একটি নির্জন প্রহর চাই সিজন ২ পর্ব ১৩

একটি নির্জন প্রহর চাই সিজন ২ পর্ব ১৩
Mousumi Akter

সারাহ’র গোলাপি রঙের পুতুলটা ধরে রোশান সারাহ’র দিকে উঁকি মারল। সারাহ’র চোখ দুটো অশ্রুসিক্ত, আ’গু’নের মত জ্বলছে, ঠোঁটজোড়া কাঁপছে। রোশান পুতুলটা হাতে নিয়ে এগিয়ে গেলো সারাহ’র দিকে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সারাহ’র দিকে। রোশানের শীতল দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে সারাহর ফুঁসে উঠে বলল,
‘ নিন বলুন, এইবার আপনি কিছু বলুন। আপনার মা পারলে আমার গায়ে হাত তুলত। উনার অসম্পূর্ণ কাজটা আপনিই করে দিন। ‘ বলেই গাল এগিয়ে দিলো। রোশান সারাহ’র গালে হাত রাখল। আলত ভাবে স্পর্শ করল। শীতল কণ্ঠে জবাব দিলো,

‘ আমার হাত দুটো তোমার শক্তি হবে, যে তোমাকে আঘাত করবে সেখানে বাঁধা সৃষ্টি করবে, তাছাড়া তোমাকে কখনো আঘাত করবেনা। আজ থেকে তোমার দু’টো হাত নয় চারটা হাত। আমি কারো আঘাতে তুমি চোখের পানি ফেলো। আঘাতের বিনিময়ে আঘাত দিয়ে হাসতে শিখতে হয়। নাহলে এই পৃথিবীতে তুমি টিকতে পারবে না। আমি তোমাকে প্রতিবাদী মেয়ে হিসাবে দেখতে চাই।’ বলেই রোশান উঠে চলে গেলো। যাওয়ার সময় গাড়িতে একটা কথাও বলল না রোশান। সে চুপচাপ গম্ভীর মুডে বসে আছে। মুডের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। রোশানের আম্মু বলছে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘ এই মেয়ে অত সুবিধার হবেনা। আমি দু’টো ভালো কথা বলছিলাম দেখলাম মুখ পুড়িয়ে আছে।’
রোশানের বাবা খানিকটা অবাক হয়ে বললেন,
‘ মানে? বউমা বাড়িতে যেতে পারেনি এখনি তোমার ভালো কথা বলা হয়ে গিয়েছে। কি এমন ভাল কথা বলেছো যে মেয়েটা মুখ পুড়িয়ে আছে।”
রোশানের আম্মু বলল,
‘ শোনো রোশান তুমি কিন্তু এই মেয়েকে মোটেও প্রশ্রয় দিওনা। মেয়ে অত সুবিধার হবেনা।’
রোশান গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

‘ কাজটা কি ঠিক করেছো আম্মু?’
‘ কোন কাজ?’
রোশান আবার ও গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
‘ ও আমার ওয়াইফ আম্মু। ভাল-মন্দ যা বলতে হয় আমিই বলব। প্লিজ তুমি কিছু বলতে যেওনা। এতে তুমি ওর চোখে খারাপ হয়ে যাবে। আর আমি সেটা চাইছিনা আম্মু।’
রোশানের আম্মু বলল,
‘ কেন ওই মেয়ে কি তোমার কাছে নালিশ দিছে?’
‘ তুমি যাকে ওই মেয়ে, ওই মেয়ে করছো সে কিন্তু তোমার ছেলের বউ। তাই নাম ধরে বলাই সম্মানের হবে।’
রোশানের বাবা রোশানের মায়ের দিকে চোখ রাঙিয়ে বলল,
‘ সময় আছে এখনো,ভালো হয়ে যাও।’

বাইরে বৃষ্টির শব্দ একটু কমেছে। তরী অন্ধকার ঘরে একা একা সুয়ে আছে। এখন তার লেখাপড়া ও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বাবার খেয়াল নেই মেয়ের দিকে। সে তার নতুন বউ নিয়ে ব্যস্ত আছে। পাশের রুমেই তরীর বাবা আর তার নতুন মা। তাদের কথোপ-কথোন সব শোনা যাচ্ছে। তরীর কানে ওদের কথোপ-কথন গুলো খুব বাজে শোনাচ্ছে। কান চেপে ধরেও লাভ হচ্ছে না। খুব জোরে তরীর বাবার চুমুর শব্দ শোনা যাচ্ছে। তরীর বাবা তার নতুন বউকে বলছে,

‘ আমি তোমার ঠোঁট দেখে পা-গ-ল হয়েছিলাম। এইজন্য ঠোঁটে চুমু খাই বেশী। ‘
মেয়েটা বলছে, ‘ আমি তোমার সব দেখেই পা-গ-ল হয়েছিলাম।’
তরীর বাবা বলছে,
‘ আর একটু কাছে আসো।’
‘ তোমার বুকেই তো আছি আর কি করব।’
‘ মন ভরছে নাতো। তোমাকে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছা হচ্ছে।’
‘ খেও কিন্তু তার আগে আমাকে একটা আইফোন দিও।’
‘ আগামিকাল ই দিবো, তুমি শুধু আমাকে খুশি করো।’

