ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ২৮

ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ২৮
Arishan Nur

পরেরদিন খুব সুন্দর একটা সকাল প্রকৃতি উপহার দিলো। একদম মেঘমুক্ত স্বচ্ছ, স্নিগ্ধ, রোদময় আকাশ। এমন আবহাওয়া সকল ভ্রমণপিয়াসুদের জন্য আর্শীবাদ। পর্দার ফাঁক গলে যখন সূর্যের আলো চোখে-মুখে এসে লাগে, বরাবরই সমুদ্রের ঘুম ছু’টে যায়। কাল রাতে দেরিতে ঘুমালেও, খুব গভীর ঘুম ঘুমিয়েছে। সে চোখ মেলে আশেপাশে তাকালো। আয়না এখনো তার বুকে মাথা রেখে নিশ্চিতে ঘুমাচ্ছে। ওর নিষ্পাপ, কোমল মুখখানা দর্শনমাত্র সমুদ্রের মুখে হাসি ফুটে। ও খানিক সময় নিয়ে এলোমেলো চুল নিয়ে খেলে।

গতকালকের হ্যাংওভার কেটে গেছে, তবে এখন এই মুহূর্তে টায়ার্ডও লাগছে খুব। মস্তিষ্কের কোথাও সূক্ষ্ম একটা ক্লান্তিবোধ আছে৷ লেবুর পানি খেলে ভালো লাগতো বুঝি। ঘড়ির কাটায় মাত্র সাতটা বাজে। এতো সকালে উঠে লাভ নেই ভেবে সে ফের চোখ বুজে। আয়না তখন সামান্য নড়ে উঠে ঘুমের মাঝে। সমুদ্র বাঁধন হাল্কা করতেই ও ওপাশ ঘুরতে চায় ঘুমের মধ্যেই। কিন্তু সমুদ্রের হিংসুকে মন কোনোভাবেই আজ আয়নার ছো’য়া অন্যকোথাও মাড়াতে দিতে রাজী নয়। ওর সব উষ্ণতার অধিকারী কেবল সে! মুহূর্তের মধ্যেই ঘুমন্ত আয়নাকে আস্তে করে টেনে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে নেয়৷ এরপর কপালে আলতো ঠোঁট ছো’য়ায়। অবসাদ থাকায় একটু পরেই তার তন্দ্রাভাব এসে যায়৷

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আরোও কিছু সময় পর, আয়নার ঘুম ভাঙ্গে। সে নিজেকে ধাতস্থ করতে সময় নিলো৷ সমুদ্রর উম্মুক্ত বুকে নিজেকে আবিষ্কার করামাত্রই লজ্জায় ফেটে পড়ে। গতকালকের সব স্মৃতি ভেসে উঠতেই সে পারলে বালিশে মুখ লুকায়। ভাগ্যিস উনি জাগ্রত অবস্থায় নেই। থাকলে এতোক্ষণে আয়নার কয়েক শত’বার লেগ পুলিং করে ক্ষ্যান্ত হতো। সে উঠে আসতে চাইলে টান অনুভব করে। চোখ বুলিয়ে দেখলো সমুদ্রের হাত তার কাঁধে হেলে আছে। সে ওর হাত সরাতে গিয়ে সামান্য ঝুঁকে। এরপরে কী ভেবে ঘুমন্ত সমুদ্রের ঠোঁটের উপর নিজের ঠোঁট ছো’য়ালো। আয়না ভেবেছিলো উনি ঘুমিয়ে আছে। কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে সমুদ্র চোখ খুলে বলে উঠে, ” এই কী করলা এটা?”
আয়না ভড়কে উঠে বলে উঠে, ” কি করলাম?”

–” আমার অসহায়ত্বের সুযোগ নিলে কেনো? হু? নিরীহ, ঘুমন্ত একটা ছেলের সুযোগ নিচ্ছো? দস্যি মেয়ে কোথাকার!”
আয়না হা হয়ে যায়। সারারাত যে ডাকাতি চালালো সে-ই সকালবেলা ডাকাত হয়ে অন্যকে দস্যি উপাধি দেয়? এ কেমন আজব বিধি?
সমুদ্র অবশ্য ওর হা হয়ে যাওয়া মুখ দেখে গলে না। ওকে টান মেরে নিজের দিকে টেনে বলে, ” তুমি অন্যদের কাছে আমাদের মধ্যকার অতি-ব্যক্তিগত তথ্য চালান করো কেন?”

