উষ্ণ প্রেমের আলিঙ্গন পর্ব ৪২

উষ্ণ প্রেমের আলিঙ্গন পর্ব ৪২
আফিয়া আফরোজ আহি

হলুদের সমারোহে সেজে উঠেছে আমার প্ৰিয় বাগানের একপাশ। সেখানে গায়ে হলুদের আয়োজন করা হয়েছে। স্টেজে দুইপাশে আলাদা আলাদা করে সাজানো হয়েছে। একপাশে আমার জন্য অন্য পাশে আদ্রর জন্য। উনাদের বাড়িতে হলুদের আয়োজন করতে চাইলেও হয়নি। কারণ আদ্রর বাবারা এক ভাই এক বোন। আদ্রর ফুপ্পি দেশের বাহিরে থাকে। আত্মীয় বলতে আমাদের সবাই।

আয়োজনে আমরা আমরাই। দুই জায়গায় আলাদা করে আয়োজন করলে অনেক বেশি ঝামেলা হবে তাই একসাথেই আয়োজন করা। স্টেজ এখনো পুরোপুরি তৈরী হয়নি কিছু কাজ বাকি রয়ে গেছে। তাজা ফুল দিয়ে স্টেজ সাজানো হচ্ছে। আমি হাতে এক কাপ কফি নিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিচের আয়োজন দেখছি। দুপুরের দিকে হলুদের অনুষ্ঠান আর রাতে মেহেন্দি। সবে সকাল দশটা বাজে। অবশেষে সবার অনুমতি নিয়ে আমাদের ভালোবাসা পূর্ণতা পেতে যাচ্ছে। যদিও বিয়ে তো আমাদের সেই কবেই হয়ে গেছে। তবে এবারের টা ভিন্ন আয়োজন, হইহুল্লোড়, আত্মীয়-স্বজন সব মিলিয়ে একদম পরিপূর্ণ। আদ্রর কথা উনি উনার বিয়েতে কোনো কমতি দেখতে চান না। একা একা নিজ মনে কথা বলছি পাশ থেকে কেউ ধাক্কা দিলো। তার দিকে তাকাতেই ঈশিতা আপু বলে উঠলো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“তুই কিরে রোদ? সারাজীবন সব অনুষ্ঠানে সবার শেষে সাজতে বসতি। কোনোরকম সেজে সবার আগে উঠে যেতি। আজকেও কি সেই প্ল্যান করছিস নাকি? তুই যে ব্রাইড সে খবর তোর আছে?”
“ব্রাইড হয়েছি তো কি হয়েছে? ব্রাইড হলে একঘন্টা সময় নিয়ে বসে বসে সাজতে হবে? আমি বাপু তা পারবো না। টুক করে বসে পাঁচ মিনিটে সেজে উঠবো আমি”
“আজকে সেটা হবে না। সময় নিয়ে সুন্দর করে সেজেগুঁজে আমার ভাইয়ের পাশে বসতে হবে। নাহয় তোকে আদ্রর পাশে বসতে দিবো না”

“বাই এনি চান্স তুমি কি আমার কালা বললে? তোমার ভাইয়ের পাশে আমায় মানাবে না সেটাই বুঝালে? বাহ্ কি সুন্দর? শেষ মেষ কন্যা পক্ষ থেকে বর পক্ষ হয়ে গেলে? ঠিক আছে শিহাব ভাইয়া আমাদের দলে”
“দল ভাগাভাগি পড়ে করিস এখন সাজতে চল”
হাত ধরে টেনে নিয়ে বসিয়ে দিলো আয়নার সামনে। অতঃপর শুরু হলো মেকআপ নামক অত্যাচার। মনে হচ্ছে মুখের ওপর এক পাল্লা আটা ময়দা লেপে দিচ্ছে। বিরক্ত লাগছে আমার। যেই আমি দুদন্ড এক এক জায়গায় বসার মেয়ে না সেই আমাকে এভাবে বসিয়ে রেখেছে ভাবা যায়? আমি একটু পর পর জিজ্ঞেস করছি,
“হলো?”

