ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ২৩

ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ২৩
Arishan Nur

রহমান এন্ড সনস্ ম্যানসনের তিনতলার বারান্দায় ইশরাক রহমান বসে আছেন। যদিও বাসার নাম রহমান এন্ড সনস্ কিন্তু তার পিতা ইমতিয়াজ রহমানের একটাই ছেলে। এমনকি ইশরাক রহমানের ও একটাই ছেলে। তবুও বাড়ির নাম রহমান এন্ড সনস্ কেন রাখা হয়েছে এ এক আজব কারবার। এমনকি তাদের বিজনেজ গ্রুপের নামও এটাই। তার বাবার রেখে যাওয়া নাম অনুসরণ করেই বছর পর বছর চলছে। নাম পরিবর্তন হয়নি। আজকের রাতটা খুব সুন্দর। পূর্নিমা আজ। আকাশে একফালি চাঁদের দেখা মিলছে। বারান্দায় হুহু করে বাতাস বইছে। দূর থেকে হাসনাহেনা গাছের ফুলগুলোর সুবাস নাকে আসছে। রোদেলার ছাদে ঝুলিয়ে রাখা উইন্ডচার্মের বাতাসে সুর তুলে টুংটাং আওয়াজও ভেসে আসছে৷ বসুন্ধরায় রাত হলে মনে হয় নির্জন কোনো গ্রাম। কেবল প্রাইভেট কার চলে। দূর-দূরান্ত কোনো দোকান-পাট নেই। তবে মশার উপদ্রব খুব। এজন্য রোদেলা গ্রিল আর বারান্দায় নেটের জাল দিয়েছে যেন মশা না ঢোকে।

এমন সময় পেছনে থেকে মিসেস রোদেলা এসে ডাক দিলো, ” আবেগ, চা দিবো?”
ইশরাক রহমান হাল্কা হেসে বলে, ” না, না। সমুদ্রের আম্মু, তুমি এসে বসো। কিছু কথা আছে।”
মিসেস রোদেলা বারান্দায় সাজানো চেয়ার টেনে আবেগের সামনাসামনি বসলেন। বাসার প্রতিটা কোণা খুব যত্ন করে সাজানো। রোদেলা খুব শৌখিন মানুষ। তাদের ড্রয়িং-ডাইনিং, বারান্দা খুব সুন্দর করে সাজানো। কেবল সমুদ্রের রুমটাই এ’বাসার সবচেয়ে অখাদ্য রুম। সবসময়ই অগোছালো রাখবে।
সে বসতেই আবেগ বলে উঠে, ” সমুদ্র ফিরেছে?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

–” হ্যাঁ, একটু আগে এলো। খেয়েই ঘুমাতে গেছে। ওর সাথে কোনো কথা আছে? তাহলে ডাক দিবো?”
–” না। ভাবছি ওদের দুই ভাই-বোনের নামে সব সম্পত্তি বন্টন করে দিবো। সব কিছু উইল করে দিয়ে যাই। বলা যায় না, ভবিষ্যতে কি হবে। সমুদ্রের এখন নিজের সংসার আছে। যেকোনো সময় অন্যকোথাও শিফট হতে চাইতে পারে। আমরা না থাকলে, আদৌ সমুদ্র ওর বোনের অধিকার ঠিকমতো দিবে কিনা, জানি না।”
–” আমার ছেলে এমন না। ও ঠিক ওর বোনের প্রাপ্ত অধিকার বুঝায় দিবে। পারলে নিজের ভাগের গুলোও দিয়ে দিবে। তবে তোমার যেহেতু ইচ্ছা, তুমি উইল করে যাকে যা দিবে লিখে দিয়ে পারো।”
আবেগ কিছুক্ষণ নিরব থেকে বলে উঠে, ” সমুদ্রের কাজে এবারে আমি স্যাটিসফাইড। ওর বিয়ের অনুষ্ঠান ঘটা করে কবে করতে চাচ্ছে?”

