আযদাহা সিজন ২ পর্ব ১৫

আযদাহা সিজন ২ পর্ব ১৫
সাবিলা সাবি

দুদিন পেরিয়ে গেছে………
রাতের নিবিড় আঁধারে পৃথিবীর গাঢ় নিস্তব্ধতা ফিওনার ভেতরের শূন্যতাকে আরও প্রকট করে তুলছে। সে কাঁচের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে, নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাইরে। মনের গহীন কোণ থেকে তুলে আসে স্মৃতির ঝাপসা ছবিগুলো—গ্ৰান্ডপা, মিস ঝাং, লিয়া, লিন—সকলেই যেন একেকটা স্বপ্নের মতো অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
মিস ঝাং-এর রোগশয্যা আর গ্রান্ডপার উদ্বেগমাখা মুখ মনে পড়তেই বুকের ভেতর অচেনা এক শূন্যতা পেঁচিয়ে ধরে ফিওনাকে।

কাঁচের দেয়ালের ওপার থেকে আকাশ মন্থিত কালো মেঘের সমুদ্র; মেঘেরা ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে সারি ধরে, কোনো বাধা ছাড়া। দেয়ালটা না থাকলে বোধহয় হাত বাড়িয়ে ছুঁয়েই ফেলা যেত এই আকাশের মোহনীয় মেঘের পর্দা, ছুঁয়ে দেখা যেতো আকাশের অভ্রান্ত শূন্যতা।
হঠাৎই শুরু হয় ঝুমঝুম বৃষ্টি, মেঘগুলো তাদের ভারী বোঝা আর ধরে রাখতে পারেনি। এখানের আবহাওয়া এতটাই অপ্রত্যাশিত, কখনো মেঘ, কখনো বৃষ্টি,আবার কখনো উজ্জ্বল রোদ্দুর—এ যেন প্রকৃতির নিজস্ব এক খামখেয়ালি খেলা। ফিওনার মনে হয়, বাইরের প্রকৃতির বৈচিত্র্যের ভেতর সে নিজের বিক্ষিপ্ত মনকেই খুঁজে পায়। কিন্তু বাইরে যতই বৃষ্টির নির্মল সৌন্দর্য তার সামনে উপস্থিত হোক না কেন, তার ভেতরে জমে থাকা বিষন্নতার অন্ধকার কোনোভাবেই মিলিয়ে যায় না।
আচমকা সারা গ্লাস হাউজ ভূমিকম্পের মতো কেঁপে উঠল, বিশাল কিছু পাহাড়ের ওপর ধপাস করে আছড়ে পড়েছে। ফিওনার বুকের ভেতর আতঙ্কের স্রোত নেমে এলো; সে মূহুর্তে বোঝার চেষ্টা করল কিসের এমন প্রচণ্ড আওয়াজ, কিন্তু তার মনে কোনো ধারণাই এলো না।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

লিভিং রুমে জ্যাসপার, থারিনিয়াস, আর আলবিরা বসে গভীর আলোচনায় মগ্ন ছিলো। ঠিক তখনই হালকা পদশব্দে গ্লাস হাউজে প্রবেশ করল অ্যাকুয়ারা।
থারিনিয়াস সাড়া দিয়ে উঠল, “প্রিন্স অরিজিন,অ্যাকু তো এসে গেছে।”
জ্যাসপার তাকাল। শক্ত পাথরের মতো দৃষ্টি দিয়ে অ্যাকুয়ারাকে দেখলো, আর অ্যাকুয়ারা ধীরপায়ে এগিয়ে এসে সম্মান প্রদর্শন করল মাথা নুইয়ে।
“প্রিন্স অরিজিন,” অ্যাকুয়ারা বলল “আপনি আমাকে পৃথিবীতে ডেকে পাঠালেন হঠাৎ, কিং ড্রাকোনিস বললেন রান্নার কাজে আমাকে নিয়োজিত করতে চান?”
জ্যাসপার তার গভীর কণ্ঠে উত্তর দিল, “হ্যাঁ,অ্যাকুয়ারা।যতদিন আমরা পৃথিবীতে আছি, রান্নার দায়িত্ব তোমার উপর। তবে, একা নয়। এখানে আরেকজন আছে। তুমি কেবল রান্না করবে, আর বাকি সব কাজ—কাটা, ধোঁয়া, প্রস্তুতি—ওই মেয়েটা করবে।”

