আযদাহা সিজন ২ পর্ব ৪৪
সাবিলা সাবি
ফ্লোরাস রাজ্যের আকাশ আজ যেন অস্বাভাবিকভাবে শান্ত। এথিরিয়নের চোখে সেই শীতলতা গা ছমছমে লাগছে। বন্ধুর কাছ থেকে খবর পেয়েই আর দেরি না করে উঠে পড়েছে ওর বন্ধুর গাড়িতে। গাড়ির গ্লাস দিয়ে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে—মাথায় একটাই প্রশ্ন ঘুরছে, “সিলভা সত্যিই কি…?”
ফ্লোরাসের সীমান্ত ছুঁয়ে রাজ্য প্রাসাদের গেটে পৌঁছাতেই চোখে পড়লো—সবকিছু যেন স্বাভাবিক। বাইরে কোথাও কোনও সাজসজ্জা নেই, না কোনো বাজনা, না কোনো অতিথির ভিড়। যেন কিছুই হচ্ছে না এখানে।
“ভেতরে বিয়ে হচ্ছে, অথচ বাইরের দুনিয়া টেরও পাবে না? এটা কেমন বিয়ে?” — বন্ধুকে বলেই নেমে পড়লো এথিরিয়ন।
প্রবেশদ্বার পার হতেই ভেতরের বাগানের কাছে এসে থমকে গেলো। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে এক রাজকীয় স্টেজ—ফুল, সোনালি রঙের কাপড়, হালকা আলো, আর শান্ত এক আবহ।
এথিরিয়নের চোখ সোজা চলে গেলো মঞ্চের দিকে।
সেখানে দাঁড়িয়ে আছে সিলভা—চোখে অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা নিয়ে,পরনে রাজকীয় ব্রাইডাল গাউন, মুখে রয়েছে ম্লান হাসি। তার পাশে দাঁড়িয়ে এক পুরুষ, গা থেকে ছড়িয়ে পড়ছে শক্তি আর উচ্চবংশীয় অহংকারের গন্ধ।
এথিরিয়নের দৃষ্টি ছুঁয়ে গেলো সেই পুরুষের চোখে—ক্যালিক্সের বড় ভাই।
সে মুহূর্তে যেন চারপাশের আওয়াজ থেমে গেল।
এথিরিয়নের বুকের ভেতরে আগুনের মত এক ব্যথা ছড়িয়ে পড়লো।
“তুমি সত্যিই এই পথ বেছে নিলে, সিলভা?” — তার মনের ভিতরে গর্জন উঠলো।
আকাশে সূর্যটা তখনো রোদ ঢালছে, কিন্তু এথিরিয়নের ভেতরের আকাশ কালো হতে শুরু করেছে…
স্টেজে যখন পুরোহিত মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করলো, ঠিক তখনই এক অপ্রত্যাশিত গর্জন ছড়িয়ে পড়লো পুরো বাগানে—
“সিলভা!”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সবাই ঘুরে তাকালো। রাজ্যরক্ষীরা হাত বাড়াতে যাচ্ছিল, কিন্তু সামনে এসে পড়লো এক পরিচিত মুখ।
এথিরিয়ন।চোখে আগুন, মুখে হতাশা আর গলার স্বরে চিৎকার— “তুমি এই বিয়ে করতে পারো না! সিলভা, তুমি জানো তুমি এটা করতে পারো না। তুমি তো আমাকে ভালোবাসো। তাহলে কেনো?”
স্টেজের ওপর কাঁপতে থাকা চোখে তাকিয়ে রইলো সিলভা। তারপর ধীরে ধীরে ঠোঁট কাঁপিয়ে বলল— “আমি কি করতাম, রিয়ন?”তুমি তো আমাকে কিছু না জানিয়ে চলে গেলে। কোথাও নিখোঁজ হয়ে গেলে, একটা শব্দও বললে না। আমার কি কিছুই জানার অধিকার ছিল না?তুমি কি একবারও ভেবেছিলে আমার কথা? আমি কীভাবে কাটিয়েছি সেই দিনগুলো?”
এথিরিয়নের ঠোঁট শুকিয়ে এল। সে কিছু বলতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই সামনে এসে দাঁড়ালেন রাজা জারেন।
রাজা জারেন দৃঢ় গলায় বললেন— “এথিরিয়ন, এটা আর কোনও সাধারণ মঞ্চ নয়। এটা আমার কন্যার বিয়ের স্টেজ। তুমি এখানে এসে এইভাবে সিনক্রিয়েট তৈরি করতে পারো না।”
তিনি আরো যোগ করলেন, “তুমি আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুর ছেলে, আর আমাদের আত্মীয়ও, সেটা ঠিক। কিন্তু তার মানে এই না যে তুমি আমার মেয়ের জীবন নিয়ে এমনভাবে হস্তক্ষেপ করবে। এখনই দয়া করে ফিরে যাও।”
এথিরিয়নের হাত দুটো কাঁপছে, চোখে জল, ঠোঁটে অভিমান।
তার চোখ তখনো সিলভার দিকে— “তোমার চোখে এখনো আমার জন্য ভালোবাসা আছে, সিলভা। এই বিয়ে তুমি নিজ ইচ্ছায় করোনা। পরিস্থিতর চাপে পড়ে করছো আমি জানি।”
স্টেজে দাঁড়িয়ে থাকা বর তখন এক পা এগিয়ে এসে তাকালো এথিরিয়নের দিকে—চোখে তীক্ষ্ণতা।
চারপাশে থমথমে পরিবেশ। আর সেই নিস্তব্ধতার মাঝেই শুরু হলো একটা যুদ্ধ—ভালবাসা বনাম সম্মান, সত্য বনাম কর্তব্য।
বাগানে সাজানো রাজকীয় স্টেজের ওপরে উঠে গেল এথিরিয়ন। এথিরিয়ন সিলভার হাত ধরে ফেলে— “আমি ছাড়া ওর হাত কেউ ধরতে পারবে না!”
