উত্তল তরঙ্গ পর্ব ৩০
দিশা মনি
নেহা নিয়াকে কোলে নিয়ে বসেছিল তার বড় আব্বু আজমাইন চৌধুরীর পাশে। আজমাইন চৌধুরী ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে ছিল নেহার দিকে। নেহা আবেগপ্রবণ স্বরে বলে,
“তুমি আবার আগের মতো সুস্থ হয়ে ওঠো বড় আব্বু। তোমার সাথে যে আমার অনেক কথা বলা বাকি আছে।”
নিয়া নেহার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলে,
“তুমি চিন্তা করো না, বড় নানা একদম আগের মতো ঠিক হয়ে যাবে। তোমাকে অনেক ভালোবাসবেন উনি। তুমি যেভাবে আমায় আদর করতেন তেমনি হয়তো উনিও কি তোমায় অনেক আদর করতেন।”
নেহা মাথা নাড়ায়। বলে,
“আমার জীবনে বড় আব্বুই ছিলেন আমার একমাত্র ভালোবাসার মানুষ, আমার অভিভাবক, আমার বাবা-মা সব।”
আরাভ বাইরে থেকে নেহাকে এভাবে কাঁদতে দেখে ভীষণ অসহায় বোধ করছিল কিন্তু তার কিছু করার ছিল না৷ আরাভ তবুও সাহস করে এগিয়ে এসে নেহার দিকে একটা টিস্যু বাড়িয়ে দিলো। নেহা সেই টিস্যুটা নিয়ে চোখের জল মুছল। আরাভ এই প্রসঙ্গে কোন কথা না বলে নেহাকে প্রশ্ন করলো,
“তুই নাকি আজকেই ফিরে যাবি?”
নেহা ইতিবাচক মাথা নাড়িয়ে বলল,
“হুম, আগামীকাল নিয়ার স্কুলে একটা প্রোগ্রামে ও অভিনয় করতে হবে৷ তাই আমাকে সেখানে যেতে হবে ওকে নিয়ে।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
নিয়াকে কোলে তুলে নেয় আরাভ। নিয়া আরাভকে বলে,
“মামা, তুমিও চলো না। আমি স্নো হোয়াইট সাজব তুমি দেখবে।”
“আমার তো এখন কিছু কাজ আছে নিয়ামনি, তাই চাইলেও যেতে পারবো না৷ তবে তুমি চিন্তা করো না, সঠিক সময় এলে আমি ঠিক তোমার সাথে দেখা করতে যাব।”
“আচ্ছা।”
দরজায় দাঁড়িয়ে দূর থেকে এই সব দৃশ্য দেখছিল রিনা। আরাভকে এভাবে নিজের কাজিন আর তার মেয়ের সাথে ঘনিষ্ঠ হতে দেখে সে যে নাখোশ সেটা তার হাবভাবেই স্পষ্ট। একটু পর বিপাসা চৌধুরী এসে রিনার কাধে হাত রাখে। রিনা ঘুরে তাকিয়ে মৃদু হাসে। বিপাসা চৌধুরী বলেন,
“তুমি এখানে কি করছ রিনা?”
রিনা নরম স্বরে বলে,
“না মানে দেখছিলাম..মিস্টার আরাভ এখানে এসেছে থেকে ওনাকে কখনো এত খুশি দেখিনি৷ আমি তো কত চেষ্টা করেছি ওনাকে একটু হাসানোর কিন্তু উনি তো সবসময় গম্ভীর থাকেন।”
বিপাসা চৌধুরী হতাশা প্রকাশ করে বলেন,
“তুমি এখন যেই আরাভকে চেনো সে আগে এমন ছিল না। আগে ও অনেক হাসিখুশি ছিল। আর ওর এই সব আনন্দের কেন্দ্রবিন্দু ছিল নেহা।”
রিনার এসব কথা শুনে একদমই ভালো লাগে না। তবুও সে জোরপূর্বক হেসে বলে,
“তখন তো উনি বোধহয় নেহাকে ভালোবাসতেন কিন্তু এখন তো পরিস্থিতি বদলেছে। নেহা এখন অন্য কারো বাচ্চার মা। এখন নিশ্চয়ই উনি শুধু নেহাকে কাজিন হিসেবেই দেখেন, তাই না?”
