ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ৩০

ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ৩০
Arishan Nur

সময় ও নদীর স্রোত কারো জন্য অপেক্ষায় থাকে না। বড় নির্মম কিংবা প্রকৃতির এক আর্শীবাদ যেন এ’বিধি। সময় কীভাবে জানি অতিবাহিত হয়ে যায়। অস্থির ঘড়ির কাঁটার যেন মৃত্যুর আগ অব্দি বিশ্রাম নেওয়ার অনুমতি নেই। যতোক্ষণ শ্বাস আছে, ওটা সেকেন্ডের কাটা পেরিয়ে মিনিট পার করে ঘন্টায় গিয়ে ঠেকে। ঘন্টা থেকে দিন, দিন থেকে পার হয় মাস। চোখের পলকে কিংবা রয়ে-সয়েই তিন’টে মাস পার হয়ে গেলো। আয়নার জীবনে অবশ্য এখনো বসন্ত আসা বাকি। কেবল শরৎ চলছিলো। হিমেল ঠাণ্ডা বাতাস, কিন্তু কোথায় জানি একটা শুষ্কতার আভাস৷

সেদিন রবিবার ছিলো। আয়নার ক্লাস ক্যান্সেল হয়ে গেছে। ও আলসে ভঙ্গিতে বিছানায় শু’য়ে থাকে। উঠতে মন চাচ্ছিলো না তার৷ তবে সমুদ্রের তার মতো অলসতা নেই। ও ঠিকই সকালে উঠে বিশ মিনিট হেটে এখন ফ্লোরে ম্যাট বিছিয়ে ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করছে। পুশ আপ দিচ্ছে আপাতত। হাত কাটা স্যান্ডো গেঞ্জি পরে আছে ও। ওর উম্মুক পিঠ দর্শন হতেই চোখ সরিয়ে নেয় আয়না। পরবর্তীতে ফের তাকায় ওর পানে। ঘেমে গেছে একদম। নিশ্চয়ই এখন গোসলে যাবে৷ হলোও তাই শেষ পুশ-আপ দিয়ে উঠে দাড়ালো ও। সাইড টেবিল থেকে পানি পান করে আয়নার দিকে তাকায় এবং বলে, ” ওই, অলস মেয়ে, আর কতো ঘুমাবা?”
আয়না কম্বল আরোও ভালোমতোন জড়িয়ে মটকা মেরে শুয়ে থাকে এবং বলে,” শীতের দিনে সকাল দশটার আগে উঠা দণ্ডনীয় অপরাধ।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সমুদ্র হাসলো এরপর ওর দিকে এগিয়ে আসে। আয়না ভাবে নিশ্চয়ই ঘুমাতে আসছে কিন্তু না ওনি তো আসলে বদ স্বভাবের। অন্যের আরাম সহ্য করতে পারে না। এগিয়ে এসেই আয়নার পায়ের দিক থেকে কম্বল তুলে নিয়ে একদম ডিভান বরাবর কম্বল ছু’ড়ে মারে। কম্বল গা থেকে সরতেই ঠাণ্ডায় একটু কেঁপে উঠে ও। সমুদ্র এরপর ফিচেল হেসে নিয়ে ওর ঠাণ্ডা হাতটা আয়নার গলায় রেখে উষ্ণতা অনুভব করে। তারপর খানিক বাদে বলে, ” তোমার শরীরের গরম উষ্ণতা তো আমায় পাগল করে দিচ্ছে৷ এক কাজ করি, আমিও দশটা পর্যন্ত ঘুমাই। আজ লেইটে অফিসে যাই।”
আয়না ইদানীং ওনার মতিগতি বুঝে ভালো। সে বলে উঠে, ” না, না, আপনার ঘুমাতে হবে না।আপনি বরং যান অফিসে।”
সমুদ্র বলে, ” সিউর?”
আয়না তড়িঘড়ি করে উঠে এক্সাইটেড হয়ে বলে, ” আজ বিকেলে কোথায় যাই?”

