আয়ুর প্রহর পর্ব ১৭

আয়ুর প্রহর পর্ব ১৭
তুশিতা নুর তৃষ্ণা

রোদ্রৌজ্জল দুপুর।আয়ুশ আর প্রণয় ঘুম থেকে উঠে পড়েছে।দু’জন গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিয়েছে।
ওরা ঘুম থেকে উঠে পড়েছে দেখে প্রহর তাদের দু’জনের জন্য খাবার বাড়তে লাগলো।
আজকে প্রহর রেঁধেছে ভাত,শুকনো মরিচ আর পেঁয়াজ হালকা ভেজে আলুভর্তা,ডালভর্তা,মরিচভর্তা,ঘন ডাল আর পেঁয়াজ দিয়ে ডিমভুনা।
প্রহর ডাইনিংয়ে খাবার পরিবেশন করতে লাগলো। ততক্ষণে আয়ুশ আর প্রণয় চেয়ারে এসে বসেছে।প্রহর আয়ুশ আর প্রণয়ের সামনে প্লেট রাখতেই আয়ুশ প্রহরকে জিজ্ঞেস করলো,
-“ তুমি খেয়েছো?”
প্রহর মাথা নিচু করে বললো,“ না!”
-“ খাওনি কেন?”
-“ আপনি আর ভাইয়া খাবার খাননি তো ,তাই আমার ও আর খেতে ইচ্ছে করেনি।”
উড়নায় আঙুল প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে বললো প্রহর।

-“ এমন বললে হবে?এখনই বসে পড়ো আমাদের সাথে।খেয়ে নাও জলদি।”
-“ আপনারা খেয়ে নিন,আমি না হয় পরে…..”
-“ বেশি কথা আর একটাও নয় প্রহর,এখনি খাবে তুমি।কথা না বলে বসে পড়ো।”
প্রহর খেতে বসে পড়লো।প্রণয় তাকিয়ে তাকিয়ে তাদের কথালাপ দেখলো।বোনের প্রতি বোনের স্বামীর সুন্দর ব্যবহার দেখে সে মুচকি হাসলো।
পরক্ষণেই তার মন বিষাদে ছেয়ে গেল।সেও তো চাইলেই পারতো এমন একটা মুহুর্তে আয়ুশের জায়গায় নিজেকে দেখতে। কিন্তু….অনীতার কী হয়েছে?সে প্রণয়ের সাথে এমন ব্যাবহার করছে কেন?সে কি কখনোই প্রণয়কে তার অধিকার দিবে না?
তখনি প্রহরের ডাকে প্রণয়ের ভাবনা হারালো।প্রহর জিজ্ঞেস করলো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-“ খাচ্ছো না কেন ভাইয়া?”
প্রণয় ইতস্ততবোধ করে বললো,
-“ কোথায়?এই তো খাচ্ছি।”
-“ উঁহু, তখন থেকে দেখছি,ভাত মেখেই চলেছো। কিন্তু মুখে তুলছো না! রান্না খারাপ হয়েছে নাকি ভাইয়া?”
-“ না বনুই।তেমন কিছুই নয়।রান্না বেশ সুস্বাদু হয়েছে। খাচ্ছি তো আমি।এই দেখ,খাচ্ছি।” বলেই এক লোকমা ভাত মুখে পুরলো প্রণয়।
প্রহর মুচকি হেসে খাবার খাওয়ায় মনোযোগ দিল।
ভাই-বোনের এমন সম্পর্ক দেখে আয়ুশের অনীতার কথা মনে পড়লো। চুপিচুপি একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে সেও খাওয়ায় মনোযোগ দিল।
রান্না সত্যিই দারুন হয়েছে।

