আযদাহা সিজন ২ পর্ব ৪০
সাবিলা সাবি
ভেনাসের নীলচে আকাশটা আজ যেন একটু বেশিই ধূসর। প্রাসাদের উঁচু বারান্দায় একা দাঁড়িয়ে আছে অ্যাকুয়ারা।মুখ তুলে তাকিয়ে আছে আকাশের পানে। ঠোঁটে লেগে আছে তির্যক হাসি, চোখে একরাশ ক্লান্ত অভিমান ফুটে আছে।
সে ধীরে ধীরে বলে উঠলো, “আমাকে বোধহয় সারাজীবন সিঙ্গেলই থাকতে হবে… আমার চোখের সামনেই সবাই প্রেম করছে—প্রিন্স, রিয়ন, থারিনিয়াস… শুধু আমিই ভালোবাসা পাবার আগে ছ্যাঁকা খেয়ে বসে আছি।” তার গলা কাঁপছে না, কিন্তু চোখের গভীরে জমে থাকা একরাশ না-বলা কষ্ট স্পষ্ট রয়েছে। ভেনাসের আকাশ তাকে কোনো উত্তর দিলো না। কিন্তু সে জানে না, তার এই নিঃশব্দ অভিমান একেবারে পৌঁছে যাচ্ছে পৃথিবীর মাটিতে— বেইজিং শহরের এক নির্জন গবেষণারকক্ষে।
লিউ ঝান বসে আছে একা, গায়ে জড়ানো কালো ভারি ওভারকোট। সামনে কম্পিউটারের স্ক্রিন জ্বলছে ম্লান আলোয়। পাশে রাখা ছোট একটা নোটবুক খুলে সে লিখে রেখেছে আজকের দিনের অনুভব “তোমাকে ফিরিয়ে দিয়ে কেন আমি কিছুতেই শান্তি পাচ্ছি না? পৃথিবীতে আসার পর থেকেই প্রতিদিন সেই মুহূর্তটা জ্বালিয়ে দিচ্ছে আমাকে। আই হেইট দিজ ফিলিং…”
দুটো পৃথক গ্রহ। দুটো মন। একই মুহূর্তে, দুই প্রান্তে, একই ভালোবাসা, দুই হৃদয়ে জমে থাকা অভিমানের মতো নিঃশব্দে পুড়ছে। অ্যাকুয়ারা এখনো জানে না—তার বলা প্রতিটা অভিমানের শব্দ প্রতিধ্বনির মতো পৌঁছে যাচ্ছে সেই মানুষের মনে, যে একদিন আবার ফিরে আসবে—তার অভিমান ভাঙাতে, আর কেবল চুপ করে জড়িয়ে ধরে বলবে: “আমি তখন বোকার মতো ছিলাম। এখন আমি জানি—তুমি ছাড়া আমি কিছুই না।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রৌদ্রস্নাত সকালের আলো ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ছে এল্ড্র প্রাসাদের গ্লাস-কক্ষে। আলোর জ্যোতি ফিওনার গায়ে সোনালি পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে। সে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে নিচের বাগানটা দেখছিল—নরম এক আবেগ তার চোখে।
পেছন থেকে হেঁটে এল জ্যাসপার। তার হাতে ছিল একটা ছোট, কালো মখমলের বাক্স। চোখে ফুটে আছে অপূর্ব কোমলতা, ঠোঁটে অদ্ভুত এক গাম্ভীর্য ভাব।
“হ্যামিংবার্ড…” ডাকতেই ফিওনা ঘুরে তাকালো। আর জ্যাসপার মুচকি হাসলো। “আজ আমি তোমাকে এমন কিছু দিবো—যেটা শুধু তোমার না, আমাদের সন্তানের জন্যও।”
সে ধীরে ধীরে সেই বাক্সটা খুললো। বাক্সের ভেতরে ছিল একটি নিখুঁতভাবে গড়া ওয়েস্ট চেইন, ‘জুবলি প্লাটিনাম’-এর তৈরি। এর ওপর সূক্ষ্মভাবে খোদাই করা ছিল এক ক্ষুদ্র ড্রাগনের ছায়া—যেন আগত ভবিষ্যতের নিদর্শন। ফিওনা বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। “এটা… এটা এত সুন্দর…”
জ্যাসপার এগিয়ে এসে ধীরে ধীরে সেই ওয়েস্ট চেইন ফিওনার কোমরে পরিয়ে দিলো। তার হাত দুটো ফিওনার পেটে এসে থামে। “এই চেইন কেবল অলংকার না, এটা আমাদের সন্তানের প্রথম উপহার। এখন সে তোমার ভেতরে আছে, তাই তোমার গায়ে থাকা মানেই তার গায়েই।” ফিওনার চোখে জল জমে আসে। “তুমি কি আগে থেকেই প্ল্যান করেছিলে?”
জ্যাসপার হেসে ফেললো। “জ্যাসপার অরিজিনের প্রেমে কোনো প্ল্যান থাকে না, হৃদয়ের নির্দেশই পথ দেখায়।” ফিওনা তখন হালকা হেসে মাথা রাখে জ্যাসপারের বুকে। চুপচাপ মুহূর্তে শুধু তাদের নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে—আর মাঝখানে জ্বলজ্বল করছে সেই জুবলি প্লাটিনামের চেইন, যা এখন একটি ভবিষ্যৎ প্রাণের প্রতীক।
বিকেলের দিকে ফিওনা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে লাগলো। পেছন থেকে জ্যাসপার তার কোমর জড়িয়ে ধরে আছে। একটা আরামদায়ক নিঃশ্বাস ফিওনার ঘাড় ছুঁয়ে যাচ্ছে। “প্রিন্স, তোমাকে কিছু বলবো?” ফিওনার গলায় ছিল কিশোরী অভিমানের নরম সুর। জ্যাসপার হালকা হাসল, “গতকাল তো বলেই ফেলেছো, তুমি পৃথিবীতে যেতে চাও… তোমার গ্ৰান্ডপার সাথে দেখা করতে।”
ফিওনা একটু থতমত খেল, “তুমি মনে রেখেছো?”
“তোমার কোনো ইচ্ছাই আমি ভুলি না, হ্যামিংবার্ড,” জ্যাসপার মৃদুস্বরে বলল। “আর তাই—আজই আমরা যাচ্ছি পৃথিবীতে।” ফিওনার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল, “সত্যি?!”
