ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ১৯

ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ১৯
Arishan Nur

রাত আটটার দিকে আয়নার ফোন বেজে উঠে। সে অতি দুঃখে পাথর হওয়ার মতো ভারাক্রান্ত হৃদয়ে যন্ত্রণা বিছিয়ে নিজের বেডে শু’য়ে ছিলো। সারাদিন মাথাব্যথার অযুহাতে রুম ছেড়ে বের হয়নি। বিকেলের দিকে বলেছে নাকে ব্যথা হচ্ছে। সহ্য করতে কষ্ট হচ্ছে জন্য শু’য়ে আছে। যদিও শারিরীক ব্যথার চেয়ে মনের ব্যথা গুলো বেশি পীড়াদায়ক তার জন্য আজ। বাবা নিজে ফিরে এসেছে দুপুরের পর। বাসার পরিবেশ একদম থমথমে। নিস্তব্ধ। যেন কোনো নীরবপুড়ি। কিন্তু সাধারণত তারা সবাই বাসায় থাকলে অনেক হাসি-মজা, গল্প করে। আজ সবকিছুই ভিন্ন রকম৷ বাবা ইতিমধ্যে দু’বার রুমে এসেছে। কিন্তু একবার আয়না ঘুমের ভান ধরেছিলো। দ্বিতীয়বার দেখেও একদম চুপচাপ শু’য়ে ছিল। বাবা বারকয়েক ডেকেছে তাকে কিন্তু সাড়া দেয়নি। ফোন আবার বেজে উঠতেই সে বিরক্ত হলো। স্ক্রিনে সমুদ্র নাম দেখতে-ই আরো রাগ লাগে। এতোবার কল দেওয়ার কি আছে ওনার? সবটা ঢং! যখন ইচ্ছা যা মর্জি তাই করবে!
সে ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বললো, ” একটু বারান্দায় আসো তো।”

–” কেন?”
–” এতো প্রশ্ন করো কেন? আসো। গেলেই দেখতে পাবে।”
–” না। পারবো না যেতে৷”
–” আ… হ্যালো তোমার রুমের বারান্দায় যেতে বলেছি। রকেটে করে নেপচুন গ্রহে যেতে বলা হয়নি।”
–” ইচ্ছে নেই।”
–” এতো অলস কেন তুমি! আমি বসুন্ধরা থেকে মিরপুর আসলাম আর তুমি রুম ছেড়ে বারান্দায় আসতে পারবে না?”
আয়না এতোক্ষণ খুব বিরক্তি নিয়ে কথা বলছিল। যখনই কানে ভাসে উনি এসেছেন ও অবাকের শেষ পর্যায়ে চলে যায়। প্রশ্ন করে,” আপনি এসেছেন?”
–” কি মনে হয়? ”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আয়না কথা বাড়াল না। সঙ্গে সঙ্গে বারান্দায় গিয়ে উপস্থিত হলো। বারান্দার গ্রিলের ফাঁ ক দিয়ে দেখা যাচ্ছে, রাস্তার ঐ’পাশে সমুদ্র ফোন কানে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ব্যস্ত রাস্তা, কোলাহল পূর্ণ। সেকেন্ডে তিনটে রিকশা পাড় হচ্ছে। তবুও আয়নার একটু হলেও ভালো লাগলো।
সে তবুও কঠোর গলায় বলে, ” কেন এসেছেন?”
–” অফিস থেকে ফেরার পথে তোমার বাসার সামনে গাড়ি আটকা গেল। আর ইঞ্জিন চালু হচ্ছে না।”
–” তাই নাকি? আমার বাসার সামনেই ইঞ্জিন নষ্ট হলো?”
–” হুম।”