বিপাসা চৌধুরী কিছু বলতে পারেন না। নিজের ছেলের মনের খবর তিনি জানেন। নেহার প্রতি আরাভের অনুভূতি যে এখনো অমলিন সেটা তিনি মানেন। আগে তার এই নিয়ে রাগ হলেও এখন আর সেটা পারেন না। দীর্ঘ ৫ বছর থেকে আরাভ জীবনে একচুলও আগায় নি শুধুমাত্র নেহার কথা ভেবে। এই তো, এই রিনা নামের মেয়েটা। যেমন দেখতে সুন্দর, তেমনই তার ব্যবহার। মেয়েটা কত চেষ্টা করেছে আরাভের মন পাওয়ার অথচ আরাভ তাকে পাত্তা দেয় নি।
বিপাসা চৌধুরী তাই রিনাকে বলেন,
“তোমাকে আমি মিথ্যা আশ্বাস দিতে চাই না, রিনা। নেহার প্রতি আরাভের অনুভূতি কখনো মলিন হয়ে যায় নি আর ও নেহার স্থানও কখনো কাউকে দেয়নি আর না ভবিষ্যতে দেবে।”
বলেই তিনি সামনে এগিয়ে যান। এদিকে রিনার মনটা একদম খারাপ হয়ে যায়। পাঁচ বছর ধরে তার দেখা সব স্বপ্ন যেন মুহুর্তে ভেঙে গেল।
আরাভ নেহাকে বলল,
“তোমরা তৈরি হয়ে থেক, আমি তোমাদের বাসে তুলে দিয়ে আসব।”
“আচ্ছা।”
নেহা নিয়াকে নিয়ে আবার ঢাকায় পৌঁছে গেছে। তাদের ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায়। দুজনেই এত বেশি ক্লান্ত ছিল যে বাড়িতে ফিরেই ঘুমিয়ে পড়ে।
অতঃপর পরদিন সকালে উঠেই নেহা নিয়াকে ঘুম থেকে ডেকে তোলে। তাকে সুন্দর ভাবে তৈরি করে দেয় একদম স্নো হোয়াইট এর সাজে। নিয়া বারবার নিজেকে আয়নায় দেখে আর বলে,
“আমাকে একদম স্নো হোয়াইট এর মতো লাগছে, তাই না আম্মু?”
নেহা নিয়ার কপালে চুমু খেয়ে বলে,
“আমার নিয়ামনিকে স্নো হোয়াইট এর থেকেও বেশি সুন্দর লাগছে। কারো নজর না লাগুক।”
বলেই সে নিজের চোখের কাজল নিয়ে নিয়ার কপালে ফোটা দিয়ে দেয়। নিয়া নেহাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“আমি আজ খুব খুশি আম্মু। আজ সবাই আমার অভিনয় দেখবে। আমার জন্য ক্ল্যাপিং করবে।”
“হুম, তোমাকেও কিন্তু খুব সুন্দর করে পারফর্ম করতে হবে। তোমার স্কুলের সম্মান রক্ষা করতে হবে। ম্যামরা অনেক ভরসা করে তোমায় বাছাই করেছে। সেই ভরসা রাখবে কেমন?”
