উত্তল তরঙ্গ পর্ব ১৫
দিশা মনি
নেহা তার নতুন কর্মস্থলে এসে কাজ শুরু করল। প্রথম দিন তার কাজের অভিজ্ঞতা যথেষ্ট সুন্দর ছিল। সহকর্মীরা সবাই তার সাথে অনেক ভালো ব্যবহার করেছে। সবার এত সুন্দর ব্যবহারে নেহা মুগ্ধ হয়। যদিও এখনো সে নিজের বসের সাথে দেখা করে নি। তবে সবার মুখে শুনেছে তার বস অনেক ভালো মানুষ। এটা শুনে নেহা স্বস্তি পেয়েছে।
আজকের কাজ শেষে তাকে তার বসের কেবিনে ডেকে পাঠালো হলো। তার বস হলেন শামিম কায়সার নামের এক মধ্যবয়সী ভদ্রলোক। যিনি নেহাকে দেখে সহাস্যে বললেন,
“তুমিই নেহা চৌধুরী?”
“জ্বি, স্যার।”
“এসো, বসো। দৃঢ়তার মুখে তোমার কথা শুনেছি। দৃঢ়তা তো একদম আমার মেয়ের মতো। ও একদিন আমাকে অনেক বড় একটা বিপদ থেকে বাচিয়েছিল। যখন আমার পরিবার আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল তখন ও আমার সঙ্গ দিয়েছিল।”
নেহা বলে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“আসলেই, দৃঢ়তা আপুর মতো মানুষ হয় না। উনি সবার এত সাহায্য করেন..আমি আমার মেয়েকেও ওনার মতো করে গড়ে তুলতে চাই। নিজের মেয়েকে একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ দিতেই তো আমার এত লড়াই।”
শামিম কায়সার খুশি হন নেহার কথা শুনে। তিনি স্নেহভরা কন্ঠে বলেন,
“তোমার জীবনে হয়তো অনেক চড়াই উতড়াই আছে সামনেও থাকবে তবে একটা কথা সবসময় মনে রাখবে। সব পরিস্থিতিতে আল্লাহর উপর ভরসা রেখে নিজের সবটুকু দিয়ে কাজ করে যাবে৷ তাহলে দেখবে একদিন তিনিই তোমাকে তোমার কাঙ্খিত মঞ্জিলে পাঠিয়ে দিবেন।”
“জ্বি, স্যার। দোয়া করবেন আমার জন্য।”
এরপর নেহার জীবন দ্রুত বদলাতে লাগল। সে নিজের সর্বোচ্চ পরিশ্রম দিয়ে নিজের ক্যারিয়ারে ফোকাস করল। পাশাপাশি নিজের মেয়েকেও যতটা পারা যায় সময় দিল। তার চোখে ছিল হাজারো স্বপ্ন। যেই স্বপ্নই তাকে ছুটে নিয়ে যাচ্ছিল এক কাঙ্খিত গন্তব্যের দিকে।
৫ বছর পর,
সময়ের স্রোতে ভেসে গেছে হাজারো স্মৃতি, দিন এবং মুহুর্ত। সূর্যকে ঘিরে ইতিমধ্যেই ৫ বার আবর্তন করে ফেলেছে সূর্য।
এই ৫ বছরের ব্যবধানে জীবনের ছন্দেও এসেছে অনেক পরিবর্তন।
নেহা আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছে। অফিসের ফর্মাল ড্রেসকোডে তাকে বেশ মানানসই লাগছে। সেদিনের সেই ভঙ্গুর মেয়েটা আজ ঘুরে দাঁড়িয়েছে মারাত্মক ইতিবাচক ভঙ্গিতে। তার দুচোখে হাজারো স্বপ্নের ঝিলিক আজো বিদ্যমান।
নেহা আয়নায় নিজেকে দেখে বলে,
“বরাবরের মতো আজকের প্রজেক্টটাও তোকে সঠিকভাবে কমপ্লিট করতে হবে নেহা। যাতে করে এই ডিলটা আমাদের কোম্পানির হাতছাড়া না হয়।”
নেহার এই ভাবনার মাঝেই হঠাৎ করে দুটো ছোট্ট হাত এসে তাকে জড়িয়ে ধরল পেছন থেকে। নেহা আলতো হেসে পিছন ফিরে তাকালো। তার মেয়ে নিয়া, ৫ বছরের এক শান্তশিষ্ট মেয়ে। তবে মায়ের ভালোবাসা পাওয়ার জন্য সে ব্যকুল! মায়ের কাছে এলে তার সব শান্তশিষ্ট ভাব হারিয়ে গিয়ে এক অবাক চাঞ্চল্য এসে ভাড় করে। নিয়া আধো আধো স্বরে বলে,
“আম্মু..জানো আজ স্কুলে কি হয়েছে?”
