একজোড়া আগুন পাখি পর্ব ৩৮
রনীতা তুশ্মি
আনায়া কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের ন্যায় তার পেছনে থাকা ব্যক্তিটিকে দেখল। ব্যক্তিটির হাতের পিস্তলটা এখনো ইনায়ার দিকে তাক করে রাখা। আনায়া পাভেলকে এহেন কাজ করতে দেখে সম্পূর্ণ হতবাক। অন্যদিকে আনায়ার স্তব্ধ ভাবগতিক দেখে পাভেল বিচলিত হয়ে বললো,
“আপনি ঠিক আছেন তো?”
আনায়া কিছু বলল না। বরং সেভাবেই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। অন্যদিকে পাভেলের নজর পড়ে কেনীথের দিকে। কেনীথের এহেন অবস্থায় পাভেল নিজেও হতভম্ব। সে আনায়াকে পাশ কাটিয়ে একপ্রকার দৌড়ে কেনীথের কাছে যায়। তড়িঘড়ি করে ছটফটিয়ে অতিদ্রুত কেনীথের হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিতে উদ্বিগ্ন সে। অন্যদিকে আনায়ার মস্তিষ্ক খানিকটা সচল হয়ে উঠতেই সে একবার কেনীথ আর পাভেলের দিকে নজর বুলিয়ে পুরনোয় মাটিতে পড়ে থাকা ইনায়াকে দেখে। অতঃপর খানিকটা ছুটে ইনায়ার কাছে পৌঁছে,ওর পাশে বসে পড়ে। ইনায়া চোখ বুঁজে রইছে, শ্বাসও ধীর গতিতে ছুটছে। চারপাশটা লাল র”ক্তে পরিপূর্ণ। অন্ধকারে যা স্রেফ কালচে তরল পদার্থের মতোই মনে হচ্ছে। আনায়া ইনায়ার এহেন অবস্থায় নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরল৷ আকস্মিক তার চোখে পানি এসে ভীর করছে। অসহ্য লাগছে এই জীবনকে। সবাই কেনো এভাবে চোখের সামনে শেষ হয়ে যাচ্ছে। একটা স্বাভাবিক জীবন তো তাদেরও হতে পারতো কিন্তু…।
আনায়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইনায়াকে আঁকড়ে ধরে। ইনায়ার মাথাটা কোলের উপর তুলে অসহায়ত্বের সাথে ডাকতে লাগে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
—“ইরা! ইরা! বোন আমার উঠে যা। কত্ত বড় হয়ে গিয়েছিস তুই। আমি ভেবেছিলাম তোকে হয়তো আর কখনো খুঁজেও পাবো না কিন্তু এখন… এতো বছর পর আমি তোকে এভাবে পেতে চাইনি। তুই কথা বল প্লিজ।”
আনায়া অনবরত ডাকে কিন্তু ইনায়া ওঠে না। এরই মাঝে পাভেল আনায়াকে এভাবে কাঁদতে দেখে খানিকটা কপাল কুঁচকে ফেলল। কেনীথের বাঁধন গুলো খোলা শেষ হলে আনায়ার কাছে এগিয়ে এসে বলল,
“আপনি এভাবে কাঁদছেন কেনো? ও কে?”
আনায়া পাভেলের কথায় ওর দিকে নজর উঁচিয়ে দেখে পুনোরায় ইনায়ার দিকে তাকিয়ে কাঁপাকাঁপা স্বরে বলল,
“ও ইনায়া… আমার একমাত্র বোন।”
এটুকু বলেই আনায়া কেঁদে ওঠে। অন্যদিকে পাভেল খানিকটা বিস্ময়ের স্বরে বলল,
“কিহ! ও-ই ইনায়া?”
আনায়া মাথা ঝাঁকায়। পাভেল কিছুটা ব্যস্ততার সাথে বলে,
“আপনি কাঁদবেন না প্লিজ, কিচ্ছু হবে না ওর।”
এই বলেই পাভেল গিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে সিঁড়ির উপরের দিকে উদ্দেশ্য করে চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে কয়েকজন লোককে ডাকে। সঙ্গে সঙ্গে উপর হতে কিছু লোক নিচে নামতে লাগল। প্রথমে দুজন গিয়ে কেনীথকে ধরাধরি করে নিয়ে যেতে লাগে। কেনীথের মনে হচ্ছে যেন পুরো শরীর অসাড় হয়ে আসছে। তবুও যথাসাধ্য নিজেকে সামলে নিয়ে এগিয়ে যায়। তবে তার নজর পুরোটা সময় রইল আনায়ার দিকে। আনায়া শক্ত চোখের চাহনিতে একবার তাকালেও নিমিষেই তার নজর এক অজানা তিক্ততায় ফিরিয়ে নেয়।
কেনীথও খানিকটা ভারী দীর্ঘ শ্বাস ফেলে সেই ঘরটা থেকে বেড়িয়ে যায় লোকগুলোর সাথে। অন্যদিকে ইনায়াকে পাভেল তড়িঘড়ি করে পাঁজাকোলে তুলে নিয়ে, আনায়াকেও জায়গাটা থেকে দ্রুত বেড়িয়ে যেতে বলে। আনায়ার চোখেমুখে অজানা ভয় আর অস্থিরতা রইলেও ও ইনায়ার সঙ্গ ছাড়লো না। পাভেলের সাথে সাথে রুম থেকে বেড়িয়ে যেতে লাগল। তবে আনায়া কেনো যেন এসবের মাঝেও আশপাশে ইতস্ততভাবে চোখ বুলাতে লাগল। যার ফলে ও সবার চেয়ে অনেকটা পেছনে পেছনে পড়ে যায়। বাকিরা সকলেই উপরে চলে গিয়েছে। যথারীতি আনায়া সিঁড়ির দিকে এগোতে নিলে আচমকা আশপাশ থেকে কিছু আওয়াজ কানে আসে।
আনায়া কিছুটা কপাল কুঁচকে ফেলে। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে চেয়েও আর ওঠে না। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো সিঁড়ি পাশে একটা দরজা রয়েছে। বুঝতে আর বাকি নেই দরজার ওপাশ থেকেই শব্দগুলো আসছে। মনে তো হচ্ছে রুমের ভেতরে কেউ রয়েছে। আনায়ার মনোযোগ হঠাৎ এদিকে সরে এসেছে। দরজাটার সামনে গিয়ে চুপচাপ দাড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করে, আওয়াজটা কিসের। অদ্ভুত এক গোংরানির আওয়াজ। নিমিষেই আনায়ার কপাল কুঁচকে যায়। তবে খুব বেশি একটা সময় না নিয়ে দরজাটা খোলার চেষ্টা করে। তখনই খপয়াল করে বাহির থেকে তালা লাগানো। আনায়া খানিকটা দৃঢ়তার সাথে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে হাতের পিস্তলটা দিয়ে তালাটা ভেঙ্গে ফেলে।
পরবর্তীতে এক মূহুর্তেও দেরি না করে সোজা দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে যায়। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঘরের কোণা থেকে কারো নড়াচড়া আর উদ্ভট গোংরানির আওয়াজ মিলছে। আনায়া সাবধানে রুমের ভেতর খানিকটা এগিয়ে যেতেই খেয়াল করে, রুমের মাঝ বরারব একটা লাইট টাইপের কিছু ঝুলছে। রুমে যেহেতু লাইট রয়েছে তবে আশেপাশে নিশ্চয় সুইচ বোর্ডও রয়েছে। আনায়া দরজার আশপাশে দেওয়ালে হাতিয়ে সুইচ বোর্ডটা খুঁজে পেতেই রুমের লাইটটা অন করল।
নিমিষেই আকস্মিক কারো চেঁচাচেচিতে আনায়ার নজর গিয়ে ঠেকে ঘরের কোণায়। কিছু সময়ের জন্য আনায়া সম্পূর্ণ হতভম্ব হয়ে যায়। ছন্নছাড়া কুৎসিতের ন্যায় অর্ধনগ্ন এক মানব রুমের কোণায় ঝটফট করছে। পায়ে তার মোটা শিকল বাঁধানো। হাত পা সহ শরীরের প্রত্যেক জায়গায় ছোট বড় বিশ্রী সব পঁচা ঘা। মাংস শুকিয়ে গিয়ে শরীরের চামড়া ফেড়ে যেন হাড়হাড্ডি সব বেড়িয়ে আসছে। পুরো মুখ বড় বড় দাঁড়ি আর চুলে ভর্তি।
