একজোড়া আগুন পাখি পর্ব ৩৩

একজোড়া আগুন পাখি পর্ব ৩৩
রনীতা তুশ্মি

মিডিয়াতে বর্তমানের ব্রেকিং নিউজ হয়ে দাড়িয়েছে রকস্টার ভিকের গাড়ি খাদে পড়েছে আর সেখান থেকে কেনীথের সাথে আরো একটি মেয়েকে উদ্ধার করা হয়েছে। দুজনের অবস্থা এতোটাই খারাপ যে কেনীথকে সবাই সহজে চিনতে পারলেও আনায়ার পরিচয় ঠিকঠাক কেউ শনাক্ত করতে পারেনি। আর হঠাৎ ভিকের সাথে এই অজ্ঞাত মেয়েও যেন সবার কাছে অতন্ত্য কৌতুহলের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ কেউ তো হিসেব মিলাতে ব্যস্থ যে এই মেয়েই সে কিনা যার সাথে নানান ভাবে কেনীথের অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটছে। যেগুলো নানান সময়ে মিডিয়ায় অনেক বেশি ভাইরালও হয়েছে। পুরোনো নানান জট গুলো নিয়ে মিডিয়া আবারও ঘাটতে বসেছে। তবে কেনীথের ভক্তদের মাঝে নানান চিন্তা ঘিরে ধরেছে। তাদের একটাই প্রত্যাশা, তাদের ভিকে যেন একদম ঠিক হয়ে যায়।

হসপিটালের আইসিইউতে আনায়া আর কেনীথ, দুজনেরই কঢ়া ট্রিটমেন্ট চলছে। আনায়ার চেয়ে কেনীথের অবস্থা অত্যাধিক খারাপ। বলতে গেলে একদম জীবন বাঁচা ম*রার পথে। দু’জনেরই কমবেশি মাথায় আঘাত লেগেছে।
গাড়ি খাদে পড়ার অল্পসময়ের মাঝেই চারপাশে লোকজন জড়ো হয়ে বড়সড় শোরগোল পড়ে যায়। এদিকে পাভেলেরও নিজস্ব নানা আলাদা লোকজন থাকে নিজের কাজের জন্য। যারা বেশির ভাগ কেনীথের কাজকর্মের জন্য লেগে থাকে কিংবা এদের বিশেষ টিমও বলা যেতে পারে।যেকারণে এই দুঃসংবাদটা তার কাছে পৌঁছাতে বেশি দেরী লাগেনি। পাভেল আগেভাগে নিজের টিমদের পাঠিয়ে দিয়েছিলো পরিস্থিতি সামলাতে। আর সে নিজেই আলাদা করে যতদ্রুত পেরেছে যথাস্থানে পৌঁছে গিয়েছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

পাভেল পৌঁছেই সবার আগে মিডিয়াদের ভিড় জমার আগেই আনায়া আর কেনীথকে হসপিটালে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে। অতঃপর যত বেস্ট ডক্টর ছিলো সব একসাথে লেগে পড়েছে ট্রিটমেন্টে জন্য। পাভেলের দশাও এখন খুব বাজে। ওর মাথা পুরো হ্যাং হয়ে গিয়েছে এসব দেখে। কখনো কল্পনাতেও ভাবেনি যে আজ এমন কিছু ঘটবে। কেনীথ বের হওয়ার আগেও পাভেলকে জানিয়ে ছিলো যে আজ কেনীথ আনায়াকে নিয়ে শিকদার বাড়িতে যাবে তবে তারা হঠাৎ কেনো ঐ রাস্তায়… আবার এমন দু*র্ঘটনা!পাভেলের মাথা পুরো ঘুরছে। তবে এতোটুকু বুঝতে পারছে যে এটা ইচ্ছেকৃত। এটা যে কেনীথ নিজে থেকেই করেছে তাও তার তীক্ষ্ণ মাথায় জানান দিচ্ছে । কিছু একটা নিশ্চিত হয়েছিলো নয়তো কেনীথ এমন কিছু কখনোই করতো না। পুরো গাড়ি এমন ভাবে খাদে পড়ে বিধ্বস্ত হয়েছে যে আনায়া আর কেনীথ যে চেয়ে বেঁচে রইছে এটাই বিস্ময়কর ব্যাপার। কিন্তু কথা হলো মিস লুসিয়াকে তিনি কি বলবে। সে শুনে কিভাবেই বা রিয়েক্ট করবে!

দেখতে দেখতে হসপিটালে আরো সাত দিন পেরিয়ে গেলো। আনায়া দু’দিনের মতো আইসিইউতে ছিলো। এরপর ওর অবস্থার উন্নতি হলে ওকে আলাদা কেবিনে শিফট করা হয়।
আনায়াকে মোটামুটি সুস্থ বলা চলে। এমনিতেও ওর খুব বেশি আঘাত লাগেনি যতটা কেনীথের ক্ষেত্রে হয়েছে। আনায়ার মাথার চেয়ে বেশি পাশে আঘাত লেগেছিলো। এখনও কপালে আর পায়ে সাদা রং এর ব্যান্ডেজ পেঁচানো। খাওয়া-দাওয়া,কথাবার্তা টুকটাক সব করতে পারলেও পায়ের জন্য হাঁটা-চলাটা ঠিকঠাক করতে পারে না সে। হয়তো খানিকটা খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাতটে হয় নয়তো হুইলচেয়ার ব্যবহার করতে হয়।

তবে এদিকে কেনীথের অবস্থা শুরু থেকেই নাজুক। আইসিইউতে নেওয়ার পর চব্বিশ ঘণ্টার অনেক আগেই আনায়ার জ্ঞান ফেরানো গেলেও কেনীথের ক্ষেত্রে বেঁধেছিলো বিপত্তি। কেনীথের জ্ঞান ফেরানো নিয়ে যেন এক বিশাল যুদ্ধের ময়দানে নেমে গিয়েছিলো হসপিটালের লোকজন। এদিকে এই খবর মিডিয়ার কানে যেতেই তা হয়ে যায় যে, কেনীথ নাকি আর বেঁচে নেই। আর এই খবর অফিসিয়ালি কেউ প্রকাশ করছে না। তবে এসবের ধার ধারতে একটু আগ্রহী ছিলো না পাভেল। সে যথাসাধ্য নিজের লোক লাগিয়ে চেষ্টা করছে যেন এই মিডিয়াতে নতুন কোনো প্রকার খবর না পৌঁছায়। নয়তো এদের কাজই হলো বিপদের সময় নতুন করে আরেক বিপত্তি বাঁধানো।
আর যখন কেনীথের জ্ঞান ফিরলো তখন পাভেল নিজেই সবার কাছে এই খবর ছড়িয়ে দিয়েছে। তবে কোনোভাবেই আনায়ার বিষয়ে কোনো কিছুই বাহিরে যেতে দেয়নি।

