আযদাহা সিজন ২ পর্ব ১৪ (২)

আযদাহা সিজন ২ পর্ব ১৪ (২)
সাবিলা সাবি

ফিওনা রান্নাঘরে ব্যস্ত, প্রতিটি পদে তাকে নতুন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। পুরোপুরি অচেনা এই পরিবেশে, হাতের কাজ থেকে চোখ সরানোর সুযোগ নেই। নানা ধরনের সবজি, মসলা,আর মাছের অদ্ভুত গন্ধে পরিবেষ্টিত হয়ে আছে। রান্নার প্রক্রিয়ায় কখনও ভুলভাবে কাটা সবজির টুকরো, কখনওবা হাতের আঙুলের ওপর কাটার আঁচড়।
অবশেষে,ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে ফিওনা যখন রান্না শেষ করে, তখন বিকেলের আলো আবহাওয়াকে শান্ত করে দিয়েছে। হাঁড়িগুলোতে রান্না করা নানা পদ জমা হয়েছে, কিন্তু তার মাথায় এখনও আতঙ্কের ছায়া।
“এই মেয়ে, শোনো!” আলবিরার কণ্ঠস্বর তাকে ভেঙে দেয়। “সবগুলো খাবার ওই লিভিং রুমের ডাইনিং টেবিলে সাজিয়ে রাখো।”

ফিওনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, একে একে হাঁড়িগুলো ডাইনিং টেবিলের দিকে নিয়ে যেতে থাকে। প্রতিটি হাঁড়ির ভারীতা তার শরীরকে ক্লান্ত করে তুলছে,মনে হচেছ সমস্ত কাজ একাই করার জন্য তাকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। অবশেষে, সবকিছু টেবিলে রেখে যখন সে দাঁড়িয়ে, মনে হচ্ছে পৃথিবীর বোঝা তার কাঁধ থেকে মুক্ত হয়েছে।
“বলছি, কাজ তো শেষ, এবার কি আমি খাবার খেতে পারবো?” ফিওনা আলবিরার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে।
আলবিরা তার দিকে ফিরে তাকিয়ে, “কাজ এখনো বাকি আছে। এখানে সব আমাদের খাবার দেয়া হয়েছে। প্রিন্স অরিজিন কি আমাদের সাথে বসে খাবে নাকি? ওনার খাবার আলাদা রেডি করে ওনার রুমে দিতে হবে।”
“রুমে? ওনার রুম, আমি তো চিনিনা,” ফিওনা বিভ্রান্তির স্বরে উত্তর দেয়।
“আমি চিনিয়ে দেবো। তাড়াতাড়ি করো, প্রিন্সের এতক্ষণে বোধহয় ক্ষিদে পেয়েছে”।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ফিওনার মনে অস্থিরতা জন্ম নেয়, কিন্তু সে চুপ করে কিচেনে ফিরে আসে। রান্নার অভিজ্ঞতা হয়তো খুব একটা স্বস্তি এনে দেয়নি, কিন্তু প্রিন্সের জন্য তার তৈরি করা খাবারগুলো তাকে ভিন্ন আত্মবিশ্বাসের পথে নিয়ে যাচ্ছে।
ফিওনা পুনরায় কিচেনে ঢুকে সার্ভিং ট্রলিতে বড় বড় প্লেট আর বাটিতে খাবার সাজাতে শুরু করে। নানান পদ, সবজি, মাংস,আর ড্রাগনদের জন্য বিশেষ প্রস্তুত করা ব্যঞ্জনগুলো একের পর এক ট্রলিতে সযত্নে রাখছে। একসময় আলবিরা কিচেনে প্রবেশ করে। গোছানো শেষ হতে দেখে সে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। ফিওনার দিকে এক নজর তাকিয়ে বলল, “সব প্রস্তুত?”
ফিওনা একটু ক্লান্ত স্বরে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ, কিন্তু একটা প্রশ্ন আছে। এই কাঠের সিঁড়ি দিয়ে সার্ভিং ট্রলি দোতলায় কিভাবে নিয়ে যাবো?”