অ্যাকুয়ারা অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, “কার কথা বলছেন প্রিন্স?”
জ্যাসপার ঠাণ্ডা কণ্ঠে বলল, “আছে একজন বোকা,দুর্বল মানবী।”
“মানবী?” অ্যাকুয়ারা বিস্ময়ে ভ্রু কুঁচকে বলল, “এই হাউজে কোনো মানুষের আগমন?”
জ্যাসপার বিরক্ত চোখে তাকিয়ে বলল, “অ্যাকুয়ারা, বেশি কথা আর বেশি প্রশ্ন আমি একদম পছন্দ করি না। শুধু আমার আদেশ মেনে কাজ করো, বাকিটা নিয়ে চিন্তা করার প্রয়োজন নেই।”
অ্যাকুয়ারা মাথা নত করে সম্মতি জানালো, প্রিন্সের প্রতিটি কথা ছিল শিলালিপির মতো,অবিচল আর চূড়ান্ত।
জ্যাসপার গম্ভীর চেহারায় ধীর পায়ে উঠে দাঁড়াল। তার চোখ আলবিরার দিকে নিবদ্ধ। ঠাণ্ডা কণ্ঠে বলল, “আলবিরা, অ্যাকুয়ারাকে ওই মেয়েটার কক্ষে নিয়ে যাও। দেখিয়ে দাও তাকে, আর ওকে জানিয়ে দিও যে তার কাজ কি হবে আগামীকাল থেকে।”

জ্যাসপারের কণ্ঠে আদেশের কঠোরতা, যা কোনো প্রশ্নের অবকাশ রাখে না। এক মুহূর্তের জন্যও থেমে না থেকে, জ্যাসপার হনহন করে সরে গেল, কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে তার ব্যক্তিগত কক্ষে যাওয়ার জন্য।
জ্যাসপারের প্রতিটি পদক্ষেপ স্থির আর তার মুখের অভিব্যক্তি শীতল, নিঃশব্দে তুষারমণ্ডিত পাহাড়ের শীর্ষের মতো নিঃসংকোচ, যেখানে অনুভূতির কোনো চিহ্ন নেই, কেবল আদেশের শক্তিই বিদ্যমান।

মিস্টার চেন শিংয়ের চোখ পিটপিট করে খুলে এলো।ধূসর আলোর আভায় ধীরে ধীরে দৃষ্টিশক্তি ফিরে আসতে লাগল। সামনে যা দেখতে পাচ্ছে, তা অস্বচ্ছ, অস্পষ্ট। চেতনা ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই টের পেলেন, তাঁর শরীর শক্তভাবে চেয়ারের সঙ্গে বাঁধা,পায়ের নিচে মেঝের শীতলতা হাড় পর্যন্ত ঠাণ্ডা করে দিচ্ছে।তিনি শরীর ঝাঁকাতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু প্রতিটি ধাক্কায় বোঝা গেল, শিকলগুলো মজবুত, তার চারপাশে লোহার বেড়ি জড়িয়ে দিয়েছে কেউ। কক্ষটি অসীম খালি; সাদা দেয়ালের চারপাশে কোনো আসবাবপত্র নেই,মনে হচছ অন্তহীন শূন্যতার মধ্যেই আটকে পড়েছেন।

চেন শিং’র নিশ্বাস ভারী হয়ে এলো। তাঁর কপালে ঘাম জমেছে, কিন্তু তিনি কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না।শিকলগুলো এতটাই শক্ত,মনে হবে কোনো প্রাচীন কাল থেকে ওগুলো অস্তিত্বে আছে, অবিচল, অমোচনীয়।
মনের মধ্যে আচমকা সমস্ত ঘটনা ভেসে উঠল —ওয়াংলি প্রতারণা। বিশ্বাসঘাতকতা। প্রতিটি ভাবনা বিষের মতো প্রবাহিত হচ্ছে তার র*ক্তে। হঠাৎ করেই,তাঁর ধৈর্যের বাধ ভেঙে গেল। তিনি সশব্দে চিৎকার করে উঠলেন, “ওয়াং লি! বিশ্বাসঘাতক!বেইমান কোথায় তুই? সামনে আয়, দেখিয়ে যা তোকে!”
চেন শিং’র কণ্ঠ প্রতিধ্বনিত হলো শূন্য কক্ষে,মনে হলো একা বনের মাঝে দাঁড়িয়ে চিৎকার করছে। কিন্তু উত্তর এল না, কেবল নিঃশব্দের প্রতিধ্বনি। কক্ষের সাদা দেয়ালগুলো তার কান্নার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