আনায়া চুপচাপ কেবিনে নিজের বেডে বসে রইছে। পাভেল বলেছিলো আজ নাকি কেনীথকে আইসিইউ থেকে আলাদা কেবিনে শিফট করা হবে। জ্ঞান ফেরার পর থেকে এখন পর্যন্ত একবারও তার আর কেনীথের সাক্ষাৎ হয়নি। ডাক্তারই নিষেধ করেছিলো এই ব্যাপারে। যেহেতু আনায়া নিজেও মানসিক আর শারিরীক ভাবে অসুস্থ তাই একেবারে কেনীথকে আলাদা শিফট করানোর পরেই সে কেনীথের সাথে দেখা করার সুযোগ পাবে।
এদিকে অবশ্য পাভেল কয়েকবার কেনীথের সাথে দেখা করে এসেছে। কিন্তু কেনীথ সেভাবে কোনো রেসপন্স করেনি ওর সাথে। আর দূর্ভাগ্যবশত কেনীথকে সর্বপ্রথম অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়ার পরই ট্রিটমেন্টের সুবিধার্থে ওর বড় বড় চুল গুলো একদম পুরোটাই কেটে ফেলা হয়েছে। মূলত কেনীথের জীবনে হয়তো এটাই প্রথম যে তাকে এমন কোনো এক্সিডেন্টের সম্মুখীন হতে হলো।

আর এদিকে আনায়া এখন যেনো আরো অদ্ভুত হয়ে গিয়েছে। সে নিজেও এখন বোঝে না, সে সবসময় কি ভাবে। নাহ, সে আর আগের মতো কিছু ভাবে না। সবসময় শূন্য মাথায় চুপচাপ বসে থাকে। যখন যে যেটা করতে বলে, তা করে নেয়। নিজ থেকে কিছু ভাবা কিংবা করার মতো সক্ষমতা আর তার নেই।
প্রায় অনেকক্ষণ পর পাভেল আনায়ার কাছে এলো। আনায়া চুপচাপ রইলেও কোথাও যেন মনে হচ্ছিলো সে এতোক্ষণ পাভেলেরই অপেক্ষায় ছিলো। পাভেল আসতেই তাকে জানালো যে কেনীথকে আলাদা কেবিনে শিফট করা হয়েছে। সে যদি চায় তবে তার সাথে দেখা করতে পারে। আনায়া এটা শুনে তেমন কোনো রেসপন্স করলো না। এদিকে পাভেল মোটামুটি জেনে গিয়েছে যে সেদিন আদতে কি ঘটেছিলো। সেসব জেনে শুধু সে হতাশই হয়েছে। এমনটা তার কখনোই প্রত্যাশা ছিলো না।

পাভেল কিছুক্ষণ আনায়ার পাশে দাঁড়িয়ে থাকার পর কি যেন ভেবে আর কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো না। বরং গিয়ে আনায়া পাশে টুল টেনে বসে পড়লো। এরপর খানিকটা ইতস্ততভাবে বলতে লাগলো,
“বলছিলাম…আপনি আমাকে নিজের ছোট ভাইয়ের মতোই ভাবতে পারেন। নয়তো কি যেন বলে…ও হ্যাঁ,দেবর মশাই না ভাই ;যাই হোক কিছু একটা।”
আনায়া ওর কথা শুনে পাশে ফিরে ওর দিকে তাকালো। ওর স্বাভাবিক চাহনিতে পাভেল খানিকটা তটস্থ হয়ে পুনোরায় বলতে লাগলো,
“দেখুন আপনার বাবার সাথে যেটা হয়েছে তা আমার মতে তা একদম ঠিক ছিলো। জানি সেসব অনেক বেশি নৃশংস কিন্তু ওসব তো আপনার বাবার প্রাপ্যই ছিলো।
কিন্তু বস আপনার সাথে যা পাগলামি করেছে তা আমি মোটেও সমর্থন করি না। উনি যা করছে তা নিঃসন্দেহে তার পাগলামি চিন্তাভাবনার জন্য অনেক খারাপই করেছে। অথচ আপনার কোনো দোষই ছিলো না। আমি মনে হয় কথা গুলো গুছিয়ে বলতে পারছি না।”
পাভেল একবার জোরে দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। পাভেল আনায়ার নজর থেকে নজর সরিয়ে মাথাটা খানিক নিচু করে বললো,

“আপনার কাছে আমার একটা অনুরোধ রয়েছে। জানিনা আপনি কি বলবেন কিন্তু আমি চাই যে আপনাদের দুজনের মাঝে সবকিছু ঠিক হয়ে যাক। দেখুন বসকে আমি সেই ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি। সে এরকম নয়। একদমই এরকম নয় সে। সময় আর পরিস্থিতি হয়তো আজ তাকে এমনটা বানিয়ে দিয়েছে। কিন্তু মন থেকে বলছি, আপনি যদি ওনার ভেতরটাকে পরখ করে দেখেন তো আপনিও বুঝতে পারবেন যে উনি এতোটাও খারাপ নয়। সে আসলে ধরে বেঁধে নিজের ভালো সত্তাকে এভাবে কলুষিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আমার মতে আপনিই…”
—“আমার কি করা উচিত?”