আলবিরার মুখে এক চিলতে হাসির রেখা ফুটে ওঠে, ফিওনার অনভিজ্ঞতা তাকে মজার কিছু মনে করাচ্ছে। “এটা নিয়ে চিন্তা কোরো না,” সে বলে, “এখানে ড্রাগন প্রাসাদে সবকিছুর জন্য ব্যবস্থা থাকে। আমি তোমাকে দেখিয়ে দিচ্ছি কীভাবে খাবার নিয়ে দোতলায় যাবে।দোতলায় উঠানোর জন্য আমাদের সিঁড়ির পেছনের দিকে লিফট আছে, ট্রলি নিয়ে সেটা ব্যবহার করতে হবে।”
ফিওনা একটু ,স্বস্তি অনুভব করে বলে, “যাক কাজটা কিছুটা সহজ হয়ে গেল।”
“তবে তাড়াতাড়ি করো,” আলবিরা নির্দেশ দেয়, “প্রিন্স অরিজিন ক্ষুধার্ত, আর ওনার খাবারের সময়ে দেরি করা চলে না।”

ফিওনা খাবারের ট্রলি নিয়ে সিড়ির পেছনের লিফটে উঠে পড়ে, লিফট দ্রুত দোতলায় উঠে যায়। তার মনে উত্তেজনা আর বিভ্রান্তি, কারণ সে এই ধরনের পরিস্থিতির সাথে কখনোই আগে পরিচিত হয়নি। আলবিরা আগেই তাকে সতর্ক করে দিয়েছে—জ্যাসপারের রুমের সামনে এসে দাঁড়ালেই তাকে বুঝতে হবে কীভাবে খাবার পৌঁছে দিতে হবে।
লিফট থেকে নেমে করিডোর পেরিয়ে, ফিওনা নিজের কক্ষে পার হয়ে, শেষের দিকে পৌঁছে যায়। আলবিরার দেয়া নির্দেশ অনুযায়ী, সে দেখতে পায় একটা গ্লাসের তৈরি বিশাল কক্ষ। সম্পূর্ণ স্বচ্ছ কাচের দেয়াল, যা বাইরের দৃশ্যকে দৃষ্টিগোচর করে, কিন্তু ভেতরের কোনো কিছুকেই বাইরে থেকে বোঝা যায় না। ফিওনা একটু অবাক হয়ে থেমে যায়।
ট্রলি একপাশে রেখে, সে গ্লাসের চারপাশে হাত বোলাতে থাকে,মনে হলো কোনো সিক্রেট মেকানিজম খুঁজে পেতে পারে। তার আঙুলগুলো কাচের ওপর দিয়ে ধীরে ধীরে বুলাতে থাকে, কিন্তু কিছুই ঘটে না। কোনো বোতাম নেই, কোনো শব্দ নেই—এ যেন রহস্যের চূড়ান্ত বিন্দু। সে ভাবছে, কীভাবে ভেতরে প্রবেশ করবে বা খাবার পৌঁছাবে।
একটু হতাশ হয়ে, ফিওনা একবার পেছনে তাকায়। তার মনে প্রশ্ন জাগে—এতক্ষণে যদি কোনো প্রকার ভুল হয়ে যায়, তাহলে কী হবে?

ফিওনা কিছুক্ষণ আগেও দন্ধে ছিল—কাচের দেয়াল কীভাবে পার হবে, কীভাবে পৌঁছে দেবে খাবার—কিন্তু হঠাৎ পেছন থেকে এক গভীর, রহস্যময় কণ্ঠ তার মনোযোগ ভেদ করে যায়। “এই মেয়ে এখানে কি করছো? আমার কক্ষের সামনে?”
আতঙ্কের ঘোর কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ায় ফিওনা। তার শ্বাস এক মুহূর্তে থেমে যায়, কারণ তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে জ্যাসপার—অপার্থিব সৌন্দর্য আর গম্ভীর অভিজাত্যে ভরা। গায়ে সাদা সিল্কের বাথরোব, যার ওপর বিকেলের সূর্যের সোনালি আলোকরশ্মি এসে পড়ছে, সেই আলোয় তার ত্বক সোনালি বর্ণে ঝলমল করছে। তার চুল, সদ্য ধোয়া, টপটপ করে পানি ঝরছে,আর সেই পানির ফোঁটাগুলো তার গালের ওপর মুক্তোর মতো চিকচিক করছে।
বাথরোবের ফাঁক গলিয়ে ঘাড়ের ট্যাটুটা অর্ধেক অংশ দেখা যাচ্ছে। ট্যাটুর রঙ সবুজ,যা নরম গাঢ় সাদা বাথরোবের স্নিগ্ধতার মধ্যে ট্যাটুর তীক্ষ্ণ রেখাগুলি এক অনন্য কল্পনার উন্মোচন করছে।