তরী বিছানা ছেড়ে উঠে গেলো। এত নোংরা কথাবার্তা সে আর নিতে পারছে না। ইচ্ছা হচ্ছে এই নোংরা পরিবেশ ছেড়ে দূরে কোথাও পালিয়ে যেতে। চোখে পানি ছলছল করছে তরীর। ঘরের দরজা খুলতেই মুখোমুখি হলো মৃন্ময়ের। একদম কাকভেজা ভিজে বাড়িতে হাজির হয়েছে সে। বাহিরে হাজারও বজ্রপাতের শব্দ উপেক্ষা করে সে বাড়িতে এসেছে। বাড়িতে ঢুকেই তরীর মায়াবী মুখটা দেখবে কল্পনাও করতে পারেনি। মৃন্ময় ভেজা শরীরে ঠোঁটে হাসি নিয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে তরীর দিকে তাকিয়ে। তরী একবার কোনওরকম মৃন্ময়ের দিকে তাকালো। তারপর দ্রুত গতিতে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলো নিচে।

মৃন্ময় বজ্রের ন্যায় তাকালো তরীর পথপানে। এই পিচ্চি মেয়েটা এতরাতে কোথায় যাচ্ছে। বাইরের ওয়েদার তো ভালো নেই। মৃন্ময় ও তরীর পেছন পেছন নামল। বাইরে মেঘ ডাকছে, বজ্রপাত হচ্ছে,তান্ডব চলছে সব ভ’য় ডর উপেক্ষা করে তরী বাড়ি থেকে পা বাড়ালো। সে তার গন্তব্য জানেনা। শুধু চাইছে এই ঝড়-বৃষ্টির মাঝে একটা অঘটন ঘটে যাক। সে মরে যাক। এই পৃথিবীতে তার আপণ বলে কেউ নেই। কেউ তাকে ভালবাসেনা। ভালবাসার মত কেউ নেই যার এই পৃথিবীতে সে কার জন্য বাঁচব। একদম চোখ বন্ধ করে তরী হাঁটছে। মৃন্ময় বুঝতে পারল মেয়েটার কিছু হয়েছে। সে নিজের ভেতরে নেই। মৃন্ময় পেছন থেকে গিয়ে তরীর হাত টেনে ধরল। আচমকা কেউ হাতের কব্জি চেপে ধরায় তরীর হৃদপিন্ড কেঁপে ওঠল। সে পেছন ফিরে তাকালো। তাকিয়ে দেখল মৃন্ময়। তরী পেছন ফিরে তাকাতেই মৃন্ময় তরীকে বলল,

‘ এই পিচ্চি যাচ্ছো কোথায় এইভাবে? বাইরে তান্ডব চলছে, একটা বিপদ ঘটাবে তুমি। চারদিকে বজ্রপাত হচ্ছে। ‘
তরী মলিন মুখে তাকিয়ে আছে মৃন্ময়ের দিকে। তার মুখে কোনো হাসি নেই। কোনো কথার উত্তর দিচ্ছেনা। মৃন্ময় আবার বলল,
‘ কি তোমার বাবা জানেন তুমি ঝ-ড় তুফানের মাঝে বাহিরে যাচ্ছো। তোমার কিছু হলে তোমার বাবার কি হবে।’
মৃন্ময় যা ভাবছে তা ভুল। সব মিথ্যা। এই পৃথিবীতে এমন কেউ নেই যে তরীকে ভালবাসে, তরীর জন্য চিন্তা করে। তরীর প্রচন্ড কান্না পাচ্ছে। এই পৃথিবীতে কেউ নেই যে ওর কান্নাটুকু ও দেখবে। তরীর মুখে কোনো কথা নেই। সে মলিন মুখে দাঁড়িয়েই আছে। মৃন্ময় আবার বলল,

‘ কি আশ্চর্য! তুমি এমন রোবটের মত চুপ হয়ে আছো কেন? চলো তোমাকে তোমার বাবার কাছে দিয়ে আসি।’
তরী এইবার শব্দ করে কেঁদে উঠল। হাউ মাউ করে কেঁদে উঠল। কেন যেন মনে হচ্ছে জীবনে প্রথম কেউ তাকে গুরুত্ব দিচ্ছে। কেউ তার বিপদের পরোয়া করছে। তরীকে এইভাবে কাঁদতে দেখে মৃন্ময়ের বুকের মাঝে অদ্ভুত এক চিনচিন ব্যাথা হচ্ছে। কেন এমন হচ্ছে। তরী কান্না মৃন্ময় একটুও সহ্য করতে পারছে না। মৃন্ময় তরীর পারমিশন ছাড়াই তরীর কাঁধে হাত রাখল। তারপর বলল,
‘ প্লিজ বলো কেন কাঁদছো? আই প্রমিজ আমি তোমার সব কান্না মুছে দিবো। ‘
তরী কাঁদতে কাঁদতে বলল,