আচমকা আনায়ার মুখ থেকে কথা শুনতে পাবে তা পাভেল ভাবেনি। পাভেল আনায়ার এহেন কথায় মাথা তুলে আনায়ার দিকে তাকালো। আনায়াকে একদম স্বাভাবিকই মনে হচ্ছে। তবে এই সামান্য কথাতে যেন ভিন্ন কিছুর আঁচ পেলো পাভেল৷ পাভেল কয়েকবার চোখের পাপড়ি ঝাপটিয়ে বললো,
“আপনারা একটা সমাধানে চলে আসুন। আমি জানি বস একজন সাইকো তবে আপনি খেয়াল করে দেখুন,আপনার এক্সিডেন্ট হওয়ার পর সে নিজেকে কতটা শুধরে নিয়েছে। মানছি সেসব হয়তো নিজের উপর জোর খাটিয়েই করছে কিন্তু করছে তো! এসব কিন্তু বসের জন্য এক অবিশ্বাস্য বিষয়। আমি হয়তো উল্টোপাল্টা বলছি কিন্তু আপনি বুঝুন প্লিজ। আপনারা দুজনে মিলে চেষ্টা করলে সব ঠিক হয়ে যাবে।

বস জীবনে যা যা বদঅভ্যেস বানিয়েছে দেখবেন সব একদম ঠিক হয়ে গিয়েছে। আপনি বিশ্বাস করবেন কিনা জানিনা, তবে গত চারমাসে উনি একটা খারাপ কাজও করেছি। অথচ এতো দিনে তিনি ১০-১২ জনকে এমনিতেই উপরে পাঠিয়ে দেয়। কি আর বলবো, আমি জানি না।
কিন্তু আমার প্রত্যাশা একটাই যে আমি বস রুপের কেনীথকে নয় বরং আরো একবার বড় ভাই সরূপ ভিভান শিকদারকে দেখতে চাই।সেই বড় ভাই যার মাঝে কোনো অন্যায় থাকবে না। যে অন্যকে কষ্ট দিয়ে নিজে শান্তি পেতে চাইবে না। আমি আমাদের একটা স্বাভাবিক সংসার সচক্ষে দেখার আশা করি। একদম স্বাভাবিক মানুষের মতো দুজনে বাঁচুন, সে আশা করি। নয়তো আপনারা যে খেলায় রয়েছেন তাতে ধ্বংস ব্যতীত কখনোই কিছু পাওয়া যায় না। যার পরিণাম হিসেবে হয়তো আপনাদের অনাগত নিষ্পাপ সন্তানের বলী হতে হয়।”
আচমকা সন্তানের বিষয়টি উঠতেই আনায়ার চোখ ছলছল করে উঠলো। তবে মুখ ফুটে একটা কথাও বললো না। অন্যদিকে পাভেল ওকে এভাবে দেখে ঠোঁট চেপে হতাশাগ্রস্ত হয়ে মুচকি হাসলো।

এইভাবেই হসপিটালে আরো তিনদিন কেটেছে। অথচ এরমাঝে আনায়া এখন পর্যন্ত একবারও কেনীথের সাথে দেখা করতে চায়নি। পাভেল অনেক বার বলেছে কিন্তু আনায়া সেসব কথায় কোনো প্রতিত্তোর করেনি। আনায়ার থেকে কোনো রেসপন্স না পেয়ে পাভেলও তেমন আর জোর করতে পারেনি। কিন্তু এদের সম্পর্কের এমন অবনতি তাকে খুব হতাশ করছে।
আনায়া যেমন কেনীথের মুখ দেখতে আগ্রহী নয় তেমনি কেনীথও। এখন পর্যন্ত একবারও কেনীথ আনায়ার কথা কাউকে জিজ্ঞেস করেনি। ও কেমন আছে কিংবা কি খবর, কিছুই না! শুধু জ্ঞান ফেরার পর শুধু একবার পাভেল কে বলেছিলো যে, “ও কি ম*রে গিয়েছে?” পাভেল তখন কেনীথের এ ধরনের জিজ্ঞেসায় কিছুটা হকচকিয়ে গিয়েছিলো। মনে মনে ভাবছিলো যে, কেনীথ কি সত্যিই ম*রার প্রস্তুতিই নিয়েছিলো কিনা! তবে যথারীতি সে কেনীথকে তার সংক্ষিপ্ত উত্তরটা দেওয়া ব্যতীত আর কিছুই বলতে পারেনি।

বর্তমানে আনায়া কেনীথ দুজনেই আগের চেয়ে খানিকটা সুস্থ। আনায়া নিজে থেকেই মোটামুটি ভালোই হাঁটাচলা করতে পারে। অন্যদিকে কেনীথ খানিকটা কষ্ট করে হলেও নিজে থেকে বসতে কিংবা দাঁড়াতে পারে।
রাতটা খুব বেশি নয়। পাভেল কাজের জন্য একটু হসপিটালের বাহিরে গিয়েছে। যাওয়ার আগে যথারীতি পুরো হসপিটালকেই দুজনের দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়েছে। তবে পাভেল যে হসপিটালে নেই তা আনায়ার জানা নেই। একটু আগে একজন নার্স এসে তাকে কিছু ঔষধ খাইয়ে দিয়ে গিয়েছে। আপাতত খাওয়া দাওয়া শেষে চুপচাপ বেডে বসে বসে কিছু একটা ভাবছে।

আনায়া তো শুরু থেকেই পুরোটা সময় শুধু ভাবতেই থাকে তবে সেদিন পাভেলের বলা কথাগুলোর পর থেকে তা ভাবনাচিন্তা খানিকটা ভিন্ন রুপ নিয়েছে। আগে চোখেমুখে সবসময় মলিনতা বিরাজ করতো কিন্তু এখন ওর চোখে ভিন্ন কিছুর সন্ধান মেলে। ওর ভাবনাচিন্তার মাঝেমাঝেই চোখজোড়ায় লাল আগুনের শিখার ন্যায় তরান্বিত হয়ে ওঠে।
আনায়া আজ এতোদিন পর হঠাৎ কি যেন ভেবে কেনীথের সাথে দেখা করতে চাইলো। ও গিয়ে নার্সের কাছে পাভেলের কথা জানতে চাইলো। কিন্তু নার্স তাকে জানালো যে পাভেল হসপিটালে নেই, সে বাহিরে গিয়েছে। অতঃপর আনায়া ভেবে নিজেই নার্সের অনুমতি নিয়ে কেনীথের কেবিনে চলে গেলো।
আনায়া কেবিনে ঢুকতেই দেখলো কেনীথ হাতদুটো বেডে টানটান করে ভর দিয়ে বসে রইছে, মাথাটা খানিক নিচের দিকে ঝুঁকানো। তার সমানেই একজন নার্স মাথার সাদা ব্যন্ডেজটায় কিছু একটা করছে। নার্সের কাজ হয়তো প্রায় শেষ। নার্স আনায়ার দিকে তাকালে আনায়া স্বাভাবিক ভাবেই তাকায়। তবে নার্স হয়তো বিষয়টি বুঝতে পেরে নিজে থেকেই প্রয়োজনীয় কাজ গুলো দ্রুত সেরে রুম থেকে বেড়িয়ে পড়ে।