বিকেলে..
দুপুরের খাবারের পর প্রণয় আর আয়ুশ গোসল করে মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়েছিল।এসে আরেকটু বিশ্রাম নিতে নিতে আসরের আযান হয়ে যায়।ওরা আসরের নামাজ পড়ে আবার বাড়িতে চলে আসে‌।তারপর আয়ুশ কোনো একটা কাজে চলে গিয়েছে।আর প্রণয় বিছানায় শুয়ে শুয়ে ফোন ঘাটছে।বাইরে হাঁটতে ইচ্ছে করছে তার, কিন্তু যেতে ইচ্ছে করছে না।
এইদিকে প্রেমা বসে বসে তার ফ্রেন্ডদের সাথে তার স্কুলের বিদায় অনুষ্ঠান সম্পর্কে কথা বলছে।
প্রেমা আর প্রণয় দু’জন দু’জনের রুমে ব্যাস্ত।প্রহর আর কী করবে।সে ঠিক করলো,এখন গিয়ে রুম গোছাবে।
প্রহর রুমে গোছাতে লাগলো।রুম গুছানোর পর সে একটা সেলফ গুছাতে গেল।সেলফে আয়ুশের জামাকাপড় রাখা ছিল।সেখান থেকে আয়ুশের একটা শার্ট উঠিয়ে তা ভাঁজ করতে গিয়ে প্রহর অনুভব করলো,শার্টটার মধ্যে কিছু একটা আছে।প্রহর পুরো শার্ট খুললো।শার্ট মেলাতেই তার মধ্য থেকে একটা কাগজ নিচে পড়লো।প্রহর কাগজ তুলে দেখতে লাগলো।তার চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল।এ কী দেখছে সে..!
দেখার পর সাথে সাথেই কাগজটা শার্টের মধ্যে গুঁজে রেখে দিলো।আগে ঠিক যেমন ছিল,তেমন করে।

রাতে আয়ুশ বাড়ি ফিরলো।সাথে কিছু বাজার নিয়ে এলো।প্রহর রাতের জন্য পোলাও,মুরগীর মাংস আর মাছভাজা রান্না করলো।সাথে টমেটো,পেঁয়াজ,কাঁচামরিচ আর শসা দিয়ে মজাদার সালাদ বানিয়ে রাখলো।
রাতের খাবার শেষ করে সবাই ঘুমোতে গেলো।রুমে ঢুকে প্রহর দেখলো আয়ুশকে বেশ অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে।তাই সে আয়ুশের পাশে গিয়ে বসে আয়ুশকে বললো,
-“ কিছু হয়েছে?”
আয়ুশ মাথা নিচু করে বসেছিল।প্রহরের কথায় সে প্রত্যুত্তর করলো,
-“ তেমন কিছু না।একটা কথা ভাবছি।”
-“ কী কথা,আমাকে বলা যাবে?” প্রহর বেশ আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো।
আয়ুশ বললো,
“ অবশ্যই।তোমাকেই তো জিজ্ঞেস করবো ভাবছি।”
প্রহর খানিকটা চমকালো।সে যে ওই কাগজটা দেখে ফেলেছে,তা কী আয়ুশ জেনে ফেললো নাকি।সে তো তেমন কোনো আচরণ করেনি আয়ুশের সাথে। রুমে আসার আগে আয়ুশের থেকে দূরে থেকেছে আর তার সাথে আগের চেয়ে একটু কম কথা বলেছে।এতটুকুই!তবে কি হলো,আয়ুশ বুঝে ফেললো না তো!
তবুও প্রহর নিজেকে ধাতস্থ করে বললো,

-“ হ্যাঁ বলুন।”
-“ ভয় পেয়ো না খুব সহজ প্রশ্ন।”
-“ ভয় পাচ্ছি না তো।”
আয়ুশ সামান্য হাসলো।তারপর জিজ্ঞেস করলো,
-“ আজকে আমাদের ফ্ল্যাটে কেউ এসেছিল কিংবা আমাদের রুমে?”
-“ না তো। কেউই আসেনি।”
-“ দুপুরের পর প্রেমা বা প্রণয় আমাদের রুমে এসেছিল?”
প্রহর একটু ভেবে বললো,
-“ না তো।কেউই আসেনি।তারা তাদের রুমেই ছিল সারাদিন।”
-“ আড্ডা দাওনি ?”
-“ বিকেলের পর একটু আড্ডা দিয়েছিলাম‌।ড্রয়িংরুম বাদে আর কোথাও আড্ডা দেইনি আমরা।”
-“ ও আচ্ছা,তবে ঠিক আছে।” বলেই আয়ুশ ঈষৎ হাসলো।সে যা আন্দাজ করেছে তাই।তবে এতে কোনো সমস্যা নেই বলেই মনে করলো সে।

