এক চিলতে রদ্দুর পর্ব ১৬

এক চিলতে রদ্দুর পর্ব ১৬
Yasira Abisha

রুহি জানে, সে আফানকে ভালোবাসে না। তার হৃদয়ের প্রতিটি অনুভূতি, প্রতিটি চাওয়া আজ শুধুই ইরাদের দিকে প্রবাহিত। আনাইকে ছাড়া তার দিন কল্পনাতীত, আর ইরাদ… সে জানে, ইরাদ ছাড়া তার জীবন অসম্পূর্ণ। কিন্তু এত বছর যে মানুষটা তার জীবনের একটা অধ্যায় হয়ে ছিল, তার জন্য কি কোনো মায়াও নেই? না, নেই। আফান যা করেছে, তার জন্য এক বিন্দু মায়াও নেই।
তবে, রুহির আত্মসম্মান তাকে বাধ্য করছে একটা সমাপ্তি টানতে, আফান যেভাবে মা বাবাকে ভুল বুঝিয়ে রাজি করেছে তা ঠিক হয়নি। এই অধ্যায়কে চিরতরে শেষ করার জন্য, আফানকে চোখে চোখ রেখে জানিয়ে দিতে হবে—সে কোথাও নেই, আর থাকবে না।

রুহি ফোন হাতে নিল। গভীর শ্বাস নিয়ে আফানের নম্বর ডায়াল করলো।
— “হ্যালো?”
— “আমাকে দেখতে আসবে?”
— “রুহি… হঠাৎ?” আফানের কণ্ঠে বিস্ময়।
— “সময় পেলে এসো। সন্ধ্যার পর।”
আর কিছু না বলে রুহি ফোন কেটে দিল। সে জানে, আফান আসবে। কিন্তু সে জানে না, আফান আসার পর কী অপেক্ষা করছে তার জন্য এতো গুলো কথা যা ভেবেছিলো আর বলার দরকার হবেনা আজ আবারো তা বলতে হবে।
রুহি কেবল আফানকে ডাকেনি, তার সঙ্গে জড়িত সবাইকে ডেকেছে। তার মা-বাবা, পরিবারের মানুষজন, এমনকি তার আর আফানের যেসব বন্ধু একসময় ভাবতো এরা একে অপরের জন্য, তারাও থাকবে।
এই সিদ্ধান্ত হুট করে নেয়নি রুহি। বিয়ে ঠিক হয়েছে জানার পর থেকেই নিজের রুমে একা বসে ভেবেছে রুহি —সে কাকে ভালোবাসে? কার জন্য তার মন কাঁদে? এক মুহূর্তের জন্যও আফানের মুখ মনে আসেনি। বরং আনাইয়ের ছোট ছোট হাসি, ইরাদের গম্ভীর অথচ গভীর দৃষ্টি—এইসবই বারবার ফিরে এসেছে মনে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

রুহির বাবা-মা তো ভাবে রুহির খুশিতেই তাদের খুশি, আফান যাওয়ার পর থেকে রুহি মন মরা হয়ে গেছিলো রুহি। এই ছোট্ট আনাই এসেই তো রুহির জীবনে প্রাণ দিয়েছে। কাল আনাই তার বাবার সাথে ব্যাস্ত হয়ে হয়ে পড়বে। রুহির ও বিয়ের বয়স হয়েছে মা বাবা চায় রুহির জীবনে সুখ আসুক তাই তো আফান যা করেছে তারপরেও তাকে মাফ করে রুহির জন্য একটা সুযোগ দিয়েছে। শুধু নিজের মেয়ের সুখ দেখতে। রুহির মা বাবা জানতো রুহি আফানকে কতোটা ভালোবাসে তাই তো কতো ভালো ভালো জায়গা থেকে রুহিকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া হতো একটাও রুহি গ্রহণ করেনি বরং আফানের জন্য সব প্রত্যাখ্যান করে দিতো। এসব ভেবেই রুহির বাবা মা আফানের ফাদে পা দেয় আর তারা ভাবে রুহি এখনো আফানকে আগের মতোই ভালোবাসে এবং তার সাথে থাকতে চায়।
রুহির মা খেয়াল করলেন আনাই ইরাদ যাবার পর থেকে রুহি তার ঘরে একা। এতো মানুষের মাঝে খুব একটা কথা বলার সুযোগ মেয়ের সাথে হয়ে ওঠে নি জামিলার (রুহির মা) কিন্তু মেয়ের চোখে যে হতাশার ছাপ, সেটা মা বুঝতে পারছিলেন ঠিকি। তাই সময় করে রুহির কাছে এসে জামিলা জিজ্ঞেস করেন,