এ জ্যাসপারের সবুজ নেত্রপল্লব দুটো ফিওনার দিকে স্থিরভাবে তাকিয়ে আছে—গভীর, প্রশান্ত কিন্তু বর্ণনাতীতভাবে তীব্র। মনে হচ্ছে সেই চোখজোড়া ফিওনার আত্মা অবধি বিদ্ধ করছে। ফিওনার মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে সেই দৃশ্য। সে স্থবির হয়ে তাকিয়ে আছে, সমস্ত পৃথিবী এই এক মুহূর্তে এসে থেমে গেছে। জ্যাসপারের চেহারার প্রতিটি রেখা, তার ভিজে চুলের ঝরঝরে ভাব, তার শরীরের প্রতিটি অনমনীয় ভঙ্গি ফিওনাকে কোনো মায়াজালে আটকে ফেলেছে।
ফিওনার মনে হচ্ছিল, এই মুহূর্তে তার স্মৃতিরা ধোঁয়াটে হয়ে গেছে—সে কোথায়, কী করছে, কী উদ্দেশ্যে এখানে এসেছে—সবকিছু ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে। তার দৃষ্টি এখন কেবল একটি মাত্র বিন্দুতে আটকে গেছে, আর তা হলো জ্যাসপারের সেই অদ্ভুত আকর্ষণীয় উপস্থিতি।

জ্যাসপার ফিওনার এমন অন্যমনস্ক দৃষ্টিতে কিছুটা বিরক্ত হয়। ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে এসে ফিওনার একদম সামনে দাঁড়ায়, এতটাই কাছে যে তাদের মধ্যে দূরত্ব বলতে কিছুই রইল না। তার শীতল দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে, চোখে এক ধরনের জিজ্ঞাসু তিরস্কার। কণ্ঠে গম্ভীর অথচ প্রখর সুরে প্রশ্ন করে, “কি হলো? জবাব দিচ্ছো না কেন? এভাবে কি দেখছো তাকিয়ে? কোনোদিন চোখের সামনে পুরুষ মানুষ দেখোনি নাকি?”
জ্যাসপারের তীক্ষ্ণ কণ্ঠে সম্বিত ফিরে পায় ফিওনা, তার কথাগুলো বাস্তবতার কষাঘাতে ফিওনাকে ফিরিয়ে আনে। নিজের ওপরেই বিরক্তি তৈরি হয়—এতক্ষণ কীভাবে এমনভাবে তাকিয়ে ছিল? একজন পুরুষ মানুষের দিকে, তাও এই অদ্ভুত ড্রাগন-পুরুষের দিকে। বাহ্যিক সৌন্দর্য যেমনই হোক, ফিওনা জানে এই আগুনের দান*বটির আসল রূপ কতটা ভয়ঙ্কর।

