আযদাহা পর্ব ৯

আযদাহা পর্ব ৯
সাবিলা সাবি

পিকিং ইউনিভার্সিটির ক্লাসরুমে আজকের সন্ধাটা এক ভিন্ন আবহ বয়ে এনেছে। পরিক্ষার সুবাদে ভার্সিটি বন্ধ তবে ভার্সিটিতেই কোচিং ক্লাস শুরু করা হয়েছে।
প্রফেসর চি-ঝাং আজ জীববিজ্ঞানের এক অদ্ভুত, রহস্যময় অধ্যায় নিয়ে আলোচনা করছেন—ড্রাগন নামের কিংবদন্তি প্রাণী। শীতল বাতাসের স্পর্শে শিক্ষার্থীরা ড্রাগনের ইতিহাসে হারিয়ে যাচ্ছে, তাদের কল্পনার পটে ভেসে উঠছে ভয়ঙ্কর, কিন্তু একই সাথে মোহময় এক সত্তা।

প্রফেসর তার গভীর, গম্ভীর কণ্ঠে ব্যাখ্যা করতে শুরু করলেন, “ড্রাগন… মহাকালের বুকে লিপিবদ্ধ এক প্রাচীন রহস্য। ইতিহাস বলছে, ড্রাগনরা ছিল এক বিশালাকার মনস্টার, বিশ ফুটেরও বেশি দীর্ঘ, শক্তিশালী পাখা আর অগ্নি নিক্ষেপের ক্ষমতা ছিল তাদের বিশেষত্ব। তাদের আঁশ ছিল যেমন ধাতব শক্ত, তেমনই অলঙ্কৃত, প্রতিটি আঁশে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে এক ভয়ঙ্কর সুন্দর বর্ণালী তৈরি করত।
তারা বায়ুর স্রোতের মতোই উড়তে পারত, আর তাদের তীক্ষ্ণ নখর আর দাঁত ছিল যেন শাণিত তলোয়ার। তবে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ছিল তাদের আগুন—একবার কোনো শিকারকে লক্ষ্য করলে, সেই আগুন তার আত্মাকেও পুড়িয়ে ফেলত।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ফিওনা ক্লাসে বসে, তার চোখ প্রফেসরের দিকে থাকলেও, মন ড্রাগনের ভয়াল ছায়ায় ঢেকে যাচ্ছে। তার মনের গহীনে এক ভয় জাগ্রত হয়—এমন এক প্রাণী যদি বাস্তবেই সামনে এসে দাঁড়ায়, তাহলে কি তার সাহস থাকবে মুখোমুখি দাঁড়ানোর?
ফিওনার চিন্তায় ভেসে আসে এক চিত্র, ড্রাগন বিশাল ডানা মেলে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, আগুনের ফুলকি ছড়াচ্ছে চারদিকে। ফিওনা নিজেই সেই আগুনে দগ্ধ হতে বসেছে, তার সারা শরীরে ভয় এক প্রবল কম্পন এনে দিচ্ছে।
তার মনে প্রশ্ন জাগে, “এই ড্রাগনরা নিশ্চয়ই মানুষ খেয়ে ফেলে। যদি আমি কখনো এমন কোনো মনস্টারের সামনে পড়ি, নিশ্চিতভাবে হার্ট অ্যাটাক করেই মরে যাব!” তার কল্পনা এক মুহূর্তের জন্য তাকে বাস্তবের মাটিতে ফিরিয়ে আনে।

“ড্রাগনরা কেন বিলুপ্ত হলো?” প্রফেসরের প্রশ্ন ফিওনাকে বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনে। প্রফেসর গভীর ভাবে উত্তর দেন, “অনেকে বলে ড্রাগনরা মানুষের লোভ আর ক্ষমতার চাপে হারিয়ে গেছে। কিছু বিজ্ঞানী বিশ্বাস করেন, তাদের শক্তি এতটাই প্রবল ছিল যে, তাদের বাঁচিয়ে রাখা মানুষের জন্য বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবে প্রকৃতপক্ষে, ড্রাগনদের বিলুপ্তির কারণ আজও রহস্যের আড়ালে ঢাকা।”
ফিওনার শরীর শিরশির করে ওঠে। তার ভেতরের সন্দেহ আরও গভীর হয়, “তাহলে… ড্রাগন কি এখনো কোথাও আছে? যদি আমি একদিন সত্যিকারের ড্রাগনের সামনে পড়ি, আমি কি বেঁচে ফিরব?”

ফিওনা আজ ক্লাস শেষ করে ভারি মেঘলা মনের সঙ্গে পিকিং ইউনিভার্সিটির সবুজ গলি ধরে একা একা হাঁটছে। তার মনে আজ একটা অস্থিরতা কাজ করছে, ড্রাগনের গোপন ইতিহাস তার চিন্তাধারার সাথে মিশে গেছে। সবকিছুতেই অনাকাঙ্ক্ষিত টানাপোড়েন। লিয়া ডরমিটরিতে ফিরে গেছে অনেক আগেই, আর লিনের বিশেষ কাজ থাকায় সে বাড়িতে চলে গেছে। ফিওনা নিজের মধ্যে অজানা অস্বস্তি নিয়ে একাই হাঁটছে।
ঠিক তখনই, হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়ায় একজন—প্রথমে চমকে ওঠে ফিওনা, মনে হচ্ছিল কারও উপস্থিতি আগে টের পায়নি। কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই চিনতে পারে সে। হাসপাতালের সেই পরিচিত চেহারা—ডক্টর লিউ ঝান! ওয়াং লির নাতি। ফিওনার চোখে অবাকের ছাপ পড়ে।
“আপনি এখানে?” ফিওনার কণ্ঠে বিস্ময়।
ডক্টর লিউ ঝান হালকা হেসে উত্তর দিলেন, “হ্যাঁ, এদিকেই যাচ্ছিলাম। হঠাৎ তোমাকে দেখে ভাবলাম, একটু কথা বলি।”