— “তুই কি চাস, মা? আমরা তোকে কিছু না জানিয়েই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আফান আমাদের সাথে দেখা করে বলেছে তুই এখনো ওর জন্য কষ্ট পাচ্ছিস। শুধু সমাজের কথা ভেবে বিয়েটা করতে চাইছিস না। সত্যি কি তাই? নাকি অন্য কিছু? তোমার বাবা আর আমি সমাজের ভয়ে কোনোদিনও তোর খুশি কোরবান হতে দিবো না, জানিস তো?”
— “জানি মা” রুহি ফিসফিস করে বলল একটা হতাশা নিয়ে।
— “ যার জন্য তুই ছোটবেলা থেকে অপেক্ষা করছিলি। আজ সেই ছেলে ফিরে এসেছে, কিন্তু তোর মুখে হাসি নেই কেন?”
— “কারণ আমি ওর জন্য অপেক্ষা করিনি, মা। আমি অপেক্ষা করেছিলাম ভালোবাসার জন্য। বিশ্বাসের জন্য। আমি অপেক্ষা করেছিলাম এমন কারও জন্য, যে আমাকে ঠকাবে না আফান আমার ছেলেবেলার ভুল ছিলো৷ যেটা বুঝতে আমি দেরি করে ফেলেছিলাম।”
মা মেয়ের কথা শুনলেন আকবর সাহেব (রুহির বাবা)

শুরু থেকেই আফানকে তার খুব একটা পছন্দ ছিলো না কিন্তু মেয়ের তার প্রতি ভালোবাসা দেখে মেনে নিয়েছিলেন।
পেছন থেকে রুহির বাবা ধীরে ধীরে বললেন, “আমার মেয়ে সিদ্ধান্ত আমি সাধুবাদ জানাই।
তবে এই ছেলেটা তোকে যে অপমান করেছে, তার বিচার কীভাবে করবি, সেটাই এখন দেখার বিষয় আমার মেয়ে যা করবে আমি তাতে তার পাশেই আছি। কি বলো রুহির মা?”
মাথা নাড়িয়ে জামিলা হ্যাঁ সূচক অনুভূতি প্রকাশ করবেন।
রুহি একটা ম্লান হাসি হাসলো।
রাত হয়ে এলো। রুহির বাড়িতে জড়ো হলো সবাই। আফান এসে দেখে, শুধু রুহি না, তার মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন, এমনকি তাদের পুরোনো বন্ধুরাও এসেছে। একটা অস্বস্তি কাজ করছিল ওর মধ্যে।
— “রুহি, এটা কী?” আফান ফিসফিস করে জানতে চাইল।
— “বসো।”

আফান বসলো। সবার সামনে এমন পরিবেশে সে অভ্যস্ত না। রুহির মা তখন গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
— “তুমি আমাদের মেয়ের সাথে কি করেছো, সেটা কি আমরা ভুলে গেছি ভেবেছো?”
আফান থমকে গেল।
— “আমি তো… আমি ভুল করেছিলাম। কিন্তু আমি রুহিকে ভালোবাসি। আমি আবার ফিরে আসতে চাই।”
রুহি এবার উঠে দাঁড়াল। তার চোখে একটুও মায়া নেই, কেবল আত্মসম্মান আর অভিমান।
— “ফিরে আসতে চাও? কেন?”
— “কারণ আমি বুঝেছি, আমি তোমাকেই চাই।”
রুহি হেসে ফেলল। একরাশ তাচ্ছিল্য নিয়ে বলল,
— “তুমি কি আমাকে চাও? নাকি নিজের স্বার্থের জন্য আমাকে ব্যবহার করতে চাও? আমি জানি, তোমার জীবন এখন সংকটে, তোমার আত্মা কষ্টে আছে, আর তুমি ভাবছো, আমি তোমাকে শান্তি দেবো। আমি তোমাকে ক্ষমা করে সব ঠিক করে দেবো।”
— “রুহি, প্লিজ…”
— “তুমি কি মনে করো, তোমার কষ্টের দায়িত্ব আমার?”
আফান তাকিয়ে রইলো,
রুহি এবার সবার দিকে তাকিয়ে বলল,

