একটি অপ্রেমের গল্প পর্ব ৩৯
জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
প্রভাকর মশাই তার ক্রোধ ছড়াতে ব্যস্ত। আর তার এই চকচকে তকতকে প্রভায় দীপ্তমান ঘরখানা। বিছানায় লেপ্টে থাকা দেহজুড়ে সেই দ্যুতি খেলা করছে। খানিকটা নড়ে উঠে অন্বিতা। সূর্যকর বড্ড যন্ত্রণা দিচ্ছে তাকে। সে পিটপিট করে তাকায়। আচমকা কোথায় আছে বুঝতে পারে না। ঝলমল জৌলুসে অপরিচিত লাগে সব। পরক্ষণেই নিউরন জেগে উঠে। মাথা তুলতেই চোখে পড়ে উদম দেহের মাহিরকে। ঘুমঘুম আর ফোলা ঠোঁটে এক গাল হাসে সে।
তারপর ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে তার বাঁধন থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা চালায়। তবে ব্যর্থ হয় সাথে সাথেই। মাহির ঘুমের মাঝেও তার হাত এত দৃঢ় করে রেখেছে যে ছাড়ানোর জো নেই। অন্বিতা আরেকটু নড়ল। পরক্ষণেই আবার গুঁটিয়ে নিল নিজেকে। আশেপাশে ত্রস্ত চোখে চেয়ে দেখল, তার শাড়ি কোথায়। শাড়িটাকে মেঝের এক কোণে ভীষণ অসহায় অবলীলায় পড়ে থাকতে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। চাঁদরটা গায়ে টেনে মাহিরের হাত সরানোর চেষ্টা করল। মাহির তো নড়ল’ই না উল্টো ঘুমের মাঝেই কপাল কুঁচকাল। অন্বিতা মিটিমিটি হাসল তা দেখে। মাহিরের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘এই অভদ্র ডাক্তার, ছাড়ো। উঠব আমি।’
মাহিরের কান অবধি বোধ হয় কথাটা গেল’ই না। সে আগের মতোই নিরুদ্বেগ। অন্বিতা ঘড়ির দিকে চাইল। সেকি! দশটা বাজে। কপাল উঁচিয়ে অন্বিতা বলে উঠে,
‘দশটা বাজে, মাহির। এত বেলা অবধি ঘুমালে মানুষ কী বলবে?’
‘মানুষ জানে, কালকে রাতে আমরা ঘুমাইনি। তাই সকালে লেইট করে উঠলে কেউ কিছু মনে করবে না।’
অন্বিতাকে আরেকটু টেনে ধরে চোখ বোজা অবস্থাতেই মাহির বলল। অন্বিতা তার হাত টেনে ধরে বলল,
‘সবাইকে নিজের মতো অসভ্য ভাব নাকি?’
মাহির মাথা ঘুরিয়ে চাইল তার দিকে। চোখ কিঞ্চিৎ খোলা। কন্ঠস্বর নিভু। জড়ানো স্বরে বলল,
‘বউকে আদর করা যদি অসভ্যতা হয় তবে সেই অসভ্যতার উপর আমি পিএইচডি করব।’
অন্বিতা তার বুকের উপর হালকা হাতে চড় মেরে বলল,
‘বাজে কথা না বলে ছাড়ো তো। দাদু, ফুপি সবাই বাসায়। তোমার মান সম্মান না থাকলেও আমার আছে।’
মাহিরের সারা নেই। সে আবারও চোখ বুজে নিয়েছে। অন্বিতা নাক মুখ কুঁচকে নিল। বীতঃস্পৃহ সুরে বলল,
‘কী শুরু করলে বলো তো? তোমার ঘুম আসলে তুমি ঘুমাও, আমাকে ছাড়ো।’
মাহির হাত আলগা করে চাঁদর টেনে অন্যদিকে ফিরে শু’লো। আঁতকে উঠল অন্বিতা। মাহিরের গায়ের চাঁদরে টান দিয়ে বলল,
‘আরে চাঁদর নিলে কেন? চাঁদর দাও।’
‘উফ, জ্বালাবে না তো। ঘুমাচ্ছি আমি।’
অন্বিতা নিজেকে একবার পরখ করে অসহায় সুরে বলল,
‘আমি উঠব তো, চাঁদরটা দাও।’
মাহির ফিরলও না। বরং বলল,
‘উঠলে উঠো, চাঁদর ধরে টানাটানি করছো কেন?’
