আযদাহা সিজন ২ পর্ব ৪

আযদাহা সিজন ২ পর্ব ৪
সাবিলা সাবি

ড্রাকোনিসের রাজকীয় চেম্বারে এক অদ্ভুত নীরবতা বিরাজ করছিল।গাঢ় সবুজ সিল্কের পর্দাগুলো ভারী বাতাসে অল্প দুলছিল,আর মেঝের মোহনীয় কারুকাজ যেন সেই স্থবির পরিবেশকে আরও রহস্যময় করে তুলছিল।দুইদিন পর জ্যাসপারকে অবশেষে মুক্তি দেওয়া হলো,তবে তাকে ড্রাকোনিসের সামনে ডেকে আনা হলো।
জ্যাসপার দাঁড়িয়ে ছিল দৃঢ় আর গম্ভীরভাবে।তার অলিভ গ্রিন চোখে ছিল অব্যক্ত ক্রোধ আর বিভ্রান্তি।ড্রাকোনিস,এক হাতে সিংহাসনের পাশে রাখা অজস্র পুঁথির মধ্যে একটি তুলে নিয়ে পড়ছিলেন।তার লম্বা,শীতল চেহারায় কোনো বিশেষ ভাব প্রকাশ পাচ্ছিল না।

“জ্যাসপার মাই সান!ড্রাকোনিস ধীর অথচ গভীর কণ্ঠে শুরু করলেন,”তুমি জানো,তোমার শক্তি শুধু তোমার নয়।এটা আমাদের পুরো রাজ্যের ভবিষ্যৎ।তুমি শুধু ভেনাসের একটা রাজ্যর প্রিন্স নও,তুমি গোটা ভেনাসের প্রিন্স!কিন্তু যে পথ তুমি বেছে নিয়েছিলে,তা আমাদের সমস্ত কিছু ধ্বং*স করতে পারতো।”
জ্যাসপার কথা বলার জন্য মুখ খুলতে চাইলেও ড্রাকোনিস তাকে হাত তুলে থামিয়ে দিলেন।
“শুনো,জ্যাসপার,”ড্রাকোনিস কঠোর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বললেন। “আমি জানি,তুমি ফিওনার প্রতি দুর্বল ছিলে।কিন্তু এই দুর্বলতা,এই ভালোবাসা তোমার এবং তার উভয়ের জন্যই বিপদ।তুমি ফিওনার স্মৃতি মুছে দিয়েছো।সে তোমাকে আর মনে রাখেনি,আর তার জন্য এটাই শ্রেষ্ঠ।তার জীবন এখন অন্য পথে এগোবে।”
জ্যাসপার শ্বাসরুদ্ধ অবস্থা নিয়ে ড্রাকোনিসের কথা শুনছিল।তার মুষ্টি শক্ত হয়ে উঠল,কিন্তু সে কিছু বলার মতো ভাষা খুঁজে পাচ্ছিল না।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ড্রাকোনিস তার আসন থেকে উঠে দাঁড়ালেন।তার লম্বা চেহারা যেন এক পর্বতের মতো দৃঢ় আর অপরাজেয়।তিনি ধীরে ধীরে জ্যাসপারের দিকে এগিয়ে এলেন।
“জ্যাসপার,ফিওনার জন্য একটা জীবন ঠিক করা হয়েছে।তার গ্ৰান্ডফাদার,চেন শিং,নিশ্চিত করেছেন যেহেতু এই বিয়েটা তার মঙ্গলের জন্য সঠিক।তুমি এটা মেনে নিতে পারো,বা না পারো,কিন্তু আমার সম্মান তোমার হাতে।তুমি জানো,ভেনাসের রাজা হিসেবে আমি যদি নিজের কথা রাখতে না পারি,‌তাহলে এই রাজ্যের ভরসা ভেঙে যাবে।রাজা জারেনের কাছে আমি কথা দিয়ে ফেলেছি যে তুমি অ্যালিসাকে বিয়ে করবে।”
ড্রাকোনিস থেমে এক মুহূর্তের জন্য জ্যাসপারের দিকে তাকালেন।তার চোখের গভীরতা থেকে ছড়িয়ে পড়ছিল এমন এক শক্তি যা জ্যাসপারকে স্তব্ধ করে রেখেছিল।

“যদি তুমি আমার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করো,মাই সান!তাহলে আমার সম্মান থাকবে না।রাজ্যের ভবিষ্যৎও অন্ধকারে তলিয়ে যাবে।আমি তোমাকে এ কথা জানিয়ে দিচ্ছি—যদি তুমি এই সিদ্ধান্ত না মানো,তবে আমি নিজেকে সবার কাছ থেকে আড়াল করে ফেলবো,আমাকে আর খুঁজে পাবেনা।”
ড্রাকোনিস তার কথার পর আর কিছু বললেন না।তিনি হনহন করে কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলেন,জ্যাসপারকে একা রেখে।
জ্যাসপার সেখানে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো।তার মনের মধ্যে যেন যুদ্ধ চলছিল।তার চারপাশে অন্ধকার ঘনীভূত হচ্ছিল,আর একমাত্র যা শোনা যাচ্ছিল তা ছিল তার নিজের ধুকপুক করা হৃদস্পন্দনের শব্দ।
“কেন আমার জীবনটা এমন হলো?কেনো সবকিছু আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে হচ্ছে?” জ্যাসপার ফিসফিস করে বলল,যেন নিজেকেই প্রশ্ন করছে।তার চোখে এক ফোঁটা অশ্রু চকচক করে উঠল,কিন্তু সে দ্রুত সেটাকে মুছে ফেলল।
তবুও,তার মনে একটি প্রশ্ন ক্রমাগত ফিরে আসছিল—ফিওনার জন্য সত্যিই কি এটাই সঠিক?

ফ্লোরাস রাজ্যের বাতাস যেন দিন দিন ভারী হয়ে উঠছে।রাজপ্রাসাদের সাদা পাথরের দেয়ালগুলোও যেন চাপা উত্তেজনা আর গুঞ্জনের প্রতিধ্বনি করছে।রাজা জারেনের দরবারে সেদিন আর দশটা দিনের মতো শান্ত কিছুই ছিল না।কারণ একটিমাত্র খবর পুরো রাজ্যে ঝড় তুলে দিয়েছে—ফিওনা লিয়ারার সন্তান।
রাজপরিবারের অন্দরমহলে শোক আর বিস্ময়ের এক অদ্ভুত মিশ্রণ।যে লিয়ারাকে এতদিন বন্দি করে রাখা হয়েছিলো যার সন্তান পৃথিবীর এক কোনে হারিয়ে গিয়েছিলো।তার র*ক্ত আজ নতুন করে জীবিত হয়ে ফিরে এসেছে।ফিওনার নাম যখন প্রথম শোনা গেল,পুরো দরবারের মানুষের মধ্যে তখন চাপা কৌতূহল জেগে উঠেছিল।কে এই মেয়ে?কীভাবে লিয়ারার র*ক্তধারায় সে এসেছে?