‘ আমার বাবা কোনদিন আমাকে নিয়ে টেনশন করবে না। কোনদিন জানতে চাইবে না এই ঝ-ড় বৃষ্টির রাতে আমি কোথায় আছি। প্লিজ!আমার হাতটা ছেড়ে দিন আপনি।’
মৃন্ময়ের হৃদয়ের যন্ত্রণা আরোও কয়েকগুন বেড়ে গেলো। সে আহত কণ্ঠে বলল,
‘ কোথায় যেতে চাও?’
‘আম্মুর কাছে। জানেন আম্মু মরার পর আর কেউ কোনদিন জিজ্ঞেস করেনি আমার কি খেতে ভালো লাগে। আমার শরীর খারাপ কিনা? আমার মন ভালো আছে কীনা? কেউ না। কেউ কোনদিন আমার সাথে মন খুলে দু’টো কথাও বলেনি।’ কথাগুলো বলে তরী কাঁদতে থাকল। মৃন্ময়ের হৃদয়ে অস্থির তোলপাড় শুরু হলো। যন্ত্রণায় বুক ফেঁটে যাচ্ছে। সে তরীর সামনে নিজেকে শক্ত রেখে বলল,

‘অপমৃত্যু হলে তো আম্মুর কাছে কখনোই যেতে পারবে না বোকা মেয়ে। জীবন অনেক কঠিন। তোমাকে লড়াই করে বাঁচতে হবে। বাঁচার মত বাঁচতে হবে।’
তরী সেসব কথার কোনো উত্তর দিলোনা। সে মৃন্ময়ের থেকে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করল। মৃন্ময়ও তরীর পেছন পেছন হাঁটতে হাঁটতে বলল,
‘ শোনো পিচ্চি, একদিন তুমি কারো হৃদয়ের রানি হবে। যে হাসতে হাসতে বলবে আমার বেঁচে থাকার জন্য তুমিই যথেষ্ট। ওইদিন তুমি হাসবে, প্রচুর হাসবে। ওই হাসি টুকুর জন্য, তোমার সেই মানুষটার জন্য হলেও তো তোমার বেঁচে থাকা উচিৎ। ‘

তরী কখনো এ ধরণের কিছু চিন্তা করেনি তার জীবন নিয়ে। তাই এসব কথা তার মনের অনুভূতির বিন্দুমাত্র পরিবর্তন৷ ঘটাতে পারল না। তবে সে পেছন ফিরল। মৃন্ময়ের চোখের দিকে তাকালো। মৃন্ময় মনে মনে বলল,
‘ ইশ! তোমার চোখের চাহনিটা। আমার একমাত্র সুখের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
পাশেই কোথায় যেন বিকট শব্দে বজ্রপাত হলো। সেই শব্দে তরী খানিকটা কেঁপে উঠল। মৃন্ময় দুষ্টুমি করে তরীর কাছে দৌঁড়ে গেলো। তরীর কাছে গিয়ে বলল,
‘ ভয় পেলে কাউকে জড়িয়ে ধরতে হয়। তাহলে ভয় কেটে যায়। আমি ভয় পেয়েছি এখন কাকে জড়িয়ে ধরব।’
তরী সরল চোখে তাকিয়ে বলল,

‘ কাকে আবার, কাকিমাকে জড়িয়ে ধরবেন কাকু।’
মৃন্ময় বিড়বিড় করতে করতে অন্যদিকে ঘুরে তাকালো। তরীর মুখের কাকু ডাক আর বিষ পানের অনুভূতি একই। মৃন্ময় বিরক্ত কন্ঠে বলল,
‘ আমার বাপের একমাত্র ছেলে আমি। বুঝতে শেখার পর থেকে বিয়ের জন্য ছটফট করছি। শুধু বিয়ে করব আর বউ এর কোলে মাথা রেখে ঘুমাব বলে বেঁচে আছি। চারপাশে যেভাবে বজ্রপাত হচ্ছে, কিছুক্ষণ বাহিরে থাকলে বজ্র আঘাতে মৃত্যু হবে। আমার বিয়ের শখ সব মাটির নিচে যাবে। দয়াকরে তুমি আমাকে কাকু না ডেকে এখান থেকে চলো।’

একটি নির্জন প্রহর চাই সিজন ২ পর্ব ১২

তরী আবারও সরল চোখে তাকিয়ে বলল,
‘ কাকুকে কি ডাকব তাহলে?’
‘কাকু না ডেকে একবারে আব্বা ডাকা ভালো। বইন আমি তোমার কাকুনা,বাপনা,মামানা,ভাইনা, ভাতিজা না, দাদাও না। এইসব বাদে যেটা বাকি থাকে ওইটাই ডাইকো। এখন ঘরে চলো।’
তরী মনে মনে ভাবছে তাহলে কি বাদ থাকে।

একটি নির্জন প্রহর চাই সিজন ২ পর্ব ১৪