উষ্ণ প্রেমের আলিঙ্গন সিজন ২ পর্ব ৫
আফিয়া আফরোজ আহি
গোধূলি বিকেলে অবশন্ন মনে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি আকাশ পানে। আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে পেজো পেজো মেঘেদের ভেলা। তাকিয়ে আছি একদম নীরব নিষ্ক্রিয় হয়ে। যেন আমার মাঝে কোনো আবেগ অনুভূতি, ক্রিয়া, প্রতিক্রিয়া কিছুই নেই। কেমন খাপ ছাড়া, খাপ ছাড়া ভাব! নিজেকে দেখে আমি নিজেই কেমন যেন অবাক হয়ে যাচ্ছি! আমি তো এমন ছিলাম না। সব সময় উৎফুল্ল সত্ত্বা ছিলাম আমি। একাই পুরো বাড়ি মাতিয়ে রাখা মেয়ে আমি। যে সবাইকে জ্বালিয়ে মা*রতো। চঞ্চল, বাঁচাল, দুস্টু এক সত্ত্বা। তাহলে হটাৎ কি এমন হলো যে আকস্মিক আমার এতো পরিবর্তন? মনের কোণে প্রশ্ন উঁকি দিলো আসলেই কি এমন কিছুই হয়নি? হয়েছে, অনেক কিছুই হয়েছে। আমার জীবনের বড় একটা মোড় ঘুরে গেছে। পাল্টে গেছে অনেক কিছুই। বিশেষ করে ইভান ভাই আর মেয়েটাকে একসাথে দেখলে নিজেকে অচেনা রূপে খুঁজে পাই। মনে হয় আমি নিজের মাঝে নেই। কোনো অনুভূতিই কাজ করে না। কেমন বিবশ হয়ে চেয়ে থাকি।
“রোদ সোনা কি করছিস এখানে? আকাশের দিকে তাকিয়ে তাঁরা গুনছিস?”
পিছন থেকে পুরুষালি কণ্ঠ স্বর ভেসে এলে ধ্যান ভাঙলো আমার। পিছনে তাকিয়ে দেখালাম আদ্র ভাই দাঁড়িয়ে আছে। উনি এখানে কখন এলেন? নিজ ধ্যানে থাকায় খেয়াল করিনি হয়তো! আদ্র ভাই এগিয়ে এসে আমার থেকে এক হাত দূরে ছাদের রেলিংয়ের সাথে হেলান দিয়ে বুকে হাত গুঁজে দাঁড়ালেন।
“তোমার গার্লফ্রেন্ড এর সংখ্যা গুনছি”
“তাহলে আমি নিশ্চিত সেটা শুন্যই হবে। তোকে আর কষ্ট করে গুনতে হবে না”
আমি চোখ ছোট ছোট করে জিজ্ঞেস করলাম,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“এতটা শিওর কিভাবে?”
❝আমি এক নারীতে আসক্ত পুরুষ। অন্য নারীর প্রতি আসক্তি তো দূর সামান্য ইন্টারেস্ট পর্যন্ত কাজ করে না আমার❞
আদ্র ভাই থামলেন। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে ফের বললেন,
❝অন্য নারীর প্রতি আসক্তি আসার আগে আমার মৃত্যু হোকে তাবুও আমার রৌদ্রময়ী ছড়া অন্য কারোর প্রতি আমার আসিক্ত না আসুক❞
আদ্র ভাইয়ের চোখে চোখ রেখে বললাম,
❝তোমাকে যে জীবন সঙ্গী হিসেবে পাবে সে অনেক ভাগ্যবতী হবে দেখে নিও❞
আদ্র ভাই বিড়বিড় করে বলল,
❝সেই ভাগ্যবতীটা একমাত্র তু্ই ছাড়া যেন অন্য কেউ না হয়❞
“কি বললে? জোরে বলো”
“বললাম আমাকে যে পাবে সে অনেক লাকি হবে কারণ আমি অনেক কিউট তাই”
“কিউট না ছাই! এই সরো তো”
“আমি কি তোর পথ আটকে রেখেছি যে সরতে বলছিস?”