নেহা নিয়াকে কোলে তুলে নিয়ে বলে,
“কি হয়েছে আমার নিয়ামনির?”
নিয়া বলে,
“আজ সাদিয়া আমার টিফিন বক্স থেকে খাবার চুরি করে খেয়ে নিয়েছে। আমি এই কথা তাজিব ভাইয়াকে বলে দিয়েছি তারপর তাজিব ভাইয়া এসে সাদিয়াকে বকেছে। আর সাদিয়া ভ্যা ভ্যা করে কেঁদেছে।”
নেহা হেসে ফেলে নিজের মেয়ের কথা শুনে। আর বলে,
“বাহ, তারপর তুমি কি খেলে?”
“তাজিব ভাইয়া আমার সাথে তার টিফিন ভাগ করেছে।”
“ওহ, আচ্ছা। তাজিব ভাইয়াকে ধন্যবাদ দিয়েছ তো?”
“হুম, দিয়েছি তো। আমার প্রিয় তাজিব ভাইয়াকে ধন্যবাদ সহ একটা হামি দিয়েছে।”
“বাব্বাহ! আমার মেয়েটা তো খুব সুন্দর ধন্যবাদ দিতে শিখেছে। তুমি সাদিয়ার সাথে অকারণে ঝগড়া করো নি তো? বা ও যখন কেদেছে তখন ওকে নিয়ে মজা করো নি তো?”
নিয়া মাথা নাড়িয়ে না-বোধক ইশারা করে।
“মনে রেখো, কখনো কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করবে না। তবে কেউ যদি তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে তাকে ছাড়ও দেবে না। যোগ্য জবাব অবশ্যই দেবে।”
নিয়া আবারো মাথা নাড়ায়। নেহা বলে,
“এখন যাও, পড়তে বসো। তারপর বিকেলে তাজিব ভাইয়ার সাথে খেলতে যেও। আর হ্যাঁ, সঠিক সময় খাবারটা খেয়ে নেবে। ইচ্ছা হলে কার্টুন দেখো একটু তবে একঘন্টার বেশি টিভি স্ক্রিনের সামনে থাকবে না। নিজের পুরো ফোকাস পড়াশোনায় দাও। তোমাকে কিন্তু জীবনে অনেক ভালো কিছু করতে হবে নিয়ামনি।”
“হুম, আম্মু। তুমি দেখো একদিন আমি অনেক বড় একজন পাইলট হবো। আকাশে বিমান উড়াব।”
নেহা হেসে বলে,
“কালকেই না তুমি বললে তুমি ডাক্তার হবে। তাজিব ভাইয়াকে ইঞ্জেকশন দিবে! আজকেই আবার পাইলট হতে চাইছ।”
নিয়া কপাল চাপড়ে বলে,
“আরে আম্মু তুমি বুঝছ না, আমি তো ডাক্তারও হবো আর পাইলটও হবো।”
“হ্যাঁ, নিয়ামনি, তুমি একসাথে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পাইলট সব হয়ো।”
বলেই মেয়ের সাথে খুনশুটিতে মেতে ওঠে নেহা।
“রাগ করে না আহি বেবি! এই নুডলস টা খেয়ে নাও।”
আহিরা রেগে এবার নুডুলসের প্লেটটাই ছুড়ে মারে। নাতাশা হতাশ হয়ে তাকায় আহিরার দিকে। আহিরা রাগী স্বরে বলে,
“বললাম না, আমি নুডলস খাবো না। আমার স্যান্ডউইচ লাগবে।”
নাতাশা বলে,
“আমি তো জানতাম না তুমি স্যান্ডউইচ খাবে, এত কষ্ট করে তোমার জন্য নুডলস বানিয়েছিলাম। আর তুমি সেটা ফেলে দিলে?”