–” মানে?”
–” লেকের ধারে কাকে কী বলেছো? তোমার এইসব হেয়ালির জন্য মানুষ আমাকে যেকোনো সময় কলি– কাতা হারবাল উপহার দিবে, সে খেয়াল আছে?”
আয়না জিহবায় কামড় বসায় এরপর বলে, ” ওহহো! আপনার ফিমেল ডক্টর ফ্রেন্ডটা নর্মালি বলছিলো কোনো কনসালট্যান্ট লাগবে কীনা? রেগুলার কোন মেডিসিন নিচ্ছি? আমি উত্তরে বললাম কিছু নেই না তো!”
সমুদ্র মুখ কালো হয়ে গেলো। ডাক্তারের ফাঁদে এভাবে তার ইঞ্জিনিয়ার বউ আটকা পড়লো? ইউশা ভদ্র ভাষায় ওর মুখ থেকে চালাকি করে এ’তথ্য বের করেছে৷

সে আয়নাকে আরোও চেপে ধরে বলে, ” বোকা মেয়ে!”
আয়না মেকি রাগে নাক ফুলালো। সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্র ওর নাকফুলের উপর প্রগাঢ় অনুভূতিসম্পন্ন চু–মু বসিয়ে নরম গলায় বলে, ” আজ তবে সেই ফিমেল ডক্টরের কাছে গিয়ে কনসালট্যান্ট নেও। প্রেসক্রিপশন নিও।কাজে লাগবে।”
আয়না দ্রুত ওনার বুকে মুখ লুকানো। সমুদ্র শব্দ করে হাসে। ওনার হাসির শব্দ শোনামাত্র আয়না বুকে কিল বসায়। সমুদ্র জিজ্ঞেস করলো, ” আমার বুকের সঙ্গে তোমার এতো শত্রুতা কিসের? ”
কিছুক্ষণ পর সমুদ্র জিজ্ঞেস করলো, ” উঠবে না আজ? রাতে ঘুম হয়েছে তো ঠিকঠাক? ”
প্রশ্নটা ইচ্ছা করে ওকে লজ্জা দেওয়ার জন্য করা। পৃথিবীবাসীর অঘোষিত নিয়মই হলো দুর্বলকে তার ওই দুর্বলতা নিয়ে আঘাত করা।
তবে আজ আয়না একদম টানা তেজি গলায় বলে, ” আপনি আর ঘুমাতে দিলেন কই? এখন দয়া করে সরুন। ঘুমাবো আমি।”

সমুদ্রের চোখ কপালে উঠে যায়। সে ভাবেওনি আয়না এমন বেখাপ্পা কথা বলবে। সে বলে, ” না। না। এখন উঠতে হবে। ব্রেকফাস্ট টাইম শেষ হয়ে যাচ্ছে। ব্রেকফাস্ট না করতে গেলে, সারা রিসোর্টের মানুষ বুঝে যাবে তুমি কাল রাতে ঘুমাও নি।”
আয়না দ্রুত উঠে পড়ে। সমুদ্রও উঠে বলে, ” যাও দশ মিনিটের মধ্যে ফ্রেশ হয়ে আসো। দশটায় ব্যুফে টাইম শেষ। এখন সাড়ে নয়টা বাজে।”

–” দশ মিনিটের মধ্যে কীভাবে ফ্রেশ হবো? আমার দাঁত ব্রাশ করতেই তো বিশ মিনিট লাগে।”
–” বিশ মিনিট ধরে দাঁত ব্রাশ করেও এই হাল!”
আয়না ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলে, ” কেমন হাল?”
–” বললে কষ্ট পাবে। আচ্ছা শুনো, অনেক আগে ফিজিক্সে পড়েছিলাম একটা মোটর বিশ মিনিটে যে কাজ করে, একসঙ্গে সেইম দক্ষতার মোটর কাজ করলে টাইম অর্ধেক লাগে। তুমি চাইলে আই ক্যান হেল্প ইউ তাহলে দশ মিনিটের মধ্যে তুমি ফ্রেশ হতে পারবে৷”