মৃদু স্বরে ফিওনা নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, “আপনার খাবার নিয়ে এসেছি। আলবিরা বললো আপনি নাকি কক্ষে বসে খাবেন তাই।”
জ্যাসপারের ঠোঁটের কোণে বিদ্রূপের হাসি খেলে যায়। “বাহ, এখন তো দেখছি আমার বিষয়ে ভালো যত্ন করছো! কী সুন্দর ভোল পাল্টে ফেললে!” তার কণ্ঠের সুরে ব্যঙ্গ ফুটে উঠলো।
তারপর হঠাৎই স্লাইডিং ডোরটি নীরবে খুলে যায়, ফিওনার সামনে প্রকাশিত হয় জ্যাসপারের কক্ষ। সেখানে আলোছায়ার খেলায় ঘেরা স্নিগ্ধ পরিবেশ। জ্যাসপার নির্দ্বিধায় প্রবেশ করে, আর ফিওনা তার পেছন পেছন অনুসরণ করে, মনের ভেতরে দোলাচলে ডুবে গিয়ে, পায়ের তালে তাল হারাচ্ছে।
রুমটি অবাক করার মতো বিশাল, ছাদের শীর্ষবিন্দু থেকে গ্লাসের দেওয়ালগুলো বাইরের প্রকৃতি আর অন্ধকার সাগরের অবিরাম ঢেউগুলোকে ফুটিয়ে তোলে,ফিওনা অস্থির হয়ে যায় ভেতরে ঢোকার পর, নিজের সত্তাকে সামলে রাখতে চেষ্টা করে।

জ্যাসপার তার নিজের সাম্রাজ্যের অধিপতি, অনায়াসে সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বসে। তার চোখে অলস তৃপ্তির ছাপ, অথচ প্রত্যেকটি পদক্ষেপের মধ্যেই লুকিয়ে আছে এক ধরনের তীক্ষ্ণ শক্তি ।সে ধীরে ধীরে ফিওনার দিকে তাকিয়ে নির্দেশ দেয়, সে ফিওনার প্রতিটি পদক্ষেপকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়।
“টেবিলে খাবার সাজিয়ে রাখো,” তার কণ্ঠে আদেশের সুর। ফিওনা তার কঠিন দৃষ্টির নীচে মাথা নিচু করে, একের পর এক পদ পরিবেশন করতে থাকে। হাঁড়ির ঢাকনা খুলে প্রতিটি খাবার টেবিলে রাখছে আর সেই সঙ্গে তার মনের ভেতরে ক্ষোভের স্রোত বয়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ আবার সেই কঠোর কণ্ঠ, “কি হলো? প্লেটে পরিবেশন করে দিচ্ছো না কেন?”

ফিওনার ভিতরটা কেঁপে ওঠে, কিন্তু সে তৎক্ষণাৎ নিজের অনুভূতি চেপে রেখে নিঃশব্দে চামচ হাতে নেয়। একে একে প্রতিটি খাবার প্লেটে তুলে দেয়। প্রতিটি পদ বেড়ে দিতে দিতে মনে মনে অসহায়ভাবে ভাবতে থাকে—জীবনে কখনোই নিজের হাতে কাউকে খাবার পরিবেশন করেনি। তাকে সবসময় পরিবেশন করা হয়েছে, আর আজ এই মনস্টারকে নিজে হাতে খাবার বেড়ে দিতে হচ্ছে! এ কী দিন এলো ফিওনার জীবনে!
তার আঙুলে খাবার স্পর্শ করছে, আর প্রতিটি স্পর্শে একটা বিদ্রুপের অনুভূতি জেগে উঠছে। এ এমন এক পরিস্থিতি যেখানে তার মর্যাদাবোধ আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে। কিন্তু সে জানে, এখানে তার প্রতিরোধের কোনো স্থান নেই।
খাবার পরিবেশন করার পর ফিওনা ধীরে ধীরে বলছিল, “আমি এবার যাই, আমি খাবার খাবো।”
জ্যাসপারের চোখে এক ধরনের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ঝিলিক দিয়ে উঠলো। তার কণ্ঠস্বর আগের মতোই কঠোর, “আমি আদেশ দিয়েছি যেতে? আগে সবগুলো খাবার টেস্ট করবো, তারপরই যাওয়ার অনুমতি পাবে।”
ফিওনা কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। তার হৃদপিণ্ড দ্রুত ধুকপুক করতে লাগলো, তবে সে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না।