মূলত হঠাৎ রুমে আলো জ্বলায় এই ন”রখাদক মানবের এহেন অবস্থা। ধসে পড়া নোংরা দেওয়ালের আবদ্ধ ঘরে তাকে বেশিরভাগ সময়ই কাঁটাতে হয়।আর হুট করে অন্ধকারে থাকা অস্তিত্বটা আলোর স্পর্শে এলে ছটফটিয়ে ওঠে। কিছুক্ষণ সময় একইভাবে অতিবাহিত হবার পর নরখা”দক ছেলেটি কিছুটা স্বাভাবিক হলো।এতোক্ষণ দু’হাতে মাথা ঢাকার চেষ্টা করলেও, এখন সে ধীরে ধীরে মুখ উঁচিয়ে আনায়ার দিকে তাকানোর চেষ্টা করে।
আনায়া খানিকটা বিস্ময়ের সাথে ছেলেটির দিকে এগিয়ে যায়।সেই সঙ্গে হাতের পিস্তলের স্লাইডটাও টেনে নেয়। ওদিকে ছেলেটি একদম বাচ্চাদের মতো আনায়ার দিকে বিস্ময়ের চাহনিতে তাকিয়ে। যেন বোঝার চেষ্টা করছে, আনায়া হয়তো তার পরিচিত কেউ। অন্যদিকে আনায়াও ছেলেটির দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে। অন্ধকার রুমের সামান্য বাল্বের আলোয় ছেলেটির চেহেরা পরিষ্কার নয়।
আনায়া আরেকটু সমানে এগিয়ে যেতেই ছেলেটি কিছুটা অস্থির হয়ে ওঠে।নিচে বসে থাকা অবস্থাতেই ঘেঁষে ঘেঁষে আনায়ার দিকে এগিয়ে আসে। দেখে মনে হচ্ছে, উঠে দাঁড়ানোর মতো নূন্যতম শক্তি তার নেই। আনায়ার অনেকটা কাছে আসতে নিলে শিকলে টান পড়ায় সে থেমে যায়। আনায়ার দিকে করুন চোখে তাকিয়ে শিকল খুলে দিতে ইশারা করে।
এদিকে আনায়া কি করবে তা বুঝতে পারছে না। আবার এখান থেকে বেড়িয়ে যেতেও ইচ্ছে হচ্ছে না। কিন্তু তবু সে নিজের হাতে থাকা পিস্তলের দিকে তাকায়। কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে ছেলেটির শিকলের মাঝে গুলি করতেই তা তা দুখণ্ড হয়।ছেলেটি ছাড়া পেয়েছে তা বুঝতেই বিস্তৃত হাসিতে তার মুখ ছেয়ে যায়। সেই সাথে আকস্মিক উম্মাদের মতো আচরণ করতে লাগে।
ছেলেটির হাভভাবে আনায়া কিছুটা অবাক হয়ে কয়েক পা পিছিয়ে যায়। কিন্তু খুব বেশি সুযোগ হয় না তার নিজেকে রক্ষা করার। বরং ছেলেটি উম্মাদের ন্যায় আনায়ার দিকে ধেয়ে আসে। আনায়া প্রচন্ড বিস্ময়ের সাথে ছুটতে শুরু করে। মাঝে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে নিচে পড়ে যাওয়ায় আর তার দরজা লাগানো সম্ভব হয় না। বরং কোনো মতে দৌড়ে রুম থেকে বেড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগে। কিন্তু এরই মাঝে পেছন থেকে ছেলেটি আধা শিকল বাঁধা পা নিয়ে অনবরত আনায়ার পেছনে ছুটতে থাকে। লোহার শিকলের শব্দে মাটির নিচের আবদ্ধ জাগয়াটা যেন বারবার লোমহর্ষক ধ্বনিতে মেতে উঠেছে।
এদিকে আনায়ার অসাবধানতার কারণে সিঁড়িতে পড়ে গিয়ে পুনোরায় উঠতে নিলে পেছন থেকে ছেলেটি আনায়ার পা টেনে ধরে। আনায়া কোনো মতে লাথি ঝাড়ি দিয়ে পা ছাড়িয়ে নিয়ে পুনোরায় তড়িঘড়ি করে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকে। সবশেষে গিয়ে উপরে পৌঁছাতেই হাঁপিয়ে ওঠে। এদিকে আকস্মিক এতো শব্দ আর হুড়োহুড়িতে উপরে থাকা লোকজনগুলো অবাক হয়ে বিষয়গুলো বোঝার চেষ্টা করে। হঠাৎ কি থেকে কি হলো তা যেন কেউই বুঝে উঠতে পারছে না।
সেই সাথে আনায়া খেয়াল করলো উপরে থাকা নার্স সহ বাকি আরো কিছু পাভেলের লোকজন ছোটাছুটি করছে। তবে আশেপাশে কোথাও পাভেল নেই। সেই সাথে ইনায়াকে অন্য একটা লোক পাজকোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সবার এই বিস্ময়ের মাঝেই পেছন থেকে নরখাদক ছেলেটির উপরে উঠে এলো। নার্সদের হাবভাবে মনে হলো তারা এই ছেলেটিকে ভালো করেই চেনে, সেই সাথে ছেলেটিকে দেখামাত্রই নার্স সহ প্রত্যেকেই আ”তংকে, বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গিয়েছে।
নার্স সহ যে যার মতো পিছিয়ে দূরে সরে যায়। অন্যদিকে আনায়া সহ বাকি কয়েকজন কিছু করে উঠবে এর পূর্বেই ছেলেটির নজর পড়ে ইনায়ার দিকে। সবকিছু ছাড়িয়ে সে ইতস্তত হয়ে ছুটে যায় ইনায়ার কাছে। পাগলের মতো হাঁপাতে শুরু করে। ইনায়ার কাছে যাওয়া মাত্রই ছেলেটির পাগলামি দেখে ইনায়াক কোলে নিয়ে থাকা ব্যক্তিটি খানিকটা ঘাবড়ে যায়। সেই সাথে ছেলেটি যখন বারবার ইনায়াকে ছোঁয়ার জন্য ব্যক্তিটির দিকে আক্রমনাত্মক ভাবে উম্মাদের মতো করতে শুরু করে,তখন ইনায়াকে ধরে রাখা ব্যক্তিটি কোনো মতে ভয়ে হাঁটু গেঁড়ে ইনায়াকে নিচে শুইয়ে দিয়ে সরে যায়।
তবে আশেপাশ থেকে বাকি লোকজন ছেলেটিকে ধরার চেষ্টা করার পূর্বেই ছেলেটি অদ্ভুত আচরণ করতে লাগে। এতোক্ষণ যে উম্মাদের মতো আক্রমনাত্মক আচরণ করছিল, সে এখন হু হু করে কান্না করছে। কখনো ইনায়ার নিথর দেহকে জড়িয়ে ধরছে, তো কখনো ইনায়ার মুখ আলতোভাবে ধরে জাগানোর চেষ্টা করছে। তবে তার বলা অদ্ভুত আওয়াজ গুলোর কোনো কিছুই স্পষ্ট নয়।
ওদিকে আনায়া বাকিদের মতো কিংকর্তব্যবিমুঢ়ের ন্যায় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে। সবকিছু যেন তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। এই মূহুর্তে তার ঠিক কেমন রিয়েক্ট করা উচিত তাও তার অজানা। হুট করেই তার মস্তিষ্কে অদ্ভুত সব চিন্তা ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে। মনে হচ্ছে এই ছেলেটাকে হয়তো সে চেনে। কিন্তু এমন একটা জরাজীর্ণ মানবকে সে কি করে চিনতে পারে তাই আনায়া বুঝে উঠতে পারছে না।
বিস্ময়ের চোখে ছেলেটির কাজকর্ম স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখছে। পরিস্থিতি সামলাতে আনায়া এবার ওদের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলে,আচমকা বাহির থেকে তড়িঘড়ি করে পাভেল ভিতরে প্রবেশ করে।
—“কি হলো, এখনো ইনায়াকে নিয়ে যাওয়া…”
পাভেলের কথা আর সম্পূর্ণ হলো না।ভেতরের পরিস্থিতি দেখে সে অনেকটাই অবাক। এখানে হচ্ছেটা কি? সে তো গাড়ি ঠিক করে কিছুক্ষণের জন্য বাহিরে গিয়েছিলো সেই সাথে ইনায়াকে দ্রুত গাড়ির কাছে নিয়ে যেতে বলেছিলো। কিন্তু অনেকক্ষণ সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও যেন কারো কোনো খোঁজ খবর পাওয়া গেলো না তখন দ্রুত ছুটে ভেতরে চলে আসে।
পাভেল একবার আনায়া সহ বাকিদের দেখছে, সেই সাথে এই অদ্ভুত পাগলের কার্যকলাপ দেখছে।
—“কি হয়েছে সবার? এই পাগলটা আবার কে?”