কিন্তু ফিওনার আসল পরিচয় জানার পর,সবাই বিস্ময়ে হতবাক।তার চেহারায় এমন কিছু ছিল,যা এক লহমায় অ্যালিসা আর সিলভার মনে ঝড় তুলেছিল।সেই চোখ… সেই নরম মুখের অবয়ব…যেন কোথাও আগে দেখা।তারা অবিশ্বাসের সঙ্গে একে অপরের দিকে তাকালো।
অ্যালিসা এক ঝটকায় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।তার হৃৎপিণ্ড দ্রুত গতিতে ধুকপুক করতে লাগল।”এটা কিভাবে সম্ভব?” তার ঠোঁট থেকে ফিসফিস করে বের হলো।
সিলভা একটু পেছনে সরে দাঁড়াল।তার চিবুক শক্ত হয়ে গেল,চোখে রাগ আর বিভ্রান্তির মিশ্রণ। “অ্যালিসা আপু,” সিলভা চাপা গলায় বলল,”এটা কি আমাদের স্বপ্ন নাকি বাস্তব?ফিওনা কিভাবে ফুপির মেয়ে হতে পারে?সে তো মানুষ ছিল,তাই না?কিন্তু এখন…”
ফিওনা তখনও বুঝতে পারছে না কেন এই দুইজন তাকে এমনভাবে দেখছে।অ্যালিসা আর সিলভাকে দেখে ফিওনার ভেতরেও এক অদ্ভুত অস্বস্তি কাজ করল।মনে হচ্ছিল,তাদের চেহারাগুলো খুব পরিচিত,কিন্তু কোথায় দেখেছে তা মনে পড়ছিল না।

অন্যদিকে,রাজা জারেন এখনও পুরো বিষয়টি জানতে পারেননি।তার ধারণা,ফিওনা শুধুমাত্র পৃথিবীর একটি সাধারণ মেয়ে ছিলো,যে এতদিন মানবী ছিলো হঠাৎ ড্রাগন হয়ে ফিরে এসেছে।কিন্তু তিনি কখনোই জানাতেন না ফিওনার সাথে ভেনাসের প্রিন্স যার সাথে তার একমাত্র কন্যার বিবাহ ঠিক করা সেই জ্যাসপারের সাথে ফিওনার একটা সম্পর্ক ছিলো।
অ্যালিসা গলা পরিষ্কার করে ফিওনার দিকে এগিয়ে গেল।তার ঠোঁটে এক ধরনের রুক্ষ হাসি ফুটে উঠল। “তোমার নাম ফিওনা,তাই না?”
ফিওনা মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।
“তুমি কি জানো,তুমি আসলে কে?বা পৃথিবীতে কোথায় ছিলে?”অ্যালিসার গলায় এক ধরনের তীক্ষ্ণতা ছিল, যেন প্রতিটি শব্দ দিয়ে সে ফিওনাকে আ*ঘাত করতে চাইছে।
ফিওনা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,”আমি পৃথিবীর চীনে বড় হয়ে হয়েছি‌।একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে তবে আমি এখন আর আগের মতো নেই।এটা আমি জানি, এর বাইরে আর কিছু আমি জানিনা,আমি শুধু ভেনাসে আমার জায়গা খুঁজতে এসেছিলাম।”

সিলভা হঠাৎই ঠোঁট কামড়ে হাসল।”তোমার জায়গা খুঁজতে?তুমি জানোও না তুমি কত বড় রহস্য নিয়ে এসেছো।”
ফিওনা আরও বিভ্রান্ত হলো।তার মনে হলো,এই দুই নারীর সঙ্গে তার কোনো অদৃশ্য সংযোগ আছে।কিন্তু সেই সংযোগের মানে সে নিজেও জানে না।
অন্যদিকে,অ্যালিসা আর সিলভা দু’জনেই ভালো করে জানে—ফিওনা যদি আসল সত্য জানতে পারে,তবে তার জীবন কখনও আর আগের মতো থাকবে না।আর সেই সত্যের মধ্যেই লুকিয়ে আছে জ্যাসপার,যার নাম তারা এখনো ফিওনার সামনে উচ্চারণ করেনি।
রাজা জারেন যখন দরবারে প্রবেশ করলেন,সবাই চুপ হয়ে গেল।তিনি ফিওনার দিকে তাকালেন,তার চোখে গভীরতা এবং অনুরাগ।কিন্তু সেই দৃষ্টির আড়ালে লুকিয়ে ছিল একটি কঠিন সত্য।তিনি জানতেন,ফিওনাকে ভেনাসের সামনে পরিচয় করানোর পর তার জীবন আর কখনও আগের মতো স্বাভাবিক থাকবে না।
রাজপ্রাসাদের দরজার বাইরে তখনো বাতাস বয়ে চলেছে,কিন্তু ভেতরে যেন সময় থমকে দাঁড়িয়েছে।সবাই অপেক্ষায়—কখন ফিওনার আসল পরিচয়,তার অতীত,তার ভবিষ্যৎ আর তার হৃদয়ের গোপন কাহিনি প্রকাশ পাবে।

রাজা জারেন ধীরে ধীরে ফিওনার সামনে এসে দাঁড়ালেন।তার চোখে এক অদ্ভুত কোমলতা আর গভীরতা।ফিওনার দিকে তাকিয়ে তিনি এক দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লেন,যেন বহুদিনের এক গোপন কথা বলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
“ফিওনা,” তিনি মৃদু গলায় বললেন,“তুমি জানো আমি কে?আমি তোমার মামা—তোমার মা লিয়ারার ভাই। তুমি এই রাজ্যের অংশ,এই পরিবারের উত্তরাধিকার। কাল তোমার জীবনে এক নতুন অধ্যায় শুরু হবে।কাল ভেনাসের একমাত্র রাজকুমার আর রাজা আমাদের দরবারে আসবেন।তাদের সামনে তোমাকে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে।এই পরিচয় শুধুমাত্র তোমার নয়, আমাদের পুরো রাজ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।”
ফিওনা কিছুটা বিস্মিত হয়ে রাজা জারেনের দিকে তাকাল।তার মনের মধ্যে এক অদ্ভুত শূন্যতা। রাজকুমার?রাজা?এসব কি?তার জীবনে এমন কিছু তো কখনো ভাবেনি।সে ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল,যেন বোঝাতে চাইল যে সে কিছুই জানে না।

ঠিক তখনই অ্যালিসা একধাপ এগিয়ে এলো।তার ঠোঁটে এক ধরণের অদ্ভুত হাসি,যা মনের গভীরে লুকানো ঈর্ষাকে স্পষ্ট করল।“ফিওনা,তুমি কি জানো এই প্রিন্স কে?”
ফিওনা আবারও মাথা নেড়ে ‘না’ জানাল।তার চোখে বিস্ময় আর কৌতূহল।
অ্যালিসা আর সিলভা একে অপরের দিকে তাকাল। সিলভার চোখে এক মুহূর্তের জন্য বিভ্রান্তি ফুটে উঠল, কিন্তু অ্যালিসার মুখে এক ধরণের তৃপ্তি ঝরে পড়ল। “এত কিছু ঘটে গেছে,আর তুমি কিছুই মনে করতে পারছো না?”অ্যালিসার কণ্ঠে এক ধরণের তাচ্ছিল্য, যেন সে ফিওনার স্মৃতিভ্রংশে সন্তুষ্ট।
সিলভা তখন ফিসফিস করে বলল,“তাহলে কি ফিওনা সত্যিই সব ভুলে গেছে?নাকি…নাকি সে অভিনয় করছে?”
অ্যালিসার চোখ চকচক করে উঠল। “ভুলে গেলেই বরং ভালো।এবার প্রিন্সকে আর কেউ আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবে না।”

