একটি নির্জন প্রহর চাই সিজন ২ পর্ব ৩১
Mousumi Akter
সারাহ রাগে গটমট করতে করতে কলেজ গেট পার হয়ে গিয়ে রিক্সায় উঠল। আকাশে তখন উথাল-পাথাল করা মেঘ। বৃষ্টি নামবে এখনি। বলতে বলতেই বড় বড় কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি পড়ল রিক্সাওয়ালার মাথার ওপর। রিক্সাওয়ালা সারাহ’কে বলল,
” মামা সাইডে দাঁড়াবো, বৃষ্টি শুরু হবে।” বলেই এক সাইডে দাঁড়ালো।
সারাহ এক মুহুর্ত দেরি না করে রিক্সা থেকে নামল। রিক্সাওয়ালার ভাড়ার টাকা পরিশোধ করে একটা দোকানের নিচে গিয়ে দাঁড়ালো। বারবার ফোনের ভাইব্রেশনে ব্যাগ কাঁপছে। ঊনিশ বার রোশানের নাম্বার থেকে কল এসেছে। সারাহ বিরক্ত হয়ে রোশানের নাম্বার ব্লক করে দিলো। কেন দিন দিন সারাহ ডেস্পারেট হয়ে যাচ্ছে। কেন এমন হচ্ছে? মনের মাঝে অশান্তির দাউ দাউ করা আ’গু’ন। কোন আ-গু-নে পু’ ড়’ ছে সারাহ সে জানেনা।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এই মুহুর্তে সে কি চায় সেটাও জানেনা। শুধু জানে সে ভালো নেই। মন আর মস্তিষ্কে কি চলছে বুঝে উঠতে পারছে না। আরিয়ানের প্রতি তীব্র ঘৃণা হয়। অতীতের সময়ের জন্য আফসোস হয়। ঘৃণা হয় নিজের প্রতি। কেন সে আরিয়ান’কে ভালবেসেছিলো। এত সুন্দর হয়েও নিজের খালাতো ভাই-এর থেকে ঠকতে হয়েছিলো তাকে। এরপর জীবনে হুট করে একজনের আগমন হলো। তার সাথে কিছুদিন থাকতে থাকতে জীবনে দ্বিতীয়বার মনে হচ্ছে সে আবারও প্রেমে পড়েছে। কিন্তু যার প্রেমে পড়েছে সে কি আদৌ কিছু বোঝে? সে কি আমার অনুভূতির সাড়া দিবে কোনদিন? সে কেন বুঝছে না আমি কি চাই? আমি আমার অনুভূতির নিংড়ে দিতে চাই তাকে। অশান্ত হৃদয়ে প্রশান্তি চাই।
সারাহ ফোন ব্যাগে রেখে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে শুরু করল। কোথায় যাচ্ছে সে জানেনা। চারদিকে মেঘ ডাকছে। প্রবল বৃষ্টি শুরু হল। অকারণ কাঁন্না পাচ্ছে। তার এই আচরণ খানিকটা অস্বাভাবিক।একটা মেন্টাল মানুষের মত বাড়াবাড়ি রকমের আচরণ।
রোশান চিন্তায় পা-গ-ল হয়ে যাচ্ছে। কোথায় গেল সারাহ। এভাবে তার নাম্বারই বা ব্লক করে দিলো কেন? রোশান নিজেই পা-গ-লের মত খুঁজতে শুরু করল সারাহ’কে। বৃষ্টিতে ভিজে শহরের অলিতে গলিতে খুঁজতে শুরু করল। নাম্বার ব্লক করাতে টানা মেসেজ করতে শুরু করল। তাতেও কাজ হলোনা, রোশান উপায় না পেয়ে অন্য মানুষের ফোন চেয়ে ফোন দিতে লাগল। সারাহ অতিষ্ট হয়ে ফোন বন্ধ করে ফেলল। আচেনা রাস্তার এক গলি দিয়ে প্রবেশ করে সারাহ এলোমেলো পায়ে হাঁটতে লাগল।
