ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ৬

ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ৬
Arishan Nur

সমুদ্র রুমে এসে ক্লান্ত শরীরে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। সারাদিন সবার সামনে স্বাভাবিক থাকলেও একদম মনের কোনো ক্ষুদ্রাংশেতে হলেও সে ভালো নেই৷ মনের কোথায় জানি খুব সূক্ষ্ম কিন্তু তীব্র একটা বেদনা অনুভব হয়৷ এই বেদনার কথা কাউকে বলতেও পারে না আর। তার অনুভূতি, মন সব যেন জড়পদার্থের ন্যায় হয়ে গেছে৷ মাঝেমধ্যে মনে হয়, মানুষ না হয়ে টেবিল-চেয়ার হলে ভালো হতো। নো ফিলিংস, নো ইমোশন।

সে সিগারেট ধরালো। রুমে একা থাকলে, কাজ না থাকলে সে বারান্দায় সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়েই সময় পার করে। একাকীত্বকে উপলব্ধি করে। একাকীত্বেরও একটা ভিন্ন ব্যথাতুর সুর-তাল আছে৷ সে যতোই হেলথ্ কনসার্ণ হয়ে স্যুগার, রেড মিট খাওয়া বাদ দিক, কিন্তু সিগারেট ছাড়ে না। ডায়বেটিস কন্ট্রোলে রাখার জন্য চিনি বাদ দিচ্ছে, ওন দ্যা আদার হ্যান্ড, মন কন্ট্রোলে রাখার জন্য ভালোবাসা বাদ দেওয়া লাগছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সিগারেটের প্যাকেট থেকে চতুর্থ সিগারেট বের করে সময় দেখলো। পৌ’নে একটা বেজে যাচ্ছে। ঘুম দরকার তার। গতকাল কেবল সাড়ে চার ঘন্টা ঘুমিয়েছে৷ কিন্তু সে জানে বিছানায় শুলে ঘুম আসবে না। সিগারেট খেতে খেতে রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইল। সে ভাবলো, ফুসফুস জ্বালানোর ব্যবস্থা আছে, কিন্তু হৃদয় জ্বালানোর কোনো ব্যবস্থা নেই কেন? আচ্ছা, ফুসফুস তো হৃদপিণ্ডের খুব কাছের সঙ্গী। কোনো ভাবে কী ফুসফুস জ্বলতে জ্বলতে হৃদয়ে দহন জ্বালাতে পারে কি?

সে আকাশের দিকে তাকিয়ে, জ্বলন্ত সিগারেট হাতে রেখে করুণ গলায় গায়,
“সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে
সেই আমি কেন তোমাকে দুঃখ দিলেম
কেমন করে এত অচেনা হলে তুমি
কীভাবে এত বদলে গেছি এই আমি। ”

আচানক মস্তিষ্কের সেরিব্রাম থেকে রেফারেন্স মেমোরি বেশ কিছু মিষ্টি স্মৃতির স্মরণ করিয়ে দেয়। সে ক্রমশ শান্ত হয়ে যায়। ভেতরটায় অশান্ত স্রোত আঁছড়ে পড়ছে। হুট করে হাতে গরম কিছু অনুভব হওয়ায়, তার হুঁশ আসে, দ্রুত হাত থেকে সিগারেট ফেলে দেয়। এরপর ব্যথায় জ্বলতে থাকা হাত দিয়েই মোবাইল ফোন বের করে গ্যালারিতে যায়। গ্যালারির বিশেষ ফাংশনে একটা মাত্র ছবি রাখা ছিলো। একটা মেয়ের ছবি। মেয়েটার মুখে খুব স্নিগ্ধ একটা হাসি। তার পাশেই সমুদ্র গিটার ধরে বসে আছে।

সমুদ্রের দৃষ্টি মেয়েটার দিকে আর মেয়েটা হাসছে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে। কোমল, তরতাজা বাতাসে মেয়েটার সিল্কি চুল এসে হামি খাচ্ছে সমুদ্রের চোখে-মুখে, তবুও সমুদ্রের চোখে বিরক্তি নেই, আছে কেবল এক গুচ্ছ মুগ্ধতা! কি জীবন্ত ছবিটা! মনে হচ্ছে, এইতো! এই ছবি তোলার সময়টা মাত্র ঘটলো। আচ্ছা, সময়ের কী পুনরাবৃত্তি ঘটে? যদি ঘটে থাকে, তবে আবারও এই সময়টায় ফিরে যেতে চায়। প্রকৃতি কী পারবে এ সময়টায়, এ দিনটায় তাকে ফেরত পাঠিয়ে সময় থামিয়ে দিতে? সামান্য হাসলো সে। এতো ছেলে মানুষী ভাবনা ভাবলে কীভাবে জগত-সংসার চলবে?