ফিওনা কিঞ্চিত অপ্রস্তুত। “আচ্ছা, মিস ঝাং কেমন আছেন? আজ সন্ধ্যায় ওনাকে দেখতে যাবো ভাবছিলাম।”
“উনি আগের থেকে অনেকটাই সুস্থ।” লিউ ঝান একটু থেমে বললেন, “তোমার কোনো আপত্তি না থাকলে বা সময় থাকলে চলো সামনের কফি শপে এক কাপ কফি খেয়ে নিই?”
ফিওনার মাথায় হঠাৎই জ্যাসপারের কথা মনে পড়ল। আজ সন্ধ্যায় তার সঙ্গে ল্যাবে যাওয়ার কথা। সে তাড়াতাড়ি মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “সরি, মিস্টার লি আজ না, আরেকদিন খাবো। প্রমিস করছি, অন্যদিন সময় দেব। আজ একটু বিশেষ কাজ রয়েছে।”
লিউ ঝান ফিওনার মৃদু হাসিতে সমাধান পেয়ে বিদায় জানালো, তবে ফিওনা লক্ষ্য করেনি—দূর থেকে একজোড়া তীক্ষ্ণ চোখ তাদের দিকে সজাগ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। শপের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সাদা গাড়ির কাচ ভেদ করে তাকিয়ে ছিলো জ্যাসপার।
তার গভীর সবুজ চোখে শীতল রাগ জমা হচ্ছে।

মনে মনে জ্যাসপার নিজেকে বলল, “এই মানবটা আবার কে? ফিওনার বয়ফ্রেন্ড নাকি? কেন এত কাছাকাছি? এইসব হিউম্যানদের মধ্যে কেবল আবেগ আর আবেগ।”
জ্যাসপার পুনরায় নিজের মনে প্রান্তর থেকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে, এক ধরনের ঠান্ডা, বিশ্লেষণাত্মক ভাব নিয়ে।
“হিউম্যানরা কতোটা নির্বোধ। তারা বিশ্বাস করে যে তারা সবকিছু বুঝতে পারে।”
এদিকে ফিওনা নিজের পথ ধরে এগিয়ে যায়, অজান্তেই সেই রহস্যময় তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তার প্রতিটি পদক্ষেপ অনুসরণ করছে।

ফিওনা হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ থেমে যায়, তার চোখে ধরা পড়ে সামনেই দাঁড়িয়ে থাকা সাদা রঙের গাড়িটি—যা তার জন্য একদমই অপরিচিত নয়। গাড়িটির শীতল, মসৃণ শরীর আকাশে ঝুলে থাকা সাদা মেঘের মতো।ফিওনার মনে কোনও সন্দেহ থাকে না, এটাই জ্যাসপারের গাড়ি। মুহূর্তেই তার চিন্তাগুলো একত্রিত হয় আর তার পদক্ষেপ দ্রুত হয়ে যায়।
গাড়ির জানালার সামনে এসে দাঁড়াতেই, গাড়ির দরজা যাদুকরীভাবে খুলে যায়। জ্যাসপার ভেতরে অপেক্ষমাণ, সময়ের কোনও সীমা নেই তার জন্য। ফিওনা এক মুহূর্তও দেরি না করে গাড়িতে বসে পড়ে, তার মনে কৌতূহলের ঢেউ।

“কতক্ষণ ধরে এসেছেন?” ফিওনার কণ্ঠে এক ধরনের অস্থিরতা, সে তার চিন্তার স্রোত থামাতে পারছে না।
জ্যাসপার তার দৃষ্টিকে এক নিমেষে শক্ত করে,তীক্ষ্ণ কণ্ঠে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, “ছেলেটা কে ছিলো?”
ফিওনা হকচকিয়ে যায়, কিন্তু দ্রুত উত্তর দেয়,
“ওহ, উনি তো আমার গ্র্যান্ডপা চেন শিংয়ের পার্টনারের গ্ৰান্ডসান ডক্টর লিউ ঝান। মিস ঝাং যে হাসপাতালে ভর্তি, উনিই তার চিকিৎসা করছেন।”
জ্যাসপার নীরব থাকে, তার ঠোঁটের কোণে হালকা এক অবজ্ঞার রেখা। কোনও শব্দ না করে গাড়ির ইঞ্জিনে জীবন সঞ্চার করে সে, তার চোখ সামনের রাস্তার দিকে স্থির। ফিওনা বুঝতে পারে না কী ঘটছে, কিন্তু তার মনে হয় কিছু একটা অনিশ্চিতভাবে বদলে যাচ্ছে।
ফিওনা আবার প্রশ্ন করে, “তারমানে, আপনি অনেকক্ষণ ধরেই অপেক্ষা করছিলেন?”
জ্যাসপার ঠোঁটের কোণ দিয়ে এক ঠান্ডা হাসি দেয়, তার কণ্ঠে শীতল দৃঢ়তা ভেসে আসে, “আমি কারো জন্য অপেক্ষা করিনা,ফিওনা। সময় উল্টো আমার জন্য অপেক্ষা করে।”

