উত্তল তরঙ্গ পর্ব ৩৩

উত্তল তরঙ্গ পর্ব ৩৩
দিশা মনি

নেহা সকালে উঠেই তৈরি হয়ে নিলো। আজ আবার তাকে নতুন করে চাকরির খোঁজ করার জন্য বের হতে হবে৷ নিয়ার শরীরটা আজ বেশি ভালো নেই। তাই ওকে আজ স্কুল পাঠায় নি নেহা৷ ঘরেই শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে সে। ঘুমন্ত নিয়ার কপালে চুমু খেয়ে নেহা বলে,
“তুমি চিন্তা করো না, তোমার আম্মু খুব শীঘ্রই ফিরে আসবে৷ এবার যে করেই হোক একটা চাকরির ব্যবস্থা আমায় করতেই হবে। নাহলে যে আমি বেশিদিন এই সমাজে টিকতে পারব না। তোমাকে একটা সুন্দর জীবন দেয়াই যে আমার লক্ষ্য। সেটা আমায় পূরণ করতেই হবে।”
বলেই নেহা বেরিয়ে যেতে নেয়। এমন সময় তার ফোনে খালেক হাসানের কল আসে। নেহা ফোনটা রিসিভ করে বলে,

“হ্যাঁ, খালেক ভাই। বলুন কি বলবেন।”
“আসলে তুমি কি এখন কোথাও নতুন জব নিয়েছ?”
“না, ভাই৷ এখনো কোথাও জব পাইনি। তবে ইন্টারভিউ দিচ্ছি। আশা করছি, খুব শীঘ্রই পেয়ে যাব।”
“শোনো, তোমায় আর কষ্ট করে ইন্টারভিউ দিতে হবে না।”
“কেন?”
“শাহরিয়ার স্যার তোমায় অফিসে ফিরতে বলেছেন।”
কথাটা শুনেই নেহা ক্ষেপে যায়। সে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“উনি কি ভেবেছেন নিজেকে? যখন ইচ্ছা আমায় চাকরি থেকে বহিষ্কার করবেন আবার যখন ইচ্ছা জয়েন করতে বলবেন! আমি কি ওনার হাতের পুতুল নাকি? মোটেই না, আমি ওনার হাতের পুতুল নই। আমি এসব কিছু মেনেও নেব না এত ইজিলি। আমি যখন একবার ঐ অফিস থেকে বেরিয়ে এসেছি তখন আর কখনোই ফিরব না।”
“দেখো নেহা, ইনফিনিক্সের মতো এত ভালো জব, এত স্যালারি আর সুযোগ কিন্তু তুমি অন্য কোথাও এত সহজে পাবে না।”
“আমার এসবের কোন প্রয়োজন নেই খালেক ভাই। আমি ঠিক নতুন কোন জবের ব্যবস্থা করে নেব।”
“দেখো, স্যার তোমাকে আবার প্রমোশন দিতেও রাজি আছেন।”
“আপনার স্যারকে বলে দিবেন, ওনার প্রোমোশন ওনার কাছেই রাখতে। আমি আর কোন কিছুর মূল্যেই ফিরছি না। লাউড এন্ড ক্লিয়ার।”

বলেই নেহা ফোনটা রেখে দেয়। ফোনটা এতক্ষণ স্পিকারে থাকায় শাহরিয়ার কায়সার সমস্ত কথোপকথন শুনছে। এসব যেন তার ইগোতে আরো বেশি আঘাত করে। শাহরিয়ার কায়সার হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বলে,
“আমার প্রস্তাব না করার এত সাহস ঐ মহিলার হয় কিভাবে? কি মনে করেছেন উনি নিজেকে?”
“স্যার, এখন তাহলে কি করবো।”
“ঐ নেহাকে তো আমার অফিসে আবার ফিরতেই হবে। এখন এটা শুধু আমার ব্যবসার লাভ বা লোকসানের মধ্যে আটকে নেই৷ এবার এটা আমার ইগোর ব্যাপার। ওকে আমি ফেরাবোই। তুমি আমার কথা শোনো, আমি যেভাবে বলছি সেভাবে সবটা করবে। নাহলে কিন্তু তোমারো চাকরি থাকবে না।”
“আচ্ছা, স্যার। আপনি যা বলবেন আমি তাই করবো।”
“গুড। এবার দেখি, ঐ নেহার স্পর্ধা কত। আমাকে ফিরিয়ে দেয়া..এসব কিছুর জন্য ওনাকে অনেক বড় খেসারত দিতে হবে।”