জ্যাসপার মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ। এখন তোমার শরীরে আমাদের শিশুর অস্তিত্ব আছে, কিন্তু ও এখনো খুব ছোট, এখনো হার্টবিট আসেনি। এই সময়টা ট্র্যাভেল সেফ। এখন তুমি ড্রাগন রূপে পৃথিবীতে যেতে পারবে, ঝুঁকি নেই একদম।”
ফিওনার হাত নিজের পেটের ওপর চলে যায়, একটু আবেগে, একটু সচেতনতায়। জ্যাসপার তখন ফিওনার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, এক গাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “তবে পৃথিবীতে যাওয়ার আরেকটা কারণ আছে। আমি চাই তুমি দেখো—আমার এই বিশাল জীবন, বিশাল সম্পদ, সমস্ত টাকা, শক্তি—এসবের উৎস। আমি কেবল ভেনাসের রাজপুত্র নই, পৃথিবীতেও আমার অনেক কিছু আছে। আমি চাই, তুমি দেখো আমি কীভাবে সব গড়েছি।” ফিওনা বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে থাকে। “তুমি আমাকে এত কিছু দেখাতে চাও কেনো?” জ্যাসপার মৃদু হেসে ফিসফিস করে বলে, “কারণ এই বাচ্চার মা শুধু রাজপ্রাসাদের রানী না, সে আমার হৃদয়েরও অধিপতি।” তারপর সে ফিওনার হাতে একটা সোনালি বলয়ের মতো যন্ত্র তুলে দেয়। “এটা পরে নাও, পৃথিবীতে নামার সময় এটা তোমার শরীরকে সুরক্ষা দেবে।”
নীলাভ আকাশের নীচে এল্ড্র প্রাসাদের ছাদে দাঁড়িয়ে ছিল চারটি অগ্নিময় আত্মা—জ্যাসপার, ফিওনা, আলবিরা আর থারিনিয়াস। পৃথিবীর উদ্দেশে এক গুরুত্বপূর্ণ যাত্রা শুরু হবে আজ। হাওয়ায় তাদের চুল উড়ছিল, চোখে ছিল এক চিলতে উত্তেজনা আর হৃদয়ে ছিল দায়িত্ব।
জ্যাসপার এক দৃষ্টিতে ফিওনার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমার পেটের ভেতরে এখনো বেবির হার্টবিট শুরু হয়নি, তবুও বেশি দ্রুত উড়ার দরকার নেই। আস্তে আস্তে উড়বে।
চারজনেই মুহূর্তের মধ্যে তাদের ড্রাগন রূপ ধারণ করলো। আগুনের মতো চোখ, ঝকঝকে আঁশ, আর বিশাল ডানা মেলে ওরা ছুটে চললো মহাশূন্যের বুক চিরে—পৃথিবীর দিকে। এ ছিল আরেক দুনিয়া থেকে আসা এক স্বপ্নের মতো দৃশ্য।
তিনদিনের মধ্যেই তারা পৃথিবীর কক্ষপথে প্রবেশ করে। মৃদু সূর্যের আলো মেখে চারটি ড্রাগন ধীরে ধীরে মাটিতে নামলো—চীনের এক গোপন স্থানে, যেখানে তাদের উপস্থিতি সাধারণ মানুষের চোখে ধরা পড়বে না।
জ্যাসপার তার হাতে থাকা স্মার্ট ঘড়ির মাধ্যমে একটা সিগন্যাল পাঠালো আর সাথে সাথে তাদের সামনে এক বিশাল দরজা খুলে গেলো। মুহূর্তেই সবার চোখে ধরা পড়লো—Rolls-Royce Boat Tail। পৃথিবীর সবচেয়ে দামি গাড়ি। গাড়িটি ছিল একেবারে রাজকীয়—সমুদ্র নীল রঙে রঙিন, পেছনে কাঠের টেক্সচার, যেন একটি বিলাসবহুল ইয়টের অংশ গাড়ির শরীরে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। সামনে লুকানো ছাতার ঘর, পেছনে বিল্ট-ইন ককটেল সেটআপ, স্পার্কলিং হেডলাইটে আভিজাত্যের ঝলক। সোনালি বর্ডার ঘেরা চাকা আর অভ্যন্তরে ক্রিম রঙের সিট, হ্যান্ড-ক্রাফটেড কাঠের টাচ এবং ফাইভ-স্টার হোটেলের মতো আরামদায়ক পরিবেশ—এই গাড়িটি যেন যেকোনো রাজকুমার বা রাজকুমারীর স্বপ্নপূরণের বাহন।
ফিওনার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল, “এটা… এটা কি গাড়ি নাকি শিল্পকর্ম?” জ্যাসপার হেসে বললো, “এটা পৃথিবীর সবচেয়ে দামি বিলাসবহুল গাড়ি।
তারপর চারজন একে একে গাড়িতে উঠলো। এই Boat Tail গাড়ির আসনে চারজন অনায়াসে বসতে পারলো—এটা এমনভাবেই ডিজাইন করা যেন ছোট একটা রাজপরিবার একসাথে যাত্রা করতে পারে।
গাড়ির দরজা বন্ধ হতেই, নিঃশব্দ গতিতে ছুটে চললো Rolls-Royce। রাস্তায় কোনো আওয়াজ নেই, শুধু নিঃসাড়ে গাড়ির স্পিড আর তাদের গন্তব্য—চীনের রাজধানী, বেইজিং।
অনেকক্ষণ ধরে গাড়ি চুপচাপ চলছিল। বাইরের দৃশ্য বদলাচ্ছিল একের পর এক—জঙ্গলের সবুজ রঙের পাহাড়ের ছায়া, আর মাঝে মাঝে শহরের ব্যস্ততা। কিন্তু ভিতরে গাড়ির পরিবেশ ছিল রাজসিক নীরব।
এই নিঃশব্দ যাত্রায় হঠাৎই ফিওনা বিরক্ত গলায় বলে উঠলো,“প্রিন্স, এটা বুঝি পৃথিবীর সবচেয়ে দামি গাড়ি? অথচ এর গতি দেখে তো মনে হচ্ছে কচ্ছপের রেসে নেমেছি আমরা। এভাবে চললে তো বেইজিং পৌঁছাতে দুদিন লেগে যাবে!”
জ্যাসপার একটু কড়া চোখে তাকালো ফিওনার দিকে, ভারী গলায় বললো “তুমি পাগল নাকি?” সে বললো, “এটা গাড়ি—ড্রাগনের ডানা মেলে উড়ে যাওয়া নয়। বেশি স্পিড দিলে ঝাঁকুনি লাগবে, আর তোমার পেটে তো এখন একটা ছোট্ট হৃদয় ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছে। একটা ঝাঁকুনি মানে আমাদের বেবির ক্ষতি। আমি ঝুঁকি নিতে পারবোনা।”
ফিওনা একটু থেমে গেল। চোখ নামিয়ে গাড়ির ভিতরটা দেখলো—গভীরভাবে অনুভব করলো, এই ধীরে চলা স্পর্শের মধ্যেই লুকিয়ে আছে যত্ন, ভালোবাসা আর নতুন জীবনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা। গাড়ি চলতে থাকলো… ধীরে, কিন্তু অনেক শক্তিময় এক গন্তব্যের দিকে।
অবশেষে দীর্ঘ যাত্রা শেষে গাড়ির চাকা থামলো বেইজিং শহরের এক শান্তপ্রাণ অলিগলির প্রান্তে—ফিওনার শৈশবের বাসভবনের সামনে। সন্ধার আলো তখন হালকা রঙে ছুঁয়ে দিচ্ছে বাড়িটার বারান্দা, জানালার কাচে প্রতিফলিত হচ্ছে এক ফেলে আসা জীবনের প্রতিচ্ছবি।
জ্যাসপার নেমে পড়লো ড্রাইভিং সিট থেকে তারপর Rolls-Royce Boat Tail-এর দরজাটা সুনিপুণ ভঙ্গিতে খুলে দিলো ফিওনার জন্য। ফিওনা ধীরে ধীরে পা রাখলো সেই চেনা উঠোনে। থারিনিয়াস আর আলবিরা নীরব পায়ে পাশে দাঁড়িয়ে রইলো, চারজন একসাথে এগিয়ে গেলো প্রধান দরজার দিকে।
ঘরের ভেতরে, আধুনিক ডিজাইনে গড়া প্রশস্ত লিভিং রুমের মাঝখানে বসে ছিলেন মিস্টার চেন শিং। চোখে চিকচিকে স্মার্ট ফ্রেমের চশমা, পরনে ছিমছাম ধূসর ব্লেজার, হাতে আধা পড়া এক সায়েন্টিফিক জার্নাল। এখনও চেহারায় বার্ধক্যের ছাপ নেই, চোখে এক গভীর মেধা আর অভিজ্ঞতার দীপ্তি। তবে সেদিন, জ্ঞানী চেন শিং যেন জ্ঞানের সব পরত এক মুহূর্তের জন্য হারিয়ে ফেললেন।
ফিওনাকে দেখামাত্র তাঁর চোখ স্থির হয়ে গেল। হাত থেকে পড়ে গেলো জার্নালটা, ঠোঁট অল্প ফাঁক হয়ে থাকলো—কোনো শব্দ নেই, শুধু নিস্তব্ধ বিস্ময়ে আটকে থাকা নিঃশ্বাস।
এই সেই মেয়ে, যার শৈশব আর প্রাণ ছিল এই ঘরের প্রতিটি কোণে—আজ হঠাৎ করেই এসে দাঁড়িয়েছে তাঁর সামনে, যেন বাস্তব নয়, বরং কোনো স্মৃতির মায়ারূপ।
চেন শিং শুধু তাকিয়ে রইলেন। শব্দের ভাষা মুছে গেছে তাঁর মুখ থেকে, হৃদয় তবু চুপিচুপি বলে উঠলো— “ফিওনা?” আর এই একটি নামেই ভরে উঠলো গোটা ঘরের বাতাস, ভরে উঠলো ফিরে পাওয়ার আর বিস্ময়ের এক অপূর্ব মুহূর্ত।
অবশেষে চোখ ভিজে এলো ফিওনার—সময় থমকে দাঁড়াল ফিওনার জন্য। সে আর এক মুহূর্তও দেরি করলো না। এক নিঃশ্বাসে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো তার প্রিয়র চেয়েও প্রিয় মানুষটিকে—তার গ্র্যান্ডপা, মিস্টার চেন শিং-কে।
চেন শিং-ও শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরলেন ফিওনাকে, যেন হারিয়ে যাওয়া কোনো ধন হঠাৎ ফিরে পেয়েছেন। নাতনির কাঁধে হাত রেখে বললেন, “তুমি ঠিক আছো তো, ভালো আছো তো?” ফিওনার চোখে জল, তবু ঠোঁটে এক তৃপ্তির হাসি, “আমি একদম ঠিক আছি গ্ৰান্ডপা, আবার তো তোমার কাছে ফিরে এলাম…”