অন্বিতা কপট রেগে বলল,
‘চাঁদর ছাড়া উঠতে পারব না, তাই।’
‘না পারলে শুয়ে থাকো।’
মাহির ঘাড়ত্যাড়া সেটা আর নতুন করে বোঝার কিছু নেই। সে যে এখন তার সাথে ইচ্ছে করে ত্যাড়ামি করছে সেটা অন্বিতা বেশ বুঝতে পারছে। তাই রাগ হলেও কিছু বলল না সে। ধীরে ধীরে উঠে বসল। তারপর দ্রুত গিয়ে মেঝেতে পড়ে থাকা শাড়িটা জড়িয়ে নিল শরীরে। যুদ্ধে যেন জয়লাভ করেছে তেমন’ই এক হাসি ফুটল ঠোঁটে। মাহিরের দিকে চেয়ে মুখ ভেংচি দিয়ে বলল,
‘অসভ্য।’
গোসর সেরে বেরিয়ে এসে মাহিরকে দেখল বিছানায় বসে ফোন দেখছে। ফোনের স্ক্রিনে পূর্ণ মনোযোগ তার। অন্বিতা এক পলক তাকে দেখে নিয়ে বারান্দায় গিয়ে ভেজা তোয়ালেটা নেড়ে আসে। তারপর এসে দাঁড়ায় মাহিরের ঠিক সম্মুখে। ফোন থেকে চোখ সরিয়ে মাহির তখন অন্বিতার দিকে চাইল। সদ্য গোসলে তার ভেজা চুল থেকে পানি পড়ছে টপটপ করে। গাঢ় নীল রঙা সুতি শাড়িতে নববধূর ভাবখানা স্পষ্ট। চোখে মুখে চেয়ে আছে চমৎকার শুভ্রতা। মাহির চোখ সরু করে মিহি সুরে বলল,
‘এভাবে তাকিও না তো, হৃদয় দূর্বল হয়ে পড়ছে আমার। হার্ট অ্যাটাক করে এত তাড়াতাড়ি আমি মরতে চাই না।’
অন্বিতা নাক ফুলাল। ক্ষিপ্ত সুরে বলল,
‘তুমি এত বড়ো রাক্ষস জানলে আমি তোমাকে কখনোই বিয়ে করতাম না।’
মাহির ভ্রু কুঁচকাল। অন্বিতাকে আপাদমস্তক দেখে বলল,
‘রাক্ষস হলে কি তুমি এখনও আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারতে, বরং তুমি তো থাকতে আমার পেটে।’
বলেই দাঁত কেলিয়ে হাসল সে। অন্বিতা ধমক দিয়ে বলল,
‘হাসবে না একদম। এসব কী করেছ, অসভ্য?’
অন্বিতা গলার সামনে থেকে চুল সরিয়ে বলল। মাহির দেখল, তার গৌর রঙা ঘাড় গলায় জায়গায় জায়গায় রক্তিম আভা। তা দেখে ঠোঁট চেপে হাসল সে। পরক্ষণেই আবার চোখে মুখে অসহায় ভাব ফুটিয়ে তুলে বলল,
‘হায় হায়, কী করে হলো এসব? আমার বউয়ের ফর্সা গলা ঘাড়ের এই অবস্থা হলো কী করে?’
এইটুকু বলে আবারও ঠোঁট চেপে মুচকি হাসে সে। অন্বিতা রোষপূর্ণ চোখে চেয়ে বলে,
‘মজা করছো আমার সাথে?’
মাহির এবার সিরিয়াস হয়ে বলে,
‘মোটেও না। ঐ ড্রয়ারে দেখো ফার্স্ট এইড বক্স আছে- নিয়ে এসো ঔষধ লাগিয়ে দেই।’
অন্বিতা ভেংচি কেটে বলল,
‘লাগবে না আমার। ইচ্ছে করে এসব করে এখন এসছে ঢং করতে।’
মাহির মাথা নুইয়ে লজ্জার ভাব ধরে বলল,
‘কী করব, বলো? এত বছরের অপেক্ষার ফল তো একটু বেদনাদায়ক হবেই। স্যরি, বেশি ব্যথা পেয়েছ?’