পাভেল কথা বলতে বলতেই ইনায়ার দিকে এগিয়ে যায়। ছেলেটির গায়ে হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে নিতে গেলে আকস্মিক ছেলেটি ক্ষিপ্ত হয়ে পাভেলের হাতে কামড়ে দেয়। পাভেল নিমিষেই ব্যাখা আর রাগের চোটে ছেলেটির গায়ে লাথি দেয়। ফলে পাভেল নিজের হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার পাশাপাশি ছেলেটিও আঁচড়ে নিচে শুয়ে যায়।
পাভেল নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে দেখে হাত থেকে র*ক্ত গড়িয়ে পড়ছে। মূহুর্তেই সম্পূর্ণ মেজাজ বিগড়ে যায় সেই সাথে চিৎকার দিয়ে সবার উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
“এখানে কি সবাইকে,তামাশা দেখতে নিয়ে এসেছি আমি? আর এই পাগল কে?ইনায়াকে গাড়িতে নিয়ে যেতে বলেছি সেই কখন অথচ ও এখানে পড়ে রয়েছে কেনো?…তাকিয়ে তাকিয়ে আমার চেহেরা না দেখে পাগল-ছাগলটাকে দূরে সরা আর ইনায়াকে গাড়িতে নিয়ে যা। হসপিটালে নিতে বেশি দেরি হলে, প্রবলেম হয়ে যাবে।”
পাভেলের কথা অনুযায়ী, যে যার মতো এদিকটায় ছুটে আসে। তড়িঘড়ি করে ইনায়াকে একজন কোলে তুলে নেয়, বাহিরে যাওয়ার উদ্দেশ্য। কিন্তু এতে যেন ছেলেটি আরো বেশি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। উম্মাদের ন্যায় সেদিকে তেড়ে আসতে নিলে সবাই আবারও কিছুটা ভড়কে যায়। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে পাভেল আশপাশে খুঁজে একটা লাঠি খুঁজে পেতেই তা দিয়ে সোজা ছেলেটির মাথায় জোরে আঘাত করতে বসে। মূহুর্তেই সে মাথা ঘুরে নিচে পড়ে যায়।
এদিকে ইনায়াকে লোকজন নিয়ে গাড়ির কাছে চলে গিয়েছে। কিন্তু আনায়া এখনও স্তব্ধ হয়ে সবকিছু দেখে যাচ্ছে। খানিকটা সময়ের জন্য নিজের এই হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে যাওয়াটা তার কাছে অজ্ঞাতই রইল। আনায়ার এই চুপ থাকার মাঝেই পাভেল তার কাছে গিয়ে বলতে লাগলো,
“আপনাকে এমন কেনো দেখাচ্ছে? চিন্তা করবেন না, কারো কিচ্ছু হবে না। ভাইকে আগেই হসপিটালের জন্য পাঠিয়ে দিয়েছি। আশাকরি ইনায়াও তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাবে…এন্ড খুব জলদি সবাই সুস্থ হয়ে যাবে। আপনি আর প্লিজ দেরি করবেন না। আমাদের মনে হয় এখনই এখান থেকে যাওয়া উচিত। বাকিটা এরা সামলে নেবে।”
আনায়া শুধু চুপচাপ কান দিয়ে পাভেলের কথাগুলো শুনে গেল। কিন্তু কোনো প্রকার প্রতিক্রিয়া করলো না। বরং তার নজর এখনো সেই ন”রখাদক মানবদের দিকে। তার দিক থেকে যেন আমার নজরই সরছে না। কিছুতো একটা অদ্ভুত চিন্তাভাবনায় হারিয়ে যাচ্ছে সে। এরই মাঝে ছেলেটি আবারও চিৎকার চেচামেচি শুরু করলে পাভেল তা দেখে বলে উঠলো,
“তোরা তাকিয়ে দেখছিস কি? ওটাকে আজ পিটি”য়ে মে”রেই ফেল।”
পাভেল কথাগুলো বলতে না বলতেই চারপাশে থেকে ওর লোকজন গুলো নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ছেলেটিকে অনবরত মার”ধোর করতে শুরু করে। কখনো গায়ে সজোরে লাথি দিচ্ছে তো কখনো চুল ধরে টেনে হিঁচড়ে ফ্লোরে আঁচড়ে
ফেলছে। নড়বড়ে দেহটা যেন নিমিষেই ভঙ্গুরের ন্যায় কুঁকড়ে যাচ্ছে বারবার।অথচ ব্যাথার চোটে করা আর্তনাদের প্রতিটা শব্দই অস্পষ্ট।
এই পর্যায়ে এসে আনায়া আর পুরো সময়ের মতো চুপচাপ থাকতে পারলো না। ছেলেটির দিকে এগিয়ে যেতে নিলে পাভেল আচমকা বাঁধা সেধে তাকে বাহিরে যেতে বলে। আনায়া বুঝে উঠতে পারছে না কি করবে। কিন্তু এরই মাঝে আকস্মিক আনায়ার মন মস্তিষ্ক এমন কিছুর জানান দেয় যে আনায়া সম্পূর্ণভাবে আঁতকে ওঠে। সে যা ভাবছে তা যদি সত্যি হয় তবে…আনায়া আর বেশি কিছু ভাবতে পারল না। বিস্ময়ে আর ভয়ে অনেকটাই হতবাক সে। এমনই মূহুর্তে সে খেয়াল করলো তার চোখজোড়াও যেন ভিজে উঠেছে। আনায়া আর পাভেলের বাঁধায় নিজেকে না থামিয়ে ছেলেটির দিকে ছুটে আসে। সবাইকে দূরে সরিয়ে দিয়ে পঁচা ঘা আর মারধরের ফলে র”ক্তে সিক্ত ফিনফিনে দেহটাকে আঁকড়ে ধরলো। এদিকে ছেলেটি প্রায় অচেতন হয়ে আনায়ার কোলেই ঢেলে পড়েছে।
অন্যদিকে এসবের কোনো কিছুই যেন পাভেলের বোধগম্য নয়। এসব হচ্ছেটা কি? আনায়া কেনো এমন করছে? তার সাথে সাথে আশে-পাশের লোকগুলোও কিছুটা অবাক চোখে আনায়াদের দিকে তাকিয়ে। আনায়া অনবরত কাঁদছে আর প্রতিনিয়ত ফুঁপিয়ে উঠছে।
পাভেল দ্রুত আনায়ার কাছে এগিয়ে এসে হাঁটু গেঁড়ে বসে। এবং আনায়ার উদ্দেশ্যে কপাল কুঁচকে বলতে লাগে,
“এ কে? আপনি কেনো এমন করছেন? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।…প্লিজ কিছু বলুন। আপনি কি এই পাগলটাকে চেনেন?”
