আষাঢ় রাতের সন্ধ্যা পর্ব ৮
Raiha Zubair Ripti
পাঁচ তালা ভবনটি সজ্জিত আছে রঙবেরঙে মরিচ বাতির আলোয়। কি অপরূপ সেই বাতির আলো। বাতি গুলোর দিকে নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে আছে সন্ধ্যা। সেদিনও এমন ভাবেই সাজানো হয়েছিল এই ভবন টি। সবাই আনন্দে মেতে ছিলো। আর সন্ধ্যা গুমরে ম’রছিলো সেদিন। সে থেকে এসব ঘটা করে বিয়েতে তেমন আগ্রহ পায় না সন্ধ্যা। সন্ধ্যার ইচ্ছে সে খুব ছোট পরিসরে বিয়ে করবে। কোনো গানবাজনা, নাচ,হইহট্টগোল কোনো কোলাহল থাকবে না। খুব সাদামাটা ভাবে বিয়ে।
স্টেজ থেকে দূরে একপাশে হলুদ শাড়ি পড়ে দাঁড়িয়ে আছে সন্ধ্যা। আসবে না আসবে না বলেও শরিফার জন্য না এসে পারলোও না। আনিসুজ্জামানের মেয়ে আনিকা বসে আছে স্টেজে । সবাই এক এক করে হলুদ লাগিয়ে দিচ্ছে। শরিফা সন্ধ্যাকে হলুদ লাগানোর জন্য আসতে বললে সন্ধ্যা গিয়ে আনিকা কে হলুদ লাগিয়ে ফের আগের জায়গায় দাঁড়ায়।
রাত থেকে থেকে আড়চোখে দেখছে সন্ধ্যা কে। সন্ধ্যা ফোনে কনার সাথে কথা বলছে। রাত যাবে কি যাবে না সন্ধ্যার কাছে সেটা ভাবতে ভাবতেই দেখলো আষাঢ়, নিখিল,আরাফাত তিনজন এক সাথে আসতেছে। সব ছেলেরাই পাঞ্জাবি পড়েছে শুধু আষাঢ় সাদা শার্ট পড়ে আছে। রাত এগিয়ে গিয়ে বলল-
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-“ ভাই এটা কি পড়ে আসছো?
আষাঢ় নিজের দিকে তাকিয়ে বলল-
-“ কি পড়ে আসছি?
-“ শার্ট কেনো শরীরে? পাঞ্জাবি পড়তে পারতে তো আজকে।
-“ তার দরকার নেই। আসতেই তো চাচ্ছিলাম না। এই আরাফাত টেনে নিয়ে আসলো।
আরাফাত এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল-
-“ হ্যাঁ রাত তোর ভাই তার নিজের গায়ে হলুদেও শার্ট পড়বে আর সেদিনও পাঞ্জাবি পড়ার কথা বললে বলবে তার দরকার নেই।
আষাঢ় বিরক্ত হয়ে বলল-
-“ এখানে আমার গায়ে হলুদের কথা কেনো টানছিস? এসব ঘটা করে বিয়ে করার কোনো মানে হয়?
-“ কেনো রে তুই কি খেজুর ছিটিয়ে বিয়ে করতে চাইছিস?
-“ হ্যাঁ…
-“ সে কি! তুই আমাদের এনজয় করতে দিবি না তর বিয়েতে? এতো কিপ্টে কেনো তুই? টাকা খরচ হবে সেজন্য?
-“ বিয়ে নিয়ে এক এক জনের এক এক রকম পরিকল্পনা থাকে। আমার বিয়েতে কোনো নাচগান কিচ্ছু হবে না। জাস্ট তোদের দাওয়াত দিব এসে খেয়ে যাবি ব্যাস।
-“ যা শালা তোর বিয়েই হবে না আমাদের হক এভাবে মে’রে দিলে।
-“ বদ দোয়া দিও না আমার ভাইয়াকে আরাফাত ভাই।
-“ আহা! দরদ হচ্ছে বুঝি তবে এবার চল গিয়ে বসি।
আষাঢ় ভেতরে আসতেই সর্ব প্রথম চোখ গেলো সন্ধ্যার দিকে। গ্রিন কালারের শাড়ি পড়েছে। মরিচ বাতির আলোয় মুখটা স্পষ্ট হয়ে আছে। আষাঢ় চেয়ারে বসলো। সন্ধ্যা একবার তাকিয়েছিলো আষাঢ়ের দিকে। সাদা শার্টে দেখে বেশ অবাক হলো। লোকটার কি কোনো পাঞ্জাবি নেই নাকি?
