ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ৩৬

ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ৩৬
Arishan Nur

আকাশ পরিষ্কার৷ আরামদায়ক ও প্রশান্তিকর প্রভাতের কিরণ উঁকি মারছে বারান্দার দরজার কোল ঘেঁষে। নাম না জানা নানারকমের পাখির কিচিরমিচির শব্দে চারপাশ মুখরিত। আজকাল ভোরে খুব শীত পরে৷ ঠাণ্ডায় জমে যাওয়ার মতো৷ উষ্ণ কম্বল মাস্ট নিতে হয়। অস্ট্রেলিয়ার ওয়েদার বরাবরই বেশ আদুরে। সোয়েটার পড়ে শীতের আমেজ উপভোগ করতে হবে। সমুদ্র ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় এক কাপ কফি নিয়ে বসে। বারান্দা থেকে খুব সুন্দর দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। দূর-দূরান্ত শুধু সবুজ ঘাস আর গাছ-গাছালিতে ভরপুর। একতলা বাড়ি দিয়ে লোকালয় সাজানো। একটা বাড়ি থেকে আরেকটা বাড়ির মধ্যকার দূরত্ব কয়েক মিটার। কফিতে চুমুক দিয়ে জিড়িয়ে নিলো। আসলে এতো মনোমুগ্ধকর পরিবেশে কেউ উদাস থাকতেই পারে না। চারপাশে সবাই খুব হাসি-খুশি। সমুদ্রের মনে হচ্ছে আয়নাকে এখানে আনা দরকার। দেখানো উচিত মানুষ কতো খুশি থাকে আর মহারানী সারাদিন গোমড়া মুখ করে কিছু হলেই ভ্যা ভ্যা করে কাঁদবে।

সে কফি শেষ করে শাওয়ার নিয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্য রেডি হয়। হাতে এপ্রোন ছিলো। আপাতত একমাসের জন্য সে তার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু আমান বাসায় আছে। ডর্মে থাকার কথা ছিলো কিন্তু আমান থাকতে দেয়নি। নিজের বাসায় জোর করে এনেছে। আমান আর নয়নতারা দু’জনই তার মেডিকেলের। বন্ধু বলা চলে। তাদের মেডিকেলে টোটাল সব রার্নিং ব্যাচ মিলিয়ে চারজন বাঙ্গালী ছিল। এরমধ্যে আমান আর নয়নতারা প্রেম করে বিয়ে করল। টানা একমাসের কাছাকাছি নবদম্পতির সঙ্গে থেকে সে রিয়ালাইজ করেছে তার নব বিবাহিত জীবন খুব বাজে রকম নিরামিষ ছিলো। আমান আর নয়নতারার প্রেম যেন ফুরায় না। আজকেও ওরা ঘুরতে যাবে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আমান প্রায় বউয়ের জন্য ফুল আনে। ক্যান্ডেল নাইট ডিনারে যায়। লং ড্রাইভিং এ যায় ওরা। সমুদ্রের ওদের সুন্দর-সুখী বিবাহিত জীবন দেখে আনন্দ লাগে আবার নিজের জন্য খুব দুঃখ অনুভব হয়। তার নব বিবাহিত জীবনও এমন সুন্দর হতে পারত। ওদের প্রেমময় সময় কাটাতে দেখে নিজেরও এমন সুন্দর মুহুর্ত অনুভব করতে ইচ্ছা করে। আয়নার কথা খুব মনে পড়ে। দূরে থাকার ফলে যেন মায়া বেড়েছে ওর জন্য। কিন্তু আয়না খুব বাজে ভাবে তাকে ইগনোর করছে। সেদিন অনেক কষ্টে ভিডিওকলে কথা বলায়, ও দু’মিনিটের মধ্যে কল কেটে দেয়৷ কিন্তু ওই দুই মিনিটের মধ্যে সমুদ্রের মনে হয় আয়না ভালো নেই।

