আযদাহা সিজন ২ শেষ পর্ব
সাবিলা সাবি
বেবির জন্মের কয়েক সপ্তাহ পর, সবকিছু এক রহস্যময় ভারসাম্যে স্থির হয়ে এসেছে। ভেনাসে ফিওনা আর জ্যাসপার এখন একসাথে নতুন জীবনের পথচলায় ব্যস্ত, কিন্তু মহাজাগতিক নিয়ম যেন চুপিসারে নিজস্ব সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে আছে।
সেই রাতটা ছিল এক অদ্ভুত রাত—আকাশ ছিল আগুনের মতো লালচে, হাওয়ায় এক ধরণের ঝিম ধ্বনি।
জ্যাসপার তখন পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে। আর প্রাসাদে ফিওনা আর জ্যাফিওন ঘুমাচ্ছে।
হঠাৎ করে পাহাড়ের আকাশে বিদ্যুৎ খেলে যায়, আর ঠিক তখনই জ্যাসপারের শরীরের ভেতর থেকে আগুনের মতো জ্যোতি ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে।
সে হাঁপাতে থাকে… চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে আগুনের মতো। তাঁর হারিয়ে যাওয়া সেই ভয়ানক, রাজকীয় ক্ষমতা—
ফায়ার কোর— ফিরে এসেছে।
হাওয়ায় আগুনের সুর বেরিয়ে আসে তার শরীর থেকে,
সে বুঝতে পারে: “আমি যুদ্ধ জয় করেছি…তাই আমি ফিরে পেয়েছি নিজের ক্ষমতা।”
এইদিকে, অন্য পাশে—
ফিওনা হঠাৎ ঘুম ভেঙে চোখ খুলে বসে।কিছু একটা… তার শরীরের মধ্যে বদলে যাচ্ছে। সে চেয়ারে বসে এক গ্লাস পানি হাতে নেয়, কিন্তু আয়নায় তাকাতেই দেখল— তার চোখে এক ধরণের রূপালি ঝিলিক ফিরেছে, তার চুলের প্রান্ত সোনালি নয়, বরং হালকা রূপালি।
তার দেহের তাপমাত্রা বদলেছে। সে ধীরে ধীরে অনুভব করে, “আমি আবার অর্ধ-মানবী হয়ে যাচ্ছি…”
তার শরীরে ফিরে এসেছে সেই পুরনো গ্লো।
ফিওনা জানে…এটা ভালোবাসার মূল্য।
এটা সেই চূড়ান্ত ভারসাম্য—জ্যাসপার ফিরে পায় তার আগুন, আর ফিওনা ফিরে পায় তার ভাগ্যবান অর্ধ-মানবী পরিচয়।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আজ ভেনাসের আকাশটা ছিল একটু বেশিই শান্ত, যেন নিজেই প্রস্তুতি নিচ্ছিল একটি হাসিমাখা দিনের রাজপ্রাসাদের ভিতর হালকা ব্যস্ততা — তবে তা কোনো যুদ্ধ বা উৎসবের নয়, বরং এক ছোট্ট পরিবারের শান্ত আনন্দঘন ভ্রমণের।
জ্যাসপার সকাল সকাল ফিওনাকে বলেছিল, “চলো আজ তোমার জন্য বানানো সেই গেম জোনটা ঘুরে আসি। আমাদের ছোট্ট প্রিন্সের জন্যও ওখানে সারপ্রাইজ আছে।”
ফিওনা হেসে মাথা নেড়ে বলেছিল,
“আমাদের বেবিটা তো এখন অনেক কিউটলি হাসে, খেলে… আজ ওর প্রথম আউটিং ভেনাসের মাটিতে।”
মাত্র পাঁচ মাস বয়স — তবুও তার চোখে দুনিয়ার বিস্ময়। ফিওনা নিজ হাতে ওকে সাজিয়েছে সাদা রঙের কোমল জামা পরিয়ে। ট্রলিতে বসে বেবি কখনো হাত নাড়ে, কখনো গুনগুন করে হাসে।
সাথে ছিলো, এথিরিয়ন — যার চোখে আজও ক্লান্তির ছাপ, কিন্তু মুখে শান্তি। সিলভা ও ছিলো— এথিরিয়নের পাশে ছায়ার মতো।
থারিনিয়াস — সবসময়ের মতো একচোখে ভ্রু কুঁচকে।আর আলবিরা — যার সোনালি চুল আজ রোদের মতো ঝলমল করছিল।
তাদের সবার গন্তব্য এল্ড্র রাজ্যের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত “গেইম জোন”— একটা আধুনিক অথচ রাজকীয় বিশাল হলরুম, যেখানে জ্যাসপার একদিন বলেছিল, “এটা শুধু খেলনার জায়গা নয়, এটা হচ্ছে ভবিষ্যতের স্মৃতি তৈরির কারখানা।”
এই গেম জোনের একপাশে ছিল শিশুর জন্য বানানো “স্মাইলিং প্ল্যানেট” —মোলায়েম খেলনা, রঙিন বল, ভেসে থাকা ছোট ড্রাগনের মতো পুতুল। আরেকপাশে বড়দের জন্য ছিল রিয়ালিটি সিমুলেশন গেম — যেখানে যুদ্ধ নয়, বরং সাহস, বুদ্ধি আর বন্ধুত্ব দিয়ে চ্যালেঞ্জ জেতা যায়।
লিউ ঝান আর অ্যাকুয়ারা অবশ্য আজ নেই। তারা পৃথিবীতে ফিরে এসেছে বহু আগেই — লিউ ঝান সব গবেষণা শেষ করে অ্যাকুয়ারার পৃথিবীতে সবসময় সার্ভাইব করার জন্য বিশেষ ক্যামিকেল তৈরি করেছে।
আর ফিওনা? সে কখনো বেবির মুখ দেখে, কখনো জ্যাসপারকে। এখন সে আর শুধু ফিওনা নয়— এখন সে একজন মা, একজন রানী, আর একজন বিজয়িনী।
এক ঝলক ধূপের আলো জানালার কাঁচে ভেসে আসে,
বেবির খিলখিল হাসির সাথে গেম জোনের দেয়ালে ছড়িয়ে পড়ে সেই আলো—যেখানে কোনো রাজনীতি নেই, নেই যুদ্ধের গন্ধ… শুধু আছে ভালোবাসা, এক নতুন ভেনাসের প্রতিচ্ছবি।
গেম জোনে ঢুকতেই চারদিক উজ্জ্বল রঙের আলোয় ঝলমল করে উঠল। মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত ডিজিটাল স্ক্রিন, দোলনা, নরম প্যাড আর জ্যোতির ছায়ায় তৈরি এক দুনিয়া— যেখানে কোনো যুদ্ধ নেই, শুধু আনন্দ আছে।
প্রথমেই তারা গেল “বেবি রোলিং পড”-এ। এটা ছিল একরকম গোলাকৃতি ডিভাইস, যেখানে ট্রলির মতো বসিয়ে শিশুকে আলতো দুলানো যায় রঙিন আলো ও হালকা সঙ্গীতের সাথে। বেবি আনন্দে হাততালি দিতে লাগল, ফিওনা হেসে বলল, “আমাদের ছোট্ট প্রিন্স তো আজই রাজ্য জয় করে ফেললো!”