— “এই ছেলেটা আমাকে ঠকিয়েছে। আমাকে ভালোবাসার অভিনয় করে আমারই সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আমাকে অপমান করেছে। আজ আমি চাই, ওর সেই অপমান আমি ফিরিয়ে দিই।”
রুহির বাবা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন।
— “আফান, তোমার আর এখানে থাকার দরকার নেই। আমাদের মেয়ে নতুন জীবন শুরু করবে, যেখানে তোমার কোনো জায়গা নেই।”
আফান বোঝার চেষ্টা করছিল যে রুহি তার জন্য এতো পাগল ছিলো আজকে যে এতো বদলে গেলো কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছিল না। আফান কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু রুহির মা সাফ জানিয়ে দিলেন,
— “এই মেয়েটা আর পেছনে তাকাবে না, ”
রুহি চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। চারপাশে সবাই নীরব, কিন্তু তার মনের মধ্যে একটার পর একটা কথা মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছিল। আজ সে শেষবারের মতো মুখোমুখি হয়েছে অতীতের সেই ছায়ার, যে তাকে একসময় নিজের বলে মনে হয়েছিল, অথচ শেষমেশ ছিল না।
সে গভীর শ্বাস নিল। তারপর ধীরে ধীরে বলল—

“আমি তো ভেবেছিলাম, তুমি আমাকে সত্যি ভালোবেসেছিলে, আফান। কিন্তু আসলে তুমি শুধু নিজের প্রয়োজনটাই দেখেছো। তুমি সবসময় নিজের আরামের জায়গাটা খুঁজেছো। যখন চেয়েছিলে, আমাকে হাতের মুঠোয় রেখেছো, আর যখন দরকার ফুরিয়েছে, আমাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছো।”
এবারো আফান কিছু বলতে চাইল, কিন্তু রুহি হাত তুলে থামিয়ে দিল।
“আমি কিছুদিন আগে পর্যন্ত ভাবতাম, হয়তো আমারই ভুল ছিল। হয়তো আমি তোমার জন্য যথেষ্ট ছিলাম না। কিন্তু আজ বুঝেছি, তুমি আসলে আমার যোগ্যই ছিলে না। কারণ আমি কখনোই তোমার মতো একজন স্বার্থপর, প্রতারকের পাশে থাকার জন্য তৈরি ছিলাম না।”
রুহির কণ্ঠ দৃঢ়, চোখে আত্মবিশ্বাসের দীপ্তি।

“তুমি জানতে, আমি তোমাকে ছাড়া ভাবতে পারতাম না। আর সেই বিশ্বাসটাই তুমি ভেঙেছো। ভালোবাসা কি এটাই? যেখানে একটা মানুষ নিজের ইচ্ছামতো ভালোবাসে, আবার নিজের ইচ্ছামতো দূরে ঠেলে দেয়? না, আফান, এটা ভালোবাসা না—এটা কেবল তোমার সুবিধাবাদী মানসিকতা।”
রুহি একটু থামল। তারপর একরাশ প্রশান্তি নিয়ে বলল—
“তাই আমি তোমাকে ছেড়ে যাচ্ছি। কারণ আমি চাই না, আমার ভালোবাসা, আমার আত্মসম্মান, আমার অস্তিত্ব তুমি আর একটুও স্পর্শ করো। আমি মুক্ত হতে চাই। আমি চাই, আমার জীবনে এমন একজন থাকুক, যে আমাকে সত্যিকারের ভালোবাসবে, শ্রদ্ধা করবে, আমাকে বোঝার চেষ্টা করবে।”
তারপর সে এক পা এগিয়ে এসে চোখে চোখ রেখে বলল—
“তুমি যা করেছো, তার জন্য তোমাকে আমি কোনোদিন ক্ষমা করব না। কিন্তু আজ থেকে তুমি আমার জীবনে একজন অচেনা মানুষ। বিদায়, আফান। এবার সত্যিই চলে যাও।”
আফান স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এতগুলো কথা শোনার পরও তার কিছু বলার ছিল না। সে বুঝতে পারছিল, আজ রুহি তাকে চিরতরে মুছে দিয়েছে তার জীবন থেকে।