ফিওনা তাদের কথার কিছুই বুঝতে পারছিল না।সে স্রেফ তাদের দিকে তাকিয়ে রইল,যেন পুরো ব্যাপারটি তার কাছে অস্পষ্ট আর অবোধ্য।
অন্যদিকে,রাজা জারেন তাদের কথার দিকে খুব একটা মনোযোগ দিলেন না।তিনি ফিওনার দিকে স্নেহমাখা চোখে তাকিয়ে বললেন,“ফিওনা,কালকের জন্য প্রস্তুত হও।তোমার সামনে তোমার ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে। এই রাজ্যের ইতিহাসে তোমার জায়গা তৈরি হবে। সবকিছু বদলে যাবে,ফিওনা।সবকিছু।”
অ্যালিসা আর সিলভা দূর থেকে দেখছিল।অ্যালিসার চোখে তখন একটাই চিন্তা ঘুরছিল—জ্যাসপার আর ফিওনার মধ্যে যদি কিছু থেকে থাকে,তবে সেটা একেবারে মুছে গেছে।এবার প্রিন্সকে নিজের করে নেওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা।

রাত গভীর।ফিওনা একা বসে আছে রাজকীয় কক্ষের জানালার কাছে।বাইরে বিশাল ভেনাসের আকাশে তারার মেলা,কিন্তু তার মন পড়ে আছে দূর পৃথিবীতে।তার গলায় পৃথিবীর এক ছোট্ট লকেট যেটি তার গ্ৰান্ডপা তাকে জন্মদিনে উপহার দিয়েছিলেন।বারবার সেই লকেটের দিকে তাকিয়ে ফিওনার মনটা ভারী হয়ে আসছে।
গ্ৰান্ডপা,মিস ঝাং,তার চেনা গলি,পিকিং ইউনিভার্সিটির আঙিনা—লিন,লিয়া তার ফ্রেন্ড,সবকিছু যেন এক অদৃশ্য শূন্যতায় পরিণত হয়েছে।ফিওনার বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে।
ঠিক তখনই দরজা খোলার শব্দ হলো।ফিওনা জানালার দিকে পেছন ফিরে তাকাল।তার সামনে এসে দাঁড়ালেন এক অদ্ভুত মমতামাখা মুখ,লিয়ারা।তার মা।
লিয়ারা ধীরে ধীরে এগিয়ে এলেন,চোখে স্নেহের আলো। তিনি ফিওনার বিষণ্ণ মুখ দেখে থমকে গেলেন।“কি হয়েছে,ফিওনা?আমার ছোট্ট প্রিন্সেস,তুমি কি পৃথিবীর কথা মনে করছ?”

ফিওনা মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ জানাল।চোখের কোনায় জল চিকচিক করছিল।
লিয়ারা তার মেয়ে কাছে গিয়ে তার চুলে হাত বুলিয়ে দিলেন।সেই স্পর্শে ফিওনার মনে হলো যেন পৃথিবীর মাটির গন্ধ লেগে আছে।“আমার মেয়ে,আমি জানি তোমার মনের কতটা জুড়ে পৃথিবী রয়ে গেছে।তোমার গ্ৰান্ডপা,মিস ঝাং,তোমার ছোট ছোট মুহূর্তগুলো—সবকিছু।সেসব ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়।জানি তোমার মন খারাপ।”
লিয়ারা ধীরে ধীরে ফিওনাকে নিজের বুকে টেনে নিলেন।তার গলা ধরে ফিওনা ফিসফিস করে বলল,“মা,আমি ওদের সবাইকে খুব মিস করি।মনে হয় যেন আমি আমার জায়গা হারিয়ে ফেলেছি।”
লিয়ারার চোখে জল এসে গেল,কিন্তু তিনি মুখে তা প্রকাশ করলেন না।তিনি ফিওনার মাথায় আলতো করে চুমু খেয়ে বললেন,“তুমি যেখানেই থাকো না কেন,তোমার জায়গা কখনো হারাবে না,ফিওনা।পৃথিবীর সঙ্গে তোমার সম্পর্ক চিরকাল থাকবে।কিন্তু এখন তোমার জায়গা এখানেও আছে।এই রাজ্য তোমার অপেক্ষায় আছে।এই পথ কঠিন তবে আমি তোমার পাশে আছি।

ফিওনা মায়ের কথাগুলো শুনে এক ধরনের ভরসা অনুভব করল।তার বুকের ভেতর জমে থাকা কষ্ট একটু একটু করে যেন কমে আসছিল।সে মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।তার মনে হলো,এই মুহূর্তে সে যতদূরেই থাকুক তার মায়ের স্নেহ তাকে আগলে রাখবে,পৃথিবী থেকে দূরে হলেও,তার মা তার পাশে।আর সেটাই তার শক্তি।
লিয়ারা কিছুক্ষণ বাদে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায়।ফিওনা বিছানায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলো,চোখদুটো বন্ধ করে আধশোয়া হয়ে আছে।

তখনি কক্ষের বিশাল দরজা খুলে,এক ড্রাগন সার্ভেন্ট প্রবেশ করল।তার উচ্চতা অন্তত ছয় ফুট,শরীর ঢেকে আছে সোনালি বর্মে,যা হালকা আলোতেও ঝলমল করে উঠছে।তার পেছনে আরও দুইজন ড্রাগন-সার্ভেন্ট,যারা রাজকীয় মর্যাদার ভার বয়ে নিয়ে এসেছে।তাদের হাতে ধরা বিশাল একটি গাউন। গাউনটি এত বড় যে তারা তিনজন মিলে ধরে এসেছে। গাউনটির সিল্কি কাপড় যেনো নিজে থেকেই আলো ছড়ায়। চারপাশে সূক্ষ্ম হীরার কারুকাজ,আর তার উপরে নীলাভ সবুজ রঙের প্রাকৃতিক ড্রাগনপাখির পালক দিয়ে তৈরি নকশা।
ফিওনা বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইল।এত জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক সে আগে কখনো দেখেনি।“এটা কী?” ফিওনা অবাক গলায় বলল।

