আয়ুর প্রহর পর্ব ২০

আয়ুর প্রহর পর্ব ২০
তুশিতা নুর তৃষ্ণা

বিকট শব্দে গু’লি করার আওয়াজ হলো। মিস্টার শামসুজ্জামানের হাত থেকে বন্দু’ক ছিটকে নিচে পড়ে গেল।আয়ুশ বন্দুক তার কাছে নিয়ে এলো।
তৎক্ষণাৎ কয়েকজন অফিসার বাড়িতে ঢুকে পড়লেন। শামসুজ্জামানের কাছে গিয়ে তাকে ধরে ফেললেন তারা।
এইদিকে শেহনাজ পারভীন হতচকিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।এতোকিছু একসাথে ঘটে যাবে,তিনি তা কল্পনাও করতে পারেননি। আশ্চর্য হয়ে গিয়েছেন।সবচেয়ে বেশি আশ্চর্য হয়েছেন যা দেখে, শামসুজ্জামানকে লক্ষ্য করে আর কেউ নয়,তারই মেয়ে অনীতা শুট করেছে।
মিস্টার শামসুজ্জামানকে নিচে আনা হলো।তারপর একজন অফিসার শামসুজ্জামানকে হ্যান্ডকাফ পড়িয়ে বললেন,
-“ ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট!”
তারপর শেহনাজের হাত থেকে সোফার কভার খুলে তার হাতেও হ্যান্ডকাফ পড়িয়ে দিয়ে বললেন,

-“ আপনিও!”
শেহনাজ আর শামসুজ্জামান একসাথে বলে উঠলো,
-“ আমাদের অপরাধ?”
তাদের কথা শুনে এক অফিসার তাদের উদ্দেশ্য করে বললেন,
-“ বাকী যা কথা হবে সব থানায়।এখন আপনারা আমাদের সাথে চলুন।”
ততক্ষণে অনীতা ও তার রুম থেকে বেরিয়ে এসেছে।সে আসলে আয়ুশ তাকে জিজ্ঞেস করলো,
-“ বাসায় একা থাকতে পারবি অনী,নাকি থানায় যাবি আমাদের সাথে?”
-“ না ভাইয়া!তোরা যা।আজকে এমনিতেই যা ধকল গিয়েছে,তাই আর যাবো না। তাছাড়া এসব মানুষদের পরিণতি দেখতেও আমার আর ইচ্ছে হচ্ছে না। তোরা যা।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

শেষ কথাটা বাবা-মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো অনীতা।মায়ের বলা সব কথা তার রুমের দরজার আড়াল থেকেই শুনেছে সে‌।মা-বাবার পূর্ব ষড়যন্ত্র সবই জানে অনীতা। কিন্তু তার মা তার নিয়ে এতোটা নোংরা কথা বলবে আর তার বাবা নিজের ঔরসজাত ছেলের দিকে বন্দুক তাক করবে এতদূর ভাবতে পারেনি অনীতা।
অনীতা নিজেও ক্রাইম ডিপার্টমেন্টে কাজ করতে আগ্রহী।তাই আগে থেকেই অস্ত্র সঠিকভাবে পরিচালনার ট্রেনিং দিয়ে রেখেছে সে।তার লাইসেন্স কৃত পিস্তল ও আছে।আয়ুশের সাথে দু’বার ডিপার্টমেন্টেও গিয়েছিলো সে।আয়ুশ আগে থেকেই অনীতাকে আজকে রাতের বিষয়ে জানিয়ে রেখেছিল।আর বলেছিল,সে যেন তার দরজার আড়াল থেকে সব লক্ষ্য করে,আর কোনো বিপদ হলে যেন নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করে।অনীতা তাই করেছে।নিজের বাবার উপর থেকে বিশ্বাস উবে গিয়েছে তার। কিন্তু চাইলেই তো মে’রে ফেলতে পারবে না।খাপে খাপে নিশানা ঠিক রেখে ঠিক বাবার হাতে শ্যুট করেছে অনীতা।
অনীতার কথা শুনে আয়ুশ বললো,