হঠাৎই লিয়ারা রেগে ওঠে। “গার্ড!”
তার আদেশে দু’জন রাজ্যপ্রহরী এগিয়ে এসে এথিরিয়নের দুই হাত ধরে ফেলে।
“ছাড়ুন! ছাড়ুন আমাকে!” — এথিরিয়নের চিৎকারে বাতাস কেঁপে ওঠে।
লিয়ারা সামনে এগিয়ে এসে ঠান্ডা কিন্তু নির্মম কণ্ঠে বলে—
“তুমি কি ভেবেছো, এসব করে পার পাবে? কী আছে তোমার? নিজের কিছু নেই—না টাকাপয়সা, না উপাধি। ভাই আর বাবার ছায়ায় বাঁচো তুমি। বলো তো, তুমি কি পারবে সিলভাকে একটা রয়্যাল লাইফ দিতে? পারবেনা তো? তাহলে কেনো তার হাত চাইছো?”
এথিরিয়ন থেমে যায় এক মুহূর্ত। চোখে জল না থাকলেও কণ্ঠ ভারী। “আমি সিলভাকে ভালোবাসি। আর ও—ওও আমাকে ভালোবাসে। দুটো হ্নদয় একসাথে থাকার জন্য এটাই যথেষ্ট।”
তার সেই দৃঢ় উচ্চারণে যেন কিছুক্ষণের জন্য নীরবতা নেমে আসে পুরো প্রাসাদবাগানে। বাতাসে ভাসে অজস্র প্রশ্ন।
এল্ড্র রাজ্যের চূড়ার সেই প্রাসাদটির প্রশস্ত বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে জ্যাসপার। পেছনে ধীর হাওয়ায় দুলছে নীলচে সিল্কের পর্দা, সামনের আকাশজুড়ে নেমে এসেছে সন্ধ্যার নরম আলো।
চোখ ধাঁধানো সেই আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকেও, আজ তার চোখ অন্য কিছু খুঁজছে—ভেতরে ভেতরে কিছু একটার ওজন যেন বুকের ওপর চেপে বসেছে।
এথিরিয়নের সেই কথাগুলো এখনো কানে বাজছে…
“সবকিছু তুমি একাই কেনো পেয়েছো, জ্যাসু ভাইয়া? টাকা, সম্মান, ভালোবাসা—সব! এমনকি বাবা, সেও তোমাকে বেশি ভালোবাসে!”
জ্যাসপার চোখ বন্ধ করলো। তার চওড়া কাঁধ যেন মুহূর্তেই ভারী হয়ে উঠেছে।ছোট ভাইয়ের মুখে এমন কথা… এমন অভিযোগ…একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে, জ্যাসপার ঠোঁট শক্ত করে চেপে ধরে।সে জানে—এই কথাগুলো অভিমানের। রাগের। ভাঙা মনের ছায়া।
তবু…
তবুও বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে। কারণ ওই ‘ভাইয়া’ শব্দটার ভেতর যে একটা ভালোবাসা ছিল, একটা নির্ভরতা ছিল, তা আজ ব্যথা হয়ে ছুরির মতো বিঁধেছে।
“আমি তো কখনও চাইনি ও এমন ভাবুক,”
চিন্তায় বলে ওঠে জ্যাসপার। “সবই ভাগ্য… রাজ্য… দায়িত্ব। অথচ ওর কণ্ঠে যে রাগ, সে কি জানে আমি কতখানি ওকে ভালোবাসি?”
তাকে ডেকে উঠলো পাহাড়ের নীরবতা।
এক মুহূর্তের জন্য তার ডান হাত নিজেই বুকের ওপর চলে এলো — যেন ছোট ভাইয়ের সেই কথার ঘা সামলাতে চাইছে।
পেছন থেকে হালকা পায়ের শব্দ। এল্ড্র রাজ্যের পশ্চিম পাশের বারান্দায় নির্জন দুপুরের আলো পড়েছে সোনালী আভায়। ছায়া আর আলোয় খেলা করে চলেছে জ্যাসপারের চওড়া পিঠ জুড়ে। সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে, চোখ তার দূরে কোথাও—যেন অনন্ত শূন্যে এক উত্তর খুঁজে ফিরছে।
ফিওনা ধীরে ধীরে এসে দাঁড়াল তার পেছনে। জ্যাসপার তাকে লক্ষ্য করেনি, কিন্তু সে বুঝতে পেরেছিল—এই স্তব্ধতা কেবল নীরবতা নয়, এ এক গোপন কষ্টের ভার।
“তুমি ঠিক আছো প্রিন্স?” – ফিওনার কণ্ঠটা ছিল নরম, ধীরে ধীরে ছুঁয়ে গেল জ্যাসপারের আত্মাকে।
জ্যাসপার ধীরে ঘুরল, চোখে একটু কুয়াশা, ঠোঁটে একটা অসমাপ্ত কথা। সে কিছু বলল না। শুধু এক মুহূর্ত চেয়ে দেখল ফিওনার চোখে, তারপর…
…আচমকা শক্ত করে জড়িয়ে ধরল তাকে।
ফিওনার দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অনুভূতি হলো—জ্যাসপারের বাহুতে ছিল একটা হালকা কম্পন। শক্তিশালী ড্রাগন হলেও, এই মুহূর্তে সে যেন ভেঙে পড়তে বসেছে।
“আমি খারাপ ভাই হতে চাইনি কখনোই…” — জ্যাসপারের কণ্ঠ নীচু, কিন্তু তীব্র আবেগে ডুবে ছিল। “তবুও আজ ওর চোখে আমি এক প্রতিযোগী, এক প্রতিদ্বন্দ্বী… ভাই নই।”
ফিওনার চোখ ছলছল করল। সে মাথা রাখল জ্যাসপারের বুকের উপর। “তুমি কেবল ভাই না, তুমি আশ্রয়, তুমি আলো। হয়তো এথিরিয়ন এখন বুঝতে পারেনি, কিন্তু একদিন সে ঠিক বুঝবে। কষ্টের শব্দ সবসময় সত্য নয়, বুঝলে?”