সে রুমে ফিরে আসে। আজকেও একবার চেষ্টা করলো ছবিটা ডিলিট করার কিন্তু এতো সুন্দর ছবিটা ডিলিট দিতে বুক কাঁপে তার। ডিলিট দিলেই হারিয়ে যাবে! এরচেয়ে বরং মস্তিষ্কের সেরিব্রামের ধারনকৃত স্মৃতি নিপাক যাক। সে আস্তে করে বলে, ” প্রিয় স্মৃতিরা, তোমরা হারিয়ে যাও কোনো এক অতলে। ধ্বংস হও প্লিজ!”
ঘুম ঘুম চোখে শুতেই ভীষণ মাথাব্যথা অনুভব হয় তার৷ দুদিন বাদে তার বিয়ে। সম্পূর্ণ নতুন এক জীবনে যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছে। এই রুমে, তার উপর, তার জীবনে, অন্যকেউ আধিপত্য স্থাপন করবে! সবটা তার ইচ্ছেতেই হচ্ছে। জীবন থামিয়ে রাখতে চায় না সে। চলমান এ মানবজীবনে আর দশটা মানুষের মতো বাঁচতে চায়। অথচ চোখ বুজলে আজোও অন্য কারো কথা মনে পড়ে। হায় রে জীবন! কাউকে ভুলে যাওয়া কখনো-সখনো খুব কঠিন ব্যাপার! কারোও জন্য আবার খুব সহজ!

পরদিন সকালবেলা একদম আলো ফোটার পর সমুদ্রের ঘুম ভাঙ্গে। ক্লান্তির কারণে গভীর ঘুম হয়েছিলো। বেশ ফ্রেশ লাগছে এখন। ফোন হাতে নিতেই অফিশিয়াল সব ম্যাসেজ, ইমেইল নোটিফিকেশন পেল সে। আজকে বিয়ের আগে লাস্ট ডে অফিসে। কালকে শুধু দুপুরে ক্লাইন্টের সঙ্গে বিশেষ মোলাকাত আছে। ওটা কাজের কিছু নয় বরং বিনোদনের জন্য আমন্ত্রিত সময়সূচি। বেডে শুয়েই আয়নাকে ইমেইল ও ম্যাসেজ করে আজকে ছুটি দিয়ে দিলো সে। বিয়ের আগে আর অফিস আসার দরকার নেই ওর। তবে ইমেইলের শেষভাগে লিখে দিলো, খুব কাজ করতে মন চাইলে যেন অনলাইনে কাজ করে ও। এরপর রুম ছেড়ে বের হয়। ড্রয়িং রুমেই আম্মুকে পাওয়া গেল। নিউজপেপার পড়ছেন সে।
সমুদ্র মায়ের কাছে যেয়ে বলে, ” গুড মর্নিং আম্মু।”

–” গুড মর্নিং। নাস্তা দিবো?”
–” দেও। আব্বু কেমন আছে?”
–” ভালো। তোমার বাবার শরীর ভালো । গত দুইদিন ধরে ঠিকঠাক খাচ্ছেও।”
সমুদ্রের মনটা কিছুটা হলেও ভালো হলো। নাস্তা খেতে খেতে সে বলে উঠে, ” আজকে অফিসের সব কাজ সেড়ে ফিরব। একটু লেইট হবে। প্লিজ জলদি বাসায় আসার জন্য জোড়াজুড়ি করো না।”
–” আচ্ছা। কিন্তু একবার আয়নার সঙ্গে শপিং এ যেতে হবে। ”
–” কেন? অনলাইনেই তো সব সিলেকশন করলো।”
–” না, ব্রাইডাল শাড়িটা ডিরেক গিয়ে কিনবে। একঘন্টার মধ্যে ব্লাউজ ওরাই বানিয়ে দিবে। বিকেলের দিকে ওকে নিয়ে যাবি। বনানীতেই শোরুম। ”
–” আচ্ছা।”