নার্স চলে যাওয়ার সময় দরজাটাও ভালো করে চাপিয়ে দিয়ে গিয়েছে। এদিকে আনায়াও কেনীথের থেকে অনেকটা দূরেই দাঁড়িয়ে। আর কেনীথও চুপচাপ বিছানায় একই ভাবে বসা। দুজনের মাঝে সম্পূর্ণ পিনপতন নীরবতা। প্রায় অনেকক্ষণ সময় একই ভাবে অতিবাহিত হওয়ার পর কেনীথ বলতে লাগলো,
“কি একটা কপাল নিয়ে এসেছিলাম! ম*রতে গিয়েও ম*রছি না।”
এই বলেই কেনীথ তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে মাথা তুলে পাশে ফিরে আনায়ার দিকে তাকালো। আনায়া একদম চুপচাপ স্বাভাবিক ভাবে দাঁড়িয়ে।তার ভাবমূর্তিতে বিশেষ কোনো পরিবর্তন নেই। কেনীথ পুনোরায় বললো,
“আবারও বাঁধা হয়ে গেলাম তাই না! বেঁচে যাওয়াটা মনে হয় উচিত হলো না।”
আনায়া এবারও কিছু বললো না। বরং ধীরে পায়ে কেনীথের দিকে এগিয়ে এলো। ওকে নিজের কাছে আসতে দেখে কেনীথ তাচ্ছিল্যের সাথে হাসলো।

” বল কি বলতে এসেছিস!”
আনায়া কেনীথের সামনা-সামনি দাঁড়িয়ে। কেনীথের প্রশ্নের উওরে নির্বিকারে বলে উঠলো,
“কিছু না!”
কেনীথ কিঞ্চিৎ কপাল কুঁচকে ফেললো। তবুও তার ঠোঁটে ঝুলছে তাচ্ছিল্যের হাসি।
“তবে আমি এখনো বেঁচে আছি কিভাবে, তা দেখতে এসেছিস?”
আনায়া মাথা নাড়িয়ে বললো,
“নাহ!”
—“হেয়ালি করবি না, বিরক্তি লাগছে!”
কেনীথের শক্ত চোখমুখের দিকে আনায়া নির্বিকার তাকিয়ে। তবে এবারও আলাদা কিছু বললো না। যে কারণে কেনীথ নিজেরই খানিকটা অস্থির হয়ে উঠলো।

—“কিছু বলার না থাকলে চলে যেতে পারিস। এতোদিন পর তোর মাঝে আমাকে দেখার জন্য দয়াধর্ম জেগেছে এটাই অনেক। আমাকে দেখে নিয়েছিস,বেঁচে রইছি আমি, এবার চলে যা!”
—“এতো অস্থির হচ্ছেন কেনো, আমি তো আপনার কোনো ক্ষতি করতে আসিনি।”
কেনীথ চুপ থেকে কিঞ্চিৎ হাসলো।
“কাহিনি কি বলতো! তোর এই স্বাভাবিক ভাবমূর্তিকেই আমার অস্বাভাবিক লাগছে।”
আনায়া চুপ রইলো। কেনীথ কিছুক্ষণ আনায়ার নির্বিকার চাহনিতে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থাকার পর আড়ালে দীর্ঘ শ্বাস ফেললো।
“বলেছিলাম যদি আমি ম*রি আর তুই বাঁচিস তবে তুই রেহানের কাছে চলে যাস। কারণ তোকে বাঁধা দেওয়ার জন্য আমার মতো কোনো জানো*য়ার থাকবে না।কিন্তু আমি এখনো বেঁচে রইছি দেখে এই নিয়ে চিন্তা হচ্ছে?
চিন্তার কিছু নেই, আমি এখনো কোনো বাঁধা দেবো না। তুই চলে যেতে পারিস। তোর বাপের সাথে যা করেছি তার জন্য মরে গেলেও আমি মাফ চাইবো না কিন্তু তোর সাথে যা করেছি তার জন্য…এখনো পুরোপুরি মাফ চাইবো না আমি। কারণ আমার হক ছিলো।”

—“আমি মানুষ! কারো ব্যক্তিগত সম্পদ নই যে, কেউ তার হক অনুযায়ী ভোগ করবে।”
কেনীথ চোখ ছোট ছোট করে আনায়ার দিকে তাকালো।
“হঠাৎ এতো কথা বলছিস যে! এবার এক্সিডেন্ট হয়ে কি মুখে খই ফোঁটার সিস্টেম চালু হয়ে গিয়েছে!”
—“উল্টোপাল্টা তো আপনিও বলছেন। এমন হাস্যরসের কথাবার্তা আপনার মুখে মানায় না।”
—“বাপরে, ভালো জানিস তো আমায়। এখন মূল কথায় আয়। আমার কাছ থেকে কিছু নিতে এসেছিস? সে রকম হলে আপাতত আমার কাছে নিজের জীবনটাই আছে। ওটা চাইলে দিয়ে দেবো, এখন নিজের এই ফালতু জীবন নিয়ে কোনো ইন্টারেস্ট নেই।”
—“দুঃখিত, আপনি ভুল ভাবছেন। আমি আপনার কোনো কিছু নয় বরং আপনার কাছে থাকা আমার নিজস্ব কিছু নিতে এসেছি।”
কেনীথ কপাল কুঁচকে বললো,