“আমার ভুল হয়ে গেছে আমায় ক্ষমা করে দেও। তখন আমার আবেগ কাজ করছিলো”
আদ্র ভাই বলল,
“নাটক কম করো পিও। তুমি যে মিথ্যা বলছো সেটা আমি জানি”
কথাটা বলে হেসে দিলো আদ্র ভাই। তার কথা শুনে আমিও হেসে দিলেন। দুজনের মুখে লেগে আছে মিষ্টি হাসি। আদ্র ভাই মানুষটাই এমন। হাস্যজ্জল, ঝলমলে স্বভাবের। কারো মন খারাপ থাকলে উনি এক নিমিষেই তার মন খারাপ দূর করে দিতে পারে। উনি চালতি ফিরতি মন খারাপ দূর করার টনিক। যার যতোই মন খারাপ থাকুক না কেন ওনার সংস্পর্শে এলে সেটা এক লহমায় কর্পূরের মতো উবে যায়। আদ্র ভাইয়ের মুখে মুচকি হাসি আর আমি খিল খিল করে হাসছি। হাসির রিনঝিন শব্দে আদ্র ভাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। পলকও ফেলছে না। ওনাকে দেখে মনে হচ্ছে উনি দিন দুনিয়া সব ভুলে বসেছেন। আস্তে করে ডাক দিলাম। আদ্র ভাইয়ের ধ্যান ফিরলো। হুট্ করে আমার গাল টেনে দিয়ে বলল,
❝তোর মুখে বিষাদ মানায় না রোদ সোনা। তোকে হাসি মুখেই মানায়। সব সময় হাসি মুখে থাকবি।কখনো মন খারাপ করে থাকবি না। তোর বিষাদে মাখা মুখশ্রী বড্ বাজে লাগে দেখতে। তোর বিষন্ন চেহারা তীরের মতো কারো হৃদয়ে আঘাত করে। তার হৃদয় ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয় ক্ষনে ক্ষনে। রক্তক্ষরণ হয়, তার নিজেকে এলোমেলো, পা*গল পা*গল লাগে। তু্ই কি সেটা জানিস?❞
মাথা নেড়ে ‘না’ জানালাম। আর ভাবতে বসলাম কে এমন হতে পারে যার কাছে আমি এতোটা স্পেশাল? আমার আশেপাশের কেউ? আমার চেনা জানা নাকি অচেনা কেউ? দুদিন আগে এটা বললে আন্দাজের ভিড়ে হলেও আমি হয়তো ইভান ভাইয়ের নাম নিতাম। কিন্তু এখন আমার জানা মতে এমন কেউ নেই যে আমাকে নিয়ে এতটা ভাবতে পারে। আমার মন খারাপ কাউকে এতটা গভীর ভাবে স্পর্শ করতে পারে। মানুষটা কে সেটা বুঝতে না পেরে আদ্র ভাইকেই জিজ্ঞেস করলাম,
❝সে কে আদ্র ভাই?❞
❝আমি❞
আদ্র ভাই কথাটা বলে ভ্যাবা চেক খেয়ে গেল। কি বলতে কি বলে ফেলেছে সেটা হয়তো বুঝতে পারে নি। উনি হয়তো ভাবে নি আমি এভাবেই মানুষটার নাম জানতে চাইবো। আর উনি মুখ ফসকে এমন কিছু বলে ফেলবে। আদ্র ভাই সময় নিয়ে কথা গুছালোঅতঃপর বলল,
“কে আবার হবে তোর বাবা-মা, পরিবারের সবাই তোর জন্য কতো ভাবে তু্ই জানিস। ওরা তোকে নিয়ে অনেক চিন্তিত। বড় মামু তো তোর জন্য কালকে ইভানকে বের করেই দিয়েছিলো এক প্রকার। কিন্তু শেষে শুভ ভাই সবাইকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে শান্ত করেছে। তাহলে তু্ই ভাব সবাই তোকে কতটা ভালোবাসে? তাঁদের সামনে যদি তু্ই এমন মুখ গোমড়া করে মন খারাপ করে বসে থাকিস তাহলে কি ওদের ভালো লাগবে?”