জ্যাসপার চামচ হাতে নিলো, ফিওনার রান্না করা খাবারের দিকে মনোযোগ দিলো। প্রথম এক চামচ মুখে তোলার পরপরই, সে তৎক্ষণাৎ থু মেরে খাবার ছিটকে ফেলে দিলো। তার মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠলো।
একটা নয়, একের পর এক খাবার পরীক্ষা করে দেখছে সে। প্রতিটিই মুখে তুলে ফেলেই ছিটিয়ে ফেলছে। জ্যাসপারের চোখে বিরক্তি ক্রমশ বাড়ছে।
“এসব কী রান্না করেছো?” তার কণ্ঠে ঝরে পড়লো তীব্র অপমান। “এগুলো কোনো খাবার? এগুলো খাওয়া যায়?”
ফিওনা অপমানে মাটির দিকে তাকিয়ে রইলো। সে জানতো রান্নাটা ভালো হয়নি, কিন্তু এইভাবে প্রত্যাখ্যান করা, এ যেনো তার আত্মসম্মানের ওপর সরাসরি আঘাত। জ্যাসপারের বিদ্রূপাত্মক কথাগুলো তাকে তীরের মতো বিদ্ধ করছে।

ফিওনার কণ্ঠে ক্ষোভ হতাশা একত্রিত হয়ে বেরিয়ে এলো, “আমি তো আগেই বলেছি, আমি কোনোদিন রান্না তো দূর, কিচেনের চেহারাও অব্দি দেখিনি। আমার গ্র্যান্ডপা আমাকে এক গ্লাস পানি পর্যন্ত ঢেলে খেতে দেয়নি।”
জ্যাসপার একেবারে শান্ত, কিন্তু তার কথাগুলোর মধ্যে তীব্রতা ছিল। “শোনো, তোমার বাড়িতে তুমি কিভাবে ছিলে না ছিলে, এটা আমার দেখায় বিষয় না। তুমি এখন আমার হাউজে বন্দি হয়ে আছো। আমার সার্ভেন্ট হিসেবে তোমাকে রেখেছি, তাই আমি যা বলবো, যেভাবে বলবো, সেভাবেই থাকবে।”
তার কণ্ঠের কঠোরতা ফিওনাকে আরও বেশি অসহায় মনে করিয়ে দিলো।
“আর এসব খাবার খাওয়া সম্ভব নয়। যাও, এখনই নিয়ে যাও এসব। অন্য ব্যবস্থা করছি তোমার জন্য। এখন চোখের সামনে থেকে নিয়ে যাও এসব ফালতু খাবার নিয়ে।”

জ্যাসপার সোফা থেকে উঠে দাঁড়ায়,তার উচ্চতা আর আধিপত্যপূর্ণ উপস্থিতি পুরো কক্ষকে ভরে দেয়। ফিওনার কাঁপা কাঁপা হাতে সবকিছু পুনরায় ট্রলিতে রাখতে শুরু করে। প্রতিটি পদক্ষেপে তার আত্মবিশ্বাসের ভেঙে পড়া স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তার মন কেমন করছে, সবকিছুই তার অক্ষমতার প্রতীক মনে হলো।
এতদূর এসে ফিওনা জানতে পারলো যে, তার চেষ্টা, তার পরিশ্রম—সবকিছুই অর্থহীন মনে হচ্ছে। সব খাবার আবারো ট্রলিতে তুলে নিতে নিতে, ফিওনা মনে মনে নিজেকে বললো, “এটাই আমার জীবন।”
ফিওনা খাবারের ট্রলি নিয়ে ততক্ষনাৎ বেরিয়ে যায় জ্যাসপারের কক্ষ থেকে। ফিওনা চলে যাওয়ার সাথে সাথেই জ্যাসপার মনে মনে ভাবে “এই বোকা মানবী মেয়েটা আসলে পারেটা কি? কিছুই পারে না!”—মনে মনে আওড়ায় জ্যাসপার,তার কণ্ঠে বিদ্রূপপূর্ণ স্বর ছিল।