আয়নার তখন এতো মেজাজ খারাপ হলো সেইসাথে তিরতির করে একটা ভালো লাগার আবেশ ছু’য়ে যায়। এট লিস্ট ভুজুংভাজুং বলে হলে এসেছে তো! আয়নার একবার মনে হয়েছিলো ওনার আসলেই এই সম্পর্কটা নিয়ে কিছু যায়-আসে না। নাহলে গতরাতে এতো সহজেই কেন বললো সবকিছু শেষ করতে চায় কীনা।
সমুদ্র ও’পাশ থেকে বলে, “হ্যালো!”
তখন ও রাস্তা থেকে উপরের দিকে হাত নাড়ছিলো হ্যালো বলার ভঙ্গিমায়৷ অক্টোবরে মাঝামাঝি কিন্তু খুব একটা গরমভাব নেই। একটা শান্ত ভ্যাপসাহীন আরামদায়ক বাতাস বইছে।
–” তোমার দারোয়ানকে নিয়ে একটা পার্সেল পাঠিয়েছি। নিয়ে নাও।”
–” পার্সেল কীজন্য? কিসের পার্সেল?”

আয়নার প্রশ্নে বেশ বিপাকে পড়ে সে। মেয়েটা একদম ছোট বালিকার মতো সবকিছুতেই কেন কেন করে মাথা খায়৷
সে সহজভাবে না বলে প্যাচিয়ে উত্তর দিলো, ” ডেলিভারি ম্যানের জব নিবো পার্টটাইম তাই একটু এক্সপেরিমেন্ট করলাম৷ কেমন হলো?”
আয়না ঠা-স করে ফোনের লাইন কেটে দেয়৷ এধরণের ফাজলামো ভালো লাগে না একদম।
সমুদ্র রাস্তা থেকে ইশারা করে বুঝায় কী হলো কেন ফোন কাটলে? আয়না উত্তর না দিয়ে বারান্দা থেকে ফিরে এসে দরজা লাগিয়ে দেয়।
আয়না রুমে আসতেই আলিয়া একপ্রকার হুড়োহুড়ি করে একটা বক্স হাতে রুমে ঢুকে।
এরপর বলে, ” আপা তোমার জন্য গিফট এসেছে। দেখো।”

আয়না বক্স খুলতেই অবাক। অনেকগুলো কিটক্যাট। ছোট-বড় সব সাইজের চকলেটের প্যাকেট। আর ভেতরে একটা হুয়াইট লিলির ব্যু’কে। অবশ্য নোট দেওয়া নেই কোনো। তবে আয়নার ধারণা ডাক্তার সাহেব কোনো কারণে অনুতপ্ত বা সর‍্যিবোধ করলে ফুল উপহার দেয়।
তখনই বেল বেজে উঠে। গেইট মনে হয় ফাহাদ সাহেব খুললেন। বাইরে থেকে পুরুষালি আওয়াজ ভেসে আসে। নিশ্চয়ই সমুদ্র এসেছে। আলিয়া বেরিয়ে যায় দেখার জন্য। আয়না চুপচাপ রুমেই বসে। কিন্তু ওর নিজের স্বভাবেও চঞ্চলতা আছে। সে বসে থাকতে পারলো না। বের হয়ে আসে রুম থেকে।
সমুদ্র তখন ফাহাদ সাহেবের সঙ্গে বেশ সিরিয়াস ভঙ্গিতে কথা বলছিলো। আয়নাকে আসতে দেখে দু’জনের দৃষ্টিই ওর দিকে গেলো। ফাহাদ সাহেব সামান্য হাসলেন মেয়েকে দেখে। সারাদিনে কেবল রুম থেকে বের হলো। নিশ্চয়ই সমুদ্র এসেছে খবর পেয়েই বের হলো৷

আয়নার মনে হচ্ছে তার বের হওয়াই ঠিক হয়নি। সমুদ্র কে দেখার তো কিছু নাই! ওই ফালতু থার্ড ক্লাস ছেলেটাকে একঝলক দেখতে আসার দরকার ছিলো না। বাসার সবাই তাকে এলিয়েনের মতো ট্রিট করছে। এতো অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে কেন আছে সবাই? ওর কেমন আনইজি লাগলো।
সমুদ্র-ই কথা বলে উঠে, ” শুনলাম তোমার নাকি মাথাব্যথা ভীষণ। ঔষধ খাবে এখন?”
আয়নার এহেন প্রশ্নে মেজাজ আরোও বিগড়ে গেলো। আরে বাবা কোন ডাক্তার কী কোনোদিন রোগীকে জিজ্ঞেস করে যে মিস রোগী আপনি কী এখন মেডিসিন নিবেন? আজব তো!

