ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ৪৫

ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ৪৫
Arishan Nur

মানুষ কতোটা আহাম্মক, বলদ আর গাঁধা হলে,একটা কাল্পনিক চরিত্রের অস্তিত্ব খুঁজতে সত্যি সত্যি পরের স্টেশনে ঠিক রাত বারোটা বাজতে দশ মিনিট আগে, ট্রেন থামলে, ট্রেন থেকে ঝাপ দিয়ে নামে? সমুদ্র এই কাজটাই করে। প্লাটফর্মে যাত্রীর আনাগোনা খুব কম। এমনকি ট্রেন থেকে গুটি ক’জন নেমেছে। সমুদ্র আয়নাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ” কী ভয় পাচ্ছো নাকি? আসো, আসো। ভয়ের কিছু নাই। সন্ধ্যামালতি ঘাড় ম টকায় না। সি ইজ প্রিটি। প্রিটি ঘোস্ট!”
আয়না বলে, ” আমি আপনার মতো ষ্টুপিড না!”

সমুদ্র সরু দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে, ” ওসব কিছু না। তুমি ভয় পাচ্ছো জন্য আসতে চাও না। আমার মতো সাহসী হলে ঠিকই নেমে পড়তে আর সন্ধ্যামালতি কে খুঁজতে আসতে। আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি তুমি নামবে না। কারণ তুমি ভীতুর ডিম। তার চেয়ে বরং ট্রেনের কেবিনে ফিরে যাও। একা ভয় পেয়ে কান্নাকাটি করবে।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আয়না চোখ বড় করে চোখ রাঙ্গালো তার দিকে, করে জেদ মাথায় চাপলো, এরপর ট্রেন থেকে নামে। ট্রেন থেকে নামতেই ঠাণ্ডায় হাত জমে আসে। বাপরে এতো শীত পড়লো কীভাবে! সে হাতে হাত ঘঁষে সামনের দিকে পা বাড়ায়। সমুদ্র একটু এগিয়েই গেছে কীনা, তার আসলেই ভয় লাগতে শুরু করে। স্টেশন একপ্রকার নির্জন। দু-তিনজন কেবল। কেমন গা ছমছমে রহস্যময়তায় ঘেরা। তবে মনের মধ্যে অন্যরকম এক এডভ্যাঞ্জার অনুভূতি আসে। নিজেকে হারিয়ে যাওয়া নাবিক মনে হচ্ছে! ইন্টারেস্টিং বটে। সে এগিয়ে সমুদ্রের সঙ্গে পা ফেলে। সমুদ্র তাকে দেখে নিজের কালো জ্যাকেট খুলে দিলো। আয়নার গরম কাপড়ের দরকার ছিলো। বিনাবাক্য সেটা নিয়ে নেয়। জ্যাকেট গায়ে জড়াতেই পরিচিত মানুষটার গায়ের গন্ধ নাকে ভাসে৷ আয়নার কাছে মানুষটার গায়ের গন্ধও কত্তো পরিচিত কিন্তু মানুষটা? মানুষ টা কী তার পরিচিত?

সমুদ্র জ্যাকেট খুলে দেওয়ায় উম্মুক হলো তার পাতলা শার্ট যার দরুন ওর নিজের বেশ শীত-শীত লাগে। আয়না অবশ্য একবিন্দু মায়া দেখায় না। ভুলেও জ্যাকেটটা ফেরত দিল না।
হাঁটতে হাঁটতে আনমনে সমুদ্র গান ধরায়। খালি গলায় গায়,
“ধীরে ধীরে যাও না সময়
আরও ধীর বও
আরেকটুক্ষণ রও না সময়
একটু পরে যাও”

ওর গান শুনতে শুনতে হাঁটতে বেশ উপভোগ করে আয়না। কেমন অদ্ভুত এক অনুভূতি। রাত বারোটায় করুন কণ্ঠে গান ওর বুকে তোলপাড় তুলে দেয়৷
পুরা প্লাটফর্ম চক্কর মেরে একদম শেষ প্রান্তে গিয়ে থেমে যায় তারা।দু’জনেই কিঞ্চিৎ হাপাচ্ছে। এদিকে একদম মানুষ নেই। পুরাটা জায়গা ধুধু নির্জন।
সমুদ্র মন খারাপের কণ্ঠে বলে, ” নাহ! সন্ধ্যামালতির দেখা পেলাম না। ভেবেছিলাম আজকে ওর সাথে দেখা হবেই। স্যাড!”
আয়না কর্কশ গলায় বলে, ” মেয়ে দেখার সুযোগ পেলে হুশ থাকে না তাই না ?”