এরপর তারা গেল “রঙিন বলের জগৎ” (Color Bubble World)-এ। সেখানে ছোট ছোট বেলুন আর বল ঘুরে বেড়াচ্ছে। জ্যাসপার নিচু হয়ে বেবির সামনে বল এনে দেয়। বেবি একেকটা বল ধরার চেষ্টা করে আবার হাত ছুঁড়ে ফেলে।
ফিওনা একপাশে বসে ওর প্রতিক্রিয়া দেখে ডিজিটাল ক্যামেরায় ছবি তুলতে থাকে।
শেষে তারা যায় “Mirror Laughter” নামের এক মজার ঘরে— যেখানে আয়না বিকৃত মুখ দেখায়, জ্যাসপার নিজের বড় নাক দেখে নকল কান্না করে, আর বেবি খিলখিল করে হেসে ওঠে।
এথিরিয়ন আর সিলভা। তারা বেছে নেয় “Sky Dive Arena”— এটা এক ভার্চুয়াল ফ্লাইট সিমুলেশন, যেখানে ড্রাগনরাও উড়ে যেতে পারে ভার্চুয়াল ভেনাসের আকাশে।
সিলভা প্রথমবারেই এক লাফে শূন্যে ভেসে যায়। এথিরিয়ন একটু হেসে বলে, “তোমার সাহস দেখে তো আমার হিংসে হচ্ছে।” সিলভা উত্তর দেয়, “তুমি যুদ্ধ জিতেছো, আজ আমাকে জিততে দাও।”
এদের মুহূর্তটা ছিল নীরব, সম্মোহনী। দুজন পাশাপাশি উড়ছিল, কিন্তু মনে হচ্ছিল, একে অপরের নিঃশ্বাসে হারিয়ে গেছে।
থারিনিয়াস সে একাই যায় “Dragon Brain Challenge”-এ। এটা এক মস্তিষ্ক-ভিত্তিক গেম যেখানে স্ট্র্যাটেজি, স্মৃতি ও বুদ্ধিমত্তা পরীক্ষা করা হয়।
প্রথমে কেউ ওকে পাত্তা না দিলেও স্কোর উঠতেই সবাই থমকে গেল। ফ্ল্যাশিং স্ক্রিনে লেখা উঠল “Highest Score: General Tharinious – 100/100”
সে তখন কেবল ঠোঁট কোণে এক ফোঁটা হাসি ফুটিয়ে বলল, “আজ মস্তিষ্ক জিতলো, পেশী নয়।”
আলবিরা চলে যায় “Fantasy Art Dome”-এ।
ওখানে হাওয়ায় ভাসা ডিজিটাল তুলিতে আঁকা যায় বিশাল ক্যানভাসে। সে আঁকলো এক সাদা ড্রাগন, একটা ছেলে শিশু আর একটা শান্ত গ্রহ। তার পাশে এক শিশু এসে বলে, “তোমার ছবিটা খুব সুন্দর।” আলবিরা মৃদু হেসে বলল, “এই ছবিটা এল্ড্র রাজ্যের আরেকটা ভবিষ্যৎ।”
ফিওনা আর জ্যাসপার বেবিকে কোলে নিয়ে বেঞ্চে এসে বসলো। চারপাশে আলো, সঙ্গীত আর হালকা কোলাহল। ফিওনা বলল, “এই মুহূর্তটা মনে থাকবে চিরকাল।” জ্যাসপার জবাব দিল, “কারণ এই মুহূর্তেই আমাদের ফ্যামিলি কমপ্লিট হয়েছে।”
আকাশে সূর্য একটু হেলে পড়ছে। বেবি একটু ঝিমুচ্ছে।
সবার মুখে প্রশান্তি, চোখে হাসি। এল্ড্র রাজ্যে আজ কোনো র**ক্তপাত নেই, নেই শত্রুর ভয়… আছে শুধু খেলা, ভালোবাসা আর এক নবজীবনের স্পর্শ।
শেষে একটা ছোট রাউন্ড ছিল “Family Glow Moment”। যেখানে বাচ্চা কোলে নিয়ে বাবা-মা একসাথে হালকা নাচ করে। পাশে হালকা রঙের বুদবুদ আর ঘরের ভেতর ছড়ানো তারা। ফিওনা বেবিকে ধরে, জ্যাসপার ফিওনার কোমর জড়িয়ে রাখে।
বেবি হেসে হাত বাড়িয়ে জ্যাসপারের নাক ধরে।
ফিওনা হেসে বলে, “দেখো, বাবার উপর হামলা শুরু করে দিয়েছে।” জ্যাসপার শান্ত গলায় ফিসফিস করে, “তুমি আর আমাদের বেবি… আমার পুরো গ্রহ।”
রাত নেমেছে নরম মায়ায়। ভেনাসের রাস্তায় ঝুলে থাকা ল্যাম্পপোস্টগুলো একটার পর একটা জ্বলে উঠছে— ঠিক যেন তারা জানে এই রাতটা একটু বেশি স্পেশাল।
জ্যাসপার এগিয়ে চলছে ধীরে, এক হাতে ধরে আছে ছোট্ট বেবির ট্রলি, অন্য হাতে ফিওনার পছন্দ করে কেনা সেই খেলনাগুলোর ব্যাগ।
ফিওনা হাঁটছে তার পেছনে-পেছনে। আজ সারা বিকেল গেম জোনে আনন্দে কেটেছে, কিন্তু এখন ক্লান্তি এসে চেপে বসেছে গায়ে। “এই ট্রলিটা দেখে মনে হচ্ছে আরেকজন বসতে পারবে, বসলে মজাই লাগবে?” হঠাৎ বলে ওঠে ফিওনা, নিজের কণ্ঠেই যেন খেলে যায় শিশুসুলভ দুষ্টুমি।
জ্যাসপার পেছনে তাকিয়ে হালকা হেসে বলল, “কারণ এটাতে আমার রাজ্যের সবচেয়ে দামি সম্পদ বসে আছে তাই বোধহয়।”
ঠিক তখনই, ফিওনা দুষ্টু হেসে হুট করে বসে পড়ে সেই ট্রলির ভেতরে। আর কোলে তুলে নেয় ছোট্ট জ্যাফিওনকে, যার দুইটা হাত ফিওনার গলায় পেঁচানো।
“ফায়ার মনস্টার, তোমার রানী আর ছোট্ট প্রিন্সকে এবার নিয়ে চলো রাজপ্রাসাদে।”
জ্যাসপার থমকে দাঁড়ায়, ফিওনা আর জ্যাফিওনের দিকে তাকিয়ে চোখের মধ্যে এক ধরণের শান্ত প্রশান্তি খেলে যায়।
“তোমরা দুজনেই আমার রাজ্যের সবচেয়ে এক্সপেনসিভ প্যাসেঞ্জার,” – সে ঠেলতে শুরু করে ট্রলি, ধীরে ধীরে, যত্নে।
আলো-ছায়ার ফাঁক গলে ফিওনার চুলগুলো উড়ছে হাওয়ায়। সে নিচু হয়ে জ্যাফিওনের কপালে একটা চুমু দেয় আর বলে, “আমাদের লিটল প্রিন্স আজ অনেক হাসলো।”
জ্যাসপার একটু ঝুঁকে ট্রলির পাশে এসে বলে, “আর আমার রানী তো আজ রাজ্যজয় করলো, শিশুসুলভ আচরনে।”
ফিওনা মুচকি হেসে বলে, “জীবনটা কখনো কখনো… এমন ছোট ছোট পাগলামিতে ভরে ওঠে।”
জ্যাসপার চেয়ে থাকে তার দিকে। তারপর সেই স্বরের নরমতায় বলে, “আর আমি ভালোবাসি সেই পাগলামিগুলো… যেগুলো কেবল তুমি-ই করতে পারো, ফিওনা।”
এদিকে পৃথিবীতে। লিউ ঝান হাসপাতাল থেকে ফিরেই ক্লান্ত ভঙ্গিতে সোফায় গা এলিয়ে দিল। অ্যাকুয়ারা দ্রুত এগিয়ে এসে এক গ্লাস পানি তার হাতে দিল।
সে এক হাতে গ্লাসটা নিল, আর অন্য হাতে অ্যাকুয়ারার হাত ধরে একটু টান মেরে নিজের হাঁটুর ওপর বসিয়ে নিল। পানি পান করে একটুখানি নিঃশ্বাস নিয়ে তার কোমরটা জড়িয়ে ধরল।
লিউ ঝান নরম গলায় বলল “ফিওনার বেবিটা কত কিউট হয়েছে, তাই না? আসার সময় কতোটা ছোট দেখে এসেছিলাম… হয়তো এতদিনে হাসতে শিখে গেছে।” একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বলে উঠল,”আসলে, আমারও না… বাবা হতে ইচ্ছে করছে।”
অ্যাকুয়ারা হেসে কাঁধে মাথা রাখল। “হয়ে যাও। কে মানা করেছে?” – সে চুপচাপ বলল।
লিউ ঝান তখন এক ঝটকায় উঠে দাঁড়াল। “ওকে দাঁড়াও… এখনই দেখাচ্ছি!”