ওর কিছু একটা হয়েছে। চোখের নিজে ডার্ক সার্কেল। শুকিয়ে গেছে। আমানের সঙ্গে নিজেকে মাপলে, সে বরাবরই লুজার৷ স্বামী হিসেবে লুজার। আমানের ওয়াইফ নয়নতারা সারাদিন মুক্তা ছড়ানো হাসি হাসে। তার আয়নাও একদা হাসতো এমন করে। অফিসে দেখেছে তো সবার সঙ্গে কতো সখ্যতা করে হাসত। সমুদ্রের ওর হাসি ভালো লাগত। তবে কি এমন হলো যে আয়না আর হাসে না৷ সেও জিজ্ঞেস করে না কেন ও আর আগের মতো হাসলো না? আয়নার জন্য মন কেমন ব্যাকুল হচ্ছে৷ নাহ দেশে ফিরেই আয়নাকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে হবে। জড়িয়ে ধরে বলতে হবে, “সর‍্যি দীপান্বিতা।”
আচ্ছা,দূরত্ব কী ভালোবাসার সমানুপাতিক ধ্রুবক? বাই এনক চান্স, দূরত্ব বাড়লে ভালোবাসারা বৃদ্ধি পায়? এমন কোনো ফর্মুলা আছে কী?

ক’টা দিন যাবত আয়নার খুব দুর্ভোগ যাচ্ছে৷ জীবনটাকে নরক সম লাগছে। হুট করে এতো পরিমাণ সিক হয়ে গেছে। ভাগ্য ভালো সেমিস্টার ফাইনাল শেষ। নাহলে ক্লাস-এক্সাম সব মিস যেতো। খুব দুর্বল লাগে তার। রুমেই শুয়ে বসে কাটাচ্ছে। তবে কিছু ই ভালো লাগছে না তার। প্রচুর মুড সুয়িং হচ্ছে ওর। খাওয়ার রুচিও নেই। মাছ-মাংস কিছুই ভালো লাগে না খেতে। সমুদ্র বললো গ্যাস্টিক। এন্টাসিড রেগুলার খেলো তাও বমি ভাব যায় না। গায়ে জ্বরও ছিলো।কাল রাতে কিছু ই খায়নি। কাল রাতেই শায়লা চৌধুরী বলছিল একবার সরাসরি ডাক্তার দেখাতে।

সকালে ব্রেক ফাস্ট করতে ইচ্ছা করছে না৷ আজকে বাসায় কেউ নেই। সে একাই। হালিমা বুয়া সহ দাদা-দাদী গ্রামে গেছেন। কয়েকদিনের মধ্যেই ফিরে আসবেন। সে বিছানা থেকে উঠে মাথা তুলতেই মনে হচ্ছে মাথা ঘুরায় পরে যাবে। উফ! এতো বিরক্ত লাগে সবকিছু। চোখ বুজে হেলান দিয়ে শুয়ে থাকে। কেমন ছটফট লাগে। মনে হচ্ছে কোথায় কি যেন অনেক কিছুই তার অজান্তেই হয়ে যাচ্ছে।
ঘণ্টা খানেকের মধ্যে, তার রুমে নক করলো কেউ। নিশ্চয়ই শায়লা চৌধুরী। উনি লাঞ্চ টাইমে খেতে আসেন বাসায়৷ আজ অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজনবোধ করেনি। নক করেই দরজা খুলে ভেতরে এসে জিজ্ঞেস, ” ভাত খাবে? তোমার আব্বু বলেছে তোমার চিকেন পছন্দ। চিকেন ফ্রাই খাবা?”
আয়না চিকেন ফ্রাইয়ের কথা শোনামাত্র মুখ বাকিয়ে বলে, ” চিকেন ফ্রাই আমি এই মুহূর্তে মারা-ই যাবো বমি করতে করতে।”

শায়লা চৌধুরীর আয়নার লক্ষন দেখে অনেককিছুই মনে হয়৷ কিন্তু আধুনিক যুগের বাচ্চা-কাচ্চা এসব লক্ষণ দেখেই যাচ-বিচার করে না। সমুদ্র তো বলেই দিয়েছিল গ্যাস্টিক সমস্যা। জামাই-বউ যা বলবে সেটাই সই। ওনি আয়নাকে পরখ করে একটু চিন্তা করে বলে, ” আমি তো এসব চিকেন-মুরগি খাই না৷ নিজের জন্য ঝাল-ঝাল কচু ভর্তা করছি। সঙ্গে লেবুর রস। কচু ভর্তার সঙ্গে লেবুর রস আর গরম ভাত৷ খাবে নাকি?”