সমুদ্র আর কথা বাড়ায় না। বিয়ে করার সিদ্ধান্ত যখন নিয়েছেই সবপ্রকার কাজেই তাকে অংশগ্রহণ করতে হবে। ছোট করে দম ফেললো সে। সে ভাবেও নি আসলেই তার বিয়ে হয়ে যাবে এতো দ্রুত৷ ছয় মাস আগেও বাবার বিজনেজ পার্টনারের বড়লোকের সুন্দরী মেয়ের সাথে বিয়ের কথা চলছিলো। ওখানেও কথা আগাচ্ছিলো বেশ দ্রুত গতিতে। কিছু আনুষ্ঠানিকভাবে ঘটার আগেই সমুদ্র মেয়েটার একটা স্ক্যান্ডালের প্রমান পায়। তারপর মেয়েটাকে ভীষণ রকম অপমান করে৷ মেয়ের বাবা তার বাবার সঙ্গে খুব ঝামেলাও করছিলো। এতে বিন্দুমাত্র চিন্তা ছিলো না সমুদ্রের। কিন্তু এই ঘটনার পরপর বাবার হার্ট এটাক হলো। তখন থেকে সব বদলে যেতে শুরু করে।

আম্মু বাবার অসুস্থতায় ভীষণ ভেঙে পড়লো। বাসার পরিবেশ বদলে গেলো। বাবার অপারেশন করতে হয়েছিলো। অপারেশন এ কোনো প্রকার সমস্যা হয় নি। সাকসেসফুলি সব হয়েছে। বাবাকে হাসপাতাল থেকে যেদিন বাসায় আনা হলো সমুদ্র সবচেয়ে খুশি ছিলো। সেদিন রাতে বাবা তাকে অফিসের সবকিছু হ্যান্ডওভার করে দেয়। বেশ কিছু কাগজ-পত্র হাতে তুলে দেয়। ওইসময় সমুদ্রের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। সে মেডিকেলে পড়েছে। ঢাকায় ব্যাক করার পর প্রাইভেট একটা হসপিটালে কাজ করছে।

সে কিভাবে ব্যবসা সামলাবে? কিন্তু তার বাবা নাকি আপাতত অফিসে বসবেন না। তার রেস্ট দরকার। হাপিয়ে উঠেছেন সে। এখন কিছুদিন বাসায় পরিবারকে সময় দিতে চান। সমুদ্র ছোটবেলা থেকে বাবাকে সারাদিন কাজ করে যেতেই দেখেছে। তিলে তিলে নিজের হাতে গড়া ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানটার মালিক তার বাবা। বাবার পাশে থেকে তার মাও সবধরনের সহযোগিতা করে এসেছে৷ দুইজন মিলেই এতোদিন ব্যবসা সামলে এসেছে। যার দরুন ঢাকা শহরে তারা রাজার হালে বসবাস করছে। অভাব কাকে বলে সেটা চোখে দেখেনি। কিন্তু বাবা যখন অবসরে চলে গেলো, তার মাও অফিস যাওয়া বাদ দিলেন।

মা ভীষণ স্বামীভক্ত মহিলা। স্বামী অসুস্থ এমতাবস্থায় সে অফিস যাবে না। স্বামীর সঙ্গেই থাকবেন বলে জানান দিলো। সমুদ্র বুঝলো তার মা-বাবা অবসর চাচ্ছেন। ওদিকে তাদের বিজনেজ পার্টনারের সঙ্গেও রিলেশন ভালো নেই। অফিস গিয়ে তদারকি না করলে কে জানে, দুইদিন পর ওরা বিশ্বাসঘাতকতা করবে না? এটার কোনো গ্যারান্টি নেই। না পারতে সমুদ্র ব্যবসার হাল ধরতে রাজী হয়। ওইদিন প্রায় ছ’বছর পর তার বাবা তাকে অনুরোধের স্বরে নিজ থেকে কিছু কথা বলে। একটা বিশেষ কারণে তাদের পিতা-পুত্রের সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। আজোও সম্পর্কের সমীকরণে কোনো উন্নতি আসেনি।