–” কোথায়?”
–” শপিংয়ে।”
–” না, জরুরি কাজ পেন্ডিং আছে।”
–” আপনার সবদিনই জরুরি কাজ থাকে?”
–” কিছুটা এমনই।”
–” শপিং যাওয়াও জরুরি।”
–” তোমার জন্য জরুরি বাট আমার জন্য নাহ।”
আয়না হতাশ হলো। একটা সিংগেল ডে’তেও সমুদ্র টাইম বের করে তাকে নিয়ে ঘুরতে যায় না৷ ওর নাকি সময় নেই। ব্যস্ত খুব। সমুদ্র গোসল সেড়ে কফি কালারের একটা শার্ট পরে ইন করে ড্রেসিং টেবিলের সামনে চুল আছড়ায় সময় নিয়ে। পারফিউম মাখে একগাদা। আয়না চোখ গোল গোল করে ঘুমু চোখে ওনার দিকে সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সহজেই তা বুঝে যায় সে।
সে মুচকি হেসে ওর দিকে তাকিয়ে বলে, “সুন্দরী, আপনার দেখি হান্ডসাম ছেলে দেখলে একদম রসগোল্লার মতো খেতে মন চায়।”

আয়না আনমনে উত্তর দিলো, ” হুম।” এরপর ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলে, ” আপনি এই শার্ট পরে অফিস যাচ্ছেন?”
সমুদ্র পরনের শার্টটা একবার পরখ করে নেয়, দেখে নেয় শার্টের কোনো অংশ ত্রুটিপূর্ণ কীনা!
সে বলে, ” এ শার্টে সমস্যা কোথায়?”
–” আমি এই শার্ট পুড়িয়ে দিবো।”
সে ভ্রু কুচকে তাকায় এবং বললো, ” রুপ দিয়ে আমাকে পুড়াচ্ছো এখন আবার আমার শার্ট কেও ছাড় দিবা না? শার্টে কি সমস্যা? চেঞ্জ করবো?”
আয়না গম্ভীরমুখে বলে, ” আপনাকে এই শার্টে একটু বেশি সুদর্শন লাগছে।”
সমুদ্র একগাল হাসি উপহার দেয়। সময় কম জন্য কথা সংক্ষিপ্ত করে বলে, ” দেখি কতোজন ললনা পটে আজ! যাচ্ছি। দশটায় উঠে নাস্তা খেয়ে নিও।”

আয়না মুখ ভার করে ওর পানে চেয়ে থাকে৷ কিন্তু ওর মধ্যে কোনো হেলদোল নেই। ও ফাইল চেক করে ফোন জাতে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলো। একপ্রকার রুম ছেড়ে গেছে, দুদণ্ড বাদে ফের ভেতরে এসে পকেট থেকে ক্রেডিট কার্ড বের করে বলে, ” এবার একাই শপিংয়ে যাও। যা লাগে কিনে আনো। পরের বার দেখি টাইম ম্যানেজ করবো।”
আয়নার একটু হলেও ভালো লাগলো। সে বিবাহিত জীবন যেমন ভাবে কল্পনা করেছিলো, বাস্তবতা তার ক্ষেত্রে পুরোপুরি ভিন্ন। সমুদ্র খুবই দায়িত্বশীল, যখন যা লাগে সব দেয়। তবে ওর মনে হয় কিসের যেন একটা কমতি আছে। তাদের সম্পর্কটা ঠিক যেন লবণ পরিমাণ মতো না হওয়া দেখতে সুস্বাদু তরকারির মতো!

তবে, সমুদ্র তাকে দারুণ ক’টা সুন্দর স্মৃতি উপহার দিয়েছে৷ আজ সে শপিং যেতে চাইছিলো কারণ আগামীকাল তার জন্মদিন। বিয়ের পর প্রথম জন্মদিন তার। এজন্য টুকটাক কেনাকাটা করতে চায়৷ বিয়ের আগে জন্মদিনের আগেরদিন করে বাবা নিয়ে যেতো দোকানে নতুন জামা-জুতা, চুলের ফিতা সব কিনে দিতো। তারপর রাতে চাইনিজ খেয়ে বাড়ি আসতো। বার্থডের আগের দিন থেকেই উৎসব ভাব শুরু হতো। সকালে স্কুল থেকে ফিরে নতুন জামা পরে আনন্দ করত। বিকেলের দিকে বাবা কেক নিয়ে আসতো। আয়নার মন বিষিয়ে উঠে। আজ তিনমাস ধরে বাবার সঙ্গে সে কোনো প্রকার যোগাযোগ রাখছে না। বাবা ফোন করলেও ধরে না। এমনকি বাবার বাড়ি একবারও যায়নি সে। তবে আলিয়া আসে, দাদার সঙ্গে কথা হয়। তার ঘুম ছু’টে যায়।

