। তার চোখে কঠিন দৃঢ়তা ছিল, কিন্তু তার মুখে চাপা এক ধরনের অপরাধবোধ ফুটে উঠল।

হঠাৎ জ্যাসপার হাঁটা শুরু করলো দ্বীপের ভেতরে।ফিওনা জ্যাসপারের পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে বলল,”তাহলে এতদিন আমি খাবো কী?আর থাকব কোথায়?দেখো, পোশাকটাও পুরো ভিজে গেছে!”
জ্যাসপার একবারও পেছনে ফিরে তাকাল না,চুপচাপ দ্বীপের গভীর বনের দিকে হাঁটতে শুরু করল।তার হাঁটার মধ্যে দৃঢ়তা ছিল,যেন সে জানে ঠিক কোথায় যেতে হবে।
ফিওনা আরও বিরক্ত হয়ে বলল,”প্রিন্স,আমি তোমার সঙ্গে কথা বলছি!তুমি কেন কিছু বলছো না?”
জ্যাসপার হাঁটা থামাল,কিন্তু পেছন ফিরে তাকাল না।কেবল নিচু গলায় বলল, “কিপ কোয়াইট!!এন্ড ফলো মি জাস্ট।”
ফিওনা কিছুটা অস্বস্তিতে থেমে গেল,কিন্তু তারপর বলল,”তুমি সবসময় এভাবে রহস্যময় আচরণ করো কেন?আমি মানুষ,আমার ক্ষুধা লাগে,ঠান্ডা লাগে,আর… আর আমার একটু আরামদায়ক জায়গায় থাকার দরকার।”
জ্যাসপার গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলল,”তুমি এত কথা বলো কীভাবে?আমি তোমাকে ঠিক জায়গায় নিয়ে যাচ্ছি।শুধু ধৈর্য ধরো।”

বনের মাঝ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তারা এক জায়গায় পৌঁছাল, যেখানে গাছের আড়ালে একটি প্রাকৃতিক গুহা দেখা গেল। গুহার প্রবেশপথের সামনে ঝুলে থাকা লতাগুল্ম সরিয়ে জ্যাসপার ভেতরে ঢুকল।
গুহার ভেতরটা অবাক করে দেওয়ার মতো ছিল।এক কোণে শুকনো কাঠ আর শুকনো ঘাস রাখা,যা সম্ভবত বিছানার মতো ব্যবহার করা যায়।অন্য পাশে একটি ছোট ঝরনা বয়ে চলেছে,যার পানি স্বচ্ছ এবং ঠান্ডা।
জ্যাসপার কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“এটা আমার তৈরি করা নয়,কিন্তু এই দ্বীপে আসা প্রতিটি প্রাণীর জন্য এই গুহা আশ্রয়ের জায়গা।তুমি এখানে নিরাপদে থাকতে পারবে।”
ফিওনা অবাক হয়ে বলল,”তুমি কি আগেও এখানে এসেছো?”
জ্যাসপার মৃদু হাসল। “এটা একসময় ড্রাগনদের বিশ্রামের জায়গা ছিল।আমরা যখন পৃথিবীতে আসতাম,এই ধরনের জায়গা তৈরি করতাম।”

ফিওনা চারদিকে তাকিয়ে বলল,”আচ্ছা,খাবার কী হবে? আমার তো ক্ষুধা লেগেছে।”
জ্যাসপার তার কথায় গুরুত্ব না দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর সে ফিরে এল হাতভর্তি অদ্ভুত ফল আর কয়েকটি পাতা নিয়ে,যার ভেতর ছোট ছোট বেরি রাখা ছিল।
ফিওনা ফলগুলো দেখে বলল,”তুমি কি আদিকালের মানুষ নাকি?এগুলো কীভাবে খেতে হয় তাও জানি না।”
জ্যাসপার নির্লিপ্ত স্বরে বলল,”তোমার কাছে চাইনিজ রেস্টুরেন্ট নেই এখানে,ফিওনা।এসবই তোমার জন্য যথেষ্ট আপতত।”
ফিওনা তার হাত থেকে ফল নিল আর এক কামড় দিয়ে বলল,”এগুলো খেতে তো মন্দ না…তবে আমি এখনও ভিজে আছি।”
জ্যাসপার তার পোশাকের দিকে একবার তাকাল এবং গুহার এক কোণ থেকে শুকনো লতাপাতা এনে দিল।”এইগুলো শুকিয়ে নাও।আগামীকাল অন্য ব্যবস্থা করব।”
ফিওনা মুচকি হেসে বলল,”তুমি যতই কঠিন দেখাও না কেন, আমি জানি, তুমি কেয়ার করো আমার।”
জ্যাসপার কিছু না বলে গুহার বাইরে চলে গেল।তার চোখে অদ্ভুত এক অস্থিরতা খেলা করছিল,যেন সে নিজের ভেতরের কোনো লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।