ফিওনার হৃদয় তখনো বিড়বিড় করছে, চোখে অদ্ভুত বিস্ময়। জ্যাসপার ধীরে ধীরে তার মনে জড়িয়ে পড়া প্রশ্নগুলোকে আরও গভীরে ঠেলে দিচ্ছে।তবে,তার চোখে আত্মবিশ্বাস, যা ফিওনাকে আরও বিভ্রান্ত করে।
গাড়িটি মসৃণভাবে এসে থামে ফিওনার বাড়ির সামনে। রাতের আলোর নিচে সাদা দেওয়ালগুলো আরও স্ফটিকের মতো ঝকঝক করছে। ফিওনা গাড়ির জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখে, তার বাড়ির চেনা চেহারা, কিন্তু তার মনে তখন একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে—জ্যাসপার কীভাবে তার বাড়ির ঠিকানা জানলো? একবারও তো ফিওনা তাকে বলেনি।
তার কপালে একটুখানি ভাঁজ পড়ে। সে চিন্তায় ডুবে থাকে, কিন্তু জ্যাসপার তার প্রতিটি চিন্তাকে সহজেই পড়ে ফেলতে পারে। তার মুখে এক ধরনের প্রশান্তি, কিন্তু সেই প্রশান্তির আড়ালে এক নিখুঁত শীতলতা।
“ভাবছো কিভাবে তোমার ঠিকানা জানলাম, তাই না?” জ্যাসপার ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি নিয়ে বলে ওঠে। কণ্ঠে অদ্ভুত এক আত্মবিশ্বাসের ধারা,মনে হলো পৃথিবীর সবকিছুই তার নখদর্পণে।

“মিস ফিওনা আমি এখানে ল্যাব তৈরির কাজে এসেছি।চিনের প্রতিটি বড় বিজ্ঞানীর নামই আমার মুখস্থ। আর মিস্টার চেন শিং-এর মতো বিখ্যাত বিজ্ঞানীর বাড়ি চিনবো না, তা কি কখনো হয়?”
ফিওনা একটু হেসে ফেলে, মৃদু হলেও সেই হাসিতে কিছুটা অস্বস্তি মিশে থাকে।
“আপনি সবই জানেন, তাই না?” ফিওনা একটু দ্বিধায় বলল, “সব কিছুই যেন আপনার জানা।”
“সব কিছু নয়,” জ্যাসপার তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “কিছু কিছু জিনিসের জন্যও আমার অপেক্ষা করতে হয়।”
ফিওনা তার কথার অর্থ পুরোপুরি বুঝতে পারে না,তবে মনে হয় এই লোকটা প্রতিটি মুহূর্তেই ধাঁধার মতো কিছু রেখে যায়।
জ্যাসপার হঠাৎ প্রশ্ন করে,”আচ্ছা, বাড়িতে এই মুহূর্তে কে কে আছে?”

জ্যাসপার তার দিকে এক পলক তাকিয়ে থাকে, সে উত্তরটি আগে থেকেই জানে। ফিওনার উত্তরের আগেই তার ঠোঁটের কোণে এক অদ্ভুত হাসি ফুটে ওঠে।
“আহ, কেউ নেই বললাম না!” ফিওনা একটু হাসি নিয়ে বলে। “গ্র্যান্ডপা লন্ডনে আর মিস ঝাং হাসপাতালে। আমরা সোজা ল্যাবে প্রবেশ করবো, এতে কোনও সমস্যা হবে না।”
জ্যাসপার তখন আর কোনও কথা না বলে ফিওনার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে,তার চোখের ভেতরে ফিওনার সমস্ত কথা লুকানো। তার চোখ গভীরতা,যা কোনও সাধারন মানুষের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। সে কেবল বললো, “চলো, সময় অপচয় করার কোনও মানে নেই।”
তারপর ফিওনা দ্রুত সামনের পথ ধরে এগিয়ে যায়, আর জ্যাসপারও তার পেছনে সঙ্গ দেয়।তাদের দুজনের গন্তব্য একটাই—মিস্টার চেন শিং-এর সেই গোপন ল্যাব।
ল্যাবের সামনে এসে দাঁড়ালো দুজন। ফিওনা দ্রুততার সাথে কীপ্যাডে পাসকোড টাইপ করল। মুহূর্তের মধ্যে সয়ংক্রিয় দরজাটি এক মৃদু শব্দে খুলে গেলো।
ফিওনাআর জ্যাসপার একসাথে ধীরে ধীরে ল্যাবের ভেতরে প্রবেশ করল।

ভেতরে ঢুকতেই ফিওনার চোখের সামনে ধরা পড়ল তার পরিচিত সেই বিশাল রুম।সাদা দেয়ালগুলো থেকে প্রতিফলিত আলো গোটা পরিবেশটাকে এক ধরনের উজ্জল মোলায়েম আভা দিয়েছে।
চারপাশে সারি সারি দাঁড়িয়ে থাকা বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি। প্রতিটি যন্ত্র, প্রতিটি মেশিন নিখুঁতভাবে সাজানো—যেন এখানে এক মুহূর্তের জন্যও বিশৃঙ্খলা ছিল না।
“এটা হলো মাইক্রো সেল ডিটেক্টর,” ফিওনা একটার পর একটা যন্ত্রের দিকে ইঙ্গিত করতে থাকে, “এটা দিয়ে কোষের পরিবর্তন দেখা হয়। আর ওটা হলো জেনেটিক এনহ্যান্সার, যা মূলত প্রানীদের ডিএনএ পরীক্ষার জন্য তৈরি।”