এই মুহূর্তে লিয়ারা কক্ষে প্রবেশ করলেন।তার মুখে শান্ত এক হাসি,যা সব উদ্বেগ মুছে দিতে সক্ষম।“এটা তোমার জন্য,লিটল প্রিন্সেস!কালকের জন্য তৈরি হতে হবে,তোমাকে আমাদের রাজ্যের ঐতিহ্যের অংশ হতে হবে।”
ফিওনা গাউনটির দিকে তাকিয়ে বলল,“মা,এটা তো অনেক ভারি!আমি কখনো এত বড় পোশাক পরিনি।আমি কি এটা সামলাতে পারব?”
লিয়ারা তার মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,“এটা তোমাকে শুধু দরবারে যাওয়ার সময় পরতে হবে।এখানে তুমি যেমন ইচ্ছা তেমন পোশাক পরতে পারো।আমাদের রাজ্য প্রাচীন ঐতিহ্য মেনে চলে,কিন্তু আমরা আধুনিক পৃথিবীর পোশাককেও গ্রহণ করেছি।তুমি চাইলেই চীনের ওয়েস্টার্ন পোশাকও পরতে পারো।”
ফিওনার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।“তাহলে কি আমি চীনের সেই পোশাকগুলো পরতে পারব?”
লিয়ারা মাথা নেড়ে বললেন,“হ্যাঁ,অবশ্যই।কিন্তু কালকের দিনের জন্য এই রাজকীয় পোশাকটাই তোমাকে পরতে হবে।এটা আমাদের রাজ্যের ঐতিহ্য।”
ফিওনা আর কিছু বলল না।তার চোখে রাজকীয় গাউনটির জাঁকজমক আর মায়ের কথার গাম্ভীর্য মিলে এক অনন্য অনুভূতি তৈরি করল।ভিতরে এক ধরনের সংকোচ থাকলেও সে বুঝতে পারল,এটাই তার নতুন জীবন,আর তাকে এটা মেনে নিতে হবে।

ফিওনা এবার তার কক্ষের ডান দিকের জানালার পাশে এসে দাড়ালো।এবার জানালার বাইরের দৃশ্য দেখে সে অবাক।আকাশে উড়ে বেড়ানো বিশাল ড্রাগনগুলো,দূর থেকে দেখা স্ফটিকের মতো উজ্জ্বল পাহাড়ের সারি,আর তার মাঝখানে ঝকঝকে শহরের জটিল স্থাপত্য।একটা অদ্ভুত বৈপরীত্য—যেন প্রাচীন কোনো রূপকথার রাজ্য আর ভবিষ্যতের কোনো মহাজাগতিক সভ্যতা এক হয়ে গেছে।
লিয়ারা তার মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন।তার চোখে গভীর মমতা,আর ঠোঁটে মৃদু হাসি।তিনি এসে ফিওনার পাশে দাঁড়ালেন।”বাহ্,তোমাকে তো বেশ মুগ্ধ মনে হচ্ছে লিটল প্রিন্সেস,” তিনি বললেন।
ফিওনা জানালার বাইরে তাকিয়ে বলল,”মা,এটা তো অবিশ্বাস্য!মনে হয় আমি কোনো রূপকথার রাজ্যে এসেছি।কিন্তু একই সাথে সবকিছু এত আধুনিক!আমি ভেবেছিলাম প্রাচীন রাজ্যগুলো হয় পুরনো,নয়তো আধুনিক শহরগুলো ঐতিহ্য ভুলে যায়।এখানে দুটো একসাথে কীভাবে সম্ভব?”

লিয়ারা একটু হেসে বললেন,”এটাই ভেনাসের বিশেষত্ব। আমরা আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্য,সংস্কৃতি আর রাজকীয় মর্যাদাকে ধরে রেখেছি,কারণ সেটাই আমাদের শিকড়।কিন্তু আমাদের শিকড়ের সাথে সাথে আমরা আকাশ ছোঁয়া প্রযুক্তি আর বিজ্ঞানে এগিয়ে গেছি।আমরা জানি,প্রাচীন আর আধুনিক—দুটোই একসাথে থাকতে পারে,যদি তুমি ভারসাম্য বজায় রাখতে পারো।”
ফিওনা মুগ্ধ হয়ে বলল,”কিন্তু কীভাবে মা?পৃথিবীতে এটা কেউ করে না।সেখানে পুরনো জিনিস ফেলে নতুন কিছু বানানো হয়।”
লিয়ারা তার মেয়েকে কাছে টেনে নিলেন।”পৃথিবী এখনও শিখছে,ফিওনা।আমাদের রাজ্য অনেক আগে থেকেই জেনেছে কীভাবে ঐতিহ্যকে সম্মান করে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে হয়।আমাদের প্রাসাদগুলো এখনও রাজাদের আমলের মতোই দেখতে,কিন্তু ভেতরে রয়েছে সবচেয়ে উন্নত প্রযুক্তি।স্ফটিকের দেয়াল,যা শক্তিশালী রশ্মি প্রতিরোধ করে, বা বিশাল ড্রাগনদের জন্য তৈরি আমাদের বিমানবন্দরগুলো।

তুমি কি জানো,আমাদের গবেষণাগারে এমন যন্ত্র আছে যা আমাদের আকাশের বাইরে অন্য গ্রহের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে দেয়?কিন্তু একই সাথে,আমরা আমাদের পোশাক,উৎসব আর রাজকীয় মর্যাদা ধরে রেখেছি।তোমার কালকের গাউন যেমন ঐতিহ্যের অংশ,তেমনি আমাদের প্রযুক্তি সেই ঐতিহ্যের রক্ষক।”
ফিওনা মুগ্ধ হয়ে তার মায়ের দিকে তাকাল।”এটা সত্যি অবিশ্বাস্য।আমার পৃথিবীর অভ্যাসের সাথে মানিয়ে নিতে একটু সময় লাগবে।”
লিয়ারা তার কপালে চুমু খেয়ে বললেন,”তুমি আমার মেয়ে।তুমি শুধু ভেনাসের নয়,পুরো মহাবিশ্বের প্রতিনিধিত্ব করবে একদিন।তোমাকে শুধু শিখতে হবে কীভাবে এই ঐতিহ্য আর আধুনিকতার ভারসাম্য রক্ষা করতে হয়।”
ফিওনা জানালার বাইরে উঁকি দিয়ে বিশাল এক ড্রাগনকে আকাশে উড়তে দেখে।সে মৃদু হেসে বলে,”আমি চেষ্টা করব,মা।”

সকালের আলোতেই ভেনাসের রাজপ্রাসাদ জুড়ে ব্যস্ততা শুরু হয়েছে।আজকের দিনটি বিশেষ,কারণ রাজ্যের সামনে ফিওনাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হবে।প্রাসাদ ভরে উঠেছে রঙিন পতাকা,ঝুলন্ত স্ফটিক প্রদীপ আর ফুলের সাজে। রাজ্যের এই ঐতিহ্যবাহী পরিবেশের মাঝেই আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া স্পষ্ট—আকাশে উড়ছে ড্রোন ক্যামেরা,যা পুরো অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করবে।
ফিওনার ঘরে সাজগোজ চলছে।বিশাল সোনালি গাউনটি তিনজন ড্রাগন সার্ভেন্ট মিলে ধরে রেখেছে।গাউনটির সাদা আর সোনার মিশ্রণে রাজকীয় অথচ নরম একটা আভা তৈরি হয়েছে।ফিওনার মুকুটটি তার মা লিয়ারার প্রিয় স্ফটিক দিয়ে তৈরি,যা আরও উজ্জ্বল দেখাচ্ছে।ফিওনা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের দিকে তাকিয়ে একবার ভাবল,“আমি কি সত্যিই এই ফ্লোরাস রাজ্যের প্রিন্সেস?”
লিয়ারা তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,“তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে ফিওনা।আজকে শুধু প্রাসাদ নয়,পুরো ভেনাস তোমাকে দেখে মুগ্ধ হবে।”
অন্যদিকে,রাজপ্রাসাদের বাইরে থেকে ঘোষণা এলো—ড্রাকোনিস,জ্যাসপার আর তার পুরো রাজ্যের সদস্যরা রওনা দিয়েছে।