-“ আচ্ছা,তবে থাক।আর পলাশ চাচা…..
মাথা পিছু ঘুরিয়ে পলাশ চাচাকে কিছু বলতে যাবে আয়ুশ,তখনি দেখে পলাশ চাচা সেখানে নেই। হতচকিত গলায় আয়ুশ বলে,
“ পলাশ‌ চাচা…পলাশ চাচা কোথায় গেল?একটু আগে তো এইখানেই ছিল ।”
আয়ুশের কথা শুনে সবার খেয়াল হলো, সত্যিই তো পলাশ কোথাও নেই।
আয়ুশ বললো,“আমি বাইরে থেকে দেখে আসছি।আপনারা সবাই এই দুইজনকে নিয়ে থানায় চলে যান।”বলেই আয়ুশ বাসা থেকে বের হতে লাগলো।
তখনি এক অফিসার খেয়াল করলেন সোফায় কিছু একটা রাখা।তিনি বলেন উঠলেন,

-—“ স্যার,সোফায় কিছু একটা রাখা আছে।একটা ফোন আরেকটা কাগজ।”
অফিসারের কথা শুনে আয়ুশ দাঁড়িয়ে পড়লো। তড়িৎ গতিতে এসে দেখলো,সোফায় একটা ফোন আরেকটা কাগজ রাখা।সে কাগজ খুলে তার মধ্যকার লিখা পড়তে লাগলো।তাতে ভাঙা ভাঙা অক্ষরে লিখা আছে,
“ স্নেহের আয়ুশ।আমি জানি,যখন তুমি এ চিরকুটটি পড়বে,তখন আমি তোমার কাছাকাছি থাকবো না।এটা এইজন্য জানি,কেননা,আমি চলে যাওয়ার আগ মুহূর্ত ছাড়া এ চিরকুট তোমাকে কখনোই লিখতাম না।
সে যাই হোক,মূল কথায় আসি।
আমি চলে যাচ্ছি।আর কখনো দেখা হবে না আমাদের।আমাকে আর ভুলেও খোঁজার চেষ্টা করো না আয়ুশ।আমি অনেক দূরে চলে যাবো।
এতোদিন মনের মধ্যে যে পাপ পুষে রেখেছিলাম,আহানা আমার হত্যা’কারীদের ধরিয়ে দিতে পেরে সে কষ্ট অনেকটাই লাঘব হবে আমার।
আমি জানি, আমি এই কাজটি পারবো।তাই আগেই লিখে রাখলাম।
আর এই ফোনটার ভিডিও রেকর্ডারে শেহনাজের বলা সব কথা রেকর্ড করা হয়েছে।এ প্রমাণাদি তোমাদের অনেক সাহায্য করবে।

তোমাদের সাহায্য করতে পেরে নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয়ে গিয়েছে আমার,তাই মনে করছি। কিন্তু আমিও তো আহানা আপার হ’ত্যাকে আত্মহত্যা বলে স্বীকারোক্তি দিয়েছিলাম।তার জন্য আমার ও শাস্তি হতে পারে। কিন্তু আমি এ বয়সে জেলে বন্দী হতে চাইনা।তাই আমাকে খুঁজো না আয়ুশ বাবা।চলি। ভালোভাবে থেকো।
আসি
পলাশ চাচা”
পুরো চিঠি পড়া শেষ করে আয়ুশ একটা নিঃশ্বাস ফেললো।পলাশ চাচা তাদের যথেষ্ট সাহায্য করেছে।পলাশ চাচা না থাকলে হয়তো আয়ুশ তার মা আহানার খু’নিদের ধরতে পারতো না। তাছাড়া পলাশ চাচাও বা ওইসময় কি করতে পারতেন?নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্যই তো হ’ত্যাকে আত্নহ’ত্যা বলে সাক্ষ্য দিয়েছেন।আয়ুশ নিজেই তো পরিস্থিতি দেখেছে।আর পলাশ চাচা তো নিজের করা অন্যায়ের স্বীকারের পাশপাশি প্রায়শ্চিত্ত ও করে গিয়েছে।তাই পলাশ চাচার চলে যাওয়াকে আয়ুশ মেনে নিল।
কাগজ আর ফোন পকেটে পুরে আয়ুশ শামসুজ্জামান আর শেহনাজসহ বাকী অফিসারদের নিয়ে থানায় চলে গেল।অনীতা বাসায় একা বসে রইলো।