আনায়া কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে উঠলো, “রোহান… ও রোহান।”
আনায়ার কথায় পাভেল কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে ফেললো।—“রোহান? কোন রোহান…”
—“ও রেহানের ভাই রোহান।”
—“রেহান আহমেদের ভাই রোহান?”
—“হ্যাঁ।”
পাভেল কথাটা প্রচন্ড বিস্ময়ের সাথে বলতেই আনায়া ঠোঁট চেপে মাথা ঝাঁকালো। এদিকে পাভেল যেন সম্পূর্ণ হতবাক হয়ে গিয়েছে। এসব একের পর এক কি হচ্ছে, কেনো হচ্ছে সবই যেন তার অজ্ঞাত।
মধ্যরাতে হসপিটালের শুনশান নীরব জায়গায় চুপচাপ বসে রয়েছে আনায়া। চোখেমুখে বিস্তর ক্লান্তির ছাপ। কিন্তু এখন বিশ্রাম নেওয়ার মতো নূন্যতম সময় তার নেই। ক্লান্তির পাশাপাশি এক আকাশ সমান চিন্তা দুশ্চিন্তায় আঁটকে রয়েছে সে। আনায়া আনমনে ভাবনা চিন্তার মাঝেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
রাত প্রায় অনেকটা হয়েছে। আরেকটু পর হয়তো ভোরও হয়ে যাবে। ইনায়াকে হসপিটালের আনতে না আনতেই অপারেশনের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। ওর অবস্থা তখন নিত্যন্তই নাজুক ছিলো। হসপিটালের আনতে দেরি হওয়ায় বাঁচা না বাঁচার প্রশ্ন উঠে যায়। যদিও শেষমেশ অপারেশনটা যথাযথ ভাবে সাকসেসফুলি কমপ্লিট হয়। তবে এখনো ইনায়ার জ্ঞান ফেরেনি। ডাক্তারের কথা অনুযায়ী জ্ঞান ফিরতে খানিকটা দেরি হতে পারে তবে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই।
অন্যদিকে কেনীথকে হসপিটালে আনা হয়েছে অনেকটা আগেই। ওকেও যথাযথ ট্রিটমেন্ট করে রেস্টে রাখা হয়েছে। কেনীথের অবস্থা খুব একটা ভালো কিংবা খারাপ বলা যায় না। অতিরিক্ত ট”র্চার আর অভার ডোজের মেডিসিন পুশ করায় শারিরীক অবস্থা কিছুটা নাজুক। কিন্তু আশাকরা যায়, সকালের মাঝে ঘুম ভাঙ্গার পর অনেকটাই সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
এ দুজন ব্যতীত আনায়ার আরো একজনকে নিয়েও প্রচন্ড দুশ্চিন্তা হচ্ছে। সেই ছেলেটিই যে রোহান তা আনায়ার বুঝতে বা নিশ্চিত হতে আর বাকি নেই। ওকে হসপিটালে নিয়ে আসার পর যা শুনেছে তাতে আনায়ার যেন সকল ভাষাই হারিয়ে গিয়েছে। তার দেখা সেই সুস্থ স্বাভাবিক ছেলেটার আজ কি করূন দশা। ওর ক্রিটিকাল এবং বাহ্যিক অবস্থা দেখে ডাক্তারদের ধারণা সে কিনা একটা নরখাদক। যদিও এটা নিশ্চিত হওয়া যাবে ফরেনসিক রিপোর্ট এলে। তবুও এসব কি আদতে বিশ্বাস যোগ্য? এই ভেবে যেন প্রতিনিয়ত চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার। সর্বদা এটাই মনে হচ্ছে, এই সবার পরিণতি কিন্তু এই সবকিছুর জন্য শুধুমাত্র সে দায়ী। রেহানের পুরো পরিবারটা শুধুমাত্র তার জন্য আজ ধ্বং”স হয়ে গিয়েছে। এতো অভিশপ্ত একটা জীবন নিয়ে আর একমুহূর্ত বেঁচে থাকতেও যেন নিজের প্রতি ঘৃণা আর বিদ্বেষে গা গুলিয়ে আসছে।
আনায়া চুপচাপ রইলেও এসব ছাড়িয়ে আরো অনেকগুলো বিষয় তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। ওখানে সে অদ্ভুত কিছু বিষয় লক্ষ করেছে। একে তো ওখানে নার্স ছিলো সেই সাথে ভেতর থেকে অনেক বাচ্চার আওয়াজও শুনেছে। তখন ওখান থেকে চলে আসায় এই ব্যাপারগুলো নিয়ে তেমন কিছু জানতে পারেনি। তবে আপাতত সবকিছু মিটে গেলে পাভেলের সাথে এই বিষয়ে একবার কথা বলতে হবে। সে চলে আসার পর তো সব কিছু পাভেলের লোকজনই করেছে।
আনায়া সবমিলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। গলা শুঁকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে। করিডরে নার্সগুলো কাজের জন্য ছোটাছুটি করছে। আনায়া তাদের থেকে দূরে খানিকটা নীরবে বসে রয়েছে। পরণে সেই একই ওয়েস্টার্ন পার্টি ড্রেস। আলাদা করে ড্রেস চেঞ্জ করার সময় সুযোগ কিংবা পরিস্থিতি হয়ে ওঠেনি। তবে গায়ে এখনো বড়সড় একটা কালো রঙের চাদর পেঁচানো। এক চাদরেই প্রায় নিজেকে পুরোপুরি ঢেকে নিয়েছে।
হুট করেই আনায়ার মনে পড়লো রেহানের কথা। সে কি করে এসব রেহানকে জানাবে। কিভাবে বলবে তার ভাই রোহানের খোঁজ মিলেছে কিন্তু সে তো…আনায়ার দুশ্চিন্তায় মাথায় ভার হয়ে এলো। রেহান এসব জানার পর কিভাবে রিয়েক্ট করবে তা আনায়া জানে না। তবে সে এতটুকু নিশ্চিত যে, ছেলেটা রোহানই। বাকিটা রেহান আর রোহানের ডিএনএ টেস্ট করালেই পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যাবে।
রোহানকে আনায়া খুব বেশি সামনাসামনি দেখেনি। তবে তার ছবি সে রেহানের মাধ্যমে প্রায়ই দেখতো। একটা পাগলাটে,সহজ সরল… কত সুন্দর দেখতে ছিলো। সবসময় শুনেছে, পড়াশোনাতেও যথেষ্ট ব্রিলিয়ান্ট ছিলো। অথচ ওর সাথেই কেনো এমন কিছু হলো? আনায়া আর এতো কিছু ভাবতে পারছে না। এতোবছর ধরে খোঁজ করতে থাকা নিজের বোন, নিজের ছোট ভাইয়ের স্থানে জায়গা দেওয়া ভাই রোহান কিংবা স্বামী নামক এক অমানুষের…একই সাথে সকলের এমন করূন পরিণত কোনটাই সামলে উঠতে পারছে না আনায়া। সেই সাথে আগামী পরিকল্পনার অতিরিক্ত চিন্তাভাবনা তো রয়েছেই।
আনায়া জোরে শ্বাস ফেলে দু-হাতে চুলগুলো এলোমেলো কপালের চুলগুলো পেছনে ঠেলে দেয়। মাথা প্রচন্ড ঝিমঝিম করছে। সকাল ভোর হয়ে এলে একবার রেহানকে এসব বিষয়েও জানাতে হবে। ভাই হিসেবে ওকে দ্রুত এই বিষয়টা জানানো উচিত।