কয়েক মুহূর্ত ধরে চললো এক আবেগঘন নীরবতা—যেখানে কথা নয়, শুধু হৃদয়ের স্পন্দন বুঝে নিচ্ছিল একে অপরকে।
তারপর ফিওনা একপাশে সরে দাঁড়াতেই জ্যাসপার সামনের দিকে এগিয়ে এলো। সম্মান জানিয়ে সে হাত বাড়িয়ে দিলো, চেন শিং সেই হাত ধরলেন—তীব্র দৃষ্টি মেলে জিজ্ঞেস করলেন, “আমার নাতনিকে ভালো রাখার জন্য তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ জ্যাসপার।” জ্যাসপার বিনীত মাথা ঝুকিয়ে বললো, “জ্বী। আমি সবসময় ওকে আগলে রাখবো। আর সব সময় ওর পাশে থাকব।”
চেন শিং ক্ষণিকের জন্য কিছু ভাবলেন, তারপর মৃদু হেসে মাথা নাড়লেন। ফিওনা কিছুক্ষণ ভেবে হঠাৎ একটু অবাক হয়ে জানতে চাইল, “গ্ৰান্ডপা…. মিস ঝাং কোথায়?” চেন শিং তখন শান্ত ভঙ্গিতে উত্তর দিলেন, “মিস ঝাং কিছুদিনের জন্য গ্রামের বাড়ি গেছে। তার মা’র শরীরটা ঠিক নেই, তাই ওনার থাকা দরকার ওখানে।”
ফিওনা মাথা নাড়লো। তার চোখের কোনে তখনো আবেগের ভেজা রেখা, কিন্তু মুখে এখন ঘরের বাতাস ছোঁয়ার এক নিঃশ্বাসে প্রশান্তি। এই ছিল বহুদিন পরে ঘরে ফেরা এক নাতনি, আর তাকে জড়িয়ে ধরে রাখা এক নানার নিঃশর্ত ভালোবাসার ফিরে পাওয়া।
রাত তখন একটু একটু করে নামছে পৃথিবীর আকাশে। ঘরে আলো জ্বলেছে, বাইরের নিস্তব্ধতা যেন ভেতরের উষ্ণ পরিবেশকে আরও ঘন করে তুলেছে। চেন শিং হালকা হাসি দিয়ে বললেন, “বাইরে থেকে খাবার অর্ডার করে দিয়েছি ডিনারের জন্য—তোমরা সবাই ফ্রেশ হয়ে নাও।”
ডাইনিং টেবিলে খাবার আসতে দেরি হলো না। চিকেন উইংস, সিচুয়ান বিফ, ফ্রায়েড রাইস, নানা রকম স্পাইসি আইটেমে সাজানো টেবিল দেখে সবাই বসে পড়লো খেতে। কিন্তু জ্যাসপার একবার তাকিয়ে পুরো টেবিল স্ক্যান করলো, তারপর একটুও শব্দ না করে উঠে কিচেনের দিকে এগিয়ে গেল।
চেন শিং তখন বললেন, “আরে! কোথায় যাচ্ছো? খাবার না খেয়ে?” জ্যাসপার তখন হালকা ভঙ্গিতে বললো, “এই খাবারগুলো ফিওনার জন্য সঠিক নয়। আমি ওর জন্য আলাদা কিছু তৈরি করতে যাচ্ছি ।”
চেন শিং ভ্রু কুঁচকে বললেন, “কেন? ও তো সবই খায়—এখন এমন কী হলো?” জ্যাসপার থামলো, তারপর ধীরে ধীরে উত্তর দিল, “কারণ ফিওনা এখন প্রেগন্যান্ট। আর এই খাবারগুলো আমাদের সন্তানের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।”
ঘরে মুহূর্তেই নীরবতা নেমে এলো। চেন শিং যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না নিজের কানে যা শুনেছেন। তারপর হঠাৎ করেই তাঁর মুখে এক অপার্থিব আনন্দের ঝলক— “তুমি কি বললে? ফিওনা… মা হতে চলেছে?”
ফিওনা লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিল, আর আলবিরা হেসে মাথা নাড়লো। চেন শিং যেন খুশিতে কেঁপে উঠলেন। উঠে এসে ফিওনার মাথায় হাত রাখলেন, তার চোখে জল চিকচিক করছিল, “আমার ছোট নাতনিটা এখন মা হতে চলেছে… এ তো স্বর্গের আশীর্বাদ!”
আর ওদিকে কিচেনে, জ্যাসপার তখন নিঃশব্দে প্রোটিন-সমৃদ্ধ, কম মশলার, পুষ্টিকর খাবারের আইটেম বানিয়ে চলেছে—শুধু তার ভালোবাসার “হামিংবার্ড” আর তাদের অনাগত সন্তানের জন্য।
ফিওনা ধীরে ধীরে কিচেনের দিকে এগিয়ে গেল। তার গায়ে তখন হালকা গোলাপি রঙের সোয়েটার, চোখে একরাশ কোমলতা। জ্যাসপারকে দেখতে পেল রান্নার মাঝে মনোযোগ দিয়ে কিছু কাটছে। সে পেছন থেকে জ্যাসপারের কাঁধে ভর দিয়ে আদুরে কণ্ঠে বলল, “প্রিন্স… বলছিলাম ওই স্পাইসি চিকেন উইংসগুলো আমার কত প্রিয় জানো… একটু খাই না প্লিজ?” জ্যাসপার থেমে গেল। তারপর মুখ ঘুরিয়ে ফিওনার চোখে চোখ রেখে একেবারে সোজা গলায় বলল, “একদম না। এই মুহূর্তে তোমার পছন্দ না, তোমার সন্তানের নিরাপত্তা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তুমি খুশি হলে আমি খুশি। কিন্তু তোমার শরীর যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, আমি নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারবো না।”
ফিওনা নিচু স্বরে বলল, “তুমি তাহলে এমন কড়া হয়ে গেলে?” জ্যাসপার হেসে বলল, “আমি কড়া নই, আমি দায়িত্ববান। তুমি এখন একজন মা, আর আমি একজন বাবা—আমাদেরকে শুধু ভালোবাসতে নয়, আগলে রাখতেও শিখতে হবে।”
তারপর সে এক চামচ সুপ তুলে বলল, “চলো, তোমার জন্য বানানো এই খাবারটাই আগে খাও। তারপর চাইলে তোমার পছন্দের কিছু বানিয়ে দেবো, কিন্তু শুধু যদি সেটা বেবির জন্য নিরাপদ হয়।” ফিওনার মুখে তখন এক চিলতে হাসি—রাগে নয়, ভালোবাসায় ভরা।
সবাই একসাথে ডাইনিং টেবিলে বসে পড়ল। থারিনিয়াস আর আলবিরা মৃদু কথা বলছিল, চেন শিং মন দিয়ে ফ্রাইড রাইসে চামচ চালাচ্ছিলেন। ফিওনার সামনে সাজানো ছিল তার জন্য জ্যাসপার বানানো বিশেষ স্যুপ—স্বাস্থ্যসম্মত, কম মসলা, আর পুরোপুরি প্রেগনেন্সি রুলস অনুযায়ী।
কিন্তু ফিওনার চোখ আটকে গেল জ্যাসপারের প্লেটে। সেখানে ছিল ঠিক তার প্লেটের মতোই স্যুপ। না কোনো স্পাইসি ফ্রাইড চিকেন, না কোনো রোস্টেড বিফ, না একটুও ঝাল বা তেলে ভাজা কিছু।
সে অবাক হয়ে মুখ তুলে জিজ্ঞেস করল, “প্রিন্স, তুমি এইসব কেনো খাচ্ছো? এত ভালো ভালো খাবার টেবিলে রেখেও আমার এই একঘেয়ে খাবারটাই তোমার পছন্দ হলো?”
জ্যাসপার মাথা নাড়ল। ঠোঁটে এক প্রশান্তির হাসি। তারপর চেন শিংয়ের দিকে একবার তাকিয়ে বলল, “তোমার পছন্দের খাবার যখন তোমার খাওয়া নিষেধ, সেটা আমি কিভাবে খাই? তুমি যখন চোখের সামনে সেই খাবার খেতে পারবে না, তখন আমি কীভাবে অবলীলায় তা উপভোগ করবো?”
সে ফিওনার দিকে একটু ঝুঁকে এসে গম্ভীর কিন্তু কোমল গলায় বলল, “বেবি তো তোমার একার নয়, আমাদের দু’জনের। তাহলে সেক্রিফাইস কেনো একা শুধু তুমি করবে? দুজনকেই করতে হবে। আমি সবসময় তোমার পাশে থাকবো মানে —সুখে, দুঃখে, কষ্টে, এমনকি খাবারের টেবিলেও।”
ফিওনার গাল হালকা লাল হয়ে উঠল। তার চোখে তখন কেবল একটিই ছায়া—ভালোবাসা। নিঃশব্দে সে জ্যাসপারের হাতটি স্পর্শ করল টেবিলের নিচ দিয়ে,যেন বলে উঠল, “এই ভালোবাসা যদি নিষেধেও বাঁধা পড়ে, তবুও সেটা আমার জীবনের সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়।”
আলোয় ঝলমলে মঞ্চ। চারদিক ক্যামেরার ফ্ল্যাশে ঝলসে উঠছে। ভেতরে ঢুকতে থাকা অতিথিদের তালিকায় দেশের বড় বড় হাসপাতালের ডিরেক্টর থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরাও আছে।
উৎসবমুখর পরিবেশ। কারণ আজ ঘোষিত হবে ‘চায়না’স বেস্ট ডক্টর অ্যাওয়ার্ড’। হাজারো চিকিৎসকের মধ্য থেকে বাছাইকৃত পাঁচজন সেরা মনোনীত চিকিৎসকের মধ্যে যিনি পাবেন সবচেয়ে বেশি পাবলিক ভোট, তাকেই দেওয়া হবে এই বছরের গোল্ডেন মেড-অ্যাওয়ার্ড।
ঘোষক মঞ্চে উঠে বললেন, “এবছরের সবচেয়ে ভোটপ্রাপ্ত চিকিৎসক, যিনি তরুণ বয়সেই একের পর এক সফল অস্ত্রোপচার, দুর্লভ কেস হ্যান্ডেল এবং নতুন মেডিক্যাল রিসার্চে চীনকে গর্বিত করেছেন… তিনি হচ্ছেন – ডঃ লিউ ঝান!”