তখন সন্ধ্যা রাস্তা থেকে একটা বেলি ফুলের মালা কিনল মৃন্ময়। এই বৃষ্টিময় সন্ধ্যায় একটা বেলি ফুলের মালা তরীকে দিতেই হবে। ও ভীষণ খুশী হবে।
পিহুর ঘর থেকে সাতকাহন বইটি এনে জানালার পাশে বসে পড়ছে তরী। বই পড়া তার অতি প্রিয় একটি শখ। কতদিন হয়েছে সে বই ছুঁয়ে দেখেনি। অথচ ছোট বেলার স্বপ্ন ছিলো বড় হয়ে ডাক্তার হবে। বড় একটা বুকশেলফ থাকবে। শেলফভর্তি সমরেশ মজুমদার, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সব বই বই থাকবে। তরীর মা বলত, যার ঘরে বউ নেই সে ঘর অন্ধকারের সমান। জ্ঞানবৃদ্ধি,এবং মানবিকতার জন্য বই পড়া অত্যন্ত গুরুত্বের। তরী ছোটবেলায় ভীষণ চঞ্চল ছিলো। পারিবারিক কলহের স্বীকার হয়ে তরী আজ মন মরা একটি মেয়ে।
যে মেয়েটি ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলো সে মেয়েটি আজ কতদিন বই ধরে দেখেনি। লেখাপড়ার অধ্যায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে তার জীবন থেকে। তরীর মায়ের ছিলো ব্লাড ক্যান্সার। দিনের পর দিন ভুগেছে অথচ ঠিকভাবে চিকিৎসা করেনি তার বাবা। কখনো ডাক্তারের কাছে নেয়নি। তরীর মায়ের বয়স ও কম ছিলো। মাত্র পনেরো বছর বয়সে মা হয়েছিলো। আর ত্রিশ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছিলো। তরীর মায়ের কপাল প্রথম থেকেই খারাপ ছিলো। তার বাবা মেয়েকে বোঝা মনে করতেন। টাকার লোভে পনেরো বছর বয়সী মেয়েকে তার দ্বিগুনের চেয়ে বেশী বয়স্ক লোকের সাথে বিয়ে দেয়। লোকটার বয়স বেশী হলেও তরীর মা স্বামী হিসাবে তাকে মেনে নিয়েছিলো।
বয়স বেশী হওয়াটা অতটা সমস্যা ছিলোনা কিন্তু আসল সমস্যা ছিলো তার চরিত্রে। বয়স্ক মানুষ, চেহারা খারাপ মানুষ নিয়েও সংসার করা যায় কিন্তু চরিত্রহীন মানুষ নিয়ে সংসার করা যায়না। তার পরপরই শরীরে মরণ ব্যাধি বাসা বাঁধে। নিজের জীবনে লেখাপড়া শিখতে পারেনি কিন্তু নিজের মেয়েকে নিয়ে স্বপ্ন ছিলো। কিন্তু সেই স্বপ্ন ও তরীর মায়ের মৃত্যুর পরে ম’রে যায়। আসলে যার কপাল খারাপ হয়, তার কপালে কোনদিনই সুখ হয়না। নিজের বাবার খারাপ চরিত্র দেখে দেখে বড় হয়ে তরী আজ পুরুষ মানুষ দেখলেই ভ’য় পায়।
তার কাছে পুরুষ মানুষ মানেই খারাপ। কিন্তু চাইলেই কি সব করা যায়। মন বড় অদ্ভুত জিনিস। পুরুষ মানুষ হাজার ও ঘৃণা করার পরেও মৃন্ময়ের প্রতি তার কেমন যেন একটা টান অনুভব হয়। মৃন্ময়’কে দেখতে ইচ্ছা করে। বুকের মাঝে দুরু দুরু করে মৃন্ময়ের জন্য। এইতো সেদিন তরী রাগ করেছিলো। সেদিন দিশা আর তরীর বাবা সিনেমা দেখতে গিয়েছিলোম মৃন্ময় জোর করে তরীর রুমে গিয়েছিলো পিহুকে নিয়ে। তরীর দূর্বলতা আর ভ’য় ভীতি দেখে মৃন্ময় তরীর মনে সাহস জুগিয়েছিলো। দিশা বা তার বাবা খারাপ ব্যবহার করলে সে যেন প্রতিবাদ করে। সে যতদিন চুপচাপ সহ্য করবে তারা খারাপ ব্যবহার করেই যাবে।