রুহি সবার দিকে তাকিয়ে বললো, মানুষটাকে ভালোবেসেছিলাম সে তার মর্যাদা রাখে নি আমিও তাই আর ফিরে তাকাবো না আপনাদেএ সবাইকে এই সিদ্ধান্তট জানানো জরুরি ছিলো। আমি চাই না আমার মেয়ে এমন কোনো পরিবেশে বড় হোক যেখানে ওর মায়ের একটা ঝাপসা অতীত নিয়ে কেউ কথা বলবে আর সেটা তার শুনতে হবে। ভুল কার ছিলো? কে কি করেছে সবটা আজ আপনাদের সামনেই শেষ করলাম।
কথাটা বলে ধীরে ধীরে পেছন ফিরে হাঁটতে লাগল রুহি। এবার সে সত্যিই মুক্ত। আগামীর পথে, যেখানে কেবল ভালোবাসা আর সম্মানের জায়গা থাকবে—আর কিছু নয়।
রুহির মা বাবা বুঝতে পেরেছে তার মেয়ের মনে এখন আফান নেই হয়তো অন্য কেউ আছে আর সে মানুষটা ডাক্তার ইরাদ।

রাত গভীর, চারপাশ নিস্তব্ধ। কিন্তু ইরাদের মনে যেন ঝড় বইছে।
ব্যালকনির চেয়ারটায় গা এলিয়ে দিয়েছে ও, কিন্তু আরামে বসতে পারছে না। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ— গাঢ় নীল আকাশ, হাজারো তারা— তবুও কেমন যেন ফাঁকা লাগছে।
রুহি…
ও কি সত্যিই ওকে হারিয়ে ফেলেছে? চিরতরে?
একসময় ভেবেছিল, ওহনার পর আর কাউকে জায়গা দেবে না। কিন্তু রুহি— ও কি কখনো বুঝতে পেরেছে, ও কবে থেকে রুহির দিকে অন্যভাবে তাকাতে শুরু করেছে?

আজ, যখন জেনেছে রুহি অন্য কারও হতে চলেছে, তখন বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠছে কেন?
কেন মনে হচ্ছে, রুহি চলে গেলে ওর জীবনের আলো নিভে যাবে?
কিন্তু যদি সেটা সত্যি হয়, তবে কেন এত দেরি হলো বুঝতে?
আজ যখন ওর সামনে সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে, তখন কি লাভ এই স্বীকারোক্তির?
হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল।
স্ক্রিনে ভেসে উঠল একটা নাম— “রুহি”
ইরাদের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। কল ধরবে কি ধরবে না, দ্বিধায় পড়ে গেল।
কিন্তু পরের মুহূর্তেই হাতটা নিজে থেকেই নড়ে উঠল।
“হ্যালো…”

ওপাশ থেকে কিছুক্ষণ কোনো শব্দ নেই।
তারপর…
“ইরাদ…”
শুধু একটা ডাক।
কিন্তু সেই কণ্ঠে যে কষ্ট লুকিয়ে ছিল, সেটা ইরাদের শরীরের রক্ত পর্যন্ত জমিয়ে দিল।
ও কিছু বলল না। শুধু শ্বাস আটকে অপেক্ষা করল।
রুহির কণ্ঠ কাঁপছিল ” আপনি কোথায়? ”
“বাসায়।”

এক চিলতে রদ্দুর পর্ব ১৫

“একটু দেখা করতে পারবেন?”
ইরাদের গলা শুকিয়ে গেল।
ওর দেখা করা উচিত হবে কি? রুহি তো কাল অন্য কারও হয়ে যাবে…
কিন্তু তবু, নিজেকে আটকে রাখতে পারল না।
“আমি আসছি।”

এক চিলতে রদ্দুর শেষ পর্ব