ওয়েটা এসে সন্ধ্যা কে জুশ দিলো। সন্ধ্যা জুশ টা খেতে লাগলো।
আষাঢ় পকেট থেকে ফোনটা বের করে সন্ধ্যা কে মেসেজ পাঠালো-
-“ এতো সেজেছো কেনো?
সন্ধ্যা বুঝে গেছে এটা আষাঢ়ের পাঠানো মেসেজ।
-“ কেনো আমার সাজা বারন নাকি?
-“ না..তবে লোকসমাগমে না সাজাই তো ভালো। কখন কে নজর দিয়ে ফেলে বলা তো যায় না।
-“ তাতে কি? আর আমি তেমন আহামরি কেউ না যে নজরে আসবো যে কারো।
-“ তুমি আহামরি নও..বাট… অমূল্য এক রত্ন কারো কাছে।
-“ নাইস জোক্স।
-“ জোক্স বলে উড়িয়ে দিলে মেয়ে। আর হ্যাঁ শুনো…এরপর থেকে সাজবা না।
-“ আপনার কথা মতো নাকি? আর আমি সাজি নি জাস্ট শাড়িটা পড়েছি.. আর হাল্কা লিপস্টিক, কাজল,টিপ দিয়েছি।
-“ খোঁপায় ফুল দাও নি কেনো তাহলে?
সন্ধ্যা খোঁপায় হাত দিলো।
-“ ছিলো না সেজন্য। এখন মেসেজ দিছেন কেনো সেটা বলুন। আর নম্বর কোথায় পাইছেন সেটা তো বললেন না।
-“ সেটা না জানলেও চলবে। এখন রাখছি… এক মিনিট ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে। চলে যাবে না কিন্তু।
আষাঢ় ছাঁদ থেকে নেমে চলে গেলো। সন্ধ্যা আয়ত্তে নিলো না। ছাঁদের রেলিংএ ভর দিয়ে ব্যস্ত নগরী কে দেখতে লাগলো। মিনিট দশ যেতেই আকস্মিক চুলে কিছু লাগিয়ে দেওয়া টের পেতেই খোঁপায় হাত লাগলো৷ বুঝতে পারলো খোঁপায় ফুল আছে। সন্ধ্যা পেছন ফিরলো। আষাঢ় কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল-
-“ হোয়াট ইজ দ্যিস? ফুল কোথা থেকে আনলেন?
আষাঢ়ের স্বাভাবিক জবাব-
-“ দোকান থেকে।
-“ তো আমার খোঁপায় কেনো সেই ফুল? আর আপনার মতলব কি সেটা বলুন।
খোঁপা থেকে ফুল খুলতে খুলতে বললে আষাঢ় থামিয়ে দেয়। বিরক্ত হয়ে বলে-
-“ খুলছো কেনো ফুল টা? থাকুক না.. ফুল ছাড়া খোঁপা টা বড্ড বেমানান লাগছিলো।
সন্ধ্যা আর খুললো না। সেটা দেখে মুচকি হাসলো আষাঢ়৷ সন্ধ্যা পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে বলে গেল-
-“ আপনার মতলবটা খুব বুঝে গেছি ডাক্তার… তবে তেমন কিছুই কিন্তু হবে না। তাই পরে হৃদয় ভাঙলে তার দায়ভার কিন্তু আমার না। বুঝে শুনে পা বাড়ান।
আষাঢ় স্মিত হেঁসে বলল-
-“ সময়ই বলবে সেটা মিস সন্ধ্যা.. হতেও তো পারে সন্ধ্যা নামক রমণীর সব জায়গা জুড়ে আষাঢ় বিচরণ করবে। কি হতে পারে না?
সন্ধ্যা পিছু তাকিয়ে কঠোর গলায় বলল-
-“ না হতে পারে না।
আষাঢ় এবার শব্দ করে হেঁসে ফেলো।সন্ধ্যা হাসির শব্দ শুনে পেছন তাকিয়ে ভ্রুকুটি করে বলল-
-“ হাসছেন কেনো? কোনো হাসির কথা বলেছি আমি?
-“ না তো।
-“ তাহলে হাসছেন কেনো?