আয়না ওনার কথা শুনেই ঘাবড়ে যায়। পাগল লোক বলে কী? সে একপ্রকার দৌঁড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে। একটু পর ফ্রেশ হয়ে বের হয়েই ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়ালো। ভেজা চুল ফ্যানের বাতাসে নড়াচড়া করে শুকানোর চেষ্টা করছে। সমুদ্র তখন ফোন স্ক্রল করছিলো। সে আসায় ফোন রেখে একদম ড্রেসিং টেবিলটার দিকে আগায়। দুজনের মধ্যে দূরত্ব কমলো। সে একদৃষ্টিতে আয়নাকে অবলোকন করছে। কমলা আর সাদা মিশেলের ঘের’আলা সুতির আনারকলি কুর্তিতে ওকে দারুণ মানাচ্ছে। একদম লিভিং বাটারফ্লাই যেনো! ওর ঘোর কাটে আয়নার অভিযোগ সুরে।
আয়নার ডান হাতের অনামিকা আঙুল ওর গলার সাইডের লাল হয়ে আসা ক্ষতপ্রাপ্ত স্থানে। ও চোখ-মুখ লাল করে বলছিলো, ” আপনি একটা খা– টাশ।”

সমুদ্র ড্রেসিং টেবিলের দিকে এগিয়ে এসে নিজের পরনের টি-শার্ট খুলে ফেলে। আয়নার চেহারা সে-মুহুর্তে দেখার মতো ছিলো। ভীষণ ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে ছিল। তবে সমুদ্র পেছন ঘুরে নিজের পিঠ প্রদর্শন করে। তারপর বলে উঠে, ” পিঠের যে অবস্থা করেছো, নিশ্চয়ই দুইটা সেলাই লাগবে। জং লি বিল্লি কোথাকার!”
আয়না লজ্জা পাওয়া চেহারা নিয়ে জিহ্বায় কামড় বসায়।
উম্মুক্ত বুক নিয়ে সামনে ঘুরে সে আয়নার হাতে থাকা সাদা সুতার কাজ করা ওড়নাটা গলার উপর দিয়ে সুন্দর করে পড়িয়ে দিয়ে বলে, ” মাই লিভিং বাটারফ্লাই!”

আয়নার ওই মুহুর্তটা এতো মোহময় লাগে। সে মায়া-মায়া চোখে ওনার দিকে তাকিয়ে রইল।
ব্রেকফাস্ট টাইম পাড় হওয়ার পর তারা বের হয়। আয়না নিরিবিলি একটা টেবিলে বসে ব্রেকফাস্ট অর্ডার দেয়। সমুদ্র ওর বন্ধুদের কাছে যায়। আজকের রাতে ফেরার পালা। বিকেলেই ঢাকার উদ্দেশ্য রওনা হবে।
নিয়াজ আর রিয়াদ বসে ছিলো সুইমিংপুলের পাশে।
সিগারেট খাচ্ছিলো। ওকে দেখামাত্র সিগারেট অফার করে বসে। ও সুখটান মেরে পুলের ধারে বসে৷
রিয়াদ টিটকারি মেরে বললো, ” তোরে হাসিখুশি লাগছে অনেক। ঘটনা কী?কালকে ভাবীর পাশেই যাইতেছিলি না আর আজকে ভাবীর থেকে দূরেই সরলি না।”

সমুদ্র বলে, ” আমি সবসময়ই হাসিখুশি থাকি।”
নিয়াজ ওকে পর্যবেক্ষণ করতে করতে বলে, ” ব্যাপার কি রে ব্যাটা? ব্রেকফাস্টের জন্য এলি না কেন?”
–” ঘুম থেকে উঠতে দেরি হলো৷
–“এই সকালেই গোসল করে বাবুসাহেব সেজে এসেছিস? ”
সমুদ্র যেকোনো ভদ্র উত্তর দিত, কিন্তু এই প্রশ্ন করার সময় ইউশা এসে দাঁড়ালো তার পাশে। সে ইচ্ছা করে বলে, ” বউ নিয়ে ঘুমালে সকালে গোসল করেই বের হতে হয়, জানোস না বুঝি কিছু!”
ওর ফ্রেন্ডরা হাসলো। ইউশা দ্রুত সরে যায়। সমুদ্রের কাছে বিয়ে করা উপলক্ষে ট্রিট চাইলো দুপুরে। সমুদ্র সবাইকে চাইনিজ খাওয়াবে বলে ঘোষণা দিলো।