ড্রাকোনিসের নির্দেশে আজকের অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছিল ভেনাসের রাজকীয় পাথরের গাড়ি।যদিও ড্রাগনরা আকাশে উড়তে পারে,তবে বিশেষ অনুষ্ঠানের গুরুত্ব প্রকাশের জন্য এমন ঐতিহ্যবাহী গাড়ির ব্যবহার করা হয়।গাড়িগুলো বিশাল আকারের এবং ভাস্কর্যের মতো নিখুঁত কারুকার্যে তৈরি।চকচকে কালো পাথরের ওপর সোনালি আর রূপার কারুকাজে লিপিবদ্ধ রাজ্যের ইতিহাস যেন চোখে পড়ে।
জ্যাসপার আর ড্রাকোনিস একটি বিশাল পাথরের প্রাইভেট কারে চড়ে ভেনাসের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ফ্লোরাস রাজ্যে রওনা দেয়।গাড়িটির ছাদ স্বচ্ছ স্ফটিক দিয়ে তৈরি,যার ভেতর থেকে আকাশের দৃশ্য দেখা যায়।গাড়ি চলতে চলতে তার চারপাশে হালকা সোনালি আলো বিচ্ছুরিত হতে থাকে।

ড্রাকোনিস একপাশে বসে হাত ভাঁজ করে জানালার বাইরে তাকিয়ে রয়েছেন।তার চেহারায় দৃঢ়তার ছাপ স্পষ্ট।অন্যদিকে,জ্যাসপার বসে আছে সাদা রঙের ব্লেজার সুট পরে,যা তার ব্যক্তিত্বকে আরও গম্ভীর ও আকর্ষণীয় করে তুলেছে।তার ব্লেজারের সাদা কাপড়ের ওপর সূক্ষ্ম রূপার সুতোয় জ্যোতির্বলয়ের মতো নকশা করা,যা পুরো ভেনাসের অভিজাততা প্রকাশ করে।কিন্তু তার চোখে-মুখে একধরনের দ্বিধা আর অজানা চিন্তা।
ড্রাকোনিস একসময় চুপ করে জ্যাসপারের দিকে তাকিয়ে বললেন,”তোমার এতো ভেবে লাভ নেই।আজকের দিনটা শুধু তোমার নয়,পুরো ভেনাসের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।মনে রাখো,রাজ্যের সম্মান সবকিছুর ওপরে।”
জ্যাসপার কোনো উত্তর দিল না।সে জানালার বাইরে পাথরের রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিল।রাস্তার দুই পাশে ঝুলছে লতা-পাতার সাজানো শৈল্পিক প্রদীপ,যেগুলো যেন রাস্তার সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।তাদের গাড়ির পেছনে একাধিক ড্রাগন গার্ডের গাড়ি,যেগুলো একই ধরনের পাথর দিয়ে তৈরি।
গাড়ি ধীরে ধীরে ফ্লোরাস প্রাসাদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। প্রাসাদ দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল—তার বিশাল প্রবেশদ্বার সোনালি আলোয় আলোকিত।জ্যাসপারের মন ভেঙে পড়ছিল প্রতিটি মুহূর্তে।সে জানতো,এই যাত্রা তার জীবনের মোড় পরিবর্তন করবে।

অবশেষে জ্যাসপাররা ফ্লোরাস প্রাসাদে প্রবেশ করল। প্রাসাদের বিশাল প্রবেশদ্বার জ্বলজ্বল করছিল সোনালি আর রূপালি আলোয়।প্রাসাদের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল রাজ্যের উচ্চপদস্থ ড্রাগন অভিজাতরা।ড্রাকোনিস ও জ্যাসপারকে রাজকীয় অভ্যর্থনা জানানো হলো।বিশাল সুরেলা তুড়ি বাজিয়ে ঘোষণা করা হলো তাদের আগমন।সবার চোখ ছিল জ্যাসপারের ওপর,যার ব্যক্তিত্ব আর পোশাক রাজকীয় মহিমাকে আরও উজ্জ্বল করছিল।
ড্রাকোনিস গাড়ি থেকে নেমে দৃঢ়ভাবে হাঁটতে শুরু করলেন,আর তার পেছনে ধীর পায়ে এগিয়ে চলছিলেন জ্যাসপার।প্রাসাদের মূল দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রাজা জারেন নিজে ড্রাকোনিসকে স্বাগত জানালেন। “আজকের দিনটি ভেনাসের ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়,”বললেন জারেন,চোখে আত্মবিশ্বাসের ঝলক নিয়ে।
ড্রাকোনিসও মাথা নাড়লেন,”নিঃসন্দেহে।আজকের দিনে লিয়ারার সন্তানকে পুরো ভেনাসের সামনে পরিচয় করিয়ে দেয়া হবে‌।আর আমাদের ছেলে মেয়ের বিবাহর দিন ধার্য করা হবে” তার কণ্ঠে ছিল একধরনের গর্ব।

তবে জ্যাসপার এসব কথায় খুব একটা মনোযোগ দিচ্ছিল না।সে পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা অভিজাত ড্রাগনদের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিজের চিন্তায় ডুবে গেল।লিয়ারার সন্তান—এই ঘোষণাটি তার কানে পৌঁছালেও তার মনের গভীরে কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল না।তার মাথায় একটাই চিন্তা—কিভাবে নিজের বিয়ে আটকানো যায়।
সে জানে,ড্রাকোনিসের নির্দেশ আর রাজা জারেনের রাজকীয় ঘোষণা তাকে বিয়ের জন্য চাপের মুখে ফেলবে।কিন্তু জ্যাসপার কখনোই নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু মানতে রাজি নয়।তার মন অস্থির,কিন্তু তার মুখে একধরনের শান্ত অভিব্যক্তি।

সবার মধ্যে একধরনের উৎসবমুখর পরিবেশ ছিল,তবে জ্যাসপারের কাছে তা কেবলই একটি আনুষ্ঠানিকতা।তার চিন্তার গভীরে ছিল এক কঠিন সিদ্ধান্তের ভার।”আজকের দিনটা শেষ করতে পারলেই শান্তি,”মনে মনে বলল সে,প্রাসাদের ভেতরের দিকে পা বাড়ানোর সময়।
রাজকীয় হলঘরটি যেন সোনার আলোয় ঝলমল করছে।বিশাল ঝাড়বাতির কাচের প্রতিফলনে ছড়িয়ে পড়া আলোয় প্রাসাদের প্রতিটি কোণা আলোকিত।উপস্থিত অতিথিরা শোভিত পোশাকে একত্রিত হয়েছে,মুখে উত্তেজনা আর চোখে প্রশ্ন।মঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন রাজা জারেন—গম্ভীর কিন্তু গর্বিত ভঙ্গিতে।তার পাশে অ্যালিসা,সিলভা,আর ড্রাকোনিস।পুরো রাজ্য আজ অপেক্ষায়,শুনবে এমন একটি ঘোষণা যা তাদের ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে।
রাজা জারেন সামনের দিকে এক পা এগিয়ে এসে দর্শকদের উদ্দেশ্যে হাত তুললেন।হলঘরের কোলাহল থেমে গেল।যেন এক মুহূর্তে পুরো ঘর নিস্তব্ধ হয়ে গেছে।রাজা গভীর স্বরে বললেন,“আজকের দিনটি ভেনাসের জন্য এক নতুন সূচনা।এক নতুন গল্পের,এক নতুন উত্তরাধিকারের গল্প।অনেক বছর ধরে আমরা আমার বোন লিয়ারাকে ব*ন্দি করে রেখছিলাম।একজন মনাবকে বিয়ে করার অপরাধে।আমরা ভেবেছিলাম তার এই সিদ্ধান্তে হয়তো,আমরা আমাদের লিয়ারেকে হারিয়ে ফেলবো।কিন্তু আজ… আজ আমি বলতে পারি,আমরা তাকে হারাইনি।উল্টো আমরা তার একটি অংশকে ফিরে পেয়েছি।”