সে অ্যাকুয়ারাকে এক হাতে কোলে তুলে নিল—
হাসতে হাসতে সে বলল, “চলো, কক্ষে!”
লিউ ঝান অ্যাকুয়ারাকে কোলে করে রুমে নিয়ে গিয়ে ধীরে ধীরে তাকে বিছানায় নামিয়ে রাখে। তার চোখে তখন এক ধরনের নরম অথচ দাবিদার আগুন—যেটা শুধু অ্যাকুয়ারার জন্যই জ্বলে।
সে হাত দিয়ে অ্যাকুয়ারার চুল সরিয়ে মুখের দুপাশে ধরে ফিসফিস করে বলল,”তোমার ভেতরে এমন এক শান্তি আছে… যা আমি আর কোনো অপারেশন রুমে খুঁজে পাইনা।”
অ্যাকুয়ারা হেসে ফেলে, কিন্তু তার চোখেও ছিল একই রকম আকর্ষণ। সে আস্তে আস্তে লিউ ঝানের শার্টের বোতাম খুলতে লাগল।
“তাহলে এসো, মিস্টার ডক্টর… এবার আমাকে ভেতর থেকে পুরোপুরি পড়ে ফেলো।” – তার কণ্ঠ ছিল স্নিগ্ধ, কিন্তু তীব্র কামনায় ঘেরা।
লিউ ঝান আর এক মুহূর্তও নষ্ট করল না।
সে তার ঠোঁট রেখে দিল অ্যাকুয়ারার কপালে, গালে… তারপর ধীরে ধীরে ঠোঁটে। একটা লম্বা, গভীর চুমুতে দুজন যেন একে অপরের শ্বাসের ছন্দে হারিয়ে গেল।
তার হাত চলে গেল অ্যাকুয়ারার পিঠে, আরেকটা হাত কোমরে… বিছানার চারপাশে আবছা আলো—শুধু তাদের নিঃশ্বাস ও হৃদস্পন্দনের শব্দ শোনা যাচ্ছিল।
ভেনাসের আকাশে নক্ষত্রেরা আজ যেন একটু বেশি উজ্জ্বল। মার্বেল-পাথরের ছাদের ওপরে খোলা জানালা দিয়ে সোনালি আলো কক্ষজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। সিলভা দাঁড়িয়ে আছে আয়নার সামনে—এই নিয়ে ২০তম পোশাক তার গায়ে।
এথিরিয়ন চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছিল তাকে, চোখে এক ধরণের প্রশংসা আর আগুন। এই শেষ ড্রেসটা ছিল একটু বোল্ড—আকাশী নীল আর রূপালি পালকের মিশেল। সিলভার নগ্ন পিঠটাকে স্পষ্ট করে রেখেছে। তার গলায় জ্বলছিল একফোঁটা এলড্র রত্ন।
ধীরে ধীরে এথিরিয়ন তার পেছনে এসে দাঁড়াল।
কোনো শব্দ ছাড়াই—শুধু নিঃশ্বাসের গরমে সিলভার ঘাড় শিউরে উঠল।
তারপরে সে দুহাত দিয়ে কোমর জড়িয়ে ধরল সিলভাকে। গলার ঠিক নিচে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“How do you still manage to look like starlight I can never touch?”
সিলভা হেসে উঠল ধীরে— “Then touch me now, before I disappear with the dawn.”
এথিরিয়নের হাত এবার উঠে গেল তার বুকের কাছাকাছি—নম্র কিন্তু আত্মবিশ্বাসী। তার ঠোঁট ঘাড় বেয়ে কাঁধে নেমে আসছে, আরেকটা হাত ধীরে ধীরে পোশাকের ফিতেটা খোলার দিকে এগোচ্ছে।
“You’ve tried on 20 dresses, my starlight… but now I want you in none.” – বলেই এথিরিয়ন তার মুখ সিলভার গালের পাশে এনে দাঁড়িয়ে রইল, নিঃশ্বাসে সে কেঁপে উঠল।
সিলভা চোখ বন্ধ করে বলল, “Then claim me like only a dragon can…”
এক মুহূর্ত পর ঘরের ঝুল পর্দা বাতাসে নড়ে উঠল,
নক্ষত্রের আলো তাদের গায়ে পড়ল—আর তারা হারিয়ে গেল এক মহাজাগতিক মিলনে, যেখানে নক্ষত্র, নিঃশ্বাস আর কামনা সব একাকার হয়ে যায়।
সময়ের গতি ধারায় পাঁচটি বছর কেটে গেছে…
ভেনাসের এল্ড্র প্রাসাদে জ্যাফিওন বড় হয়ে উঠেছে তার রাজকীয় মা-বাবা—ফিওনা আর জ্যাসপারের ছায়ায়। তার বয়স এখন পাঁচ, তীক্ষ্ণ চোখ, সাহসী মেজাজ আর এক চিলতে দুষ্টু হাসি। একাই এখন কালো ড্রাগন রূপে ভেসে বেড়াতে পারে সে। মেঘ ভেদ করে যখন ভেনাসের আকাশে নামে, সবার নজর আটকে যায় তার তীব্র ডানার ছায়ায়।
আজ তারা সবাই পৃথিবীতে এসেছে—একটি বিশেষ দিনে।
অ্যাকুয়ারা আর লিউ ঝানের কন্যা লিউ ইয়ান আজ তিন বছরে পা রাখলো। ছোট্ট, লাজুক, মিষ্টি চেহারার এই মেয়েটি এখন সবার ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দু। ঘরজুড়ে সাজানো হয়েছে গোলাপি বেলুন, রঙিন লাইট আর মেঝেতে ছড়ানো খেলনা।
পাশেই থারিনিয়াস আর আলবিরা এসে পৌঁছেছে। তাদের দুই বছরের ছেলে, যার নাম আলরিয়াস—একটা কাঠের ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কাঁধে ছোট্ট লালপাখার ব্যাগ, যেন খেলনার সৈনিক।
আর এসেছে সিলভা আর এথিরিয়ন—তবে এবার তারা এক নতুন আনন্দের অপেক্ষায়। সিলভা এখন এক মাসের গর্ভবতী। তার মুখে ক্লান্তির ছাপ, তবে চোখে মুগ্ধ প্রশান্তি। এথিরিয়নের একহাতে তার কোমর ঘিরে আছে, যেন পৃথিবীর সব নিরাপত্তা সেখানেই গাঁথা।
এই মুহূর্তে সবাই মিলিত— লিউ ঝান আর অ্যাকুয়ারা কেক কাটছেন তাঁদের মেয়ের হাত ধরে।
থারিনিয়াস তার ছেলেকে নিয়ে খেলনাঘরে ব্যস্ত, তাদের ছেলেকে ছোট পিয়ানো বাজাতে শেখাচ্ছে।
সিলভা হালকা হেসে জানালো, “আমার বেবির নাম আমি আগে থেকেই ঠিক করেছি— ওর নাম হবে সিয়ন।”
এথিরিয়ন সেদিকে তাকিয়ে বললো, “তুমি কীভাবে জানো আমাদের ভবিষ্যতের রাজপুত্র না রাজকন্যা হবে?”