তাছাড়া তরী যেন আবার লেখাপড়া শুরু করে। কেন যেন মনে হয়েছিলো তরীর মা এসে তরীকে বুঝাচ্ছিলো। সেদিনের পর থেকে মৃন্ময় যেন তরীর ভরসার জায়গা। তরী সাতকাহন বইটা ছেড়ে একটা চকলেট বক্স বের করল। মৃন্ময় পিহুর হাত দিয়ে সেদিন পাঠিয়েছিলো। সেই বক্সে ছিলো একটা চিরকুট। চিরকুটে লেখা ছিলো, ‘ তুমি হাসলে মনে হয়, একটা স্বচ্ছ পদ্মফুল। ‘
তারপর কত হাজার বার সরি বলেছিলো তা গোনা ছিলোনা তরীর। তার মায়ের মত এই প্রথম কেউ তার রাগের কেয়ার করছিলো। সেদিনের পর থেকে তরী চিরকুট’টা রেগুলারই একবার করে পড়ে আবার চকলেট বক্সে রেখে দেয়। একটা চকলেট ও সেখান থেকে খায়নি। এরই মাঝে হঠাৎ দিশা তরীর রুমে এসে চকলেটের বক্সটা তরীর হাত থেকে ছোঁ মে’রে নিয়ে বলল,
“প্রেম করতেছো?”
তরীর রুচিতে বাঁধে দিশার সাথে কথা বলতে। বাবাকে বিয়ের পর থেকে অপছন্দ করে। এখন মৃন্ময়ের দিকে আকৃষ্ট দেখে আরো বিরক্ত লাগে। তরী গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“ওটা দাও।”
হিংসায় দিশার চক্ষু ছুটে যাচ্ছে। বেশ রাগান্বিত কণ্ঠে বলল,
“আমার প্রশ্নের আগে উত্তর দাও, প্রেম করতেছো? কার সাথে?”
তরী ঘৃণাভরা দৃষ্টিতে দিশার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি বলতে আগ্রহী নই।”
দিশা আবারও রাগান্বিত কণ্ঠে বলল,
“তোমার মুখে দেখছি বুলি ফুটেছে।”
“বুলির কি হলো?”
দিশা এবার মৃন্ময়ের নাম ধরেই বলল,
“কে দিয়েছে এটা? মৃন্ময়!”
তরী চকলেটের বক্সটা ছোঁ মেরে দিশার হাত থেকে নিয়ে বলল,
“মৃন্ময়ের প্রতি আমার এত আগ্রহ নেই, যতটা তোমার আছে।”
মৃন্ময়ের তরীর প্রতি আকৃষ্টতা দিশাকে পোড়াচ্ছে। সে চাইছে না মৃন্ময় তরীর কাছাকাছি আসুক।।দিশা খুব চিল্লাপাল্লা করে তরীর বাবাকে ডাকল। তরীর বাবা এগিয়ে আসতেই দিশা বলল,
” তোমার মেয়ে কার সাথে যেন প্রেম করছে, আমি সেটা জানতে চাইতেই আমার গায়ে হাত তুলেছে। দেখো ওর হাতে চকলেট। কে দিয়েছে এসব। আমি না হয় ওর সৎমা তাই বলে আমার গায়ে হাত তুলবে।”
তরীর বাবা কোনো কথা না শুনেই তরীর দু’গালে খুব জোরে চ’ ড়’বসিয়ে দেয়। তরীর ঘাড় ধরে রুম থেকে ধাক্কা মেরে বলে,
” দূর হ আমার চোখের সামনে থেকে। সাতদিনের মাঝে তোর বিয়ে দিয়ে দিবো আমি।”