সমগ্র অডিটোরিয়ামে এক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা, তারপরেই তুমুল করতালি আর হর্ষধ্বনি। সামনে বসে থাকা লিউ ঝান স্থির চোখে মঞ্চের দিকে তাকিয়ে ছিলো। তার পাশের সহকর্মীরা দাঁড়িয়ে পড়েছে উল্লাসে। লিউ ঝান ধীর পায়ে মঞ্চে ওঠলো। তার পরনে ছিল সাদা মেডিক্যাল কোটের উপর কালো স্যুট, চোখে আত্মবিশ্বাসের দীপ্তি। অ্যাওয়ার্ড গ্রহণ করে মাইকের সামনে এসে সে বললো— “আমি এই সম্মান তাদের উৎসর্গ করছি, যারা নির্ঘুম রাত কাটান শুধু অন্যের প্রাণ বাঁচাতে। চিকিৎসক হওয়া মানে শুধু পেশা নয়—এটা এক ধরনের প্রতিজ্ঞা। ধন্যবাদ আমাকে এই দায়িত্বের যোগ্য মনে করার জন্য।” তার কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ক্যামেরার ঝলকানি আরও তীব্র হয়ে ওঠলো।
বাইরে বের হওয়ার সময় প্রায় শত শত তরুণী ছাত্রী, নার্স, এবং মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থীরা তাকে ঘিরে ধরলো। কেউ বলছে— “ডক্টর ঝান, একটা সেলফি প্লিজ!”
“আপনি আমার অনুপ্রেরণা!”
“এই মেডাল আপনার মতো হ্যান্ডসাম ডক্টরেরই প্রাপ্য!”
এক পর্যায়ে নিরাপত্তার লোকদের হস্তক্ষেপ করতে হয় ভিড় সামাল দিতে। কিন্তু লিউ ঝান হাসি মুখে সকলের অনুরোধ রাখলো। কারো ফোনে সেলফি, কারো মেডিক্যাল বইয়ে অটোগ্রাফ, আবার কেউ নিজের সাদা কোটে তার সাইন নিলো।
ডক্টর লিউ ঝান এখন শুধু একজন চিকিৎসক নন, হয়ে উঠেছেন চীনের তরুণ প্রজন্মের এক আইকন। তার চিকিৎসা দক্ষতা, ব্যক্তিত্ব এবং দায়িত্ববোধ মিলিয়ে সে হয়ে উঠেছে একজন আধুনিক দিনের নায়ক।
আজকের দিনটা ছিল অন্যরকম। হাজারো ভিড় আর করতালির মধ্য দিয়ে “চীনের সেরা চিকিৎসক” পুরস্কার পাওয়া লিউ ঝান এখন একেবারেই একা বসে আছে সাদা টেবিল ক্লথ ঢাকা একটি টেবিলে। তাঁর পরনে নেভি-ব্লু ওভারকোট, চোখে একরাশ ক্লান্তি। রেস্তোরাঁয় টুং টাং সুর বাজছে। আজ তার বাবা-মার জোরে ব্লাইন্ড ডেটে আসতে হয়েছে তাকে। মেয়েটি সুন্দরী, মার্জিত, চীনের এক নামকরা উদ্যোক্তার মেয়ে। কিন্তু… লিউ ঝানের হৃদয়ে কারো জন্য জায়গা ফাঁকা নেই। সে মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে বারবার দেখছে অন্য এক মুখ।
“অ্যাকুয়ারা”
তার চোখে ভেসে ওঠে সেই গভীর আকাশী রঙের চোখের চাহনি, সেই সাহসী আর কোমল কণ্ঠস্বর, সেই একটুখানি হাসি—যা পৃথিবীর কোনও ব্যাখ্যায় ধরা পড়ে না। টেবিলের সামনে বসা মেয়েটির ঠোঁট নড়ছে, কথা বলছে, কিন্তু লিউ ঝান শুনছে না কিছুই। সে যেন উপস্থিত হয়েও অনুপস্থিত।
হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো লিউ ঝান। মেয়েটি চমকে উঠল— “কোথায় যাচ্ছেন আপনি?”
লিউ ঝান সংক্ষেপে উত্তর দিলো,”আম সরি!! আমার হৃদয় অন্য কোথাও পড়ে আছে। আমি শুধু একটা শরীর নিয়ে এখানে বসে ছিলাম।”
সে দ্রুত রেস্তোরাঁর দরজা ঠেলে বেরিয়ে গেলো।
রাত তখন গভীর। শহরের সব কোলাহল পেছনে ফেলে লিউ ঝান তার গাড়িতে উঠে পড়লো। অন্ধকার পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি ছুটে চললো। চীনের একদম নির্জন, কুয়াশা ঢাকা পাহাড়ের দিকে গাড়ি এগিয়ে গেলো।গাড়ি থামলো পাহাড়ের সামনে। গাড়ি থেকে নেমেই উঠে গেলো পাহাড়ের চূড়ায়।কুয়াশার পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে লিউ ঝান চোখ বন্ধ করলো। কয়েক সেকেন্ড পরেই তার শরীরের আকৃতি বদলাতে শুরু করলো—চোখ লালচে আভা ছড়াল, পিঠ থেকে পাখার মতো আঁশ বেরিয়ে এলো, বিশাল আকার ধারণ করলো—লিউ ঝান তার আসল রূপে, এক আগুনের ড্রাগন!