কচুর ভর্তা আইটেমের নাম শুনেই আয়নার খাওয়ার ক্রেভিংস হলো। এতোদিনে এই প্রথম তার খাওয়ার খেতে ইচ্ছা জাগলো। সে চোখ উজ্জ্বল করে তাকালো। সত্যি বলতে তার এই টাইপ খাওয়ার খেতেই মন চাচ্ছিলো। কিন্তু বাসার কেউ বুঝছিলোই না। সবাই চিকেন, বার্গার, পিজ্জা, রামেন এনে দিচ্ছিলো, যেগুলো দেখলেই ওর বমি পায়। সে দ্রুত হেটে রান্নাঘরে চলে যায়। নিজেই ভাত বেড়ে কচুর ভর্তা দিয়ে খাওয়া শুরু করলো৷ আসলেই তো! গরম ভাত আর কচুর ভর্তা, ভাতের উপর লেবুর রস কচলিয়ে খেতে এতো মজাব।সে অনেকদিন পর আরাম করে পুরো এক প্লেট ভাত খেলো। এক বাটি কচুর ভর্তা সে একাই শেষ করলো। এতো ক্ষুধা ছিলো পেটে সে কল্পনাও করেনি।
শায়লা পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিলো। আয়নার খাওয়া শেষ হতেই উনি বলে উঠে, ” একবার ডাক্তার দেখাও, আয়না। তোমার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে, ইউ আর সিক।”

আয়না একবার ওনার দিকে তাকালো। শায়লা চৌধুরী বলে উঠে, ” সাইক্রিয়েসিস্ট দেখাতে চাইলে সেটাও দেখাও।”
আয়না ভ্রু কুচকে তাকালো ওনার দিকে এরপর বলে, ” সাইক্রিয়াসিস্ট কেনো দেখাবো?”
শায়লা একটু চমকে উঠে বলে, ” আমরা তো আর ছোট না। বয়সের সঙ্গে অভিজ্ঞতাও আছে। সবটাই বুঝছি, দেখছি। তোমার আর সমুদ্রের মধ্যে সমস্যা চলছে। প্রবলেম সলভ করার চেষ্টাও নেই তোমাদের মধ্যে।কেমন সব ধোঁয়াশার মধ্যে রাখছো। অনির্দিষ্ট সবটা। কিছু ক্লিয়ারও করছো না। রোদেলা ভাবীও চিন্তায় অতিষ্ঠ। তোমাদের দু’জনের চিন্তায় সবার ঘুম হারাম হচ্ছে। তুমি সম্পর্কের টানপোড়নটা সামলাতে পারছো না। ইউ নিড মেন্টাল পিস।”
আয়না বলে, ” বাবাও চিন্তা করছে নাকি?”

–” হ্যাঁ। তোমার বাবা তো সরাসরি সমুদ্রের সঙ্গে বসতে চাচ্ছে। সমুদ্রের উপর রেগেও আছে মনে হয়। তোমার আব্বু সমুদ্রের সঙ্গে বসলে, ওকে প্রচুর কথা শোনাবে। এজন্য, আমি বারং করছি তোমার আব্বুকে। বারবার বলছি, ওরা ছোট মানুষ। দু’জনই একটু খামখেয়ালি। বাড়ির বড় সন্তান। রাগ-জেদ বেশি৷ এডজাস্ট করতে একটু টাইম লাগবে। তোমাদের মধ্যে ম্যাচুরিটিও কম। সংসার বুঝো কম। আয়না, পারসোনালি আমরা কেউ তোমাদের মধ্যে ইন্টারফেয়ার করতে চাই না।”

আয়না উঠে দাঁড়াতে চাইলে মাথা যেন ঘুরে উঠে। মুহুর্তের মধ্যে সব ঘোলা লাগে। দু’দণ্ড পর আজ কয়েকদিনের ব্যবধানে ফের হড়বড় করে বমি করে দেয়। বেশ ক্লান্ত লাগে ওর। ডাইনিংরুমে বসেই শায়লাকে বলে, ” আমি একটু পর বের হবো।”
–” এই অবস্থাতে।” ( বেশ হতভম্ব হয়ে উনি জিজ্ঞাসা করলেন।)
–” হাসপাতালেই যাবো।”