আয়ুশ তার বাবা আর সৎ মায়ের বিরুদ্ধে থানায় আগেই এফ আই আর করে রেখেছিল।তার সাথের অফিসারদের সাথে সব প্রমাণাদি নিয়ে সে রাতেই থানায় চলে এলো।
প্রমাণাদি বলতে,সবচেয়ে বড় প্রমাণ পলাশের রেকর্ড করা ভিডিওতে পলাশের মুখ না দেখা গেলেও শেহনাজের মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।আর পলাশ ও শেহনাজের কথাও স্পষ্ট শোনা গিয়েছে। শামসুজ্জামান বন্দুক তাক করার সময় আয়ুশ চতুরতার সহিত তার শার্টের বুকের পাশে পকেটে থাকা পেন ক্যামেরা দিয়ে শামসুজ্জামানের পজিশন রেকর্ড করে নিয়েছে।
তাই শেহনাজ আর শামসুজ্জামানকে আহানার হত্যা’কারী হিসেবে চিহ্নিত করা হলো।আর এতো শক্ত প্রমানাদির জন্য তারাও তাদের অপরাধ অস্বীকার করার জো পেল না।

ফজরের আযান শোনা যাচ্ছে।
মিস্টার শামসুজ্জামান আর শেহনাজকে আলাদা আলাদা লকাবে রাখা হয়েছে।সকাল ১০:০০ টার মধ্যেই তাদের কোর্টে চালান করা হবে।
আয়ুশ মসজিদে গিয়ে ফজরের নামাজ পড়ে অনেকক্ষণ বসে রইলো।নিজের মায়ের জন্য অনেকক্ষণ দোয়া করলো।তার ভিতরটা ফেটে আসছে।খুব জোরে কান্না করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু পারছে না সে।তবে তার শুকিয়ে যাওয়া চোআ থেকে দুয়েকফোটা অশ্রু নিরবে বের হয়েছে‌ মাত্র।চোখের পানি গন্ডাদেশে আসা মাত্রই পুরো গালে চোখের পানি মাখিয়ে নিয়েছে সে।
একটু দেরী করেই মসজিদ থেকে বের হলো আয়ু্শ। পথিমধ্যে দেখতে পেলো এই সকাল বেলা একটা মা তার ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। প্রাতঃভ্রমণ করছে।
আয়ুশের দু চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।
ফের মনে পড়ে যায় তার যায় তার মায়ের কথা।
আয়ুশ যখন ছোট ছিল,তার বাবা তাকে সময় দিতো না বললেই চলে।যা সময় দিতো সব আয়ুশের মা আহানা দিতেন।
আয়ুশকে সময় দেওয়ার জন্য,আয়ুশ কে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তিনি ব্যাবসা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছিলেন।
আয়ুশকে নিয়ে তিনি প্রায়ই প্রাতঃভ্রমণে বের হতেন।কখনো কখনো বিকেলে বের হতেন।আয়ুশ কে নানান কিছু দেখাতেন।সবসময় আগলে রাখতেন।

“ এতো তাড়াতাড়ি এতো কিছু শিখালে কি এতো তাড়াতাড়ি চল যাওয়ার জন্যেই!তোমার আগলে রাখার দিনগুলো এতো অল্প সময় কেন ছিল মা!তোমার মতো কেউ আমার মাথায় অতি স্নেহে হাত বুলিয়ে দেয় না।তোমার মতো করে আমায় “ আব্বা” বলে কেউ ডাকে না।তোমার মতো করে কেউ আমায় হাসায় না।তোমার মতো আমায় কেউ ভালোবাসে না মা!তোমার জন্য আমি মা ডাকতে পারি না।আমার ধমনীতে কান্নাদের আটকে দেই।বাবার আদর আমি পাইনি।কিন্তু তুমি আমায় একসাথে বাবা-মায়ের আদর দিয়েছো।যখন কাউকে তার মায়ের সাথে দেখি,আমার তোমাকে মনে পড়ে মা।তুমি আমার অনুপ্রেরণা ছিলে।তুমি ছিলে শুধু “আমার মা”!আজ কোথায় গেলে মা!”
বিড়বিড় করে নিজের সাথে কথাটুকু বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললো আয়ুশ!অনেক যুদ্ধ করে চোখের কোণে পানির ফোটাদের আটকালো আয়ুশ।