ইউশা লাউঞ্জের ভেতর আসতেই দেখে আয়না বসে নাস্তা খাচ্ছে। তাকে দেখে আয়না-ই হাত নেড়ে হাই জানায়। সে এগিয়ে যায় আয়নার দিকে। ওকেই খুশি-খুশি লাগছে বড্ড। আয়নার চুলও ভেজা।
দুজনের মধ্যে দু’টো কথা হতে না হতেই ওয়েটার আসে। আয়নাই ডেকেছিলো। সে দু’টো ম্যাংগো জুস ওর্ডার দিয়ে ওয়েটারকে বলে, ” একটা জুস স্যারকে দিয়ে আসবেন।”
ইউশা তখন বলে, ” সমুদ্রের জন্য ওর্ডার দিচ্ছো?”
–” হ্যাঁ।”
ইউশা সরাসরি ওয়েটারকে বলে উঠে, ” স্যারের জন্য তাহলে একটা পাপায়া জুস বানান।”
ওয়েটার আচ্ছা ম্যাম বলে চলে যায়। ইউশাও কিছু না বলে উঠে পড়ে৷ খানিক বাদে সমুদ্র জুস খেতে খেতে ফিরে এসে আয়নার টেবিলে জুসের গ্লাস দেখে বলে, ” থ্যাংকস আয়না, আমার প্রিয় জুস খাওয়ানোর জন্য। অনেক দিন পাকা পেপের জুস খাই না৷ মন একদম ভালো হয়ে গেলো।”
সে জুস খেতে খেতে লবিতে বসলো৷ কিন্তু আয়নার কপালে সরু ভাজ দৃশ্যমান হয়৷ ওই আপু কীভাবে জানলো সমুদ্রের পাপায়া জুস পছন্দ?

আলিয়া ফোনে শ্রাবণের সঙ্গে কথা বলছিলো। শ্রাবণ ও’পাশ থেকে জিজ্ঞেস করলো, ” এখনো আপসেট আছো?”
ও আলিয়ার বাড়ির ঘটনা জানে সব। আলিয়া আনমনা হয়ে বলে, ” না।”
–” তাহলে বের হও। চল মিট করি কোথাও।”
–” না। মুড নাই।”
–” অন্য বফ-গফরা কতো ডেটে যাচ্ছে। তুমি আসো না কেনো?”
আলিয়া ঝাড়ি মেরে বললো, ” আমি তোমার গফ না বুঝছো?”
–” না। বুঝিনি।”
–” উই আর নট ইন এ রিলেশনশীপ।”
–” তাহলে কীসে আছি আমরা? সিএনজি-শীপে?”
আলিয়া ওর কৌতুকে হাসলো এবার বলে, ” আমরা অনলি জাস্ট ফ্রেন্ড।”

–” না। না। এটা জাস্ট ফ্রেন্ডের নমুনা না। আই থিংক আমরা, ফ্রেন্ডস উইথ এক্সট্রা কেয়ার এন্ড এটেনশনে আছি।”
–” এতোদিন শুনে এলাম ফ্রেন্ডস উইথ এক্সট্রা বেনিফিট। তুমি আবার এটা কোন নতুন টার্ম আবিষ্কার করলে?”
শ্রাবণ বেশ জ্ঞানী ভাব নিয়ে কথা বললো, ” ফ্রেন্ড এর সঙ্গে বেনিফিট বিষয়টা আমার বাজে লাগে। তাছাড়া তোমার কাছে আমি কিছুটা মোর দ্যান ফ্রেন্ড, লেস দেন বয়ফ্রেন্ড টাইপ পার্সন। বাট আমার কাছে তুমি শখের নারী। ইন হিন্দি পাসান্দিদা অওরাদ।”
আলিয়ার বেশ মনে ধরলো কথাগুলো। কিন্তু ওইসময় বেল বেজে উঠে। এ অবেলায় কে এলো? সে বলে, ” বাসায় কেউ এসেছে। রাখি।”

