আয়ুর প্রহর পর্ব ২২
তুশিতা নুর তৃষ্ণা
কিছুদিনের মধ্যেই কোর্টের রায় এসে গেল।
এতোদিন আয়ুশকে বহু দৌড়ঝাঁপ করতে হয়েছে।আজকে রায়ের ফাইনাল তারিখ। চুড়ান্ত শুনানি হবে আজ।অবশেষে আজকে সে একটু শান্ত হলো।
আজকে প্রহর আর অনীতাকে নিয়ে কোর্টে গিয়েছিলো আয়ু্শ।কোর্টে যখন জজ সাহেব রায় কেসের চুড়ান্ত রায় দিচ্ছিলেন,তখন যেন আয়ুশের বুকের ধুকপুকানি বেড়ে যাচ্ছিলো।আয়ুশের একপাশে বসেছিল প্রহর।আর অন্যপাশে অনীতা।আয়ু্শ তাদের দু’জনের হাত খুব শক্ত করে ধরে রাখে।
প্রহর বুঝতে পারে আয়ুশের মনের কথা,ব্যাথা।তাই সে আয়ুশের কাঁধে আলতো করে হাত রাখে।আয়ুশ প্রহরের দিকে তাকালে প্রহর আয়ুশকে ইশারায় স্বান্তনা দেয়,“ যা হবে,সব ভালো হবে।”
রায় ঘোষণা করা হলো।মিস্টার শামসুজ্জামান ও মিসেস শেহনাজকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।বড় বড় উকিল হায়ার করেও তার আর তাদের বাসায় ফিরতে পারেনি,পারবেও না।আয়ুশ আদালতে প্রমাণ হিসেবে রেকর্ডার আর তার সাক্ষ্য সাথে পলাশ চাচার সাক্ষ্য পেশ করার পরই তারা তাদের অপরাধ স্বীকার করে নেয়।এখন তাদের আর নিস্তার নেই।আপাতত জেলখানাকেই নিজ আবাস হিসেবে ধরে নিয়ে সেখানেই বাকী জীবন পাড়ি দিতে হবে।
আদালতের কাজ সমাপ্ত হওয়ার পর শামসুজ্জামান আর শেহনাজকে যখন ফের জেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো,তখন তারা পুলিশদের কাছে একটু সময় চায়।অনীতার সাথে কথা বলার জন্য।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
শেহনাজ পারভীন জানেন,সৎ বোন হলেও ছোট থেকেই অনীতাকে আয়ু্শ নিজের বোন মনে করে।অনীতাকে আয়ুশ নিজের কলিজা মনে করে।অনীতা আয়ুশ কে যাই বলুক না কেন,আয়ুশ সেটা করতে প্রস্তুত।এখন তিনি ভাবছেন,যদি অনীতাকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে আয়ুশকে বলে শাস্তি কিছুটা কমানো যায়।
তাই অনীতার সাথে দেখা করতে চাইলেন তারা। কিন্তু অনীতা মা-বাবার সাথে দেখা করতে চাইছিলো না।তখনি আয়ুশ অনীতাকে বলে,
“ তোর যদি ইচ্ছে হয়,তাহলে তোর বাবা -মায়ের সাথে দেখা করতে পারিস।
আমি তোকে কখনোই কোনোকিছুর জন্য জোর করবো না অনী।তবে আমি তোকে এতটুকু বলবো,শত অপরাধ করলেও ওরা তোর বাবা-মা।একটু দেখা অন্তত করে আয়।ভালো হবে।”
-—“ তোর ও তো বাবা আছে সেখানে।তুইও আয় আমার সাথে।”
-—“ যে মানুষটা তার নিজ হাতে আমার মায়ের শ্বাসরোধ করেছিল,তার কাছে অন্তত যেতে পারবো না অনী।সে আমার মায়ের,আমার জন্মদাত্রীর খু’নি অনী।আমি যাবো না।আমি চাই ওদের সাথে আর কখনো আমার দেখা না হোক। কিন্তু তুই যা, শেষ দেখা হিসেবে হলেও দেখা করে আয়।”
আয়ুশের শেষোক্ত কথা অনীতার মনে ধরলো।তাই সে বললো,
-—“ তা যা বলেছিস ভাইয়া!শেষ দেখা হিসেবে দেখা তো করতেই পারি।”
বলেই একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বাবা-মায়ের কাছে যায় অনীতা।
তাদের কাছে যাওয়ার পর__
মিসেস শেহনাজ অনীতাকে দেখেই মেকি কেঁদে উঠেন।গলায় কান্নার ভাব এনে আবেগপ্রবণ হওয়ার অভিনয় করে অনীতাকে বলত লাগেন,
“ অনী-রে। আমাদের এখান থেকে নিয়ে যেতে বল না রে।আয়ুশকে বল,আমি তাকে বাড়িতে জায়গা দিবো।আমাকে এখান থেকে নিয়ে যেতে বল।”
-—“ তোমার কি মনে হয় মা?ভাইয়ার যাওয়ার আর কোনো জায়গা নেই।বাড়িতে থাকার লোভে ভাইয়া তোমাদের শাস্তি মওকুফ করবে নাকি?!”