ডক্টর লিউ ঝান ধীরে ধীরে চেন শিংয়ের বাড়ির দিকে এগিয়ে আসে, মনটা কিছুটা ভারাক্রান্ত। মিস্টার চেন শিংয়ের কাছ থেকে ফিওনার কোনো খোঁজ পেতে এসেছিলো। দরজায় কড়া নাড়লো, কিন্তু উত্তর এল না।বাড়ি খাঁ খাঁ করছে, কোনো মানুষের সাড়া নেই।কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ল্যাবের দিকে রওনা দিল। মনের মধ্যে শঙ্কার মেঘ জমাট বাঁধছে—এতক্ষণে দেখা হয়ে গেলো ওয়াং লির সাথে।
ওয়াং লি বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বলে উঠলেন, “একি, লিউ ঝান! তুমি এখানে?”
“গ্ৰান্ডপা!” লিউ ঝান কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে বললো, “আমি তো এসেছিলাম মিস্টার চেন শিংয়ের সাথে দেখা করতে, ফিওনার কোনো খোঁজ পেয়েছেন কিনা জানতে।”
ওয়াং লি এক মুহূর্ত থেমে বললেন, “ওহ,হ্যাঁ,পেয়েছে।”
লিউ ঝান উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,”সত্যি? কোথায় ফিওনা?”
ওয়াং লি কিছুটা স্থির কণ্ঠে বললেন, “ফিওনা একটা বিশেষ কাজে তার খালার বাসায় গিয়েছে হঠাৎ করেই।গ্রিসে। মিস্টার চেন শিংও ওখানে গেছেন কালকে, ফিওনাকে আনতে।”
লিউ ঝান কিছুটা স্তম্ভিত হলো,”ওহ! কিন্তু কোনো কিছু বললো না তো আমাকে মিস্টার চেন শিং। আর মিস ঝাং তো এখনো হাসপাতালে, তার কি হবে?”

ওয়াং লি কিছুটা নির্লিপ্তভাবে বললেন, “হয়তো চেন শিং সুযোগ পায়নি তোমাকে বলার। তুমি মিস ঝাংয়ের চিকিৎসা চালিয়ে যাও। চেন শিং আর ফিওনা দ্রুত ফিরে আসবে।”
লিউ ঝান মাথা নত করে বলল, “ঠিক আছে, গ্ৰান্ডপা। তবে…কেন জানি মনে শান্তি আসছে না।”
ওয়াং লি এক হালকা হাসি দিয়ে বললেন, “এটাই তো মানুষের জীবন, কিছু না কিছু বোধহয় সর্বদা আমাদের অস্থির করে রাখে।”
লিউ ঝান প্রস্থান করে, কিন্তু তার অন্তরে উদ্বেগের বীজ বপন করে দিয়ে যায় এই কথোপকথন। ফিওনার জন্য মনটা এখনো আনচান করছে। মুখের কথায় শান্তি আসছে না, যতক্ষণ না চোখে দেখে নিশ্চয়তা মেলে।
ফিওনা তখনও নিরাবেগ ভঙ্গিতে কাঁচের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে, বাইরের দৃশ্য তার চোখে যতটা স্থির, মনে ততটাই প্রগাঢ় নিঃসঙ্গতা।

আচমকা দরজা স্লাইডিংয়ের শব্দে খুলে গেল,কিন্তু ফিওনা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। নীরবতার মধ্যে কক্ষে প্রবেশ করলো আলবিরা, সঙ্গে আরেকজন।
আলবিরা কণ্ঠে একরকম তাচ্ছিল্যের সুর নিয়ে বলল “এই যে মেয়ে,বাইরে কি দেখছো এতক্ষণ ধরে?”
ফিওনা ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ালো, চোখে বিস্ময়। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক অপরিচিত মেয়ে—গায়ের রঙ তুষারের ন্যায় শুভ্র আর চুলের রং আকাশের মতো নীল, চোখে অতলান্ত মহাসাগরের গভীরতা। ফিওনা কিছুই বলতে পারল না,বাকশক্তি হারিয়ে গেছে।
আলবিরা ঠোঁট কামড়ে বিরক্তির ছাপ রেখে বলল, “শোনো মেয়ে, ও হচ্ছে অ্যাকুয়ারা, ড্রাগন সদস্য। ও এসেছে রান্নার জন্য। তবে মনে রেখো, রান্নার বাইরে সমস্ত কাজ তোমার দায়িত্ব। অ্যাকুয়ারা শুধুমাত্র রান্না করবে। আর যা পারো না, ও সব দেখিয়ে দেবে। এখন কি বোঝা গেছে?”