একবার বিশাল পাখা মেলে ধরতেই আকাশ থরথর করে কেঁপে উঠলো। “অ্যাকুয়ারা… আমি আসছি,” গর্জন তুলে লিউ ঝান আকাশে উড়ে গেলো—দূর, বহুদূরে… ভেনাসের দিকে, যেখানে তার হৃদয়ের মালিক অপেক্ষা করছে।
চুপিচুপি, কারো চোখে ধরা না পড়ে তাই, সিলভা বেরিয়ে এসেছিল প্রাসাদের পেছনের ছোট্ট গেট দিয়ে। চাঁদের আলোয় তার চুল ঝলমল করছিলো। হাওয়া হালকা ঠাণ্ডা, কিন্তু হৃদয়ের ভিতর যেন অদ্ভুত এক উত্তাপ।
পেছনে ধীরে ধীরে ছায়ার মতো এক অবয়ব এগিয়ে এলো—এথিরিয়ন। তার হাতে ছিল একটি ছোট্ট জ্বলন্ত আলো, যেন তার আগুনের হৃদয় থেকেও উষ্ণতর।
“ইউ নো?,” সিলভার পাশে এসে দাঁড়িয়ে এথিরিয়ন মৃদু স্বরে বলল, “এই রাতটা আমি অনেক দিন ধরে চাইছিলাম—শুধু আমাদের জন্য।”
সিলভা এক ঝলকে তাকালো তার চোখে, যেখানে ছিল শুধু সততা আর একরাশ প্রশ্রয়। তারা ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগল বাগানের সরু পথ ধরে, দুই পাশে সুগন্ধি ফুল, ওপরে আকাশে ছড়ানো তারা। এথিরিয়ন মাঝেমধ্যে মাটিতে আগুনের দাগ টেনে পথের ওপর ছোট ছোট শিখা জ্বালাচ্ছিল—তাদের জন্য আলো, আর যেন ভালোবাসার সাক্ষী।
চাঁদের আলোয় প্রাচীন বাগানের পাথরের সিঁড়ির ধারে বসে ছিল সিলভা আর এথিরিয়ন। বাতাসে ফুলের গন্ধ, চারপাশে নিস্তব্ধতা। সিলভার হালকা বেগুনি চুলগুলো বাতাসে হালকা নড়ছিল আর এথিরিয়নের চোখ স্থির ছিল তার মুখের দিকে।
“তোমার চোখে আমি আমার ভবিষ্যৎ দেখি,” এথিরিয়নের কণ্ঠ ছিল গাঢ় আর থমথমে, কিন্তু হৃদয়জুড়ে কোমলতা।
সিলভা কিছু বলল না। শুধু ধীরে ধীরে মুখ ঘুরিয়ে এথিরিয়নের চোখে তাকালো। সেই চোখে ছিল আগুনের শক্তি, কিন্তু প্রেমের আতিথ্য।
হঠাৎ যেন মুহূর্ত থেমে গেল। এথিরিয়ন তার আঙুল বাড়িয়ে সিলভার গালের পাশ ছুঁয়ে বলল— “তোমার ঠোঁটে এত প্রশ্ন জমে আছে… আমারতো উত্তর দিতে ইচ্ছে করছে।”
সিলভার শ্বাস ভারী হয়ে এলো। তারপর সে চোখ বন্ধ করলো। এথিরিয়ন ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো, তাদের নিঃশ্বাস মিলতে লাগলো… আর ঠিক সেই সময়, খুব ধীরে, খুব সতর্কভাবে, যেন কোনো পবিত্র প্রতিজ্ঞার মতো, সে তার ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো সিলভার ঠোঁটে।
চুম্বনটা ছিল প্রথম সূর্যোদয়ের মতো—ধীরে, নরম, আর সত্যি।সিলভা একটু কেঁপে উঠলো। তারপর তার হাত এথিরিয়নের গলার পেছনে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো। মুহূর্তটি দীর্ঘ হলো, যেন সময় নিজেই তাদের জন্য কিছুটা ধৈর্য ধরলো।
চুম্বনের পর দুজনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ ছিল। কেবল হৃদপিণ্ডের শব্দ… আর ভালোবাসার নিঃশব্দ প্রতিধ্বনি বাজতে লাগলো।
সকালটা শুরু হয়েছিল এক অদ্ভুত প্রশান্তি নিয়ে। সূর্য যেন একটু বেশি উজ্জ্বল আজকে, বাতাসে যেন আজ অন্যরকম হালকা উৎসবের গন্ধ। ফিওনা যখন জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরের দিকে তাকালো, তখন সে দেখতে পেল জ্যাসপার ইতিমধ্যেই প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে—তার পড়ে কালো ওভারকোট আর তার চোখে সেই চেনা আত্মবিশ্বাস, আর ঠোঁটে এক স্নিগ্ধ হাসি।
“আজকে তোমার জন্য একটা অন্যরকম দিন হতে যাচ্ছে, হামিংবার্ড,” জ্যাসপার বলল, “আজ তুমি জানবে পৃথিবীতে আমার পদচিহ্ন কোথায় কোথায় ছড়ানো।”
ফিওনার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল। সে জানতো জ্যাসপার সাধারণ কেউ নয়, কিন্তু আজকের দিনটা যেন তার সমস্ত ধারণা ভেঙে দিতে চলেছে।
এদিকে আলবিরা আর থারিনিয়াস সকালে বেরিয়ে পড়েছে নতুন প্রজেক্টটা নিয়ে একটি বৈশ্বিক কোম্পানির ক্লায়েন্টদের সঙ্গে মিটিংয়ে। ওদের পৃথিবীতে আগমনের একটি বড় উদ্দেশ্য ছিল এই প্রজেক্টের বিস্তার।
আর জ্যাসপার? সে ফিওনাকে নিয়ে রওনা দিল।
প্রথমে তারা গেল একটি বিশাল টাওয়ারে—“Draconis Global Technologies”। ভবনটির গ্লাস দেওয়ালগুলো সূর্যের আলোয় হীরের মতো ঝলমল করছিল। জ্যাসপার দেখাল—এটি তার প্রথম পৃথিবীর ইনভেস্টমেন্ট, যেখানে তারা সুপারকম্পিউটিং এবং মহাকাশ গবেষণা নিয়ে কাজ করে।
তারপর একে একে তারা গেলো ‘Eldr Crystal Resorts’—বিশ্বের দামি হোটেল চেইনের একটির মালিক সে।
Venura Fashion House—বিশ্বখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইন ব্র্যান্ড, যার ইনভেস্টর জ্যাসপার।
DragonCore Energy—একটি শক্তি উৎপাদনকারী সংস্থা, যারা ভিনগ্রহীয় প্রযুক্তিতে পৃথিবীতে সবুজ শক্তির বিপ্লব ঘটাচ্ছে। ফিওনা চুপচাপ গাড়িতে বসে ছিল, কিন্তু তার চোখ বিস্ময়ে ছলছল করছিল। “তুমি… এত বড়ো কিছু করো?” ফিওনা ফিসফিস করে বললো। জ্যাসপার হালকা হাসলো।
“তার মানে তুমি… বিলিয়নিয়ার?” ফিওনা অবাক হয়ে বললো। জ্যাসপার এক ঠান্ডা হাসি দিলো। “উঁহু ট্রিলিয়নিয়ার!! কিন্তু বর্তমানে আমি শুধু একজন হাজবেন্ড, যার সম্পদ তোমার হাসির চেয়ে মূল্যবান নয়।
ফিওনার কণ্ঠে তখনো বিস্ময়ের রেশ, চোখে এখনো ঝিলমিল করছে আগুনের মতো আলো। সে হঠাৎ জিজ্ঞেস করল— “তুমি তো তাহলে ইলন মাস্কের থেকেও ধনী… তাহলে বিশ্বের সবচেয়ে ধনীর তালিকায় তোমার নাম নেই কেনো?”
জ্যাসপার হালকা হেসে তাকালো তার দিকে।
তার চোখে ছিল এক নিঃশব্দ অহংকার আর গভীর নিঃসঙ্গতা সে বলল— “আমি ভেনাসের প্রিন্স। এই পৃথিবীতে নিজেকে হাইলাইট করার কোনো ইচ্ছেই নেই আমার। আমি যা করেছি, করবো—তা ভেনাসের জন্য, আর এখন তোমার আর আমাদের অনাগত সন্তানের জন্য।”
এটা বলেই জ্যাসপার একটু থামলো তারপর তার কণ্ঠ নরম হয়ে গেলো—“তবে যদি কখনো এই পৃথিবীতে কেউ হাইলাইট হয়… সেটা হবে তুমি।”
ফিওনা কাঁপা কণ্ঠে বলল “আমি…?” জ্যাসপার এবার তার দুই হাত ধরে চোখে চোখ রেখে বলল—“হ্যাঁ। তুমি। আমি তোমাকে পৃথিবীর বেস্ট বিজনেস উ-ম্যান বানাবো। তুমি বাঁচবে নিজের পরিচয়ে, আমার পরিচয়ে নয়। তুমি হবে এমন এক নাম—যার পাশে কোনো উপাধির দরকার হবে না। কারণ তুমি এলিসন ফিওনা। আর সেটাই যথেষ্ট।”
ফিওনার বুক কেঁপে উঠলো। সে জানতো, এই মুহূর্তে কোনো রাজ্য, কোনো সিংহাসন, কোনো ডায়মন্ড কিংবা ট্রিলিয়ন ডলারের সাম্রাজ্য—এই একটিমাত্র বাক্যের সমান নয়।
জ্যাসপার ফিওনার হাত ধরে নিয়ে গেল এক আধুনিক, ঝকমকে ভবনের সামনে। ভবনটা যেন মেঘ ছুঁয়ে আছে, পুরোটা কাঁচের গায়ে আঁকা ঝলমলে রুপালি লোগো—
Fionex নিচে ছোট করে লেখা— “Powered by Vision. Inspired by Fiona.”
ফিওনা থেমে গেলো। তার চোখ বিস্ময়ে ছলছল করে উঠলো। “এই… এইটা কী?”—তার গলা কেঁপে উঠল।
জ্যাসপার ধীরে ধীরে বলল— “এই ভবনটা শুধু একটা কোম্পানির অফিস নয়। এটা তোমার স্বপ্নের প্রথম পদক্ষেপ। ফিওনেক্স—তোমার নামে। এটা হবে বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক AI & Space Tech কোম্পানি। আমি শুধু বীজটা দিয়েছি, বাকি সাম্রাজ্য তুমি গড়বে। CEO তুমি, সিদ্ধান্ত তোমার। আমি শুধু ছায়া হবো।” ফিওনা চোখে পানি নিয়ে চুপ করে রইলো। জ্যাসপার সামনে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে বলল—
“আজ থেকে এই ভবনের প্রতিটা দরজা তোমার জন্য।
আমি চাই, পৃথিবী জানুক একজন নারী শুধু প্রেম করতে জানে না— সে গড়তে জানে, লড়তে জানে, নেতৃত্ব দিতেও জানে। তুমি যদি চাও, আমি এই সাম্রাজ্য তোমার পায়ের নিচে বিছিয়ে দেবো।”
ফিওনা তার বুকের ভিতর দিয়ে এক শক্তির ঢেউ টের পেল। এটাই তো ভালোবাসা—যেখানে কেউ তার নিজের পরিচয়ের চেয়ে তোমার স্বপ্নকে বড় করে দেখে।
ফিওনা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে বিশাল ভবনের দিকে, যেখানে ঝকঝকে সোনালি হরফে লেখা —Fionex তার চোখে জল, ঠোঁটে নীরব হাসি। জ্যাসপার চুপচাপ তার পাশে দাঁড়িয়ে রইল, যেন সে ফিওনার প্রতিটা অনুভূতি নিঃশব্দে পড়ে নিচ্ছে। “এত বড় উপহার, এত বড় স্বপ্ন… আমি এখনই কীভাবে শুরু করবো প্রিন্স?” — ফিওনার গলা কেঁপে উঠল।
জ্যাসপার তার কাঁধে হাত রাখলো, গলার নিচে নরম অথচ দৃঢ় স্বরে বলল “না, হামিংবার্ড। এখন তুমি শুধু বিশ্রাম নেবে। একবার আমাদের ছোট্ট বেবিটা নিরাপদে দুনিয়ায় এসে যাক, তারপর তুমি দৌড়াবে তোমার রাজ্যে।Fionex অপেক্ষা করবে, পৃথিবী অপেক্ষা করবে—কিন্তু আমি চাই না, তোমার শরীরের এক বিন্দু ক্লান্তিও তুমি এখন নাও।এখন তুমি শুধু মা হবে—আর আমি তোমার পাহাড়াদার।”
ফিওনা চোখ নামিয়ে নিচের দিকে তাকাল—নিজের পেটের দিকে। যেন ভেতরে কারো ছোট্ট নিশ্বাস সে অনুভব করতে পারছে। সে বলল ধীরে— “তুমি কি আমাকেও কোনো প্রজেক্টের মতো প্রটেক্ট করছো?”