সে বিষন্নতা গায়ে সুগন্ধির মতো মেখে বারান্দায় পা রাখে। বারান্দায় তার লাগানো নয়নতারা গাছটি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। আয়নার একটা স্মৃতি মনে পড়লো। কয়েক সপ্তাহ আগের কথা। সে বারান্দার জন্য শাহবাগের একটা নার্সারি থেকে এই গাছ এনে লাগিয়েছে কিন্তু এতো যত্ন-আত্তি করার পরও গাছে ফুল ফুটে না। সে সমুদ্রকে জিজ্ঞেস করে, ” আপনি তো ডাক্তার মানুষ, দেখেন তো গাছটার কী রোগ হলো যে ফুল ফু’টে না।”
সমুদ্র গম্ভীরমুখে বলে, ” তুমি এক কাজ করো, গাছের ডগায় একখানা ভারী চুমু খাও, ব্যাঙ রাজপুত্র যেমন রাজকন্যার চুমু খেয়ে ব্যাঙ থেকে রাজপুত্র হয়েছে, তেমনি দেখা গেলো, তোমার চুমু পেয়ে এ’গাছে ফুল ফুটলো।”
আয়না ওইদিন খুব হেসেছিলো।

অফিস আওয়ারে বেশ ব্যস্ত সময় পার করছে সমুদ্র। সে অফিসের সব কাজ সামলালেও মনে মনে আয়নাকে নিয়ে একদম অস্ট্রেলিয়া সেটেল ডাউন হওয়ার প্লান করছে। ভবিষ্যতে কার্ডিওলজি এর উপর হায়ার স্টাডিজ করার পরিকল্পনা আছে তার। নেক্সট ইনটেকের জন্য এপ্লাই টাইম চলছে। ও ভাবছে ও এপ্লাই করলে ওর হওয়ার চান্স কম। তবুও অনলাইনে এপ্লাই করে ফেলে আজকে। কাউকেই বলেনি বিষয়টা।শুধু প্রোফেসর এডরিক স্যার জানে।
সে এপ্লাই করে ফেলে অফিসের কাজে মনোযোগ দেয়৷ তখন সজল ভাই এসে বলে ভাইভা বোর্ডে আসতে৷ ওর খেয়াল হলো, তার পিএ এর পোস্টে নতুন মানুষ নিয়োগ দেওয়া হবে। টুম্পা আপুর প্রেগ্ন্যাসি লিভ চলে। এছাড়া তার প্রোমোশনও হবে। তাই ভ্যাকেনসিতে লোক নেওয়া। সজল ভাই যাকে সিলেকশন করবে সেই সবচেয়ে যোগ্য তবুও কেন তাকে ডাকছে৷

একে একে তিনজনের ভাইভা শেষ করে চতুর্থ ক্যান্ডিডেট যখন ভেতরে আসে, সমুদ্র চমকে উঠে। দু’বার মেয়েটার দিকে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকায়। এবং দু’বারই আশ্চর্য হয় সে। ইন্টারভিউয়ের একটা পর্যায়ে সে জিজ্ঞেস করে, ” আপনি কী ই– হুদি?”
কর্পোরেটে এ’টাইপ প্রশ্ন কেউ করে না। এসব সিভিতে লেখা থাকে৷ মেয়েটা ভ্যাবাচেকা খেলেও হাসি মুখে বলে, ” নো, স্যার।”
সমুদ্র ভাইবা বোর্ড থেকে বের হয় আসে। সে কেবিনে বসে সিগারেট ধরায়। চোখ বুজে চেয়ারে হেলান নিয়ে রেস্ট নেয় কিছুক্ষণ।
পিউয়ের আজকে ভার্সিটির অরিয়েন্টেশন। পিউ আর আলিয়া দু’জনেই একি ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলো।আলিয়া এসেছে তার বোনের বাসায় সাজতে। দু’জন সেজেগুজে আয়না সহ যাবে অরিয়েন্টেশনে।
আয়না যখন আলিয়ালে মেকাপ করে দিচ্ছিলো। আলিয়া ফাঁকে ফাঁকে কথা বলছিলো।
সে বলে, ” আপা, জন্মদিনের প্লান কি?”

–” এখনো কিছু ভাবি নি।”
–” বাসায় আসো প্লিজ। বাবা অনেক করে বলে। আপসেট ও হয়৷ আমরাও মিস করি তোমাকে৷”
আয়না বলে, ” না। যাবো না৷”
এমন সময় পিউ ফোন হাতে করে এনে আয়নার কাছে ধরে বলে, ” তোমার রাগী বর কল করেছে। তোমাকে কল করে নাকি পাচ্ছে না। এজন্য আমাকে কল দিয়ে বকা দিচ্ছে৷”
কথা শেষে পিউ ঠোঁট উল্টায়। ভাইয়ের ব্যাপারে ভাবীকে অভিযোগ করলো।
আয়না কানে ফোন ধরতেই সমুদ্র বলে, ” কই তুমি? ফোন ধরো না কেন?”