–” কিছু বলেনি তো। ওকে আর জোর করবো না। ওরা দু’জন সময় নিক। তারপর যখন চায়, আসবে। বাসার দরজা সবসময়ই বউমার জন্য খোলা। ”
–” আকদের পর ওদের একবারও এ’বাসায় দাওয়াত দিলে না, কেমন শ্বাশুড়ি তুমি? একদম জল্লাদ!”
মিসেস রোদেলা হেসে বলে উঠে, ” আমার মতো ইয়ং এন্ড মডার্ণ শ্বাশুড়িকে তুমি জল্লাদ বলছো? সমুদ্রর সঙ্গে বের হলে, মানুষ বলে আমি ওর বড় বোন।”
আবেগ বলে উঠে, ” শায়লা কি ওই বাসায় উঠেছে?”

–” কি জানি। ওর সাথে যোগাযোগ কম রাখি। আচ্ছা তুমি এতোদিন পর ফাহাদকে কই থেকে খুঁজে বের করলে?”
–” আর বলো না। সবটাই কাকতালীয় ব্যাপার। মেঘ তো আমার জুনিয়র ছিলো। ভার্সিটিতে একই হলে ছিলাম। কিন্তু ভার্সিটির পর যোগাযোগ ছিলো না। শুধু জেনেছিলাম মেঘ বিসিএস ক্যাডার হয়ে সরকারি বড় পোস্টে আছে। বিয়ে করেছে। বাচ্চা আছে। এইটুকুই। এরপর শায়লার মাধ্যমে আবার দেখা হলো। আমার অপারেশনের পর তো অফিস যাওয়া বাদ দিলাম৷ এক ভাই দাওয়াত দিলো। আমাদের সব বিজনেস পার্টনারদের দাওয়াত করলেন উনি। তুমি তো ওই দাওয়াতে যাও নি। কি যেন হলো তোমাদের! সমুদ্র ঝামেলা করছিলো। আমি পিউকে নিয়ে গেলাম।

ওইদিন দাওয়াতের অনুষ্ঠানে শায়লা মেঘের সঙ্গে আসে। ওরা তার ক’টা দিন আগেই কোর্ট ম্যারেজ করেছে। এজন্য দাওয়াতে শায়লা তার হাসবেন্ডকেও এনেছিলো সবার সঙ্গে পরিচয় করানোর জন্য। আমি তো মেঘের ব্যাপারে জানতাম না। শায়লা কোর্ট ম্যারেজ করবে এটা শুনেছিলাম৷ কিন্তু মেঘের সঙ্গে দ্বিতীয় বিয়েতে বসতে চলেছে জানায়নি। মানে শায়লা আসলে জানত না আমি আর মেঘ রুমমেট ছিলাম। ওই অনুষ্ঠানেই জানতে পারলো আমি আর ফাহাদ পূর্বপরিচিত। ফাহাদের ডাকনাম কিন্তু আবার মেঘ। এতোদিন পর পুরাতন মানুষ দেখে খুশিই হলাম৷ কোনোদিন ভাবিও নি আবার মেঘের সঙ্গে দেখা হবে৷ একসঙ্গে অনেক গল্প করলাম। তবে ওর প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর খবর আবার শায়লার সঙ্গে বিবাহ সব শুনে অবাক-ই লাগে।”

মিসেস রোদেলা জানতেন শায়লা তার পুত্রবধূর বাবাকে বিয়ে করেছে। অন্য কোনো শ্বাশুড়ি হলে হয়তো অনেক ঝামেলা করত এই ইস্যু নিয়ে৷ কিন্তু রোদেলা এসব কিছুই করবে না। শায়লাও ওর পরিচিত আর আয়ুর বাবা ও পরিচিত মানুষ। কারো ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে ঘাটাঘাটি, খোটা মারার স্বভাব তার মধ্যে নেই। আয়ু তাকে খুব পছন্দ হয়েছে। মেয়েটাকে বিয়ে করে তার ছেলের মধ্যে কতো পজিটিভ পরিবর্তন আসছে। এখন রাত করে বাড়ি ফেরে না। সময়মতোই আসে বাসায়। বিয়ের মাত্র ক’টা দিন পার হলো, এতেই এতো পরিবর্তন ছেলের মাঝে! তবে, মিসেস রোদেলার কেন যেন শায়লাকে খানিকটা সুবিধাবাদী মহিলা লাগে। মানে খুব একটা পছন্দ করতো না। একটু দূরত্ব রেখে চলাফেরা করত। কিন্তু শায়লা-ই তার বিপদে এসে দাঁড়ালো এজন্য সে কৃতজ্ঞ তার উপর। এখন সমুদ্র শায়লার সঙ্গে এতো বেশি ক্লোজ হয়েছে। তাদের বিজনেজের থার্ড পার্টি শায়লা। শায়লার এনে দেওয়া বিজনেজম্যানদের সঙ্গে ডিল করছে সমুদ্র। প্রোজেক্টের কাজ চলছে। সেদিন ইভানাও বলছিলো শায়লার এতো আনাগোনা কেন? উত্তর দিতে পারেনি কোনো সে।

