উত্তল তরঙ্গ পর্ব ৪৬

উত্তল তরঙ্গ পর্ব ৪৬
দিশা মনি

আহির নিজের অফিস থেকে সবেমাত্র বাসায় ফিরলো। আহিরা তখন ডাইনিং টেবিলে বসে খাবার খাচ্ছিল। তার পাশেই বেজার মুখ করে বসে ছিলেন মুমিনুল পাটোয়ারী। আহির নাতাশার সাথে এনগেজড ক্যান্সেল করার পর থেকে তিনি আহিরের উপর নাখোশ। তাই তিনি আহিরকে দেখেও কোন কথা বললেন না। আহির মুমিনুল পাটোয়ারীকে দেখে কিছু বলার চেষ্টা করলেন কিন্তু মুমিনুল পাটোয়ারী উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,

“আমার তোমার কোন ধরনের কোন কথা শোনার কোন অভিপ্রায় নেই। তুমি তো সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছ, নিজের জীবন নিজের ইচ্ছামত চালাবে। তাহলে তাই করো। যদি আমার ইচ্ছাকে সম্মান করতে তাহলে এভাবে সবার সামনে এনগেজমেন্ট ভেঙে দিয়ে আমাকে অপমান করতে না। তুমি কি বুঝতে পারছ না, তোমার এই একটা কাজের জন্য আমাকে সবার সামনে কতটা ছোট হতে হয়েছে।”
মুমিনুল পাটোয়ারীর অভিযোগের সামনে আহিরের মাথা নিচু হয়ে গেল। আহির বলল,
“আমার পক্ষে সত্যিই নাতাশাকে বিয়ে করা সম্ভব না।”
“তাহলে সেটা আগেই বলতে পারতে। এভাবে ব্যাপারটা এনগেজমেন্ট পর্যন্ত নিয়ে এসে সবাইকে এভাবে অপদস্ত করার কি প্রয়োজন ছিল তোমার?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আহির বলার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছিল না। কারণ সত্যিকার অর্থে সেই দায়ী সব কিছুর জন্য। আহির এবার আহিরার পাশে বসে পড়ে। আহিরা নিজের মতো খাচ্ছিল৷ মুমিনুল পাটোয়ারী চলে যেতে নেবেন এমন সময় হঠাৎ করে হন্তদন্ত হয়ে সেখানে প্রবেশ করে নেহা। নেহাকে দেখে মুমিনুল পাটোয়ারী অবাক হয়ে বলেন,
“তুমি কে?”
আহির এবং আহিরাও নেহার দিকে তাকায়৷ আহির অবাক হয়ে বলে,
“নেহা এখানে কি করছে? ওর তো এখানে আসার কথা না।”
এরমধ্যে দুজন গার্ড ছুটে এসে বলল,
“দেখুন না স্যার, আমরা হাজার বাধা দেয়া সত্ত্বেও উনি আমাদের কোন কথা না শুনে এভাবে ভেতরে চলে এলেন। বললেন ওনার নাকি কোন জরুরি কাজ আছে।”
আহিরা অবশ্য নেহাকে দেখে ভীষণ খুশি হয়ে বলে ওঠে,

“আন্টি, তুমি এসেছ।”
মুমিনুল পাটোয়ারী অবাক হয়ে বলেন,
“তুমি চেনো ওকে আহিরা?”
আহিরা মাথা নাড়ায়। মুমিনুল পাটোয়ারী গার্ডদের নির্দেশ দেন,
“তোমরা যাও, উনি মনে হয় আহির ও আহিরার পরিচিত কেউ।”
গার্ডরা চুপচাপ বিদায় নেয়। নেহা আবেগাপ্লুত হয়ে আহিরার দিকে তাকায়। সে যেটা ভেবেছিল তাই সত্য। এই আহিরাই তার সেই হারিয়ে যাওয়া যমজ মেয়ে। আহিরাও নেহার দিকে তাকিয়ে ছিল হাসিমুখে। নেহা আহিরার দিকে দুহাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
“মায়ের কাছে এসো, আহিরা..”

নেহার কথা শুনে আহির ও মুমিনুল পাটোয়ারী ভীষণ অবাক হয়ে যান। আহিরা অবশ্য ছুট্টে চলে যায় নেহার কাছে। নেহা নিজের মেয়েকে এতদিন পর ফিরে পেয়ে তাকে বুকের সাথে গভীর ভাবে জড়িয়ে আলিঙ্গন করে। তার এতদিনের বঞ্চিত মাতৃহৃদয় যেন কেঁদে ওঠে। আহিরার গায়ে হাত বুলিয়ে সে বলে,
“তোমাকে যখন প্রথম দেখেছি তখন থেকেই নিজের ভীষণ আপন মনে হয় আহিরা৷ আজ আমি জানতে পারলাম, তুমি সত্যিই আমার আপন, আমার সন্তান তুমি..!”
মুমিনুল পাটোয়ারী স্তম্ভিত হয়ে আহিরের দিকে তাকিয়ে বলে
“এই মেয়েটা এসব কি বলছে আহির? সত্যি কি ও আহিরার মা?”
আহির কিছু বলে না। মুমিনুল পাটোয়ারী বলে ওঠেন,
“চুপ করে আছ কেন? আমি যে প্রশ্ন করছি তার উত্তর দাও।”
নেহা বলে ওঠে,