ফিওনার প্রতিটি কথায় জ্যাসপার তার পাশে পায়চারি করে। তার হাত একের পর এক যন্ত্রের ওপর দিয়ে যায়, সে প্রতিটি বস্তুকে স্পর্শ করে দেখে যাচ্ছে। সে দেখে প্রতিটি যন্ত্র নতুনের মতো ঝকঝক করছে,পরিষ্কার আর গোছানো—ঠিক তার করা কিছুদিন আগের সেই ধ্বংসযজ্ঞের কোনো চিহ্নই নেই।
জ্যাসপারের ঠোঁটে এক বিদ্রূপাত্মক হাসি ফুটে ওঠে। সে স্মরণ করে সেদিনের সেই প্রলয়। যখন তার অগ্নিদৃষ্টিতে এই গোটা ল্যাব ছাই হয়ে গিয়েছিলো—যন্ত্রপাতি গুঁড়িয়ে,কাঁচ ভেঙে তছনছ হয়ে গিয়েছিলো। আর আজ?আজ আবার সবকিছু নতুন করে গোছানো। হাসি চাপতে পারল না জ্যাসপার। তার ঠোঁটের কোণে বিদ্রূপ জমে উঠলো।
“সবকিছুই কেমন পরিষ্কার, সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছে,” তার কণ্ঠে হালকা তাচ্ছিল্যের আভাস।”এই ল্যাব তো সেদিন কিয়ৎক্ষণের মধ্যেই তছনছ হয়ে গিয়েছিলো… এখন একদম নতুন।খুব দক্ষতা দেখিয়েছে তারা।”
ফিওনা তার দিকে কৌতূহলী চোখে তাকায়, “আপনি কি কিছু বললেন?”
“কিছু না, মিস। শুধু ভাবছি, মানুষ জিনিস মেরামত করতে খুবই দক্ষ, কিন্তু সম্পর্ক মেরামতের সময়, তারা তেমন সফল হয় না।” তার কণ্ঠের শীতলতা ফিওনার মনে আরও কৌতূহল তৈরি করে, কিন্তু সে কিছু জিজ্ঞেস না করেই একপাশে সরে দাঁড়ায়।

জ্যাসপার চারপাশটা আবার একবার ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে। তার চোখ চকচক করে ওঠে ল্যাবের নিখুঁত বিন্যাস দেখে। “আমার ল্যাবটাও ঠিক এমনভাবেই তৈরি করবো। মিস্টার চেন শিং এর রুচি খুবই উন্নত।” একরকম প্রশংসার সুরে বলে উঠল জ্যাসপার।
ফিওনা তার দিকে এক নজর তাকিয়ে বলে, “হ্যাঁ, গ্ৰান্ডপা সত্যিই খুব খুঁতখুঁতে। প্রতিটি ছোটো বিষয়েও তার অগাধ মনোযোগ।”
এবার তার দৃষ্টি হঠাৎ পড়ে পাশের সেই গোপন কক্ষের দরজার দিকে। সেটি যেখানেই আছে, ঠিক তার পেছনে জমে থাকা রহস্যের বাতাস। দৃষ্টির ইঙ্গিত বুঝতে পেরে, জ্যাসপার পায়চারি করতে করতে দরজাটার কাছে এসে দাঁড়ায়। হালকা গম্ভীর কণ্ঠে বলে, “আচ্ছা, ফিওনা, এটা কিসের রুম?”
ফিওনার কণ্ঠ একটু কম্পিত হয়ে যায়। “এটা সিক্রেট রুম, এখানে গ্ৰান্ডপা আর ওয়াং লি কোনো এক গোপন প্রকল্পের কাজ করছে। এখানে কেউই প্রবেশ করতে পারে না, বিশেষ অনুমতি ছাড়া।”
জ্যাসপার কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। মুখে এক অদ্ভুত হাসির ছায়া খেলে যায় সে এরই মধ্যে একটা চিন্তা ভেবেছে।

“তাহলে তো আমার ল্যাবেও এমন একটা সিক্রেট রুম তৈরি করতে হবে। এই ধারণাটা বেশ আকর্ষণীয়।”
জ্যাসপার এবার নিজের চোয়াল শক্ত করে বলে উঠল, “আচ্ছা চলো এই রুমে প্রবেশ করি। দেখা যাক এখানে কী কী রাখা আছে । এটাও দেখে নেওয়া উচিত।”
ফিওনা দ্রুত মাথা নেড়ে বলল, “না, এটা তো নিষিদ্ধ! গ্ৰান্ডপা অনুমতি ছাড়া কাউকেই এখানে ঢুকতে দেন না। আমাকেও না।”
জ্যাসপার তার গাঢ় চোখে এক ঝলক বিদ্রুপের হাসি আনল। “ফিওনা, তুমি এতটাই বোকা এটা জানোনা যে এই পৃথিবীতে যা কিছু নিষিদ্ধ, তা আরও বেশি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে।” তার কথার মধ্যে ছিলো এক ধরনের তীক্ষ্ণতা, যা ফিওনার বুকের গভীরে কাঁপন তুলল।