সে প্রশ্ন করে, ” সমুদ্রের জন্য প্রস্তাব কি তুমি আগে দিয়েছিলে?”
–” ওই অনুষ্ঠানেটাতে আমি এমনি বলছিলাম আমার ছেলের জন্য একটা মেয়ে দেখতে৷ শায়লা টুকটাক ঘটকালি করে তো তাই বলেছিলাম। ওরা ওইসময় কিছু বলেনি। এরপর প্রায় দুই সপ্তাহ পর কি যে হলো, শায়লা কল দিয়ে ওর বাসায় ডাকে৷ আমি অসুস্থ ছিলাম জন্য ওর বাসায় যেতে চাইনি। পরে ও আর মেঘ আমাদের বাসায় এলো। খেয়াল আছে না? ওইদিন তোমার সামনেই তো প্রস্তাব দিলো।”

মিসেস রোদেলা অতীতের দিনগুলো স্মরণ করলো। একদিন হুট করে দুপুরের পর শায়লা আসলো। সঙ্গে ওর হাসবেন্ড। শায়লাকে দ্বিতীয়বার জীবন গুছাতে দেখে রোদেলা খুশিই হয়। যখন দেখলো, শায়লার হাসবেন্ড আবেগের ভার্সিটির জুনিয়র তখন তো আরোও বেশি ঘনিষ্ঠতা বেড়ে গেলো। ওদের এমন না বলে আসায় রোদেলা কীভাবে আপ্যায়ন করবে এটা ভেবেই কূলকিনারা পাচ্ছিলো না। ফাহাদ সাহেব প্রথম এসেছেন বাসায়। ভারী আপ্যায়ন না করলে মন খচখচ করবে। সমুদ্র-পিউ দুইজন ই বাসায় ছিলো না। পাতিলে যখন পোলাও বসায়, তখন আবেগ তাকে এক গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার জন্য ডাকলো। ওইদিন মেয়ের বাবা-ই প্রস্তাব রাখে। আবেগ তো মেয়ের কিছুই আর দেখেনি। ওর ভার্সিটির জুনিয়র, রুমমেটের মেয়ে মানে ওর মেয়ের মতো। ব্যাস আর কিছু দেখবে না।

মিসেস রোদেলা স্বামী যা বলে তাতেই মত দেয়। উনিও আর আপত্তি করেনি। শুধু শায়লা একবার বায়োডাটা জোর পূর্বক দেখালো। মেয়েটা এতো মিষ্টি দেখতে তাও নাকি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে। তারা সঙ্গে সঙ্গে রাজী হয়ে যায়। সমুদ্র রাজী হলেই আগাবে বলে জানায় ফাহাদ সাহেবকে। সেদিন-ই আয়না সিএসইতে পড়ে শুনে আবেগই বলে, ওদের কোম্পানিতে আইটি বেসড একটা ইন্টার্ণশীপের প্রোগ্রাম অরগানাইজড করা হয়েছে। আয়নাও জয়েন করুক। তাহলে সমুদ্রের সঙ্গে অগ্রীম পরিচয় হবে। জানা-শোনা হবে।