-— “ তা জানি না।তবে আমরা মিলেমিশে থাকবো।অনীরে,তুইই বল।আমি আর তোর বাবা ওই অন্ধকার কারাগারে কিভাবে থাকবো?কী নোংরা জায়গাগুলো। ওগুলো কি আমাদের থাকার জন্য যোগ্য জায়গা বল?একটা কাজের লোক ও নেই।ওখানে কিভাবে থাকবো রে?আয়ু্শ তো তোর কথা শুনে।ওকে বল না,আমাদের এখান থেকে বের করে নিয়ে যেতে।”
মায়ের কথা শুনে অনীতার চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো।তার মানে তার মা এখন তাকে এসব বলার জন্য ডেকেছে।সে দাঁতে দাঁত চেপে উত্তর দিলো,
“ যখন বড়মাকে মেরেছিলে তখন থেকেই ভি আই পি কারাগারের ব্যাবস্থা করে রাখতে পারলে না?তখন মন কোথায় ছিল?জানতে না,সত্য কোনোদিন চাপা থাকে না?দেখলে তো, তোমাদের জঘন্য কর্মের ফল কত সুন্দর। আগে থেকে এতোকিছু ভাবলে না,যে একবার ধরা পড়লে কি হবে?এখন থাক,ওই চার দেয়ালের কারাগারে।পাপের প্রায়শ্চিত্ত কিছুটা হলেও করো।অন্তত এখন অনুতাপ করো।ভালো লাগবে।”
মেয়ের মুখের এমন কথা শুনে শামসুজ্জামান রেগে গিয়ে কিছু বলতে গেলে শেহনাজ কনুইয়ের খোঁচা দিয়ে শামসুজ্জামানকে কথা বলতে নিষেধ করলেন।এখন অনীতার সাথে শান্তভাবে কথা বলতে হবে।তার মনটাকে গলিয়ে করুণা নিতে হবে।তাই তিনি আবার বললেন,
-—“ কার জন্য করেছি,বল তো অনী! আমাদের সুখের জন্যই তো।আহানাকে না মা’রলে জীবনে শান্তিতে থাকতে পারতাম?এতো আরাম-আয়েশ একা একা ভোগ করতে পারতাম?বল।”
এইবার মায়ের এহেন কথা শুনে অনীতা রেগে যায়,সে বলে
-—“ আমার না এখন খুব ঘৃণা হচ্ছে এই ভেবে যে,তুমি আমার মা!যদি সৃষ্টিকর্তার নিয়মসমূহে এমন কোনো নিয়ম থাকতো যে,যে যার মতো ইচ্ছেনুযায়ী মা বেছে নিবে,তাহলে আমি কখনোই তোমার গর্ভে আসতাম না।প্রয়োজন হলে,কোনো সহজ সরল দরিদ্র মহিলার ঘরে জন্মাতাম। তবুও তোমার মতো খু’নির ঘরে নয়।
একজন ভালো মানুষকে মার’লে শান্তি পাওয়া যায়!জানতাম না তো মা!
তো এখন তো ভালোই হয়েছে।বড়মাকে মেরেছো,এখন খুব শান্তিতে থাকো।আশা করছি তোমাদের এখানে খুব ভালো লাগবে।
জানতো মা, সৃষ্টিকর্তা ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে দেন না।এখন বুঝছো তো!”
শেহনাজ চুপ হয়ে গেলেন।অন্যদিকে শামসুজ্জামান শেহনাজের দিকে রাগান্বিত চোখে তাকিয়ে কি যেন বিড়বিড় করতে লাগলেন।
তখনি একজন কর্তব্যরত কনস্টেবল বললেন,
“ অনেক সময় দিয়েছি আপনাদের।কথা শেষ।এবার চলুন।” বলেই শামসুজ্জামান আর শেহনাজের কাছে এগিয়ে আসেন তিনি। সাথে আরো কয়েকজন কনস্টেবল।
এ কথা শুনে অনীতা তার বাবা-মায়ের দিকে তাকায়।সে বলে,
“ আশা করছি,চার দেয়ালের মাঝে তোমাদের র জীবন বেশ ভালোই কাটবে।চললাম।ভালো থেকো।” বলেই চলে যেতে লাগে অনীতা। তার ইচ্ছে হয়, পিছু ফিরে বাবা -মাকে একটাবার জড়িয়ে ধরতে।জড়িয়ে ধরে একটু কান্না করতে। কিন্তু কেন জানি তার পা পিছু ফিরতে তাকে বাঁধা দেয়।কান্না আটকে রেখে অনীতা কোর্টের বাইরে যেতে অগ্রসর হয়।বাইরে আয়ুশ আর প্রহর তার জন্য অপেক্ষা করছে।
এইদিকে শামসুজ্জামান আর শেহনাজকে পাশপাশি দুইটা লকাবে রাখা হয়েছিল। জেলখানার শিকের ফাঁক দিয়ে তারা দুইজন কথা কাটাকাটি করতে থাকে। তাদের কথার আওয়াজে একজন কনস্টেবল এসে তাদের ধমক দিয়ে গেলে শামসুজ্জামান শেহনাজের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কয়েকটা গালি দিয়ে বলে,
-“ তোর জন্যই আমার জীবনটা পুরো শেষ কালনাগীন।তোর চমড়ার রং সাদা হলেও তোর নোংরা নোংরা প্ররোচনায়ই আমি আমার সব শেষ করেছি।সব হারিয়েছি তোর জন্য।চাইলে ভুল শোধরাতে পারতাম। কিন্তু তোর জন্যই আজকে আমার এই হাল।…….!”