ফিওনা একটু থেমে, নিঃশ্বাস নিয়ে জ্যাসপারের দিকে ফিরে বলল, “আমি… আমি এই রুমের পাসকোড জানি না।” তার কণ্ঠে হতাশা ছিল,সে নিজেই এই অজানার দ্বারে পৌঁছে হতাশ হয়েছিলো পুর্বে।
জ্যাসপার তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, ফিওনার মনের গভীর কথা সে পড়ে ফেলেছে।তার ভ্রু একটু কুঁচকে গেল, তবে সেটা কিছুটা বিদ্রুপের মিশ্রণ। “তুমি চাইলেও গ্রান্ডপা তোমাকে এই রুমে ঢোকার অনুমতি দেয়নি?” সে শান্ত গলায় প্রশ্ন করল।
ফিওনা একটু ইতস্তত করে বলল, “হ্যাঁ… মাঝে মাঝে এই রুম থেকে অদ্ভুত শব্দ আসে। আমার মনে হয়েছে ওখানে কিছু আছে, কিন্তু গ্ৰান্ডপা কখনো আমায় কিছু বলেনি। আমারও ইচ্ছা হয়, ভিতরে কি লুকিয়ে আছে তা দেখার।”
জ্যাসপারের ঠোঁটে সেই বিদ্রুপের হাসিটা আরও গভীর হয়ে উঠল। “অদ্ভুত শব্দ, বলছো? হয়তো কিছু এমন লুকিয়ে আছে যা তোমার কল্পনার বাইরে। অথবা… এমন কিছু যা সত্যিই ভয়ঙ্কর।” তার গলার স্বরে একটা অন্ধকার শিহরণ ছিল, যা ফিওনার মেরুদণ্ড বেয়ে নেমে গেল।

“সায়েন্টিস্টরা সবসময় কিছু না কিছু লুকিয়ে রাখে, ফিওনা। বিশেষত যখন সেটা বিপজ্জনক।” জ্যাসপার এবার দরজার প্যানেলের দিকে তাকিয়ে নিজের চোয়াল শক্ত করল। “তবে মনে হচ্ছে, এটা জানার সময় হয়ে গেছে।”
ফিওনার মনে ভয় মিশ্রিত কৌতূহল দানা বাঁধল।
জ্যাসপার ফিওনার দিকে একরকম অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, তার গভীর চোখদুটোতে সন্দেহের আভা। “মেইন দরজার পাসওয়ার্ড জানো, আর এটা জানো না? কীভাবে সম্ভব, ফিওনা?” তার কণ্ঠে অবিশ্বাস স্পষ্ট।
ফিওনা একটু পিছিয়ে গিয়ে মাথা নিচু করে বলল, “আমি সত্যিই জানি না। গ্রান্ডপা কখনো এই রুমের পাসওয়ার্ড আমাকে বলেনি।”
জ্যাসপারের ঠোঁটের কোণে বিদ্রুপের ছাপ ফুটে ওঠে। তার চোখে মৃদু অস্বস্তি সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না যে ফিওনা এমন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানে না। কিন্তু তার চোখ দুটো হঠাৎ চকচক করে ওঠে, সে কোনো কৌশল বের করে ফেলেছে। “এটা তো বায়োমেট্রিক পদ্ধতি। তোমার আঙুল রাখো ডিসপ্লেতে”।
ফিওনার চোখ বড় বড় হয়ে যায়। “না, না,” সে দ্রুত বলল, পেছনে সরে এসে, “গ্ৰান্ডপার কাছে এটা সিক্রেট এলার্ট থাকতে পারে। যদি আমার আঙুলের ছোঁয়া পড়ে, সিগন্যাল সরাসরি তার কাছে চলে যেতে পারে! আমি জানি না তিনি কী ব্যবস্থা রেখেছেন।”

জ্যাসপারের মুখের হাসি মিলিয়ে যায়, তার ভ্রু কুঁচকে যায়। এক ধরণের ধৈর্যহীনতা তার চোখে ফুটে ওঠে। “তুমি কি সত্যিই এতটাই বোকা? নাকি বোকা বানাচ্ছো আমাকে? তুমি কি জানো না এই রুমের মধ্যে কী ধরনের তথ্য লুকানো থাকতে পারে?
ফিওনার বুকের মধ্যে শিরশিরে উত্তেজনা ভর করে, কিন্তু সে দ্বিধায় ভুগছে। “আমি… আমি জানি না, মিস্টার জ্যাসপার। গ্ৰান্ডপা আমাকে নিষেধ করেছেন। আমি তার বিশ্বাস ভাঙতে চাই না।”
জ্যাসপার এবার এক পা সামনে এগিয়ে এসে ধীরে ধীরে তার মুখের কাছে গিয়ে বলল, “বিশ্বাস? এই পৃথিবীতে একটাই নিয়ম কাজ করে, ফিওনা, আর তা হলো ক্ষমতা। তুমি যদি দুর্বল হও, তাহলে কেউ তোমাকে বিশ্বাস করবে না, আর যদি শক্তিশালী হও, তাহলে কাউকে বিশ্বাস করতে হবে না। এখন তুমি যা করছো, তা হচ্ছে তোমার দুর্বলতা দেখানো।”
ফিওনা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তার মনের ভেতর একধরনের উত্তেজনা তীব্রতা বেড়ে যায়।

ফিওনার নিরবতা দেখে জ্যাসপারের চোয়াল তীব্রভাবে শক্ত হয়ে উঠল,তার ভেতরে জমে থাকা ক্রোধ এখন আর সামলানো যাচ্ছে না। তার তীক্ষ্ণ অলিভ-গ্রিন চোখের চারপাশ রক্তিম আভায় আচ্ছন্ন, সেই চোখের গভীরে তাণ্ডবের আগুন ঝলসে উঠছে। তার নাকের ডগা রাগে লাল হয়ে উঠেছে, আর মুখের সেই সাধারণ সৌন্দর্য এখন কোনো পৈশাচিক রূপ ধারণ করেছে।
সে এক মুহূর্ত দেরি না করেই কড়া স্বরে বলে উঠল, “ফিওনা, আমি বলছি তোমাকে—এই দরজাটা খোলো। এখনই।”