গুহার নিস্তব্ধতাকে মুহূর্তেই চিরে ফেলল এক ভয়ঙ্কর গর্জন। সেই শব্দে ফিওনা চমকে উঠল।তার চোখ আতঙ্কে বড় হয়ে গেল। “এটা…এটা কী ছিল?”
জ্যাসপারের মুখে চিন্তার গভীর রেখা পড়ল।তার চোখ ধীরে ধীরে গুহার অন্ধকার কোণগুলোর দিকে ঘুরল।”কিছু বলার দরকার নেই,” সে ঠাণ্ডা গলায় বলল। “এখান থেকে বেরোতে হবে। এখনই।”
ফিওনা বিভ্রান্ত হয়ে বলল, “কিন্তু কেন?এটা তো শুধু একটা গর্জন।হয়তো কোনো বন্য প্রাণী…”
জ্যাসপার তার কথা শেষ করতে দিল না।হঠাৎ তার হাত ধরে দ্রুত গুহার বাইরে নিয়ে যেতে লাগল।তার শক্তি এতটাই ছিল যে ফিওনা বাধা দিতে পারল না।”আমার সঙ্গে চুপচাপ চলে এসো,ফিওনা।এখানে আর থাকা নিরাপদ নয়।”

তারা দুজনেই দ্রুত বনের গভীরতায় ঢুকে পড়ল।পেছনে গর্জন ধীরে ধীরে বাড়তে লাগল।ফিওনা পেছন ফিরে তাকাতে চেয়েছিল,কিন্তু জ্যাসপার তার হাত শক্ত করে ধরে রাখল। “পেছনে তাকিয়ো না,”সে দৃঢ়ভাবে বলল।
প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে দৌড়ানোর পর তারা একটি খোলা জায়গায় পৌঁছাল।জ্যাসপার তার শ্বাস ধীরে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছিল।ফিওনা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,”তুমি কী বলতে চাও?সেটা কী ছিল?তুমি কি জানো?”
জ্যাসপার চোখ বন্ধ করে মাথা নিচু করল। “এটা কোনো সাধারণ প্রাণী নয়।এই দ্বীপে কিছুই সাধারণ নয়।এই জায়গা একসময় ড্রাগনদের আশ্রয়স্থল ছিল,কিন্তু এখন এখানে কিছু ভয়ঙ্কর শক্তি বাস করে।আমি জানতাম,এই দ্বীপে আসা ঝুঁকিপূর্ণ হবে।”
ফিওনা আতঙ্কিত হয়ে বলল, “তাহলে তুমি আমাকে এখানে এনেছিলে কেন,তুমি তো বললে এটা নিরাপদ জায়গা তাহলে?”

জ্যাসপার গম্ভীর স্বরে বলল,”কারণ এখানে আসা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিল না।তুমি বেঁচে আছ,সেটাই বড় কথা নয় কি।কিন্তু এখন আমাদের দ্রুত নিরাপদ জায়গা খুঁজতে হবে।”
হঠাৎ দূরে গর্জনের শব্দ আবার শোনা গেল।এবার তা আরও কাছাকাছি।
ফিওনা ফিসফিস করে বলল,”এটা কি আমাদের খুঁজে বের করছে?”
জ্যাসপার তার দিকে তাকিয়ে বলল,”হ্যাঁ।আর আমি এখন লড়াই করতে চাই না।আমার শক্তি কমে গেছে।আমি যদি লড়াই করি,আমার শক্তি চিরতরে শেষ হয়ে যাবে,আর আমি আর কখনো ভেনাসে ফিরতে পারব না।”
ফিওনার চোখে এক মুহূর্তের জন্য হতাশার ছায়া পড়ল। “তাহলে এখন কী করব?আমরা কি সারাক্ষণ দৌড়ে বেড়াব?”
জ্যাসপার মৃদু গলায় বলল,”না। আমরা বেঁচে থাকব।এবং তোমাকে নিরাপদে চীনে পৌঁছে দেবার কোনো উপায় বের করব।”
ফিওনা তার কথায় কিছুটা ভরসা পেল,কিন্তু তাদের সামনে অপেক্ষা করছে কী,তা ভাবতেই তার শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল।

