আষাঢ় রাতের সন্ধ্যা পর্ব ৩৪
Raiha Zubair Ripti
আজ এক সপ্তাহ হলো সন্ধ্যা রাজশাহী তে। ক্লাস, প্রেজেন্টেশন, আর স্টাডি—এগুলো নিয়েই তার ব্যস্ততা। এটেন্ডটেন্স মিস দেওয়া চলবে না তার৷ সন্ধ্যা কে ছাড়া আষাঢ়ের বাসায় মন টিকে না। বাসায় আসলেই খালি খালি লাগে। আষাঢ়ের কাছে দিন যেন থমকে গেছে। সন্ধ্যার অভাব তাকে অস্থির করে তুলেছে।
আষাঢ় তার কেবিনে বসে মনমরা হয়ে বারবার ফোনটা হাতে নিচ্ছে। শেষমেশ আর অপেক্ষা করতে পারল না। সন্ধ্যার নম্বরে কল দিল।
সন্ধ্যা রান্না করছে এমন সময় আষাঢ়ের ফোন আসলো। সন্ধ্যা পাশ থেকে ফোন টা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে আষাঢ় বলে উঠল-
-“ কি করছো?
সন্ধ্যা পোলাও নাড়তে নাড়তে বলল-
-“ প্লাউ রাঁধছি।
আষাঢ ভ্রু কুঁচকালো।
-” প্লাউ টা আবার কি?
-“ আশ্চর্য প্লাউ চিনেন না?
-“ না তো।
-“ প্লাউ মানে পোলাও।
-“ বললেই হতো পোলাও। সেটাকে আবার বিকৃতি করে প্লাউ বলতে হবে কেনো? আর একা একা প্লাউ খাচ্ছো! ওহ্ সরি আমিও তোমার মতো প্লাউ বলতেছি। পোলাও খাচ্ছো একা একা মনে সুখে? আর এদিকে তুমি বিহীন যে আমি রক্তশূণ্য হয়ে গেছি।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
-“ শাক সবজি বেশি বেশি খান তাহলে রক্তশূণ্য থেকে রক্ত পূর্ণ হবে।
-“ মজা নিচ্ছো?
-“ মজা কেনো নিবো আমি? আপনি আমার বেয়াই লাগেন?
-“ আমি রাজশাহী চলে আসি?
-“ তারপর?
-“ তারপর তোমার সাথে থাকবে।
-“ কোথায় হলে?
-“ আরেহ্ না ফ্ল্যাট নিবো একটা।
-“ আপনার মতলব কি আমি বুঝি না? পুরুষ মানুষ বলে কথা। থাকতে পারছেন না তো।
-“ বুঝো তাহলে?
-“ তা বুঝবো না?
-“ ট্রাস্ট মি ওরকম কিছু না। রাতে ঘুম হয় না আমার।
-“ কেনো?
-“ তুমি নাই পাশে। জড়িয়ে না ধরলে ঘুম আসে না তো।
-“ কোল বালিশ নেই পাশে?
-“ কোল বালিশ আর তুমি এক হলে নাকি?
-“ তা বলুন ফোন কেনো দিলেন? এখন অফিসে নাকি হসপিটালে আপনি?
-“ হসপিটালে আছি।
-“ ওহ খেয়েছেন?
-“ না। তোমার স্পেশাল প্লাউ খেতে চলে আসি?
-“ আসুন বাসি গুলো খাওয়াবো।
-“ ভালোবেসে যা দিবে তাই খেয়ে নিব প্রিয়।
-“ আচ্ছা এখন রাখছি। রান্না করতেছি তো। পুড়ে যাবে নাড়া না দিলে।
-“ ওকে আমি তাহলে আসছি বাই বাই।
দুপুরের দিকেই রওনা হয় আষাঢ়। রাতে অফিস থেকে বাসায় ফিরে। রুমে আসতেই দেখে কনা চেয়ারে আসে একটা বই পড়ছে। রাত ব্লেজার টা বিছানায় রেখে বলল-
-“ কি পড়ছো?