জ্যাসপার কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর একটুখানি মাথা নাড়ল।
ফিওনার কোমল হাতগুলো এখনও জ্যাসপারের পিঠে রাখা, চোখে এক ধরণের আশ্বাস। কিন্তু সেই মুহূর্তেই এল্ড্র প্রাসাদের এক দায়িত্বশীল গার্ড দ্রুত হেঁটে এল বারান্দায়। তার মুখ থমথমে, চোখে তীব্র তাগিদ।
“ প্রিন্স অরিজিন!”ফ্লোরাস রাজ্যে আজ রাজকুমারী সিলভার বিয়ে হচ্ছে… এবং এথিরিয়ন কিছুক্ষণ আগে সেখানে পৌঁছেছেন সেখানকার পরিস্থিতি ভালো নয়।”
ফিওনার চোখ বিস্ফারিত হলো। “কি?! এখন? হঠাৎ বিয়ে? মা আমাকে কিছু জানালোনা কেনো…”
জ্যাসপারের মুখ মুহূর্তেই শক্ত হলো। চোখে রক্তিম ক্ষিপ্রতা। আবেগ ভুলে গিয়ে সে এখন একজন বড় ভাই—একজন অভিভাবকের মতো দৃঢ় হয়ে উঠেছে।
সে এক মুহূর্তও নষ্ট করল না। পেছনে না তাকিয়েই বলল,
“গাড়ি প্রস্তুত করো। আমি এখনই ফ্লোরাসে যাচ্ছি।”
ফিওনা চমকে উঠল। “আমি তোমার সঙ্গে যাবো, প্রিন্স।”
জ্যাসপার থমকে দাঁড়াল, ফিরে তাকাল ফিওনার চোখে। তার চোখে স্পষ্ট উদ্বেগ, ভালোবাসা আর এক ধরনের ভয়।
সে ফিওনার গাল ছুঁয়ে বলল ধীরে, “তুমি জানো আমি তোমায় কোথাও একা ফেলে যেতে চাই না। কিন্তু এই মুহূর্তে… সেখানে কী ঘটছে জানি না, কেমন পরিস্থিতি সেটাও জানিনা, তোমাকে এই অবস্থায় আমি ওখানে নিতে পারবোনা।আমি একা যাবো, ফিওনা।”
“ঠিক আছে যাও…” – ফিওনার কণ্ঠ ভাঙা।
জ্যাসপার চোখ বন্ধ করে এক মুহূর্ত দম নিল। “তুমি এখানে থাকো। আমি কথা দিচ্ছি, সব পরিস্থিতি সামলে তবেই আসবো। শুধু আমার জন্য অপেক্ষা করো।”
তারপর, কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে, জ্যাসপার দ্রুত পা চালিয়ে চলে গেল বারান্দা থেকে। বাতাসে উড়তে লাগল তার কালো চুল, চওড়া কাঁধ। পেছনে ফিওনা দাঁড়িয়ে, চোখে চিন্তা। তার ঠোঁট কাঁপছে।
এথিরিয়নের শেষ কথাটার পর যখন চারপাশ থমকে গেছিলো,ঠিক তখন ক্যালিক্স এগিয়ে আসে, গলার স্বরটা কঠোর ও বিদ্রূপে ভর কন্ঠে বললো “তুই.. আবার তুই?তুই প্রথমে এসেছিলি আমার আর সিলভার মাঝখানে। এখন আমার ভাইয়ের বিয়েতেও বাধা দিচ্ছিস?তুই কি সব সময় শুধু নষ্ট করতেই আসিস, এথিরিয়ন?”
সিলভা একটু অস্বস্তি বোধ করে, চোখ নামিয়ে ফেললো।এথিরিয়নের চোখে আগুন জ্বলে ওঠে, কিন্তু সে নিজেকে সামলে রাখে।
এথিরিয়ন ঠান্ডা গলায় বলে “তোর ভাই কি ওর মতামত জানতে চেয়েছে?? ওর সম্মতিতে বিয়ে হচ্ছে, নাকি চাপের মুখে— সেটা জানে তোর ভাই? তোরা কেউই জানিস না সিলভা আসলে কী চায়। কারণ তোরা শুধু নিজেদের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়েছিস সিলভার ওপর।”
ফ্লোরাস রাজ্যের বাগানে আজ পরিস্থিতি অস্বস্তিকর। রঙিন ফুলের গন্ধ, চুপি চুপি বাজা সুর, আর হাজার চোখের সামনে বিয়ের স্টেজে দাঁড়িয়ে আছে সিলভা ও ক্যালিক্সের বড় ভাই।আর তার পাশেই বন্দি গার্ডদের হাতে এথিরিয়ন।ঠিক সেই মুহূর্তেই রাজপ্রাসাদের প্রধান ফটকে জোরে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে যায় একটি গাঢ় নীল রাজকীয় গাড়ি।
প্রহরীরা দৌড়ে আসে। সামনে রাজকীয় পতাকা। তারা চিনে ফেলে… এল্ড্র রাজ্যের প্রিন্স জ্যাসপার অরিজিন!