জ্যাসপার ঘন কুয়াশার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলছিল,ফিওনা তার পেছনে পা টেনে টেনে হাঁটছিল।হঠাৎ করেই তারা বনের একটি ফাঁকা জায়গায় পৌঁছাল,যেখানে একটি ছোট্ট তাবু দাঁড়িয়ে আছে।জায়গাটিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে আগুনের ছাই,ক্যান্সার খালি ক্যান আর কয়েকটি ব্যবহৃত প্লেট।দৃশ্যটি যেন কারো পিকনিকের গল্প বলছিল।
ফিওনা তৎক্ষণাৎ বিস্মিত হয়ে বলল,”ওরে বাবা!ড্রাগনরাও কি পিকনিক করে নাকি?”
জ্যাসপার তার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকাল।”পিকনিক?ড্রাগনরা?তুমি আসলে আমাদের সম্পর্কে কী জানো?”
ফিওনা হেসে বলল,”তোমাদের অনেক কিছুই জানি না।কে জানে,হয়তো ড্রাগনরাও মজা করতে পারে!”
কিন্তু জ্যাসপার তাবুটির চারপাশে হাঁটতে শুরু করল। তার চেহারায় চিন্তার ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠল।সে বলল,”এটা ড্রাগনদের কাজ নয়।এসব মানবদের কাজ।আর এই দ্বীপে কোনো মানুষ থাকার কথা নয়।”
ফিওনা ভ্রু কুঁচকে বলল,”তাহলে এটা কী?কারা এখানে পিকনিক করতে এসেছিলো?”
জ্যাসপার তাবুর কাছে বসে পড়ে মাটি স্পর্শ করল।তার আঙুলের ওপর ধুলো জমে উঠল।সে গভীরভাবে তাকিয়ে বলল,”এটা পিকনিক নয়।এটা গবেষণার জায়গা মনে হচ্ছে।”

ফিওনা অবাক হয়ে বলল,”গবেষণা?এখানে? কেন?কিসের জন্য?”
জ্যাসপার তাবুর একটি কোণে একটি আধ-খোলা নোটবুক দেখতে পেল।সে সেটি তুলে নিল এবং ধুলো ঝেড়ে পৃষ্ঠাগুলো উল্টাতে লাগল।পাতাগুলোর মধ্যে কিছু নকশা এবং লেখার চিহ্ন দেখা যাচ্ছিল—ড্রাগন,দ্বীপের গঠন,আর একটি অজানা ধাতুর খোঁজ সম্পর্কে কিছু তথ্য।
জ্যাসপার বলল,”কেউ এখানে ড্রাগনের শক্তি নিয়ে গবেষণা করতে এসেছিল।আর আমার ধারণা,তারা এখন আর এখানে নেই।”
ফিওনা বিস্মিত হয়ে বলল,”তাহলে তারা কোথায় গেল?আর তারা এখানে ড্রাগন নিয়ে কী করছিল?”
জ্যাসপার চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।তার চোখে সন্দেহের ছাপ। “আমরা যদি তাদের উদ্দেশ্য বুঝতে পারি,তবে জানতে পারব এই দ্বীপে আর কী বিপদ লুকিয়ে আছে।”
ফিওনা হাসি চাপার চেষ্টা করে বলল,”আচ্ছা,বিজ্ঞানীদের পিকনিক যদি এমন হয়,তবে আমি কখনোই তাদের সঙ্গে আসব না!”

জ্যাসপার এক মুহূর্তের জন্য তাকিয়ে থাকল, তারপর তাবু ছেড়ে সামনে এগিয়ে গেল। তার মুখের ভাব বদলে গিয়েছিল। “তোমার মজা করার সময় না এটা ফিওনা।এখানে থাকার প্রতিটি মুহূর্ত বিপদের সম্ভাবনা বাড়াচ্ছে।”
ফিওনা তাবুর ভেতরে ঢুকে চারপাশে তাকাল।মেঝেতে ছড়ানো ছিল কিছু ব্যক্তিগত জিনিসপত্র।কোণায় একটা মাঝারি আকারের ব্যাগ পড়ে ছিল।ঞফিওনা ব্যাগটা খুলে দেখল।তার ভেতরে দু’জনের ব্যবহৃত পোশাক—একটি পুরুষের জ্যাকেট আর কিছু শার্ট, টি শার্ট আর একটি মেয়ের পাতলা জিন্সের জ্যাকেট আর কিছু শর্ট টপস্ আর জিন্স প্যান্ট।কয়েকটি তোলা ছবি,কিছু নোটবুক,আর কয়েকটি অর্ধেক ভরা খাবারের ক্যানও দেখা গেল।
আরও গভীরভাবে দেখতে গিয়ে ফিওনা একটা ভরা ওয়াইন বোতল আর কয়েকটি খালি ক্যান খুঁজে পেল।দেখে মনে হচ্ছিল,তারা এখানে একসঙ্গে কিছু সময় কাটিয়েছে।সবকিছু এত পরিষ্কার যে মনে হচ্ছিল,তারা খুব সম্প্রতি এখান থেকে সরে গেছে।