সমুদ্র চোখ বড় করে বলে, ” মাই গড, তুমি দেখি ভূতের উপরও জেলাস। কাম অন, সি ইজ জাস্ট এ ঘোস্ট।”
আয়না মুখ ফিরিয়ে নেয়, ওইসময় মনে হলো কারো ছায়া প্লাটফর্মের মোজাইক করা ফ্লোর থেকে সরে গেলো। কোনো নারীমূর্তি ছিল বলে মনে হচ্ছে আয়নার। হঠাৎ ভয় ঝেকে ধরে। গায়ে হীম ধরা ভয় খেলে যায়৷ ও চোখ বড় বড় করে ঢোক গিললো। এমন সময় দূর থেকে হুক্কাহুয়া শব্দ ভেসে আসে। এর পরপর-ই কেমন করুন সুরে কারো কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে৷ আয়না পিলে চমকে উঠে বলে, ” সমুদ্র, আমার মনে হয় এই জায়গাটা ভালো না। নিশ্চয়ই খারাপ কিছু আছে।”

তখনই দূর থেকে কেমন কাদো গলায় ছোট্ট বাচ্চার কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে। আয়না পারলে সমুদ্রের গায়ে ঢুকে যায় ভয়ে। কাদো কাদো মুখে বলে, ” নিশ্চয়ই সন্ধ্যামালতি এসেছে। কেনো এসব বাজে কথা মুখে আনেন? এখন সত্যি হলো না?”
–” খাইসে রে! এখন কী হবে আয়ু? সন্ধ্যামালতি যদি সামনে আসে কেমনে সামলাবো ওরে?”
আয়না ভয়ার্ত চোখে তাকাতেই সমুদ্র হোহো করে হেসে ওর মাথায় চাটি মেরে বলে, ” কুকুরের কান্নায় আওয়াজও চিনো না!”
আয়না যেনো জানে পানি ফিরে পেলো। স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো ও৷ এমন সময় ট্রেনের হুইশেল বেজে উঠে বিকট শব্দে। শব্দের তোপ এতো জোরে ছিলো যে স্টেশনের শেষ মাথা অব্দি কানে বাজে৷ সমুদ্র চোখ বড় করে বলে, ” ওহ শীট! নো!”

এরপর দুইজন একে অপরের দিকে তাকালো এরপর সমুদ্র কোনো চিন্তাভাবনা না করেই আয়নাকে কোলে তুলে নিলো। এরপরে দেয় এক দৌঁড়। দিক-বেদিক ভুলে সমানে দৌড় লাগায়। অবশেষে ট্রেন চলতে শুরু করার দশ সেকেন্ড আগে ট্রেনে। আর সামান্য দেরি হলে ট্রেন মিস যেত। আয়নাকে কোল থেকে নামিয়ে ও হাপাতে থাকে। টিটি এসে সমুদ্রের উপর চটে এক প্রকার ঝারি মেরে বললো, ” মাইয়া মানুষ নিয়ে বের হইসেন। সময়ের আক্কেল-জ্ঞান রাখে চলবেন না?”
–” সর‍্যি ভাই।”

ভদ্রলোক বিরক্ত মুখে সামনের দিকে অগ্রসর হয়। সমুদ্র একটু হেঁটে কোথা থেকে এক বোতল পানি এনে নিজে ঢকঢক করে খেয়ে আয়নাকে সাধলো। আয়নাত ও পিপাসায় গলা ফেটে যাচ্ছিলো। সে এক চুমুকে পানি পান করে সমুদ্রের দিকে তাকায়। ওই নীলচে চোখের মণির দিকে তাকালেই মায়া লাগে৷ বুক ভার লাগে! ভালোবাসার মরুভূমিতে আটকা যেতে মন চায়। পরক্ষণেক মরিচীকা নামক ভয়াবহ বস্তু আঘাত হানে! যদি সবটা মরিচীকা হয়? ওর এই কেয়ার, ভালোবাসা সব মিথ্যা হলে? দ্বিতীয়বার পারলে আয়না সব ধাক্কা সামলাতে? উহু পারবে না!
–” আয়ু?”

সমুদ্রের মুখে ‘আয়ু’ নামটা শুনে কেমন মিশ্র অনুভূতি হতো। আগে আকারে-ইঙ্গিতে কতো বুঝিয়েছিলো তাকে আয়না না ডেকে আদর করে আয়ু ডাকতে কিন্তু জনাব যেন বুঝতে-ই চাইতো না।
–” সিদ্ধ ডিম খাবা? ট্রেনে সিদ্ধ ডিম খেতে দারুণ মজা লাগে।”
আয়না সমস্ত চিন্তার অবসান ঘটিয়ে ওর পানে তাকায়। দুজনের মধ্যে নিরবে বোঝাপড়া চলে৷ চোখের ভাষা পড়ার চেষ্টা চলে। একটা সময় পর সমুদ্র মোলায়েম কণ্ঠে বলে, ” আরেকবার সুযোগ দিতে খুব চাপ যাবে? দেওয়া যায় না? ওয়ান মোর চান্স!”