আয়না ওর দিকে তাকাতেই দেখে সমুদ্র আগে থেকেই ওর পানে চেয়ে আছে। আয়না দ্রুত রুমে ফিরে আসে কিছু না বলেই। সমুদ্র একটু পর আয়নার রুমে ঢুকে। হাতে একটা কালো ব্যাগ৷ এখানে ওর কিছু প্রয়োজনীয় হেলথ্ ইকুপমেন্ট থাকে। এই ব্যাগটা ওর খুব প্রিয় একটা ব্যাগ৷ ইন্টার্ণ করার টাইমে ওর প্রিয় প্রোফেসার উপহার দিয়েছিলো এটা।

আয়না তখন রুমে বসে কেবল একটা কিটক্যাট মুখে দিয়েছে। ওমন সময় সমুদ্রের সাথে দ্বিতীয়দফায় সাক্ষাৎ ঘটে। সে দ্রুত নড়েচড়ে বসে টেবিল থেকে ওড়না নিতে ধরবে ওমন সময় সমুদ্র সুধালো, ” থাক, ওড়না না নিলেও হবে৷ আমিই তো এসেছি। আমার সামনে ওড়না নেওয়া লাগবে না।”
কথাগুলো বেশ স্পষ্ট আর কেমন অধিকারবোধ স্বরুপ বলা। বলার ধাঁচেই যা প্রকাশ পাচ্ছে। কিন্তু আয়নাও কম যায় না। সে সঙ্গে সঙ্গে টেবিল টান মেরে একটু ছামটা মেরে ওড়না গায়ে জড়ায়৷ টেবিল থেকে একঝটকায় নেওয়ার ফলে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সমুদ্রের হাতে লাগে। আয়না দেখেও যেন দেখে না। ইগনোর করে করে সমুদ্রের অন্তরের জ্বালাপোড়া আরোও বাড়াচ্ছে ও। সমুদ্র এতোদিন পড়ে এসেছে গ্যাস্ট্রিকের জন্য পেটে, বুকে জ্বালা হয়। আজ এক অভিনব গ্যাস্ট্রিক আবিষ্কার করে সে। এইটা মনো-গ্যাস্ট্রিক। মনের মধ্যে জ্বালাপোড়া শুরু করে।

তার ধ্যান ভাঙ্গে। সমুদ্রের কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে৷ এমন অনুভূতি খুব, খুব তাড়া করে। চোখ গেলো আয়নার হাতের দিকে। ওইতো এখনো তার নামের অক্ষরগুলো জ্বলজ্বল করছে আয়নার হাতের তালু। মুহুর্তের মধ্যে কেমন অজানা জেদ চাপে। খুব সেপারেশন চাই তোমার? চাইলে বুঝি খুব দিবো! আমাকে তো বলার সাহস পাচ্ছো না। সমুদ্রের কেমন আয়নার উপর বড্ড জোর খাটাতে মন চাচ্ছে। এমন উদ্ভব সব অনুভূতিকে দমিয়ে নিয়ে বলে, ” হলুদ খামটা দেখেছো?”
আয়না ভ্রু কুচকে বলে, ” কোন হলুদ খাম?”