দু’জনেরই সুবিধা হবে। ট্রেনিংটা মেয়েটার ক্যারিয়ারের জন্যও ভালো। ফাহাদ রাজী হয়, মেয়েকে হবু শ্বশুড়ের কোম্পানিতে ইণ্টার্ণ করতে দেওয়ার জন্য। তবে ইন্টার্ণ করার আগে কিছু বলেনি আয়নাকে। সম্পূর্ণ বিষয়টিই হাইড রাখা হয়৷ ও শুধু জানত তার আব্বুর পরিচিত সিনিয়রের কোম্পানির আইটি সেক্টরে একটা পার্ট টাইম জব অফার দিয়েছে। ওনার ছেলের সাথে যে এক প্রকার বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়েছে এটা প্রথমে সমুদ্র-আয়না দুইজনের কেউই জানত না। দুই পক্ষই একটা কথা সাফ বলে দিয়েছিল, ছেলে-মেয়ে আপত্তি করলে, তারা জোর করবে না। এমনকি বিয়ের সম্পর্ক না আগালেও তাদের মধ্যকার সম্পর্ক খারাপ করবে না। ওরা যা সিদ্ধান্ত নেবে সেটাই মেনে নেওয়া হবে।

মিসেস রোদেলা বেশ মনোযোগ দিয়ে সবটা শুনেন। এরপর বলে উঠে, ” ফাহাদ ভাই নিজের বিয়ের কয়েকদিন পরেই মেয়ের বিয়ের জন্য এতো অস্থির হলো কেন? এখনকার মেয়েরা গ্রাজুয়েশন শেষ করে বিয়ে করে, বয়স তো খুব পেরিয়ে যাচ্ছিলো না আয়ুর।”
আবেগ থমকালো সামান্য বিষয়টা এভাবে তো একদম ভাবে নি। তবে ফাহাদ বলেছিল ওর দুশ্চিন্তা হচ্ছে। আবেগ বলে, ” বাবার দ্বিতীয় বিয়ে হয়েছে জন্য ওর মেয়ের ভালো প্রস্তাব আসবে কিনা এসব নিয়ে খুব চিন্তায় ছিলো মনে হয়।”
মিসেস তরোদেলা আর কোনো প্রশ্ন করলেন৷ অতীত নিয়ে এতো মাথাব্যথা নেই তার৷ পুত্রবধূকে বেশ পছন্দ হয়েছে তার। শিক্ষিত, স্মার্ট মেয়ে। একদম মনের মতো একটা বউমা পেয়েছে৷

আয়না রুমে বসে আছে। আজকে বাসায় অনেক গেঞ্জাম। আত্মীয়-স্বজন অনেকেই এসেছেন। দাদাভাইকে রিলিজ দেওয়া হয়েছে। সে একদম সুস্থ। তাকে দেখতেই অনেকে আসতে চাচ্ছিলো। এজন্য বাবা সবার জন্য একটা ডেট ফিক্সড করে গেট টুগেদার আয়োজন করেছে। তাদের বাসায় প্রায়শ এমন দাওয়াতের আয়োজন হয়। মেহমান, আত্মীয়রা আসেন। বাবার এক বাবুর্চি-ই ঠিক করা আছে। কল দিয়ে বলে দিলে ডেকচি ভর্তি রান্না করে আনবে। আয়নার শ্বশুড়বাড়ির লোকজন কেও দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। এ’ আটদিনে সমুদ্র একবারও আসেনি তাদের বাসায়। খুব নাকি ব্যস্ততা ওনার। হুহ!

সন্ধ্যা সাতটার দিকে সমুদ্রের বাবা-মা আর বোন আসলো। সঙ্গে ওর ফুপু ইভানা আন্টি। যাকে ও ওর আরেক মা বলে পরিচয় করিয়েছে। ইভানা আন্টির ছেলেও এসেছে৷ কিন্তু যার শ্বশুড়বাড়ি সে-ই এসে পৌঁছে নি। আয়নার এতো রাগ উঠে। সে অনেকদিন পর আজ শাড়ি পরেছে। এতো অশান্তির পরও সমুদ্র আসছে ভেবে হাল্কা সেজেছে। কিন্তু ওনার নাকি ব্যস্ততা। আসতে দেরি হবে আবার নাও আসতে পারে। আয়নার মন চাচ্ছে ওনার অফিসে গিয়ে সব কাগজ-পত্র ছিঁড়ে ফেলতে! কাকে ব্যস্ততা দেখায় উনি? আয়নাকে তাকে গুণাই ধরে না।
মিসেস রোদেলা সবার সঙ্গে আলাপ করে আয়নার রুমে ঢুকে। আয়না তখন ফোনের স্ক্রিনে চোখ রেখেছে। শ্বাশুড়িকে আসতে দেখে সে ফোন রেখে দিয়ে মুচকি হাসি দেয়। একটু নার্ভাস ও লাগে বটে৷
মিসেস রোদেলা বলে উঠে, ” ওয়াও মা। তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে। মাশাল্লাহ।”