-“ তোমাকে বলতে হবে নাকি মেয়ে কেনো হেসেছি আমি?
-“ অবশ্যই।
-“ হু আর ইউ?
-“ আ…মি…..
-“ হু তুমি তারপর।
-„ আপনার মাথা। আপনাকে নাকি সবাই ভয় পায়..রাগী বদমেজাজি জানে। কই আমার তো তেমন টা মনে হয় না।
-“ দুজনেই যদি বদমেজাজি.. গম্ভীর হই তাহলে সব আগাবে কি করে?
-“ কি আগাবে?
-“ সেটা না হয় এখন অপ্রকাশ্যে থাক। সবার কাছে আমি বদমেজাজি গম্ভীর হলেও তোমার কাছে আমি বেহায়া হতেও পারি।
-“ আপনার কথার আগামাথা আমি কিচ্ছু বুঝতেছি না।
-“ তুমি তো অবুঝ নও মেয়ে..বুঝেও না বুঝার ভান করছো।
-“ আমি তো বলছি সেসব সম্ভব না..
-“ কি সম্ভব আর কি অসম্ভব সেটা না হয় আমার উপর ছেড়ে দিন।
-“ আসছি।
সন্ধ্যা চলে যেতে নিলে আষাঢ় পেছন থেকে বলে উঠে-
-“ বাসায় চলে যাচ্ছো নাকি?
-“ হু..
-“ চলো আমিও চলে যাব।
-“ আপনি কেনো যাবেন? আপনার বন্ধুরা এখানে এনজয় করুন।
-“ এসব হইহট্টগোল আমার পছন্দ না। চলুন যাওয়া যাক।
সন্ধ্যার পাশাপাশি হেঁটে সন্ধ্যার সাথে চলে গেলো আষাঢ়। নিখিল পুরোটা সময় সন্ধ্যা আর আষাঢ় কে দেখছিল। তাদের দু’জনের মধ্যে এতক্ষণ ধরে কিসের কথা হতে পারে? সন্ধ্যা চার তলায় আসতেই আষাঢ় নিজেদের ফ্ল্যাটে না গিয়ে তিন তলায় যাওয়ার জন্যে পা বাড়ালে সন্ধ্যা বলে উঠল-
-“ আপনি কোথায় যাচ্ছেন?
-“ কেনো তোমাকে দরজা অব্দি দিয়ে আসতে।
-“ আমি কি বাচ্চা?
-“ না বাচ্চা হতে যাবে কেনো?
-“ তাহলে?
-“ আমার ইচ্ছে।
সন্ধ্যা নিজের মতো হাঁটতে লাগলো। আষাঢ় সন্ধ্যাদের ফ্ল্যাটে এসে দাঁড়ায়। সন্ধ্যা দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতে নিলে আষাঢ় পেছন থেকে বলে উঠে –
-“ এই সন্ধ্যা.
সন্ধ্যা পেছন ফিরে। বিরক্তির ভাব নিয়ে বলে-
-“ আবার কি হলো?
-“ তুমি এমনই থাকবে সারাজীবন কেমন? আমি এই সন্ধ্যা কে বড্ড পছন্দ করি সেই কথায় কথায় কান্না করা সন্ধ্যার থেকে।
-“ মানে?
-“ মানে? নাথিং। ভেতরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। শুভ রাত্রি।
শ্রেয়া আজ আসে নি গায়ে হলুদে। মন মেজাজ সব বাজে হয়ে আছে। হৈ-হুল্লোড় পছন্দ করা মেয়েটাকে চুপিসারে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে দেখে সন্ধ্যা বেশ অবাক হলো। তবে শ্রেয়া কে ইগনোর করে সন্ধ্যা রুমে যেতে নিলে শ্রেয়া পেছন থেকে ডেকে বলে-
-“ সন্ধ্যা দাঁড়া।
সন্ধ্যা দাঁড়িয়ে গেলো। তবে পেছন ফিরলো না।
শ্রেয়া এগিয়ে এসে বলল-
-“ কিছু কথা ছিলো তোর সাথে আমার। প্লিজ মানা করিস না।
-“ মানাটাই করবো। তোমার সাথে ট্রাস্ট মি আমি একটুও কথা বলতে ইন্টারেস্টেড নই। প্লিজ সামনে থেকে সরো।
-“ এমন করে থাকবি কতকাল? কথা কি কোনোদিন আর বলবি না?