পরদিন সারাদিন ভালোই কাটলো।প্রণয়ের এক জায়গায় কাজ ছিল।সেখানে সে গিয়েছে।আয়ুশের আজ নাকি আবার কি জরুরী কাজ আছে।সে ও বাড়িতে নেই আজ।প্রেমা আর প্রহর সারাদিন গল্পগুজব আর রান্নায় কাটিয়েছে‌।বাড়িওয়ালার মেয়ে মিষ্টি আজ তাদের সাথে পরিচিত হতে এসেছিল।প্রেমা আর প্রহর যে পরিমাণ মিশুক মেয়ে, মিষ্টির সাথে ভাব জমাতে তাদের আর বেশি সময় লাগেনি।
সবাই সন্ধ্যা পর্যন্ত আড্ডা দিল।এশার পর প্রহর আর প্রেমা নামাজ পড়ার একটু পরই প্রণয় বাড়িতে আসলো।আজকে বাড়িতে গিয়েছিলো সে।
এসে ফ্রেশ হয়ে প্রেমার সাথে কথা বলতে এলো প্রণয়।প্রহর আর প্রেমা একসাথে আড্ডা দিচ্ছিলো দেখে প্রণয় বললো,

-“ ভালোই হয়েছে তোরা একসাথে আছিস।”
প্রেমা জিজ্ঞেস করলো,
-“ কিছু বলবে নাকি ভাইয়া?তোমাকে খুব আপসেট দেখাচ্ছে।”
-“ হ্যাঁ রে।বলতেই তো এলাম।আজকে বাড়িতে গিয়েছিলাম।”
-“ তো কী হয়েছে?বাড়িতে যাওয়ার পর তোমায় মে’রেছে না কী কিছু করেছে?বকেছে তোমায়?কি বলে বকেছে?বাসায় তোমার জায়গা হবে না বলেছে?আমাকে নিয়ে কিছু বলেছে?মা কি…. ”
প্রেমার কথা শেষ না হতেই প্রণয় নিজের দু হাত দু কনাএ চেপে প্রহরকে বললো,
-“ একে থামা তো বনুই।এসেছি কথা বলতে।কথা না শুনেই কান ঝালাপালা করে দিল।”
প্রহর প্রেমার কনুইয়ে খোঁচা দিয়ে মুখে আঙুল দিয়ে প্রেমাকে চুপ করে থাকতে বললো,
-“ এখন শোন।”
প্রেমা বললো,“ বলো।”
-“ তুই চুপ থাকবি?” চোখ গরম করে বললো প্রণয়।
প্রণয়ের চোখ গরম দেখে প্রেমা নিজের ঠোঁটে আঙুল দিয়ে মাথা নাড়িয়ে আচ্ছা আচ্ছা বলতে থাকলো।প্রণয় কথা বলা শুরু করলো,
-“ মা বাসায় যাওয়ার জন্য ফোন দিয়েছিল।তাই বাসায় গিয়েছিলাম।যাওয়ার পরই মা বলতে লাগলো,প্রেমাকে নিয়ে বাসায় যেতে। কিন্তু প্রেমা তো আগেই বলে দিয়েছে,তাকে যেন বাসায় যাওয়ার জন্য না বলি।বাসায় যাওয়ার ইচ্ছে হলে সে নিজেই আমায় বাসায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলবে।এই কথাই মাকে বলেছিলাম।তারপর..”
প্রহর বললো,“ তারপর..”