গাড়ির দরজা খুলে নামল জ্যাসপার।
আজকের এই বিশেষ দিনে—থারিনিয়াস আর আলবিরার বিয়ের জন্য—জ্যাসপার নিজেই পড়েছিল তার রাজকীয় প্রিন্স পোশাক: গাঢ় নীল সিল্কের লম্বা জ্যাকেট, সোনালী বর্ডারে সূচিকর্ম, কাঁধে বেল্ট আর কোমরে রুপার তলোয়ার। পায়ে কালো লেদার বুট, চুল ব্রাশ করা আর চোখে আগুন।
তার গতি যেন এক বজ্রপাতের পূর্বাভাস।
প্রাসাদ চত্বরে ঢুকেই সে দৃশ্য দেখে স্থির দাঁড়িয়ে গেল। এথিরিয়ন, তার ছোট ভাই, রাজপ্রাসাদের মাটিতে গার্ডদের হাতে বন্দি। চোখ লাল, গলা রুদ্ধ, তবুও চিৎকার করছে—
“সিলভা! সিলভা আমি তোমাকে ভালোবাসি!”
চারপাশ স্তব্ধ।তখনই গর্জে উঠল জ্যাসপার— “ছাড়ো আমার ভাইকে!”
সবাই থমকে গেল। প্রহরীরা সরে গেল এক পলকে। কেউ জ্যাসপারের চোখে চোখ রাখার সাহসও পেল না।
সে এগিয়ে গেল এথিরিয়নের কাছে। চোখে যন্ত্রণার ছায়া। বুকের গভীরে জমে থাকা অভিমানের ভিতরে আজ শুধুই ভাইয়ের জন্য ভালোবাসা। “আমার ভাইকে ধরে রাখার সাহস কী করে হয় তোমাদের?”
তার দৃষ্টি ছিন্ন হলো লিয়ারার দিকে। তিনি উঠে দাঁড়ালেন।
“তোমার ভাই বিয়েতে বাধা দিচ্ছে, জ্যাসপার। ওর ভালোবাসা একতরফা। আর রাজপ্রাসাদে এমন বিশৃঙ্খলা মেনে নেওয়া যায় না।”
জ্যাসপার এগিয়ে গেল। শান্ত গলায়, কিন্তু প্রতিটি শব্দ যেন মাটিকে কাঁপিয়ে দেয়—“একতরফা বলছেন আপনি?তাহলে সিলভার চোখে জল কেন? কেন ও চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে? কারণ ওর হৃদয় আজ ভেঙে যাচ্ছে। ভালোবাসা যদি দুইটি হৃদয়ের স্বতঃস্ফূর্ত টান হয়, তবে সেই টানকে ভেঙে ফেলা অপরাধ। আমি আজ আমার ভাইয়ের পাশে দাঁড়াতে এসেছি, কারণ সে কোনো অন্যায় করেনি—সে শুধু ভালোবেসেছে।”
জ্যাসপারের কথাগুলো যেন রাজপ্রাসাদের দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে। সকলের চোখ তার দিকে, তবে সেই নিরবতা ভেঙে এবার এগিয়ে আসে লিয়ারা—ফ্লোরাস রাজ্যের বড় রাজকুমারী, ফিওনার মা।
আজ তার মুখে রাজকীয় কঠোরতা নেই, ছিল শুধু একজন মায়ের ক্ষতবিক্ষত কণ্ঠ। তার চোখ লাল, ঠোঁট কাঁপছে, কিন্তু কণ্ঠে আগুন— “তুমি এখন তোমার ভাইয়ের পক্ষ নিচ্ছো? বলো জ্যাসপার, আমার মেয়েকে কি তুমি জোর করে বিয়ে করোনি?”
জ্যাসপার চুপ। মাথা উঁচু করে তাকিয়ে আছে। “আমার কোমল, শান্ত, নিরীহ মেয়েটাকে তুমি কী বানিয়ে ফেলেছো? ও সাইকো হয়ে গেছে! তার চোখে এখন ভালোবাসা নয়, আছে রক্ত… আমার সেই শিশুর মতো কোমল মেয়ে খুনি হয়ে গেছে, জ্যাসপার। তুমি তাকে এমন করে ফেলেছো!”
তার চোখে জল আসে, কিন্তু সেই জলের ভিতরেও আছে তীব্র রাগ। “ওকে জোর করে বিয়ের আসর থেকে তুলে নিয়ে গেছো। ওকে তোমার সাথে রেখে রেখে তোমার মতো মানসিক ভারসাম্যহীন বানিয়ে ফেলেছো। তুমি ওর ভেতরে এমন কিছু ঢুকিয়ে দিয়েছো! তুমি ভালোবাসা দিতে জানো না জ্যাসপার, তুমি শুধু ধ্বংস করতে জানো!”
চারপাশে স্তব্ধতা। সবার নিঃশ্বাস যেন আটকে গেছে।
“এখন আবার, সেই তোমার অকর্মা, দায়িত্বজ্ঞানহীন ভাই এথিরিয়নের জন্য আমার ভাতিজিকে চাইছো? যে এখনও নিজের ভবিষ্যত স্থির করতে পারে না, বাবার ছায়ায় বাঁচে? যে শুধু আবেগ চেনে, দায়িত্ব না? না জ্যাসপার, আর না! আজ কেউ আর আমাদের বাড়ির মেয়েকে ছিনিয়ে নিতে পারবে না।”
তার কণ্ঠ এক রাজকন্যার মতো, কিন্তু চোখ এক ভাঙা মায়ের। এথিরিয়ন স্থবির। জ্যাসপার এক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করে।রানী লিয়ারার সেই চিৎকার যেন বৃষ্টির মতো আঘাত করে জ্যাসপারের হৃদয়ে। কিন্তু তার ভেতরে একটাই প্রশ্ন উঁকি দেয়— “আমি কি সত্যিই এই পরিণতির কারণ?”