সিলভা মুচকি হেসে বললো, “কারণ আমার স্বপ্নে সে এসেছে… এল্ড্র রাজ্যের আলো নিয়ে।”
জ্যাফিওন লিউ ইয়ান আর আলরিয়াসকে নিয়ে ড্রাগন রূপে ঘরের ছাদে ছোট্ট চক্রে উড়তে লাগলো। ছোটরা হেসে উঠলো, বড়রা করতালি দিলো।
পৃথিবীর সেই বড় ঝান ম্যানশনে সোফার কক্ষে সবার হাসি, গল্প, শিশুর খেলা আর কেকের সুগন্ধ মিশে এক অপূর্ব পরিবেশ তৈরি করেছে। ছোট্ট লিউ ইয়ান তার গোলাপি ফ্রকে কেক কাটছে, আর আশেপাশে সবাই করতালি দিচ্ছে।
কিন্তু এই চঞ্চল পরিবেশে হঠাৎই এক দিকে টান পড়ে যাচ্ছে কেকের স্তরগুলো… কারণ কেক খাওয়ার প্রতিযোগিতা যেন শুরু করে দিয়েছে আমাদের ছোট ড্রাগন প্রিন্স—জ্যাফিওন!
সে এক টুকরো… তারপর আরেক টুকরো… তারপর লুকিয়ে আরেকটা…জ্যাসপার একটু দূর থেকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন, “জ্যাফিওন! আর না। এটা চার নাম্বার টুকরো! অতিরিক্ত কেক খেলে অসুস্থ হয়ে পড়বে তুমি।”
ছোট্ট জ্যাফিওন মুখটা একটু বাঁকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। হঠাৎই লিউ ঝান পাশে এসে আরেক টুকরো কেক এগিয়ে দিয়ে বললেন, “আরে আরে খাও লিটল প্রিন্স ! বার্থডে পার্টিতে কেক না খেলে চলে?”
এথিরিয়ন পাশে দাঁড়িয়ে হেসে উঠে বললেন, “চাচ্চু বলেছি, খাও যত খুশি খাও!”
জ্যাফিওন যেন উৎসাহ পেয়ে গর্বে বুক ফুলিয়ে জ্যাসপারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো—”পাপা, ইউ আর সাচ আ স্ট্রিক্ট ফাদার! ”
জ্যাসপার একটু অবাক, একটু চুপ। তারপর ধীরে বললো, — “কি বললে তুমি? পাপা স্ট্রিক্ট? পাপা তো তোমার হেলথের কথা চিন্তা করেই এতো কেক খেতে বারন করলাম!”
জ্যাফিওন গোঁ গোঁ করে মুখ ফুলিয়ে বলল, “ঝান আঙ্কেল আর রিয়ন চাচ্চু খুব ভালো। আমাকে কোনো কিছুতেই মানা করে না! আর পাপা, ড্রাগনদের অতিরিক্ত খাবারে অসুখ হয় না!”
জ্যাসপার একদম চমকে গেল। মাথা একটু ঘোরালো, চোখ সরু করে বললেন, “তোমাকে এসব কথা শিখিয়েছে কে?”
জ্যাফিওন কেকের একটা কামড় দিয়ে হেসে বললো,
— “কেনো? লিউ ঝান আঙ্কেলই তো বলেছে! He’s a doctor! He knows everything! and he is so kind person.
জ্যাসপার এবার চোখের ভেতর আগুন মিশিয়ে মনে মনে বলল, “উফ্…এই পাতি সেনাপতিটা আমার ছেলেকেও নিজের দলে টেনে নিয়েছে…”
জ্যাফিওন তখনও কেকের শেষ টুকরোটা হাতে ধরে দাঁড়িয়ে, মুখে একটু গোমড়া অভিমানী ভাব।
জ্যাসপার হালকা গলায় বললো, “তার মানে তুমি পাপাকে ভালোবাসো না?”
এই প্রশ্নে জ্যাফিওনের চোখ গোল হয়ে গেল। সে সঙ্গে সঙ্গে জ্যাসপারের গালে একটা ছোট্ট ভালোবাসার চুমু দিলো, তারপর কোমল গলায় বললো, “I love you more than everything, Papa… but… তুমি তো মম্মিকে আমার থেকেও বেশি ভালোবাসো।”
জ্যাসপারের চোখে একটু বিস্ময়, আবার একটু মায়া। সে জ্যাফিওনকে ধীরে কোলে তুলে নিলো, চোখে চোখ রেখে বললো, “তোমার এমন মনে হলো কেনো পাপা?”
জ্যাফিওন ছোট্ট গলায় ফিসফিস করে বললো, “মাম্মি যা চায় তুমি সঙ্গে সঙ্গেই এনে দাও। তাকে কখনো না বলো না। কিন্তু আমায় তো কত কিছুতেই বাধা দাও…”
জ্যাসপার হেসে কপালে একটা চুমু দিয়ে বললো, “আরে হামিংবার্ডের ছানা, মাম্মি তো বড়… বড়রা নিজেদের ভালো-মন্দ বোঝে। তাই ওকে স্বাধীনভাবে সব কিছু করতে দিই।তুমি তো এখনো ছোট, চাঁদমুখো ড্রাগন—তোমাকে এখন বুঝে, বেছে চলতে হবে।আর একটা কথা মনে রেখো… মম্মির সঙ্গে কখনো নিজেকে তুলনা কোরো না।কারণ… তোমার মম্মি হচ্ছে আমার হামিংবার্ড—আমার জীবনের প্রথম ভালোবাসা। আর সে যদি আমার প্রথম ভালোবাসা না হতো, তাহলে তুমি—আমার জীবন আলো করা ছেলেটা—এই মহাবিশ্বের আলোই দেখতে না। বুঝেছো পাপা?”
জ্যাফিওন একটু চুপ থেকে বড় বড় চোখে বাবার মুখের দিকে তাকালো। তারপর ছোট্ট গলায় বললো “I understand, Papa…” তারপর সে বাবার গলায় হাত জড়িয়ে বললো, “তুমি আর মাম্মি দুইজনকেই আমি দুনিয়ার সবথেকে বেশি ভালোবাসি।”
জ্যাসপারের মুখে তখন এক অদ্ভুত প্রশান্তির ছায়া। বুকের ভেতর ভালোবাসার ঢেউ যেন গর্জন করে উঠলো, কিন্তু বাইরে থেকে সে শুধু ফিসফিস করে বললো, — “আমার গর্ব তুমি, ছোট ড্রাগন… আমার হৃদয়ের খণ্ড।”
সবাই আজ পৃথিবীর মাটিতে—মিস্টার চেন শিং-এর গ্র্যান্ড ভিলায় উঠেছে। সবুজে ঘেরা সেই বিশাল বাড়ি, চারদিকে ফুলের গন্ধ, আর ভেতরে রাজকীয় সাজসজ্জা—বাচ্চাদের খেলাধুলার জন্য আলাদা স্পেস, বড়দের চায়ের আড্ডা আর সন্ধ্যার হাওয়া খাওয়ার জন্য বারান্দা।
জ্যাফিওন তো প্রথমেই দৌড়ে গেছে বাগানে। সঙ্গে লিউ ইয়ান আর আলরিয়াস। আর সিলভা আর এথিরিয়ন ছায়ায় বসে গরম জলে পা ডুবিয়ে রিল্যাক্স করছে।আলবিরা অ্যাকুয়ারাকে নিয়ে কিচেনে ঘুরে বেড়াচ্ছে—নতুন কিছু কুকিং এক্সপেরিমেন্ট করতে।
এমন সময়, হঠাৎ ফিওনার হাতে এক মগ কফি দিয়ে পেছন থেকে জ্যাসপার বললো— “ফিওনা… পৃথিবীতে এসেছি আবার কবে আসবো জানিনা। আমি চাই আমাদের লাভ স্টোরিটা আবার রিবাউন্ড করি।”
ফিওনা অবাক। চুলের পাশে একটু বাতাস লেগে যখন তার মুখে পড়ছিলো, তখন চোখের পাতায় অচিরেই বিস্ময় ছুঁয়ে গেলো।সে ধীরে ধীরে জ্যাসপারের দিকে তাকিয়ে বললো— “রিবাউন্ড মানে? আমাদের তো সবই চলছে সুন্দর মতো…”
জ্যাসপার হালকা হাসলো। তারপর এক পা এগিয়ে এসে তার হাতে থাকা কফির মগটা নিয়ে টেবিলে রাখলো।দুটো হাত ফিওনার কোমরের পাশে রেখে চোখে চোখ রেখে বললো—
“না, আমি চাই সব আবার হোক—ঠিক যেভাবে আমরা শুরু করেছিলাম।আমাদের প্রথম দেখা থেকে শুরু করেমাউন্টেন গ্লাস হাউজ,তোমার প্রথম কান্না,
আমার গর্জন,তোমার রংতুলি,আমার আগুনে শ্বাস…সব কিছু আবার—একদম শুরু থেকে।যেনো এটা আমাদের দ্বিতীয় জন্ম।একটা রিমেক, একটা রিবাউন্ড, একটা নতুন অধ্যায়… আর তুমি থাকবে আমার সঙ্গেই, আবার… ঠিক নতুন প্রেমিকার মতো।”
ফিওনা এক মুহূর্ত চুপ থাকে। তার ঠোঁটে আস্তে আস্তে একটা মিষ্টি হাসি খেলে যায়।
সে জ্যাসপারের বুকে মাথা রেখে বললো— “তুমি না… এখনো প্রেমে নতুন নতুন পাগলামি করা ছাড়লেনা…আচ্ছা বলো, তাহলে আমাদের ‘প্রথম দেখা’টা কবে শুরু করবো?”