জ্যাসপার হেসে বলল— “না, ফিওনা। প্রজেক্টেরতো একটা সময় রেজাল্ট বের হয়, কিন্তু তুমি আমার হৃদয়ের একমাত্র চিরস্থায়ী মিশন ।”
.
.
.
.
ভোরের আলো তখন ভেসে উঠেছে এলড্র প্রাসাদের সোনালি স্তম্ভে। কিন্তু রাজপ্রাসাদের থ্রোন হল ঘরটি আজকে যেন আগুনে জ্বলছে। এথিরিয়ন নিচু মাথায় দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনে দাঁড়িয়ে রাজা ড্রাকোনিস—ভয়ংকর রূপে, চোখে লাল আগুনের ফুলকি। “ভার্সিটি থেকে সাসপেন্ড?!” — রাজার কণ্ঠ যেন বজ্রের মতন কাঁপিয়ে দিলো দেয়ালগুলো। “তুমি কী শুধু আমার ছেলে? না ড্রাকোনিস বংশের উত্তরসূরি?”
এথিরিয়ন কাঁধ শক্ত করে বলল, “আমার দোষ আছে মানলাম… কিন্তু সেদিন—”
ড্রাকোনিস তাকে থামিয়ে দিলেন হাত তুলে, “তোমার কোনো ‘কিন্তু’ এই বংশের গরিমাকে রক্ষা করতে পারে না। তুমি কি জানো তোমার একেকটা পদক্ষেপ কীভাবে প্রভাব ফেলে সমগ্র রাজ্যে? তুমি যদি নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ না রাখো, আমি কীভাবে বিশ্বাস করবো তুমি একদিন ড্রাগনদের নেতা হবে?” এথিরিয়নের চোখে এবার আগুন নয়, বরং গ্লানির ছায়া। “আমি শুধুই নেতা হতে চাই না বাবা… আমি একজন স্বাধীন ড্রাগন হতে চাই, যার পথ একটু আলাদা। কিন্তু তাতে যদি আপনি লজ্জিত হন—আমি সরে যাবো।”
রাজা ড্রাকোনিস তার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ রইলেন। তারপর গম্ভীর গলায় বললেন— “তোমার আলাদা পথ, যদি আমাদের সম্মান নষ্ট করে, তবে সেটা স্বাধীনতা নয়—দায়িত্বহীনতা। আমি তোমাকে শাস্তি দিচ্ছি না, আমি তোমাকে সময় দিচ্ছি—নিজেকে প্রমাণ করার। আগামী মাসের মধ্যেই তুমি কিছু অর্জন করে দেখাও, নইলে… এল্ড্রের উত্তরাধিকার প্রশ্নের মুখে পড়বে।”
ভোরের সূর্য উঠলেও এলড্র রাজ্যের রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরে যেন এক বিন্দু আলো নেই। প্রাসাদের ট্রোনরুমে তার বাবার গর্জন কাঁপিয়ে দিচ্ছে ছাদের নীচের নীল আগুন। “তোমার ভাইকে দেখো—জ্যাসপার। আর একবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখো। একজন প্রিন্স কীভাবে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী সাম্রাজ্য গড়ে তুললো, অথচ কারো নজরেও পড়লো না! আর তুমি? ভার্সিটি থেকেও সাসপেন্ড!”
এথিরিয়নের বুক ধড়ফড় করলো। সে ধীরে ধীরে বললো, “আপনি সবসময় জ্যাসু ভাইয়ার সাথে আমার তুলনা কেনো করেন বাবা। আমি কোনো প্রিন্স নই…”
“তুমি হতে চাও না, সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি।” রাজা ড্রাকোনিস তাচ্ছিল্য করে ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, “তুমি ড্রাগনদের র*ক্ত বইয়ে বেড়াও, অথচ চরিত্রে নেই কোনো দৃঢ়তা, না কোনো দায়িত্ববোধ। তুমি কাকে নেতৃত্ব দেবে, এথিরিয়ন? এক ঝাঁক উড়ন্ত ভুলকে?”
এথিরিয়নের মুখে রাগের আভাস ফুটে উঠলো, কিন্তু সে চুপ থাকলো। ড্রাকোনিস এবার ধীরে ধীরে আসলো তার কাছে,য়কণ্ঠস্বর হঠাৎ নরম হয়— “তোমার মা চাইতেন, তুমি তার মত কোমল হও। আর আমি চাইতাম, তুমি আমার মতো দৃঢ় হও। তুমি কোনটাই হলেনা…” সেই মুহূর্তে এথিরিয়নের চোখে একফোঁটা জল জমে ওঠলো।
রাতের আলো ঝলমল করছে ফার্স্ট ক্লাস রেস্টুরেন্টের সোনালি দেয়ালে। বিলাসবহুল সজ্জায় ভরা টেবিলের পাশে বসে আছে ফিওনা আর জ্যাসপার। ফিওনার চোখে মিশে ছিল বিস্ময় আর কৌতূহল। সে ধীরে জিজ্ঞেস করল, “প্রিন্স, এতো এতো সম্পদ… তুমি এতো কম বয়সে কীভাবে করলে?”