লিয়ারার অভিযোগ-ভরা কণ্ঠ চারদিকে ধ্বনিত হতে থাকে। পুরো সভা স্তব্ধ, গার্ডদের মুখে উদ্বেগ, অথচ জ্যাসপার নিঃশব্দ। তার চোখে যেন শোক আর দহন একসাথে।
তার ঠোঁট একটুখানি কাঁপে। তারপর ধীরে কিন্তু জোরালো গলায় সে বলে— “হ্যাঁ মাদার ইন ল। আমি স্বীকার করছি, আমি আপনার মেয়েকে জোর করে বিয়ে করেছি। আমি জেদি ছিলাম ছিলাম। আমি ততটাই নিষ্ঠুর ছিলাম যতটা আপনি বলছেন।”
তার কণ্ঠে কোনো অজুহাত নেই, কোনো আত্মপক্ষ সমর্থন নেই। শুধু স্বীকারোক্তি। কিন্তু এরপরের কথাগুলো যেন সময়কে থামিয়ে দেয়।
“কিন্তু একটা কথা আপনি ভুলে গেছেন। আমি আমার জীবনের সমস্ত কিছু দিয়ে তাকে ভালোবেসেছি। আর আপনার মেয়েও… আমায় ভালোবেসেছিল। তার হৃদয়ের প্রতিটি স্তরে ছিল আমার ছোঁয়া, আমার ভালোবাসা।”
লিয়ারা চোখ নামিয়ে নেন, কিন্তু জ্যাসপার থামে না।
“যেদিন ওর স্মৃতি আমি মুছে দিয়েছিলাম নিজ হাতে, ও একটা খালি খোলসে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু যদি আজ… এই মুহূর্তে, লিউ ঝানের সাথে তার বিয়ে হতো, আর তার স্মৃতি ঠিক তখনই ফিরে আসতো—তখন আপনি কি ওকে বাঁচাতে পারতেন?”
তার কণ্ঠে ক্ষোভ নয়, প্রশ্ন। তীব্র, প্রশ্ন। “যদি সে বিয়ের দিন হঠাৎ করে মনে পড়তো, আমি তার জীবনের একমাত্র প্রেম? যে হাতটা আজ অন্য কারো হাতে, তা একসময় কাঁপতে কাঁপতে আমার গালে ছোঁয়া দিত—তখন কি সে বেঁচে থাকতো? বলুন,! তখন কি সে আমাকে ছাড়া বাঁচতো?”
সবাই স্তব্ধ। রানী লিয়ারার মুখ সাদা হয়ে যায়। কেউ উত্তর দিতে পারে না।জ্যাসপার চোখ নামিয়ে শান্ত কণ্ঠে বলে—
“আমি নিষ্ঠুর ছিলাম, আমি তা জানি। কিন্তু আমি একজন এমন ভালোবাসার দানব, যে তার ভালোবাসাকে সবকিছু দিয়ে আগলে রাখতে জানে।”
প্রাসাদের বাগানে নিঃস্তব্ধতা।লিয়ারার প্রশ্নের জবাবে জ্যাসপার যেভাবে কণ্ঠ তুলেছে, তাতে বাতাসেরও সাহস নেই নড়ার। এথিরিয়নের চোখ লাল,আর সিলভা স্থির দাঁড়িয়ে—তার চোখে ঝাপসা জল, হৃদয়ে যুদ্ধ।
জ্যাসপার ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে আসে। তার রাজকীয় পোশাক সূর্যের আলোয় ঝলমল করছে, কিন্তু চোখে-মুখে স্পষ্ট এক ক্লান্তি ও যন্ত্রণার রেখা। সে সামনের দিকে তাকিয়ে দৃঢ়ভাবে বলে:” মাদার ইন ল , আমি আপনার কাছে আর কোনো অযৌক্তিক দাবি করবো না। শুধু একটি অনুরোধ করতে এসেছি। আমার ভাই, এথিরিয়ন… তাকে একটু সময় দিন।”
সবাই তাকিয়ে আছে, নিঃশব্দ।”আজ আপনি যদি ওকে সিলভার কাছ থেকে আলাদা করে দেন, ও ভেঙে যাবে। আর একজন যখন ভালোবাসায় ভেঙে যায়, তখন সে কেবল বিপজ্জনক নয়, সে নিজেও নিজের সবচেয়ে বড় শত্রু হয়ে ওঠে।”
জ্যাসপার এবার সিলভার দিকে তাকায়। তারপর ফের লিয়ারার দিকে তাকিয়ে নম্রভাবে মাথা নিচু করে বলে—
“ওদের একসাথে যেতে দিন। আমার দায়িত্বে। ফিওনা যেমন এল্ড্র প্রাসাদে রানীর মতো থাকে, ঠিক সেভাবেই সিলভাও থাকবে। সম্মানে, মর্যাদায়। কোনো অসম্মান হবেনা।”
“আমি কথা দিচ্ছি, এথিরিয়ন অল্প সময়ের মধ্যেই নিজেকে প্রমাণ করবে। যদি না পারে, আমি নিজ হাতে ওকে ফিরিয়ে নিয়ে আসবো। কিন্তু যদি পারে… তবে দয়া করে তখন ওর ভালোবাসার মর্যাদা দিন।”
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে জ্যাসপার একটুখানি থামে। গলার স্বর এতটাই সত্য আর গভীর ছিল যে, কেউ আর বিরোধ করার সাহস পায় না।লিয়ারার ঠোঁট একটুখানি কাঁপে, কিন্তু কোনো শব্দ বের হয় না।
এদিকে সিলভার চোখ ফেটে জল গড়িয়ে পড়ছে। আর এথিরিয়ন… অবশেষে মুক্ত এক নিশ্বাস ফেলে।
নিস্তব্ধতা। সবাই যেন নিশ্বাস আটকে তাকিয়ে আছে। ঠিক তখনই—জ্যাসপার ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে রাজকীয় গর্ব আর এক ভেতরগত শূন্যতা নিয়ে।
সে উঠলো স্টেজে, যেন এল্ড্র রাজ্যের প্রতিটি পদক্ষেপ এখন সেই স্টেজে প্রতিফলিত হচ্ছে।
সিলভা নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে, চোখে এক অজানা বিস্ময় আর আবেগের কুয়াশা। জ্যাসপার সামনে দাঁড়িয়ে হালকা হাত বাড়িয়ে বলে— “চলো, সিলভা। এখানে তোমার জায়গা না।”
সিলভা একটু থেমে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে হাত বাড়ায়। হাত ছুঁয়ে দেওয়া মাত্রই জ্যাসপার ওর হাতটি শক্ত করে ধরে ফেলে।
ঠিক তখনই—”থেমে যাও, জ্যাসপার!”