জ্যাসপার কানের পাশে ফিসফিস করে বললো—“আজ রাত থেকে… তুমি ঠিক যেমন ছিলে সেদিন—রাতের সাদা ড্রেস পড়ে বারান্দায় কফির মগ হাতে আর আমি ছিলাম নিচে দাঁড়িয়ে ল্যাম্পপোস্টর নিচে।
রাত নেমেছে মেঘলা ঘুমে। চাঁদকে যেন আড়াল করেছে হালকা মেঘের চাদর। চারপাশে নিস্তব্ধতা।ফিওনা আজ দাঁড়িয়ে আছে সেই পুরনো শৈশবের বারান্দায়, যেখান থেকে একদিন সে অনেক দূর তাকিয়ে ভেবেছিলো, “ভবিষ্যৎটা কেমন হবে?”
তার হাতে এক মগ গরম কফি। আজ রাতে জ্যাসপার আসবে—একেবারে সেই আগের মতো করে।
হঠাৎ ফিওনার চোখ চলে যায় রাস্তায়।ল্যাম্পপোস্টের নিচে, হালকা আলোয় কেউ একজন দাঁড়িয়ে…
কালো হুডিচোখে সানগ্লাসমুখে মাস্ক
আর…ফিওনার চোখ বড় হয়ে আসে। এক মুহূর্তে ফিরে যায় সেই দিনের স্মৃতিতে… যে রাতে এক অচেনা আগন্তুক দাঁড়িয়ে ছিলো এই একই জায়গায়, যার উদ্দেশ্য ছিল ভয় দেখানো, বন্দি করা… না, ভালোবাসা নয়… একটি ফাঁদ।
তবে আজ?আজও ফিওনা চোখ সরিয়ে নেয়…
হালকা ভয়ের ভান করে কক্ষে ফিরে যায়।
জ্যাসপার অনেক নিচ থেকে তাকিয়ে থাকে ফিওনার চলে যাওয়া বারান্দার দিকে। তার হৃদয়টা কেমন যেন ধকধক করে উঠে। নিজের সাথেই বলে— “সেদিন তার জন্য কোনো প্রেম ছিলো না আমার হৃদয়ে… ছিলো এক পরিকল্পনা।আর আজ… আজ এই মেয়েটার মাঝেই আমার সবকিছু।আমার প্রাণ, আমার আত্মা, আমার ছায়া… এই মেয়েটাকে ছাড়া আমি কিছুই না।”
হাওয়ায় আস্তে আস্তে কাঁপে সেই হুডির কোণা।চোখের পেছনে লুকানো ভালোবাসা যেন ছাপ ফেলে দেয় রাতের আকাশে।
সকালের আলো এসে পড়েছে বারান্দার জানালায়। ফিওনা ঘুম থেকে উঠে দেখে, টেবিলের উপর একটি ভাঁজ করা কাগজ রাখা।
তাতে স্পষ্ট হ্যান্ডরাইটিং “আজকের বারে– দ্বিতীয় দেখা। সময় মতো চলে এসো।”
– জ্যাসপার
ফিওনা মনেই করে ফেলে সেই দ্বিতীয় দেখা, দ্বিতীয় ধোকা… আর তারপর সবকিছুর গাঢ় ভালোবাসা। স্মিত হেসে প্রস্তুত হয়।
অবশেষে ফিওনা চলে আসে সেই বারে।জ্যাসপার ঠিক আগের মতোই প্রস্তুত – কালো হুডি, চোখে সানগ্লাস।
তবে এবার তার চোখে প্রেম, গর্ব আর গভীর মুগ্ধতা।
ফিওনা যখন পৌঁছায়। জ্যাসপার সেখান থেকে হাত ধরে টেনে নিয়ে ফিওনাকে নিজের গাড়িতে তুলে তারপর। চলন্ত গাড়ির মাঝেই সে তার চোখের সানগ্লাস খুলে ফেলে আর তখনি ফিওনার সামনে হাজির হয় জ্যাসপারের সেই অরন্যর মতো সবুজ চোখজোড়া।
ফিওনা স্তব্ধ। কোনো কথা নেই তার ঠোঁটে, শুধু চাহনিতে মুগ্ধতা।
পরদিন একই ভাবে বেহাই লেকে পৌঁছে যায় ফিওনা।
সেখানে আবার দেখা।জল নীল, বাতাস মিষ্টি।
এবার জ্যাসপার তার মুখের মাস্ক খুলে… পুরো চেহারা দেখায়। সে যেন বলে— “এই আমি, যাকে ভালোবেসে তুমি হৃদয় দিয়েছিলে। এবার সবটা নিখুঁত করে নিতে এসেছি।”
আরও একদিন পরে ফিওনারবিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে।
চেনা সেই কফি শপ। জ্যাসপার বসে আছে ঠিক আগের টেবিলে। সুমাত্রা ডার্ক রোস্ট কফির অর্ডার চলে এসেছে।
ফিওনা এসে বসে।তাদের চোখে চোখ পড়ে—স্মৃতির সেতু গড়ে উঠে।
তারপর সন্ধায় দুজন মিলে চলে যায়। চেন শিং-এর ল্যাবে
সেখানে পৌঁছে জ্যাসপার ধীরে ধীরে তার ড্রাগন রূপ ধরে… তবে এবার ফিওনা ভয় পায় না। সে এগিয়ে আসে… ড্রাগনের চোখে তাকায়। “তুমি এখন আর ভয়ঙ্কর নও… তুমি আমার ভালোবাসা।”
জ্যাসপার এবার আর দেরি করে না—সে ফিওনাকে কোলে তুলে নেয়। গাড়িতে বসিয়ে পাহাড়ের পাদদেশে নিয়ে আসে।
তারপর ড্রাগন রূপে জ্যাসপার পিঠে তুলে নেয় ফিওনাকে। জোছনার আলোয় পাহাড় বেয়ে উঠে আসে সেই মাউন্টেন গ্লাস হাউজে।যেখানে একসময় ফিওনা বন্দি ছিল,আর এখন… ভালোবাসা, বিশ্বাস আর বন্ধন।
দরজার সামনে এসে জ্যাসপার বলে— “এইবার নতুনভাবে শুরু করি, এবার আর তুমি বন্দিনী নও… তুমি এই হৃদয়ের রানী।”
রাত গভীর।
পুষ্পরাজ পাহাড়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে সেই স্বপ্নময় বাড়ি— মাউন্টেন গ্লাস হাউজ। চাঁদের আলোয় ঝিকমিক করছে কাঁচের দেয়াল, আর তার ছাদে দাঁড়িয়ে আছে ফিওনা আর জ্যাসপার।
দুজনেই নীরব। শুধু বাতাসের মৃদু হাওয়া আর হৃদয়ের শব্দ। হঠাৎই ফিওনা একধাপ পেছনে সরে দাঁড়ায়…
এরপরেই সে ছাদের কিনারা থেকে নিচে লাফ দেয়!