“তুই কি ডিভোর্স পেপার টাইপের কিছু চাচ্ছিস? দেখ তারা আমাদের বিয়েটা শুধু ধর্মীয় ভাবে হয়েছে সেখানে তোর বাপে আলাদা করে কোনো আইনি ডকুমেন্টস বানায়নি যে তোকে এখন আমাকে আলাদা করে ডিভোর্স দিতে হবে। দিতে হলে ধর্মীয় ভাবে তালাক… ”
—“আমার বোন কোথায়? ”
কেনীথ আনায়ার কথায় আকস্মিক ভাবে চুপ হয়ে গেলো। আনায়ার স্বাভাবিক চেহারাটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার কর কেনীথ মুখ ঘুরিয়ে পাশে নজর ফেরালো।
“মিঃ কেনীথ! আমি জানতে চাইছি আমার বোন ইনায়া কোথায়?”
কেনীথ নির্বিকারে বললো,
—“জানি না!”
আনায়া খানিকটা জোর গলায় বললো,
“জানি না মানে?”
কেনীথ মুখ তুলে আনায়ার দিকে তাকালো। অতঃপর নিজে থেকে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে ঠিকঠাক উঠে দাঁড়ালো। অবশ্য কেনীথের মতো এসব পাগলাটে মানুষদের জন্য এসব অস্বাভাবিক নয়।কেনীথ দৃঢ়তার সঙ্গে বললো,
“জানি না, মানে জানি না। পালিয়ে গিয়েছে ও!”
আনায়া খানিকটা বিস্ময়ের চোখে তাকিয়ে বললো,

“মিথ্যে বলবেন না। আর দয়া করে কোনো হেয়ালি করবেন না। আমার বোনকে ফিরিয়ে দিন, সত্যি বলছি নিজেদের এমন ব্যবস্থা করবো যে ম*রার পরও আপনি আমাদের সন্ধান পাবেন না। সর্বোচ্চ দূরে চলে যাবো আমরা। আমাদের নিয়ে আপনি কিংবা অন্য কারো আর কখনো কোনো সমস্যা হবে না। আমার জীবনে আর কিছু চাই না। সবার জীবনের অভিশাপ আমি কিন্তু এবার সবাইকে মুক্তি দিতে চাই। বলুন ইনায়া কোথায়?”
—“আমি জানলে, তোর সাথে এতো কথা বাড়াতাম না। আমার সত্যিই জানা নেই ও কোথায়। ওকে গত কয়েকমাসে আমিও অনেক খুঁজেছি কিন্তু পাইনি।”

এবার আনায়া খানিকটা জ্বলে উঠলো। চোখমুখ শক্ত হয়ে গেলো। এতোদিন অনেক সহ্য করেছে সঙ্গে অনেক কিছু ভেবে নিয়েছে এই ক’দিনে। কৌশলে পাভেলের কাছে ইনায়ার সম্পর্কে জানতে চেয়েও তেমন কিছু জানতে পারেনি। তবে এটুকু জানে যে তার বোন বেঁচে রইছে।আর এখন কেনীথ ও কিছু বলছে না। আনায়া এবার খানিকটা ঝাপটে কেনীথ জামার বুকের অংশটা খিঁচে ধরলো। এরপর হিসহিসিয়ে বললো,
“অনেক সহ্য করেছি, আমার বাপের সাথে যা করেছিস সেটা তার প্রাপ্য ছিলো। এটা নিয়ে না হয় আমি কিছু বলবো না। আমার সাথে যেটা করেছিস সেটাও আমার প্রাপ্য, কারণ আমি পাপী। এক নিষ্পাপ বাচ্চাকে মা/রার মতো জঘ*ন্য পাপ আমি করে ফেলেছি। হোক সেটা পুরোটা তোর কার্যকলাপের ফল হিসেবে, তবুও পাপটা আমিই করেছি।

আর আমি পাপী হওয়ার পাশাপাশি এক অভিশাপ। সবার জীবনের অভিশাপ আমি। প্রত্যেককে আমার জন্য ধ্বং/স হতে হয়েছে। কেউ চিরতরে হয়েছে আর কেউ প্রতিনিয়ত হচ্ছে। সব হিসেব-নিকেশ মিলিয়ে আমাকে জ্যান্ত পুড়ি/য়ে শাস্তি দিলেও আমার কোনো আফসোস রইবে না কিন্তু… আমার বোন, ও একটা অন্যায়ও করেনি। কোনো দোষ নেই ওর। তবে ওর সাথে কিসের শত্রুতা মেটাতে চাস তুই। বল ওকে কোথায় রেখেছিস, কি করেছিস ওর সাথে বল!”
কেনীথ এতোক্ষণ চুপচাপ সব শুনলেও শেষ মূহুর্তে আনায়ার হাতের থাবা শক্ত হয়ে এলে কেনীথের চোখমুখও আরো বেশি দৃঢ় হয়। পরবর্তীতে আনায়া খানিকটা চিল্লিয়ে বলতে নিলে কেনীথ শক্তহাতে আনায়ার গাল শক্ত হাতে চেপে ধরে আর ওকে ধাক্কা দিয়ে দেওয়ালের সাথে আঁটকে ফেলে। অতঃপর সে নিজেও হিসহিসিয়ে বলতে লাগলো,
“ও শুধু একা তোর বোন নয়। ও আমারও বোন হয়। তাই এসব হাদিস দেওয়া বন্ধ কর।”

“তাহলে বলছিস না কেনো ও কোথায়। কি করেছিস…”
কেনীথ আনায়ার গাল দুটো আরো বেশি জোরে চেপে ধরলো।
“সীমা অতিক্রম করিস না। শেষবারের মতো বলছি, মন দিয়ে শুনে রাখ। আমি জানি না, ইনায়া কোথায়। ও নিরুদ্দেশ হয়েছে। পারলে তুই নিজেও হয়ে যা। শান্তি পাই আমি। তোর এই বি/ষাক্ত চেহারাটা আমার একটুও দেখতে ইচ্ছে করে না। নিজেকে অভিশাপ ভাবিস না! তবে ম*রে যা, আমার সাথে সাথে বাকি সবাইও শান্তি পেয়ে যাবে। আর তা না পারলে অন্তত আর কখনো আমাকে নিজের এই মুখটা দেখাস না। যদি বিন্দু পরিমাণ লজ্জা সরম আর আত্মসম্মান থাকে তো তবে।”