জ্যাসপার একটু হাসলো, কিন্তু হাসিটা ছিল ভারাক্রান্ত।
তার চোখে ঝলক ফেলছিল অতীতের ছায়া। সে বলল,
“আমার জীবন, ফিওনা, অন্য ড্রাগনদের মতো কখনো ছিল না। আমি জন্মেছি প্রিন্স হিসেবে—আর একজন প্রিন্স মানে ভেনাসের সমস্ত দায়িত্বের বোঝা তার কাঁধে। অর্থ, জলবায়ু, শাসন, সবকিছু। আমার বয়স যখন দশ, তখনই প্রথম পৃথিবীতে এসেছিলাম, শুধু পৃথিবীর সবকিছু পর্যবেক্ষণের জন্য। দশ বছর বয়স থেকেই আমার জীবন কাটে কঠোর পরিশ্রমে। ড্রাগনের মস্তিষ্ক মানুষদের থেকে আলাদা—আমাদের চোখ খুলতেই অনেক জ্ঞান থাকে, তবে আনন্দের সময় ছিল খুব কম আমার জীবনে। যখন অন্য ড্রাগনরা ছোটবেলায় হেসে, খেলে বড় হয়েছে। তখন আমি ভেনাসের ভবিষ্যত গড়ার স্বপ্নে মগ্ন ছিলাম। আমাদের সব সম্পদের ৪০ শতাংশ ছিল ড্রাকোনিসের হাতে। আজ সেই সম্পদ আমি ১০০ শতাংশে নিয়ে এসেছি—ট্রিলিয়ন ডলারের সাম্রাজ্য গড়েছি, কিন্তু এটা শুধুই আমার একার নয়, এটা পুরো ভেনাসের জন্য।” ফিওনার চোখে এক মিশ্র অনুভূতি ফুটে উঠলো—আশ্চর্য আবার গর্বের ছোঁয়া।
জ্যাসপার সামনের কাঁচের জানালার দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। বাতাসে ভেসে আসা রেস্তোরাঁর নরম মিউজিকটাও যেন থেমে গেল তার কানের পাশে।
তার কণ্ঠটা এবার একটু ভাঙা, একটু নিচু হলো।
“আমার মা… খুব ছোট বয়সেই সমাধী হয়ে যান। আর শৈশব?” — সে হালকা মাথা নাড়ল — “আমার শৈশবটা কেটেছে দায়িত্ব আর শাসনের ছায়ায়। আনন্দ ছিল না, স্বাধীনতা ছিল না।লাভ ফাংশনাটাও ছিলোনা। আমার জীবনটা ছিল ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট।” ফিওনা ধীরে ধীরে জ্যাসপারের হাত ধরল। চোখে জল টলমল করছে।
জ্যাসপার এবার ফিওনার চোখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। “কিন্তু যখন প্রথম তোমার প্রেমে পড়লাম… বিশ্বাস করো, সেই সাদাকালো জীবনটা রংধনুর চেয়েও রঙিন হয়ে গেল।”
জ্যাসপার পুনরায় বললো “তোমার প্রেমে পড়ার আগে আমার জীবনটা ছিলো নিঃস্ব এক সাদাকালো পৃষ্ঠা। কিন্তু যেদিন তোমার ছোঁয়ায় প্রথম হ্নদয় স্পন্দন করলো, সেদিন থেকে আমার অন্তরের ক্যানভাসে একে একে জ্বলে উঠলো ষোলো লক্ষ সাতাত্তর হাজার দুইশো ষোলোটি রঙ— পৃথিবীর যত রঙ আছে, তার সবকটিই যেন একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়লো আমার নিঃরঙ অস্তিত্বের উপর।”
ফিওনা তখন আবেগে আপ্লুত হয়ে জ্যাসপারের হাতে চুমু খেলো, সে ভাষা হারিয়ে ফেলেছে কিছু বলার।
গত কয়েকদিনেই যেন ফিওনার জীবনের গতি পাল্টে গেলো। আকাশে ভেসে ভেসে, প্রাইভেট জেটের জানালা দিয়ে পৃথিবীর মানচিত্রকে দেখে ফিওনার মনে হয়েছিল—সে যেন একটা গল্পের পাতায় হাঁটছে।
প্রথম দিন, হংকং-এর কাঁচঘেরা স্কাইলাইন স্পর্শ করে জ্যাসপার বলেছিল, “Origin SilkTech – এশিয়ার সবচেয়ে দ্রুতগতির কমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক, এখান থেকেই শুরু।”
তারপর লন্ডন— বরফঢাকা টেমস নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে ফিওনা দেখেছিল Origin BioInvest-এর সদর দফতর। জ্যাসপার বলেছিল, “ইংল্যান্ডের শত শত তরুণের জীবন আমি বদলেছি এই কোম্পানির মাধ্যমে—ক্যান্সার রিসার্চে বিনিয়োগ করে।”
আমেরিকায়— নিউ ইয়র্কের গগনচুম্বী ভবনের শীর্ষে,
Origin Skyline Media – পৃথিবীর শীর্ষ ৫ মিডিয়া গ্রুপের একটি। “তুমি যখন চাইবে, তোমার কণ্ঠস্বর এই পৃথিবীর শেষ কোণায় পৌঁছাবে,” জ্যাসপার বলেছিল মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে। আরও গিয়েছে দুবাই, জাপান, অস্ট্রেলিয়া—ফিওনার জন্য প্রতিটি অফিসের দরজা খুলেছে। অভ্যর্থনার আলোর নিচে দাঁড়িয়ে সব কর্মচারী সম্মানের চোখে তাকিয়েছে তার দিকে। এক বিকেলে, প্যারিসের এক ছাদ-বাগানে দাঁড়িয়ে ফিওনা বলে ফেলেছিলো “তুমি পুরো পৃথিবীকে নিজের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছো… এ যেন একেকটা রাজ্য, আর তুমি সম্রাটের মতো আমায় তার রানির আসনে বসাচ্ছো।”
জ্যাসপার তখন হেসে বলেছিলো, “এগুলো সব আমার নয়, ফিওনা। এই পুরো সাম্রাজ্য তোমার চোখের আলোয় আলোকিত হচ্ছে। আমি শুধু পথ দেখিয়েছি, কিন্তু তুমি—তুমি আমার শেষ গন্তব্য।”
মাত্র তিনদিন। মাত্র তিনদিনেই লিউ ঝান ভেঙে ফেলেছিল পৃথিবী আর ভেনাসের মধ্যবর্তী সব বাধা। সে এসেছিল ভালোবাসার তাগিদে, ড্রাগনের রূপে সে পৌঁছেছিল এল্ড্র রাজ্যের সীমান্তে।
ভেনাসের আকাশ তখন সন্ধ্যার গাঢ় নীল আর বেগুনি আলোয় ছায়াময়। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে নিরব শব্দে, যেন কোনও হারিয়ে যাওয়া অতীতকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে রাজ্যকে।
লিউ ঝান দাঁড়িয়ে ছিল পাহাড়ঘেরা মূল ফটকের সামনে। গা ভর্তি নীল ওভারকোট তখন ভিজে ভারী হয়ে পড়েছে, যেন পৃথিবীর ক্লান্তি তার কাঁধে লেগে আছে এখনো।কপালের চুলগুলো বৃষ্টির পানিতে লেপ্টে গিয়েছে চোখের কোণ ছুঁয়ে। তবুও তার চোখ দুটো—
দুই জ্বলন্ত অগ্নিশিখার মতোই জ্বলছে।
সে ধীরে ধীরে পা ফেললো এল্ড্রের সোনালি পাথরের মেঝেতে। মাটির প্রতিটা ধুলিকণায়, বাতাসের প্রতিটা শ্বাসে যেন প্রাচীন ড্রাগনদের নিঃশ্বাস লেগে আছে।
এ ছিল রাজকীয়, অপার সৌন্দর্য ও দুঃসহ ইতিহাসে মোড়া এক ভূখণ্ড।
আকাশজুড়ে ভেনাসের সন্ধ্যাবেলা নেমেছে এক মায়াবী বিষণ্নতা। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মাঝে প্রাসাদের ছাদে দাঁড়িয়ে ছিল অ্যাকুয়ারা।তার হাতে ছোট্ট এক রূপার জলপাত্র, স্নেহভরে সে রাজপ্রাসাদের ছাদবাগানে রাখা ফুলগাছগুলোয় পানি দিচ্ছিল।প্রতিটি পাতায়, প্রতিটি ফুলে যেন তার হৃদয়ের কোমলতা ঢেলে দিচ্ছিল সে।
হঠাৎ…কোনো এক অদৃশ্য ডাকে যেন থমকে গেল তার হাত।চোখ দুটো আপনাআপনি ছাদ থেকে দূরে, রাজপ্রাসাদের মূল ফটকের দিকে চলে গেল।
আর তখনই… বৃষ্টির পর্দা ভেদ করে একটা চেহারা ফুটে উঠলো চোখে— নীল ওভারকোটে ভিজে এক ছায়ামূর্তি।কপালে চুল লেপ্টে আছে, চোখ দুটো অদ্ভুত আগুনে ঝলসে উঠছে।
অ্যাকুয়ারা নিঃশ্বাস ফেলে ফিসফিস করে বলে উঠলো,
“লিউ ঝান…?”
শব্দটি যেন হারিয়ে গেল বাতাসে, কিন্তু তার হৃদয় তখন তীব্র স্পন্দনে কেঁপে উঠছে। দীর্ঘদিনের পুরনো মুখ, যাকে সে ভেবেছিল ফিরে আসবে না কখনো…সে দাঁড়িয়ে আছে আবার, এল্ড্র রাজ্যের ঠিক সামনে। ভিজে, নীরব, অথচ প্রতিটি ক্ষণে যেন আকাশ কাঁপিয়ে দিচ্ছে তার উপস্থিতি।
অ্যাকুয়ারার চোখে তখন শুধু একটাই মুখ—লিউ ঝান।
তার হৃদয় যেন এক লহমায় কয়েক বছর পার করে ফেলল।সে আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করলো না। জলপাত্রটি রেখেই ছুটে নেমে এলো ছাদ থেকে, নিজের কক্ষে ঢুকে রাজপরিবারের সিলমোহর খচিত ছাতাটি হাতে তুলে নিলো।বৃষ্টির ধারার তোয়াক্কা না করে বেরিয়ে এলো ছুটে—এক নিশ্বাসে পৌঁছে গেল প্রাসাদের মূল ফটকে।
তার হাতে থাকা ছাতাটি ধীরে ধীরে তুলে ধরলো লিউ ঝানের মাথার ওপর। বৃষ্টি থেমে থাকেনি, কিন্তু তাদের দু’জনের মাঝখানে এখন একটা নীরব আচ্ছাদন।
একটা মুহূর্ত, দুটো দৃষ্টি, অথচ কোনো শব্দ নয়।
লিউ ঝান চুপচাপ হাত বাড়ালো, আর অ্যাকুয়ারা নিঃশব্দে তার হাত ধরলো।তারপর, কোনো প্রহরীর তোয়াক্কা না করে,লিউ ঝান অ্যাকুয়ারার হাত ধরে নিয়ে গেলো রাজপ্রাসাদ থেকে একটু দূরের সেই গোপন ফুলের বাগানের দিকে।সেখানে ছিল ভেনাসের সবচেয়ে অপার্থিব ফুলগুলো, যেগুলোর গন্ধে হৃদয়ের না বলা কথা জেগে ওঠে।লিউ ঝান ধীরে ধীরে অ্যাকুয়ারার চোখের দিকে তাকালো।তার চোখে ছিল দীর্ঘ পথ পেরিয়ে আসা এক নিঃশব্দ ঝড়।হঠাৎই, এক টান দিয়ে সে অ্যাকুয়ারার হাতে ধরা ছাতাটা মাটিতে ফেলে দিলো। ছাতাটা ছোঁ মেরে গড়িয়ে পড়ল ভিজে ঘাসের ওপর।
এক সেকেন্ডের মধ্যেই ঝিরঝিরে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো আছড়ে পড়ল অ্যাকুয়ারার কাঁধে, গালে, চুলে।
সে কেঁপে উঠলো হালকা ঠান্ডায়। চোখদুটো বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে উঠলো, ঠিক তখনই—
লিউ ঝান এক ঝটকায় তাকে বুকে জড়িয়ে ধরল।
এক হাত দিয়ে তার কোমরটাকে শক্ত করে আগলে রাখলো,অন্য হাতে মাথাটা টেনে নিলো নিজের কাঁধে।
বৃষ্টির নিচে, নিঃশব্দে, ধুকধুক করা দুটো হৃদয় এক হয়ে গেলো। চারপাশটা যেন নিঃশেষ হয়ে গেল—
শুধু বৃষ্টির শব্দ,আর হৃদয়ের গভীর নিস্তব্ধতা।
অ্যাকুয়ারা প্রথমে স্তব্ধ, তারপর তার দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগল— এটা কি স্বপ্ন? না কি সত্যিই, এই দীর্ঘ অপেক্ষার শেষ প্রহরে… লিউ ঝান অবশেষে ফিরে এসেছে শুধু তার জন্য?