“ফিওনা!” জ্যাসপার চিৎকার করে— এক সেকেন্ড দেরি না করে সেও লাফ দেয়। পতনের মাঝপথে সে ফিওনার কোমর জড়িয়ে ধরে, আর পরমুহূর্তে তার শরীর থেকে জেগে ওঠে ড্রাগন রূপ! আকাশে বিশাল পাখা মেলে ধরে সে।
রাতের আকাশে তারা উড়ে চলে—পুষ্পরাজ পাহাড়ের চারপাশে চক্কর দেয় একবার, দুবার, বারবার… তাদের চুল উড়ছে হাওয়ায়, ফিওনার চোখে খুশির অশ্রু।
অবশেষে আবার ফিরে আসে মাউন্টেন গ্লাস হাউজের ছাদে।
ড্রাগন রূপ থেকে মানব রূপে ফিরে আসে জ্যাসপার।
ফিওনা তার চোখের দিকে তাকায়—তারা দুজন একে অপরকে জড়িয়ে ধরে।চাঁদের আলোয় ঠোঁটের মাঝে মিলিয়ে যায়—দীর্ঘ এক চুম্বন।
অবশেষে তারা পৃথিবীকে বিদায় জানিয়ে মিস্টার চেন শিং আর লিউ ঝান, অ্যাকুয়ারা সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসে।
পরদিন ভেনাসের সকালের আলো জানালার পর্দা ছুঁয়ে মৃদু আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। ঘরের ভেতর নিস্তব্ধতা। ফিওনা ধীরে ধীরে চোখ মেলে দেখে জ্যাফিওন তার পাশে মিষ্টি মুখে ঘুমিয়ে আছে।
কিন্তু…জ্যাসপার নেই।
“প্রিন্স?” ফিওনা চারপাশে তাকায়। বালিশ, বাথরুম, বারান্দা— কোথাও নেই।
তখনি তার চোখে পড়ে টেবিলের ওপর রাখা একটা সাদা বড় কাগজ। একটা বিশাল চিঠি।
সাদা খাম খুলতেই ঝরে পড়ে জ্যাসপারের পরিচিত গন্ধ—
জ্যাসপারের পারফিউমের ঘ্রান আর মৃদু আগুনের গন্ধে মিশে থাকা একটুকরো হৃদয়।
ফিওনা চিঠিটা হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করলো।
“আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয় হ্যামিংবার্ড,
যখন তুমি এই চিঠিটি পড়ছো, তখন আমি হয়ত মেঘপুঞ্জের ওপারে কোনো অলিখিত গগনে, কিংবা সময়ের অন্য প্রান্তে এক অন্তর্লুপ্ত সন্ধিক্ষণের সন্ধানে পাড়ি দিয়েছি। না, বিচলিত হয়ো না, কারণ আমি এবার হারিয়ে যাইনি।
আমি জানি—ভেনাসের প্রতিটি দৃশ্য আজ মায়াবী,কারণ তুমি আছো, জ্যাফিওন আছে; আমাদের একে অপরের প্রতি এই দুর্বার আকর্ষণ নীহারিকা ছাড়িয়ে পৌঁছেছে নক্ষত্রলোক পর্যন্ত। আজ আমি তোমাকে বলবো সেই সমস্ত স্বীকারোক্তির কথা, যা হয়ত কখনো উচ্চারণ করিনি যা ছিলো মনের ভেতরে গোপনে; তবে আর চেপে রাখা সম্ভব হলো না। আজ আমি আবার শতবর্ষ পুরোনো সেই অভ্যাসে তোমাকে এই চিঠি লিখছি।
তোমায় প্রথম দেখেছিলাম সেই ছাদবেষ্টিত বারান্দায়,সন্ধার আবছা আলোয়, যেখানে তুমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলে কফির মগ হাতে। সেই প্রথম দেখায় আমার হৃদয়ে কেবল বিরক্তি আর তীব্র বিরাগ ছিল। কারণ তুমি ছিলে আমার গোপন মিশনের একমাত্র লক্ষ্য আর একটি হাতিয়ার মাত্র।
তোমার প্রতি মায়া দেখানো ছিল আমার কৌশলের অংশ। আমার ভাইকে মুক্ত করা আর ভেনাসের প্রতি কর্তব্য পালনই ছিল আমার একমাত্র সংকল্প। আমি ছিলাম সেই অগ্নিসঞ্চারী ড্রাগন প্রিন্স—যার হৃদয়ে প্রেমের জন্য কোনো পরিসর ছিল না। আমার ভিতরে দাউ দাউ করে জ্বলছিল প্রতিশোধের আগুন; যেখানে বিন্দুমাত্র ভালোবাসা ছিল না। তোমার সঙ্গে আমার যত সান্নিধ্য, যত কথা, সব ছিল আমার পূর্বনির্ধারিত ষড়যন্ত্রের অংশ। তোমাকে অপ*হরণ করেছি, তারপর মাউন্টেন গ্লাস হাউজে ব*ন্দি করেছি। তোমার উপর মানসিক, এমনকি শারীরিক নিপীড়নও প্রয়োগ করেছি। সেটা কিন্তু ভেনাসের কঠোর নিয়ম লঙ্ঘন করে আমি নিজে নিজেই করেছি। মনে হচ্ছিল, ওতেই মনে হয় আমার প্রশান্তি আসছে।
তবে… তবে যেদিন তোমার প্রথম চুম্বন আমার ওষ্ঠ ছুঁয়ে গেল, আমি বুঝে গেলাম আমি আর সেই আগের প্রিন্স নেই। তোমার সেই চুম্বন আমার সমগ্র অস্তিত্ব বদলে দিলো। দীর্ঘ ২৮ বছরের জীবনে প্রথম মনের গহিন অন্তরীক্ষে তীব্র অজানা অনুভূতির সঞ্চার হলো।কীভাবে কি হয়েছে, আমি নিজেও বুঝতে পারিনি। তবে তোমার কোমল স্নিগ্ধ অধরের স্পর্শে আমার হৃদয়ের মৃত ফাংশন এক মুহূর্তে জীবন্ত হয়ে উঠেছিল। তোমার ভালোবাসা আমাকে এমন এক গভীরতায় ডুবিয়ে দিল, যেখান থেকে ফেরা আর সম্ভব ছিল না। আমি ভুলে গেলাম তুমি মানুষ আর আমি ড্রাগন। ভুলে গেলাম, তুমি পৃথিবীর আর আমি ভেনাসের। ভুলে গেলাম তোমার ক্ষীণ শারীরিক গঠন আর আমার দানবীয় অস্তিত্ব। আমাদের এক হওয়া কি আদৌ সম্ভব ছিল? না, সম্ভব ছিল না। এই দুই ভিন্ন জগতের প্রাণীরাও এক হতে দিত না। অথচ জানো, তোমার ভালোবাসা না পেলে আমি আজও এক নিষ্ঠুর দানব হয়েই থেকে যেতাম। তোমাকে পাগলের মতো ভালোবেসে ফেলেছিলাম, আজও পাগলের মতোই ভালোবাসি, ফিওনা। এমনটা কিন্তু শুধুমাত্র জ্যাসপার অরিজিন করেছে, মহাবিশ্বের আর কোনো ড্রাগন কখনও করেনি।