নীল রঙের মতো রঙিন বিকেল৷ আকাশে ধূসর মেঘের আধিপত্য আজ যেন চড়া। স্বচ্ছ, নির্মল মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে আকাশে। প্রকৃতি ঘিরে বিশুদ্ধ বাতাস সঙ্গে আর্দ্রতার ছোয়া। নির্বিশেষে আজকের আবহাওয়া আর প্রাকৃতিক রুপ স্মৃতির মানসপটে আটকে রাখার ন্যায় অধিকতর সুন্দর। আলো ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। সন্ধ্যা নামতে আর বেশি দেরি নেই৷ অস্ট্রেলিয়ার বিকেলের সময়টা বেশ সুন্দর। আজ সমুদ্রের সেমিনারের শেষ দিন ছিলো। সে অর্গানাইজার কমিটি লিডার হয়েছিলো। এমনকি সেমিনারের বেস্ট পার্ফমারও সে। অনেক স্টুডেন্টকে টপকে বেস্ট এর এওয়ার্ড জিতে নিয়েছিলো। বিভিন্ন দেশের বড় বড় ডাক্তার- প্রোফেসারের সঙ্গে সবাই মিলে ফটোশুটেও করেছে। মজার বিষয় হলো কম্পিটিশনে ইউশাও ছিলো। হ্যাঁ! ইউশা। ইউশাকে তার সঙ্গে সিলেক্ট করেছে৷ ইউশাকে রেজাল্টের জন্য মনে হয় সিলেক্ট করেছিল। সমুদ্রের জানা ছিলো না, সেমিনারে তাদের মেডিকেল কলেজ থেকে ইউশাও জয়েন করছে।যদিও বা সেমিনারে ওর সাথে সাক্ষাৎ হলেও সমুদ্র রাস্তা পরিবর্তন করত। তাদের মাঝে কথা-বার্তা হয়নি।

তার দৃষ্টি সামনের রোডের দিকে। পরিষ্কার ফকফকা পিচঢালা রাস্তার ধারে বেশ যত্ন নিয়ে একটা অচেনা গাছ উঁকি মারছে। আজকে বাসার জন্য শপিংয়ে যাবে৷ এখন সে একদম ফ্রি। এ’কয়েকদিন দম ফেলবারও সময় ছিলো না। আজ মনমতো শপিং করে নিবে। তার ফেরার কথা আরোও পনের দিন পর কিন্তু চেষ্টায় আছে দ্রত রিটার্ন টিকিটে ফিরে যাওয়ার। জরিমানা দিয়ে হলেও। এম্বাসিতে তার এক ফ্রেন্ড আছে, তাকেও বলে রেখেছে আবার অনলাইনেও আপডেট রাখছে। এখানে আর মন টিকছে না। একটা দিনও অতিরিক্ত থাকতে ইচ্ছা করছে না। আয়নাকে দেখার জন্য অস্থির লাগছে। বাসা থেকেও অনবরত মা ফোন দিয়ে ঝারি মারছে।

প্রথম দিকে কেউ বুঝতে পারেনি তাদের সম্পর্কের অস্বাভাবিকতা কিন্তু সমুদ্রকে সি অফ করতেও আয়না এলো না আবার, শ্বশুরবাড়িও একবারও যায় নি। আবার পিউয়ের মুখে শুনেছে ও নাকি ভার্সিটির হলে উঠে যাচ্ছিলো৷ পরে ওর বাবা আর আলিয়া বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ওদের বাসায় ফেরত এনেছে৷ মেয়েটার এমন পাগলামো ওকে আরোও মরিয়া করে তুলছে। সে ফোঁস করে দম নেয়। কবে ফিরবে সে আয়নার কাছে? আয়নাকে দায়িত্ব ভাবা উচিত হয়নি তার। দায়িত্ব তে একদা তিক্ততা আসে। মানুষ হাপিয়ে যায়। বোঝা ভাবা শুরু করে। যেমনটা সে ভাবছিল। আয়নার কোনোকিছুরই দাম ছিলো না তার কাছে। বিয়ের পর পর কয়েকদিন ও সুন্দর করে সেজে তার জন্য অপেক্ষা করত। কিন্তু সমুদ্র লেইটে আসত। কখনো শুধুমাত্র প্রাকৃতিক আদিম নিয়মের তাড়নায় কাছাকাছি যেতো বা ওকে রেখেই ঘুমিয়ে যেতো। আয়না অবশ্য অভিযোগ করতো না। তবে, আয়না নিশ্চয়ই কারো জন্য বোঝা হওয়া ডিজার্ভ করে না। সি ডিজার্ভস মাচ্ বেটার।