কেনীথ এটুকু জোর গলায় বলেই আনায়াকে ছেড়ে দিলো। অতিরিক্ত উত্তেজিত হওয়ায় মাথাটা অত্যধিক ব্যাথা করছে। কেনীথ সম্পূর্ণ সাদা ব্যান্ডেজে মোড়ানো মাথায় একহাতে চেপে পিছিয়ে এসে ধপ করে বিছানায় বসলো। অতঃপর জোরে কয়েকবার নার্স বলে চিৎকার করতেই দ্রুত দুজন নার্স সহ ডক্টর এসে কেবিনে প্রবেশ করলো। তারা আসতেই সবাই কেনীথের পেছনে লেগে পড়লো।
এদিকে একপাশে চুপচাপ আগুন চোখে তাকিয়ে আনায়া। যেন কেনীথের প্রতি তার পুরো বিদ্বেষে ভরা ক্ষো/ভ গুলো তার স্বাভাবিক ভাবমূর্তিপূর্ণ শান্ত চোখের ক্ষি/প্ত চাহনিতে উপচে পড়ছে। আনায়া কিছুক্ষণ একই নজরে কেনীথকে দেখার পর কেবিন থেকে বেরিয়ে পড়লো।

তবে এর পর সে আরেকটা কাজ করে বসলো। কেনীথের কেবিন থেকে বেরিয়ে নিজের কেবিনে না গিয়ে সবার আড়াল হওয়ার চেষ্টা করলো। আনায়া হুট করে কি করতে চাইছে তা নিজেও জানে না। আজ মাথা ঠিকঠাক ভাবে চলার মতো নয়। কেনীথের শেষের কথাগুলো তাকে খুব বিরক্ত করছে। আনায়া অবাক হয় পৃথিবীর এতোসব বিচিত্র মানুষদের দেখে। এরা কতো অদ্ভুত! যে মানুষটা তার জীবনের সবকিছু শেষ করে দিয়েছে।সবদিক দিয়ে প্রতিনিয়ত তাকে টুকরো টুকরো করে ভাঙ্গতে চেয়েছে সেই এখন তাকে বলছে আত্মসম্মানের কথা। তার সতিত্বকে জানো/য়ারের মতো নিঃশেষ করে এখন দিচ্ছে লজ্জা সরমের দোহায়। পাগল, সব পাগল, সে নিজেও একটা পাগল আর পাগল ছাড়া দুনিয়া চলে না।

আনায়া অনেকটা সবার অগোচরেই হাসপাতালে থেকে বেরিয়ে গেলো। দুর্ভাগ্য বশত সে তার পাগলমিতে সফলও হয়ে গেলো। সে বেরিয়ে যাওয়ার সময় আলাদা করে সে কারো নজরে পড়লো না। যে কারণে তাকে বাঁধা দেওয়ার মতোও আর কেউ রইলো না।
এদিকে আনায়া আরো এক ভুল পদক্ষেপ নিয়ে বসলো। সে শহরের মেইন রোডের দিকে না গিয়ে হসপিটালের পেছনের রাস্তা ধরে এগোতে লাগলো। ক্ষো*ভের দরূন কি করছে, কেনো করছে কিচ্ছু মাথাতে নেই। শুধু এতোটুকু জানে যে আজ জীবনের সব রা*গ ক্ষো*ভ তার মাথায় আগুনের লাভার মতো ফুটছে। আর এটাই হয়তো তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল পদক্ষেপের মাঝে অন্যতম হয়ে দাঁড়াবে।
হসপিটালের এই রাস্তায় মানুষের আনাগোনা নেই বললেই চলে। তবে এই রাস্তা ধরে অনেকটা পথ এগোলে শহরের রাস্তায় প্রবেশ করা যায়। তবে এটা তেমন নিরাপদ নয়। পুরো রাস্তার আশপাশ জুরে বড় বড় গাছপালায় ঘেরা জঙ্গল। মাঝেমধ্যে অনেকটা দৈর্ঘ্য পর পর একটা আধভাঙ্গা ল্যাম্পপোস্টের দেখা মেলে।

কোনটায় আলো জ্বলেছে তো আবার কোনোটা একদম অকেজো হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে। আনায়া সেসবের ধ্যান জ্ঞান নেই। অল্পস্বল্প আলোতেই নিজের মতে হেঁটে চলছে। প্রায় দেখতে দেখতে মধ্য রাস্তায় চলে আসার পর হঠাৎ কিছু অদ্ভুত আওয়াজে ওর ধ্যান ফেরে। অনেকটা গায়ে কাটা দেওয়ার শিহরণে জেগে ওঠে আনায়া। চারপাশে ঘন জঙ্গল আর এদিকটায় ল্যাম্পপোস্ট নেই বললেই চলে। দূরের একটার আলোতেই চারপাশটা কোনোমতে দেখা যাচ্ছে। চারপাশে রাতের ঠান্ডা হাওয়াও বইছে। আনায়ার মনের ভয়টাকে আরেকটু বাড়িয়ে দিতে এই শীতল হাওয়া কাঁটার মতো গায়ে বিঁধছে। আনায়ার গায়ে হসপিটালের পাতলা পোশাক ব্যতীত আর কিছু নেই।

মধ্যে রাস্তায় এসে আনায়ার হঠাৎ থেমে যাওয়ার কারণ হলো কিছু মানুষের উদ্ভট হাসি। এই হাসি নিঃসন্দেহে বাজে কিছুর ইঙ্গিত দেয়। হাসিটা পেছন থেকে আসছিলো বিধায় আনায়া পেছনে তাকিয়ে দেখে তিনজন অদ্ভুত সব নোংরা পোশাক পড়া মাতাল লোক দাঁড়িয়ে রইছে। প্রত্যেকের হাতে একটা করে ম*দের কাঁচের বোতল। বড়বড় চুল,আর দেখতে একদম অরুচিকর। জঘন্য মাতাল রুপে ক্রমশ গা দুলিয়ে হাসছে আবার একে অন্যের উপর ঢেলে পড়ছে।
আনায়া এদেরকে দেখে আচমকা গলা শুকিয়ে এলো। পাশেই জঙ্গল, আজ তার সাথে কিছু একটা হয়ে গেলে তার শরীরের টুকরো গুলো হয়তো সকালে মাঝে জঙ্গলের পশুপাখিরা খেয়ে নেবে। কত অদ্ভুত ভাবে তার জীবনটা শেষ হয়ে যাবে। আনায়া আচমকা এসব ভাবতে গিয়েই দেখলো লোক তিনজন তার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। এদের মাঝে বেঁটে করে নোংরা জামাপ্যান্ট পড়া একজন বলতে লাগলো,

