একটি অপ্রেমের গল্প পর্ব ৩৮
জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
মসীবর্ণ অম্বর। সুধাংশু অনস্তিত্ব ছায়ালোকে কিরণ ছড়াচ্ছে মিটিমিটি তারকা। বাতাবরণের হালচাল স্বাভাবিক। দূর থেকে ভেসে আসছে কুকুরের বেখাপ্পা আর্তনাদ। সোডিয়ামের ঔজ্জ্বল্যে পিচ ঢালা রাস্তাটা চকচক করছে। অন্বিতার পাশে এসে দাঁড়ায় মাহির। অন্বিতা নিরুদ্বেগ। মাহির তাকে এক পলক দেখে নিয়ে জানতে চাইল,
‘মন খারাপ?’
অন্বিতা মাথা নাড়িয়ে “না” বলল। মাহির শুধাল ফের,
‘ফুপি আর শশীর কথায় কষ্ট পেয়েছ?’
অন্বিতা চাইল। মাহিরের চোখে চোখ পড়তেই নির্মল হাসল সে। বলল,
‘না। তোমার আর দাদুর উত্তরে আমি আশ্বস্ত হয়েছি।’
মাহির অন্বিতার হাত ধরে তাকে নিজের দিকে ফিরাল। দুই হাত নিজের হাতের মুঠোয় ভরে বলল,
‘ভরসা রেখো। আমি তোমার বিশ্বাস ভাঙব না।’
‘সত্যি?’
‘হ্যাঁ, সত্যি।’
অন্বিতা প্রসন্ন হাসল। ঠোঁট উপচে পড়ল অনুপম হাসি।
‘রুমে চলো।’
মাথা হেলিয়ে মাহিরের পেছন পেছন পা বাড়াল অন্বিতা। বিছানায় বসল গিয়ে। মাহির তার ঠিক সম্মুখে বসল। অন্বিতা আলতো হেসে বিছানার দিকে চেয়ে বলল,
‘বিছানাটা ঝেড়ে দিব?’
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মাহির চাইল বিছানার দিকে। ফুলের পাপড়িতে ভরে আছে তা। বলল,
‘একটু পর।’
এইটুকু বলে সে অন্বিতার মুখটা নিজের হাতের আঁজলায় নিয়ে মেঘমন্দ্র স্বরে বলল,
‘আমায় একটা ওয়াদা করবে, অন্বি।’
মাহিরের পিঙ্গলবর্ণ চোখে চেয়ে যেন অন্বিতা খেই হারাচ্ছে। বুকের ভেতর দ্রিমদ্রিম শব্দ হচ্ছে তার। গলায় কাঁপুনি ধরেছে। তাও রয়েসয়ে বলল,
‘কী?’
‘ওয়াদা করো, আজীবন আমায় আগলে রাখবে। আমাকে কখনও ছেড়ে যাবে না। ওয়াদা করো।’
মাহিরের কন্ঠে আকুতি। মনে হচ্ছে সে যেন ভয় পাচ্ছে। কীসের ভয়? অন্বিতাকে হারিয়ে ফেলার ভয়? অন্বিতা তার ঘাড় কাত করে শান্ত স্বরে বলল,
‘আমি কি ছেড়ে যাওয়ার জন্য তোমার হাত ধরেছি? ভয় পাচ্ছো কেন?’