লিয়ারা সামনে এসে দাঁড়ায়, উত্তেজনায় কাঁপছে গলা। “আমার ভাতিজীর জীবনও নষ্ট করবে তুমি?” তার কণ্ঠে বিষ, চোখে আগুন।
কিন্তু তখনই এক ভারী কণ্ঠ ভেসে আসে— “লিয়ারা!”
রাজা জারেন সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়েন। তার ঠান্ডা অথচ কঠিন কণ্ঠ সবার কানে গিয়ে ধাক্কা মারে।
“থামো। আজ কারও বিয়ে হবেনা এই অবস্থায়। কেউ কারও জীবন নিয়ে খেলতে পারবে না।”
তিনি লিয়ারার দিকে চেয়ে বলেন,”জ্যাসপার যা বলেছে, আমি সেটাই চাই। আমি ওদের দু’জনকে যেতে দিচ্ছি।”
লিয়ারার ঠোঁট কেঁপে ওঠে, কিন্তু তিনি আর কিছু বলতে পারেন না।
এরপর…জ্যাসপার সিলভার হাত ধরে নামিয়ে আনে স্টেজ থেকে। নীচে তখন এথিরিয়ন দাঁড়িয়ে, চোখে অবিশ্বাস আর কৃতজ্ঞতার মিশ্র ছায়া।জ্যাসপার সিলভার হাতটি নিঃশব্দে তুলে রাখে এথিরিয়নের হাতে।
তিনজন একসাথে চলে যায়, প্রাসাদের দিকে নয়—নতুন জীবনের পথে।
পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা ক্যালিক্সের ভাই, চেয়ে থাকে নিঃশব্দে।তার চোখে ক্ষোভ আছে, অপমান আছে—আর একরাশ পরাজয়ের অভিমান।
পর্যন্ত বিকেল নামতেই এল্ড্র প্রাসাদ যেন রূপকথার জগতে রূপ নিয়েছে।
সোনালী আলোর মালায় প্রাসাদের প্রতিটি স্তম্ভ, প্রতিটি করিডোর জ্বলজ্বল করছে। ছাদের ওপরে ঝুলছে বেলজিয়ান ক্রিস্টালের ঝাড়বাতি, আর বাগানে ছড়িয়ে আছে হাজারো স্টারডাস্ট ফুল। আকাশজুড়ে উজ্জ্বল তারা যেন এই শুভক্ষণে আশীর্বাদের গান গাইছে।
দু’টি বর্ণময় স্টেজ।একটিতে থারিনিয়াস দাঁড়িয়ে, পাশে আলবিরা—নীল রঙের হালকা ঝলমলে গাউনে, সোনালী চুলে রত্নজড়িত মুকুট। থারিনিয়াস পরেছে গাঢ় নীল স্যুট, বুকচাপা সোনার এম্ব্রয়ডারি।
অন্যদিকে, এথিরিয়ন হাতে ধরে আছে সিলভার। সিলভা পড়েছে এল্ড্র রাজ্যের ঐতিহ্যবাহী সাদা-রুপালি রাজকীয় ব্রাইডাল গাউন, তার মাথায় ছোট্ট স্ফটিকের টিয়ারা। এথিরিয়ন পরেছে কালো আর রুপালি রঙের সাজে রাজারোপযোগী পোশাক।
আর সবার সামনে—জ্যাসপার। একবার চোখে তাকালেই বোঝা যায়, ওর হৃদয় শান্ত। ফিওনা পাশে দাঁড়িয়ে। আজ সে গর্বিত—কারণ সে জানে, এথিরিয়নের জন্য লড়ে যাওয়ার পরিণতি আজ এই আশীর্বাদপুষ্ট শুভদিন।
বিয়ে শুরু হয়।
রাজপুরোহিত ধ্যানমগ্ন কণ্ঠে মন্ত্র পড়ছেন। যখন চারটি হাত একত্রে বাঁধা হচ্ছে রুপার ফিতেতে, তখনই হঠাৎ চারপাশে বাতাস বদলে যায়।
এক রহস্যময় আলো ছেয়ে ফেলে পুরো প্রাসাদ। হাওয়ার মধ্যে এক অপার্থিব সুগন্ধ, যেন স্বর্গ থেকে নেমে এসেছে কারো উপস্থিতি।
তারপর…
সাদা-সোনালি আলোর ভেতর থেকে আগমন ঘটে এক রাজসিক চেহারার পুরুষ—উচ্চ, দীপ্ত, অনন্ত কণ্ঠে ঘোষণা দেন: “আমি আভ্রাহার, ভেনাস দেবতা।
আজ ভালোবাসা জয়ী হয়েছে।যাদের হৃদয়ে নেই প্রতারণা, যাদের ভালোবাসায় নেই শর্ত— তাদের পথ আমি আলোকিত করি।”
তিনি একে একে চারজনের মাথায় হাত রাখেন।
থারিনিয়াস আর আলবিরার চোখে জল—তারা অবশেষে এক হলো বহু অপেক্ষার পর।
এথিরিয়ন ও সিলভা—তারা একে অপরের চোখে চেয়ে শপথ করে, “আমরা শুধু প্রেমে নয়, সংগ্রামরেও সঙ্গী।”
আকাশ থেকে তখন একঝলক সোনালী পুষ্পবৃষ্টি নামে।
পুরো এল্ড্র রাজ্য গুঞ্জনে গেয়ে ওঠে— “শুভ হোক এই দুটি মিলন। রাজ্য জয় করুক প্রেম।”