–” পিউ আর আলিয়াকে সাজিয়ে দিচ্ছিলাম৷ কি হলো আপনার?”
–” আজকে আসতে দেরি হবে৷”
–” প্রতিদিন ই হয়৷”
সমুদ্র নরম গলায় বলে, ” আজ একটু বেশি দেরি হবে, বউ। সর‍্যি।”
–” ইটস ওকে।”
ওরা তিনজন বেরিয়ে যায়। নবীনবরণ শেষ করে শপিং শেষে খাওয়া-দাওয়া সেড়ে, বাড়ি ফেরে। তখন সন্ধ্যা সাতটা বাজে। আয়না অপেক্ষায় থাকে সমুদ্রর। দশটা বাজে। সবাই খেয়ে নিলেও ও খায় না। অপেক্ষায় থাকে৷ সোয়া এগারোটা অব্দি জেগে থাকে সে। একটা সময় পর বিছানায় বসা অবস্থাতে ঘুমে ঢুলে পড়ে৷

সমুদ্রের গাড়ি যখন বাসায় ঢোকে তখন বারোটা পার। বাসায় ঢুকে ডাইনিং টেবিলের দিকে চোখ যায়৷ খাবার সাজানো আছে। এমনকি লেবুর শরবত ও বানানো আছে। সে অল্প একটু তরকারি থেকে চিকেন খেয়ে রুমে আসে। রুমে আসতেই তার মন খারাপ হয়। আয়না বিছানায় বসেই কাত হয়ে ঘুমাচ্ছে। নিশ্চয়ই ওর অপেক্ষায় ছিলো। মেয়েটা সে বারং করেছে ওর জন্য অপেক্ষা না করতে কিন্তু শুনে না ও৷
সে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়ে আয়নাকে নিজের বুকেএ সঙ্গে জড়িয়ে নেয়৷আয়না জানতেও পারে না ওর ব্যস্ত বর ওকে কতোটা ভালোবাসা নিয়ে আগলে নিলো৷ পরদিন দ্রুত অফিস যেতে হবে জন্য ঘুমিয়ে পরে সমুদ্র। কিন্তু নিদ্রার সমস্যা হলে যা হয়! ঠিকঠাক ঘুম পূরণ হয় না৷ সকাল হতেই যথারীতি কাজের জন্য বের হয় ও। কিন্তু আজকে আয়না জাগে নি। ওকে আর জাগায় না সমুদ্র। বেঘোরে ঘুমুচ্ছে।

আয়না যখন উঠে তখন নয়টা বাজে। ঘুম থেকে উঠে রুম সম্পূর্ণ ফাঁকা পেলো সে। সমুদ্র এসেছিল রাতে? হ্যাঁ! ওইতো ওনার ভেজা টাওয়াল বেডেই পরে আছে৷ আজ আয়নার জন্মদিন। কিন্তু সমুদ্র তাকে উইশ না করেই চলে গেছে অফিস। এমন কি কাল রাতে এসে একবারও কথাও বলেনি ওর সাথে। এতো ব্যস্ততা কিসের ওনার? জন্মদিনটা তার ভালোই যায়৷ ফেসবুকে অনেকেই উইশ করে। পিউও উইশ করে৷ সে বড্ড আগ্রহ নিয়ে রাতের জন্য সমুদ্রের পছন্দের বিরিয়ানি রোস্ট বানায় নিজ হাতে।

ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ২৯

বিকেল হয়ে আসলে, সুন্দর একটা শাড়ি পরে রেডি হয়। আজকে সমুদ্র একবারও কল দেয়নি ওকে। সেও দিলো না। তার বার্থডে, সে কেন ম্যাসেজ দিবে৷ সন্ধ্যায় অবাক জনক ঘটনা ঘটে৷ বাবা, দাদা-দাদি, আলিয়া আসলো। কেক নিয়ে আসলো। এতো, এতো উদাসীনতার মাঝেও একটু হলেও তার ভালো লাগলো।কিন্তু সমুদ্রর আসার নাম-গন্ধ ও নেই। ফোনও তুলে না ও। কেক কেটে ফেলা হলো। খাওয়া-আড্ডা হলো৷ আয়না সমুদ্রের অপেক্ষায় একটু পর জানালার দিকে তাকিয়ে দেখে গাড়ি আসছে কিনা৷ কিন্তু সমুদ্র আসে না৷

ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ৩১