“আমার অনুমতি ছাড়া তোমায় কে নুডলস বানাতে বলেছে? আমি পাপাকে বলে দেব, তার অনুপস্থিতিতে তুমি আমার কেয়ার করছ না। তারপর বুঝবে।”
নাতাশা ভয়ে বলে,
“নাহ, আহি বেবি। এমন করে না। তুমি না গুড গার্ল। আমি এখনই তোমার জন্য স্যান্ডউইচ বানিয়ে আনছি।”
আহিরা সোফার উপর পায়ে পা তুলে বসে পড়ে। এতটুকুনি মেয়ের এত এটিটিউড দেখে নাতাশার গা জ্বলে যায় কিনে সে কিছু বলতেও পারে না। আহিরা বলে,
“যাও, ফাস্ট ফাস্ট আমার জন্য স্যান্ডউইচ নিয়ে এসো। আর হ্যাঁ, চিকেন ফ্লেভার, সাথে চিলি সস যেন থাকে। যদি খাবারে স্বাদ না হয়, তাহলে কিন্তু আবারো ফেলে দেব।”
নাতাশা দাঁতে দাঁত চেপে রান্নাঘরে যায়। তার হাসপাতালে যাবার সময়ও হয়ে এসেছে। যাওয়ার পথে আবার তাকে আহিরাকে স্কুলেও নামিয়ে দিয়ে যেতে হবে। এসব নিয়ে যারপরনাই বিরক্ত সে৷ আহির কিছু জরুরি কাজে দেশের বাইরে গেছে দুদিন হলো। আর এই দুদিনেই এই ছোট্ট মেয়েটা নাতাশার জীবন একদম বরবাদ করে দিয়েছে। নাতাশা রান্নাঘরে গিয়ে স্যান্ডউইচ বানাতে বানাতে বলে,
“দুই বাপ-বেটি মিলে আমার জীবনটা একদম জাহান্নাম বানিয়ে রেখেছে। আমি তো শুধু আহিরের জন্য এই বাচ্চা নামের আপদটাকে সহ্য করছি নাহলে তো কবেই..কেন যে এই মেয়েটাকেও আহির ত্যাগ করলো না তেমনভাবে ঐ নেহা আর ওর আরেক মেয়েকে করেছিল। যদি তা করতো তাহলে আজ আমায় এই দিন দেখতে হতো না।”
এদিকে মুমিনুল পাটোয়ারী এসে আহিরাকে কোলে দিয়ে বলে,
“কি হয়েছে আমার আহিরা দিদিভাই? এত রাগ করে আছে কেন?”
আহিরা বলে,
“উফ দাদাই, তোমাকে আর কি বলবো। নাতাশা আন্টি কিছুই পারে না। আমার মেজাজটা গরম করে দিলো। তোমার ফোনটা আমায় একটু দাও তো পাপাকে ফোন করি। দেখি পাপা কবে আসে।”
“এই নাও দিদিভাই। আমি কল দিয়ে দেব?”
“না, দাদাই। তার কোন প্রয়োজন নেই। আমি হলাম সুপারস্মার্ট। আমি নিজেই জানি কিভাবে কল করতে হয়। ”
বলে সে অতি সহজেই আহিরকে কল দিল। কিন্তু আহির ফোনটা রিসিভ করল না। আহিরা রেগে ফোনটা আছাড় মারল৷ মুমিনুল পাটোয়ারী ভয়ে বললেন,
উত্তল তরঙ্গ পর্ব ১৪
“কি হলো দিদিভাই?”
“তোমার ছেলে আমায় ইগ্নোর করছে দাদাই! আমার ফোন রিসিভ করছে না। আই কান্ট বেয়ার ইট। তোমার ছেলেকে বলে দিও, তার সাথে আমি আর কোন কথা বলব না। সে যেন প্রিন্সেস প্রিন্সেস বলে ন্যাকামো করে আমার কাছে না আসে।”
বলেই আহিরা ভীষণ রাগ দেখিয়ে নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়।