সেবার মিশন শেষে যখন তোমাকে পৃথিবীতে রেখে ফিরে গেলাম; তোমার কাঁপা চোখ, প্রশ্নময় দৃষ্টি দেখে আমার বক্ষঃস্থল ভূমিকম্পের মতো কেঁপে উঠেছিল। সেই দৃশ্য আজও আমাকে পোড়ায়। আমি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, ‘ফিরে আসবো আবার তোমার কাছে’ কিন্তু এলাম না। কারণ আমি জানলাম—আমার ভালোবাসা তোমার জীবনে এক অভিশাপের মতো। যা তোমার শীতল হৃদয় জ্বালিয়ে ছারখার করে, তোমাকে নিঃশেষ করে দিবে। যে প্রিন্স ড্রাগনের এক ঝলকে শত শত নারী নিজেকে আগুনে ছুঁড়ে দিতে প্রস্তুত, যার এক নির্দেশে কাঁপে পুরো ভেনাস, যে একবার আগুন ছড়ালে পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম অংশও ছাই হয়ে যেতে পারে; সেই জ্যাসপারের হৃদয়টাও সেদিন রক্তা*ক্ত হয়েছিল, নিঃশব্দে ছিঁড়ে গিয়েছিল মাঝখান থেকে। নিজেকে শত টুকরো করে ছিন্নভিন্ন করেও, আমি তোমাকে দূরে ঠেলে দিয়েছিলাম— শুধু এইজন্য যে তুমি সুরক্ষিত থাকো, হামিংবার্ড।
কিন্তু তারপরেই আমি বুঝলাম, তুমি হেরে যাওয়ার মেয়ে নও। ভালোবাসার দাবিতে, নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিয়েও তুমি ভেনাসে চলে এলে। এই বিশাল পথ পারি দেওয়া তোমার জন্য যে কত কঠিন ছিল, তা ভাবলেও আমার মস্তিষ্কের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কোষে জট পাকিয়ে যাবে। অথচ দেখো, আমি… আমি কী করলাম? আমি তোমাকে ফিরিয়ে দিলাম। অস্বীকার করলাম তোমাকে, অস্বীকার করলাম তোমার চোখের জলকে। আমি কি নিষ্ঠুর, তাই না বলো? কিন্তু তুমি তো জানো না, সেদিন তুমি চলে যাওয়ার পর আমি দ্বিতীয়বার মনের দিক থেকে মৃ*ত্যু বরণ করলাম। মনে হচ্ছিল, আমারই শরীরের একটা অংশ আলাদা হয়ে গেল। ভিতরে ভিতরে আগুন জ্বলছিল, কিন্তু কেউ তা দেখেনি। না, আমিও দেখাইনি।
তারপর আবার তোমাকে ফিরে পেলাম… লুনার দ্বীপে একসাথে কাটানো সেই স্বপ্নভেজা মুহূর্তগুলো আমাদের ক্লান্ত হৃদয়ে শান্তির সুগন্ধ ছড়িয়ে দিয়েছিল। সেদিন প্রথমবার মনে হয়েছিল, এইতো…এইতো জীবনের সব অনুপূর্ণতা মিলিয়ে এক পূর্ণতার নাম ‘তোমাকে’ পেয়েছি। ভেবেছিলাম, তোমাকে ছাড়া আমার জীবনে আর কোনো ভোর আসবে না। আর কোনো সন্ধ্যা নিঃসঙ্গ কাটবে না। তোমাকে ফিরে পেয়েছি; না, আমি তো নিজেকেই ফিরে পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, শত ঝড় এলেও এবার তোমাকে আঁকড়ে ধরবো। একবারের জন্যও হারাতে দিব না, কক্ষনো হারাতে দিব না। সেদিন আমরা আবারও এক হয়ে গেলাম। আমার ভেতরের ভাঙাচোরা হৃদয়ের ধ্বংসস্তূপের নিচে থেকে যেন ধীরে ধীরে এক নতুন বসন্ত গজিয়ে উঠলো। তোমার ছোঁয়ায়, তোমার কণ্ঠের উষ্ণতায়, আমার সেই হারিয়ে যাওয়া হৃদয় একটু একটু করে সুস্থ হতে লাগলো। বলতে পারো, গোধূলির আলোয় মলিন কোনো ফুল আবার রং ফিরে পাচ্ছিল। অর্থাৎ তুমি ফিরে এসেছিলে, আর আমি আবার বেঁচে উঠেছিলাম।
কিন্তু… কিন্তু আবারও নিয়তির নিষ্ঠুর বিচারের কাছে হার মানলাম আমি। জানো, ভালোবাসা কখনও কখনও পাথরের মতো ভারী হয়ে ওঠে। তাকে বুকে চেপে ধরে বাঁচা যায় না, আবার ছেড়ে দিলেও শান্তি মেলে না। আর তাই তোমার সেই অমূল্য ভালোবাসাটাকে আমি আবার দূরে ঠেলে দিলাম। কিন্তু তুমি তো জানো না, সেদিন যখন তোমার স্মৃতির পাতা থেকে নিজেকে মুছে দিচ্ছিলাম, আমার হৃদয় কেঁপে উঠেছিল, কাঁপছিল আঙুল, আত্মা শুকিয়ে গিয়েছিল, তবুও মুছে দিয়েছিলাম নিজেকে। একটি একটি করে ছিঁড়ে ফেলেছিলাম সেইসব মুহূর্ত, যেগুলোয় তুমি আমাকে ‘আমার’ বলে ডাকতে। মুছে দিয়েছিলাম আমার অস্তিত্ব, মুছে দিয়েছিলাম ‘তোমার আর আমার’ সমস্ত গল্প, মুছে ষ ফেলেছিলাম ‘জ্যাসপার অরিজিন’ নামের সেই অগ্নিময় পরিচয়, যে নিজের সমস্ত রাজ্য-সাম্রাজ্য বিসর্জন দিয়ে তোমার চোখের মধ্যে গড়ে তুলেছিল এক অনন্ত রাজত্ব। যে এই জগতের সমস্ত আলো তোমার হাসিতে বন্দি করতে চেয়েছিল।
অথচ সবকিছু মুছে দেওয়ার পর তুমি ভুলে গেলে…
ভুলে গেলে এক ড্রাগন প্রিন্স তোমার ছায়াতেই নিজের পাখা মেলতে শিখেছিল, ভুলে গেলে সেই দুষ্টুমিতে ভরা খামখেয়ালি মুহূর্তগুলো, ভুলে গেলে সেই এক টুকরো চাঁদের আলোয় গড়া সুখের রাতগুলো। আর আমিও ভাঙতে ভাঙতে ধুলো হয়ে উড়ে গেলাম তোমার অচেনা ভুবনে।
সেদিন তোমাকে বিদায় জানিয়ে হেলিকপ্টারে তুলে দিয়ে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়ালাম। কিন্তু আমার মুখে কোনো কঠোরতা ছিল না। আমার বুকের ভেতর ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল।
তোমাকে পিছনে ফেলে আসা, তোমার সেই আহাজারি, তোমার না-বোঝা চোখদুটো…সেদিন আমার ভেতরের ড্রাগনের সমস্ত শাসন ভেঙে দিলো।
আমার চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে একফোঁটা অশ্রু—
হ্যাঁ, সেই রক্তবর্ণ অশ্রু… ড্রাগনের অশ্রু, যা ছিলো নিষিদ্ধ… সেই ফোঁটা পড়লো লুনার দ্বীপের মাটিতে। শ্রাবণের শেষ রাতে…চাঁদের আলোয় সেই অশ্রু ছিল এক ফোঁটা লাল রক্ত—
যেটা আমার প্রাণের প্রথম স্বীকারোক্তি ছিলো তোমার জন্য।
তুমি তখন জানোনি, তুমি চলে গেলে, কিন্তু আমি সেদিন আর কোনোদিন আগের মতো থাকিনি। তোমার ফেলে যাওয়া সুগন্ধ, তোমার অশ্রুসিক্ত চোখের শেষ “বিদায়” শব্দটা নিয়ে।আমি ফিরে এলাম ভাঙা হ্নদয় নিয়ে ভেনাসের। আর তখন পৃথিবীতে তোমার বিয়ে ঠিক হলো,এনগেজমেন্টও হলো, আর আমি?আমি সেই খবর পেয়ে পাগল হয়ে গেলাম।