ফিওনা জবাব দিল না, মুখে কিছু বলার শক্তি কোথাও হারিয়ে ফেলেছে। আলবিরার চোখে বিরক্তি চেপে বসেছে, কিন্তু সে তা প্রকাশ করল না। কয়েক মুহূর্ত ফিওনার দিকে তাকিয়ে থেকে শেষে হালকা শ্বাস ফেলে বলল, “ঠিক আছে,অ্যাকুয়ারা, তুমি এবার এই মেয়েটাকে নিয়ে রাতের খাবারের আয়োজন শুরু করো।”
এটা বলেই আলবিরা ঘুরে দাঁড়ালো, নীরবে কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল।
ফিওনার চোখে প্রশ্ন, মনের অস্থিরতা বেড়ে গেল। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অ্যাকুয়ারা এই অজানা জীবনের নতুন অধ্যায়ের আরেকটি উপাখ্যান।

অ্যাকুয়ারা নিঃশব্দে ফিওনার সামনে এগিয়ে এসে দাঁড়ায়। তার মুখে অমায়িক হাসির আভাস।
“হাই! আমি অ্যাকুয়ারা, আকাশী ড্রাগন সদস্য। তোমার নাম কী?” তার কণ্ঠে একধরনের অদ্ভুত মাধুর্য ফুটে ওঠলো।
ফিওনা কিছুটা ইতস্তত করে বলল, “আমার নাম এলিসন ফিওনা।”
অ্যাকুয়ারার ঠোঁটের কোণে হাসি উঁকি দেয়। “বাহ,তোমার নামটা ঠিক তোমার মতোই সৌন্দর্যে ভরা।”
ফিওনা অবাক হয়ে যায়। এটাই প্রথমবার, যখন কোনো ড্রাগন তার সঙ্গে এতো কোমল আর স্নিগ্ধ ভাষায় কথা বলছে। একটু দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠে সে প্রশ্ন করে, “তুমি কি সত্যিই ড্রাগন?”
অ্যাকুয়ারা ঠোঁটের ওপর আঙুল রেখে খেলাচ্ছলে বলে, “তোমার কি সন্দেহ আছে?”
“না, কিন্তু এখানে আসার পর থেকে এতগুলো ড্রাগন দেখেছি, কেউ তো এত মিষ্টি করে কথা বলে না।”
অ্যাকুয়ারার চোখের তারায় একপ্রকার গভীর রহস্য জ্বলে ওঠে। সে ধীর কণ্ঠে উত্তর দেয়, “আসলে আমি অন্যদের চেয়ে ভিন্ন। আমাদের কয়েকজন ড্রাগনের মধ্যে মানুষের মতো আবেগ অনুভূতির ফাংশনটা অনেক বেশি সক্রিয়। এটাই আমাকে আলাদা করে তুলেছে।”

ফিওনার মনে একটু প্রশান্তি ঢেউ খেলে যায়।অবশেষে, কারো সঙ্গে কথা বলে শান্তি পাওয়ার মতো কাউকে পাওয়া গেল। সে মনে মনে চিন্তা করে,এই শীতল, নিঃসঙ্গ পরিবেশে এমন কারো উপস্থিতি সত্যিই স্বস্তি এনে দিল।
অ্যাকুয়ারার কথার মধ্যে ছিল এক প্রকার কোমল অভিজ্ঞান, যা তাকে অন্য সব ড্রাগনের চেয়ে আলাদা করে তুলেছিল।

অ্যাকুয়ারা ফিওনার দিকে একটু মৃদু হেসে বলে, “শোনো ফিও, আমার নামটা বেশ দীর্ঘ আর কঠিন, তাই না? তুমি আমাকে সংক্ষেপে অ্যাকু বলেই ডেকো। আর আমি তোমাকে ফিও বলে ডাকব, কেমন?”
ফিওনা মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। “ঠিক আছে, অ্যাকু।”
অ্যাকুয়ারা তার চিরচেনা অমায়িক হাসিটি আরও প্রসারিত করে বলে, “আচ্ছা তাহলে, চলো রাতের খাবারের আয়োজন করি। তারপর রাতে তোমার সঙ্গে একটু আড্ডা দেওয়া যাবে।”
ফিওনা কোনো কথা না বাড়িয়ে অ্যাকুয়ারার পিছু পিছু হাঁটতে থাকে। অ্যাকুয়ারা,যে অন্য ড্রাগনদের মতো নির্ভীক আর তীক্ষ্ণ হলেও, তার ব্যবহারে এক ধরনের মনোহর স্নিগ্ধতা লুকিয়ে ছিল, যা ফিওনাকে অল্প সময়েই টানতে সক্ষম হয়েছে।