সমুদ্র তার দেওয়া বক্স থেকে কিটক্যাট সরিয়ে একদম শেষ প্রান্ত থেকে একটা খাম বের করে দেয়। এরপর বলে, ” তোমার দেনমোহর। সেদিন দেওয়া হয়নি তো। তুমিও চাও নি।”
আয়নার হাতে ধরিয়ে দিলো। আয়না একবার ওর দিকে তাকালো। সমুদ্র আচমকা ওর নাকফুলের জায়গায় হাত রাখলো। আয়না কেঁপে উঠে কিঞ্চিৎ।
ও সুধালো, ” সয়েলিং তো হয়নি। তাহলে নাকফুল খুলে ফেলেছো কেন?”
–” এমনি।”
–” নাক ফোঁড়ানোর জায়গা বন্ধ হয়ে যাবে কিন্তু রক্তজমাট বেঁধে। তখন আর নাকফুল ঢুকবে না।”
–” না ঢুকলে নাই।”

বেশ ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে উঠে ও। সমুদ্র বুঝে কালকের রাগ সবটা ওই নাকফুলের উপর দিয়ে যাচ্ছে। ওটা সমুদ্রের দেওয়া উপহার দেওয়া ছিলো বটে। আর মেয়ে যে পরিমাণ রেগে বোম হয়ে আছে, নাকফুল পড়তে বললে বারান্দা দিয়ে রাস্তায় ফেলে দিলেও দিতে পারে!
সমুদ্র ইচ্ছে করে ওকে চেতানোর জন্য বলে, ” অবশ্য নাকফুলে তোমাকে মানায়ও না তেমন। অযথাই করেছিলে। বোঝা উচিত ছিলো। বুদ্ধিমতী হলে বুঝতে।”

আয়নার এতো রাগ উঠলো। আয়না কি পড়বে, না পড়বে, কাকে কোন নামে ডাকবে এসব ওর একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। ওনার কিছু বলাই তো বেমানান সেখানে ব্যাটা উল্টাপাল্টা মতামত দেয়। আয়না ধাপ করে উঠে দাঁড়িয়ে খ্যাপাটে বাঘিনীর ন্যায় ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। একপ্রকার রাগ নিয়েই নাকফুলটা নাকে বসাতে গিয়ে বেকায়দায় ব্যথা পায় আর মুখ ফুটে অস্ফুটে আউ বলে উঠে। সমুদ্র হন্তদন্ত পায়ে এগিয়ে এসে ওর কাঁধ ধরে নিজের দিকে টেনে এনে বললো, ” আমাকে বললেই তো ঠিকঠাক মতো পড়িয়ে দিতাম৷”
আয়নার কাছে ওনার সবকিছুই, এইযে অতিরিক্ত কনসার্ন সবকিছুই যেন আলগা ঢং, লোক দেখানো পিড়িতি মনে হচ্ছে। সে মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকালে, ক্ষণেই সে ওর থুতনিতে হাত রেখে এদিকে ঘুরিয়ে খুব সাবধানে নাকফুল পড়িয়ে দিয়ে সেখানটায় হাত বুলায়। এরপর বলে, ” যার উপর আগ্নেয়গিরির মতো রেগে ফুঁসছো, সে জলজ্যান্ত সামনেই আছে। পারলে তার উপর রাগ দেখাও। অন্যকিছুর উপর রাগ দেখাতে হবে না।”

এরপর টুক করে ওই জ্বলতে থাকা নাকফুলের উপর একটা আলতো করে চুমু খেলো।
এরপর বলে, ” উম, নাক বোঁচা এজন্য ঠিকঠাক আরাম করে ভারী কি–স ও দিতে পারলাম না।”
আয়নার এতো মেজাজ খারাপ হয়। সে সঙ্গে সঙ্গে বাজখাঁই গলায় বলে, ” বোঁচা নাক নিয়ে এতো সমস্যা থাকলে, বিয়ে করলেন কেন? খাড়া নাকওয়ালা মেয়ের কাছে যান। এক্ষুনি বের হন আমার রুম থেকে।”
সমুদ্র হাসি আটকাতে পারেনা। কালকে থেকে পরিস্থিতি এতো বাজে যাচ্ছিলো যে হাসার মতো পরিবেশ ছিলো না। কিন্তু এই মুহূর্তে দম ফাটানো হাসি পাচ্ছে। মানুষ নিজের বোঁচা নাক নিয়েও এতো অবসেসড হয়!
আয়নাকে আর রাগানো ঠিক হবে না ভেবে সে রুম ছেড়ে বের হলো। কিন্তু একেবারে চলে যায় না। ফাহাদ সাহেবের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলে জানলো আয়না ওর বাবার উপর ও রেগে আছে৷ সমুদ্রের মনে হচ্ছে আজ বুঝি রাগ দিবস। দেখি সুযোগ পেলে ওকে ‘ হ্যাপি এংরি ডে’ উইশ করে আরোও খ্যাপাতে হবে৷