–” থ্যাঙ্কিউ আন্টি আই মিন……. ”
আয়নার মুখ দিয়ে মা শব্দটা বের হচ্ছিলো না কেন জানি। এতোদিন ধরে এই ডাকে কাউকে ডাকেনি। হুট করে “মা” শব্দটা মুখে আনতেও কষ্ট হচ্ছিলো৷ রোদেলা আচমকা ওর কপালে একটা চুমু খেল। এরপর সোনার একটা চেইন গলায় পড়িয়ে দেয় এবং বললো, ” তুমি আমাদের বাসায় একবারও গেলে না। শ্বাশুড়িকে পছন্দ হয়নি নাকি?”
–” না,না। ছিঃ এসব কি বলছেন আন্টি আই মিন আম্মু। ”
আম্মু বলার সময় ওর চেহারাটা মলিন দেখায়। রোদেলা তা খেয়াল করে বলে, ” তুমি আমাকে মামণি বলে ডেকো কেমন? ”

আয়নার এই সামান্য বিষয়টা এতো ভালো লাগলো। সে মিসেস রোদেলাকে জড়িয়ে ধরে। ওকে জড়িয়ে ধরে রোদেলা বলে উঠে, ” আমারও মা ছিলো না। আমি এই কষ্টটা বুঝি সোনা।”
সেদিনের অনুষ্ঠানে অনেকে আসলেও সমুদ্র এলো না। আয়না একফাঁকে ওকে কল দিলো। প্রথমে সরাসরি কল কেটে দিলো। আয়না পুনরায় কল দিলে কল রিসিভ হলো। ও’পাশ থেকে গম্ভীরমুখে বলে, ” কি? ”

–” কি মানে কি?”
–” কি মানে হলো হোয়াট।”
–” ধ্যাত। আসলেন না কেন আজ? সবাই এসেছে। ”
–” তুমি দাওয়াত দিয়েছো যে আসবো?”
–” বাবা বলেনি আপনাকে?”
–” বউ কে আমার?”
–” উফ! মেয়েদের মতো এমন নাক ফুলিয়ে অভিমান কেন করছেন?”
–” অভিমান কী স্ত্রীবাচক শব্দ নাকি? রাখছি। তুমি বরং অন্যদের সঙ্গেই ভাব জমাও। আমার থাকা-না থাকায় কী আসে?”

আয়নার কেন জানি হাসি পেলো। এসব কথা-বার্তা তার মতো রাশভারি কারো কাছে শুনবে আশা করেনি। ওনার মুখে এমন অভিমানী বাক্য মানায় না৷
সে হেসে ফেলে। যদিও বা হাসি আটকাতে চাচ্ছিলো।
সমুদ্র বলে উঠে, তুমি হাসলে? বাহ ওয়াও। ভাবলাম আমাকে কনভিন্স করবে। বাট ভুলেই গেছিলাম তোমার তো ইলেকট্রিক্যাল মন। রাখি।”
আয়না বুঝতে পারে না কী এমন হলো! অনেকবার কলে ট্রাই করেও আর রিসিভ করে না ও।
পরদিন দুপুরের আগেই আয়না আবার সমুদ্রকে কল লাগায়৷ প্রথমে না ধরলে, আয়না ম্যাসেজ দিলো, আপনি ফোন না ধরলে অফিসে গিয়ে হাঙ্গামা করব৷ অফিসের সব কাগজ ছিঁড়ে রেখে আসবো। সঙ্গে সঙ্গে কল ব্যাক করে৷
আয়না বলে উঠে, ” আপনি এখন বাসায় আসুন।”