দুজন একসঙ্গে নিচে, কিচেনের দিকে ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে যায়। এই নির্জন পর্বতের শীর্ষে, গ্লাস হাউজের শীতল নিস্তব্ধতার ভেতরে, তাদের পায়ের নিচের কাঠের মেঝেতে প্রতিটি পদক্ষেপ এক ধরনের সঙ্গীত হয়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল।
রাতের নীরবতা ভেদ করে রান্নাঘরে প্রবেশ করা মাত্রই,কক্ষটি কিছুটা উষ্ণতা লাভ করে। ফিওনার মনেও ধীরে ধীরে একপ্রকার স্বস্তির বাতাস বইতে শুরু করে। তাদের সামনে রাতের খাবারের আয়োজন অপেক্ষা করছে, আর রাতের গভীরে জমে উঠবে এক নতুন বন্ধনের গল্প।
ফিওনা তখন নিঃশব্দে সবজি আর মাছ কাটতে ব্যস্ত, আর অ্যাকুয়ারা রান্না করার জন্য মৃদু উত্তাপের মধ্যে পাতিলে মনোযোগী।
ফিওনা ধীরে ধীরে অ্যাকুয়ারার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, “আচ্ছা অ্যাকু, তোমরা ড্রাগনরা এত খাবার খাও? এই ধরনের পরিমাণ কীভাবে সম্ভব?”
অ্যাকুয়ারা মৃদু হাসি হেসে বলে, “হ্যাঁ, আমাদের রাজ্যে আমরা সঠিক পরিমাণে খাই। তবে সেই খাবারের পুষ্টিমূল্য পৃথিবীর তুলনায় অনেক বেশি। আমাদের এক প্লেট খাবারে যে পুষ্টি থাকে, তা পৃথিবীর দশ পাতিল খাবারের চেয়ে বেশি শক্তিশালী।”

ফিওনার মস্তিষ্কে তখন একটা ধাক্কা লেগে যায়।
পৃথিবীর খাবার? সে একমুহূর্ত চুপ থেকে আবার প্রশ্ন করে, “পৃথিবীর খাবার? তোমাদের রাজ্য বলতে তুমি কোন রাজ্যের কথা বলছ? পৃথিবী তোমাদের রাজ্য নয়?”
অ্যাকুয়ারা তখন ফিওনার দিকে তাকিয়ে একটু মৃদু বিরক্তি নিয়ে বলে, “বোকা মেয়ে, তুমি কি বলছ? পৃথিবী থেকে তো ড্রাগন কবেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে।আমরা তো ভেনাস থেকে এসেছি।”
ফিওনার মুখ থেকে নিঃশব্দে একটা ছোটো শ্বাস বেরিয়ে আসে। তার চোখ বিস্ফোরক দৃষ্টিতে অ্যাকুয়ারার মুখের দিকে স্থির হয়ে আছে। হাত থেকে সবজি কাটার ছুরি পড়ে যায় ফ্লোরে। শব্দটি রান্নাঘরের নির্জনতাকে ভেঙে দেয়, আর ফিওনা মনে মনে দুলে ওঠে। এই নতুন সত্য তার সমগ্র বিশ্বাসকাঠামোকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছিল।
ফিওনার ঠোঁট কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে এলো একটি প্রশ্ন,গলার স্বর একেবারে শীতল, “তোমরা সবাই ভেনাস থেকে এসেছো?”

অ্যাকুয়ারা নির্দ্বিধায় বললো, “হ্যাঁ,পুরো ভেনাসটাই ড্রাগনের রাজ্য।”
ফিওনার শরীরজুড়ে বিদ্যুতের মতো কেঁপে উঠল।ভেনাস—যে গ্রহের দিকে সে ছোটবেলা থেকে অপার মুগ্ধতায় চেয়ে থেকেছে, সেই উজ্জ্বল, নক্ষত্রময় স্বপ্নের জগত। অথচ এখন, অ্যাকুয়ারার মুখ থেকে বেরিয়ে আসা এই নির্মম সত্য সেই স্বপ্নকে কঠিন বাস্তবতার শিকলে বন্দী করে ফেলছে। ভেনাস—যেখানে সে কল্পনা করতো শান্তি, সৌন্দর্য আর অপার্থিব আলোর উপস্থিতি, সেখানে জ্যাসপারের মতো ফায়ার মনস্টারদের রাজত্ব?
ফিওনা আবারও কাঁপা গলায় প্রশ্ন করল,“তাহলে তোমরা পৃথিবীতে কেন এসেছো?”
অ্যাকুয়ারা গভীর এক নিঃশ্বাস নিল, প্রাচীন এক ইতিহাস বয়ে আনলো তার মনে। “কারণ আমাদের প্রিন্সের ভাই, আমাদের আরেক ড্রাগন সদস্য এথিরিয়নকে পৃথিবীর কোনো এক বিজ্ঞানী ব*ন্দি করে রেখেছে। তাকে উ’দ্ধার করতেই আমরা এসেছি।”