এরই মাঝে আনায়া মাথা উঁচিয়ে পাশে ফিরে দেখে, পাভেল তার দিকে এগিয়ে আসছে। হাতে একটা দুটো মগ। আনায়ার কাছে আসতেই একটা মগ আনায়ার দিকে বাড়িয়ে দেয়। ধোঁয়া ওঠা গরম কফি। আনায়া পাভেলের দিকে তাকিয়ে দেখে তার চেহেরায় তীব্র হতাশা। চোখে-মুখে ক্লান্তির ছাপ। আনায়া কিছুটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মগটা হাতে নেয়। মনে মনে ভাবতে থাকে পাভেলকে নিয়ে। এই ছেলেটা শুরু থেকে এখন পর্যন্ত কম কষ্ট করেনি। সবসময় কেনীথের পাশে দেখেছে। নিজের সহ বাকিদের বিপদেও ও যতটা পেরেছে, পাশে থেকেছে। মাঝেমধ্যে আনায়ার মনে হয়, পাভেল যদি কেনীথের সঙ্গ না পেতো তবে হয়তো ওর জীবনটাও এতো ধোঁয়াশার মাঝে হারিয়ে যেতো না। বাকি সবার মতো পাভেল নিজেও একটা সুস্থ জীবন যাপন করতে পারতো।
আনায়াকে আনমনে একটানা তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে পাভেল কিছুটা ইতস্ততবোধ করে। ওর হাবভাবে আনায়ার ধ্যান ভাঙতেই নিজেকে সামলে নিয়ে ভারী দীর্ঘশ্বাস ফেলে, কিঞ্চিৎ মুচকি হাসে। অতঃপর স্বাভাবিক ভাবে বসে নিয়ে দু-হাতে কফির মগটা ধরে বলে ওঠে,
—“হাতে সময় থাকলে বসুন, কিছু কথা বলার আছে।”
আনায়া ভাবগাম্ভীর্যের তৎপরতায় পাভেল কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আনায়ার পাশে বসল। দু’জনের মাঝে যথেষ্ট দূরত্ব। আনায়া বিষয়টা খেয়াল করে আনমনে মুচকি হাসে। আনায়া শুরু থেকেই খেয়াল করে এসেছে, পাভেল বরাবরই তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। যদিও সে তার অনেক ছোট। মূলত কেনীথকে বড়ভাই মানার প্রেক্ষিতেই তার প্রতি এতো সম্মান। এছাড়া অবশ্য কারো সাথে কখনো খারাপ বিহেভিয়ারও আনায়া করতে দেখেনি।
আনায়া চুপচাপ বসে রয়েছে কিন্তু কিছু বলছে না দেখে পাভেল পুনরায় কিছুটা বিব্রত হয়। ইতস্ততভাবে স্বাভাবিক হতে গিয়ে, গরম কফি মুখে দেওয়ায় জিহ্বার খানিকটা যেন পুড়ে গিয়েছে। এরই মাঝে আনায়া তার দিকে না তাকিয়েই বলে ওঠে,
“ধীরেসুস্থে খান, এতোটাও নার্ভাস হওয়ার কিছু নেই। কেনীথকে বড় ভাই মনে করলেও, আমাকে ছোট বোন মনে করুন। আমি আপনাকে সবসময় বড় ভাই হিসেবেই মেনেছি।”
যদিও আনায়ার নজর ছিলো তার হাতে থাকা ধোঁয়া ওঠা কফির দিকে। তবে তার কথায় পাভেলের যেন আরো কিছুটা ইতস্তত হয়।চোখমুখ খিঁচে নিজেকে সামলে নিয়ে তড়িঘড়ি করে আনায়ার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
“আপনি কিছু বলতে চাইছিলেন!”
আনায়া খানিকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কফিতে একবার চুমুক দিয়ে বললো,
“কেনীথ আপনার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ?”
আনায়া প্রশ্নে পাভেল কিছুটা ঘাবড়ে যায়। হঠাৎ এমন প্রশ্নের কারণ তার জানা নেই। তবে পাভেল কিছু বলছে না বিধায়, আনায়া পাশে ফিরে পাভেলের উদ্দেশ্য পুনোরায় বলতে লাগে,
“যদি কখনো তাকে নিজ হাতে শেষ করতে হয়, তখন আপনি কি করবেন?”
পাভেলের হাতে থাকা কফির মগটা খানিক কেঁপে উঠলো বিস্ময়ের সাথে আনায়ার দিকে তাকাতেই আনায়া নির্লিপ্ত ভাবে আবারও বলল,
“উত্তর দিন।”
—“এসব কি বলছেন? পাগলামি কেনো করছেন…আপনি প্লিজ রেস্ট করুন। নয়তো বাসায় চলে যান। আমি এদিকটা সামলে নেবো।”
আনায়া যেন পাভেলের কথাগুলো শুনেও শুনলো না। নির্বিকার কফিতে চুমুক দিয়ে বলে উঠল,
—“ধরুন,আমি আপনাকে এই কাজটা করতে বললাম। আপনি পারবেন না! কেনীথকে চিরতরে শেষ করে দিতে?”
পাভেলের ঘাম ছুটে যাওয়ার মতো অবস্থা। হাত কাঁপছে অনবরত। সেইসাথে কফির কাপটাও। কোনো কিছুই আনায়ার দৃষ্টির অগোচর নয়।
—“পার…বো না আমি এস…ব করতে। কখনোই পা…রবো না।
—“কেনো পারবেন না?”
আনায়ার নির্লিপ্ত আর দৃঢ়তার চাহনিতে পাভেল শক্ত মুখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর আনায়া আবারও বলে ওঠে,
“ধরুন,কেউ আপনার পুরো পরিবার,প্রিয়জনদের জীবন ধ্বংস করে দিয়েছে। সবাই প্রচন্ড কষ্ট নিয়ে দিনের পর দিন মৃত লা” শ হয়ে বেঁচে রয়েছে। এরজন্য দায়ী শুধু একটি মানুষ বেশে থাকা এক অমানুষ। এরপরও আপনি সেই অমানুষটাকে ছেড়ে দিবেন? ইচ্ছে হবে না তাকে চিরতরে শেষ করে দিতে?”
—“………
—“উত্তর দিন!”
—“অবশ্যই! আমিও তাকে এমনি এমনি ছেড়ে দেবো না।”
পাভেল আকস্মিক দৃঢ় কন্ঠে কথাটা বলতেই আনায়া ছোট্ট করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তবে সেই মূহুর্তে পাভেল আবারও বলতে লাগলো,
“তবে ভাইয়ের সিচুয়েশন আর সবার সিচুয়েশন এক ছিলো না।সে নিজেও অনেক কষ্ট সহ্য করেছে।… হ্যাঁ, সে যেটা করেছে তা সম্পূর্ণ ভুল, অন্যায়। কিন্তু…”
—“কোনো কিন্তু নেই। আপনার ভাইয়ের সাথে যা হয়েছে তার জন্য দায়ী হলো আমার বাবা। সেক্ষেত্রে তার শিকার হওয়ার কথা ছিলো,শুধুমাত্র আমার বাবা। কিন্তু এমনটা তো হয়নি। আচ্ছা মানলাম, তার সাথে আমার শুরু থেকে একটা সম্পর্ক ছিলো বিধায় আমিও দোষী। তবে শাস্তিটা শুধু আমি আর আমার বাবার প্রাপ্য ছিলো, তাই না?