ফিওনার বিদায়ের পরপরই, জ্যাসপার দ্রুত লিভিং রুমে প্রবেশ করে, সেখানে পৌঁছে দেখতে পায় কেউই খাবার স্পর্শ করেনি। পুরো কক্ষ জুড়ে খাবারের বিষাদময় গন্ধ ভাসছিল, যা তার ধৈর্যের শেষ সীমায় নিয়ে আসে। তার কঠোর দৃষ্টিতে চারপাশটা এক নিমেষে নির্জীব হয়ে ওঠে।সে ঠাণ্ডা কণ্ঠে আদেশ দেয়,
“থারিনিয়াস, শহর থেকে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি খাবার নিয়ে এসো। এ খাবার আমাদের খাওয়ার যোগ্য নয়।” থারিনিয়াস দ্রুত বেরিয়ে যায়, কোনো প্রতিক্রিয়া না জানিয়ে।
অন্যদিকে, জ্যাসপার হালকা পদক্ষেপে বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে যায়। তার লক্ষ্য গোপন ল্যাব, যেখানে শুধুমাত্র অল্প কয়েকজনের প্রবেশাধিকার রয়েছে। বাতাসে তার উপস্থিতি ধোঁয়ার কণার মতো মিলিয়ে যাচ্ছে। একাকী সে সিঁড়ি বেয়ে গুহার গভীর অংশে প্রবেশ করে। নিস্তব্ধতায় ভরা ল্যাবটি তাকে স্বাগত জানায়। সেখানে পৌঁছে সে ধীরে ধীরে স্টারলিংক ডিভাইসটি চালু করে।

ক্লান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে, সে ড্রাকোনিসের সাথে সংযোগ স্থাপন করে, “ড্রাকোনিস, যত দ্রুত সম্ভব পৃথিবীতে অ্যাকুয়ারাকে পাঠান,” কণ্ঠে দৃঢ়তা প্রকাশ পেলেও, মনের ভেতর অসহায়ত্বের সুর ছিল।
ড্রাকোনিসের কণ্ঠে অদ্ভুত জিজ্ঞাসা ভেসে আসে, “ওকে হঠাৎ কেনো দরকার?”
জ্যাসপার চোখ তুলে তাকায়, উত্তর দেওয়ার আগে একটা গাঢ় ভাবনায় ডুবে ছিল, “শহর থেকে খাবার আনাটা ক্রমশ ঝামেলার হয়ে উঠছে। থারিনিয়াসের বারবার শহরে যাওয়া আসা লক্ষ্য করলে, সাইন্টিস্টরা ঠিকই ধরতে পারবে যে সে একজন ড্রাগন। এ কারণেই অ্যাকুয়ারাকে চাই, ও রান্নার কাজটা দেখলেই নিরাপদ হবে।”
ড্রাকোনিস শ্বাস নিয়ে বলে, “ঠিক আছে, আজ রাতের মধ্যেই ওকে পাঠাবো।”
ড্রাকোনিস নিরুত্তর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে, তারপর জিজ্ঞাসা করে, “আর এথিরিয়নের কি খবর?”
জ্যাসপারের কণ্ঠ এবার আশ্বাসের ছোঁয়া পেল, “আপনি আমার ওপর ভরসা রাখুন। ওকে মুক্ত করতে একটু সময় লাগবে।”