এই কথা শুনে ফিওনার মনের ভেতর গভীর এক চিন্তার ঢেউ উঠল। জ্যাসপার বারবার এই বন্দিত্বের কথা বলেছে, কিন্তু তার গ্ৰান্ডপা—বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী মিস্টার চেন শিং—এমন কাজ করতে পারেন? তার গ্ৰান্ডপা কখনোই এমন নিষ্ঠুর কাজ করবে না। নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে! হয়তো ওই ড্রাগন পৃথিবীর মানুষের ওপর আ’ক্রমণ চালিয়েছে, নয়তো এত বড় বিজ্ঞানী এমন কাজ করতে পারে না। ফিওনার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হলো না, কিন্তু একইসঙ্গে সন্দেহের বীজটাও মাথা চাড়া দিচ্ছে।
জ্যাসপার প্রতিবার বলেছে, “আমার ভাইকে মুক্ত করলেই, তোমার মুক্তি মিলবে।”

খাবারের প্রস্তুতির তুমুল ব্যস্ততার মধ্যে হঠাৎ করে কিচেনের প্রবেশপথে আলবিরার উপস্থিতি গম্ভীর এক ছায়া ফেলল। তার পদক্ষেপের শব্দ মেঝেতে ধ্বনিত হলো, আর চোখের এক কোণে ফিওনা দেখল তাকে, মুখে কঠোর এক নির্দেশের ভাব ফুটে উঠেছে।
“এই অ্যাকুয়ারা শোনো,” আলবিরার কণ্ঠ শীতল অথচ কর্তৃত্বপূর্ণ, “প্রিন্সের কফিটা তৈরি করে, ফিওনাকে দিয়ে পাঠাও।”
অ্যাকুয়ারা মাথা নত করল, তার চোখে অবিচল দৃঢ়তা। “হ্যাঁ, আলবিরা। আমি এক্ষনি কফি তৈরি করছি।”
ফিওনা তাকিয়ে রইল, প্রত্যেকের আচরণের মাঝে এক অদ্ভুত শৃঙ্খলা আর কঠোর নিয়মের ছাপ।
অ্যাকুয়ারার হাত দ্রুত, কফির বয়ামে নড়ে উঠল।

অ্যাকুয়ারা নিঃশব্দে একটা সসপ্যানে পানি গরম করতে দিলো, ধোঁয়া ধীরে ধীরে পাকিয়ে উঠতে শুরু করলো।অন্যদিকে সে দক্ষ হাতে সুমাত্রা কফি বিনগুলোকে কফি গ্ৰাউন্ডারে নিয়ে পিষতে লাগলো। বড় আকারের দানা গুলো ক্রমেই মিহি গুঁড়োয় পরিণত হলো, বিশেষ যত্নে এগুলো পিষা হচ্ছিলো।
ফিওনার দিকে তাকিয়ে অ্যাকুয়ারা বললো, “কফি মেকারে এগুলো দাও, ফিও। প্রিন্সের জন্য সুমাত্রা ডার্ক রোস্ট কফি তৈরি করো। এই সুমাত্রা কফি উনার প্রিয়।তবে মনে রেখো, দুধ দেবে, কিন্তু চিনি একদম না।”
ফিওনার তখন মনের গভীরে একটা পুরনো স্মৃতি জেগে উঠলো। সেই দিন, যখন জ্যাসপার তাকে নিয়ে কফি শপে গিয়েছিলো, ঠিক এই একই কফিটা অর্ডার করেছিলো। কিছুক্ষণ তার মন সেই দৃশ্যের স্মৃতিতে হারিয়ে গেলো।
“কি হলো ফিও?” অ্যাকুয়ারা কৌতূহলী দৃষ্টিতে প্রশ্ন করলো। “তাড়াতাড়ি করো, কফি মেকারে ঢালো এগুলো।”
ফিওনা ধীরে ধীরে কফি মেকারের সামনে চলে এলো।মনের ভেতরে অসহ্য একটা ভাবনা খেলা করছিলো—“কী ভয়ংকর গন্ধ! এটার মধ্যে আবার চিনি ছাড়া কিভাবে পান করে জ্যাসপার?” মনের সেই গোপন কথাগুলো আওড়াতে আওড়াতে সে কফিটা তৈরি করতে শুরু করলো।