সমুদ্র মনের ভুলেও শ্বশুড়কে সেপারেশন নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করেনি। নতুন জামাই সে। এসব জিজ্ঞেস করা মানে হলো কিছুটা এমন– নিজ থেকে কুমিরের জন্য খাল কেটে সেই খালে সোফা আর এসির ব্যবস্থা করা। আগ বাড়ায় বিপদ ডাকার মতো নির্বোধ হওয়া যাবে না। এজন্য কৌশলে সেপারেশনের এন্টি দেনমোহর বুঝিয়ে দিয়ে তাদের বিয়েটার ভিত্তি আরোও মজবুত করতে উঠেপড়ে লেগেছে। নিজের কামাই করা টাকা দিয়েছে দেনমোহরে। অধিকার তো আছেই, আজ থেকে আরোও একধাপ বেশি এগিয়ে গিয়ে , আরোও বেশি অধিকারের ভাগীদার হলো।
ফাহাদ সাহেবের সঙ্গে বসে টিভি দেখতে বসে সে। একটু পর ফাহাদ সাহেব উঠে পড়লেন। মনটা বড় উসখুস করছে সমুদ্রের । আয়নাকে দেখলে এক কাপ চা বানাতে বলবে। রুমে যেতেও খানিক লজ্জা লাগছে। কিছুক্ষণ পর আয়না বের হয়৷ ওকে দেখে বোঝার উপায় নেই ওর মনে কী ঝড়টাই না গেছে। বেরিয়ে এসে দেখলো সমুদ্র টিভিতে খেলা দেখছে৷ মুখের এক্সপ্রেশন দেখেই বোঝা যাচ্ছে নিশ্চয়ই বাংলাদেশ আজ খুব বাজে খেলছে।

সমুদ্র আয়নাকে দেখামাত্র টিভি অফ করে দেয়। আয়না প্রশ্ন করে, ” অফ কেন করলেন?”
–” বউ সামনে থাকলে টিভি দেখা ঠিক হবে না।”
আয়না বিরক্ত হয়ে চলে যায়। ফাহাদ সাহেব সবকিছুতেই মাত্রাতিরিক্তভাবে বাড়াবাড়ি করেন। আজ নিজের বাসা জ্বলছে। নিজের মেয়ে রেগে আছে। তবুও মেয়ে জামাই আপ্যায়নে কমতি রাখেন না। সমুদ্রকে কল করেছিলেন তিনি। এমনি কথাবার্তার জন্য। কথার ফাকে বললেন আয়না সারাদিন মাথাব্যথার জন্য শু’য়ে আছে। এটা শুনেই সমুদ্র আসবে বলে জানায়। এরপর তিনি হামিলা বুয়াকে দিয়ে খাসির মাংস, মুরগির মাংস আর রুপচাঁদা মাছ রান্না করতে বলেন। সমুদ্রকে ডিনার করতে দিলেন৷ কিন্তু নিজে না খেয়ে রুমে ঢুকে পড়ে। সমুদ্র অল্প খেয়ে আয়নার রুমে যায়৷ আয়না তখন বেডের উপর অযথাই গোছানো কাপড় গুলোর ভাঁজ খুলো ফের গুছাচ্ছে। এসব ইচ্ছে করেই করছে যেন ব্যস্ত থাকা যায়। সমুদ্র গিয়ে একটা গুছিয়ে রাখা ওড়না হাতে নেয়। এরপর বলে, ” গুছানো জিনিস এলোমেলো করছো কেন?”