তবে কেনো আমাদের পাপের শান্তি ইনায়া, রোহান, রেহান সহ তার পুরো পরিবারকে ভোগ করতে হচ্ছে? রেহানের বাবা মা কিংবা ওর ভাই রোহান—ওদের কারোরই তো কোনো দোষ ছিলো না। আমার বোনটাই বা কি দোষ করেছিলো? আর আমার ফ্রেন্ডগুলো? ওদের একেকটার জীবন নরক বানিয়ে ছেড়েছেন উনি। এরপরও কিভাবে ছাড় দেই ওনাকে। কিভাবে সব ভুলে মাফ করে দেই?”
—“তবে আপনি কি চাইছেন?”
পাভেলের প্রশ্নের উত্তরে আনায়া ভারী দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। অস্থির লাগছে তার। চোখ বন্ধ করে আনমনে বলে উঠলো,
“জানি না। কিচ্ছু জানি না। কিন্তু আমার আর এসব সহ্য হচ্ছে না। সব শেষ করে দিয়ে নিজেকেও শেষ করতে ইচ্ছে হচ্ছে। আ’ম টোটালি টাইয়ার্ড অব দিস ফা%কিং লাইফ!”
পুনোরায় দুজনের মাঝে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করে। অনেকটা সময় হয়ে যায় আনায়া কিংবা পাভেল কোনো কথা বলে না। ওদিকে পাভেলের কফি এতোক্ষণে ঠান্ডাও হয়ে গিয়েছে। অথচ তার নজর মগে থাকা ঘন কালো মিশ্রণ থেকে এখনো সরেনি। আনায়া অনেকটা সময় চুপচাপ থাকার পর বলে উঠলো,
“ওই জায়গাটা নিয়ে কিছু জানার ছিল।”
আনায়ার কথায় পাভেলের ধ্যান ভাঙতেই কিছুটা নড়েচড়ে বসে। অন্যদিকে আনায়াও কিছুটা সিরিয়াস হয়।
—“কোন জায়গা…”
—“যেখান থেকে ইনায়াদের পেলাম।”
—“ওহ হ্যাঁ, জ্বী বলুন।
—“ওখানে আসলে হয়টা কি? আমি কিছু নার্সদের দেখেছি। অনেক ছোট বাচ্চার আওয়াজও শুনেছি। আরেকটা বিষয়, ইনায়াকে নার্সগুলো ম্যাম বলছিলো। ইনায়া ওখানে কি করত? এসব ঠিক আমার বুঝে আসছে না।”
পাভেল খানিকটা ভাবুক ভঙ্গিতে বলে উঠল,
“কাহিনি তো আমিও বুঝতে পারছি না, কিন্তু… ”
—“ঐ নার্সগুলো কোথায়? আর আমি নিশ্চিত ওখানে অনেকগুলো বাচ্চা ছিল।আপনার লোকগুলো যেহেতু ওখানে তবে…ওরা এখন কোথায়? এখনো ওখানেই রয়েছে?”
—“নাহ, আমি আমার লোকেদের বলেছি ওদের ওখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে।”
—“সত্যিই ওখানে বাচ্চা ছিল, তাই না?”
—“জ্বী।”
—“আর ঐ অলিভার নামের লোকটা, সে কি বেঁচে রয়েছে?”
—“নাহ।”
আনায়া খানিকটা চুপচাপ থেকে কিছু একটা ভেবে নিয়ে বলল,
“অলিভারটা বেঁচে থাকলে হয়তো সহজেই সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যেতাম। যাই হোক, এদিকটা একটু স্বাভাবিক হলে, নার্সের সাথে আর বাকি যদি কোনো কর্মী বেঁচে থাকে তবে… ওদের সাথে আমি দেখা করতে চাই। বাকিটা হয়তো ইনায়া স্বাভাবিক হলে জানতে পারব।”
পাভেলও আনায়ার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনে সহমত পোষণ করে। সেই সাথে কফির মগে ঠোঁট ছোঁয়াতেই, দেখে তা একদম ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। বিরক্ত হয়ে ঘড়িতে সময় দেখে বুঝল, খুব শীঘ্রই নতুন ভোরের সূচনা হতে চলেছে।
ভোর হয়ে গিয়েছে। সেই সাথে আনায়া খানিকটা অস্থির হয়ে উঠেছে। কিছুক্ষণ আগেই সে রেহানকে হসপিটালে আসতে বলেছে। তবে কোনো কিছু জানায়নি। শুধু বলা হয়েছে,অত্যন্ত জরুরী বিষয়। না আসলেই নয়।
সেই সাথে বেড়েছে ইনায়ার জ্ঞান না ফেরার আশংকার ভয়। ওদিকে রোহানের উপর চলছে যথাসাধ্য ট্রিটমেন্টের তোরজোর। ওকে হসপিটালে নিয়ে আসা হয়েছিলো প্রায় অজ্ঞান অবস্তায়। খানিকটা আগে জ্ঞান ফিরলেও সে প্রচন্ড পাগলামিতে মেতে ওঠে। তাকে সামলাতে গিয়ে ডক্টরদের হিমশিম খেতে হয়েছে। ফলস্বরূপ পরিশেষে ঘুমের ইনজেকশন পুশ করে পরিস্থিতি সামলাতে হয়। আপাতত সে এখন গভীর ঘুমে।
আনায়া করিডোরে অনবরত পায়চারী করছে। ওদিকে পাভেল হঠাৎ হসপিটালের কাজে বাহিরে গিয়েছে। কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসের ব্যবস্তা করতে। এমনিতেও এখন হসপিটালের বড় পরিধির একটা অংশ তাদের জন্য কাজ করছে। ডাক্তার কিংবা নার্স, সার্ভেন্ট কেউ থেমে নেই। যে যার কাজে অনবরত ছুটছে।
আনায়া বারবার হসপিটালের মেইন দরজার দিকে তাকিয়ে দেখছে, রেহানের দেখা পাবার আশায়। তবে এরইমাঝে রেহানের পরিবর্তনে কিছু ওয়ার্ডবয় আর নার্স ভেতরে প্রবেশ করে। তবে খানিটা অবাক করা বিষয় হলো প্রত্যেকেরই মাস্ক আর ক্যাপ পড়ো। যা হসপিটালের বাকি লোকদের মতো না। খুব বেশি হলে চার থেকে পাঁচজন ছিল তারা। আনায়া খুব একটা প্রয়োজনীয় না মনে করে, বিষয়টাকে গুরুত্ব দিল না।
আরেক কয়েকবার পায়চারি করতে করতেই হঠাৎ নজরে এলো রেহান। কালো জ্যাকেট,কালো প্যান্ট আর সাদা টিশার্ট পড়া।চুলগুলো এলোমেলো, চোখেমুখে বিধ্বস্ততা। সব মিলিয়ে ভাবভঙ্গি এমন যেন আনায়ার খবর পেয়েই সে ছুটে এসেছে।
রেহান আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করবে এর পূর্বেই আচমকা তার নজর পড়ে আনায়ার দিকে। খুব বেশি দেরি না করে রেহান ছুটে যায় তার কাছে।
—“কি হয়েছে, তোমায় এমন দেখাচ্ছে কেনো?আর হটাৎ হসপিটালে কেনো… ”
—“তুমি প্লিজ শান্ত হও। আমি যা বলবো মনোযোগ দিয়ে শুনবে। ঘাবড়ানো কিংবা দুশ্চিন্তার কিছু নেই।”
রেহান খানিকটা কপাল কুঁচকে বলল,
“আনায়া ভণিতা না করে জলদি বললো কি হয়েছে!”