–” সময় নাই।”
–” লাঞ্চব্রেকে আসুন।”
–” না।”
–” আমি কিছু জানি না৷ আপনি এক্ষুনি আসবেন। বলে দিলাম।”
এরপর আয়না ফোন কেটে দেয়। তার ধারণা সমুদ্র তার বলায় আসবে না। আদৌ তাদের মধ্যে স্বাভাবিক স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক নেই। ওনার নিশ্চয়ই কাজ ফেলে আয়নার সঙ্গে মিট করার ইচ্ছা নাই।
ঠিক দশ মিনিট পর কল আসে। ও ভাবে সমুদ্রের কল৷ কিন্তু স্ক্রিনে যখন রঙ্গন নামটা দেখে অবাক হলো। রিসিভ করতেই রঙ্গন বলে, ” কিরে তোর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। দু’দিন ধরে ক্লাসে আসোস না। সব ঠিকঠাক? ”

–” হ্যাঁ।”
–” বিবাহিতা হয়ে গেলে আর পড়তে মন চায় না নাকি?”
–” আরে না। বাসায় একটু সমস্যা ছিলো।”
–” কি সমস্যা?”
আয়না কথা এড়িয়ে গিয়ে বলে, ” দাদাভাই সিক। ”
— ” আমি আর সুব্রত তোর বাসার কাছেই। আসি?”
–” এখন?”
–” হ্যাঁ। ”
এভাবে তো ফ্রেন্ডদের মুখের উপর না করা যায় না। সে বলে উঠে, ” আচ্ছা আয়৷”

সত্যি ওরা দশ মিনিট পর আয়নার বাসায় আসলো। ড্রয়িংরুমেই বসে ওরা। হালিমা বুয়া চা-নাস্তা দেয় খেতে। আয়না টুকটাক কথা বলতে থাকে।
রঙ্গন বলে উঠে, ” বিয়ে করলি জানালি না অব্দি আমাকে।”
–” আমি সেকশনের ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে একবারেই সবাইকে বলেছিলাম।”
–” ওই গ্রুপে আমি এক্টিভ না জানোস-ই তো। ”
–” কাউকেই পার্সোনালি বলি না।”
–” আমি তোর সবচেয়ে ক্লোজ ফ্রেন্ড ছিলাম। একটা মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং এর জন্য তুই ফ্রেন্ডশিপ এভাবে নষ্ট করলি! ”

ওমন সময় সুব্রত প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলে উঠে, ” চিকেন ফ্রাই টা সেই মজা দোস্ত। রঙ্গন খা তুইও।”
এমন সময় মেঘ ডাকে। বৃষ্টি আসার পূর্বাভাস। ঝড়ো বাতাস শুরু হয়। আয়না দ্রুত পেছনের বারান্দায় চলে যায়৷ কাপড় শুকাতে দিয়েছে। ভিজে গেলে আরেক বিপদ। পেছনের বারান্দায় গেলে ঘরের সঙ্গে কোনো যোগসূত্র থাকে না৷ বারান্দায় দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ হিমেল হাওয়া উপভোগ করে ফিরে আসে। তখনই রঙ্গন বললো, ” ভাইয়া এসেছে। সোজা তোর রুমে ঢুকে পড়লো।”

আয়না ভ্রু কুচকে তাকালো। এক সেকেন্ড সময় নিলো সবটা বুঝে উঠতে। এরপর নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়। সে রুমে যেতেই অবাক, সমুদ্র তার বেডে কপালে হাত রেখে শু’য়ে আছে। আয়নাকে দেখেও যেন দেখলো না।
আয়না হতভম্বও হলো আবার অজানা এক আনন্দ এসে ভর করে। আয়নার কথা রেখেছেন তবে। এসেছেন উনি!
তাকে চুপ থাকতে দেখে সমুদ্র বলে উঠে, ” লাঞ্চব্রেকে আমি টুকটাক মেডিকেল রিলেটেড স্টাডি করি। তোমার কথায় সব ফেলে আসলাম।”