ফিওনা স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তার চোখগুলো বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে যায়,জ্যাসপারের আচরণে সে সম্পূর্ণ হতভম্ব হয়ে গেছে। জ্যাসপারকে এমন অবস্থা সে কখনো দেখেনি। এই ঠাণ্ডা, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মানুষটা এভাবে কি করে তার ওপর এত রেগে যায়? তার অবাক দৃষ্টি এখন জ্যাসপারের ওপর স্থির হয়ে আছে।
কোনো সাড়া না পেয়ে জ্যাসপার এক মুহূর্ত দেরি না করেই ফিওনার হাত শক্ত করে চেপে ধরে। হঠাৎ করেই এক প্রবল টানে তাকে দরজার ডিসপ্লের সামনে নিয়ে গেল,মনে হলো কোনো দুর্বল পুতুলকে টেনে আনা হচ্ছে। ফিওনার মুখে যন্ত্রণার ছাপ ফুটে ওঠে, কিন্তু জ্যাসপারের মুখে কোনো দয়া বা অনুশোচনা নেই।
“ছাড়ুন আমাকে, জ্যাসপার… আমার লাগছে!” ফিওনার কণ্ঠে ব্যথা ফুটে ওঠে, কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয় না।
জ্যাসপার জোর করে ফিওনার বুড়ো আঙুলটা ডিসপ্লেতে চেপে ধরে। প্রথমে ডান হাত, তারপর বাম হাত—কিন্তু প্রত্যেকবারই ডিসপ্লেতে ভেসে ওঠে একটাই বার্তা: “পাসওয়ার্ড ডিনাইড”। সেই বার্তা দেখে জ্যাসপারের চোয়াল আরও কঠোর হয়ে ওঠে, তার মুখের ভেতরে ক্রোধের ঢেউ আছড়ে পড়ছে।
ফিওনা হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে, কিন্তু তার শক্তি এতটাই কম যে জ্যাসপারের হাতে বন্দী হয়ে যায়। “ছাড়ুন আমাকে! জ্যাসপার, বলছি, আমার খুব লাগছে!” ফিওনার কণ্ঠে কাতরতা স্পষ্ট।
জ্যাসপার থেমে যায়, তার অগ্নিদৃষ্টিতে তাকায় ফিওনার দিকে। তার চোখের চারপাশে রক্তাভ আলো জ্বলছে, আর সে ক্রোধে এতটাই তীব্র হয়ে উঠেছে যে তার সামনের মানুষকেও যেন গিলে ফেলতে পারে। কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে, জ্যাসপার ধীরে ধীরে ফিওনার হাত ছেড়ে দিল, কিন্তু তার মুখের সেই রাগ আর ভেতরের উত্তেজনা এখনও স্পষ্ট।

ফিওনা তার হাতটা ধরে একটু দূরে সরে গেল, তার হৃদয় দ্রুত বেগে ধুকপুক করছে। জ্যাসপারের এই অচেনা রূপ তাকে স্তব্ধ করে দিয়েছে।
ফিওনার কণ্ঠ রাগে কাঁপছিল, তীক্ষ্ণতায় ভরা প্রশ্ন তার ঠোঁট থেকে ঝরল, “আপনার সাহস কীভাবে হয় আমার সাথে এমন ব্যবহার করার? আপনার আসল উদ্দেশ্য কী? কে আপনি?”
জ্যাসপারের ঠোঁটে এক বিদ্রুপের হাসি ফুটে উঠল, তার চোখে একরকম দম্ভ ঝলসে উঠছে। “বোকা মানবী,” সে মৃদু হেসে বলে উঠল, “তুমি সত্যিই বুঝতে পারো না, তাই না? আমি বুঝেছি, তোমার সাথে এভাবে কিছু হবে না। তবে তোমাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতেই হবে।”

তার কণ্ঠে শীতলতা ফুটে উঠল,এক অজানা শক্তির ছায়া ফিওনার চারপাশে নামতে শুরু করেছে। জ্যাসপার ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো, তার চোখে এক অদ্ভুত দৃষ্টির ছায়া। “তার আগে, তোমাকে আমার আসল পরিচয়টা দিয়েই দেই। দেখবে আমার আসল রূপ?” তার কণ্ঠে ছিল হুমকি।
“তুমি কি ঠিক থাকতে পারবে? যদি নিজের ভালো চাও, তাহলে এখনই বলো,সিক্রেট রুমের দরজার কেমিক্যাল প্রতিরোধ করার উপায় কী?”
ফিওনার চোখ ভয়ে বড় হয়ে গেল। তার সারা শরীর আতঙ্কে জমে গেল, কিন্তু সে মুখ শক্ত করে জবাব দিল, “আমি কিচ্ছু জানি না, প্লিজ, এখান থেকে বেরিয়ে যান।”
জ্যাসপারের মুখ এক মুহূর্তের জন্য পাথরের মতো কঠিন হয়ে গেল। তার চোখে আগুনের ঝলকানি ফুটে উঠল। “ঠিক আছে,” সে শীতল গলায় বলল, “তাহলে দেখো আমি কী করতে পারি।”