বাবা নিজ থেকে কথা বলেছে তার সঙ্গে এতেই সমুদ্র আবেগে আপ্লূত হয়ে যায়। নইলে কোনোদিন এতো প্যারাদায়ক ব্যবসা সামলাতে রাজী হতো না। সেদিনই বাবা তাকে সাফ বলে দেয়, এ বাসায় থাকলে হলে দ্রুত বিয়ে করে সেটেল হতে হবে। মাও ভীষণ জোড়াজুড়ি করে যেন সমুদ্র আর কখনো বিয়ে নিয়ে ঝামেলা না করে। তখন কেবল বাবার অসুস্থতার কথা ভেবে বলে দিয়েছিলো, এক প্রকার ওয়াদা করেছিলো, বিয়ে করতে রাজী সে। তার বাবা-মা নেক্সটে যে মেয়েই পছন্দ করবে, তাকে বিয়ে করবে। তবে আকদ করবে আগে পারিবারিকভাবে। প্রথমেই ঘটা করে কিছু করতে ইচ্ছুক নয় সে। আগে পারিবারিকভাবে বিয়ে করে রাখবে। বাইরের কেউ এ ব্যাপারে জানবে না। পরে সময়মতো বউ বাড়িতে আনবে। বড় অনুষ্ঠান হলে হবে পরবর্তীতে। কে জানত? বাবা অসুস্থ থাকলেও তার কোন পরিচিত ভার্সিটির ফ্রেন্ডের মেয়ের সাথে বিয়ে পাকা করে ফেলবে,তাও এতো দ্রুত। সমুদ্রের সব শর্তেই মেয়ে পক্ষ রাজী।

সবই ভাগ্য! নিয়তিতে তার সঙ্গে আয়না আছে এজন্য এতো ঝড়-ঝাপটা চললেও ওর সাথেই বিয়ে হচ্ছে।
যে ভাগ্যে থাকে, তাকে এমনই সহজ ভাবে প্রাপ্তিস্বরুপ পাওন চায়, আর যারে চাই, সে যদি ভাগ্যে না থাকে, তাহলে সারা দুনিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ করলেও পাওন যাইব না।
অফিসে আজ বেশ কিছু মিটিং করেছে সে। কয়েকবার আয়নার ডেস্কেও চোখ গেলো। ওর ডেস্ক ফাঁকা। সমুদ্র লাঞ্চ ব্রেকের আগে অনলাইন মিটিং এ বসলো। তার আগে শিডিউল দেখে নেয়। বিকেলের দিকে বের হতে হবে। এর আগেই কাজ সব গুছিয়ে রাখতে হবে।

আয়নার আজ দেরি করে ঘুম ভাঙ্গে। এগারোটার পর উঠে সে। হুট করে অনেক ঘুম কোথা থেকে ভর করেছে চোখে। সে ঘুম থেকে উঠেই ফোন হাতে নেয়। সমুদ্র তাকে সাড়ে ছয়টায় হোয়াটসঅ্যাপে একটা ম্যাসেজ দিয়েছে আর ছয়টা পয়ত্রিশ এ একটা অফিশিয়াল ইমেইল দিয়েছে। সে ম্যাসেজ খুলতেই অবাক হলো। গুড মর্নিং উইশ করেছে তাকে। এই প্রথমবার কোনো ছেলে তাকে সকালে গুড মর্নিং উইশ করলো। তার মন ভালো হয়ে যায়। সে হেসে দিলো। আবার আফসোস হলো কেন এতো বেলা করে উঠে গুড মর্নিংটা হারিয়ে ফেললো! ইমেইল খুলে দেখলো, তাকে ছুটি দিয়ে দিয়েছে। আজ ছুটি না দিলেও সে যেত না। পরক্ষণেই তাকে বেশ চিন্তিত হতে দেখা গেলো। সে মনে মনে ভাবে, সমুদ্রের কাছ থেকে বিষয়টা লুকানো কি ঠিক হচ্ছে? ওর তো আয়নার ব্যাপারে সবটা জানার অধিকার আছে! কি করবে সে? জানিয়ে দিবে সবটা?