মেকআপ আর্টিস্ট আমার কথায় বিরক্ত হচ্ছে সেটা তার মুখের এক্সপ্রেশন আর কথা শুনেই বোঝা যাচ্ছে। তিনি বারবার বলছে,
“আপু একটু কম নড়াচড়া করেন। চুপচাপ বসেন এইযে হয়ে গেছে”
কিন্তু আমি শুনলে তো? হয়ে গেছে ডায়লগ টা শুনতে শুনতে প্রায় এক ঘন্টা হয়ে গেছে। বিরক্ত হয়ে বলে উঠলাম,
“আর কতো? আমি আর বসে থাকতে পারবো না”
ঈশিতা আপু ধমক দিয়ে বলল,

“আর একটা কথা বললে তোর মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে দিবো। চুপচাপ বসে থাক যতক্ষণ না মেকআপ ডান হয়”
আপুর ধমক শুনে বসে আছি। একটু পর ইভা, রোশনি আর আরু এলো। তারাও সাজুগুজু করবে। ঈশিতা আপু ইভা আর রোশনিকে সাজিয়ে দিচ্ছে। আর এদিকে আমি সংয়ের মতো বসে আছি। অবশেষে মেকআপ নামক অত্যাচার শেষ হলো। উঠে মাজা টান করে দাঁড়ালাম। মনে হচ্ছে এতক্ষন একাধারে বসে থাকায় কোমর ধরে গিয়েছে। হাত পা ঝাড়া দিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালাম। নিজেকে নিজেই চিনতে পারছি না। গাঁয়ে গোলাপি পাড়ের হলুদ শাড়ি আটপৌর ভাবে পড়া। কোমরে ফুল দিয়ে তৈরি করা কোমর বন্ধনী। পুরো গাঁ মুড়িয়ে আছে তাজা ফুলে। গাঁয়ের গহনা সব তাজা ফুলের। গাঁ থেকে ফুলের মিষ্টি ঘ্রান ভেসে আসছে। আশেপাশ ফুলের ঘ্রানে মো মো করছে। ইভা এসে কাঁধে হাত দিয়ে হেলান দিয়ে বলল,

“বনু তোকে তো পুরো ফুলকুমারী লাগছে। মাশাআল্লাহ কারো নজর না লাগুক। আজকে নিঃঘাত আদ্র ভাই তোকে দেখে হার্ট ফেল করবে”
আদ্রর কথা শুনে লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম। স্মরণ হলো গতকাল রাতের ঘটনা। ভিডিও কলে দুজন কথা বলছি। মন খারাপ থাকলেও আদ্রর সাথে কথা বলে মনটা ফুরফুরে হয়ে গিয়েছিলো। আদ্রর সাথে কথা বলছি আর খিলখিল করে হাসছি। আদ্র এক ধ্যানে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। উনার এমন চাহনি দেখে অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। উনার চোখের চাহনি কেমন নেশালো। মনে হচ্ছে উনি কোনো নেশায় বুদ হয়ে আছেন। আদ্রর নাম ধরে আসতে করে ডাক দিলাম। কোনো উত্তর এলো না। গলা ঝাড়া দিলাম,তাতেও ওনার হুস নেই। এবার একটু জোরেই ডাক দিলাম। আদ্র ধ্যান ভেঙ্গে ভ্রু কুঁচকে চাইলো।

“কোন ধ্যানে পড়েছো শুনি? এতো করে ডাকছি শুনতেই পাচ্ছ না”
“রৌদ্রময়ীর ধ্যান”
তড়াক করে বলে উঠলাম,
“কি বললে? শুনতে পাইনি আবার বলো”
আদ্র দুস্টু হাসলো। ঠোঁটের কোণে হাসি বজায় রেখে বলল,
“ভাবছিলাম তোকে বুকে জড়িয়ে টুপ্ করে তোর গোলাপ রঙা ওষ্ঠে অধর ছুঁয়ে দিবো। তুই লজ্জায় রাঙা হয়ে মুখ লুকাবি আমার বুকের মাঝে। ভাবনা টা সুন্দর না?”
“সুন্দর না কঁচু। সব আমায় লজ্জা দেওয়ার ধান্দা, বদ লোক একটা”
“কিরে! কি বিড়বিড় করছিস? জোরে বল আমিও একটু শুনি”