মঞ্চের নিচে সবাই ফিসফিস করতে শুরু করল। “লিয়ারার অংশ?কী বলতে চাইছেন তিনি?” অ্যালিসা আর সিলভা মাথা নিচু করে ভাবছিল,”ফিওনাকে দেখার পর প্রিন্স কি প্রতিক্রিয়া করবে…?”
রাজা জারেন ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে এলেন।তার কণ্ঠে এবার গর্বের সুর।“আমার বোন লিয়ারার মেয়ে, আমার ভাগ্নি,আজ এখানে উপস্থিত হবে।এতদিন সে পৃথিবীতে মানবী হিসেবে বসবাস করেছিল।কিন্তু তার রক্তে বইছে ড্রাগনের শক্তি।ডিএনএ পরীক্ষায় নিশ্চিত হওয়া গেছে,সে-ই আমাদের হারানো উত্তরাধিকার।সে আজ ড্রাগন রূপে ভেনাসে ফিরে এসেছে।”

জ্যাসপার মঞ্চের এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো।এতক্ষণ তার চোখ ছিল অন্যমনস্ক।এই অনুষ্ঠানের জন্য তার কোনো আগ্রহ ছিল না।কিন্তু রাজা জারেনের কথা শুনে তার মনোযোগ ফিরে এলো। “লিয়ারার মেয়ে?” জ্যাসপারের মুখে অদ্ভুত এক ভাব ফুটে উঠল।”মানবী থেকে ড্রাগন? এটা কিভাবে সম্ভব?” নিজের মনে প্রশ্ন করল সে।
এক মুহূর্তের জন্য তার মনে পড়ল পৃথিবীর সেই ছোট্ট মুখ।তার হৃদয়ে যেন এক মুহূর্তের জন্য কাঁপন জাগল।কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সে নিজেকে সামলে নিল।সে জানত,এই মুহূর্তে তার একমাত্র লক্ষ্য নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা রক্ষা করা।

অ্যালিসা আর সিলভা মঞ্চের পেছন থেকে সব দেখছিল।তারা এতটাই চিন্তিত যে কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছিল না।অ্যালিসার মনে চলছিল দোলাচল,”ফিওনার যদি সবকিছু মনে থাকে?”
রাজা জারেন হাত তুললেন,“তোমরা সবাই প্রস্তুত হও।এখন তোমাদের সামনে হাজির করা হবে আমার ভাগ্নিকে যে শুধু লিয়ারার উত্তরাধিকারই নন,ভেনাসের ভবিষ্যতের অংশ।”
জ্যাসপারের মুখে এবার সামান্য অবাক চাহনি দেখা দিল।তার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে বিদ্রূপের হাসি খেলে গেল।”মানবী থেকে ড্রাগন,তাহলে এবার দেখা যাক,ভেনাসের এই নতুন উত্তরাধিকারী আর কী কী চমক আনতে পারে,”মনে মনে বলল সে।কিন্তু তার চিন্তার গভীরে কোথাও এক অজানা শঙ্কা ছায়া ফেলল,যা সে নিজেও বুঝতে পারল না।

ফ্লোরাস প্রাসাদের সোনালী দরবার যেন ভেনাসের ঐশ্বর্যের এক প্রতীক।ঝাড়বাতির আলোয় প্রতিটি কোণা জ্বলজ্বল করছে।রাজ্যের অভিজাত অতিথিরা উপস্থিত,সবার চোখে মুগ্ধতা আর কৌতূহল।জ্যাসপার দরবারের এক কোণে দাঁড়িয়ে রয়েছে—মনমরা আর বিষণ্ণ।রাজা ড্রাকোনিসের আদেশে তাকে এখানে আসতে হয়েছে,যদিও সে মন থেকে এই অনুষ্ঠানে থাকতে চায়নি।বিশেষ করে,অ্যালিসার সঙ্গে বিবাহের প্রসঙ্গ শুনলেই তার মনে বিরক্তি আর অসহায়তার মিশেল দেখা দেয়।
ঠিক তখনই দরবারে এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে এলো।সবার দৃষ্টি সিঁড়ির দিকে নিবদ্ধ হলো।মৃদু পায়ের শব্দ আর রাজকীয় গাউন ঘষার কোমল সুর যেন পুরো পরিবেশকে জাদুময় করে তুলল।রাজা জারেনের পাশে এসে দাঁড়াল এক অনিন্দ্যসুন্দর তরুণী।তার মাথায় রাজকীয় মুকুট,লাল-সোনার গাউন তার রূপকে আরও আভিজাত্যের ছোঁয়া দিয়েছে।
ফিওনা।

জ্যাসপার প্রথমে ঠিক বিশ্বাস করতে পারল না।তার হৃদপিণ্ড যেন এক মুহূর্ত থেমে গেল,আবার দ্রুত বিট করতে শুরু করল।সে মন্ত্রমুগ্ধের মতো ফিওনার দিকে তাকিয়ে রইল। “এটা কীভাবে সম্ভব?ফিওনা এখানে?ভেনাসে?ড্রাগন হয়ে?” তার মনে হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগল।
ড্রাকোনিস,যিনি এক কোণে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন,তার দৃষ্টি অবাকের চরম পর্যায়ে তিনি গভীর শ্বাস নিয়ে ফিওনার দিকে তাকালেন।তার মনে পড়ে গেল সেই মুহূর্ত,যখন তিনি এল্ড্র রাজ্যের বিশেষ কক্ষে ফিওনাকে প্রথম দেখেছিলেন।যে ভেনাসে প্রথমবার পা রেখেছিলো তার পুত্র জ্যাসপারের জন্য,যাকে জ্যাসপারের জীবন থেকে দূরে সড়াতে মিথ্যা বলা হয়েছিলো জ্যাসপারকে।এক অদ্ভুত মানবীর প্রেমে তার ছেলে পাগল।আজ সেই মেয়েই ড্রাগনের রক্ত প্রবাহিত তাও,আবার লিয়ারার সন্তান।