“কি বলবেন উনি? ওনার আজ আর কিছু বলার মুখ আছে নাকি? এতদিন ধরে উনি আমার সাথে কত শত অন্যায় করেছেন। যার কোন সীমা হয় না। উনি আমার থেকে আমার মেয়েকেও দূরে সরিয়ে দিয়েছেন। এতদিন আমার মেয়ে আমার মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়েছে শুধু ওনার জন্য। ওনার পাপের ঘড়া তো আগে থেকেই পরিপূর্ণ ছিল এবার তা উপচে পড়ার জোগাড়। আল্লাহ এত পাপ সহ্য করবেন না। মিস্টার আহির আপনার সব পাপের হিসাব এবার আমি নেবো আপনার থেকে।”
মুমিনুল পাটোয়ারী আহিরকে জিজ্ঞেস করেন,

“এই মেয়েটা এসব কি বলছে আহির? তুই তো আমায় বলেছিলি আহিরার আসল মা ওকে জন্ম দেয়ার পর আর নিজের কাছে রাখতে চায়নি৷ তাই তুই আহিরাকে নিজের সাথে নিয়ে এসেছিলি। কিন্তু এই মেয়েটা দাবি করছে তুই ওর মেয়েকে ওর থেকে কেড়ে নিয়েছিস এসবের মানে কি?”
আহির এবার আহিরার দিকে তাকায়। তার পিতৃহৃদয় কেপে ওঠে। আহিরের ভেতরের শয়তান আবারো জেগে ওঠে। তাই আহির বলে ওঠে,
“মিথ্যা বলছে ঐ মহিলা। উনি আহিরার মা নন। উনি ফ্রড, আহিরা শুধু আমার মেয়ে। প্রিন্সেস তুমি আমার কাছে চলে এসো। বাবা ডাকছে তো।”

কিন্তু আহিরা এক পাও নড়ে না। আহির অস্থির হয়ে ওঠে। নেহা বলে ওঠে,
“সত্যকে আর কত লুকিয়ে রাখবেন আহির? এবার আর কোন উপায় নেই। ডিএনএ টেস্টের রিপোর্ট আমার কাছেই আছে। যা থেকে শতভাগ পরিস্কার হয়ে যায় যে, আহিরা আমারই মেয়ে। এখন কি আপনি সেই ডিএনএ রিপোর্টও অস্বীকার করবেন? সেই ক্ষমতা দেখানোর স্পর্ধা করবেন না।”
আহির ক্ষিপ্তবেগে এগিয়ে এসে নেহার থেকে ছিনিয়ে নেয় আহিরাকে। আহিরা কান্না করতে শুরু করে। আহির সিকিউরিটি গার্ড ডেকে বলে,
“বের করে দাও এই মহিলাকে এখান থেকে। আহিরা শুধু আমার মেয়ে,,,ওর কেউ নয়। ছোটবেলা থেকে আহিরা আমার কাছে মানুষ হয়েছে। আর এখন ও আহিরাকে আমার থেকে আলাদা করে দেবে, এটা আমি হতে দেবো না।”
আহিরা ক্রন্দনরত স্বরে বলে,

“ছাড়ো আমাকে পাপা! আমি আমার মাম্মার কাছে যাব।”
আহির চেচিয়ে বলে,
“উনি তোমার মাম্মা নয় আহিরা! উনি একজন ফ্রড। উনি সব মিথ্যা বলছেন।”
আহিরা বলে,
“না, আমি জানি উনিই আমার মাম্মা। ওনাকে আমার শুরু থেকেই আপন লাগে। ওনার মধ্যে থেকে একটা মাম্মা ফিলিংস আছে। সেদিন হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে উনি আমায় বলেছিলেন, একটা পরীক্ষা করাবেন আর সেই পরীক্ষার মাধ্যমে জানা যাবে উনি আমার মাম্মা কি না। সেই পরীক্ষায় তো জানা গেছে, উনি আমার মাম্মা। তাহলে তুমি কেন আমাকে আমার মাম্মার কাছে যেতে দিচ্ছ না? আই হেইট ইউ। আমাকে মাম্মার কাছে যেতে দাও।”
আহির ভীষণ ক্ষেপে যায়। সিকিউরিটি গার্ড এলে সে বলে,

“এই মহিলাকে এখনই বের করে দাও।”
সিকিউরিটি গার্ড নেহাকে টানতে থাকে। এদিকে আহিরা নেহার কাছে যাবার চেষ্টা করে। তখন আহির নির্দয়ের মতো আহিরাকে নিয়ে গিয়ে একটা ঘরে বন্দি করে রাখে। মুমিনুল পাটোয়ারী আহিরকে বলে,
“এসব কি করছ তুমি?”
আহির এতটাই হিংস্র হয়ে ওঠে যে কারো কথা শোনে না। সে নেহাকেও হুমকি দিয়ে বলে,
“আর কোনদিন যদি তুমি আমার মেয়ের কাছে আসার চেষ্টা করো তাহলে আমি সবার আগে তোমার মেয়ে নিয়াকে তোমার থেকে আলাদা করে দেব। তারপর তোমাকে এই দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেব।”
নেহা বলে ওঠে,

উত্তল তরঙ্গ পর্ব ৪৫

“যত পাপ করার এখনই করে নিন মিস্টার আহির চৌধুরী, কারণ আমি আপনার পতন দেখতে পাচ্ছি। আপনার পতন সন্নিকটে। সমস্ত পাপের হিসাব আপনাকে দিতেই হবে। আপনার ভালো সময় ফুরিয়ে আসছে এবার নিজের পাপের ফল ভোগার জন্য প্রস্তুত হন। আপনার সব পাপের ফল আমি আপনাকে দেবোই। মনে রাখবেন, আমি হার মানবো না।”

উত্তল তরঙ্গ পর্ব ৪৭