মাহির ঊর্ধ্বশ্বাস ফেলে। হাত যুগল অন্বিতার গাল থেকে সরিয়ে নিজের কোলের উপর রাখে। বিমর্ষ সুরে বলে,
‘মা বাবাকে অনেক ছোট বেলায় হারিয়েছি। তাঁদের আদর ভালোবাসা বুঝিনি আমি। দাদুর একচ্ছত্র ভালোবাসায় বেড়ে উঠা, মামা আর ফুপিও ছিলেন পাশে। তবে দাদু ব্যতিত আর কারোর ভালোবাসা উপলব্ধি করতে পারিনি। দাদুও ছিলেন ব্যস্ত মানুষ। গ্রামের চেয়ারম্যান। নিজের দায়িত্ব কর্তব্য সেরে বাকি যেটুকু সময় পেতেন আমাকে দেওয়ার চেষ্টা করতেন। তাও, তাও, আমার মনে কিছু একটার শূন্যতা ছিল। কেন যেন নিজের জীবনে পুরোপুরি ভালোবাসাটা অনুভব করতে পারছিলাম না। একা লাগত, মাঝে মাঝে লাগত অসহায়।
পাশে থেকে ভরসা দেওয়ার মতো এক দাদু ব্যতিত আর কাউকে পাইনি কখনও। তবে দাদুর কাঁধে বিশাল দায়িত্বের বোঝা দেখে দাদুকে কখনও নিজের দুঃখ, কষ্ট, একাকীত্বের কথা বলিনি, পাছে দাদুর দুশ্চিন্তা যদি আরো বাড়ে, সেই ভয়ে। নিজের মতো থেকেছি, পড়াশোনা করেছি। দাদুর স্বপ্ন ডাক্তারীকে নিজের স্বপ্ন ভেবে পূরণ করেছি। তার মাঝে একদিন তুমি এলে। হঠাৎ তোমার আচমকা আগমনে আমার রুক্ষ হৃদয় ঝলমলিয়ে উঠল বসন্তের প্রকৃতির ন্যায়। নিদারুণ সুখ বইল চিত্ত জুড়ে। ভেবে নিলাম, এই মানুষটাকে নিয়েই বাকি জীবন কাটিয়ে দিব। তবে মাঝে করে বসলাম মস্ত বড়ো এক ভুল। তারপর দুটো বছরের শ্বাসরুদ্ধকর জীবন কাটালাম। তখন বুঝলাম, এই মানুষটাকে ছাড়া আমি ঠিক কতটা অসহায়। বুঝলাম, বেঁচে থাকতে হলে তাকেই আমার লাগবে। আর আজ, এই যে এই মানুষটা একান্তই আমার, আমার স্ত্রী, আমার ভালোবাসা। আমি আমার বাকি জীবনটা তোমার হাতে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চাই, অন্বি। আমায় তুমি ফিরিয়ে দিও না।’
কন্ঠে ব্যাকুলতা ঠাসা। চোখ মুখ তার উদগ্রীব হয়ে উঠেছে। অন্বিতা হতবাক হয়ে ঢোক গিলল। মানুষটা এভাবে কেন বলছে? এত আকুলতা কেন? সে আদৌ তার ভালোবাসা দিয়ে এই আকুলতা মেটাতে পারবে তো? বড্ড চিন্তায় পড়ে সে। মাহির চঞ্চল হয়ে উঠে। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে,
‘কিছু বলছো না কেন, অন্বি?’
অন্বিতা চোখ বুজে নিজেকে ধাতস্ত করে। এই শক্ত পোক্ত কঠিন ধাচের মানুষটা ভালোবাসার এত কাঙাল সেটা তার ভাবনায় ছিল না। আজ যেন মানুষটাকে নতুন করে চিনেছে। তার পূর্ণমেদুর চাহনি। মাহিরকে আশ্বস্ত করে বলল,
‘শেষ নিঃশ্বাস অবধি আমি তোমাকেই ভালোবাসব, মাহির। বিশ্বাস রাখো, তোমার স্ত্রী তার ভালোবাসায় কখনও অভিযোগ তুলতে দিবে না।’
মাহিরের ঠোঁট কোণে কিঞ্চিৎ হাসি। অন্বিতাকে কাছে টেনে বুকে জড়িয়ে নিল। অন্বিতা টের পেল, মাহিরের হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিক। সে সেখানে হাত রেখে বলল,
‘এ কী ডাক্তার সাহেব, আপনার হৃদপিন্ডের গতি তো স্বাভাবিক না।’
অন্বিতার মাথায় চিবুক ঠেকাল মাহির। কন্ঠস্বর খাদে নামিয়ে বলল,
‘হৃদপিন্ডের মালিকের আলিঙ্গন পেয়ে তার এহেন অবস্থা। কী করব বলো তো?’
মাথা তুলে অন্বিতা তাকাল। রগড় সুরে বলল,
‘সাবধান করুন। না হয় অ্যাটাক ফ্যাটাক করে বসবে।’
‘সেটা তো আরো আগেই করেছে, তোমাকে বধূরূপে দেখে।’
লাজুক হেসে মাহিরের বুকে মুখ লুকাল অন্বিতা। মাহির ফিসফিসিয়ে বলল,
‘তা কি শুধু জড়িয়ে ধরেই বসে থাকবে? আর কিছু করবে না?’
লজ্জায় মিইয়ে যাওয়া সুরে অন্বিতা বলল,
‘আর কী করব?’
মাহির আগের মতোই হিসহিসিয়ে বলল,
‘পুরো বাসর বাকি আমাদের, আর তুমি করার মতো কিছুই পাচ্ছো না?’