“কিরে শা/লী, এইখানে কি করোস। আমাদের বিনোদন দিবি নাকি!”
এই বলেই তিনজন অট্টহাসিতে হেঁসে ফেললো। অন্যদিকে আনায়া কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে গেলো। তবে মূহুর্তেই কিছুর সাথে ধাক্কা লাগতেই আনায়া ত্বরিত বিস্ময়ের সাথে পেছনে তাকালো। পেছনে তাকাতেই দেখতে পেলো তিন মাতালের মতো আরো দুটো লোক দাঁড়িয়ে রইছে আর দিকে তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে অনবরত বিশ্রি ভাবে হাসছে।
তবে এবার আর আনায়ার ভয় হলো না। আচমকা তার ভয় সংশয় সব পালিয়ে গিয়েছে। আনায়া এখন নিজেকে তাচ্ছিল্য করছে। ভাবছে জীবনে শেষ পরিণতি কি তবে এই হলো! হাস্যকর! এর আগে বৈধ ভাবে এক জা*নো*য়ার তাকে ছিড়েখুঁড়ে খেয়েছে আর আজ একদল জা*নো*য়ার তাকে অবৈধ ভাবে খাবে। ঘুরেফিরে তো সবই একই, পার্থক্যটা শুরু বৈধ অবৈধতার।আর সে তো হলো শুধু ভোগের বস্তু। চারপাশে এতোগুলো মানুষের বিশ্রী হাসির মাঝে আনায়া আরো একবার তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে ফেললো।

প্রায় অনেকটা রাত হওয়ার পর হসপিটালে পৌঁছাতেই পাভেলের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে। আনায়া হসপিটালের কোথায়ও নেই। হসপিটালের সবার সাথে রাগারাগি ঝারা ঝারি করতে করতে সোজা সিসিটিভি চেক করলো। খেয়াল করে দেখলো আনায়া হসপিটালের পেছনের রাস্তার দিকে গিয়েছে।
মাথা যেন তার সেখানেই হ্যাং হয়ে গেলো। এই খবর আর রাতে কেনীথকে দেওয়া হলো না। সে এতোক্ষণে ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়ে গিয়েছে। কিন্তু পাভেল এটা বুঝতে পারছে না যে হসপিটালের মানুষজন কতটা কেয়ার লেস হলে এতোক্ষণ ধরে একটা পেশেন্ট গায়েব থাকার পরও তারা কেনো… অন্তত তাকে জানানো তো উচিত ছিলো। এতো বার করে বলে রেখে গিয়েছিলো অথচ তারা কেউ দেখলোও না যে আনায়া হসপিটাল ছেড়ে এতোদূর চলে গিয়েছে।
এটা হওয়ারও অবশ্য খানিকটা কারণ রয়েছে। আনায়ার দায়িত্ব যে নার্সের কাছে ছিলো সে ততটা দায়িত্বশীল ছিলো না।হেঁয়ালিটা বেশি ছিলো তার কাজে। এছাড়া আনায়া অনেকটা সুস্থও ছিলো। আর সবচেয়ে বড় বিষয় পুরো হসপিটাল এখন কেনীথের চিন্তাতেই থাকে। আগে কেনীথ তো পরে বাকিরা।
কিন্তু এসব পাভেল এখন বোঝার মাথায় নেই। সে হসপিটালের দায়িত্বহীনতার ব্যবস্থা পরে করে নেবে। আগে অন্তত আনায়ার কাছে পৌঁছাতে হবে। পাভেল নিজেই গাড়ি নিয়ে হসপিটালের পেছনের রাস্তায় চলে গেলো সঙ্গে তার লোকজনকেও সেখানে আসতো বললো।

পরদিন সকাল বেলায়। হসপিটালকে খানিকটা অদ্ভুত লাগছে কেনীথের। মনে হচ্ছে কিছু একটা ঠিক নেই। আর হয়তো কয়েকটা দিন। এরপর ওকে এখান থেকে মুক্তি দেওয়া হবে। অবশ্য এবার নিজে রাজি ছিলো বিধায় এতোদিন হসপিটালে থেকেছে নয়তো তার মতো লোক হসপিটালে দিনের পর দিন পড়ে থাকতে তা অবিশ্বাস্য।
কেনীথ সকালের খাবার আর ঔষধ খেয়ে দেয়ে পাভেলের জন্য অপেক্ষা করছে। চুপচাপ বেডে বসে বসে ভাবছে যে কেনীথকে সে যে কাজে পাঠিয়েছিলো তা আদোও ও করতে পেরেছে কিনা। এই ইনায়া গায়েব হওয়ার পর নতুন অনেক ঝঞ্ঝাট এসে দেখা দিচ্ছে। কেনীথের মনে হচ্ছে নতুন দেখা দেওয়া সমস্যাগুলোর পেছনে ইনায়ার গায়েব হওয়াটা কোনো না কোনো ভাবে সম্পৃক্ত। তবে কেনীথ একদম নিশ্চিত নয়।

কিন্তু সে আপাতত বিরক্ত হচ্ছে পাভেল এখনো আসছে না দেখে। মেজাজ পুরো বিগড়ে যাচ্ছে তার। এরই মাঝে কেনীথ একটা নার্সকে ডেকে বললো যে যদি পাভেল হসপিটালে থাকে তবে সে যেন একটু তার কাছে আসে। এদিকে নার্স তার কথা মতো চলে গেলেও কেনীথ সকাল থেকে ডাক্তার নার্সদের বিহেভিয়ারে খানিকটা অবাক হচ্ছে। বুঝতে পারছে না হঠাৎ সবার হয়েছে টা কি। যেন এদের মধ্যে একটা আ*তংক ছড়িয়ে রইছে। অনেকটা দিন ধরেই তো হসপিটালের রইছে এর আগে তো এদের এমন পরিবর্তন হয়নি। তবে হঠাৎ কেনো সবাই… হসপিটালে কি আবার কিছু হয়েছে কিনা তাও বুঝতে পারছে না।
কেনীথের অসহ্যকর অপেক্ষার মাঝেই পাভেল কেবিনে এসে প্রবেশ করলো। ওর ফর্সা চোখমুখ লাল গিয়েছে। মনে হচ্ছে খুব করে কেঁদেছে। কেনীথ ওর ভাবমূর্তিতে কপাল কুঁচকে ফেললো। পাভেলের লাল চোখজোড়া ছলছল করছে। না জানি কখন আবার টুপটাপ পানি গড়িয়ে পড়ে।