বিশাল বড় শপিংমলে নিজের জন্য একজোড়া এডিডাসের জুতা ছাড়া আর কিছুই কিনলো না। এরপর সোজা লেডিস জোনে চলে যায়৷ হরেক রকম মেয়েলি জিনিস দেখে কনফিউজড হয়ে যায় সে। কি কিনবে আয়নার জন্য? ওর কী পছন্দ ভাবতে গিয়ে খানিক চমকে। আসলে সমুদ্র জানেই না আয়না কি পছন্দ করে। কোন জিনিস নিলে ও খুশি হবে। আরেক দফা নিজের প্রতি ধিক্কার জানালো সে। জামা-কাপড়ের কর্ণার এ গেলে সেলসম্যান জিজ্ঞেস করে, ” কেমন ড্রেস লাগবে? কার জন্য নিচ্ছো? উনি দেখতে কেমন? তাহলে হেল্প করবো।”

গটগট ইংলিশে সমুদ্রকে জিজ্ঞেস করলো।
সমুদ্র বলে, ” আমার ওয়াইফের জন্য কিনবো। ও দেখতে খুব সুন্দর। সব রকম ড্রেসেই ওকে মানাবে।”
সেলসম্যান সুন্দর কয়েকটা টপস সাজেশন দিলো। সেগুলো কিনে ও হেঁটে হেঁটে আনমনে কিডস জোনে যায়। কিডস জোনের পাশে খেলার কৃত্রিম সুবিধা আছে। অনেক বাচ্চাকেও দেখা গেলো বাবা-মায়ের সঙ্গে এসেছে। একটা বেবি ওর মায়ের কোল থেকে পাপা পাপা করে ওর বাবাকে ডাকছে।
পাপা ডাক শোনামাত্র সমুদ্রের মধ্যে কেমন অদ্ভুত একটা অনুভূতি জাগ্রত হয়। ইশ বেবিটার মা-বাবা কতো লাকি! এটাই তো জাগতিক নিয়ম। একসময় সবারই বাবা হতে ইচ্ছা জাগবে। ওই বাচ্চার বাবা কতো হ্যাপি। বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে কতো আদর করছে।

কিডস জোন সম্পূর্ণ টা বাচ্চাদের টয়স আর কাপড় দিয়ে ভর্তি। তার চোখ গেলো সুন্দর একটা লাল গেঞ্জির উপর। ওটা কেনার লোভ সামলাতে পারলো না। আনমনে কিনে ফেলে জামাটা। শপিং শেষে খাওয়া বাইরেই সারলো। খাওয়ার সময় ওর ফ্রেন্ড ম্যাসেজে দিয়ে জানালো অস্ট্রেলিয়া টু বাংলাদেশ। ট্রান্সজিট চীনে হবে, আগামীকাল বিকেলের একটা ফ্লাইটের টিকিট পাওয়া গেছে। বাট ইকোনমি ক্লাস এর। ডাবল পেমেন্ট করতে হবে। সমুদ্র জীবনেও বিসনেজ ক্লাস ছাড়া ফ্লাই করে না। সেই সমুদ্র বাড়তি টাকা খরচ করে ইকোনমি ক্লাসে যেতে রাজী হয় কেবল দ্রুত বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে।

আয়না বসে আছে গাইনোকোলজি ডিপার্টমেন্টের চেম্বারে। ডক্টর সোনিয়া বেগমের রুমে। সমুদ্র যেই হাসপাতালে জব করেছিল, সেখানেই এসেছে সে। ম্যাডাম খুটে-খুটে আয়মার কাছ থেকে ডিটেইলসে হিস্ট্রি শুনছে। চোখে মোটা পাওয়ারের চশমা লাগানো। ভদ্রমহিলার বয়স পঞ্চাশের বেশি হবে। যখন শুনলো তাদের হাসপাতালের একজন ডক্টরের ওয়াইফ আয়না। তখন নাম জানতে চাইলো।
আয়না নাম বলতেই উনি দু’মিনিট ভেবে বলে উঠে, ” ওহ আচ্ছা। ডক্টর সমুদ্র। জুনিয়র ডক্টর তো চিনতে দেরি হলো। নীল চোখ ওর মনে পড়েছে।”
ডক্টরের ওয়াইফ শুনে সে আরোও কিছু প্রশ্ন করে বলে, ” কেমন ডক্টরের বউ তুমি! হ্যাঁ? পনের-বিশ ধরে অসুস্থ। আমার কাছে আগে আসো নি কেন?”
আয়নার থেকে বয়সে বড় হওয়ায় ধমকের সুরেই কথাগুলো বলে উঠে এরপর একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলে, ” যাও, এক্ষুনি টেস্ট করিয়ে,এক ঘণ্টা পর রিপোর্ট নিয়ে আমার কাছে আসবে৷”