ফিওনা ব্যাগটা হাতে নিয়ে তাবু থেকে বেরিয়ে এল।জ্যাসপার তখনও বাইরে দাঁড়িয়ে দ্বীপের পরিবেশ পরীক্ষা করছিল। ফিওনা ব্যাগটা দেখিয়ে বলল,”প্রিন্স,এখানে তো মনে হচ্ছে কোনো কাপল বিজ্ঞানী পিকনিক বা গবেষণা করতে এসেছিল।এই দেখো,তাদের জিনিসপত্র।”
জ্যাসপার ব্যাগের দিকে তাকাল। তার চোখে সন্দেহের ছাপ স্পষ্ট। সে ব্যাগটা নিয়ে দ্রুত চেক করতে লাগল।জ্যাকেটের পকেট থেকে একটি ছোট রেকর্ডার বের করল।রেকর্ডারে ধুলোর কোনো চিহ্ন নেই।
জ্যাসপার বলল,”কাপল বিজ্ঞানী,বলছো?এই জিনিসগুলো দেখে তাই মনে হচ্ছে।কিন্তু প্রশ্ন হলো,তারা এখানে কী করছিল?এই দ্বীপ কোনো সাধারণ জায়গা নয়।”
ফিওনা বলল,”তাহলে কি ওরা আমাদের মতো কোনো দুর্ঘ*টনার শিকার হয়েছিল?”
জ্যাসপার মাথা নাড়ল।”সম্ভবত।অথবা এর পেছনে অন্য কিছু আছে।”

সে রেকর্ডারটা চালানোর চেষ্টা করল। কিছু শব্দ ভেসে উঠল: “আমরা লুনার দ্বীপে এসেছি…শক্তির উৎস এখানে স্পষ্ট। কিছু বিরল খনিজ পাওয়া গেছে যা সম্ভবত…” তারপর রেকর্ডিং বন্ধ হয়ে গেল।
ফিওনা বলল,”শক্তির উৎস? তুমি কি কিছু বুঝতে পারছো?”
জ্যাসপার গভীর চিন্তায় পড়ে গেল। সে বলল, “এই দ্বীপে শুধু ড্রাগন নয়,কিছু প্রাকৃতিক রহস্যও লুকিয়ে আছে।সম্ভবত তারা সেই রহস্য খুঁজতে এসেছিল।”
ফিওনা বলল,”তাহলে এখন কী করবো?”
জ্যাসপার বলল,”আগে এই দ্বীপে নিরাপদ জায়গা খুঁজতে হবে।আর তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আরও তথ্য বের করতে হবে।”

ফিওনা ব্যাগটা নিজের কাছে রেখে বলল, “তাহলে এবার সত্যি কোনো অ্যাডভেঞ্চারের মধ্যে ঢুকে পড়েছি।”
জ্যাসপার তাকে সতর্ক দৃষ্টিতে দেখল।”এটা অ্যাডভেঞ্চার নয়,ফিওনা।এটা একটা অজানা বিপদ।”
ফিওনা তাবুর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে বলল, “তোমার শক্তি ফিরে পেতে যেহেতু সময় লাগবে,তাই আমি বলছি, এই তাবুতেই থেকে যাই।ব্যাগে যতটা পোশাক আছে,তাতে ক’দিন কেটে যাবে। আর খাবার?সেটা তো জোগাড় করাই যাবে।কী বলো?”
জ্যাসপার তৎক্ষণাৎ মাথা নাড়ল। তার চোখে বিরক্তির ঝিলিক। “তাবুতে থাকা?মাথা খারাপ!এটা তো একটা সরু তাঁবু।এর ভেতরে জায়গা বলতে কিছু নেই।এখানে আমি তো দূরের কথা,ড্রাগন হিসেবে আমার আত্মসম্মানও আসবে না।”
ফিওনা হেসে বলল,”আত্মসম্মান!সত্যিই,প্রিন্স,তুমি কী চাও? একটা রাজপ্রাসাদ?দ্বীপের মাঝখানে সেটা কীভাবে পাবে?”