ফিওনা ভয় আর বিস্ময়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল,যখন সে দেখল জ্যাসপারের সারা শরীর এক অদ্ভুত শক্তির ঢেউয়ে আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে। তার গায়ের রঙ পাল্টাতে শুরু করল, আর এক প্রবল শক্তির ঝড় তাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরলো। তার পেশীগুলো ফুলে উঠল, তার চোখের রং বদলে এক তীব্র লালাভ আভায় রূপান্তরিত হলো। তার শরীরের প্রতিটি অংশে এক অমানবিক পরিবর্তন ঘটতে শুরু করল—তাকে আর মানুষ বলা যায় না, সে এখন এক প্রাচীন,ভয়ঙ্কর ড্রাগনের রূপ ধারণ করছে।
ফিওনার পা থেকে মাথা পর্যন্ত আতঙ্ক ছড়িয়ে গেল। সে ধীরে ধীরে পেছাতে লাগল, কিন্তু তার চোখের সামনে ভয়ানক দৃশ্য থেকে চোখ সরাতে পারল না। জ্যাসপার এখন সম্পূর্ণ রূপে ড্রাগন হয়ে উঠেছে। তার লম্বা ডানা দুটো ছড়িয়ে আছে, তার মুকুটের মতো মাথা, সেই বিশাল চোয়াল,আর তার দেহের চারপাশে ঘুরে বেড়ানো আগুনের শিখা—এইসবই ছিল এমন কিছু যা ফিওনার কল্পনাতেও আসেনি।
“এবার বুঝলে তুমি কার সাথে কথা বলছো?” জ্যাসপারের ড্রাগনের মতো গম্ভীর, ভয়ানক কণ্ঠ ফিওনার কানে প্রবেশ করল। “তুমি বেছে নাও, ফিওনা। দরজা খুলবে নাকি আমার আসল শক্তির স্বাদ পাবে?”
মুহূর্তের মধ্যে ফিওনার শরীর অসাড় হয়ে গেল। বিশাল চেহারার ড্রাগন, যে উচ্চতা বিশ ফুট, তার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো।

তার বিশাল ডানা ছড়িয়ে আছে,সেগুলো বনভূমির অংশ, সবুজ রঙের শরীর অরণ্যের গহনে লুকিয়ে থাকা গাছের রংকে ধূসরিত করেছে। চোখ দুটি অলিভ গ্রিন, মর্মান্তিকভাবে উজ্জ্বল, অন্ধকারে দীপ্তিময় উজ্জ্বলতার এক অশুভ দিক। লেজটি সাপের মতো সরু আর ক্ষিপ্র, ধারালো নখগুলো শত্রুর জন্যে একটি ভয়ংকর প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।
ল্যাবটি বিশাল,উচ্চতার কারণে সেখানে তার নিজস্ব রূপে ফিরে আসা জ্যাসপারের জন্য তেমন সমস্যা হয়নি। জ্যাসপারের ড্রাগন রূপের বিশালতা এক মর্মভেদী বাস্তবতার অভিজ্ঞতা এনে দিল, যা ফিওনার মনকে পুরোপুরি আচ্ছন্ন করে ফেলল। ভয়ের এক শীতল ঢেউ তার শরীর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল। কিভাবে সম্ভব—এমন কিছু কি সত্যি?
জ্যাসপারের গভীর কণ্ঠ ফিওনার কানে বেজে উঠল। “তুমি কী বুঝতে পারছো, ফিওনা? আমি আর তোমার পরিচিত জ্যাসপার নই; আমি তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছি ড্রাগন প্রিন্স জ্যাসপার অরিজিন।”

ফিওনার মনে হচ্ছিল,সবকিছু থেমে গেছে। তার মন শুধুই একটাই চিন্তায় ভরে গেছে—এই অদ্ভুত প্রাণী, যে রূপে এখন সে তাকিয়ে আছে সত্যি কি এটা নাকি কোনো মতিভ্রম? ভয়ের কারণে তার হাত-পা স্থির হয়ে গেল, সারা শরীর বরফ হয়ে গেল। তার জ্ঞান কিছুটা অন্ধকারে চলে যেতে লাগল।
“না!” সে মনে মনে চিত্কার করতে চাইছিল, কিন্তু কিছুই বলতে পারল না। শেষপর্যন্ত, তার চোখের সামনে সবকিছু কালো হয়ে গেল, আর সে জ্ঞান হারাল।
জ্যাসপার,এখন ড্রাগনের রূপ ধারণ করে, তার শক্তি আর প্রতিশ্রুতি নিয়ে সেই গোপন রুমের দিকে তাকাল।
ফিওনার অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে জ্যাসপার ধীরে ধীরে নিজের মানব রূপে ফিরে আসে। তার শক্তিশালী ড্রাগনের চেহারার উজ্জ্বলতা ম্লান হয়ে যায়, আর বদলে আসে একটি পরিচিত, কিন্তু চেহারার সৌন্দর্যে তীব্র বিরক্তির ছাপ।

“উফ,” সে নিঃশ্বাস ফেলে বলে ওঠে, “এই মানবজাতি কেন এত দুর্বল? তাদের সুরক্ষিত রাখতে সক্ষম এমনকি একজনেরও শক্তি নেই।”
দরজার পাশে দাঁড়িয়ে, সে ফিওনার দেহের দিকে তাকায়। হতাশা আর তাচ্ছিল্যেতা তার চোখে। “কিভাবে সম্ভব? তোমাদের জ্ঞান, তোমাদের সমৃদ্ধি—এগুলো কিসের কাজ যদি এমন সামান্য ভয়ে তোমরা অজ্ঞান হয়ে যাও?”
অর্থহীনভাবে তার মাথা ঝাঁকিয়ে দেয়। সে ভেবেছিল, মানবজাতির শক্তির খোঁজে এসে কিছু আলোকিত দৃষ্টি পাবে, কিন্তু এখানে এসে তার প্রত্যাশা বিপরীত প্রান্তে ঠেকে গেছে।
“তবে অপেক্ষা কর,” সে অদ্ভুত এক হাসি মুখে এনে বলে, “এটা তো কেবল শুরু। আমি তোমার জন্য আরও চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসব। ”