আয়না ফ্রেশ হয়ে রুম ছেড়ে বের হতেই মিলি দৌঁড়ে এলো, তার পায়ের কাছে ঘেঁষে দাঁড়ালো। সে মিলিকে গুড মর্নিং বললো। উত্তরে মিলি লেজ নাড়িয়ে মিউমিউ বলে। এরপর দাদা-দাদি, আলিয়া এমনকি হালিমা বুয়াকেও সে এই বেলা এগারোটায় গুড মর্নিং উইশ করে৷ আলিয়া তখন কনফ্লেক্স খাচ্ছিলো। সে এই প্রথম আপাকে সকাল বেলা উঠে এতো খুশি দেখলো। ওর আবার কি হলো? সবাইকে গুড মর্নিং বলছে। এমন আচরণ আজই প্রথম। সে আমলে নেয় না, বরং নিজের আপাকে দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আপাকে আজ অন্যরকম সুন্দরী লাগছে।
হামিলা বুয়া পরোটা আর সবজি তুলে নিয়ে বললো, ” আপামনি আপনারে একদম ঝাক্কাস রূপবতী লাগছে৷ আপনার বিয়ের ফুল ফুটে গেছে তবে!”

আয়না বলে উঠে, ” বিয়ের ফুল কীভাবে ফুটে হামিলা খালা?”
হালিমা বুয়া বেশ জ্ঞানী ভাব ধরে বলে, ” প্রত্যকটা মেয়েরই জন্মের সময় ভাগ্য নির্ধারণ করা থাকে। নির্ধারিত মানুষটা জীবনে আসলে, ভাগ্যফুল ফুটে। তখন মেয়েদের রুপ বেড়ে যায়। আপামনি, আজকে আপনারও ভাগ্যফুল ফুটছে। এজন্য দেখেন কী সুন্দর লাগছে আপনারে৷ কারো নজর না লাগুক। ”
আয়না সামান্য হাসলো। গতকাল সে আর আলিয়া পার্লার থেকে ফেশিয়াল করে এসেছে। এজন্য বুঝি ফর্সা ফর্সা লাগছে৷ নাকি আসলেই সমুদ্রের জন্য তার ভাগ্যফুল ফুটেছে?
সে লাঞ্চ ব্রেকে কল লাগায় সমুদ্রকে। প্রথমবার ধরলো না। দ্বিতীয়বার সমুদ্র কল ধরে একটু লো ভয়েজে বলে, ” হ্যাঁ আয়না বলো। কিছু বলবে?”

–” হু।”
তখন ফোনের ভেতর থেকে আয়না অন্য মানুষের আওয়াজ পেল। সমুদ্র বলে, ” মিটিং এ আছি। অফিশিয়াল কিছু বলবে? ”
–” না।”
–” ব্যক্তিগত কিছু? ”
–” হু।”

সমুদ্র লো ভয়েজে বলে উঠে, ” তাহলে বিবি সাহেবার পারসোনাল স্পেস লাগবে তাই তো? সেজন্য একটু অপেক্ষা করুন৷ আমি চারটার মধ্যে তোমার বাসার সামনে আসবো। তারপর শপিং এ যাব।”
আয়নার কেমন শিহরণ বয়ে যায়। সমুদ্র এতো সুইট ভাবে কথা বলতে পারে? তার বিশ্বাস ই হচ্ছে না । সে কল কেটে দিলো। তারপর প্রায় দু’ঘন্টা ধরে সাজুগুজু করলো। গোলাপি রঙের একটা সালোয়ার কামিজ পড়ে নেয়।
সত্যি সাড়ে চারটার মধ্যে সমুদ্র তার বাসার নিচে এসে উপস্থিত হয়। আয়না গ্যারেজে নেমে, গিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ে। সমুদ্র সোজা বনানীর উদ্দেশ্য ছু’টে৷
গাড়িতেই সমুদ্র বলে উঠে, ” কিছু বলার ছিলো নাকি?”