নেহা ইন্টারভিউ দিয়ে বের হলো। তার মনটা ভীষণ খুশি আজ। কারণ ইন্টারভিউ সে অনেক ভালো দিয়েছে। তার প্রশংসাও করেছে ইন্টারভিউয়াররা। নেহা অনেকটাই নিশ্চিত যে সে জবটা পেয়ে যাবে। নেহা খুশি হয়ে ভাবে,
“এবার এই জবটা পেয়ে গেলেই আমি নিশ্চিত হবো৷ সামনে কত খরচ, নেহার স্কুলের বেতন দিতে হবে, ফ্ল্যাটের ভাড়া, কারেন্ট বিল, পানির বিল…কেউই তো ছাড় দেবে না।”
নেহা হেটে হেটে যাচ্ছিল। বাড়িতে পৌঁছে যাবার পর নেহার খুশি আরো বেড়ে যায়। কারণ নিয়া অনেকটাই সুস্থ। নেহা নিজের মেয়েকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলে,
“আরে আমার নিয়ামনি তো দেখছি আগের থেকে অনেক সুস্থ। তো বলো, কি খেতে চাও তুমি নিয়ামনি?”
“আমি তোমার হাতের তৈরি নুডলস খেতে চাই আম্মু।”

“ঠিক আছে, একটু অপেক্ষা করো। আমি তোমার পছন্দের নুডলস বানিয়ে নিয়ে আসছি।”
নেহা খুশি মনে রান্নাঘরে চলে যায়। নিয়ার জন্য নুডলস তৈরি করতে থাকে সে।
আহিরা স্কুলে একা বসে আছে। আজ স্কুলে এসেছে থেকে সে নিয়াকে খুঁজে চলেছে। কারণ আহিরার মনে বারবার নিয়ার মায়ের কথা ভাসছে। আহিরা ভাবে,

“ঐ আন্টিটা কত ভালো..দুই দুই বার উনি আমাকে বাঁচিয়েছেন। ওনাকে তো আমার ধন্যবাদ জানানো উচিৎ। কাল তো ভালো ভাবে কথাও বলতে পারলাম না। তার আগেই আব্বু আমায় নিয়ে গেল।”
এসব ভাবনার মাঝেই আহিরা হঠাৎ খেয়াল করলো নিয়া ক্লাসে নেই। তারমানে আজ ও স্কুলে আসেনি৷ আহিরার মনটা খারাপ হয়ে গেল। তার মানে আজ কি সে ঐ ভালো আন্টির দেখা পাবে না? আহিরা বললো,
“ব্যাপার না, কাল আমি ওনার সাথে দেখা করে নেব।”
ভেবেই সে ক্যান্টিনের দিকে পা বাড়ালো।

রাতের দিকে নেহা যখন নিয়াকে ঘুম পাড়িয়ে নিজে কম্পিউটার অন করল তখন আরো একটা বড় খুশির খবর পেল। সে আজ যেখানে ইন্টারভিউ দিতে গেছিল সেখানে তার চাকরি হয়ে গেছে। নেহা তো খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলে,

“তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আল্লাহ। নিজের জীবনের সবথেকে বাজে পরিস্থিতিতেও আমি তোমার উপর ভরসা রেখেছিলাম, কারণ আমার মনে আছে, ছোটবেলায় আমার আম্মু আমায় বলেছিলেন, আল্লাহর উপর সবসময় ভরসা রাখতে। জীবনে যাই হয়ে যাক, কখনো নিরাশ হবে না। সৃষ্টিকর্তা সবসময় ন্যায়বিচার করেন, হয় দুনিয়ায় আর নয় তো কেয়ামতের মাঠে। আমি সেই কথায় ভরসা রেখেছি৷ তাই আমি জানি, তুমি একদিন ঐ আহিরকেও তার উচিত শাস্তি পাইয়ে দেবে৷ তুমি ছাড় দাও কিন্তু ছেড়ে দাও না।”
অতঃপর নেহা বারবার কনফার্মমেশন লেটারটা পড়ে আর এটা ভেবে স্বস্তি পায় তার একটা গতি হয়ে গেছে। আর দুশ্চিন্তায় থাকতে হবে না।

বিপাসা চৌধুরী প্রতিদিনের মতো আজকে রাতেও আজমাইন চৌধুরীর জন্য খাবার নিয়ে এসেছিলেন। খাবার এনে নিজের স্বামীর মুখের দিকে ধরে তিনি বলেন,
“এই নাও, খাবারটা খেয়ে নাও।”
আজমাইন চৌধুরী খাচ্ছিলেন না। কেমন যেন অদ্ভুত ব্যবহার করছিলেন। হঠাৎ করে তার হাত-পা অস্বাভাবিক ভাবে কাপতে শুরু করে। তাঁর এই অবস্থা দেখে বিপাসা চৌধুরী আরাভের নাম ধরে আহাজারি করে বলেন,
“আরাভ..দেখে যা তোর আব্বু কেমন জানি করছে।”
আরাভ ছুটে এসে বলে ওঠে,
“কি হয়েছে আব্বুর?”
আজমাইন চৌধুরীর অবস্থা তখন আরো বেশি খারাপের দিকে। আরাভ এবং বিপাসা চৌধুরী দুজনেই কিছু বুঝতে না পেরে কাঁদতে থাকেন। আরাভ এম্বুলেন্সে কল করে। কিছু সময় পর এম্বুলেন্স চলে আসলে আজমাইন চৌধুরীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

রাত তখন আনুমানিক ১২ টা, আচমকা নেহার ফোন বেজে ওঠে। নেহা ফোনটা রিসিভ করে। বিপরীত দিক থেকে আরাভ ক্রন্দনরত স্বরে বলে,
“নেহা..আমি তোর আরাভ ভাই বলছি। আব্বুর অবস্থা ভীষণ খারাপ। ওনাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছি। ডাক্তার কোন নিশ্চয়তা দিতে পারছেন না। আব্বু অনেকদিন পর কোমা থেকে সেরে উঠেছেন্ম বারবার শুধু তোর নাম নিচ্ছেন। ডাক্তার বলেছেন আব্বুর হাতে আর বেশি সময় নেই। উনি তোকে কিছু বলতে চান। তুই কাল সকাল সকাল চলে আসিস প্লিজ। তোকে আমি হাসপাতালের ঠিকানা পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
নেহা অস্থির হয়ে বলে,

উত্তল তরঙ্গ পর্ব ৩২

“কি হয়েছে বড় আব্বুর?”
“জানি না রে..কিন্তু উনি বারবার নাকি তোরই নাম নিচ্ছেন। তোকে নাকি কিছু বলার আছে। তুই কাল সকালেই চলে আসিস।”
নেহা ভাবতে থাকে,
“বড় আব্বু আমাকে কি এমন বলতে চায় যে, এই অসুস্থ অবস্থাতেও উনি আমার খোঁজ করছেন। আমাকে সবটা জানতেই হবে।”
“ঠিক আছে আরাভ ভাই,তুমি চিন্তা করো না। বড় আব্বু সুস্থ হয়ে যাবে। আমি আগামীকাল সকাল সকাল যাব।”

উত্তল তরঙ্গ পর্ব ৩৪