—“রেহান! রোহানকে পাওয়া গিয়েছে।”
—“কিহ! কি বলছো…”
—“হ্যাঁ,তুমি ঠিকই শুনেছো।”
—“কোথায় ও…আর হস…পিটালে…ওর কিছু…’
—“ঘাবড়ানোর প্রয়োজন নেই। ওর ট্রিটমেন্ট চলছে।”
—“ওর কি হয়েছে? কিসের ট্রিটমেন্ট চলছে?এখন কোথায় আছে…আমি দেখা করবো ওর সাথে।”
—“রেহান প্লিজ, আমার কথা শোনো তোমায় আরো কিছু বলার আছে।”
আনায়ার হাবভাব অভিব্যক্তি কোনো কিছুই রেহানের সুবিধাজনক মনে হচ্ছে না। মন মস্তিষ্ক এটাই বলছে, কিছু তো একটা ঘাবলা রয়েছেই। না জানে আনায়া তাকে কি বলতে চাইছে। তবে শেষমেশ আনায়াকে সবটাই রেহানকে জানাতে হলো। আনায়ার বলা ঘটনাগুলো শুনে রেহান যেন সম্পূর্ণ বাকরূদ্ধ। কিভাবে সম্ভব এসব তা তার মাথাতেই কাজ করছে না।
—“পাগল হয়ে গিয়েছো তুমি? কিভাবে বলছো যে রোহান নরখাদক… আর ইউ মেড?নরখাদকের অর্থ বুঝো তুমি?”
আনায়া খানিকটা অস্থিরতার সাথে ভারী শ্বাস ফেলল। হুট করে কেমন যেন প্যানিক করছে সে। পুরো ঘটনা বলতে গিয়ে হাত পা কাঁপছে। এমন কেনো হচ্ছে বুঝতে পারলো না।এতক্ষণ তো সব ঠিকই ছিলো। হয়তো রেহানের সামনে এসেই সে আর এই বিষয়গুলো সহজতর ভাবে নিতে পারছে না।
আনায়া রেহানের বিস্ময় আর রাগের সংমিশ্রণ চেহরার দিকে তাকিয়ে রইলো। কিছুক্ষণ চুপচাপ ওকে দেখার পর,নিজেকে সামলে নিয়ে শক্ত গলায় বলতে লাগলো,
“নিশ্চয়, আমি তোমায় এখানে মজা করতে ডাকিনি! সবকিছু জেনে বুঝেই তোমাকে কথা গুলো বলছি।”
রেহান আনায়ার কথা শুনে পাশে ফিরে মাথায় হাত দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে লাগে। মাথা ঘুরছে তার। সব কিছু দুঃস্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। এতোটা এলোমেলো অগোছালো জীবন কিভাবে হতে পারে। এদিকে আনায়ার যেন ইচ্ছে হচ্ছে নিজের গলা চেপে নিজেই শেষ করতে। আর কত এসব সহ্য করতে হবে।
এরই মাঝে আচমকা হসপিটালের একপাশ থেকে চেঁচামেচির আওয়াজ এলো। রেহান আনায়া দুজনেই অবাক হয়ে বোঝার চেষ্টা করলো ঘটনা কি। আনায়া দৌড়ে সেদিকটায় এগিয়ে গেলে তার পেছন পেছন রেহানও ছুটে যায়। নার্স ডাক্তার সহ সকলেই ছোটাছুটি করছে কেনো, তা কেউই বুঝতে পারল না। আনায়া আবার ভীরের মাঝেই একজন নার্সকে চিন্তিত সুরে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে? সবাই এমন কেনো করছে?”
নার্সটা খানিকটা কাঁপা কাঁপা স্বরে বলতে লাগল,
“সঠিকটা বলতে পারছি না, তবে মাঝরাতে যে পেশেন্টগুলো এসেছিলো তাদের মাঝে একজনের অবস্থা বেশ ক্রিটিকাল।”
এটুকু বলেই নার্সটা তার কাজের জন্য ছুটে গেলেও, আনায়া সম্পূর্ণ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। মাঝরাতে বলতে তো…তারাই এসেছে। আর তারমাঝে একজনের অবস্থা ক্রিটিকাল বলতে কি বোঝালো নার্স।
আনায়া আর রেহান দ্রুত নার্সদের পেছন পেছন ছুটে যায়। সর্বপ্রথম রোহানের কেবিনের কাছে আসতেই দু’জন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। পুরো রুমে ডাক্তার নার্সদের তোরজোর। কাউকে বাঁচানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চলছে। বেডের উপর হাত পা ছড়িয়ে ছটফট করছে রোহান। হার্টরেড বেড়ে গিয়েছে,মনিটরে অস্বাভাবিক রিডিং দেখে ডাক্তাররা চমকে উঠেছে। ডাক্তাররা দ্রুত ওকে ইলেক্টিক শক্ দেওয়ার ব্যবস্থা করে। বুকের মাঝে প্রতিবার শক্ দেওয়ার পর, রোহান বুক চেড়ে শূন্যে উঠে যায়। আবার ধপ করে বিছানায় পড়ে। তবে খুব বেশি একটা সময় এই কার্যক্রম পুনরাবৃত্তি হলো না। আকস্মিক মুখ থেকে অস্বাভাবিকভাবে ফেনা বেরিয়ে আসে। এবং খুব দ্রুতই রোহান সম্পূর্ণ রূপে স্তব্ধ হয়ে যায়। সেই সাথে ডাক্তাররাও প্রচন্ড হতাশা নিয়ে নিজেদের কার্যক্রম থামিয়ে দেয়।
এদিকে বাহির থেকে স্তব্ধ হয়ে, চাতকের ন্যায় তাকিয়ে ছিলো রেহান আর আনায়া। গ্লাসের অপর প্রান্ত থেকে সবকিছুই তাদের চোখে সামনে ঘটে যায়। রোহানের সর্বশেষ অবস্থা দেখে আনায়া আকস্মিক ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। নিজেকে সামলাতে একহাতে মুখ চেপে ধরে। এদিকে রেহান যেন বুঝতেই পারছে না কি থেকে কি হয়ে গেল। তার চোখ মুখ থেকে যেন বিস্ময়ই কাটছে না। আর আনায়াই বা এভাবে কাঁদছে কেনো।
খানিকটা সময়ের মাঝেই ডাক্তার কেবিন থেকে বেড়িয়ে, তাদেরকে দেখে এগিয়ে এলো। আনায়ার কান্নার বেগ এখনো কমেনি। শব্দ না করেই অনবরত কেঁদেই চলেছে। এদিকে রেহান একদম নির্লিপ্ত। ডাক্তার তার সামনে এগিয়ে এলেও সে কিছু বলছে না। স্তব্ধ হয়ে সে একবার আনায়াকে দেখছে তো একবার ডাক্তারকে। এরই মাঝে ডাক্তার খানিকটা অনুতপ্ত আর হতাশা নিয়ে বলে উঠল,
সরি টু সে, বাট হি হ্যাজ পাস্ট অ্যাওয়ে। আমরা তাকে বাঁচাতে পারিনি।”
এ কথা শোনা মাত্রই আনায়া আরো বেশি কান্নায় ভেঙে পড়ল। ইচ্ছে হচ্ছে চিৎকার করে কাঁদতে। ওদিকে রেহান পাগল প্রায় অবস্থা। কেমন অস্থিরতায় সম্পূর্ণ ছটফটে হাভভাব তার।অস্থির হয়ে বোঝার চেষ্টা করছে কি হচ্ছে এসব। আনায়া এভাবেই কেনো কাঁদছে। কে ঐ ছেলেটা। ওমন বিদঘুটের মতো নিস্তেজ শরীরের জন্য এতো কেনো কষ্ট পাচ্ছে আনায়া৷ ও কি আনায়ার পরিচিত কেউ? আর তার ভাই রোহানই বা কোথায়। এমন পরিস্থিতিতে ডাক্তার চলে যেতে নিলে, আচমকা রেহান বলে উঠল,
“আমার ভাই কোথায়? রোহান কোথায়? আনায়া তুমি বলেছিলে ও এই হসপিটালে রয়েছে৷ প্লিজ একটু বলো, ও কোথায়? ওর সাথে কথা বলবো আমি।”
এবার আনায়া সম্পূর্ণ হু হু করে কেঁদে উঠল।ডাক্তার তাদের দিকে অপলক তাকিয়ে রইল। এদিকে আনায়ার কান্না রেহান খানিকটা বিরক্ত হয়ে বলল,
“তুমি এভাবে কাঁদছো কেনো? ঐ পাগলের মতো লোকটাকে তুমি চেনো?”