–” ফ্রেন্ড উইথ এক্সট্রা কেয়ারকে ইগনোর করা উচিত না।”
–” শাট আপ।”
আলিয়া গেইট খুলতেই অবাক হলো। শায়লা চৌধুরী দাঁড়িয়ে আছে তাও দুই বক্স মিষ্টির দামী গিফটবক্স নিয়ে। সে হাসি হাসি মুখে ভেতরে এসে বললো, ” আব্বুর সঙ্গে কথা হয়েছে?”
–” নাতো।”
–” কল দেয়নি তোমায়? খুশির সংবাদ শুনোনি?”

খুশির সংবাদ শব্দটা কানে বাজলো ওর৷ উদ্ভট এক চিন্তায় তার কপালের ঘাম ছু’টতে লাগে। কি হতে পারে সুসংবাদ? ওনার জন্য যা সু, তাদের দু’বোনের কাছে তা কু। উনি কী প্রেগন্যান্ট নাকি? আপা বলেছে বাবা আরোও কয়েক মাস আগেই বিয়ে করে ফেলেছিলো। আলিয়ার কান্না করার মতো অবস্থা। উনি যদি আসলেই প্রেগন্যান্ট হয়, ভার্সিটি গেলে সে মুখ দেখাতে পারবে না। সবাই বলবে আলিয়ার মেয়ের বয়েসী বোন। শ্রাবণ ও হাসবে তার উপর।
শায়লা চৌধুরী থেমে নেই৷ উনি আলিয়াকে ডাইনিং টেবিলের বসিয়ে, রান্নাঘর থেকে প্লেট এনে পুডিং আর মিষ্টি সার্ভ করে খেয়ে দেয়। তারপর ওদের দাদা-দাদীর রুমে যায়। আয়না ফোন অন করে দেখে বাবা চল্লিশ মিনিট আগে একবার কল দিয়েছিল কিন্তু ওইসময় শ্রাবণের সঙ্গে কল এনগেজড ছিলো তার। সে ঢোক গিললো।
শায়লা ফিরে এসে দেখল আলিয়া কিছুই খায় নি। সেও তার বিপরীতে বসে বলে, ” সুসংবাদ শুনো নি এখনো?”
আলিয়া ভয়ে ভয়ে বলে, ” আপনি কী প্রেগন্যান্ট আন্টি?”

শায়লা চমকালো এরপর হেসে ফেলে। ওইসময় আলিয়ার খুব ইমব্রেসড ফিল হলো।
শায়লা চৌধুরী বলে উঠে, ” তোমার আব্বুর প্রোমোশন হয়েছে।”
আলিয়ার স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। শায়লা চৌধুরী বলে, ” তোমার আব্বু এখন অনেক বড় পজিশনে আছে। দায়িত্বও বেড়ে গেছে। কাজের চাপও বাড়বে৷”
আলিয়া পুডিং মুখে দিলো। কথা ঘুরানোর জন্য সে বলে, ” পুডিং ভালো হয়েছে। আমার পুডিং এমন হয় না। ভেঙে যায় সবসময়।”

–” আমি বানিয়েছি তোমার জন্য। তুমি একা আছো বাসায় সেজন্য তোমার পছন্দের পুডিং বানিয়ে আনলাম। একদিন ফ্রি থাকলে, আমি তোমাকে পুডিং বানানো শেখাবো। পুডিংয়ে সবকিছু পরিমাণ মতো দিতে হয়,নাহলে পুডিং ভালো হয় না। এক্সটা করে বেকিং পাউডার দিলে আর ভাঙ্গে না।”
আলিয়া বলে, ” ও।”
দুপুরের দিকে ফাহাদ সাহেব আসলেন। তখন শায়লা চৌধুরী রান্নাঘরে ছিলো। তাকে বাসায় আসতে দেখে শায়লা চৌধুরী বলে, ” খালি হাতে এলে কেনো? মিষ্টি কোথায়?”
ফাহাদ সাহেব বলে উঠে, ” মিষ্টি আনার কথা একদম খেয়াল ছিলো না৷”
এরপর আলিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে, ” মা, তোমার আপার সঙ্গে কথা হয়েছে? ওরা কেউ ফোন ধরছে না।”
–” না, আব্বু।”