“ঠিক আছে, মাই সান! সাবধানে থাকবে, আর মানবদের কোনোরকম ক্ষতি যেন না হয়, সেটাও মনে রেখো,” ড্রাকোনিসের কণ্ঠে পিতৃসুলভ কড়া আদেশ আর ভালোবাসা মিশে ছিল।
জ্যাসপার ধীর চোখে ড্রাকোনিসের কথার প্রতি সম্মতি জানালেও, কোনো বাক্য না বলে, চুপচাপ ভিডিও কলটি কেটে দেয়। মনে এক অজানা আশঙ্কা—কিছু কঠিন সিদ্ধান্তের ভার প্রতিনিয়ত তার বুকের পাথরকে আরও ভারী করে তুলছে।
জ্যাসপার গ্লাস হাউজে ফিরে আসতেই এক প্রকার বিরক্তির সঙ্গে লক্ষ্য করলো, লিভিং রুমে ইতিমধ্যে থারিনিয়াস খাবারের আয়োজন করে ফেলেছে। নীরব পরিবেশে তার প্রবেশের সাথেই লম্বা টেবিলে সাজানো রকমারি সুস্বাদু খাবারের দৃশ্য। সূক্ষ্ম কাঁচের বাসনে সাজানো মাংসের পদ, তাজা সবজি, আর মশলাদার সসের ঝাঁজ ছড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু তার ভাবনা সেই দৃশ্যপটকে একটুও আলোড়িত করতে পারেনি।
জ্যাসপার এক ঝটকায় মাথা ঝাঁকিয়ে আলবিরাকে আদেশ করে, “আমার খাবার কক্ষে পৌঁছে দাও।”
আলবিরা বিনয়ের সাথে এগিয়ে এসে প্রশ্ন করলো, “প্রিন্স অরিজিন, ওই মেয়েটার খাবার এখন দেবো?”
জ্যাসপার দৃষ্টিতে তীক্ষ্ণতা আর কঠোরতার ছোঁয়া, “কোন মেয়েটা? ফিওনা?” এক মুহূর্তের বিরতি নিয়ে ঠান্ডা কণ্ঠে পুনরায় বলল,”ওকে আমাদের আনা খাবার দেবে না। এটা আমার আদেশ। ওর করা বাজে রান্নাই ও খাবে। এটাই তার শাস্তি।”

বলে সে এক মুহূর্ত দেরি না করে, হনহন করে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে উঠে যায়, তার পায়ের নিচে সিঁড়ির কাঠগুলো বিদ্রোহের আগুনে ফুঁসে ওঠার অপেক্ষায় ছিল।
আলবিরা প্রিন্সের আদেশ পালনে নিষ্ঠার সাথে খাবারের ট্রে জ্যাসপারের কক্ষে পৌঁছে দেয়। তারপর শান্তভাবে নিচে নেমে ডাইনিং টেবিলে বসে পড়ে, রাজকীয় খাবারের অপেক্ষায়। একটু পরই ফিওনা লিভিং রুমে প্রবেশ করে। খাবারের টেবিল দেখে তার চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে। একপ্রকার তাড়াহুড়ো করেই সে টেবিলের সামনে চলে আসে, তার মুখে খিদের ছাপ স্পষ্ট।
“খাবার চলে এসেছে? আমার খাবার কোথায়?” ফিওনা অধীর হয়ে প্রশ্ন করে।

আলবিরার মুখে একরকম শীতল নিষ্ঠুরতার ছায়া পড়ে, “প্রিন্স আদেশ দিয়েছেন তোমাকে এখানের কোনো খাবার দেয়া হবে না । তোমার রান্না করা খাবারই তোমাকে খেতে হবে। যাও,কিচেন থেকে নিজের খাবার নিয়ে নাও।”
ফিওনা ভেঙে পড়ে অসহায়ভাবে। কাঁপা হাতে কিচেনের দিকে পা বাড়ায়। সে প্লেটে খাবার তুলে নেয়, তারপর ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নিজের রুমে উঠে আসে। বিছানায় বসে খাবার মুখে দেয়ার চেষ্টা করে।

আযদাহা সিজন ২ পর্ব ১৪

এক চামচ খাবার তুলতেই মুখের স্বাদে তার মুখ বিকৃত হয়ে যায়। খাবারের স্বাদ এতটাই কদর্য যে সে থু মেরে ফেলে দেয়। নিজের ওপর অসীম রাগ আর হতাশায় চরম বিরক্তি ধরে তার। “আমি কি সত্যিই এতোটা অযোগ্য?” নিজেকে প্রশ্ন করতে করতে সে এক চামচ খেতে গিয়েই বিরক্তিতে মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
তবু পেটের খিদের জ্বালায় কষ্ট করে আরও কয়েক চামচ গিলে ফেলে, গিলে নেয়া প্রতিটি খাদ্যকণা তার নিজের গ্লানিকে আরও গাঢ় করছে। খাবার গিলতে গিলতেই চোখের পানিতে ভেসে যায় সে, জলকণা তার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে, কিন্তু চুপচাপ, নিঃশব্দে।

আযদাহা সিজন ২ পর্ব ১৫