“আচ্ছা।”
আহিরা সকাল থেকে কম করে হলেও ১০ বার ড্রেস চেঞ্জ করেছে। কিন্তু একটা ড্রেসও তার পছন্দ হচ্ছে না। এরমধ্যে আহির নতুন একটা ড্রেস এনে আহিরাকে দেখিয়ে বলে,
“এই ড্রেসটা পড়ে দেখো। আমার প্রিন্সেসের জন্য এটাই বেস্ট।”
আহিরার এই ড্রেসটাও পছন্দ হয় না। সে নাক কুচকে বলে,
“আমার এটাও ভালো লাগছে না। আমার সবথেকে বেস্ট ড্রেসটা চাই। যেটা পড়লে আমাকে সবথেকে সুন্দর লাগবে।”
“তুমি তো এমনিতেই প্রিটি মাই প্রিন্সেস। তুমি যা পড়বে সেটাতেই সুন্দর লাগবে।”
এমন সময় নাতাশা একটা ড্রেস এনে আহিরার হাতে দিয়ে বলে,
“এটা পড়ে দেখো তো আহি। এটা তোমার নিশ্চয়ই ভালো লাগবে।”
আহিরা ড্রেসটা দেখে। তার মুখে খুশির ঝিলিক ফুটে ওঠে।
“হুম, তোমার পছন্দ ওতোটাও খারাপ না নাতাশা আন্টি। আমি এটাই পড়বো।”
আহিরের মুখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফুটে ওঠে। সে নাতাশাকে ধন্যবাদ জানায়। নাতাশাও হাসিমুখে বলে,
“আরে ধন্যবাদ দিতে হবে না।”
আর মনে মনে বলে,
“এভাবেই ধীরে ধীরে আহিরার মাধ্যমে আমি তোর জীবনে নিজের জায়গা তৈরি করব।”
আহিরা ড্রেসটা পড়ে তৈরি হয়ে নেয়। এরপর বলে,
“তাহলে এবার স্কুলে যাওয়া যাক!”
অতঃপর আহির ও নাতাশা আহিরাকে নিয়ে রওনা দেয়। নাতাশা একপ্রকার নিজে থেকেই যেতে চেয়েছে এই অনুষ্ঠানে। আর আহিরও কোন আপত্তি করে নি।
স্কুলে এসেই নিয়াকে নিয়ে তাদের হেড টিচার মিসেস খাতুনের কাছে যায় নেহা। কারণ সে জানতে পেরেছে নিয়াকে নাকি অভিনয় থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। এটা জেনে নিয়া খুব কান্না করছিল। নেহা হ্যাড ম্যামের কাছে বলল,
“ম্যাম, আমি কি শুনছি এসব? নিয়াকে নাকি শেষ মুহুর্তে স্নো হোয়াইটের চরিত্র থেকে বাদ দেয়া হয়েছে৷ কিন্তু আমাদের তো এসব ব্যাপারে ইনফর্ম করা হয়নি।”
তিনি কিছুটা বিরক্ত স্বরে বলেন,
“আমাদের ওকে ভালো লাগেনি তাই বাদ দিয়েছি। এই নিয়ে এত কথা বলার কি আছে?”
“ম্যাম, আপনারা চাইলে বাদ দিতেই পারেন। কিন্তু শুরুতে ওকে সিলেক্ট করে এত আশা দেখালেন মেয়েটাকে আমি এভাবে সাজিয়ে নিয়ে এলেন তারপর এভাবে হঠাৎ করে যদি ও জানতে পারে যে ওকে বিনা নোটিশে বাদ দেয়া হয়েছে তাহলে তো কষ্ট পাবেই। ও একটা বাচ্চা।”
“দেখুন, এটা একটা অনেক বড় অনুষ্ঠান। এখানে এসব ঠুনকো ইমোশনের কোন দাম নেই। আমাদের বেস্টটা প্রেজেন্ট করতে হবে।”
বলেই তিনি নেহাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে যান। এরপর নেহার স্কুলেরই আরেকজন শিক্ষক এগিয়ে এসে বলেন,”আসলে এসবকিছুই পলিটিক্স। কোন এক ধনী লোকের মেয়ে স্নো হোয়াইট হয়েছে। এমনকি তার মেয়েকে বকা দেয়ায় তো শায়লা ম্যামকে স্কুল থেকেই ছাটাই করা হয়েছে।”
এটা শুনে নেহা রেগে বলে,
উত্তল তরঙ্গ পর্ব ২৯
“ছি! বাবা-মায়ের শিক্ষা যদি এমন হয় না জানি তাদের সন্তান কেমন হবে। এভাবে সামান্য কারণে একদম শিক্ষিকাকে স্কুল থেকে বের করে দিলো। আমি দেখা করবো, ঐ অভিভাবকের সাথে যে নিজের মেয়েকে এমন জঘন্য শিক্ষা দিচ্ছে। তাকে দুটো উচিত কথা না বললে আমার শান্তি হবে না।”