আমার সেই পাগলামি পুরো ভেনাস দেখলো—আমি তোমার নামে ছুটেছি প্রাসাদের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে, তোমার জন্য ধ্বংস করতে বসেছিলাম পুরো ভেনাস।
কিন্তু কেউ এই পাগলামি সহ্য করতে পারলো না। তখন ড্রাকোনিস আর ভেনাসের শাসকরা আমাকে বন্দি করে দিলো… একটা লোহার খাঁচায়, যেখানে ড্রাগনের আগুনও নিভে যায়, আর আমার চোখের জলও শুকিয়ে গিয়েছিলো।
নিয়তির চক্রে তোমাকে আবারও ফিরে পেলাম তবে এবার ভেনাস-এ।
সেদিন আবার প্রথমবার যখন তোমাকে ফ্লোরাস রাজপ্রাসাদে দেখলাম… আমার হৃদয় যেন থেমে গিয়েছিলো।
আমি নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গিয়েছিলাম,ফিওনা। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। তোমাকে আবার দেখতে পাওয়াটাই যেন এক অলৌকিকতা ছিলো সেদিন।
কিন্তু…তোমার চোখে তখন আমার জন্য কোনো স্মৃতি ছিল না।তুমি ভুলে গিয়েছিলে— আমি কে।
পুনরায় নিয়তি জানিয়ে দিলো … তুমি আমার এলিজিয়া— সেই শত বছর আগের প্রেম আমার, যার জন্য আমি ভালোবাসার চিঠি লিখতাম, তোমার প্রিয় ফুল খুঁজে আনতাম গ্রহের সবচেয়ে উঁচু পাহাড় থেকে।
কিন্তু তুমিতো আমাকে মেনে নাওনি।
কারণ, সেই আগের জন্মে তোমার হৃদয় ছিলো জায়রনের জন্য… আর আমি থেরন তোমার জন্য ছিলাম একটা অত্যচারী , নিষ্ঠুর অংহকারী খলনায়ক।
আমি তখন আরেকবার পাগল হয়ে গেলাম,ফিওনা।তোমাকে হারাতে হারাতে আমি নিয়তির শাসন ছিঁড়ে ফেললাম।তোমাকে ছিনিয়ে নিলাম নিয়তির হাত থেকে।আমি বদলে দিলাম ভবিষ্যৎ,আমি তোমাকে আমার করে নিলাম, তোমার হৃদয়ে আবার নিজের নাম লিখলাম।তুমি তখন আমাকে ঘৃণা করলে।আমার স্পর্শে রাগ, আমার কাছে আসতে অনীহা।তবুও আমি অপেক্ষা করলাম। কারণ, আমি জানতাম— ভালোবাসা একদিন ফিরে আসে, যদি তা সত্যি হয়।
আর একদিন সত্যিই তুমি ফিরে এলে।তোমার সমস্ত স্মৃতি ফিরে এলো।তুমি আমার ফিওনা হয়ে গেলে…
আর এলিজিয়া হয়ে গেলে থেরনের-এর।
সেই শত বছরের ভালোবাসা এখন নতুন আকার পেলো।সব বাধা, সব ব্যথা, সব জীবন-চক্রের শেষে আমরা—এক হয়ে গেলাম।আজ আমি তোমাকে এই চিঠি লিখছি এই বারান্দার টেবিলে বসে, যেখানে তুমি ঘুমিয়ে আছো আমাদের সন্তানকে পাশে নিয়ে।
আমি কাঁদছি না, ফিওনা। কারণ এই চোখ আজ কান্নার জন্য না। এই চোখ তোমাকে দেখার জন্য— প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ।শুনে রাখো, ফিওনা… শত জন্মেও যদি বারবার পুনর্জন্ম নিয়ে ফিরে আসি—আমি প্রতি জন্মে শুধু তোমার হবো আর তোমাকে আমার করে নিবো। এই ড্রাগন প্রিন্স তোমার। ফিওনার প্রিন্স ফিওনার হয়ে থাকবে সারাজীবন। তোমার চুমুতে আগুন জ্বালানো হৃদয় নিয়ে তোমার চোখের মাঝে ভালোবাসা খুঁজতে।
চিরন্তন তোমার,
— হামিংবার্ডের,ফায়ার মনস্টার!!!
নরম আলোয় ভরে উঠেছে পুরো কক্ষ। জানালার পর্দাগুলো ধীরে ধীরে দুলছে, যেনো বাতাসও চুপচাপ শুনছে এক প্রেয়সীর বুকচেরা কান্না।
ফিওনা একা বসে আছে বিছানার পাশে টেবিলের নিচে মেঝেতে। হাতে চেপে ধরা সেই চিঠি— যেটা পড়তে পড়তে তার চোখ দিয়ে অনবরত জল ঝরছে।
চোখের পানি চুপচাপ গড়িয়ে পড়ছে কাগজের ওপর। কিছু অক্ষর ভিজে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু চিঠির প্রতিটা শব্দ যেনো তার হৃদয়ের প্রতিটা শিরায় ছুঁয়ে যাচ্ছে। “তোমার থেকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম…
…আমার সেই রক্তবর্ণ অশ্রু পড়লো লুনার দ্বীপের মাটিতে…”
এই লাইনটা পড়ে হঠাৎ তার গলা বুজে আসে, একটুও আর উচ্চারণ করতে পারে না।
ঠিক তখনই…
“টক… টক…”দরজাটা ধীরে ধীরে খোলে।
ফিওনার ভেজা চোখে তাকিয়ে দেখে সেই দীর্ঘ প্রিয় ছায়া… জ্যাসপার। এক মুহূর্ত, নিঃশব্দ।
ফিওনা যেনো নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না।
তার দৃষ্টি কাঁপে, ঠোঁট নড়ে ওঠে…তারপর সেই কাঁপা কাঁপা হাতে চিঠিটা বুকে চেপে, ছলছল চোখে উঠে দাঁড়ায়।
পরের মুহূর্তেই সে ছুটে যায় জ্যাসপারের দিকে।
” প্রিন্স!”
জ্যাসপারের বুকের ভেতরে ঝাঁপিয়ে পড়ে সে, দুহাতে তাকে জড়িয়ে ধরে।তার বুকের ভেতর চাপা কান্না গর্জে উঠে— চিঠিটা শক্ত করে ধরা, চোখ তুলে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলে… “কেনো…? কেনো এতটা ভালোবাসলে আমায়?
জ্যাসপার কিছু বলে না। শুধু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তাকে।
তার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে ফিসফিস করে বলল—
“কারণ ভালোবাসা মহাবিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর জিনিস,তুমি আমার জীবনে না এলে আমি সেই সুন্দর জিনিসটার সাথে হয়তো কখনোই পরিচিত হতাম না। এই মহাবিশ্বে মানুষ বলো আর প্রানী সবার জীবনেই ভালোবাসার স্বাদ একবার হলেও পাওয়াটা জরুরি।”
আযদাহা সিজন ২ পর্ব ৫২
চুপচাপ, নিঃশব্দে… আলো গলায় পড়ে, চোখে পড়ে তাদের দুটি চোখের জল। একটা চোখে লাল অশ্রু, অন্যটায় স্বচ্ছ। তাদের মাঝে তখন আর কোনো দূরত্ব নেই, শুধু একটাই সত্য
ভালোবাসা।