উত্তল তরঙ্গ পর্ব ২০

উত্তল তরঙ্গ পর্ব ২০
দিশা মনি

নেহা কেবিনের সামনে এসে ফাইলটা আবার ভালো করে দেখে নিয়ে কেবিনে প্রবেশ করতে যাবে এমন সময় তার দুই চোখ থমকে গেল ডান দিকের টেবিলে বসা ব্যক্তিটিকে দিকে। নেহা যেন নিজের দুই চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। সে কি ঠিক দেখছে? নেহা বলে উঠল,
“নাহ, এটা হতে পারে না। এই ভয়ানক অতীত আমার জীবনে ফিরতে পারে না।”
আহির তখনো নেহাকে দেখে নি। সে নিজের হাতে থাকা ফাইলটা একবার ভালো করে চেক করে নিচ্ছে। এরমধ্যে হঠাৎ করে খালেক ইসলাম নেহার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললেন,

“কি হলো নেহা? এভাবে দাঁড়িয়ে আছ কেন? যাও প্রেজেন্টেশনটা দাও।”
নেহা দ্রুত কেবিনের দরজা থেকে সরে এসে খালেক ইসলামকে বলল,
“আমি এই প্রেজেন্টেশনটা দিতে পারবো না। আপনি দয়া করে কিছু একটা করে ম্যানেজ করুন।”
খালেক ইসলাম অবাক স্বরে বললেন,
“এসব কি বলছ তুমি নেহা? এমনিতেই শাহরিয়ার স্যার তোমার উপর রেগে আছে তার মধ্যে যদি এই প্রেজেন্টেশনটা না করতে চাও তাহলে কোম্পানির অনেক বড় লস হয়ে যাবে। এত অল্প সময়ে তো অন্য কাউকে পাওয়াও যাবে না। এমন হলে তোমার চাকরিটা হয়তো আর থাকবে না।”
নেহা এবার উভয় সংকটে পড়ে। আহিরের মুখোমুখি সে হতে পারবে না কিন্তু এই চাকরিটাও যে তার দরকার। অনেক ভেবে নেহা খালেক ইসলামকে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“আমি প্রেজেন্টেশনটা দেব কিন্তু তার জন্য আপনায় আমার একটা সাহায্য কর‍তে হবে।”
“কি সাহায্য?”
নেহা কিছু একটা বলে৷ তার কথা শুনে খালেক ইসলাম বলেন,
“কোন ব্যাপার না, আমি দেখছি কি করা যায়।”
“ধন্যবাদ।”

আহির বারবার ঘড়িতে সময় দেখছে। এসে থেকে ১০ মিনিটের মতো তারা বসে আছে। কিন্তু প্রেজেন্টেশনের কোন প্রস্তুতি এখনো দেখতে পাচ্ছে না। শাহরিয়ারকেও কিছুটা বিরক্ত লাগছ। আহির হঠাৎ করে শাহরিয়ারকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে ওঠে,
“আমি তো শুনেছিলাম আপনি সময়ের ব্যাপারে অনেক পাংচুয়াল মিস্টার আহির। কিন্তু বাস্তবে তো ভিন্ন কিছু দেখছি।”
শাহরিয়ার অবাক ও কিছুটা রাগী স্বরে বলে ওঠে,
“মানে কি বলছেন আপনি?”
“প্রেজেন্টেশন দিতে আর কত টাইম লাগবে?”