কেনীথ অনেকটা বিরক্ত হয়ে বললো,
“চেহারার এই হাল কেনো,কি হয়েছে?”
পাভেল কেনীথের একদম কাছে এসে দাঁড়ালো। ও রীতিমতো ফুঁপিয়ে চলেছে। কথা বলতে গিয়ে যেন ওর গলায় কাঁটার মতো বিঁধছে।
“বস! গত রাতে হসপিটালের পেছনের রাস্তায় জঙ্গলে একটা মেয়ের লা/শ পাওয়া গিয়েছে। পুলিশ পোস্টমর্টেমের জন্য লা/শটাকে নিয়ে গিয়েছে। তাদের প্রাথমিক রিপোর্ট অনুযায়ী মেয়েটিকে ৩-৫ জন্য গনধ/র্ষ/ন করেছে। এরপর শরীরের বিভিন্ন অংশ কাঁচের টুকরো গেঁথে ফেলাও হয়েছে।আর সর্বশেষে মেয়েটার শরীরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। মেয়েটার পুরো শরীরের প্রায় অনেকটাই ঝলসে গিয়েছে।”
এই বলতে বলতেই পাভেলের চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা জল নিচে গড়িয়ে পড়লো। এদিকে কেনীথ একজনরে ভ্রু কুঁচকে পাভেলের দিকে তাকিয়ে রইছে। এতোক্ষণ মনোযোগ দিয়ে ওর সব কথা শোনার পাশাপাশি ওর ভাবগতিক লক্ষ করে বললো,

“তুইও কি মেয়েটাকে দেখতে গিয়েছিলি?”
পাভেল কান্না আটকাতে ঠোঁট চেপে মাথা ঝাঁকাল।কেনীথ আরেকটু তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললো,
“তুই কি মেয়েটাকে চিনিস?”
পাভেল পুনোরায় মাথা ঝাঁকিয়ে বললো,
“হুম!”
“আমিও কি চিনি?”
—“হুম!”
কেনীথ খানিকটা সময় চুপ থাকার পর কিছু একটা ভেবে বললো বিস্ময়ের সাথে বললো,
“পাভেল তুই আবার ইনায়া…”

পাভেল দ্রুত মাথা নাড়িয়ে না বললো। কেনীথ এতে যেন বড়সড় স্বস্তি পেলো। কিসব ভাবতে বসেছিলো সে। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বিরক্তির সাথে পাভেলের দিকে তাকিয়ে বললো,
—“তবে কার কথা বলছিস গাধা!যার জন্য এভাবে কেঁদে…”
এরই মাঝে পাভেল প্যান্টের পকেট থেকে একটা প্লাস্টিকের প্যাকেট বের করে কেনীথের সামলে ধরলো। স্বচ্ছ ব্যাগের ভেতরে দুটো লকেট দেখা যাচ্ছে। একটা স্টার আর একটা ঝিনুক আকৃতির। এই দুটো লকেটকে কেনীথ ভালো করেই চেনে। কিন্তু এগুলো এভাবে কেনো পাভেলের হাতে আবার…কেনীথের হিসেব ঠিক মিলছে না।পাভেল আদতে কি বলতে এসেছে। এরই মাঝে পাভেল কেনীথের হাতে প্যাকেটটা দিলে কেনীথ সেটা হাতো নিয়ে দেখলো। অতঃপর সেগুলো মুঠো করে পাভেলের দিকে তাকিয়ে বললো,
“এগুলো কেনো?”
—“এগুলো আনায়া ম্যামের।”
—“হ্যাঁ,আমি জানি কিন্তু…”
এরই মাঝে পাভেল ফুঁপিয়ে উঠলে কেনীথ আকস্মিক দাঁড়িয়ে গিয়ে পাভেলকে খাবলে ধরলো। ওর হুডির গলা শক্ত করে চেপে হিসহিসিয়ে বললো,
“হোয়াট দ্য ফা*/ক ইজ দিস! কি বলতে চাস তুই?”
—“বস, আনায়া ম্যাম…”
কেনীথ আকস্মিক পাভেলর মুখ বরাবর ঘুষি মারতেই পাভেল ছিটকে দূরে সরলো। হাত দিয়ে নাক মুছতে গিয়ে একগাদা রক্তে হাত ভিজে উঠলো। এদিকে কেনীথ পাগলের মতো পাভেলর দিকে এগিয়ে এসে আবারও ওর হুডির গলা টেনে ধরে হিসহিসিয়ে বললো,

“কি হয়েছে তারার! বল তাড়াতাড়ি… ”
পাভেল খানিকটা হাঁপিয়ে হাঁপিয়েই বলতে লাগলো,
“কাল রাতে হসপিটাল থেকে কাউকে না জানিয়েই সে চলে গিয়েছে। হসপিটালের পেছনের রাস্তা দিকে…কোথায় যেতে চেয়েছিলো জানি না। তবে আমি তার যাওয়ার খবর যতক্ষণে জানতে পেরেছি ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিলো। আমি যাওয়ার আগেই ওনাকে একদল জানো/য়ার সম্পূর্ণ শেষ করে দিয়েছে।”
পাভেলের র*ক্তমাখা চেহারায় কান্নার স্রোত বইছে।কেনীথ পাভেলের দিকে শূন্য চোখে তাকিয়ে। ওর আ/ক্রোশ রাগ সবকিছু নিভে গিয়েছে। কেনীথ আকস্মিকতায় পাভেলকে ছেড়ে দিলো। অতঃপর স্বাভাবিক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো যে,
“তুই কি সিওর যে ওটা তারাই। তুই তো বললি মেয়েটাকে একদম পু/ড়িয়ে…”

একজোড়া আগুন পাখি পর্ব ৩২

কেনীথের কথা শেষ হওয়ার আগেই পাভেল বললো,
“মেয়েটার পরনে হসপিটালের ড্রেস ছিলো। আশেপাশের জামার টুকরো থেকেই তাই জানা গিয়েছে। গলাতেও এই দুটো লকেট হয় চেইন পাওয়া গিয়েছে। যেগুলো মূলত ওনারই। এছাড়া ডিএনএ রিপোর্ট এলেই বাকিটা নিশ্চিত হওয়া যাবে কিন্তু ধারণা করা হচ্ছে ৯৯%… উনি আনায়া ম্যামই।”

একজোড়া আগুন পাখি পর্ব ৩৪