জ্যাসপার হালকা বিরক্তি নিয়ে বলল,”তোমার জন্য তো আর রাজপ্রাসাদ দরকার নেই,ফিওনা।আমার কথা ভাবো। আমার শ্বাস নেওয়াও কঠিন হবে এখানে।আর ঘুমানোর কথা বলো না।আমার ড্রাগন শরীর এখানে এক মিনিটও সহ্য করতে পারবে না।”
ফিওনা ঠোঁট কামড়ে হাসি চাপার চেষ্টা করল। “তোমাকে ঘুমাতে কে বলেছে? আমিই তো এখানেই থাকব। তুমি বাইরে কোথাও আরাম করে বসে থাকো।”
জ্যাসপার চোখ কুঁচকাল।”তুমি কি সত্যিই সিরিয়াস?”
ফিওনা গম্ভীরভাবে বলল,”অবশ্যই। আমাকে তো আর ভেনাসে যেতে হবে না,তাই তাবুতেই চলবে। আর তুমি,প্রিন্স, কয়েকটা দিন বাইরে কাটাও।আমিও দেখব তুমি কীভাবে পরিস্থিতি সামলাও।”
জ্যাসপার কিছুক্ষণ নীরবে তাকিয়ে রইল। তার মুখে একধরনের অসহায়ত্ব ফুটে উঠল। “তুমি কখনোই সহজ কোনো সমাধান দেবে না,তাই না?”
ফিওনা কাঁধ ঝাঁকাল।”আমি শুধু বাস্তববাদী।আর তাছাড়া,তুমি আমার সঙ্গে আছো,তাই ভয় কিসের?”
জ্যাসপার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ঠিক আছে,ফিওনা। তুমি এখানে থাকতে চাও তাই থাকো। তবে মনে রেখো, কোনো বিপদ হলে আমি দায়ী নই।”

ফিওনার মুখে চওড়া হাসি ফুটে উঠল।”তুমি যে আমাকে নিয়ে এত ভাবো,সেটা না বললেও বুঝতে পারি।”
জ্যাসপার তার দিকে চোখ ছোট করে তাকাল।”তোমার এই অযথা ভুল ধারনা মনে পুষে যদি সাময়িক শান্তি পাও তবে তাই পাও।”
তাবুর মধ্যে থাকা নিয়ে ফিওনার এই জেদের সামনে জ্যাসপার আর তর্ক করল না।তবে তার ভেতরে একধরনের অস্বস্তি কাজ করছিল।দ্বীপের পরিবেশ এবং অজানা বিপদ সম্পর্কে সে যে কতটা চিন্তিত,সেটা ফিওনা তখনও বুঝতে পারেনি।
হঠাৎ করে আকাশজুড়ে বিদ্যুৎ চমকে উঠল।তার সঙ্গে যেন মাটিও কেঁপে উঠল এক মুহূর্তের জন্য।ফিওনা জানালার দিকে তাকিয়ে বলল,”এই দ্বীপে আসার পর থেকে মনে হচ্ছে শুধু বৃষ্টি আর বৃষ্টি!আর এই বজ্রপাত! সবকিছু যেন কোনো গল্পের মতো রহস্যময়।”