আয়না নিরব থেকে ট্রেনের সঙ্গে সঙ্গে যাওয়া চাঁদের পানে তাকিয়ে থাকে। সমুদ্র বুঝে ওর নিরবতায় ভীষণ রকমের অভিমান লুকিয়ে আছে৷ ক্ষোভ আছে! তবে কী রাগ,জেদ, ক্ষোভ জয়ী হবে? তাদের ম্যারিড লাইফ পরাজয় মানবে? পরাজিত হলে যদি ও সুখে থাকে, হার-ই সই! সমুদ্র বড় আশা নিয়ে তাকিয়ে থাকে। নিজের মনের সঙ্গে নিজেই কথা বলে।

আয়না অনেকক্ষণ থম মেরে চুপ থাকার পর বলে, ” আপনার দেওয়া ইফোর্ট দেখতে চাই আমি। সমুদ্র, ভরসা আর বিশ্বাস অর্জন করতে হয়। আমি দ্বিতীয়বার যে আপনার প্রয়োজন হবো না, আমাকে প্রিয়জন ভাববেন– আমাকে এই ভরসা আপনাকে দিতে হবে। যতোক্ষণ অব্দি আমি আপনার থেকে এমন কোনো আশার বাণী পাচ্ছি না৷ ততোক্ষণ অব্দি আপনার সঙ্গে ফিরবো না। স্ত্রী হিসেবে অবহেলা মেনে চলছিলাম হাজার কষ্ট হলেও, কিন্তু আমার সন্তান যেন ভবিষ্যতে কোনো অবহেলা না পায় এটার ইনশিওরিটি আপনাকে দিতে হবে।”
আয়না বলা কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনে সমুদ্র। উত্তরে কেবল বলে, ” আমি তোমাকে নিরাশ করবো না। দেখবে, আমাদের সুখের সংসার হবে।”

আয়না সমুদ্রের দিকে তাকালো। ওর চোখ ছলছল করছে। নিশ্চয়ই মিসক্যারেজের কথা স্মরণ করে কান্না আসছে।
সমুদ্র ওর দিকে মোহগ্রস্ত চাউনিতে তাকিয়ে বলে, ” ভালোবাসায় নাকি প্রমাণ দেওয়া যায় না, তবে আমি অনুভব করাবো, আমি আসলেই আমার স্ত্রীকে খুব ভালোবাসি।”
দুজনেও কিয়ৎক্ষণ চুপ থাকে, সমুদ্র পরিবেশ হাল্কা করার জন্য বলে, ” ডিম সিদ্ধ আনি। ওয়েট।”
এরপর হেঁটে কোথা থেকে একটা কাগজে করে সাদা ডিম সিদ্ধ আনে। সঙ্গে লবণ-মরিচ। নিজে এক কামড় বসিয়ে আয়নার মুখে তুলে ধরে। আয়না ভেবেছিল খেতে খুব একটা আহামরি কিছু না, কিন্তু কামড় দেওয়ার পর মনে হচ্ছিলো বেশ মজার।

রাত সাড়ে বারোটার পর দুজনে ফিরে যায় কেবিনের দিকে। কেবিনের সামনে আসতেই রঙ্গন-পিউকে দেখা গেলো। পিউ ভাইয়াকে দেখে সামান্য ঘাবড়ে যায় তবে হাসি মুখ করে বলে ” তোমাদের খোঁজার জন্য-ই বেরিয়েছি। পথিমধ্যে রঙ্গনের সঙ্গে দেখা। দুজন মিলে আলাপ করছিলাম তোমরা কোথায় থাকতে পারো।”
সমুদ্র তেমন সন্দেহ করে না। আয়নাকে কেবিনের সীট্র বসিয়ে দিয়ে চলে যায়। আয়নার খুব ঘুম পাচ্ছিলো। ওদিকে, আলিয়া, পিউ আর রুশা কি মুভি দেখছে আর হাসছে। মুভির সাউন্ড কানে বাজছে বেজায়৷ সে ঘুমিয়ে পড়ে। চোখ খোলা রাখতে পারে না।
কিছুক্ষণ ফিরে এসে সমুদ্র দেখে আয়না ঘুমে৷ ও ফিসফিস করে বলে, ” তোমরা আমার সীটে গিয়ে মুভি দেখো। যাও।শব্দ করো না।”

ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ৪৪

ওরা তিনজন চলে গেলো। চিপস সাথে নিয়ে৷ সমুদ্র আয়নার পাশে বসার পর আয়না একটু নড়ে হাওয়ায় কাঁধ বেকিয়ে মাথা কোথাও রাখতে চাইলে, সমুদ্র নিজের বাহু এগিয়ে দিয়ে ওকে আরাম দেয়। আয়না ঘুমের ঘোর সমুদ্রের বাহুকে বালিশ ভেবে বেশ আদুরে ভঙ্গিমায় ঘুমিয়ে থাকে৷ সমুদ্র মুচকি হেসে বলে, ” আই উইল বি ইউর পারসোনাল পিলো (pillow) , হোয়েনেভার ইউ নিড টু স্লিপ।”

ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ৪৬