“ঘুম পাচ্ছে ঘুমাবো”
“আজ কেটে পড়লেও দুদিন বাদে পার পারবি না বলে দিলাম”
“মানে? কেন?”
“দুদিন পড় তো আমাদের বা..”
আমি তাড়াহুড়ো করে বলে উঠলাম,
“এই তুমি থামবে? বললাম না ঘুমাবো। ভালো থেকো। আল্লাহ হাফেজ”
ফট করে কল কেটে দিলাম। নাহয় এই লোক আমায় লজ্জায় চুবিয়ে মারতো। এটা আমি শিওর। ফোনটা পাশে রেখে আদ্রর একটু আগে বলা কথাগুলো ভাবতেই লজ্জায় গালে লালিমা ছড়িয়ে গেল।
ইভার মুখে আদ্রর নাম শুনে স্মৃতিচারণ করতে ব্যাস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। ইভা আমায় ধাক্কা দিয়ে বলল,
“কি বনু? তার নাম শুনেই ব্লাস করছিস? সামনে এলে না জানি কি করবি”
“উস্টা খাবি বলে দিলাম”

“সত্যি কথা বললে এমনই হয়। আর সত্যি বলমু না”
আসলেই তো সকালের দিকে ফুপ্পিরা চলে এসেছে। আরু এসে দেখা করে গেছে। কিন্তু আদ্র? মহাশয়কে তো একবারও দেখলাম না। কি এমন কাজে ব্যাস্ত তিনি? এই তার ভালোবাসা? কোথায় এসে বলবে বউ আমি এসে গেছি, তা না করে উনি কোনো রাজ কার্য করছে কে জানে? গাল ফুলালাম। কথা বলবো না উনার সাথে। এমন সময় ডাক পড়লো নিচে যাওয়ার। আয়োজন শেষ এখন আমাদের যাওয়ার পালা।

স্টেজে বসে আছি। পাশের জায়গাটা এখনো ফাঁকা। আদ্র মহাশয় এখনো আসেনি। আমার ভাবনার মাঝেই আগমন ঘটলো তার। সাদা পাঞ্জাবীর ওপর হলুদ রঙের কোটি। হাতে ঘড়ি, চুল গুলো সুন্দর করে গুছিয়ে রাখা। উনার এই লুকেই আমি ফিদা। মানুষটা এতো সুন্দর কেন? উনাকে কেন এতো সুন্দর হতে হবে? এইযে আশেপাশের কতো গুলো মেয়ে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে। ইচ্ছে করছে মেয়ে গুলোর চোখ ফুটো করে দেই। এদের সাহস কতো আমার জামাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে? অ*সভ্য মেয়ে কোথাকার! ওদের বকতে ব্যাস্ত আমি আর এদিকে কখন যে আদ্র সাহেব আমার পাশে এসে বসেছে সে খেয়াল আমার নেই। ধ্যান থেকে বেরিয়ে এলাম আদ্র ধাক্কায়।

“ভাবনার রানী কি ভাবছিস?”
“এই তুমি আমায় সব নামের সাথে রানী ডাকো কেন?”
“তুই তো আমার রানী। আমার মন মহলের সিংহাসনের একমাত্র রানী”
উনার এই কথার বিপরীতে কি বলা যায় সেটা আমার জানা নেই। উনার কথার বিপরীতে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে যাই। বলার মতো কিছু খুঁজে পাইনা। ঈশিতা আপু এসে বলল,
“গল্প করার জন্য সারাজীবন পাবি এখন আমাদের হলুদ লাগাতে দে”

ঈশিতা আপুর কথায় আদ্রর থেকে চোখ সরিয়ে নিলাম। একে একে বড়রা সবাই হলুদ দিয়ে চলে গেল বাড়ির ভিতরে। বাগানে শুধু আমরা ছোটোরা। আমাদের বিয়ে উপলক্ষে সবাই বাড়ি এসেছে। ইয়াদ ভাই, ইফাজ ভাই, রুদ্র ভাইয়া, রিসাব ভাইয়া সবাই। ইয়াদ আর ইফাজ ভাইয়ার মেঝ আব্বুর কাজের সূত্রে সেখানেই তাঁদের সাথে থাকতো। রিসাব ভাইয়া হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করতো। রিসাব ভাইয়া আমার আপন ভাই হলেও রুদ্র ভাইয়ের সাথে যেমন খুনসুটি ময় সম্পর্ক তেমন না। ভাইয়া আমায় অনেক ভালোবাসে তবে তার সাথে খুনসুটি হয় না। রুদ্র ভাই কয়েকদিন আগে পড়াশোনা শেষ করে কাজের জন্য অন্য জায়গায় থাকতো। আজকে আমাদের বিয়ে উপলক্ষে পুরো বাড়ি জমজমাট। সবাই একসাথে। সবার মাঝেও একটা মানুষ অনুপস্থিত। সে আর কে নয় ইভান ভাই। সবাইকে একসাথে দেখে মনটা ভালো হয়ে গেল। একে একে সবাই হলুদ মাখিয়ে যাচ্ছে। নিজেকে কেমন হোলদিয়াপাখি মনে হচ্ছে। পুরো হাতে, পায়ে, মুখে হলুদের ছড়াছড়ি।