জ্যাসপার চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল, কিন্তু ফিওনার কথার উত্তরে বলল, “কারণ,এটা সাধারণ দ্বীপ নয়।এই দ্বীপ রহস্যময়,ফিওনা। এখানের প্রকৃতি অদ্ভুত। যেকোনো সময় ঝড় শুরু হতে পারে, আবার হঠাৎ সব শান্ত। এখানকার পরিবেশ সাধারণ নিয়ম মেনে চলে না।”
ফিওনা তার কথা শুনে এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেল। কিন্তু তার ভাবনার সময় আর ছিল না। হঠাৎ করে আকাশ ফেটে যেন মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলো। বাতাস এমনভাবে শোঁ শোঁ করে বইছিল, মনে হচ্ছিল তাবুটাও উড়ে যাবে।
“তুমি কি বাইরে ভিজে দাঁড়িয়ে থাকতে চাও,প্রিন্স?” ফিওনা বলল, তারপর হঠাৎই জ্যাসপারের হাত ধরে টেনে তাবুর ভেতরে নিয়ে এল।
তাঁবুর ভেতর একধরনের অন্ধকার। বৃষ্টি আর ঝড়ের শব্দে চারপাশ ভরে গেছে। ফিওনা হঠাৎ তাবুর ভেতরে থাকা একটা লণ্ঠন দেখে হাঁপ ছাড়ল। “এখানে একটা লণ্ঠন আছে! মনে হচ্ছে এখানের আগের লোকেরা খুবই প্রস্তুত ছিল।”
সে ব্যাগের ভেতর হাত দিয়ে খুঁজতে শুরু করল। অবশেষে, সে এক প্যাকেট ম্যাচ পেল। “পাওয়া গেছে!” ফিওনা বলল বিজয়ের সুরে।
মিনিটখানেকের মধ্যে লণ্ঠনের আলো জ্বলে উঠল। পুরো তাবু আলোকিত হয়ে গেল। আলোতে ফিওনা জ্যাসপারের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, “দেখেছো? অন্ধকার আর ঝড় তো আর চিরকাল থাকবে না। একটু চেষ্টা করলেই সব ঠিক হয়ে যায়।”

লণ্ঠনের হলদে আলোয় ফিওনার ভেজা চেহারা যেন আরও আলোকিত হয়ে উঠল। ভেজা চুল তার কপালের পাশে লেপ্টে আছে, ভেজা পোশাক তার শরীরের আকৃতি স্পষ্ট করে তুলেছে। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো যেন তার গালে মুক্তার মতো ঝকঝক করছে। এই মুহূর্তে ফিওনাকে দেখে জ্যাসপারের মনে হলো, সে কোনো মানুষ নয়—এ যেন স্বর্গ থেকে নেমে আসা কোনো অপ্সরা।
জ্যাসপার পলকহীন চোখে তাকিয়ে রইল ফিওনার দিকে। তার মুখে কোনো কথা নেই, চোখের গভীরে এক অজানা আবেগ খেলা করছে। এতদিন নিজেকে শাসন করে রেখেছে, নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। কিন্তু এই মুহূর্তে তার সমস্ত প্রতিরোধ ভেঙে পড়তে চাইছে।
ফিওনা লণ্ঠন জ্বালিয়ে জ্যাসপারের দিকে তাকিয়ে বলল, “কি হলো? এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?”
জ্যাসপার যেন হঠাৎ ধাক্কা খেয়ে বাস্তবে ফিরে এলো। “কিছু না,” সে দ্রুত মুখ ঘুরিয়ে নিল, যেন তার আবেগ ধরা পড়ে যাবে। কিন্তু তার কণ্ঠস্বর আর চোখের গভীরতা ফিওনাকে বিভ্রান্ত করে তুলল।
ফিওনা তার দিকে এগিয়ে এসে বলল, “তোমার এই চুপ থাকা আমাকে আরও বিভ্রান্ত করে। তুমি কি কিছু বলবে না?”

জ্যাসপার গভীর শ্বাস নিল। “তোমাকে এভাবে দেখার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না,” সে মৃদু স্বরে বলল।
লণ্ঠনের উজ্জ্বল আলোতে, ফিওনা ও জ্যাসপার একে অপরের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। জ্যাসপার, ভেজা পোশাক পরিহিত, যেন আরও বেশি হ্যান্ডসাম হয়ে উঠেছে। তার চোখের উজ্জ্বলতায় এক অদ্ভুত আভা ছিল, যেন আকাশের তারাদের মতো। ভেজা চুলগুলো তার মুখের ওপর ছড়িয়ে পড়েছে, আর পোশাক শরীরের ওপর লেপ্টে থাকা তার আকৃতিকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে।

আযদাহা পর্ব ৫৩

ফিওনা তার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল, সময় যেন থমকে গেছে।ফিওনা হঠাৎ করে বলল,”ইউ আর সাচ আ হট অ্যান্ড সেক্সি-লুকিং ড্রাগন”!”তার কথায় এক অপ্রত্যাশিত হাসি ফুটে উঠল।জ্যাসপার একবারের জন্য অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল। তারপর, কিছুটা অস্বস্তিতে চোখ পাকিয়ে অন্যদিকে ঘুরে বসে পড়ল।

আযদাহা পর্ব ৫৫