ফিওনার হাতে কফির মগ, ধীরে ধীরে শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছে। সে স্থির দাঁড়িয়ে আছে, দৃষ্টিতে দ্বিধার ছাপ।
অ্যাকুয়ারা এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,”কি হলো, ফিও? দাঁড়িয়ে আছো কেনো? যাও, প্রিন্সের কক্ষে দিয়ে এসো কফিটা।”
ফিওনার কণ্ঠে অজান্তেই অনিচ্ছার আভাস ফুটে উঠলো। “আমাকে যেতে হবে?”
অ্যাকুয়ারা হালকা হাসি দিয়ে জবাব দিলো, “হ্যাঁ,আলবিরার কথা মনে নেই? আমার কাজ শুধু রান্না। আর প্রিন্সের আদেশকে আমি উপেক্ষা করতে পারবো না, ফিওনা। এটা তোমাকেই করতে হবে।”
ফিওনার বুকের ভেতর এক অজানা অস্থিরতা ছটফট করে উঠলো। জ্যাসপারের সামনে আবার যেতে হবে!সেই অগ্নিদৃষ্টি, সেই নির্দয় স্বর—যখনই তার সামনে গেছে, একরকম শাস্তির মতো মনে হয়েছে সবকিছু। কী জানি এবার কী অপেক্ষা করছে?

অ্যাকুয়ারা আবারও বললো,”কি হলো ফিওনা?এত ভাবছো কেনো?”
ফিওনা হালকা কাঁপা গলায় বললো,”না, কিছু না… যাচ্ছি।”
কফির মগটা শক্ত করে ধরে ফিওনা ধীরে ধীরে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে উঠলো। প্রতিটি পদক্ষেপে অজানা শঙ্কার মেঘ জমতে থাকলো। করিডোরটা সুনসান, নিঃশব্দ। ফিওনার পায়ের আওয়াজই এ খাঁ-খাঁ নির্জনতার মধ্যে সবচেয়ে কর্কশ শব্দ হয়ে উঠছিল।
ফিওনা জ্যাসপারের কক্ষের সামনে এসে দাঁড়াল। মনে হচ্ছিল,এটাই তার জীবনের সবচেয়ে অস্বস্তিকর মুহূর্ত—কিভাবে ভেতরে প্রবেশ করবে, সে নিজেই জানে না।দরজায় নক করার সাহস তার নেই,অথচ দরজাটিও অদৃশ্য স্বপ্নের মতোই গায়েব হয়ে আছে।

হঠাৎই, কোনো জাদুর ছোঁয়ায়, স্লাইডিং দরজাটি আপনাআপনি খুলে গেল। চোখের সামনে উন্মোচিত হলো জ্যাসপারের কক্ষ, যার দেয়ালগুলো কাচের মতো স্বচ্ছ আর পোক্ত।
অন্যপক্ষে, জ্যাসপার দাঁড়িয়ে ছিলো কাঁচের দেয়ালের সামনে উল্টো দিকে ঘুরে। যখন ফিওনা কক্ষের সামনে পৌঁছালো, ঠিক তখনই তার উপস্থিতির সংকেত এল জ্যাসপারের কাছে। ভেতর থেকে জ্যাসপার ফিওনাকে দেখে নিলো—এই কক্ষের ভেতর থেকে বাইরের দৃশ্য সবসময় পরিষ্কার।
ফিওনার কাঁপা হাতে ধীরে ধীরে কক্ষের ভেতরে প্রবেশ করলো। প্রতি পদক্ষেপে তার হৃদস্পন্দন দ্রুত গতিতে বাজতে লাগলো।
জ্যাসপার তাখনো উল্টোদিকে ঘুরে দাঁড়ানো।