শাহরিয়ারের ইগো হার্ট হয় কথাটা শুনে। যেই শাহরিয়ার সবসময় অন্যকে কথা শোনায় সে আজ নিজেই অন্যের কটু কথায় বিরক্ত। শাহরিয়ারের সব রাগ গিয়ে জমা হলো নেহার উপর। শাহরিয়ার চোখ বন্ধ করে বলল,
“আমি এক থেকে তিন গুনব। এরমধ্যে যদি ঐ মেয়েটা না আসে তাহলে ওকে আমি চাকরি থেকে বের করে দেব।”
“এক,,,দুই,,,,তি..”
শাহরিয়ার নিজের গণনা শেষই করতে পারে না এরইমধ্যে তার কানে আসে একটি নারীকন্ঠের শব্দ,
“উহুম..”
শাহরিয়ার চোখ খুলে সামনে তাকাতেই দেখতে পায় নেহা সমস্ত ফাইল নিয়ে এসেছে। তবে তার সাজসজ্জা অদ্ভুত। মাথায় একটা উইগ বা পরচুলা লাগিয়েছে সে! চুলটা ভীষণ অদ্ভুত। চোখেও একটা মোটা ফ্রেমের চশমা আবার ভুরুর উপর একটা নকল আঁচুল! সবথেকে বড় কথা মুখটাও সে মাক্স দিয়ে ঢেকে রেখেছে।
নেহাকে দেখেই শাহরিয়ার অস্ফুটস্বরে বলে ওঠে,

“এসবের মানে কি?”
এদিকে নেহা একবার আড়চোখে আহিরের দিকে তাকিয়ে নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। ঘৃণায় তার পুরো শরীর জ্বলে উঠল। মনে পড়ে গেল ৫ বছর আগের সেই হিংস্র দিনগুলোর কথা। নেহা নিজেকে সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে যাচ্ছিল। তাই স্বাভাবিক ভাবে প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করা শুরু করে। গলার স্বরটাও যথাসম্ভব বদলানোর চেষ্টা করল।
নেহা যখন প্রেজেন্টেশন দিচ্ছিল তখন সকলের মনযোগ ছিল নেহার দিকে। তার প্রেজেন্টেশন ছিল একদম নিখুঁত। শাহরিয়ার শুরুতে নেহার উপর রেগে থাকলেও নেহার প্রেজেন্টেশন দেখে তার চাপা রাগটা কিছুটা লোপ পেল। তার বদল চোখে একপ্রকার খুশির আমেজ দেখা গেল। নেহা আহিরের দিকে আর না তাকিয়েই প্রেজেন্টেশন দিচ্ছিল। আহির শুরুর দিকে প্রেজেন্টেশন স্বাভাবিক ভাবে নিলেও ধীরে ধীরে গলার স্বরটা কেন জানি তার কাছে ভীষণ চেনা ঠেকছিল। আহির আনমনে বলে ওঠে,

“এই গলার স্বর কি আমি আগেও কখনো শুনেছি? এত চেনা কেন লাগছে? কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব? আজই তো আমি এখানে প্রথম এলাম আর এই মহিলাকেও তো আমি চিনি না।”
আহিরের ভাবনার মাঝেই হঠাৎ করে তার সহকারী বলে ওঠে,
“স্যার, প্রেজেন্টেশন তো ভালোই লাগল৷ আপনার সিদ্ধান্ত কি? ইনফিনিক্সের সাথে কি ডিল করবেন?”
তত্মধ্যে নেহার প্রেজেন্টেশন শেষ হলো। সবাই তার প্রেজেন্টেশন দেখে এতটাই মুগ্ধ হয়ে গেল যে কড়োতালির শব্দে পুরো অফিস-রুম মেতে উঠল।
শাহরিয়ারও নিদ্বিধায় হাততালি দিলো। সবার চোখেমুখে প্রসন্নতা থাকলেও আহিরের চোখে ছিল সংশয়। নেহার দিকে অবাক চোখেই তাকিয়ে ছিল সে। এমন সময় শাহরিয়ার কায়সার বেশ ভাব নিয়ে বললেন,
“তো বলুন মিস্টার আহির পাটোয়ারী, প্রেজেন্টেশন কেমন লাগল?”
আহির নেহার থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল,