–” কিসের টেস্ট ডক্টর?”
–” কিসের আবার? প্রেগ্ন্যাসির টেস্ট দিয়েছি।”
আয়না হতভম্ব হয়ে যায়। আসলেই সে প্রেগন্যান্ট! কিভাবে সম্ভব। তার তো কিছু অসুখ আছে। ট্রিটমেন্ট ছাড়া কিভাবে প্রেগন্যান্ট হলো সে? তবে কিছু বললো না ডক্টরকে। এগিয়ে গিয়ে কাউন্টার থেকে বিল পরিশোধ করে টেস্ট করতে যায়। তারপর ওয়েটিং রুমে বসে অপেক্ষায় থাকে। অপেক্ষা করতে করতে হুট করে শরীর খারাপ লাগে তার। একঘন্টা অপেক্ষায় থেকে সে কাহিল হয়ে পড়ে। রিপোর্ট নিয়ে ডক্টরের চেম্বারে গেলে উনি আগেই জিজ্ঞেস করলো, ” তোমার তো শরীর খারাপ। সঙ্গে কেউ আসেনি?”

–” না।”
–” সমুদ্র কোথায়?”
–” দেশে নেই।”
–” তাই বলে একা আসবে নাকি! বাসার কাউকে কল দিয়ে আসতে বলো।”
তখনই আয়নার ফোনে শায়লা চৌধুরীর কল আসে। ডক্টর সোনিয়া বেগম আয়নার অনুমতি নিয়েই শায়লাকে হসপিটালে আসতে বলে। আয়নার খুব টেনশন হচ্ছিলো না জানি রিপোর্টে কি এসেছে। সে মা হতে চলেছে? অনুভূতি আটকে রাখতে না পেরে দু’চোখ ভরে আসতে ধরে তার।
সোনিয়া ম্যাডাম কোথায় জানি গেলেন, রুগী এসেছে জন্য কেবিন ছেড়ে ওয়ার্ডে গেল। ফিরে এসে দেখে শায়লা চৌধুরী পৌঁছে গেছে। আয়নার পাশে দাঁড়িয়ে আছে৷ ডক্টর সোনিয়া বেগম নিজের কেবিনেই থাকতে বলেছিল আয়নাকে৷ রিপোর্টও দেখেনি আয়নার। এখন দেখবেন৷ ইমার্জেন্সি ছিলো জন্য যেতে হয়েছিল তখন৷
শায়লা চৌধুরীকে দেখে জিজ্ঞেস করে, ” পেশেন্ট এর কে হন আপনি? ”

শায়লা একবার আয়নার দিকে চেয়ে থেকে বলে, ” আমি আয়নার স্টেপ মাদার৷”
সোনিয়া বেগম রিপোর্ট একবার দেখেই হেসে বলে, ” কংগ্রাচুলেশনস, আয়না। ইউ আর প্রেগন্যান্ট।”
আয়নার বাক্যটা শোনামাত্র চোখে আনন্দের জল চলে এলো৷ ওর নিজের পেটে হাত বুলিয়ে দেয়৷
শায়লা ওকে জড়িয়ে ধরে বলে, ” আলহামদুলিল্লাহ খুবই খুশির সংবাদ।”
আয়না নিজেও মুহুর্তের মধ্যে সব বিষাদ ঝেড়ে ফেলে দেয়। ক্ষণেই কিছু একটা চিন্তা করে বলে, ” কিন্তু আমি তো কিছুই বুঝতে পারি নি। কীভাবে সম্ভব।”
সোনিয়া বেগম বলেন, ” প্রথমবার কনসিভ করেছো তো তাই সিমটমস গুলো বুঝো নি।”
আয়না জিজ্ঞেস করেই ফেলে, ” আমার তো সমস্যা আছে। পিসিওএস আমার।”
সোনিয়া বেগম বলেন, ” পিসিওএস হলেই যে তুমি বন্ধা এটা ভুল ধারণা। আগে ডাক্তার দেখিয়েছো? বিয়ের আগে বা পরে?”