গলার স্বর যতই নরম করুক চোখে মুখে তার দুষ্টুমি স্পষ্ট। অন্বিতা আর কথা বাড়াল না তাই। চুপচাপ গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়াল। মাহির উঠল বিছানা ছেড়ে। আলমারি থেকে কাপড় বের করতে করতে বলল,
‘অপেক্ষা করো, ফ্রেশ হয়ে এসে একসাথে নিচে নামব।’
গাড়িতে উঠতে নিয়েও কারোর গলার স্বরে থমকে দাঁড়ায় অমিত। পেছন ফিরে চেয়ে পরিচিত এক মুখ দেখে। চিনতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি বিধায় হেসে জিজ্ঞেস করে,
‘কেমন আছেন?’
‘ভালো। আপনি কেমন আছেন?’
‘আমিও ভালো।’
আভা এগিয়ে এল খানিকটা। অমিতদের দিকে চেয়ে ইতস্তত সুরে বলল,
‘একটা অনুরোধ করব, রাখবেন?’
অমিত ভাবল ঈষৎ। মেয়েটা অন্বিতার বান্ধবী, এই মেয়েটার হঠাৎ তার কাছে কী অনুরোধ থাকতে পারে। অমিতের কাছ থেকে উত্তর না পেয়ে আভা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল যেন। ক্ষীণ সুরে বলল,
‘রাখবেন না?’
অমিত প্রসন্ন হেসে বলল,
‘চেষ্টা করব। কী অনুরোধ, বলুন।’
আভা আশেপাশে একবার তাকাল। কথাটা কী করে যে বলবে, বড্ড অস্বস্তি হচ্ছে তার। অমিত তাকে দেখছে। মেয়েটাকে অস্থির দেখাচ্ছে। কিছু বলতে চেয়েও হয়তো বলতে পারছে না। তাই সে আশ্বস্ত করে বলল,
‘নির্দ্বিধায় বলতে পারেন, অসুবিধা নেই।’
আভা ঈষৎ হাসল। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিজেকে ধাতস্ত করে বলল,
‘আপনার বন্ধু অয়নের ফোন নাম্বারটা পেতে পারি?’
চমকাল, থমকাল অমিত। চোখ পিটপিট করে কতক্ষণ দেখল আভাকে। আভা লজ্জায় আড়ষ্ট। চোখও তুলতে পারছে না। অমিত এক লহমা সময় নিয়ে বলল,
‘আপনি অয়নকে পছন্দ করেন?’
আচম্বিত এমন প্রশ্ন শুনে খানিকটা ঘাবড়ে যায় আভা। কী বলবে বুঝে উঠতে পারে না। মাথাটা আরো নুইয়ে ফেলে। অমিত শান্ত স্বরে বলে,
‘ভয় পাবেন না। বলুন আমায়।’
আভা অপ্রতিভ। লজ্জায় মর মর অবস্থা। তাও সাহস করে উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে বলল,
‘জি।’
মৃদু হাসল অমিত। মনে হলো, অয়নের এই ছন্নছাড়া জীবনকে গুছিয়ে দেওয়ার জন্য এখন অতি জরুরি ভিত্তিতে কাউকে প্রয়োজন। আর সেটা যদি হয় অন্বিতার বান্ধবী তবে মন্দ নয়। সে বলল,
‘ফোন বের করুন, আমি নাম্বার বলছি।’
একটি অপ্রেমের গল্প পর্ব ৩৮
আষাঢ়ের মেঘ সরে এক চিলতে আলো ফুটল। ঐটুকু আলো দেখে অমিত খুশি হলো যেন। মন মনে খুব করে চাইল, এই আলোর আগমনে যেন তার বন্ধুর জীবনের সমস্ত তমশা প্রশমিত হয়। যেন বসন্তের প্রথম কিরণের ন্যায় প্রস্ফুটিত হয়ে উঠে তার জীবন।