আলবিরা বিস্ময়ে মুখ ঢেকে ফিসফিস করে বলল, “এটা কীভাবে সম্ভব?ফিওনা এখানে?সে তো আমাদের সঙ্গে ছিল মাউন্টেন গ্লাস হাউজে!তখনও কি আমরা জানতাম না যে সে লিয়ারার মেয়ে?”
থারিনিয়াস এবং অ্যাকুয়ারা মুখের দিকে তাকাল একে অপরের।অ্যাকুয়ারা বলল,“আমি তো ভেবেছিলাম ফিওনা শুধুই একজন মানবী।কিন্তু…তার মধ্যে যদি ড্রাগনের রক্ত থাকে,তবে এটা স্পষ্ট।তার আসল পরিচয় এতদিন লুকিয়ে ছিল।”
এথিরিয়ন,যে বরাবরই শান্ত আর বিচক্ষণ,ফিওনার দিকে গভীর নজরে তাকিয়ে বললো,“আমাদের উচিত ছিল এটা আগে থেকেই বোঝা।কিন্তু হঠাৎ করে কিভাবে সবকিছু বদলে গেলো,ফিওনা মানবী থেকে ড্রাগন হয়ে গেলো কিভাবে?”
জ্যাসপারের ভেতর তখন অন্যরকম এক ঝড় চলছিল।
জ্যাসপার দাঁড়িয়ে আছে এক কোণে।তার চোখ ফিওনার উপর আটকে আছে,আর হৃদয় যেন থেমে গিয়ে আবার দ্রুত বিট করতে শুরু করেছে।সে নিশ্চিত,এটাই তার ফিওনা।কিন্তু কীভাবে?ফিওনা এখানে কীভাবে এলো?
রাজা জারেন গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,“সকলকে জানানো হচ্ছে,এই মেয়েটি আমার বোন লিয়ারার কন্যা। প্রাসাদের হারিয়ে যাওয়া এক র*ক্তের উত্তরাধিকারী। বহুদিন পর আজ আমাদের মধ্যে ফিরেছে।সে ফ্লোরাস রাজ্যের ছোট প্রিন্সেস ফিওনা।”

দরবারজুড়ে হালকা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়লো।সবাই ফিসফিস করতে লাগলো।তবে সেই গুঞ্জনের মধ্যে জ্যাসপার যেন আর কিছুই শুনতে পেল না।তার কানে বারবার শুধু একটি কথাই বাজতে লাগলো—”প্রিন্সেস ফিওনা।”
জ্যাসপারের ভেতর গভীর এক টান অনুভূত হলো।এটা তার হামিংবার্ড,সে নিশ্চিত।কিন্তু তার মনে আরেকটি প্রশ্নও জাগছে—যদি সে তার ফিওনা হয়,তাহলে রাজা জারেন তাকে লিয়ারার কন্যা বলে কেন পরিচয় দিচ্ছেন?
তার হৃদয় আবার তীব্রভাবে বিট করলো।সে নিজেকে বারবার বলছে,“না,আমি ভুল করতে পারি না।আমার হামিংবার্ডকে চিনতে আমার কখনো ভুল হবে না। কিন্তু…যদি সে অন্য কেউ হয়?”
এক মুহূর্তের জন্য সে নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করলো,”না হয়তো এটা কেবল চেহারার মিল।হয়তো এটা ফিওনা নয়।” কিন্তু যতবার সে ফিওনার দিকে তাকাচ্ছে,তার হৃদয় যেন বুনো গতিতে ছুটে চলেছে।
“ফিওনা,” সে নিজের ভেতরে নামটি ফিসফিস করে উচ্চারণ করলো।এই নাম যেন তার আত্মার গভীরে ঝড় তুলছে।

তখনই ফিওনার চোখ একবারের জন্য জ্যাসপারের দিকে গেল।তার নির্লিপ্ত দৃষ্টি দেখে জ্যাসপারের বুকের ভেতর ভারী শূন্যতা তৈরি হলো।ফিওনার চোখে তাকে চেনার কোনো লক্ষণ নেই।
জ্যাসপার নিজের মনে বললো,“না, এটা অসম্ভব।এটা আমার হামিংবার্ড।তাকে চিনতে ভুল হওয়ার প্রশ্নই আসে না।যদি সে অন্য কেউ হতো,তবে আমার হৃদয় কখনোই এভাবে প্রতিক্রিয়া করতো না।”
রাজা জারেন তার বক্তব্য শেষ করে ফিওনার দিকে তাকালেন। “এখন থেকে,প্রাসাদ তোমার ঘর।তুমি এই রাজ্যের উত্তরাধিকার।এখানে তোমার জন্য সবকিছু প্রস্তুত।”
জ্যাসপারের মনে তখনো একটাই প্রশ্ন বারবার ঘুরপাক খাচ্ছিল—”এই ফিওনা যদি আমার ফিওনা হয়,তবে সে আমাকে দেখেও কেনো রিয়াকশন করলো না?”

তার ইচ্ছে হলো প্রাসাদের নিয়ম-কানুন ভেঙে ছুটে গিয়ে ফিওনাকে জড়িয়ে ধরে জানতে চাওয়া,”তুমি কি জানো আমি তোমার জন্য কতটা প্রতীক্ষায় ছিলাম?” কিন্তু সে জানে,এই মুহূর্তে তা অসম্ভব।
তবু তার ভেতরের একান্ত অনুভূতি তাকে বলছিল, “তুমি যদি সত্যিই আমার ফিওনা হও,তবে আমি তোমার হারানো স্মৃতিগুলো ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবো।আমি প্রমাণ করবো যে তুমি শুধু আমারই।”
এথিরিয়ন জ্যাসপারের দিকে এগিয়ে এসে তার গম্ভীর মুখাবয়বের দিকে নজর দিল।এথিরিয়ন বিস্ময় প্রশ্ন করলো “জ্যাসু ভাইয়া,ফিওনা ড্রাগন ছিলো?তাও আবার ফ্লোরাস রাজ্যের প্রিন্সেস?”তার প্রশ্নের উত্তরে জ্যাসপার গভীরভাবে চিন্তিত হলো।

জ্যাসপার যেন তার অন্তরের গভীর থেকে একটা ভারি নিশ্বাস নিল। “হয়তো,”সে বললো,“কিন্তু আমার হামিংবার্ড।সে একবারও আমার দিকে তাকাচ্ছে না।সে আমাকে চিনতেই পারছে না।”
এথিরিয়ন হাস্যোজ্জ্বল কিন্তু চিন্তিত মুখ নিয়ে বললো, “কিভাবে চিনবে ভাই?তুমি তো ওর স্মৃতি লকেটের মধ্যে ক্যাপচার করে রেখেছো,আবার সেটা সাগরের গভীরে ফেলে দিয়েছো।”
জ্যাসপার কষ্টের ছাপ নিয়ে বললো “তবুও কি,ওর হৃদয় একবারও ভাবছে না,যে আমি ওর কতটা কাছের কতোটা আপন।”
এথিরিয়ন কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললো,”এটা তোমার জন্য কঠিন হতে পারে,কিন্তু ফিওনার হ্নদয় হয়তো অনুভব করবে একটা সময়।এথিরিয়ন সতর্কতার সাথে বললো,”তোমার উচিত ওকে সময় দেওয়া।হয়তো একদিন সে মনে করতে পারবে তোমার কথা।”
জ্যাসপার মুখে একটি কঠিন হাসি নিয়ে বললো,”আমি অপেক্ষা করব কারণ আমি জানি,আমার হামিংবার্ড কখনো হারিয়ে যাবে না আমার কাছ থেকে।”