একটা ফোন পেয়ে থানায় ফিরে এলো আয়ুশ। মিস্টার শামসুজ্জামান আয়ুশের সাথে দেখা করতে চাচ্ছেন।প্রথমে কারণটা না বুঝতে পারলেও পরে বুঝলো আয়ুশ। তবুও গেল সে।
লকাবের গ্রিলের সামনে যেতেই মিস্টার শামসুজ্জামান আয়ুশকে দেখতে পেয়ে বলে উঠলেন,
“ আয়ুশ তুমি না আমার ছেলে।আমাকে তুমি কিভাবে এখানে ধরে রাখতে পারো । শেহনাজ না হয়,তোমার কেউ না।ওকে তুমি বন্দী রাখতে পারো। কিন্তু তুমি তো আমার রক্ত।আমার অংশ।আমাকে এখানে বন্দী রাখতে তোমার একটুও কষ্ট হবে না আয়ুশ?”
আয়ুশ চোয়াল শক্ত করে বললো,”আপনি আর কিছু বলবেন?আর কিছু বলার আছে আপনার?”
মিস্টার শামসুজ্জামান মুখের ভাব পরিবর্তন করে ফেললেন।স্বর কাঁদো কাঁদো করে বললেন,

-—“ কি আর বলবো বলো।তোমার সাথে আমার কতোকিছুই বলার ছিল। ইচ্ছে ছিল,বাবা-ছেলে কত গল্প করবো।কিন্তু তুমি তো আমায় এইখানে আটকে রেখছো।আমাকে বাহিরে নিয়ে যাও না আয়ুশ?”
-— আমি তো আপনাকে এখান থেকে বের করতে পারবো না আর।সব প্রমাণ রেকর্ড হয়ে গিয়েছে।”
-—তবুও..একটু দেখো আমায় ছাড়াতে পারো কী না!
আয়ুশ মুখের চোয়াল শক্ত করে বললেন,
-—“ কি মনে করেছেন আপনি?আমি চাইলেন আপনি ছাড়া পেয়ে যাবেন?এখানেই থাকতে হবে আপনার ।এখানেই।আর কি বললেন,বাবা-ছেলে মিলে গল্প করার খুব ইচ্ছে আপনার।এমন ইচ্ছে থাকলে ভুলে যান।আমি আপনার ছেলে নই।যখন দিনের পর দিন বিভিন্ন কাজে দূরে থেকেছেন,একবার ও তো ফোন দিয়ে আমার কথা জিজ্ঞেস করেননি। শুধুমাত্র নিজের জৈবিক চাহিদা ছাড়া আমাদের মা-ছেলের খোঁজ করতেও সময় পাননি আপনি।আজকে লকাবে ঢুকানোর পর ছেলের সাথে খুব গল্প করার ইচ্ছে হচ্ছে তাই না?ভুলে যান।

আমার মাকে খুব কষ্ট দিয়ে মে’রেছেন আপনারা দু’জন।আপনাদের ফা’সি না হওয়া পর্যন্ত আমি দমবো না।এতোদিন ক্ষমতার জোর দেখিয়ে আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছিলেন।এখন আমার মায়ের ছেলে পুরো আইন জানে।আপনাকে আপনার যোগ্য শাস্তি আমি দিবোই।দয়া করে আর কিছু বলবেন না।তাহলে আমি ভুলে যাবো আপনি একসময় সম্পর্কে আমার কি হতেন।বিদায়!”বলেই আয়ুশ চলে যেতে লাগলো।
শামসুজ্জামান বুঝলেন,উনার ন্যাকা কাঁদায় ও আয়ুশের মন সহজে পরিবর্তন হবে না। কিন্তু তাও হাল ছাড়লেন না তিনি।নিজের গলার স্বর নরম করে আয়ুশকে ডাক দিলেন,

আয়ুর প্রহর পর্ব ১৯

“ নিজের বাবাকে এভাবে রেখে কষ্ট হবে না তোমার আয়ুশ বাবা?”
শামসুজ্জামানের উক্ত কথা শুনে আয়ুশ দাঁড়িয়ে পড়লো।কতোদিন পর তার বাবা তাকে বাবা বলে ডাক দিয়েছে।রক্তের টান আয়ুশের শিরায় শিরায় বয়ে গেল।সে পিছনে তাকালো। শামসুজ্জামানের মুখের হাসি প্রসারিত হলো। আয়ুশ শামসুজ্জামানের কাছে যাবে কী না তা ভাবতে লাগলো। মুহুর্তেই মত চুড়ান্ত করে সে শামসুজ্জামানের লকাবের দিকে দ্রুত পায়ে এগুতে লাগলো!

আয়ুর প্রহর পর্ব ২১