কনা আকস্মিক রাতের কন্ঠ শুনে চমকে গেলো। থতমত খেয়ে বলল-
-“ এ..এই তো একটা বই পড়ছিলাম।কফি বানিয়ে আনবো?
-“ কফি লাগবে না। আমার কাছে আসো তো।
কনা বইটা টেবিলে রেখে রাতের দিকে এগিয়ে আসলো। রাত কনার হাত ধরে পাশে বসিয়ে উল্টোপাশ থেকে একটা প্যাকেট এনে কনার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল-
-“ এটা তোমার জন্য।
-“ এতে কি আছে?
-“ সাদা রঙের একটা শাড়ি আছে। পড়ে রেডি হয়ে আসো। আমরা একটু বের হবো।
-“ এই রাতের বেলায়?
-“ হুম। রাতের সময়টা ঘুরার জন্য পারফেক্ট।
কনা ওয়াশরুমে গিয়ে শাড়ি টা পড়ে আসতেই রাত বলল-
-“ চুল গুলো খোলা রাখবে। হাল্কা লিপস্টিক লাগাবে। গাঢ় কাজল দিবে। কপালে লাল টিপ পড়বে।
কনা অবাক হলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রাতের বলা অনুযায়ী নিজেকে সাজাতে সাজাতে বলল-
-“ আজ এত পরিবর্তন ব্যপার কি?
রাত হোয়াইট শার্ট পড়তে পড়তে বলল-
-“ বলেছিলাম সম্পর্ক টাকে নিয়ে আগাবো৷ সেটার জন্যই প্রথম সূচনা টা স্মরণীয় করে রাখার জন্য একটু পরিবর্তন। উই লাইক ইট?
-“ ইয়েস। নাও অ্যা’ম রেডি।
রাত তাকালো কনার দিকে। ঘোর লাগা চাহনি নিয়ে বলল-
-“ ইউর লুকিং ইজ সো প্রিটি।
-“ রিয়েলি?
-“ হ্যাঁ। তো যাওয়া যাক তাহলে।
রাত হাত বাড়িয়ে দিলো।
কনা রাতের হাতটা ধরলো। রাত বাসা থেকে নেমে গাড়ির দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল।
কিছুক্ষণ পর গাড়ি থামল। কনা জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখল একটা ওপেন রুফ রেস্টুরেন্ট। রেস্টুরেন্টটা সাজানো হয়েছে ঝুলন্ত লাইট আর ফুল দিয়ে। কনার চোখে একধরনের বিস্ময় ফুটে উঠল।
কনা অবাক হয়ে নিজের চারপাশের দৃশ্য দেখছিল। হালকা বাতাসে ক্যান্ডেল লাইটের শিখাগুলো কাঁপছিল। টেবিলে সাজানো খাবার আর ফুলগুলো যেন রাতটাকে বিশেষ করে তুলেছে। এই রকম আয়োজনের জন্য সে একদম প্রস্তুত ছিল না।
রাত ধীরে ধীরে চেয়ার টেনে বসলো। তার চেহারায় এক অদ্ভুত প্রশান্তি। আজ তার কোনো ব্যস্ততা নেই, নেই কোনো ক্লান্তি।
” আমরা এখানে কেনো?”
রাত কোনো উত্তর দিলো না। চারপাশে হালকা মিউজিক বাজছে। কনার মনের মধ্যে ধীরে ধীরে উষ্ণতা কাজ করতে শুরু করল।
কনার চোখে চোখ রেখে বলল—
“খুব সুন্দর লাগছে তোমাকে এই সাজে।”
কনা কিছুটা লজ্জা পেয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। রাতের এমন আচরণে কনার মনে অদ্ভুত এক অনুভূতি কাজ করলো। এতদিনের দূরত্ব, অবহেলা—সবকিছু যেন ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে।
-“ একবার তো বলেছেন।
-“ ফের আবার বললাম। ভালো লাগে না বরের মুখে প্রশংসা শুনতে?