লজ্জায় মুখের রং বদলাল অন্বিতার। মাহিরের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়াতে চাইল। ছাড়ল না মাহির। উল্টো শাসিয়ে বলল,
‘প্রেম করা অবস্থায় একটা চুমু অবধি খেতে দাওনি বিয়ের অজুহাত দেখিয়ে। অবশেষে সেই কাঙ্খিত রাত আমি পেয়েছি। আজকে একদম মোচড়ামুচড়ি করবে না।’
মাহিরের ঠান্ডা, শীতল ধমকে অন্বিতার শরীর জমে গেল। বুকের কম্পন বেড়ে জানান দিল, সে ভয় পাচ্ছে। এই রাতের আশায় সেও ছিল। প্রেমিক হিসেবে মাহিরকে সে কখনো সীমা লঙ্ঘন করতে দেয়নি। মাহিরও কোনোদিন জোর করেনি তাকে। তার ভালোবাসায় সম্মান রেখেছে অটুট। আজ মাহিরকে ফিরিয়ে দেওয়ার অধিকার বা ইচ্ছে কোনোটাই তার নেই। যদিও জানে, সে চাইলেও এই কাঙ্খিত পুরুষের আগ্রহকে অগ্রাহ্য করতে পারবে না। তাই মৌন থেকে সম্মতি’ই জানাল বোধ হয়।
মাহিরের হাতন বাঁধন আলগা হলো। অন্বিতা সোজা হয়ে বসল তখন। চোখ তুলে তাকানো দায়। মাহির এগিয়ে এসে তার ললাটে চুম্বন এঁটে দিয়ে বলল,
‘তোমাকে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্খায় যদি একটু বেশিই উন্মাদ হয়ে উঠি, তবে ক্ষমা করে দিও।’
অন্বিতা শ্বাস আটকে বসে রইল। জবাব দিল না কোনো। মাহির তার আরক্ত গালে তার পুরু ঠোঁট বসাল। খানিকটা কেঁপে উঠল অন্বিতা। মাহির কিঞ্চিৎ হাসল তা দেখে। ক্ষীণ সুরে জিজ্ঞেস করল,
‘ভয় পাচ্ছো?’
অন্বিতা মাথা নাড়িয়ে “না” জানাল। মাহির জিজ্ঞেস করল,
‘তাহলে কাঁপছো কেন?’
‘শীত লাগছে।’
হেসে ফেলল মাহির। এই বিদঘুটে গরমে কারোর শীত লাগে না-কি। সে বালিশের পাশ থেকে এসির রিমোট নিয়ে এসিটা আরো কমিয়ে দেয়। বলে,
‘চিন্তা করো না, একটু পর গরম লাগবে।’
এই নিস্তব্ধ, নিস্তেজ রাতে এক পুরুষ যখন নিজের প্রেয়সীতে মত্ত অন্যদিকে আরেক পুরুষ সেই প্রেয়সীর দুঃখে নিদ্রা ছিন্ন। দুই চোখের পাতা এত ভার কেন? কেন তা এক হচ্ছে না? কেন একটু ঘুমিয়ে মনকে শান্ত করতে পারছে না? পাশেই ভুসভুস শব্দ তুলে অমিত ঘুমাচ্ছে। অন্যদিন হলে অয়ন এতক্ষণে বিরক্ত হয়ে উঠলেও আজ তার মাঝে কোনো ভাবান্তর নেই। যেন এই শব্দ কানেই যাচ্ছে না তার। বধির সে, কান হৃদয় সবকিছুতেই যেন তালা মেরেছে।
একটি অপ্রেমের গল্প পর্ব ৩৭
তাও যদি একটু খানি শান্তি পায়। দুই বছর যাবত যেই নারীকে নিয়ে হৃদয়ের আঙিনা সাজিয়েছে সেই নারী আজ অন্যকারোর ভালোবাসায় সুখোবতী। তাকে ভুলে রিক্ত আঙিনা নিয়ে বাকি জীবন কাটাবে কী করে? অয়ন পাশ ফিরল। কার্ণিশ বেয়ে জল পড়ল কি-না বোঝা গেল না। তার হৃদয় নিংড়ে বেরিয়ে আসা রুদ্ধশ্বাসে আওড়াল,
‘মৃতু মানুষকে ভোলার চেয়েও জীবিত মানুষকে ভুলে যাওয়া কঠিন।’