আনায়া কান্নার মাঝেই ভাঙা স্বরে বলে উঠল,
“ওটাই রোহান…ও আর নেই৷ রোহান আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গিয়েছে ।”
কোনোমতে এটুকু বলতে না বলতেই আনায়া পুনোরায় কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। এদিকে রেহান যেন সম্পূর্ণ নিস্তেজ হয়ে পড়ল৷ হাত পা অসার হয়ে আসছে তার। গ্লাসের দেওয়ালের ওপারে থাকা, বিদঘুটে দেখতে মানুষটা কিনা তার ভাই। রেহান অপলক সেদিকে তাকিয়ে রইল। মনে মনে পাগলের মতো হাসতে হাসতে আওড়াল,
“আনায়া মিথ্যে বলছে। আমার ভাই মোটেও ওমন দেখতে না। রোহান তো অনেক সুন্দর। কতসুন্দর ফর্সা, বড় বড় সিল্কি চুল, একদম স্বাস্থ্যবান একটা ছেলে সে। এমন রোগা,বিদঘুটে লোকটাকে, আনায়া কিভাবে রোহান বলছে? ও কি পাগল হয়ে গিয়েছে? আবার বলছে, রোহান নেই। রোহান কোথায় গিয়েছে তবে? রোহান ম”রতে পারে না। আমার ভাই ম” রতে পারে না। মিথ্যে বলছে আনায়া৷ একদম মিথ্যে বলছে।”
রেহান সম্পূর্ণ ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছে। বাহির থেকে গ্লাসে দুহাত রেখে রোহানের নিথর দেহটাকে দেখছে। এরই মাঝে আবারও সোরগোল বেঁধে গেলে আনায়া থমকে যায়। কান্না থামিয়ে কোনো মতে বোঝার চেষ্টা করে কি হয়েছে। একজন নার্স এসে ডাক্তারকে খবর দেয় ইনায়ার অবস্থা ভালো না।হার্ট রেড বেড়ে গিয়েছে। ডাক্তার একমুহূর্তও দেরী না করে ইনায়ার কাছে ছুটে যায়। আনায়াও পাগলপ্রায় রূপে তাদের পেছনে যায়। কিন্তু রেহান সেইখানেই স্তব্ধ মানবের ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকে।
এদিকে ডাক্তার নার্সরা আনায়াকে আর ভেতরে ঢুকতে দিল না। দ্রুত ওর অবস্থা দেখে ইলেক্ট্রিক শক্ এর ব্যবস্থা করে। ইনায়া হুবহু রোহানের মতো বিহেভ করছে। যা দেখামাত্রই ডাক্তার সহ প্রত্যকেই খানিকটা অবাক। এদিকে আনায়াও সম্পূর্ণ অস্থির হয়ে উঠেছে। তার ঘাম ছুটে যাচ্ছে, চোখ বেয়ে অনবরত পানি ঝড়ছে। আনায়া হাসফাস করতে লাগল। এরই মাঝে তার কাছে ছুটে এলো পাভেল। আনায়ার অবস্থা দেখে কপাল কুঁচকে বলে উঠল,
“কি হয়েছে এখানে? কি হচ্ছে এসব?”
পাভেল হসপিটালে প্রবেশ করার পর থেকে হসপিটালের অবস্থা দেখে কিছু বুঝে উঠতে পারছিল না। সবার ব্যস্ততার মাঝে জিজ্ঞেস করে তেমন কোনো উত্তরও পায়নি। শুধু শুনেছে দুজন পেশেন্টের অবস্থা ক্রিটিকাল। কিন্তু তারা কারা সেটা জানা হয়নি। পাভেল তাই দ্রুত এগিয়ে আসতেই হঠাৎ ইনায়ার কেবিনের সামনে আনায়ার দিকে তার নজর পড়ে। আর আনায়ার কাছে আসতেই ওর অবস্থা দেখে সম্পূর্ণ অবাক হয়ে যায়। আপাতত বোঝার চেষ্টা করছে এখানে হয়েছেটা কি! এরই মাঝে তার চোখ পড়ে গ্লাসের অপাশে থাকা ইনায়ার দিকে। বিস্ময়ে যেন তার হুঁশই ফিরছে না। আনায়ার কান্না দেখে পাভেল বলে উঠল,
“কি হয়েছে ওর? ওমন কেনো…”
—“জানি না, ওর কিছু হলে আমি বাঁচবো না। আর..রোহান…রোহান…”
–“কি হয়েছে রোহানের?”
—“”রোহান আর নেই৷ ডাক্তার বললো,ও…ও…মা”রা গিয়েছে।”
—“কখন হয়েছে এটা?”
—“এ…একটু আগেই।”
পাভেল প্রচন্ড বিস্ময়ের সাথে থমকে দাঁড়াল।কি বলছে এসব। এটুকু সময়ের মাঝে কিভাবে কি! এদিকে আনায়ার কান্না থামছেই না। পাভেল কি বলবে সেটাও বুঝে উঠতে পারছে না। মাথা কাজ করছে না তার। তবে হুট করেই তার কেনীথের কথা মাথায় এলো। প্রচন্ড উত্তেজনার সাথে বলে উঠল,
“ভাই কোথায়?”
আনায়া পাভেলের কঢ়া কথায় খানিকটা চুপ হয়ে যায়। সে কিছু বলতে নেবে তার পূর্বেই পাভেল আনায়ার হাভভাবে যা বোঝার বুঝে যায়।সঙ্গে সঙ্গে জোর গলায় বলতে লাগল,
“এতোটা কেয়ারলেস হলে কি করে হবে? এখানে এতোকিছু ঘটে যাচ্ছে আর এই হসপিটালের এতগুলো মানুষ…এই বাস্টা%র্ড গুলো করছেটা কি!”
একজোড়া আগুন পাখি পর্ব ৩৭ (৩)
এই বলতেই না বলতেই পাভেল দৌড়ে কেনীথের কেবিনের দিকে ছুটে গেল। আশেপাশে তেমন কাউকেই দেখতে না পাওয়ায় মাথা যাস্ট ঘুরতে থাকে। একটা নার্স, ডক্টর, ওয়ার্ডবয় বলতে আশেপাশে কেউ নেই। পাভেল দ্রুত কেবিনের দরজাটা একটানে খুলে ভেতরে প্রবেশ করল। রুমের ভেতরের পরিস্থিতি তার সমানে দৃশ্যমান হতেই, সে সম্পূর্ণ কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের ন্যায় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।