-“ আগে তো কখনও করে নি। তাই বুঝতে পারতেছি না আজ।
খাবার সার্ভ করতে করতে রাত গভীর গলায় বলল
” টেবিলে আজ সব তোমার পছন্দের খাবার। আজকের দিন টা আমি তোমার নামে উৎসর্গ করতে চাই। বলো কি চাও আজ তুমি আমার কাছে?
কনা কোনো উত্তর দিল না। তার হাতের আঙুলগুলো কাপছিল।
খাওয়া শেষে রাত কনার হাতটা নিজের হাতে তুলে নিল।
“আজ থেকে নতুন করে শুরু করব, কনা। আমাদের সব পুরনো ভুলগুলো ভুলে গিয়ে একসঙ্গে বাঁচব। আর আমরা আজ বাসায় ফিরবো না।
-“ তাহলে কোথায় যাবেন?
রাত হাতের ইাশারায় রাস্তার ওপর পাশে থাকা রিসোর্ট দেখিয়ে বলল-
-“ ওখানে থাকবো আজ। চলো।
কনা রাতের কথায় কিছুটা বিস্মিত হলো। তার চোখে স্পষ্ট জিজ্ঞাসা ফুটে উঠলো।
“এভাবে হুট করে! মা জানতে চাইবে না?”
রাত মুচকি হেসে বলল—
“মা’কে জানিয়ে রেখেছি। এই রাতটাকে আমরা শুধু আমাদের জন্যই রাখব। তুমি তো চাও?”
কনা খানিকটা ইতস্তত করে মাথা নিচু করল। এভাবে রাতের কাছে আসা তার জন্য নতুন, তবে মনের কোথাও এক ধরনের তৃপ্তি ছিল।
রাত কনার হাত ধরে রিসোর্টের দিকে এগিয়ে গেল। চারপাশে নিস্তব্ধ রাত, নরম বাতাস আর রাস্তার আলোগুলো যেন এই মুহূর্তটাকে আরও গভীর করে তুলছিল। রিসোর্টে পৌঁছে রুমের দরজা খুলতেই কনার চোখে পড়ল মোমের আলোয় সাজানো এক দৃষ্টিনন্দন পরিবেশ। রুম জুড়ে ছড়ানো সাদা গোলাপের পাপড়ি, মৃদু সুগন্ধি আর টেবিলে রাখা একটি ছোট কেক।
কনার মুখে বিস্ময়ের ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠল।
” আরে এ তো পুরোই হানিমুন রুম বলে মনে হচ্ছে।
রাত তার পেছনে দাঁড়িয়ে মৃদুস্বরে হেসে বলল—
” বাহ্ তোমার সেন্স তাহলে বেশ ভালোই।
কনা ধীরে ধীরে ঘুরে রাতের দিকে তাকাল।
রাত কেকের কাছে গিয়ে ছুরি হাতে তুলে নিলো।
“আসো, আজকের রাতটাকে স্মরণীয় করে রাখি। আমাদের নতুন জীবনের শুরুতে মিষ্টি খাওয়া বাকি থাকা ঠিক হবে না।”
কনা এগিয়ে এসে কেক কাটল। রাত নিজের হাতে তাকে খাইয়ে দিল।
রাত ধীরে ধীরে কনার হাত ধরল। তারপর ফিসফিস করে বলল-
“তুমি কি জানো, তোমার হাতটা ধরে রাখলেই আমি আজকাল ভীষণ শান্তি পাই? এতদিন অনেক দূরে ছিলাম, কনা। আজ তোমাকে কাছে পেয়ে সবকিছু ভুলে যেতে চাই।”
কনা মাথা নিচু করে বলল—
“আমি তো কখনও দূরে যেতে চাইনি। সবসময় চেয়েছি আপনার পাশে থাকতে।”
রাত কনার মুখটা নিজের হাতের ভেতর নিয়ে বলল—
“আমি জানি, অনেক কষ্ট দিয়েছি তোমাকে। কিন্তু এবার সব ভুলে শুধু আমাদের ভালোবাসাটাকে নতুন করে সাজাতে চাই। তুমি কি আমার পাশে থাকবে?”