আয়না রাগান্বিত গলায় বলে, ” আমার কাপড় আমি যা ইচ্ছা করব। আপনার এতো কী?”
–” আমার বউয়ের কাপড় তাই এতোকিছু! তোমার একটা ওড়না নিয়ে যাই?”
–” ওড়না দিয়ে আপনি কী করবেন?”
–” কিছু করবো না। জাস্ট আমার আলমারিতে রেখে দিবো। আমার মতো আমার আলমারিও বিবাহিত ব্যাচেলর। মেয়ে কাপডের ছো’য়া চাই ওর। কি কান্নাকাটি করে প্রতি রাতে! জানো নাতো। সেদিন বলছিল, আমার কাঠের তাকে আর জেন্টস প্যান্ট চাই না। মেয়দের কাপড় সাজিয়ে রেখে আমাকে ক্ষ্যামা দাও। এজন্য নিয়ে যাচ্ছি তোমার ওড়না। আলমারির দুঃখে আমিও দুঃখিত। ”

আয়নার এতো পরিমাণ –হাসি আর মেজাজ গরম দুটো একসঙ্গে হলো। আচমকা সমুদ্র তার হাত টেনে ধরে নিজের সামনে দাঁড় করায়। এরপর বলে, ” আর কতো রাগ করে থাকবে?”
আয়নার সত্য বলতে সমুদ্রের উপর রাগ অনেকখানি কমে এসেছে। ওর এক্সপেক্টেশন এতো ডাউন ছিলো। ভেবেছিল সমুদ্র আর কোনোদিন আসবেই না। ফোনও দিবে না। কিন্তু ও এসেছে। এতেই খুশি আয়না। ওর লাইফে প্রথম পুরুষ হলো সমুদ্র। ওর উপর অটোমেটিক রাগ কমে আসে। কিন্তু অভিব্যক্তিতে প্রকাশ পায় না।
সমুদ্র ওড়না টান মেরে পকেটে ঢুকালো। আয়না অসন্তোষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ” আমার ওড়না ফেরত দেন!”

–” লাগবে আমার।”
আয়না মনে মনে ভাবে, এই লোকটা এতো পিকিউলিয়ার কেন? ওড়না দিয়ে তার কাজটা কী? মন চাচ্ছে এক্ষুনি চারটে ওড়না ওনার গলায় ঝুলিয়ে দিতে। যত্তসব!
কিয়ৎক্ষণ পরে সে আয়নার দিকে ঝুকে এসে ওর কোমড় আলতো করে ধরে। মুখে-চোখে ঠোঁট গোল করে ফুঁ দেয়। নিজের মুখটা একটু সামনে আগাতেই সিগারেটের বাজে গন্ধ ভেসে আসে। বিরক্ত হয় আয়না। ডাক্তার হয়েও সিগারেট খায়। তারউপর ওর একদম সিগারেটের স্মেল পছন্দ না।
–” সিগারেটের গন্ধে তো আপনার পাশে থাকা যাচ্ছে না। প্লিজ দূরে সরেন৷”
সমুদ্র বলে, ” ঘরে বউ আসলে সিগারেটের প্যাকেট ভুলেও খুলে দেখবো না। তখন তো অন্য প্যাকেট খুলতে ই টাকা যাবে। ”

–” অন্য প্যাকেট বলতে কি মিন করছেন?”
–” কাপড় আর থালাবাসন মাজার সাবানের প্যাকেট। ডাবল মিনিং নিচ্ছো কেন?”
আয়না পাগলের কথায় সাড়া দেওয়ার প্রয়োজন মনে করে না৷
–” তোমার বাবা ডিনার করালো কিন্তু ডেজার্ট তো দিলো না।”
আয়না ভ্রু কুচকে তাকাতেই ওকে মুহূর্তের মধ্যে সমুদ্র নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে নেয়। আয়না পিলে চমকে উঠে দূরে সরে আসতে চায়। সমুদ্র বাঁধা মানে না।