দুঃখে, কষ্টের প্রচন্ড বৃষ্টির মাঝে তরী ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। কোথায় যাবে সে? কে দিবে আশ্রয়? পৃথিবীতে কি কেউ আছে যে তাকে একটু আশ্রয় দিবে? কেউ কি নেই তার অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তি দিবে। বাসা থেকে বের হতেই তরী দেখল, ছাতা হাতা মৃন্ময় একটা ফুলের মালা হাতে নিয়ে এগিয়ে আসছে। তরীকে দেখেই মৃন্ময় হলো মেঘ না চাইতে জলের মত। মৃন্ময় আজ ভেবেই এসেছে এই বৃষ্টিটা সে পিহুর সাহায্য নিয়ে তরীর সাথে কাটাবে। বাড়ি ঢোকার আগেই তরীর দেখা মিলল।
মৃন্ময়’কে দেখেই মনে হল এই পৃথিবীতে একমাত্র আপণজন তার মৃন্ময়। নিজেকে আর সামলাতে পারল না। ছুটে গেলো মৃন্ময়ের কাছে। আক্সমিক মৃন্ময়কে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ কাঁন্নায় ভেঙে পড়ল। এমন কিছু আজ মৃন্ময়ের জন্য অপেক্ষা করছিলো মৃন্ময় জানতনা। শরীর যেন কাঁপতে শুরু করল। হৃদস্পন্দের গতিবেগ যেন থেমে গেলো। দুই ঠোঁটের মাঝে ফাঁকা হয়ে গেলো তার। কি যে ঘটে গেলো তার মন আর শরীরে সে টের পেলনা। কেবল কিঞ্চিৎ হেসে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
” ধন্যবাদ সৃষ্টিকর্তা, আজ আমার বর্ষণসঙ্গিনীকে খুঁজে পেয়েছি।”
তরী প্রচন্ড কাঁন্নায় ঢলে পড়ল মৃন্ময়ের বুকে। কষ্টের তীব্রতা যেন আজ ক্রমশ কমছে। মৃন্ময় পরমে স্নেহে তরীকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বলল,
” তোমার সব টুকু কষ্ট নিংড়ে দাও তরী। আমি তোমার কষ্টের ভার নিতে চাই।”
তরী ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে বলল,
” আমি ম’রে যেতে চাই। আমাকে মে’রে ফেলুন আপনি। আমি আর সহ্য করতে পারছি না। ”
মৃন্ময় তরীর কপালে আলত চুমু দিয়ে বলল,
” বোকা মেয়ে তুমি ম’র’বা কেন? তোমার চোখে তাকিয়ে সেই কবেই ম’রে গিয়েছি মায়াবিনী। তুমি একবার আমার হাতটা শক্ত করে ধরো, তোমার জন্য সারা দুনিয়ার সাথে যুদ্ধ করতে রাজি আমি। ”
তখন ও তরী কাঁদছে, তবে এই কাঁন্না আনন্দের। তীব্র আনন্দের। যেন ম’রা গাছে নতুন করে সবুজ পাতা গজানোর মত।
একটি নির্জন প্রহর চাই সিজন ২ পর্ব ৩০
চিন্তায় পা-গ-ল প্রায় রোশান। কাক ভেজা হয়ে রাস্তা দিয়ে ঘুরাঘুরি করছে। জীবনে প্রথমবার এতটা দুঃচিন্তায় পড়েছে সে। সে কতশতবার ফোন কলে ট্রাই করেছে তার হিসাব নেই।
নিজের গভীর অনুভূতি সে সারাহ’কে বোঝাতে পারেনা। তবুও একটা মেসেজ লিখল,
” কোথায় হারিয়ে গেলে সারাহ। তুমি ছাড়া শূণ্য লাগছে সব। এক সেকেন্ডের জন্য মনে হচ্ছে তুমি ছাড়া আমি অতল সমুদ্রে হারিয়ে যাচ্ছি। ঠাঁই খুঁজে পাচ্ছিনা কোথাও। প্লিজ কাম ব্যাক মাই লাইফ।