“উহু”
“এই জন্যই বলছি সব সময় হাসি মুখে থাকবি। সবার সামনে নিজেকে স্ট্রং রাখবি। যেন কেউ এসে এক নিমিষেই তোকে আঘাত দিতে না পারে”
আদ্র ভাইয়ের কথার বিপরীতে শুধু মাথা নেড়ে সায় জানালাম। দুজনের মাঝে নীরবতা। কি বলবো ভেবে পাচ্ছি না ম আদ্র ভাই টপিক চেঞ্জ করলো। ফের একা একা নিজের মতো বক বক শুরু করলো। আমি এক মনে আদ্র ভাইয়ের কথা শুনছি। মাঝে মাঝে টুকটাক জবাব দিচ্ছি। আর হাসির কথা হলে দুজন হেসে উঠছি। আদ্র ভাইয়ের সংস্পর্শে এসে মনটা একদম পুরোপুরি ভালো হয়ে গেছে। মন খারাপেরা কোথায় যেন পালিয়ে গেছে। একটু একটু করে নিজের পুরোনো সত্ত্বায় আবার ফিরে যাচ্ছি। আমি আর আদ্র ভাই কথা বলছি এমন সময় সিঁড়ি দিয়ে কারো পায়ের শব্দ শোনা গেল। ধুপ ধাপ পা ফেলে এগিয়ে আসছে কেউ। উচ্চ স্বরে কারো সাথে কথা বলতে বলতে আসছে। কথা বলার ধরণ শুনে মনে হচ্ছে মানুষটা কথা বলছে কম ঝাড়ি দিচ্ছে বেশি। তবে আমরা সেদিকে পাত্তা দিলাম না। আমরা আমাদের মতো গল্প করায় মত্ত হলাম। আমরা কথা বলছি এক পর্যায়ে কেউ চি*ল্লিয়ে শক্ত কণ্ঠে বলে উঠলো,
“তোকে কতোবার বলেছি সোহান আমার জিনিসের দিকে হাত দিবি না। তোর কানে যায় না? তু্ই কেন আমার ফাইলে হাত দিয়েছিস? কোন সাহসে?”
ইভান ভাই চিৎকার করে কথা বলায় আমরা দুজনই অবাক নেত্রে তার দিকে তাকালাম। এর আবার হটাৎ করে কি হলো? যা ইচ্ছে হোক তাতে আমার কি?অন্যের জামাইয়ের দিকে তাকাতে আমার বয়েই গেছে। চোখ সরিয়ে নিলাম। আদ্র ভাইয়ের সাথে কথা বলায় ব্যাস্ত হলাম। ইভান ভাই কল কেটে সামনে এসে দাঁড়ালেন। গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
“এই সন্ধ্যা বেলা তোরা দুজন এখানে কি করছিস? রোদ তু্ই ওর সাথে কেন?”
ঝাঁঝালো কণ্ঠে জবাব দিলাম,
“আমরা যা ইচ্ছে তাই করছি আপনার কি? আপনার বাড়া ভাতে ছাই তো ফেলিনি তাই না?”
ইভান ভাই তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললেন,
“যেটা জিজ্ঞেস করেছি তার উত্তর দে। এক্সট্রা কথা শুনতে ইচ্ছে করছে না”
“আমার কাছে কৈফিয়ত চাওয়ার আপনি কে?”
“বেশি বাড়াবাড়ি না করে নিচে যা”
“আপনার কথা শুনতে আমি বাধ্য নোই”
“একে তো কাউকে না বলে এসেছিস। তার ওপর মুখে মুখে তর্ক করছিস?”
“আপনি যে কাউকে না জানিয়ে বিয়ে করেছেন তার বেলায়? আমি তো তাও শুধু ছাদে এসেছি। নিজের চরকায় তেল দিন। আর শুনুন মিস্টার ইরফান খান ইভান আপনি আর আমার সামনে আসবেন না”
ইভান ভাই বুকে হাত গুঁজে জিজ্ঞেস করলেন,
“আসলে কি করবি?”
“আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো”
“রোদ!”
ইভান ভাই হাত উঠিয়েও হাত নামিয়ে নিলেন। আদ্র ভাই উগ্র কণ্ঠে বললেন,
“ইভান যতদূর এগিয়েছিস সেখানেই থেমে যা নাহয় আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবে না। তোর সাহস কিভাবে হয় তু্ই রোদের ওপর হাত উঠাতে চাস?”