ড্রাকোনিস জ্যাসপারের দিকে নিবিড় দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল,ছেলের মুখাবয়বের প্রতিটি অভিব্যক্তি বোঝার চেষ্টা করছিল।সে জানতো,ফিওনার মনে জ্যাসপারের কোনো স্মৃতি নেই;কিন্তু জ্যাসপারের স্মৃতিগুলো ছিল কষ্টের এক অতল গহ্বর।সেই স্মৃতিগুলি তার হৃদয়ে এমনভাবে খোদিত হয়ে আছে,সেগুলো কখনো মুছবে না।
জ্যাসপার যখন দূরে ফিওনাকে দেখছিল,তার চোখে অস্বাভাবিক এক শূন্যতা ছিল।ড্রাকোনিসের মনে দুশ্চিন্তার ঢেউ বয়ে গেল—এখন তার একটাই প্রশ্ন ঘুরছিল,জ্যাসপার কি এবার অ্যলিসাকে বিয়ে করতে মানা করবে?
ড্রাকোনিসের মনে একদিক থেকে আশা আর অন্যদিকে দুঃশ্চিন্তা ভর করেছে।যদি জ্যাসপার ফিওনার প্রতি তার অনুভূতি ভুলে যেতে না পারে,তবে অ্যলিসার সাথে তার বিয়ের পরিকল্পনা কীভাবে সফল হবে?সে জানতো, জ্যাসপারের হৃদয় এখনও ফিওনার জন্য দোলা খাচ্ছে,আর এই পরিস্থিতিতে রাজা জারেনকে দেয়া অ্যলিসার প্রতি তার প্রতিশ্রুতি অন্ধকারে চলে যাবে।

এমন পরিস্থিতিতে ড্রাকোনিসের মনে একটি প্রশ্ন জেগে উঠলো—জ্যাসপার কি তার ভালোবাসাকে পুনরায় পাওয়ার জন্য সংগ্রাম করবে,না কি পরিবারের সম্মান আর দায়িত্বকে গুরুত্ব দিয়ে অ্যলিসাকে গ্রহণ করবে?
ড্রাকোনিসের দৃষ্টি যখন জ্যাসপারের দিকে গড়ালো,সে বুঝতে পারলো,ছেলের চোখে একটা সংকল্পের ছাপ রয়েছে।কিন্তু সেই সংকল্প কি—জ্যাসপার কি সত্যিই নিজের হৃদয়কে অগ্রাহ্য করে অ্যলিসার সাথে নতুন একটি জীবন গড়ে তুলতে পারবে?
হঠাৎ করেই রাজা জারেন মঞ্চে ড্রাকোনিস আর জ্যাসপারকে ডাকলেন।তার গম্ভীর কণ্ঠস্বর পুরো হলঘর জুড়ে গুঞ্জরণ সৃষ্টি করলো।“এটা ভেনাসের রাজা ড্রাকোনিস,” তিনি ঘোষণা করলেন,“এল্ড্র রাজ্যের এবং পুরো ভেনাসের কিং।আর তার পুত্র আমাদের ভেনাসের একমাত্র প্রিন্স,জ্যাসপার অরিজিন।”

জ্যাসপারের নাম উচ্চারিত হতেই ফিওনার হৃদয়ে একটি শীতল ঝড় বয়ে গেল।তার গ্ৰান্ডপা বলেছিলেন,জ্যাসপার আর সে দু’জন দু’জনকে ভালোবেসেছিলো।মুহূর্তের মধ্যে যেন মহাবিশ্ব থেমে গেল,সবকিছু অদৃশ্য হয়ে গেল।ফিওনা জ্যাসপারের দিকে তাকাল,তাদের দৃষ্টির গভীর সংযোগ স্থাপন হলো, দুজোড়া চোখের মিলন ঘটলো।
জ্যাসপারের সবুজ চোখের দৃষ্টিতে ফিওনার ‌এক অদ্ভুত অচেনা অনুভুতি হলো।কিন্তু সেই অনুভূতি খুব দ্রুত তীব্র যন্ত্রণায় পরিণত হলো।মস্তিষ্কের গভীরে কিছু অস্পষ্ট স্মৃতি আবছা আবছা করে ভেসে উঠতে শুরু করলো।
“না, না!” ফিওনা চিৎকার করে উঠতে চাইলো,কিন্তু তার কণ্ঠরোধ হলো।মাথার ভেতর যেন একটি বিস্ফো*রণ ঘটছে।এই মুহূর্তে সবকিছু তার হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে।আবছা স্মৃতির ঝাপটায় সে তলিয়ে যাচ্ছিল।স্মৃতির পেছনে লুকিয়ে থাকা ভয়াবহ সত্য আর একান্ত অচেনা অনুভূতি তার মস্তিষ্ককে বিদ্ধ করছে।

ফিওনার মাথার ভেতর তীব্র যন্ত্রণা ঝড়ের মতো ঘুরছিল।তার চারপাশের দৃশ্যগুলো ঝাপসা হয়ে গেল,মঞ্চের আলো ধীরে ধীরে অন্ধকারে মিশে গেল।পায়ের নিচের মাটি যেন সরে যাচ্ছে,আর এক মুহূর্তে মনে হলো,সে অজ্ঞান হয়ে পড়তে যাচ্ছে।
কিন্তু ঠিক তখনই,শক্ত অথচ উষ্ণ একজোড়া হাত তাকে ধরে ফেলল।তার দেহ ভারহীন হয়ে সেই হাতে ভর করলো,যেন সেই হাত ছিল তার একমাত্র আশ্রয়।ফিওনার অচেতন শরীর ধীরে ধীরে জড়িয়ে গেল সেই বুকের গভীর উষ্ণতায়।
জ্যাসপার তাকে নিজের হাতে তুলে নিল,যেন সে ভেনাসের সবচেয়ে মূল্যবান কিছু ধরে রেখেছে।তার চোখে অদ্ভুত এক উদ্বেগ ঝিলমিল করছিল,কিন্তু মুখে গভীর স্থিরতা।ফিওনার নিস্তেজ মুখের দিকে তাকিয়ে তার সবুজ চোখের গভীর অনুভূতি জেগে উঠলো।

আযদাহা সিজন ২ পর্ব ৩

“আমার হামিংবার্ড,”জ্যাসপার মনে মনে বলল।তার হৃদয় এক মুহূর্তের জন্য ভারী হয়ে গেল,কারণ সে বুঝতে পারছিল,ফিওনার স্মৃতির কোনো চিহ্নই তাকে চিনতে সাহায্য করছে না।
তবুও,ফিওনার মুখে এক ঝলক শান্তি খুঁজে পেল জ্যাসপার।সে তাকে নিজের বুকে শক্ত করে ধরে রাখলো,যেন মহাবিশ্বের কোনো শক্তিই তাকে আর ছিনিয়ে নিতে পারবে না।মঞ্চের সমস্ত দর্শকের সামনে,সেই মুহূর্তটি যেন স্থির হয়ে গেল।জ্যাসপারের চোখে ছিল এক অসীম প্রতিজ্ঞা—এবার সে কিছুতেই তার হামিংবার্ডকে হারাবে না।

আযদাহা সিজন ২ পর্ব ৫