–” হ্যাঁ।”
–” বলো?”
–” আমি আসলে আপনার থেকে কিছু হাইড করতে চাই না।”
–” বয়ফ্রেন্ড আছে নাকি? থাকলে মিট করায় দাও। ট্রিট নেই জামাই-ইন-ল থেকে।”
আয়না বিষ্ফোরিত চোখে তার দিকে তাকায়। কারো হবু স্বামী এ বিষয়টা এতো সহজ ভাবে নিবে বলে মনে হয় না তার৷
সমুদ্র গাড়ি চালাতে চালাতে বললো,” কি হলো? কি ভাবছো? বয়ফ্রেন্ড আবার আবেগে হাত কেটে ফেলেছে নাকি?”
আয়না বুঝলো নিশ্চয়ই মজা নিচ্ছে ও। কিন্তু আয়না মন খারাপ করে মাথা নিচু করে ফেলে৷
সমুদ্র যেন এবারে সিরিয়াস হলো। সে বলে উঠে, ” কি হয়েছে?”

–” আসলে….
–” আসলে-নকলে যা বলার বলে ফেলো। নকলেই কী প্রেমিক আছে কোনো?”
–” সমুদ্র! ”
সমুদ্র একটু হতভম্ব হলো। এই প্রথম মেয়েটা তাকে তার নাম ধরে ডাকলো। নিজের নামটা তার এমনিতেই খুব পছন্দ। আজকে আরোও বেশি পছন্দ হওয়ার একটা কারণ পেলো৷
সে বলে, ” বলো।”
–” আমার একটা অসুখ আছে।”
–” সবারই অসুখ থাকে। অসুখ আছে জন্য ই আমরা ডাক্তারি পড়ি।”
–” কিন্তু অসুখটার জন্য ভবিষ্যতে ইমপ্যাক্ট পড়লে?”
–” পড়লে পড়বে।”
–” উফ, আপনি বুঝছেন না কিছুই।”

সমুদ্র গাড়ি থামিয়ে পার্ক করলো রোডের এক সাইডে। এরপর বলে, ” অসুস্থতা নিয়ে এতো আপসেট হচ্ছো কেন?”
আয়না মাথা নিচু করে বলে উঠে, ” আমার পিসিওএস (PCOS) এর সমস্যা আছে। যদি আমি কখনো মা না হতে পারি? তখন তো আপনাকে ঠকানো হবে। এজন্য আপসেট হচ্ছি। আমি চাই না, আমার অসুখ লুকিয়ে আপনার সঙ্গে প্রতারণা করতে।”

সমুদ্র তাকে অবলোকন করলো দুবার। তবে কিছু বললো না। আয়না তাকে চুপ থাকতে দেখে বেশ ভয় পায়, আবার হতাশাও কাজ করে। কেন যে তার এই সমস্যা দেখা দিলো? আর বাকি মেয়েদের মতো স্বাভাবিক হলে কি সমস্যা হতো?
সে হতাশাগ্রস্ত গলায় বলে, ” আপনি চাইলে বিয়ে ভেঙে দিতে পারেন। আমি আপত্তি করবো না।”
সমুদ্র এবারে বলে উঠে, ” রোগ-বালাইয়ের ক্ষেত্রে ডাক্তারের চেয়ে শিক্ষক বেশি পণ্ডিতি করলে তো মুশকিল। ”
আয়না তার কথা কিছুই বুঝে না। তাও সুধালো, ” আপনি এই অসুখ সম্পর্কে জানেন নিশ্চয়ই? ”

–” তোমার চেয়ে ভালো জানি।”
এরপর আয়নাকে অবাক করে দিয়ে সমুদ্র খুব সুন্দর একটা হাসি উপহার দিয়ে বলে, ” অসুস্থতার জন্য গিল্ট ফিল করছো কেন? অসুস্থতা সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত৷ কারো হাতে কিছু করার নেই। তবে সৃষ্টিকর্তা মানুষের উছিলাতেই অসুস্থতার আরোগ্য লাভ করার সমাধান দিয়েছেন। আমরা ডাক্তাররা তো আছিই সমাধান দেওয়ার জন্য। তাছাড়া পিসিওএস খুব কমন একটা রোগ। সারা বিশ্বেই এই সমস্যা ফেস করছে মেয়েরা। প্রোপার ট্রিটমেন্ট, হেলথি লাইফস্টাইল অনুসরণ করলে অসুবিধা সেড়ে যায়।”