দুপুরে রিসোর্টের কর্মচারী সহ ওদের সঙ্গে আসা সব ফ্রেন্ডদের সমুদ্র চাইনিজ খাওয়ায়। ইউশাও এসেছিলো। কিন্তু একটু পর ও চলে যায়। ওকে ডাকতে কেবল শ্রেয়সী যায় পিছু, খানিক বাদে ও একাই ফিরে আসে। সবাই অনেকদিন পর একসঙ্গে অনেক মজা করে। এরপর ওর ফ্রেন্ডরা ওদের কংগ্রাচুলেড করতে বড়সড় একটা কেক এনে উপহার দেয়। কেকের উপর ইউনিক এক লেখা ছিল তা হলো:
“ডক্টর প্লাস ইঞ্জিনিয়ার ইজ ইকুয়াল বায়োটেক লোডিং।”
সমুদ্র তার বন্ধুদের বুদ্ধির প্রশংসা করতে বাধ্য হলো। কেক কেটে সমুদ্র সবার আগে আয়নাকে খাওয়ায় একফাঁকে বলে উঠে, ” তারপর, বায়োটেকের আম্মু! আমার পুচকে বায়োটেক কবে আসছে?”
আয়না ওর হিল দিয়ে একটা লাথি মারে সমুদ্রের পায়ে। সমুদ্র আউ বলে সরে যায়।
খাওয়ার পর শেষবারের মতো তারা চা-বাগান ঘুরে দেখছিলো। এবারের ট্যুরে বন্ধুরা কোয়ালিটি টাইম কাটানোর জন্য কেবল রিসোর্টেই ছিলো। বাইরে বের হয়নি। বিকেলেই বাস। হাতে সময় একদম নেই৷
আয়না চা-বাগানের সিঁড়ি বেয়ে উঠছে আর একটু পরপর ওর ঘের দেওয়া আনারকলি নিয়ে ঘুরছে। খিলখিল করে হেসে সমুদ্রের দিকে তাকায়।

সবুজে ঘেরা চা-বাগানে কমলা রঙের আয়না যেন একরাশ মুগ্ধতা ছড়াচ্ছিলো। ওর উপর থেকে সমুদ্র চোখ ফেরাতে পারে না৷ চারপাশে খালি সবুজ, সারি সারি চা-পাতার বাগান। উপরে স্বচ্ছ নীল আকাশ। দূর-দূরান্ত যতোদূর চোখ যায় কেবল সবুজ এবং সেই সবুজের মাঝে এক টুকরো কমলা যেন আয়না। প্রাকৃতিক দৃশ্যর নৈসর্গিক সৌন্দর্য আর আয়নার মুক্তা ছড়ানো হাসিতে সমুদ্র আকৃষ্ট না হয়ে পারেনা। লবি থেকে একটা লাল গোলাপ তুলে এনেছিলো লুকিয়ে ৷
সে আয়নার হাত টান মেরে একটু এগিয়ে গিয়ে বিনা অনুমতি নিয়েই ওর কানে গোলাপ গুঁজে দিয়ে বলে, ” তোমার কানে গোলাপ মানায় ভালো।”

–” কীভাবে জানলেন?”
মেয়েটার প্রশ্ন করার স্বভাব ভালো লাগে না তার। সে আয়নার কাছে গিয়ে তাকে নিজের দিকে এনে বলে, ” মেহেদীর দিনে দেখেছি।”
–” আপনার মনেও আছে?”
–” আছে।”
আয়না দুষ্টুমি করে বলে, ” আমাদের বিয়ের তারিখ মনে আছে?”
সমুদ্র মাথা চুলকে বলে, ” ভুলে গেছি।”