হটাৎ খেয়াল করলাম এক কোণে শুভ ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছে। কোথাথেকে হুট্ করে তিথি আপু এসে ভাইয়ার পুরো গালে হলুদ লেপ্টে দিলো। শুভ ভাইয়া গম্ভীর মুখে তিথি আপুর দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ভয়ে আছি কখন যেন শুভ ভাইয়া আপুকে দেয় এক ধমক। তবে সেটা হলো না। ভাইয়া আপুকে কিছু না বলে এসে হলুদের বাটি থেকে এক খাবলা হলুদ নিয়ে তিথি আপুর পুরো মুখে লেপ্টে দিলো। আপু বেক্কলের মতো ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। শুভ ভাই পাত্তা না দিয়ে ওখান থেকে চলে গেল। আমি ভাইয়ার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছি।
ঈশিতা আপু এলো সবার শেষে। আমার আর আদ্রর পুরো মুখ হলুদ দিয়ে ভুত বানিয়ে দিয়ে বলল,

“আমার বিয়েতে তোরা আমায় ভুত বানিয়েছিলি আজ আমি তোদের ভুত বানালাম। হিসাব বরাবর”
আদ্র কিছু বলল না পকেট হাতড়ে কিছু খুঁজছে। অবশেষে খুঁজে পেয়ে আলতো হাতে রুমাল দিয়ে আমার মুখের অতিরক্ত হলুদ গুলো মুছে দিতে লাগলো। খুব সতর্কতার সহিত কাজ করছে। উনার সম্পূর্ণ মনোযোগ আমার মুখে। যেন হলুদ উঠাতে গিয়ে আমি ব্যাথা না পাই। ইভা এসে বলল,
“আহা কি ভালুপাসা?”

আদ্র জবাব দিলো না। ওনার সমস্ত মনোযোগ আমার মুখশ্রী তে। হলুদ দেওয়া শেষে সবাই বসে আড্ডা দিচ্ছি। একেক জন একেক কথা বলছে আর আমরা হাসছি। সব ভাই বোন একসাথে হলে যা হয় আরকি। সবার মাঝে শুভ ভাই চুপচাপ বসে আছে আর তিথি আপু ভাইয়া কে একটু পড় পড় খোঁচাচ্ছে। বেঁচেরা শুভ ভাইয়েরা অবস্থা দেখে আমার মায়া হচ্ছে।

আমার শান্তশিষ্ঠ ভাইয়ের কপালে কিনা শেষমেষ তিথি আপুর মতো দুস্টু মেয়ে জুটলো? আমি ওদের দিকে তাকিয়ে আছি এমন সময় গালে কারো হাতের স্পর্শ পেলাম। মনে হচ্ছে গালে কেউ হলুদ ছুঁইয়ে দিয়েছে। কিছুটা শীতল অনুভব হচ্ছে। ফিরে তাকালাম মানুষটার দিকে। মানুষটার দিকে তাকাতেই অনেকটা অবাক হলাম। অনেক দিন পড় মানুষটা আমার সামনে। তাকে দেখে কিছুটা ভয় হচ্ছে। আবার আগেই শেষ ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে নাতো? আচ্ছা এতদিন মানুষটা কোথায় ছিলো? সামনের মানুষটা আমার দিকে খানিকটা ঝুঁকে কানে কানে বলে উঠলো,

উষ্ণ প্রেমের আলিঙ্গন পর্ব ৪১

“বিয়ের জন্য অনেক অনেক শুভেচ্ছা রোদপাখি”
আমার মুখ দিয়ে অস্ফুস্ট স্বরে বেরিয়ে এলো,
“ইভান ভাই আপনি?”

উষ্ণ প্রেমের আলিঙ্গন পর্ব ৪৩