–” আপনার তাহলে আমার অসুখ নিয়ে কোনো সমস্যা নেই?”
–” অসুখ নিয়ে সমস্যা থাকলে ডাক্তারি কেন পড়তাম?”
আয়না সামান্য হাসলো। সে বেশ রিলিফ ফিল করে। এখন আর কোনো চিন্তা নেই তার৷
সমুদ্র বলে উঠে, ” নামো। শোরুম সামনেই।”
আয়না গাড়ি থেকে নেমে শোরুমে ঢূকে পড়ে৷ গতকাল রাতে সমুদ্রের রেফারেন্স অনুযায়ী একটা লাল গোল্ডেন পাড়ের কাতান শাড়িই সিলেক্ট করে রাখা হয়েছিলো।
সেলসম্যান সমুদ্রের সামনেই আয়নাকে জিজ্ঞেস করলো, ” ম্যাম, আপনার ব্লাউজ ফিটিংস এর জন্য কোন সাইজ ব্যবহার করবো?”
আয়নার তখন ভীষণ লজ্জা লাগলো। আস্তে করে করে,” মিডিয়াম।”

–” ওকে। আধা ঘন্টা অপেক্ষা করুন ম্যাম।”
আধা ঘণ্টা কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না তারা।এজন্য আয়না দোকানের বাকি কালেকশন দেখতে থাকে। তার চোখ গিয়ে আটকে একটা সেমি ব্রাইডাল খয়েরী লেহেঙ্গার দিকে। তার ইচ্ছা ছিলো পাকিস্তানি ব্রাইডদের মতো লেহেঙ্গা পড়ার কিন্তু তার আগেই সমুদ্র শাড়ি পড়তে বললো। অবশ্য সমুদ্রের ইচ্ছা অনুযায়ী বিয়ের দিন সাজবে এতেই খুশি সে।
সেলসম্যান আয়নার মনোভাব বুঝি ধরে ফেলে। সে বললো, ” ম্যাম, এই লেহেঙ্গাটা আমাদের বেস্ট কালেকশন। আপনি চাইলে দেখতে পারেন।”
সমুদ্র পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। আয়না দ্রুত বলে, ” না। না। দরকার নেই।”
–” আপনাকে খুব মানাবে ম্যাম। ট্রায়াল দিয়ে দেখেন৷”
–” না। না। লাগবে না।”
তখন সমুদ্র বললো, ” ট্রায়াল দিয়ে দেখো।”

সেলসম্যানকে আর পায় কে? সঙ্গে সঙ্গে লেহেঙ্গা আয়নার হাতে দিয়ে দিলো। ট্রায়াল রুমের পথ ও দেখিয়ে দেয়৷
শোরুমটায় ব্রাইডাল,সেমি-ব্রাইডাল কালেকশন থাকে। বেশ নামী-দামী ব্রান্ডের শোরুম। এখানকার সব আউটফিট বেশ এক্সপেন্সিভ। এজন্য কাস্টমারও হাতেগোনা। সমুদ্র তাকে ট্রায়াল রুমে পাঠিয়ে দিয়ে, একদম ট্রায়াল রুমের বাইরে অপেক্ষায় থাকে৷ একটু পর আয়না বের হয়ে আসলো।
সমুদ্র তখন ফোন চালাচ্ছিলো। আয়নাকে বের হতে দেখে ওর দিকে চোখ তুলে তাকালো। এরপর আস্তে করে বলে, ” মাশাল্লাহ খুব সুন্দর লাগছে তোমাকে।”
আয়না একটু উৎকন্ঠাবোধ করে। ভীষণ রকম লজ্জা লাগলো। ইদানীং কি যেন হয়েছে তার, সমুদ্র সামনে আসলেই লজ্জা লাগছে।