কনা কোনো কথা না বলে শুধু মাথা নাড়ল। তার চোখে লজ্জার রং যেন আরও ঘন হয়ে উঠল।
রাত ধীরে ধীরে তার হাত ধরে বিছানার কাছে নিয়ে গেল।
“আজ শুধু আমরা। অন্য কোনো চিন্তা নয়, কনা। এই রাতটা আমি শুধু তোমার করে রাখতে চাই।”
কনা ধীরে ধীরে রাতের চোখে তাকালো।
রাতের হাতের স্পর্শে কনার হৃদয় ধুকপুক করছে। ধীরে ধীরে রাত মোমের আলোয় আলতো করে কনার কপালে চুমু খেলো। তারপর কনার হাত ধরে বলল—
” এই রাতটা হোক আমাদের নতুন জীবনের শুরু।”
রাত জানালার পর্দা টেনে দিলো। চারপাশে শুধু মোমের আলো আর সাদা গোলাপের মিষ্টি সুবাস। রাতটা যেন এক চিরস্মরণীয় অধ্যায় হয়ে রইল তাদের জীবনের।
আষাঢ় হলের সামনে বসে আছে। রাত এখন এগারো টা বাজে। সন্ধ্যাকে ফোন করে বলেছে তার স্পেশাল প্লাউ নিয়ে নিচে আসতে। সে খাবে। সন্ধ্যা প্রথমে বিশ্বাস করে নি যে আষাঢ় সত্যি এসেছে। পরে জানালা দিয়ে দেখতেই দেখলো আষাঢ় এসেছে। সন্ধ্যা তড়িঘড়ি করে পোলাও টিফিন বাটিতে করে নিয়ে বের হতে চাইলে দারোয়ান আঁটকে দেয়। এতো রাতে কেনো বাহিরে যাবে সেটা জানতে চাইলে সন্ধ্যা জানায় তার হাসবেন্ড এসেছে। দারোয়ান আষাঢ় কে গেস্ট রুমে এসে বসতে বললো। আষাঢ় বাধ্য ছেলের মতো বসলো। সন্ধ্যা রেগে বলল-
-” কি সমস্যা ভাই আপনার? এতো রাতে কেনো এসেছেন এখানে?
-“ আমার সমস্যা আপাতত একটাই।
-“ কি?
-“ জামাই কে ভাই ডাকছো কেনো? আমি তোমার ভাই লাগি?
-“ কথার কথা বলে ফেলছি।
-“ আচ্ছা এখন খাইয়ে দাও।
-“ হাত দিয়ে খান।
-“ আমি ফ্ল্যাট দেখবো কাল। তুমি হল ছেড়ে ফ্ল্যাটে গিয়ে থাকবে এখন থেকে। যাতে হঠাৎ হঠাৎ আসলে দারোয়ানের এই প্যারা না পোহাতে হয়।
আষাঢ় রাতের সন্ধ্যা পর্ব ৩৩
-“ আপনাকে পিওর বউ পাগল বলবে লোকজন বুঝেছেন?
-“ তো বলুক আমি কি বলতে না করেছি নাকি? বউ পাগল উপাধি শোনার মাঝেও প্রাউড পাওয়ার একটা ব্যপার আছে।
-“ তাড়ছিড়া পাগল আপনি। খেয়ে এখন কি করবেন?
-“ সেদিনের মতো হোটেলে গিয়ে থাকবো। আর সকাল হলেই বউ নিয়ে চলে যাব।
-“ তারপর?
-“ তারপর বউকে জড়িয়ে ধরে একটা ঘুম দিয়ে চলে যাব।