ইভান ভাই আদ্র ভাইয়ের কথায় পাত্তা দিলেন না। খপ করে আমার ধরে সেখান থেকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে আসলেন। আমি হাত মোচড়া মুচরি করছি ইভান ভাইয়ের হাতের বন্ধন থেকে আমার হাত ছাড়ানোর জন্য। ইভান ভাই আমাকে সোজা আমার রুমের সামনে এনে ছেড়ে দিলেন। শক্ত কণ্ঠে বললেন,
“আমি আর তোর সামনে আসবো না। কিন্তু তোকে আদ্র আশেপাশে যেন না দেখি”
“আমি যার আশেপাশে ইচ্ছে ঘুরবো তাতে আপনার কি? আপনি কে আমাকে মানা করার। ইউ আর নাথিং মিস্টার ইভান”
ইভান ভাই অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। উনার মুখে কোনো উত্তর নেই। নিরুত্তর, নিশ্চল তিনি। কিছুক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে থেকে সেখান থেকে প্রস্থান করলেন। গেলে যাক এতে আমার কি? ওনাকে নিয়ে কিছু ভাবতে আমার বয়েই গেছে, হুহ।
ছাদে ইভান ভাই আর আদ্র ভাই দাঁড়িয়ে আছে। দুজন দুজনের মুখোমুখি। দুজনের মাঝে নীরবতা। কিন্তু চোখে চোখে এদের নীরব যুদ্ধ চলছে। কেউ কাউকে এক চুল পরিমান ছাড় দিতে নারাজ। আদ্র ভাই শান্ত কণ্ঠে বলল,
“ইভান রোদের ওপর অধিকার খাটাতে আসিস না। ভুলে যাস না এখন তু্ই অন্য একটা মেয়ের স্বামী”
ইভান ভাই আদ্র ভাইকে শাসিয়ে বললেন,
“তোর আমাকে জ্ঞান দেওয়া লাগবে না। আমার বিষয়ে আমি জানি। নিজেকে নিয়ে ভাব। তু্ই ওর আশপাশ থেকে সরে যা আদ্র। তু্ই ভালো করেই জানিস রোদ আমাকে পছন্দ করে, তোকে না”
“জানি”
“তার পরও কেন ওর আশেপাশে ঘুরছিস?”
“আমি জানি ও তোকে পছন্দ করে আমাকে না। তাই চলেই তো যাচ্ছিলাম কিন্তু এখন আর না। তু্ই তো বিয়ে করেই নিয়েছিস তাহলে আর সমস্যা কি? এখন আমি ওর আশেপাশে ঘুরি আর যাই করি তাতে তোর কিছু আসা যাওয়ার কথা না। ওকে এভাবেই ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়েও কি তোর শান্তি হয়নি? তু্ই চাস টা কি? রোদকে কষ্ট দিতে? তাহলে তোর চাওয়া ভুল। আমি থাকতে কেউ রোদকে কষ্ট তো দূর ওর গাঁয়ে সামান্য আঁচড় দিতে এলেও তাকে আগে আমার মুখোমুখি হতে হবে। তোর জন্য ওকে একা ছেড়ে দিয়ে আমি ভুল করেছি। চরম ভুল। যে ভুলের মাসুল এখন ও দিচ্ছে। কষ্ট পাচ্ছে। আমার উচিত ছিলো ওকে আগলে রাখা। কিন্তু আমি অভিমান করে ওকে একা ছেড়ে যাচ্ছিলাম যেটা আমার ভুল হয়েছে। তু্ই চিন্তা করিস না আমি আমার ভুল খুব শীঘ্রই শুধরে নিবো। কাউকে আমার রৌদ্রময়ীকে আঘাত করার সুযোগ দিবো না, কাউকে না”
ইভান ভাই ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন,
“কি করবি তু্ই?”
“সেটা সময় এলেই দেখতে পারবি। তোকে আবারও বলছি তু্ই রোদের থেকে দূরে থাক। তু্ই ওর থেকে যতো দূরে থাকবি ও ততই ভালো থাকবে”
আদ্র ভাই হন হন পায়ে নিচে চলে এলো। ইভান ভাই বিস্তীর্ণ আকাশের পানে চেয়ে আছে। বুক চিরে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“দূরেই তো আছি। আর কতো দূরে যাবো? আমি রোদ পাখির থেকে এতটা দূরত্বে চলে গেছি যে এখন আমাকে দেখে তার মুখে হাসির বদলে তার চোখে আমার জন্য ঘৃণা ফুটে ওঠে। হায়রে পোড়া কপাল আমার”
উষ্ণ প্রেমের আলিঙ্গন সিজন ২ পর্ব ৪
ইভান ভাই হাসার চেষ্টা করলো। হাসি যেন তার মুখ দিয়ে বেরোতে চাইছেই না। পুনরায় মানুষটা নিজেকে শক্ত খোলসে আবৃত করে নিলো। আকাশের দিকে তাকিয়ে দাঁত কিড়মিড়ি দিয়ে বলে উঠলো,
❝যে বা যারা আমাকে আমার রোদ পাখির থেকে আলাদা করেছে তাঁদের আমি ছাড়বো না। যারা আমার রোদ পাখির ক্ষতি করতে চেয়েছে তাঁদের একেকটাকে ধরে ধরে শেষ করবো। অতঃপর আমার শান্তি❞