প্রণয় হাত দিয়ে নিজের মুখ ঘষে প্রেমার দিকে তাকিয়ে বললো,
“ মা বললো,প্রেমার নিজের ইচ্ছায় আর কিছু চলবে না।প্রেমাকে এখানে থাকতে দিতে অনেক আপত্তি করেছিল মা‌।অনেক বুঝিয়েছি।তাই ওর এখানে থাকার এতো আবদার মা ফেলে দিতে পারেনি।বলেছেন প্রেমা আর কতদিন এখানে থাকবে এখানে আসার পর ফোন দিয়ে বলে দিতে ।”
প্রেমা বললো, “ এক মাসের কমে আমি যাবো না ভাইয়া।আমি আরও এক মাস থাকবো।এখনি বলে দাও।”
“আচ্ছা,এখনি কল করে বলে দিচ্ছি” বলেই প্রণয় তার মা সাবিনা বেগমকে ফোন দিলো। অনেকক্ষণ কথা বলে কথা বলা শেষ করে প্রেমার উদ্দেশ্য বললো,
মা বলেছেন,গুণে গুণে আর দশ-বারোদিন থাকতে পারবি।এরপর তোকে বাসায় চলে যেতে হবে।”
প্রণয়ের কথা শুনে প্রেমা মুখ গোমড়া করে বললো,
-“ আমি তো ভেবেছিলাম,প্রহুর কাছে পাক্কা একমাস থাকবো। সেখানে এখন মাত্র ১০-১২ দিন।”
প্রহর প্রেমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,

-“ মন খারাপ করিস না প্রেমা‌। আল্লাহ চাইলে আবার আসতে পারবি।মা যে এখন থাকতে দিয়েছে এইটাই অনেক।”
প্রেমা মাথা নাড়িয়ে প্রহরকে জড়িয়ে ধরলো।
তখনি কলিংবেল বেজে উঠলো।প্রেমা প্রহরকে ছেড়ে দিলে প্রহর দরজা খোলার জন্য উঠলো,আয়ুশ এসেছে হয়তো।
প্রহর উঠার পর প্রেমা ফিসফিসিয়ে প্রণয়কে জিজ্ঞেস করলো,
–“ মা এমন কেন করে ভাইয়া?”
প্রণয় মলিন মুখে বললো,“ মা বলে,এখানে বনুইয়ের কাছে থাকলে তুই নাকি অনিরাপদ থাকবি।তাই এমন…!
-“ মা কবে বুঝবে!”
বলেই দুই ভাই-বোন দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

রাত ১২:০০ টা।
আয়ুশ কোথাও যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে।প্রহর ও ঘুম থেকে সজাগ হয়ে গিয়েছে।প্রহরকে হঠাৎ ঘুম থেকে উঠতে দেখে আয়ুশ ও অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো।
প্রহর শোয়া অবস্থায়ই আয়ুশ কে জিজ্ঞেস করলো,
-“ কোথায় যাচ্ছেন এতো রাতে?”
-“ একটা কাজ আছে।”
প্রহর উঠে বসলো।আয়ুশের কাছে গিয়ে বললো,
-“ কি এমন কাজ যার জন্য আপনাকে যখন তখন বাইরে যেতে হয়।”
আয়ুশ প্রহরের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“ আশা করছি,তুমি তা জানো।”
-“ কিন্তু আজ কোথাও যাবেন না প্লিজ।”
-“ আমাকে যেতে হবে প্রহর।”

আয়ুর প্রহর পর্ব ১৬

প্রহর বিছানা থেকে নেমে আয়ুশের হাত ধরে আয়ুশকে এনে বিছানায় বসালো।তারপর নিজে ফ্লোরে বসে আয়ু্শের হাঁটুর উপর আয়ুশের দু’ হাতের ভাঁজে নিজের হাত রাখলো।তার চোখ ছলছল করছে।ছলছল চোখেই আয়ুশকে জিজ্ঞেস করলো,
-“ একটা কথা বলি?”
-“ বলো?”
-“ আয়ু ছাড়া মানুষ বাঁচে?”

আয়ুর প্রহর পর্ব ১৮