-“ ইচ্ছে আমার এটাই বিশ্বাস কর। তোর সাথে কথা বলতে গেলে আমার রুচিতে বাঁধে।
-“ বোন হই আমি তোর সন্ধ্যা।
-“ চার বছর আগেই সেই বোন আমার কাছে মৃ’ত হয়ে গেছে।
-“ সন্ধ্যা!
সন্ধ্যা চলে যেতে নিলে শ্রেয়া পেছন থেকে বলে উঠে –
-“ কখনও যদি শুনিস নিখিল তোর কাছে ফিরতে চাচ্ছে তাহলে কি নিখিল কে সাদরে গ্রহণ করে নিবি?
না চাইতেও সন্ধ্যার মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটলো। পেছন না ফিরেই বলল-
-❝ তারে বলে দিও— আই ডিজার্ভ বেটার দ্যান হিম❞ সে এখন আমার নোখের ও যোগ্য নয়। যদি এমন দিন আসে তবে জেনে রেখো তার দিকে সন্ধ্যা ভুলেও ফিরে তাকাবে না। সে তোমাকেই ডিজার্ভ করে। কথায় আছে রতনে চিনে রতন।
সন্ধ্যা চলে গেলো। শ্রেয়া তাকিয়ে থেকে নিজের রুমে চলে আসলো।
নিখিল পকেট থেকে ফোন বের করে আষাঢ় কে ফোন করলো। আষাঢ় বেলকনিতে বসে ছিলো। নিখিলের ফোনটা রিসিভ করে কানে নিতেই নিখিল বলে উঠল-
-“ কি রে তুই কোথায়?
-“ নিজের রুমে।
-“ রুমে কেনো?
-“ কোথায় থাকবো তাহলে?
-“ ছাঁদে আসবি না?
-“ না..
-“ কেনো?
-“ আই নিড অ্যা স্লিপ..ডোন্ট ডিস্টার্ব মি।
আষাঢ় ফোন কেটে দিলো। নিখিল কিয়ৎ ক্ষন ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকে ফোন টা পকেটে ভরলো। আরাফাত পাশ থেকে বলে উঠল-
-“ কি বললো?
-“ আসবে না।
-“ চিনিসই তো আষাঢ় কে। কি মনে করে আসলো। না থেকেই চলে গেলো।
-“ ওর মধ্যে যে বেশ বদল এসেছে দেখেছিস?
-“ তোর ও নজরে এসেছে সেটা?
-“ হু। শা’লা কারো প্রেমে পড়েছে নিশ্চিত।
-“ কার?
-“ সেটাই তো বুঝতেছি না। মেয়েটা কে হতে পারে বল তো? শুনেছি আমাদের পরিচিত কেউ।
-“ সন্ধ্যা?
হুট করে বলে বসলো নিখিল। আরাফাত চমকে বলল-
-“ সন্ধ্যা সেই মেয়ে?
-“ আমিই তো জিজ্ঞেস করলাম তোকে। মেয়েটা সন্ধ্যা নাকি?
-“ আরেহ্ সন্ধ্যা হবে কেনো?
-“ মনে হলো তাই আর কি বললাম।
রাত সেই কখন থেকে সন্ধ্যাকে খুঁজে চলছে ছাঁদে। অথচ মেয়েটার দেখা নেই। আশ্চর্য মেয়েটা গেলো কোথায়? চলে গেছে নাকি? রাত শরিফা কে ডেকে বলল-
-“ এই সরিষার তেল সন্ধ্যা কোথায়?
শরিফা নাচ দেখছিলো। রাতের কথা শুনে ঘাড় বেঁকিয়ে বলল-
-“ জানি না তো।
রাত ধমক দিয়ে বলল-
আষাঢ় রাতের সন্ধ্যা পর্ব ৭
-“ জানিস না কেনো?
-“ আশ্চর্য আমার ঠেকা নাকি জানার? আপনি খুঁজে নেন আপনার এতো দরকার যখন।
দূর থেকে শরিফা আর রাত কে দেখে চলছে আরাফাত। এই রাত কেনো বার বার শুধু শরিফার সাথে এভাবে কথা বলে? কেমন একটা লাগে আরাফাতের রাত কে শরিফার সাথে কথা বলতে দেখলে। কি আশ্চর্য এক রাত কে নিয়ে দুই পুরুষ জেলাস ফিল করছে অথচ রাত জানেও না সেটা।