আয়না জবাব দিলো ও বিয়ের আগে থেকেই প্রোপার ট্রিটমেন্ট নিত। কয়েক কেজি ওজনও কমিয়েছিলো।
সোনিয়া বেগম বলেন, ” তুমি লাকি যে কনসিভ করতে ঝামেলা হয় নি৷ কিন্তু অনেকেরই কনসিভ করতে সমস্যা হচ্ছে। তুমি রেস্টে থাকবে। সাবধানে থাকবে।”
উনি ঔষধ লিখে দিলেন আবার সাতদিন পর আসতে বললেন আর এরমধ্যে অসুবিধা ফিল করলে যেকোনো সময় যেন চলে আসে। এবং পইপই করে এক্সট্রা সাবধান আর কেয়ারে থাকতে বলে দিলেন৷
শায়লা চৌধুরী বের হয়েই একগাদা মিষ্টি কিনলেন। বাসায় ফিরে আয়নাকে রেস্ট নিতে বলে, উনি হাল্কা খাবার আনতে যান।

উনি যখন নুডুলস রান্না করছিলেন, আয়না রান্নাঘরে আসে। তা দেখে বলে উঠে, ” তুমি রান্নাঘরে কেন? কি খাবে বল? তোমার আব্বুকে কল দিয়ে এখুনি আসতে বলো।”
আয়না থমথমে গলায় বলে, ” একটা রিকুয়েষ্ট ছিলো।”
–” কি?”
–” আপনি এখনি সবাইকে নিউজটা দিয়েন না। এমন কি বাবাকেও না।”
শায়লা চোখ বড় করব তাকিয়ে বলে উঠে, ” কি বলছো এসব?”
আয়নার মুখের প্রতিক্রিয়া বদলে যায়, বাদনখানি জুড়ে বিষন্নতার ছায়া ফুটে উঠে। কেঁদে ফেলে বলে, ” সমুদ্র এখুনি বাচ্চা চাচ্ছিলো না৷ বাচ্চা পছন্দও করে না।ওর জন্য নিশ্চয়ই আমার বাবু এক্সিডেন্টাল ইস্যু। ওর জন্য আমরা খুশির নই বরং আগাছা।”

শায়লা বলে, ” এভাবে বলো না আয়ু। সমুদ্র তো ফ্যামিলি পার্সন। ও ঠিক খুশি হবে শুনে৷”
আয়না মাথা ঝাকিয়ে বলে, ” উহু। ওনাকে আমি চিনি। উনি মোটেও খুশি হবে না।”
শায়লা বলে উঠে, ” এতোবড় খুশির সংবাদ হাইড করবে?”
–” উনি দেশে ফিরলে সরাসরি জানাবো। ততোদিন গোপন রাখতে চাই।”
–” তুমি এবার্শনের চিন্তা মাথায় আনছো নাতো?”
আয়না নিজের পেটে হাত রেখে বললো, ” না৷ আমি এতো অসহায় মা নই। উনি বাচ্চার দায়িত্ব না নিলেও আমার কিছু যায়-আসে না। উনি বাচ্চার রেসপনসেবলিটি না নিলে, আমার বাচ্চার জন্য আমি একাই ইনাফ। আমার বাচ্চা অসহায় না৷ ওর মা ইঞ্জিনিয়ার। ওকে সিকিউর লাইফ দেওয়ার সামর্থ্য আছে আমার।”
–” আমার মনে হয় তুমি বেশি ওভার থিং করছো। রেস্ট নেও। ঠিকমতো খাও। আর হাসি-খুশি থাকো। সমুদ্র আসলে দেখবে আমরা সেলিব্রেশন করবো।”