“জ্বি, সুন্দর ছিল।”
“তাহলে বলুন এবার আপনাদের নেক্সট প্ল্যান কি?”
“আমরা আপনাদের কোম্পানির সাথে কোলাবরেট করতে চাই। আমরা আশাবাদী ইনফিনিক্স ও পাটোয়ারী যদি একত্রিত হয় তাহলে আমরা সাউথ এশিয়ার একটা শীর্ষস্থানীয় কর্পোরেট কোম্পানিতে পরিণত হবো।”
শাহরিয়ার কায়সার গম্ভীর স্বরে বলেন,
“প্রস্তাবটা ভালো। তবে আমাদের আগে একটা সুন্দর ডিলে পৌঁছাতে হবে।”
এরপর তাদের মধ্যে আরো অনেক ব্যবসায়িক কথাবার্তা চলতে থাকে। এদিকে নেহা মনে মনে ভাবে,
“হায় আল্লাহ! আমায় এ কোন পরীক্ষার মধ্যে ফেললে তুমি? এখন যদি এই আহির ইনফিনিক্সের সাথে কোলাবরেট করেন তাহলে তো এখানে ওনার আসা যাওয়া লেগেই থাকবে। কোনভাবে যদি উনি আমায় দেখতে পেয়ে যান তাহলে কি হবে? তারপর যদি উনি নিয়ার ব্যাপারে জেনে ওর কোন ক্ষতি করতে চায়….নাহ, আমি এটা হতে দিতে পারি না। প্রয়োজনে ৫ বছর আগে যেভাবে নিজের মেয়েকে নিয়ে দূরে চলে এসেছিলাম সেভাবে আরো দূরে কোথাও চলে যাব। তবুও এই শয়তানটার কোন ছায়া আমি পড়তে দেব না নিজের মেয়ের উপর।”

মিটিং শেষ করে বেরিয়ে যাওয়ার সময় হুট করেই আহিরের নজর পড়ে নেহার উপর। নিজের কৌতুহল আর দমন করতে না পেরে আহির তার সামনে এসে দাঁড়ায়। আহিরকে নিজের সামনে রেগে রাগে, ঘৃণায় নেহা ফেটে পড়ে। কিন্তু কোন অনুভূতিও সে বর্তমানে ব্যক্ত করতে পারছিল না। আহিরকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিতেই হঠাৎ করে আহির বলে ওঠে,
“এক্সকিউজ মি!”
নেহা থেমে যায়। আহির নেহার পাশে এসে বলে,
“আমি কি কোনভাবে আপনাকে চিনি?”
কথাটা শুনেই নেহার হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেলো৷ তাহলে কি আহির তাকে চিনতে পেরে গেল? ভয়ের মাঝেও নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে সে বলল,

“নাহ, আমি আপনাকে এই প্রথমবার দেখলাম।”
“কিন্তু আপনার গলার স্বর আর চেহারা আমার খুব চেনা চেনা লাগছে। যদি কিছু মনে না করেন তাহলে..আমি কি আপনার মুখটা একটু দেখতে পারি?”
নেহা ভয়ে গুটিয়ে যায়। বলে,
“কেন?”
“আমার মনে হচ্ছে, আমি হয়তো আগেও আপনাকে কোথাও দেখেছি আর সেটা নিশ্চিত হতেই..”
“বললাম তো, আমি আপনাকে চিনি না। আপনিও আমায় চেনেন না। তাহলে কেন শুধু শুধু আমার চেহারা দেখতে চাচ্ছেন?”

“মাফ করবেন। আমি আপনায় বিব্রত করতে চাই নি। আমি শুধু নিজের সংশয়টা..”
“দেখুন, আমি পরপুরুষের সামনে নিজের মুখ দেখাই না। তাই এই ব্যাপারে আর কথা না বাড়ানোই ভালো।”
“এগেইন সরি, যদি আপনাকে হার্ট করে থাকি। কিন্তু আমাকে নিজের মনের সংশয় দূর করতে হবে। আর সেজন্য আমি আগে থেকেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি কারণ আমি এখন যা করতে যাচ্ছি সেটা আপনার ভালো নাও লাগতে পারে।”
“মানে? কি করতে চান আপনি?”

উত্তল তরঙ্গ পর্ব ১৯

আহির ধীরে ধীরে নেহার দিকে এগিয়ে গেলো। নেহা ভয়ে জমে গেল। নেহা কিছু বুঝে ওঠার আগেই আহির তার মাস্কের দিকে হাত বাড়ালো। নেহা দুচোখ বন্ধ করে নিলো। এই বুঝি তার সব সত্যি সামনে চলে আসে!

উত্তল তরঙ্গ পর্ব ২১