সমুদ্র তার সামনে এসে দাঁড়ালো। তখনই ভারী দোপাট্টাটা কাঁধ থেকে পড়ে যেতে ধরলে, খপ করে ধরে ফেলে সেটা সমুদ্র। বাহুতে পুরুষালি স্পর্শ লাগায় বেশ খানিক কেঁপে উঠে আয়না। সমুদ্র দোপাট্টা কাঁধে তুলে দিয়ে, সম্পূর্ণ ওড়না পেছন থেকে, ঘুরিয়ে এনে ডান হাতে পাড়টা গুঁজে দিলো। আয়না চোখ নিচু রেখে দাঁড়িয়ে ছিলো।
সমুদ্র বলে, ” লেহেঙ্গা পড়েই থাকবে?”
আয়না দ্রুত ট্রায়াল রুমের দিকে ছুটে দরজা লাগিয়ে দেয়। সমুদ্রের হাসি পেল বেজায়।
দু’মিনিট না যেতেই আয়না ভেতর থেকে বলে, ” আছেন আপনি? ”

–” আবার আটকে গেছো নাকি?”
–” আরে না। আসলে আই নিড হেল্প। আপনি কাউকে ডেকে আনতে পারবেন, কোনো ফিমেল স্টাফকে?”
–” দরজা খোলো।”
আয়না দরজা খুলে দিতেই সমুদ্র ট্রায়াল রুমের ভিতর ঢুকে পড়ে৷ ছোটো রুমটার দরজা অটো লেগে যেতে ধরে৷ আয়না হচকচিয়ে উঠে বলে, আপনি কেন আসলেন?”
–” হেল্প করতে।”
আয়না কিছু না বলে অসহায় মুখে তাকিয়ে থাকে। এর অর্থ হলো প্লিজ যান এখান থেকে । মুখে বলে উঠে, ” কেউ দেখলে খারাপ ভাববে।”

সমুদ্র সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে দেয়। সে আয়নার দিকে তাকায়। ট্রায়াল রুমের হলদে আলোয় ওকে আরোও বেশি সুন্দর লাগছে। মিররের দিকে তাকিয়ে ওর প্রতিবিম্ব দেখলো। হুকের সঙ্গে চুল আটকে গেছে। নিশ্চয়ই হুক থেকে চুল মুক্ত করতে পারছে না৷
সে বিড়বিড় করে বলে,” মেয়ে মানুষের এতো ঝামেলা!”
এরপর মিররের দিকে তাকিয়েই নিজের হাতটা ওর পিঠের দিকে নিয়ে গিয়ে হুক থেকে চুল মুক্ত করে দিলো। মুখে কেবল ” এক্সকিউজ মি” বলল। আয়না সঙ্গে সঙ্গে চোখ খিঁচে বন্ধ করে, নিশ্বাস এক প্রকার বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকলো। সমুদ্র কাজ শেষ করে রুম ছেড়ে বের হয়৷ আয়নাও চেঞ্জ করে ফিরে আসে। ততোক্ষণে ব্লাউজ মেকিংয়ের কাজও শেষ।
সেলসম্যান জিজ্ঞেস করলো, ” ম্যাম লেহেঙ্গা টা সঙ্গে এড করবো?”
আয়না বলে, না, লাগবে না৷ ”

সে সামনে এগিয়ে গেলো। সোফায় বসে সমুদ্রের আসার অপেক্ষা করতে থাকে।
ক্যাশ কাউন্টারে সমুদ্র দাঁড়িয়ে বলে উঠে, ” শাড়ির সঙ্গে লেহেঙ্গাটাও দিয়ে দেন।”
ক্যাশ কাউন্টারের মহিলাটা বললো, ” ম্যামকে লেহেঙ্গায় মানাবে অনেক।”
–” হ্যাঁ, এজন্য ই তো নিচ্ছি। ওর পছন্দও হয়েছে খুব।”

ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ৫

–” স্যার, আপনি ম্যামের অনেক কেয়ার করেন দেখছি। সি ইজ ভেরি লাকি।”
সমুদ্র উত্তরে কেবল মুচকি হাসে।
আয়না জানলোও না সমুদ্র শাড়ির সঙ্গে লেহেঙ্গাটাও তাকে কিনে দিয়েছে। প্যাকেট হাতে বেরিয়ে আসে দু’জনে৷

ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ৭