রাত গভীর। এল্ড্রে প্রাসাদের বাইরে আলো ঝলমলে উৎসবের শেষ ধ্বনি মিলিয়ে যাচ্ছে। আকাশজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হোলোগ্রাফিক আতশবাজি ধীরে ধীরে নিভে আসে।
জ্যাসপার একা বসে ছিলো তার ব্যক্তিগত কক্ষে। কাউচে বসে মাথাটা পেছনে দিকে হেলান দিয়ে চোখ বুজে রেখেছিলো। তার গায়ে এখনও অনুষ্ঠানের রাজপোশাক—কিন্তু চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ, এক বিষণ্ন প্রশান্তি। হঠাৎ দরজা না ঠুকেই ভেতরে ঢুকে পড়ে এথিরিয়ন।
কাপলে পড়ে থাকা এলোমেলো চুল, চোখ দুটো লাল। সিলভার সাথে বিয়ের পরেও ওর মধ্যে যেন একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছিলো। এক মুহূর্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে, পরের মুহূর্তে হঠাৎই…ধপ!
জ্যাসপারের পায়ের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। দুহাতে জ্যাসপারের পা আঁকড়ে ধরে বলে ওঠে—
“ভাইয়া… জ্যাসু ভাইয়া… আমায় মাফ করে দিও।”
“আমি তখন যা বলেছি… যা করেছি… আমার মাথায় কিছুই ছিল না। আমি ঈর্ষায় পুড়ছিলাম… তোমার মতো হতে চেয়েও হতে পারিনি। আজ বুঝলাম, ভালোবাসা, সম্মান, সম্পর্ক—এসব জোর করে পাওয়া যায় না, অর্জন করতে হয়…”
জ্যাসপার চোখ মেলে তাকায়। প্রথমে কিছু বলে না। শুধু ধীরে ধীরে এথিরিয়নের মাথায় হাত রাখে।
“তুই আমার ভাই, এথিরিয়ন। তোর চোখের জল দেখার মতো কঠিন আমি কখনো ছিলাম না।”
“কিন্তু ভাইয়া… আমি জানতাম না তুমি আমাকে এতটা ভালোবাসো…” জ্যাসপার তখন উঠে দাঁড়ায়, এথিরিয়নকেও টেনে তোলে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে।
“তুই আমার ভাই… তোর প্রতি ভালোবাসা বলে বোঝাতে হয় না। মনে রাখতে হয়। আর আমি তো সেই দিন থেকেই তোর পাশে আছি—যেদিন তুই প্রথমবার উড়া শিখে উড়ে গিয়েছিলি আকাশে, আমাকে দেখাতে…”
দু’ভাই কিছুক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে থাকে—কোনো রাজকীয়তা নয়, কোনো অহংকার নয়—শুধু দুই ভাইয়ের নিঃশর্ত আত্মিক মিলন।
জ্যাসপার ধীরে ধীরে বললো, “এখন থেকে আমরা একসাথে সব করবো, এল্ড্রেকে গড়ে তুলবো, পরিবারকে আগলে রাখবো… রাজপথে না হোক, হৃদয়ে আমি তোকে ঠিক ততটাই রাজপুত্র বানাবো, যতটা আমি নিজে।”
জ্যাসপার তখন এথিরিয়নের কাঁধে হাত রাখে। গলায় এক শান্ত অথচ দৃঢ় সুর— “দেখ, তুই এখনো ছোট রিয়ন। তোর ভিতরে আগুন আছে, কিন্তু ধৈর্য কম। সফলতা হুট করে আসে না। এখন চাইলেও সবকিছু পেয়ে যাবি না—এই বাস্তবতা মানতে শিখ। সাফল্যকে গড়ে তুলতে হয় সময় দিয়ে, পরিশ্রম দিয়ে।”
একটু থেমে জ্যাসপার বলে, “তোর ইউনিভার্সিটির সব ব্যবস্থা আমি করে রেখেছি। পড়াশোনার প্ল্যান, এমনকি প্রজেক্ট গাইড পর্যন্ত ঠিক করা আছে।”
তারপর চোখে চোখ রেখে বলে— “যতদিন না তুই নিজে সফলতা অর্জন করবি, তোর আর সিলভার দায়িত্ব আমার। কিন্তু মনে রাখিস, আমি চাই না তোরা শুধু স্বামী-স্ত্রী হয়ে একসাথে থাক—তোরা একে অপরের শক্তি হয়ে থাকবি। একসাথে পড়শোনা করে,একসাথে গড়ে তোলে নিজের ভবিষ্যৎ।”
“আর সিলভা…” জ্যাসপার হালকা হেসে বললো—”ওর মতো একটা মেয়ে যখন তোর পাশে দাঁড়িয়ে, তখন তুই একদিন ঠিক ওপরে উঠবি—সবার ওপরে।”