কিছুক্ষন বাদে লিউ ঝান অ্যাকুয়ারাকে বুক থেকে সরিয়ে বলতে লাগলো। লিউ ঝানের কণ্ঠটা ছিলো ভেজা, ভারি আর একটু কাঁপা। “আমি জানি না, দ্বিতীয়বার ভালোবাসা যায় কিনা… কিন্তু যেদিন তুমি তোমার মনের কথাটা বললে…আর আমি চলে গেলাম পৃথিবীতে… সেদিন থেকেই আমার হৃদয়টা যেন ধীরে ধীরে পুড়ে যাচ্ছিল। কী নাম দেয় সেই অনুভূতিকে, আমি জানি না… কিন্তু জানো অ্যাকু, আমি—আমি ভীষণভাবে মিস করেছি তোমাকে। এটা কি… এটাও কি ভালোবাসা?”
অ্যাকুয়ারা একটু দূরে তাকালো, যেন বৃষ্টির পর্দায় লুকিয়ে আছে তার কথাগুলো।
তারপর ধীরে ধীরে, শান্ত কিন্তু গভীর কণ্ঠে বললো—
“ভালোবাসা দ্বিতীয়বারও হ্নদয়ে ফিরে আসে, ঝান…
যদি সময়টা সঠিক হয়, আর ব্যাক্তিটাও সঠিক হয়… ঠিক এই মুহূর্তের মতো।” তাদের মাঝখানে তখন আর কোনো ছাতা ছিল না, ছিল কেবল ভিজে যাওয়া দুইটা হৃদয়—যারা বুঝে গেছে, ভালোবাসা কখনো একবারেই সীমাবদ্ধ হয়না।
লিউ ঝান একটু থেমে, অ্যাকুয়ারার চোখে চোখ রেখে নরম কণ্ঠে বললো— “তোমাকে পাওয়ার অফারটা কি… এখনও আছে, অ্যাকুয়ারা।”
অ্যাকুয়ারা কিছু না বলে চুপ করে রইলো। হয়তো হাজারটা কথা ঘুরছিল তার মনে, কিন্তু ঠোঁট অবধি কিছুই আসলো না।
লিউ ঝান আস্তে করে তার গালে হাত রাখলো। চোখে অদ্ভুত এক কোমলতা। “জানো, আকাশী রঙটা শান্তির প্রতীক।আর তোমার চোখদুটো… ওখানে পুরো একটা আকাশ লুকানো। আমি সারাজীবন ওই চোখে তাকিয়ে কাটিয়ে দিতে পারবো। তুমি… তুমি একমাত্র মেয়ে যে আমার অতীতকে বুঝেছো, সম্মান করেছো। আমার মনের ভিতরকার যুদ্ধগুলো বুঝতে চেয়েছে। আর তখনও তুমি আমার পাশে থাকতে চেয়েছো… তোমাকে আমি কীভাবে হারিয়ে ফেলি, অ্যাকু?”
বৃষ্টির ফোঁটা তখন দুজনের গা বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে,
কিন্তু তাদের হৃদয়ের মাঝে এক উষ্ণতার স্রোত বইতে শুরু করেছে। অ্যাকুয়ারা হঠাৎই থেমে গেল। চোখদুটো কিছুক্ষণ স্থির লিউ ঝানের চোখে, তারপরেই নিঃশব্দে গড়িয়ে পড়লো প্রথম অশ্রুবিন্দুটা।
কোনো শব্দ ছিল না—শুধু বৃষ্টির ফোঁটা আর ভেজা নিশ্বাসের মাঝখানে, অ্যাকুয়ারার কান্না যেন এক সুরহীন সংগীত হয়ে বেজে উঠলো। সে মুখ ঘুরিয়ে ফেলার চেষ্টা করলো, কিন্তু লিউ ঝানের হাত ছাড়লো না তার মুখ।
লিউ ঝান ফিসফিস করে বললো— “কাঁদো… কাঁদো অ্যাকুয়ারা। আমি এখানে আছি। এবার আর পালিয়ে যাবো না।”
অ্যাকুয়ারা কাঁদতে কাঁদতে বললো— “তুমি জানো না… আমি কতদিন এই শব্দগুলো শুনতে চেয়েছি… তুমি ফিরবে—এই বিশ্বাসটুকু নিয়েই আমি ছিলাম…”
তার কণ্ঠ ভেঙে পড়েছে, কিন্তু সে আর নিজের আবেগ লুকাতে পারছে না।লিউ ঝান তাকে আরও কাছে টেনে নিলো, বৃষ্টিভেজা শরীরে আঁকড়ে ধরলো গভীর ভালোবাসায়। এ মুহূর্তে ভেনাসের আকাশও হয়তো একটু নরম হয়ে এসেছে।
লিউ ঝান বুঝে উঠতে পারছিল না কীভাবে থামাবে অ্যাকুয়ারার অঝোর কান্না। তার সমস্ত শক্তি, সমস্ত যুক্তি যেন অকার্যকর হয়ে গিয়েছে ঐ কয়েকটি অশ্রুবিন্দুর সামনে।তার হৃদয়টা কেঁপে উঠলো— “এই কান্না, আমি আর সহ্য করতে পারছি না…” লিউ ঝান আর এক মুহূর্তও নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না। অ্যাকুয়ারার ভিজে চুল, অশ্রুসজল আকাশী চোখ, কাঁপতে থাকা ঠোঁট—সবকিছু যেন আগুন ধরিয়ে দিল তার হ্নদয়ে।
লিউ ঝান আচমকা এগিয়ে এলো,কোনো পুর্ব ঘোষনা ছাড়াই এক উগ্র আবেগে, এক তীব্র টান আর না-পাওয়ার যন্ত্রণায়, ঠোঁট বসালো অ্যাকুয়ারার ঠোঁটে। সেই চুম্বনে ছিল ক্ষতবিক্ষত একটা আকুতি—না পাওয়া দিনের রাগ, অপেক্ষার ব্যথা আর ভালোবাসার দাবী—সব মিশে এক হয়ে গিয়েছিলো সেই চুম্বনে। অ্যাকুয়ারা প্রথমে হতভম্ব হয়ে পড়ে, কিন্তু পরের মুহূর্তেই নিজের সমস্ত দ্বিধা ভেঙে সাড়া দেয় সেই চুম্বনে।
বৃষ্টি ঝরছিল, ফুলেরা কাঁপছিল, আর লিউ ঝান অ্যাকুয়ারাকে বুকে টেনে নিয়ে ধীরে ধীরে বাগানের নরম ঘাসের ওপর শুয়ে পড়ে চুম্বনরত অবস্থায়,
আযদাহা সিজন ২ পর্ব ৩৯
তার বুকের ওপর ছিল অ্যাকুয়ারা, আর দুই জোড়া ঠোঁট তখনও লেগে আছে একে অপরের সঙ্গে— অন্ধকার আকাশের নিচে, বৃষ্টিভেজা ভেনাসে, দুইটি হৃদয় তখন নীরবে একে অপরের কাছে আত্মসমর্পণ করছিলো।