আয়না ওর বুকে আবারো কিল বসাতে গেলে সমুদ্র খপ করে ধরে ফেলে ওকে নিজের দিকে টেনে একদম বুকের সঙ্গে লেপ্টে নিয়ে বলে, ” আমি তোমার বন্ধু বা ছোট ভাই না, হাসবেন্ড আমি। যখন-তখন মারবা না, বুঝছো?”
আয়না মাথা ঝাকায়। সমুদ্র সঙ্গে সঙ্গে ওর ওড়না সরিয়ে দিয়ে বলে, ” হাসবেন্ড এর সঙ্গে যখন-তখন মারামারি না, রো–মন্স করতে হয়।”
আয়না ওর ওড়না টানতে টানতে কাদো কাদো মুখে বলে, ” কেউ দেখে ফেলবে তো।”
সমুদ্র ওর কাণ্ড দেখে হেসে ক্ষতপ্রাপ্ত স্থানে আদুরে ভঙ্গিমায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, ” সর‍্যি ফর দ্যাট। আজোও ফার্মেসী ঘুরে আসা হলো না।”

–” আপনি কেমন মানুষ ? সাথে প্রয়োজনীয় মেডিসিন কেন রাখেন না?”
–” আমি ডাক্তার, ফার্মেসীর দোকানদার না যে সব রকম ঔষধ ,প্রোটে–কশন ইত্যাদি মালামাল নিয়ে ঘুরবো।”
আয়না সরে আসতে চাইলে সমুদ্র ওইখানটায় ঠোঁট ছু’ইয়ে বলে, ” তারপর আমার বায়োটেকের আম্মু! আপনার তো ফ্রেন্ডমুন করার কথা! কিন্তু আমার মতো হান্ডসাম ছেলের উপর লোভ সামলাতে না পেরে ডিরেক হানিমুন সেরে নিলে। এখন আপনার লোভ সামলাতে না পারার এ’দায়ভার নিশ্চয়ই আমার নয়।”
আয়না সরতে চাচ্ছিলো কিন্তু সমুদ্র গোলাপ ফুলের পাপড়ি ছিঁড়ে ওর মুখে ছুঁ’য়ে দেয়। যে জায়গায় পাপড়ি ছোঁ’য়ায় সে জায়গায় টুপ করে চু–মুও দেয়।
বিকেলের দিকে তারা চা-বাগান চা-পাতা দিয়ে তৈরি চা খেয়ে রওনা হলো। বাসে আয়নার হাল্কা জ্বর আসলো। সে সমুদ্রের কাধে মাথা রেখে শু’য়ে ছিলো।

সেদিন রাতে শায়লা চৌধুরী ফাহাদ সাহেবের সঙ্গে তার বাসায় থাকলো। আলিয়া কিছু বলতে পারলো না। দাদীও চান শায়লা চৌধুরী থাকুক। একাকী গতি করতে পারবে না সে। আপাও নেই। একা বাবার সঙ্গে তর্ক করার সাহস তার নেই। এম্নিতে মনোবল তার দুর্বল। তার উপর ঝামেলা করলে তাকে বিয়ে দিয়ে দিবে এটা তো নিশ্চিত। তার উপর সে পাবলিকে কোথাও চান্স পায় নি। প্রাইভেটে পড়তে হবে, এমন পরিস্থিতিতে বাবাকে রাগিয়ে দেওয়া ভুল হবে।

ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ২৭

আপার শ্বশুড়বাড়ি আছে, নিজে পাবলিকে পড়ে। পড়তে টাকাও লাগে না৷ কিন্তু আলিয়ার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। সে ন্যাশনালে পড়তে চায় না। প্রাইভেটে পড়তে হলে, বাবার সাপোর্ট ছাড়া সে নিঃস।ঢাকায় সে একলা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতেও পারবে না। আপার শ্বশুড়বাড়ি গিয়েও থাকবে না।এরচেয়ে সৎমায়ের সঙ্গে থেকে বাবার টাকায় লাখটাকা সেমিস্টার ফ্রি দিয়ে থাকাই ভালো। এজন্য চুপ থাকে। সেদিন রাতে শায়লা চৌধুরী এ’বাসায় থাকেন৷

ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ২৯