এথিরিয়নের চোখে জল।সে ধীরে মাথা নেড়ে বলে— “ভাইয়া, আমি কথা দিচ্ছি… আমি তোমাকে গর্বিত করবো। শুধু ভাই না, একজন শিক্ষক, একজন অভিভাবক হিসেবেও…”
জ্যাসপার কাঁধে হাত রেখে বলে— “আমার চাওয়াই সেটাই। সাকসেস নিজে অর্জন কর, তবেই তার মান থাকবে।”
ঘরের বাতাস তখন ভারী নয়—হালকা। যেন ভবিষ্যতের এক নির্ভার শুরু।
চাঁদের আলো ঢালু হয়ে পড়ছে এল্ড্র প্রাসাদের স্ফটিক করিডোরে। প্রাসাদের প্রাচীন দেয়ালে শীতল রুপালি জ্যোৎস্না যেন এক গোপন প্রেমের নীরব সাক্ষী।
এটি ছিলো সেই রাত — যখন রাজকীয় বিয়ে শেষ হয়েছে,কিন্তু এখনো নতুন বর আর বধুরা এক ছাদের নিচে থেকেও পৃথক।
রাজ-প্রথা মেনে আজ রাতটা আলাদা ঘুমানোর নিয়ম।
আলভিরা আর সিলভা একই ঘরে। তারা বিয়ে নিয়ে হাসাহাসি করছে, লাজুক মুখে কুশনে মুখ লুকাচ্ছে।
থারিনিয়াস আর এথিরিয়ন — পৃথক দুটি ঘরে নিঃশব্দে শুয়ে থাকার কথা ছিল।
কিন্তু…
প্রায় মধ্যরাতে, যখন প্রাসাদের সবাই ঘুমে, তখনই সাদা পোশাকে চুপিচুপি করিডোর ধরে এগিয়ে যাচ্ছিল এথিরিয়ন। ওর চোখে ঝলমলে উত্তেজনা, পায়ে লুকিয়ে রাখা ব্যাকুলতা। গন্তব্য— সিলভার ঘর।
একই সময়ে, করিডোরের অন্য প্রান্তে থেকে বেরিয়ে আসে থারিনিয়াস। কিছুটা অবহেলাভরে হাঁটছে সে। গন্তব্য— আলভিরার ঘর।
হঠাৎ দুজন মুখোমুখি।করিডোরে এক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা।
থারিনিয়াস চোখ টিপে হেসে বলে: — “এই রিয়ন! কোথায় যাচ্ছিস এত রাতে?” এথিরিয়ন ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়: — “তুমি কোথায় যাচ্ছো?”
থারিনিয়াস সঙ্গে সঙ্গে গম্ভীর সুরে বলে: — “আমি তো প্রিন্সর রুমে যাচ্ছি। কাল রিসেপশন আছে, কিছু আলোচনা বাকি।”
এথিরিয়ন মুচকি হেসে বলে: — “মিথ্যে বলছো কেনো? তোমার চেহরায় তো রাজনীতি বোঝাচ্ছে না, বরং কারো সাথে দেখা করার আকাঙ্ক্ষা দেখা যাচ্ছে।”
থারিনিয়াস মুখ লাল করে হেসে ফেলে: — “তুই যা বলিস… আর তোর হাতে ওই ছোট বাক্সটা কি, হুম? নিশ্চয়ই রাজ্যশাসনের চিঠি নয়।”
এথিরিয়ন গলায় গাম্ভীর্য এনে বলে: — “আমি… আমি যাচ্ছি শুধু ওর পাশে একটা গিফট রেখে আসতে… ঘুম ভাঙলে যেন দেখে…”
থারিনিয়াস এবার সামনে এগিয়ে এসে ওর কাঁধে হাত রেখে মুচকি হেসে বলে: — “ভাই, সত্যি কথা বলি, এই ভালোবাসা নামের জিনিসটা বড় অদ্ভুত। ঘুম আসে না… বুক কাঁপে… কিন্তু মুখে বলি ‘আমিও শুধু একটা উপহার রেখে আসবো!’”
আযদাহা সিজন ২ পর্ব ৪৩
এথিরিয়নও হেসে ফেলে: — “আর তুমি? তুমি কী রাখবে ওর পাশে?”
থারিনিয়াস চুপ করে, মুখে এক কোমলতা ফুটে ওঠে: — “আমার মা যেভাবে ছোটবেলায় রাখতেন আমার ঘুমের মধ্যে আমার বিছানার পাশে… একটা চিরুনি। যেন ঘুম ভাঙলে ওর চুলে আমার ছোঁয়া থাকবে।”
দুজনেই একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। দুই প্রেমিক পুরুষ, যাদের হৃদয় নতুন দায়িত্ব, ভালোবাসা আর এক অদ্ভুত মায়ায় পূর্ণ।
এথিরিয়ন হেসে বলে: — “চল, রাজকীয় ড্রাগনরা আজ রাতে প্রাসাদের ভেতরে একটু অনাধিকার চরণ করি।”
থারিনিয়াস কাঁধে হাত রাখে: — “আজ রাতে চাঁদ আমাদের সাক্ষী, ভুল করলেও সে কিছু বলবে না।”
দুজন একসাথে হাঁটতে শুরু করে। করিডোরে পড়ে থাকে একসাথে ছুটে যাওয়া দুই ছায়া।