-—“ দোষ কি আমার একার নাকি?তুমিই তো আমকে প্রথম পছন্দ করেছিলে।আর আহানাকে মা’রারা প্ল্যানটা তো দু’জনে মিলেই বানিয়েছিলাম। কিন্তু তুমি এখন………….
শেহনাজ আরও কিছু বলতে উদ্যাত হলে একজন মহিলা কনস্টেবল এসে মিসেস শেহনাজকে শামসুজ্জামানের থেকে দূরে আলাদা লকাবে নিয়ে রাখেন। শামসুজ্জামান একা একাই শেহনাজকে গালাগালি করতে থাকেন। পাশাপাশি নিজেকেও ধিক্কার দিতে থাকেন। কিন্তু এখন কোনো লাভ নেই।
__
অনীতা কোর্ট থেকে বের হলে আয়ুশ অনীতা আর প্রহরকে নিয়ে তার মায়ের কবরের কাছে যায়। অনীতা আর প্রহর দূরে দাঁড়িয়ে থাকে।আয়ুশ একা একা মায়ের কবর জিয়ারত করে সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে একা একা তার মায়ের সাথে কথা বলে।
মায়ের কবরের উপর থেকে হালকা কিছু মাটি উঠিয়ে হাতের তালু চোখের কাছে নিয়ে আসে আয়ুশ।হাতের তালুতে রাখা ওই মাটির উপর আয়ুশের চোখের পানি টুপটুপ করে পড়ে।সে বিড়বিড় করে বলতে থাকে,
“ আজকে আমি তোমার হত্যা’কারীদের শাস্তি দিতে পেরেছি মা।তুমি চলে যাবার পর তোমার আয়ুশ তোমাকে যে কথা দিয়েছিল।তা আজ সে পূর্ণ করেছে মা।”
বলেই আবারো ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে আয়ুশ। শুধু ভাঙা ভাঙা গলায় বলে “ ওপারে ভালো থেকো মা।”
দূর থেকে আয়ুশের নিরব কান্না দৃষ্টিগোচর হয় প্রহর আর অনীতার।নিজের কাছের মানুষের মন খারাপ আমাদের মন খারাপ হয়,আর তাদের মন ভালো থাকলে আমরাও খুশি থাকি।
আয়ুশ প্রহর আর অনীতা দু’জনেরই বেশ কাছের।তাই আয়ুশের কান্না দেখে প্রহর আর অনীতা দু’জন দু’জনের হাতে হাত রেখে নিজেরাও কেঁদে ফেললো।
সন্তানের দোয়া বাবা-মায়ের জন্য কবুল হয়।তাই আয়ুশ মায়ের কবরের কাছে আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে তার মায়ের জন্য দোয়া করলো।সূরা ইয়াসিন পড়লো।আরো কিছু দোয়া পড়ার পর সে তার মায়ের কবরের পাশ থেকে বেরিয়ে অনীতা আর প্রহরের কাছে এলো।
এসে দেখলো প্রহর আর অনীতা দুজনের চোখেই পানি ছলছল করছে।এ দেখে সে তার দু হাত প্রহর আর অনীতা দু’জনের মাথায় রেখে দুজনের মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
-“ কাঁদে না।”
তারপর প্রহরকে বললো,
আয়ুর প্রহর পর্ব ২১
-—“ প্রহর!যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হয়,আজ অথবা আগামীকাল!তুমি আমার সাথে তোমার বাবার বাড়ি যাবে।”
আয়ুশের কথা শুনে প্রহর অবাক নেত্রে আয়ুশের দিকে তাকালো।আয়ুশ তো জানে প্রহরের মা কেমন!তবুও প্রহরের বাসায় কেন যেতে চাচ্ছে আয়ুশ?
জিজ্ঞাসু নয়নে আয়ুশের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন পরে প্রহর,
“ কিন্তু কেন?”
“ যেতে হবে প্রহর।যেতে হবে।কারণ আছে বলেই বলছি।আমরা আজকালের মধ্যেই রওনা দিবো।রেডি থেকো।”