ফিওনা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “আপনার কফি নিয়ে এসেছি।”
জ্যাসপার,তার কণ্ঠস্বর ঠান্ডা কাচের মতো অদৃশ্য প্রাচীরের পিছনে লুকিয়ে ছিল। “টেবিলের ওপর কফি রেখে চলে যাও,” সে নির্দেশ দিলো।
ফিওনা, যদিও তাঁর নির্দেশ মেনে কফির মগ টেবিলের ওপর রাখল, কিন্তু সে সেখানে থেকে গেল—সাহস সংগ্রহ করে, সে একক প্রচেষ্টায় প্রশ্ন করল, “বলছি,আমাকে আর কতদিন এখানে আটকে রাখবেন?”
জ্যাসপার এরূপ প্রশ্ন শুনে সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে তাকালো।প্যান্টের পকেটে দু হাত গুঁজে রাখা তাঁর ভঙ্গি ছিলো বাঘের, প্রস্তুত, কিন্তু কৌতূহল নিয়েও।

ফিওনার হৃদয়ে হালকা ভয় নাড়া দিল—ফিওনা বুঝতে পারলো, এখানে সে শুধুই এক প্যাচানো চাকা, যা জ্যাসপারের দুর্ভেদ্য খেলার অংশ।
কফির তীব্র গন্ধের মাঝে, তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকা ওই আগুনের মনস্টারের সম্মুখীন হতে, ফিওনার মনে নানা প্রশ্নের কুয়াশা ছিল। কিন্তু, সেই ভয়ানক অনুভূতির মধ্যে, সে আশাও খুঁজছিল—একটি সম্ভাবনা, যা হয়তো তাকে মুক্তির দিকে নিয়ে যাবে।
জ্যাসপারের কঠোর গলার আওয়াজ ঘুরে ফিরে অন্ধকারের মাঝে প্রতিধ্বনিত হলো। “তোমাকে আমি আদেশ করেছি, কফি রেখে চলে যেতে, অযথা প্রশ্ন করতে নয়।” তার কথায় ছিল শাসকের নির্দেশ, এক অমোঘ আইন যা ভঙ্গ করা যায় না।

ফিওনার মনে এক চাপা বিরক্তি উদিত হলো। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো ,“আচ্ছা,আজব! আমাকে আটকে রেখেছেন। আর আমি তা প্রশ্ন করবো না। মানে, আমার এখানে থাকতে খুব শখ লাগছে? মনে হচ্ছে আমি পাহাড়ের বনভোজনের জন্য এসেছি, প্রশ্ন করতে নয়, বরং এ-সব কিছু উপভোগ করতে!”
ফিওনার কণ্ঠস্বরের তীব্রতা পাহাড়ের শীর্ষ থেকে অবতীর্ণ এক ঝরনার মতো,বিস্ফোরক আর প্রবাহিত।
“কতবার বলবো, যেদিন তোমার নানা আমার ভাইকে মুক্তি দিবে, সেদিন তুমি মুক্তি পাবে। তার আগে নয়,” জ্যাসপার তার গম্ভীর কণ্ঠে চূড়ান্ত ঘোষণা দিলো। একটা নিষেধাজ্ঞা যা অমান্য করা যাবে না।
“দেখুন, যদি সত্যিই আপনার ভাইকে আমার গ্রান্ডপা আটকে রাখে,” ফিওনা কিছুটা আবেগপূর্ণ কণ্ঠে বললো, “আমি তাকে অনুরোধ করবো। আমার গ্রান্ডপা আমার কথা রাখবে। আমি জানি, প্লিজ, আমাকে দিয়ে আসুন আমার বাড়িতে। আমি নিজে আপনার ভাইকে উদ্ধার করে দিবো, কথা দিচ্ছি।”
জ্যাসপার তার কথায় বিদ্রূপ হাসি ফুটিয়ে তুললো। ফিওনার কথাগুলো তার কাছে শুধুই বাচ্চাদের কল্পনা মনজ হলো।

আযদাহা সিজন ২ পর্ব ১৪

জ্যাসপার এক পা দু পা করে ধীরে ধীরে ফিওনার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। তার প্রত্যেক পদক্ষেপ অন্ধকারের গহ্বরে একটি নতুন আতঙ্কের জন্ম দিচ্ছিল।
ফিওনার হৃদয়ের ধুকপুকানি বাড়তে লাগল। ভয়ের অনুভূতি তাকে গ্রাস করছিল। ফিওন সমান তালে এক পা দু পা করে পিছিয়ে যেতে যেতে এক পর্যায়ে কাঁচের দেয়ালে এসে ঠেকে গেল। তার পিঠের সাথে দেয়ালটি এক শীতল ও শ্বাসরুদ্ধকর বন্ধন তৈরি করছিল,এই মুহূর্তে সে বুঝতে পারলো এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসা তার জন্য কতটা কঠিন।

আযদাহা সিজন ২ পর্ব ১৬