আয়না কোমল গলায় বলে, ” বাবাকে এখুনি বলবেন না, প্লিজ।”
–” তোমার বাবা যদি জানে আমি এতোবড় খুশির সংবাদ লুকিয়েছি আমার উপর খুব রাগ করবে। তাছাড়া তোমার এক্সট্রা যত্ন দরকার। ”
–” বাবার সঙ্গে আমি কথা বলবো পরে। নিজের যত্নও নিজেই নিবো।”
রাতের বেলা ও মেডিসিন ঠিকমতো নিলো। ডাক্তার বলছিল আরোও আগে থেকেই আন্ডার কনসালট্যান্ট এ থাকা উচিত ছিলো। প্রেগ্ন্যাসি কনফার্ম হতে একটু দেরি করে ফেলেছে। সেদিন রাত আটটাতেই ঘুমিয়ে যায় ও। প্রোপার গাইডলাইন মানা শুরু করে দেয় ও।আর হেলাফেলা করা যাবে না৷
শায়লা চৌধুরী সমুদ্রকে ফোন করে জানতে পারলেন সমুদ্র আগামীকাল ফ্লাইট ধরবে আর আয়নাকে না জানাতে। ওকে নাকি সারপ্রাইজ দিবে। শায়লা চৌধুরী ভাবে দু’দিনেরই তো ব্যাপার। কিছু হবে না৷ দুই’ দিন পর সবাই তো জানবেই আয়নার প্রেগ্ন্যাসির বিষয়টি।

পরদিন যথারীতি সবাই অফিসের জন্য বের হবে। ফাহাদ সাহেব নাস্তা কর‍তে বসলেন। আয়নাও এলো। অল্প একটু খাওয়া-দাওয়া করলো। আজকে ওকে হাসি-খুশি দেখাচ্ছে। ফাহাদ সাহেব আয়নাকে ডাইনিং টেবিলে খেতে দেখে খুব খুশি হন। আলিয়ার এক্সাম চলছে। এজন্য ব্যস্ত একটু। ও বোনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়। শায়লা চৌধুরী দুপুরে আসবে এটা বলে সবাই যে যার মতো অফিসে চলে গেলো।

বারোটার পর থেকে আয়নার মনে হলো ওর প্রেশার আপ-ডাউন করছে। মাথা ভার লাগছে। সে বেডে শুয়ে ফোন হাতে নেয়। ফেসবুক স্ক্রল করতে করতে নজর এলো সমুদ্রকে ট্যাগ করে এক ডক্টর ছবি পোস্ট দিয়েছে৷ ওদের সেমিনারের ছবি গুলো। সমুদ্রের পাশে সাদা শার্ট পরে ইউশা দাঁড়ানো। ছবিটা দেখামাত্র আয়নার যেন দুনিয়া এলোমেলো হয়ে যায়। সেমিনারে ইউশাও আছে! বাহ কি দারুণ মানিয়েছে দু’জনকে। একদম পার্ফেক্ট কাপল যেন!
ও যেন চোখে আঁধার দেখে। সমুদ্রর সঙ্গে গতকাল থেকে ফোনে কথা হয়নি।

তবে কি সমুদ্র? সে ভাবতে পারেনা এর বেশি। পেটে প্রচুর চাপ অনুভব করে। ভাবে ওয়াশরুম যেতে হবে। বেড থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পা বাড়াবে এমন সময় কি হলো জানে না সে, কেবল বুঝলো, খুব কষ্ট হচ্ছে তার। মুখ-চোখ উলটে আসে। চিৎকার দিয়ে উঠে। ফাঁকা বাসায় কেউ তার ডাকে সাড়া দেয় না। সে হাঁটার শক্তি পায় না। কোনো কিছু ধরার চেষ্টা করে কিন্তু আশেপাশে কোনো আসবাবপত্র বা দেয়াল না থাকায় সে পা পিছলে পরে যায়। সাদা ফ্লোর ক্ষণেই লাল রাঙ্গা হয়ে ফুটে উঠে। টকটকে লাল। লাল রক্ত দেখেই তার মুখ রক্ত শূন্য হয়ে পরে। ব্যথায় কুকরে উঠে সে। চোখ দিয়ে টপাটপ পানি গড়াতে থাকে।

ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ৩৫

আয়না সেন্স হারাতে থাকে। দূর থেকে মনে হয় কেউ খুব সুন্দর ভয়েজে বলে উঠে, ” আম্মু।”
কণ্ঠস্বরটা যার ও বুঝি জীবনে বেদনার স্বাদ পায় নি। বেদনার স্বাদ পাবে কীভাবে? মাতৃগর্ভ আর জান্নাতে কোনো দুঃখ থাকে না। দুঃখ কেবল পৃথিবীর উপাদান।

ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ৩৭