–” দরজা খোলা। আচ্ছা আপনার কী কাণ্ড-জ্ঞান নেই? কমনসেন্সের অভাব?”
সমুদ্র চোখ বুলিয়ে দেখে আসলেই দরজা অল্প একটু ফাঁকা হয়ে খোলা আছে। আফসোস হলো তার কেন লক করে আসলো না ভেতরে । ম্যাডামের রাগ অনেকটাই কমে গেছে। ভালো সুযোগ ছিলো। এটাও হাতছাড়া হলো। ধ্যাত! দরজাটার উপর এতো রাগ উঠলো। পারলে দরজা ভে_ঙে গুড়িয়ে দিতো!
সে নিজের পক্ষে সাফাই গেয়ে বলে, ” ঘরে জামাই থাকলে তোমার ফ্যামিলির কেউই আসবে না। ট্রাস্ট মি।”
–” সরেন তো।”

তারপর সে বলে, ” অন এ সিরিয়াস নোট, তুমি দুপুরে খাও নি এজন্য তোমার বাবাসহ পুরা পরিবার না খাওয়া। সবাই তোমার জন্য না খেয়ে আছে। তোমার দাদাভাইয়ের গায়ে জ্বর। কাশছে অনেক। তিনিও খান নি৷ এভাবে বেঁকে বসে থেকে ওদের কষ্ট দিও না। একসাথে সবাইকে নিয়ে ডিনার করো।”
সমুদ্র আরো টালবাহানা করতো আজ থেকে যাওয়ার জন্য। কিন্তু হঠাৎ কোথা থেকে মিলি ছাড়া পেয়েছে৷ ও
ফাকা অংশ দিয়ে আয়মার রুমে ঢুকে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্র বিড়াল দেখামাত্র চিল্লা-পাল্লা শুরু করে৷ ওকে দেখে মনে হচ্ছে কেউ সমুদ্রের লেজে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। মিলিও কেন যেন বেশ মজা পায়। সে সমুদ্রের দিকেই ছু’টে যায়। সমুদ্র দ্রুত বিছানায় উঠে পড়ে এরপর ভয়ার্ত সুরে বলে, ” বিড়ালকে বের করে দেও না প্লিজ। ওকে সরাও।”
আয়না এতোক্ষণে সমুদ্রকে শায়েস্তা করার কোনো পন্থা পায়। নাহলে এই লেজকাটা শেয়ালটাকে কোনোভাবেই যুক্তি দিয়ে হারানো যায় না।

সে মিলিকে কোলে তুলে নিয়ে বললো, ” মিলি কেন যাবে? এটা মিলির বাসা। যারা বিড়াল ভয় পায় তারা যাক।”
সমুদ্র বেড থেকে নামতে চাইলে ফের ও মিলিকে ছেড়ে দিলো। মিলির কাছে সমুদ্র কিছুটা জোকারের মতো বোধহয়। মিলি লেজ নাড়িয়ে হাঁটা দিলে ও লাফালাফি করে। খুব মজার ঘটনা। মিলি লেজ নাড়িয়ে সমুদ্রের দিকে ছু’টে। সমুদ্র দ্রুত বেডে উঠে পড়ে৷
আয়নাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ” এই প্লিজ ওকে সরাও।”
–” না।মিলি এখন খেলবে৷ আপনার সমস্যা কেন এতো?”
সমুদ্র বলে, ” তুমি বিড়ালটাকে কোলে নেও। আমি যাচ্ছি। বাট ওয়ান কন্ডিশন ভুলেও ওকে ছেড়ে দিবে না।”
–” আচ্ছা৷”

ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ১৮

সমুদ্র বেড থেকে নেমেছিলো কিন্তু আয়না মিলিকে ছেড়ে দেয়, কন্ডিশন মানে না কোনো। বেচারা সমুদ্র পায়তারা করছিল আজ বউয়ের বাড়ি রাতে থেকে যাবে, কিন্তু ভাগ্য অসহায় হলে যা হয় আরকি। এই বয়সে এসেও বিড়ালের ভয়ে আয়নার বাসা থেকে একপ্রকার ছু’টে বেরিয়ে আসে সে। বিড়ালটাও খুব পাজি। তাকে দেখেই তার পিছু ছুটে’। কেন রে ভাই? কি দোষ তার?

ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ২০