জ্যাসপার ধীর পায়ে ফিওনাকে কাঁধে তুলে নেয়,তার শক্তিশালী বাহু ঘিরে ধরে থাকে অপার বিশ্বাসের এক আবেগ। ফিওনার মাথাটি ঝুকে আছে,অজ্ঞান অবসন্নতা তার মুখাবয়বে। তার দীর্ঘ বাদামী চুলগুলো জ্যাসপারের পিঠে ঝুলে পড়ে একধরনের কোমল আচ্ছাদনে।
ল্যাবের রহস্যময় পরিবেশে, জ্যাসপারের মনোযোগ গাঢ় সংকল্পের দিকে ফিরিয়ে নেয়। সে এক পাশে একটি কম্পিউটার স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে, দ্রুত কয়েকটি কিপ্যাডে আঙুল চালাতে শুরু করে। তার প্রতি অঙ্গভঙ্গি একটি সংকেত বহন করে—
“মিস্টার চেন শিং,” সে টাইপ করতে থাকে, প্রতিটি অক্ষরে ভবিষ্যতের পাণ্ডুলিপি রচনা করছে। “আমি আপনার আদরের একমাত্র নাতনী এলিসন ফিওনাকে আমার সাথে করে নিয়ে গেলাম।আমার ভাই এথিরিয়নকে যেদিন মুক্ত করবেন, সেদিন আবার নিজের একমাত্র নাতনীকে দেখতে পারবেন আর যদি এথিরিয়নের আর বিন্দুমাত্র ক্ষতি হয়, তাহলে ফিওনার কি অবসাদ হবে আপনি স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারবেন না,সবশেষ আমার ইমেইল আইডি দিয়ে গেলাম আমার সাথে যোগাযোগ করবেন।”

ল্যাবের সাইফার আর সিক্রেটসের মাঝে, জ্যাসপার তার কাজ সম্পন্ন করে। ঞলিখিত বার্তার শেষে, সে নিশ্চিত করে যে, প্রয়োজন হলে সবকিছু উল্টে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত। এই লড়াইয়ের মাঝে, ফিওনাকে তার বাহুতে বয়ে নিয়ে চলা তারই এক অঙ্গ।
জ্যাসপার ফিওনাকে কাঁধে নিয়ে ল্যাবের প্রবেশদ্বার অতিক্রম করে। তার পা জোড়া একাত্ম হয়ে গেছে এই অন্ধকার জগতে,যেখানে বিজ্ঞান আর রহস্যের অবিরাম তাপ আবহাওয়ার মতো ঘিরে রেখেছে। চাঁদ আলো ফোটাতে ব্যর্থ, তবে তার ভেতরে ধূসর সমুদ্রের অন্তর্নিহিত গোপনীয়তা আবিষ্কারের সংকল্প।
ফিওনাকে পাজায় তুলতে, জ্যাসপারের শক্তি তার রক্তনালীতে রক্তের মতো প্রবাহিত হয়। অজ্ঞান অবস্থায় ফিওনার দেহটি পেশীশক্তির অভাব ভোগ করছে; অথচ তার সৌন্দর্য সেই ঘরানার আলো। জ্যাসপার ফিওনাকে গাড়ির আসনে বসিয়ে রাখে, তার কোমল মুখটি শিশিরবিন্দুর মতো ঝরে পড়েছে।

যখন সে ড্রাইভিং সিটে বসে, তার অলিভ গ্রিন চোখের অভিব্যক্তি হয়ে উঠে অন্তর্গত যুদ্ধের সাক্ষী। সে ফিওনাকে কয়েক মুহূর্তের জন্য নিবিড়ভাবে দেখে সময় থেমে যায়। তার গাঢ় চিন্তাভাবনায়, জ্যাসপার বুঝতে পারে, ফিওনার জীবন এখন তার হাতে, আর এথিরিয়নের মুক্তি ফিওনার হাতে।
গাড়ির স্টার্ট দেওয়ার জন্য জ্যাসপার গভীর নিশ্বাস নিয়ে তাতে চাপ দেয়। ইঞ্জিনের গর্জন গভীর অরণ্যের গর্জনের মতো, সেই অন্ধকারের সাথে সাহসী পাড়ি জমাতে চায়। ফিওনার অজ্ঞান দেহটি নিরাপদে বসে আছে, সে এখন এক বিপদগ্রস্ত চিত্র।

আযদাহা পর্ব ৮

অন্ধকার পথ ধরে গাড়ি চলতে থাকে, যেখানে প্রতিটি পাঁকা ঘনিষ্ঠ মনে করিয়ে দেয় নতুন অধ্যায়ের কথা। জ্যাসপারের অঙ্গীকার—ফিওনাকে বন্দি করা তার অজানা পথে নিয়ে যাওয়া, যেখানে এক নতুন বন্দী জীবন,এ ক নতুন লক্ষ্য তাকে অপেক্ষা করছে।

আযদাহা পর্ব ১০