–” সর‍্যি জানতাম না যে আপনি লাঞ্চব্রেকে পড়েন৷”
–” খেতে দাও। খিদে পেয়েছে অনেক।”
–” আসেন।”
সমুদ্র উঠে ডাইনিং টেবিলের দিকে আগায়। আয়না রান্নাঘরে চলে যায়। সুব্রত আর রঙ্গন বসে ছিলো। সমুদ্রের সঙ্গে দু’একটা কথা বললো৷
আয়না রান্নাঘর থেকে ফিরতেই রঙ্গন বলে, ” আয়ু শুন। আমরা যাচ্ছি।”

আয়না বাধ্য হয়ে ওদেরকে বিদায় দিতে যায়। এরমধ্যেই হালিমা বুয়া সমুদ্রকে সব খাবার বেড়ে দেয়৷ কিন্তু সমুদ্র একটা কিছুও মুখে না দিয়ে রুমে ঢুকে পরে৷ আয়না ফিরে আসতেই দেখে টেবিলে সব খাবার পরে আছে। সে ভ্রু কুচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রুমে ফিরে আসে৷
সমুদ্র বিছানায় বসে ফোন স্ক্রল করছে৷ আয়না আসতেই জিজ্ঞাসা করে, ” তোমার সিজি কত?”
–” মেয়েদের বয়স, ছেলের স্যালারি আর ছাত্রদের সিজি জিজ্ঞেস করতে হয় না।”
–” ফালতু কথা রাখো। নিশ্চয়ই তোমার সিজি এর অবস্থা ভালো না। ভালো রেজাল্ট করবে কীভাবে? সারাদিন ফ্রেন্ড সার্কেল নিয়ে আড্ডা। ভার্সিটি বা বাসায় সবখানে আড্ডা দেওয়া।”

সে বুঝে সমুদ্র রেগে আছে কিন্তু হুট করে রাগ কেন করলেন? অবশ্য ওনার রাগার কোনো ভ্যালিড রিজিন লাগে না৷
আয়না নিজে সমুদ্রের পাশে বসে বলে, ” আপনি খান নি কেন?”
–” তোমার বাসায় খাওয়ার জন্য আসিনি।”
–” ক্ষুধা লেগেছে বললেন আবা…. ”
–” ক্ষুধা মরে গেছে। মাথা ব্যথা করছে।”
সমুদ্র হুট করে আয়নার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। আয়না নড়েচড়ে উঠলো।
সে বুঝতে পারছে যে খুব রেগে আছে৷ কিন্তু কেন? ঠিক রাগ না কেমন জেলাস ফিল হচ্ছে। আয়নার বাসায় ওর ছেলে ফ্রেন্ডরা কেন আসবে? কী আজব! এতে জেলাস ফিল করার কী আছে? ভার্সিটির ফ্রেন্ড-ই তো। জেলাস কেন হচ্ছে সে?

ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ২২

প্রেম থাকলে জেলাস হয় প্রেমিক। তবে কী?
তখনই আয়না বলে উঠে, ” বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়েন৷ আমার কোলে কেন?”
সমুদ্র জবাব দেয় না। ওদিকে দরজা খোলাই ছিলো। দাদী এসে একবার এই দৃশ্য দেখে গেছে। কি লজ্জা। আয়নার লজ্জায় মুখ নিচু করে ফেলে। সমুদ্রও টের পেয়েছে দাদী এসেছিলেন, তবুও সরে নি বরং উনি যাওয়ার পর আয়নার পে-/টের সঙ্গে নাক ঘঁষে। আরোও ঘনিষ্ঠ হয়ে শু’য়ে থাকে মটকা মেরে। লজ্জায় আয়নার দূরে কোথাও দৌড়ে পালাতে মন চাচ্ছে।
আয়না যতোবারই বলে উঠে বালিশে মাথা রাখেন। সমুদ্র যেন ততোই গা ছেড়ে দেয় তার উপর। একটা মানুষ এতো পরিমাণ ঘাড়বেকা কেমনে হয়?

ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ২৪